১
এটা ছিল অনিবার্য : কটু কাঠবাদামের গন্ধ তাঁকে সর্বদা প্রতিবাদহীন প্রেমের নিয়তির কথা স্মরণ করিয়ে দিত। তখনো বাড়িটি অন্ধকারাচ্ছন্ন। বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো গন্ধটা পেলেন। একটা জরুরি আহ্বান পেয়ে তিনি এখানে দ্রুত ছুটে আসেন, যদিও এই কেসের জরুরি তাগিদ তার কাছ থেকে অনেক দিন আগেই তিরোহিত হয়েছিল। অ্যান্টিলিয়া থেকে আগত শরণার্থী জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর, প্রবীণ পঙ্গু যুদ্ধ-ফেরতা, শিশুদের আলোকচিত্রশিল্পী এবং দাবায় তার সর্বাপেক্ষা সহানুভূতিশীল প্রতিপক্ষ, সোনালি সায়ানাইডের সুগন্ধি বিষাক্ত ধোঁয়া বুকে টেনে স্মৃতির তাবৎ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করেছেন।
জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর সব সময় তার যুদ্ধকালীন ক্যাম্পখাটে ঘুমাতেন। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো মৃতদেহকে সেখানে একটা কম্বল দিয়ে ঢাকা দেখতে পেলেন। বিষ বাষ্পীভূত করার জন্য জেরেমিয়া ছবি পরিস্ফুটন করার কাজে যে ট্রে ব্যবহার করতেন সেটা তার পাশে ধরা আছে। মেঝের ওপর পড়ে আছে, খাটের একটা পায়ের সঙ্গে বাঁধা, একটা কালো গ্রেটডেন কুকুর, তার তুষার ধবল বুক দেখা যাচ্ছে, আর তার পাশেই পড়ে রয়েছে জেরেমিয়ার ক্রাচ দুটি। একটা জানালা দিয়ে ঊষার ঝলমলে আলো প্রবেশ করে নানা জিনিসে আকীর্ণ ঘরের গুমোট আবহাওয়া সবেমাত্র একটু হালকা করতে শুরু করেছে। এই ঘরটি শয়নকক্ষ ও ল্যাবরেটরি উভয় কাজে ব্যবহৃত হতো। যে আলোটুকু ঘরে এসে পড়েছে তাতেই ডাক্তার উরবিনো তাৎক্ষণিক ভাবে মৃত্যুর নির্ভুল কর্তৃত্ব উপলব্ধি করলেন। ঘরের অন্য জানালাগুলি, আর যেখানে যত ফাঁকাফোকর আছে, সব পুরনো ছেঁড়া কাপড় ও কালো কার্ডবোর্ড দিয়ে আটকানো। এটা ঘরের দুঃসহ গুরুভার আরো বাড়িয়ে তুলেছিলো। একটা তাকে ওপর লেবেল ছাড়া একগাদা বয়াম ও বোতল রক্ষিত আছে। আরো আছে দুটি জীর্ণ ভাঙাচোরা টিনের ট্রে, যার উপরে ঝুলছে সাধারণ একটা আলোর বাল্ব, লাল কাগজে মোড়ানো। তৃতীয় ট্রে-টি, যা রাসায়নিক উপাদানসমূহ দ্রবণের কাজে ব্যবহৃত হতো, মৃতদেহের পাশে ধরা ছিলো। সারা ঘরময় ছড়িয়ে আছে পুরনো সাময়িকী ও খবরের কাগজ, কাচের প্লেটের ওপর নেগেটিভের স্তূপ, ভাঙা আসবাবপত্র, কিন্তু কোথাও কোন ধুলা নেই। সর্বত্রই একটা পরিশ্রমী হাতের ছোঁয়া বোঝা যায়। জানালা দিয়ে বাতাস আসা-যাওয়ায় পরিবেশ কিছুটা পরিশুদ্ধ হলেও যিনি শনাক্ত করতে পারতেন তিনি ঠিকই কটু কাঠবাদামের মধ্যে দুর্ভাগা প্রেমের নিভে আসা জলন্ত ছাই লক্ষ করলেন। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো কোন রকম সচেতন পূর্ববোধজাত ইচ্ছা ছাড়াই প্রায়ই ভাবতেন যে এই পরিবেশে মৃত্যুবরণ করা পবিত্র ত্রাণ লাভের জন্য সুবিধাজনক হবে না। কিন্তু পরে এক সময় তাঁর মনে হয় যে এখানকার পরিবেশের বিশৃঙ্খলা হয়তো ঐশ্বরিক কোনো বিধানের নির্দেশ মেনে চলেছিলো।
ইতিমধ্যে একজন পুলিশ পরিদর্শক এখানে এসে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে খুব তরুণ এক মেডিকেল ছাত্র, পৌরসভার ডিসপেন্সারিতে সে আইন সম্পর্কিত চিকিৎসা বিদ্যার প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ করছিলো। ডাক্তার উরবিনোর জন্য অপেক্ষা করার সময় এরা দুজন ঘরে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা করে, মৃতদেহ ঢেকে দেয়। তারা ডাক্তারকে গম্ভীরভাবে সম্ভাষণ করলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার মধ্যে শ্রদ্ধার চাইতে সমবেদনার ভাবই বেশি প্রকাশ পেল। কারণ জেরেমিয়া সাঁৎ-আমুরের সঙ্গে ডাক্তারের প্রগাঢ় বন্ধত্বের কথা কারো অজানা ছিলো না। প্রখ্যাত শিক্ষক ডাক্তার উরবিনো রোজ তাঁর সাধারণ ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের ক্লাস শুরু করার আগে যেভাবে প্রত্যেক ছাত্রের সঙ্গে করমর্দন করতেন আজও সেভাবেই ওদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করলেন, তারপর, যেন একটি ফুল ধরছেন সেভাবে, তর্জনী ও বৃদ্ধাঙুল দ্বারা কম্বলের একটা প্রান্ত ধরে, ধীরে ধীরে, গির্জার কোন পবিত্র অনুষ্ঠানের মতো মৃতদেহটি অনাবৃত করলেন। জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর শুয়ে আছে, সম্পূর্ণ নগ্ন, শরীর শক্ত ও বাঁকানো, চোখ খোলা, দেহ নীল বর্ণ। গত রাতে তাকে যে রকম দেখাচ্ছিল এখন তার চাইতে পঞ্চাশ বছর বেশি বয়সের দেখাচ্ছে। চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে, দাড়ি আর চুল হলুদাভ, পেটের ওপর পুরনো কাটা দাগ, সেখানে সেলাইর গিঁট উঁচু হয়ে আছে। ক্রাচ ব্যবহারের ফলে বুক আর বাহু ক্রীতদাসদের জাহাজের মাল্লার মতো চওড়া, কিন্তু তার অসহায় পদযুগলকে দেখাচ্ছিল কোন এতিম বালকের পায়ের মতো। ডাক্তার উরবিনো এক মুহূর্ত মনোযোগ সহকারে তাকে দেখলেন। মৃত্যুর বিরুদ্ধে নিজের দীর্ঘ ব্যর্থ সংগ্রামের দিনগুলিতে তার হৃদয় কখনো আজকের মতো এত তীব্র ব্যথা ও বেদনায় মুচড়ে ওঠে নি। তিনি বললেন, বোকা! বোকা একটা! সব চাইতে যা খারাপ হতে পারতো সেটা তো পার হয়ে গিয়েছিল।
তিনি কম্বল দিয়ে মৃতদেহ আবার ঢেকে দিলেন, তারপর তার প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় ফিরে গেলেন। গত বছর, তিন দিনের সরকারি উৎসবের মধ্য দিয়ে, তাঁর ৮০তম জন্মদিন উদযাপিত হয়। ধন্যবাদজ্ঞাপক ভাষণের সময় তিনি আবারও অবসর গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার লোভ সংবরণ করেন। তিনি শুধু বলেন, যখন মরবো তখন বিশ্রাম নেবার প্রচুর সময় পাবো আমি, কিন্তু আপাতত ওরকম কোন কর্মসূচি আমার পরিকল্পনার অংশ নয়। যদিও তিনি তার ডান কানে ক্রমেই কম শুনছিলেন এবং তাঁর ঈষৎ টলমলো পদক্ষেপ লুকাবার জন্য তাঁকে রুপার হাতল বাঁধানো ছড়ির ওপর ঝুঁকে হাঁটতে হতো, তবু এখনো তাঁর পরনে লিনেনের স্যুট, বুকের উপরে সোনার চেইন, যুবা বয়সে যে রকম স্মার্ট ছিলেন এখনো সে রকমই আছেন। পাস্তুরের দাড়ির ঢংয়ে রাখা তার দাড়ির রঙ মুক্তার মতো সাদা, চুলের রঙও একই রকম, চুল পেছন টেনে আঁচড়ানো, মাঝখানে পরিচ্ছন্ন সিঁথি, আর এই সবই ছিল তার চরিত্রের বিশ্বস্ত অভিব্যক্তি। তাঁর স্মৃতির ক্ষেত্রে ক্রমেই ভাটার পরিমাণ বেড়ে চলেছিল, ওই ক্ষতি পূরণের জন্য তিনি টুকরো কাগজে দ্রুত হাতে নোট রাখতেন, যার পরিণতিতে তাঁর বিভিন্ন পকেটে বিভ্রান্তিকর কাগজপত্রের সমাহার ঘটতো, ঠিক তাঁর ডাক্তারি ব্যাগের মতই, যেখানে তিনি গাদাগাদি করে ভরে রাখতেন তাঁর চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, ওষুধের বোতল, আরো নানা জিনিস। তিনি যে শহরের সব চাইতে বয়োবৃদ্ধ এবং সব চাইতে খ্যাতিমান চিকিৎসক ছিলেন তা-ই নয়, তিনি ছিলেন শহরের সব চাইতে খুঁতখুঁতে ব্যক্তিও। তবু, তিনি যে রকম খোলাখুলিভাবে তাঁর জ্ঞানের পরিচয় দিতেন এবং যে রকম সারল্যের সঙ্গে তার শক্তিশালী নামটি কাজে লাগাতেন, সে তুলনায় যতটুকু প্রীতি ভালবাসার যোগ্য তিনি ছিলেন তা তিনি পান নি।
পরিদর্শক এবং প্রশিক্ষণকারী চিকিৎসক দুজনের প্রতিই তাঁর নির্দেশ ছিলো স্পষ্ট এবং দ্রুত। ময়না তদন্তের কোন প্রয়োজন নেই। ট্রে-তে রাখা ফটোগ্রাফিক অ্যাসিড দ্বারা সক্রিয় করা সায়ানাইডের ধোঁয়া যে মৃত্যুর কারণ তার যথেষ্ট প্রমাণই রয়েছে সারা বাড়ির গন্ধের মধ্যে। এ সব বিষয়ে জেরেমিয়ার জ্ঞান এতো বেশি ছিলো যে এটা কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা হতে পারে না। পরিদর্শককে একটু দ্বিধা করতে দেখে ডাক্তার উরবিনো তাঁর সুপরিচিত বিশেষ ভঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ভুলে যাবেন না যে আমিই মৃত্যুর সার্টিফিকেট সই করবো। নবীন ডাক্তারী আশাহত হল : একটি মৃতদেহের ওপর সোনালি সায়ানাইডের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করার সুযোগ সে কখনো পায় নি। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো একটু অবাক হয়ে ভাবছিলেন এই যুবকটিকে তিনি মেডিক্যাল স্কুলে দেখেন নি কেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার সলাজ ভঙ্গি ও অ্যান্ডিয় উচ্চারণ থেকে বুঝতে পারলেন যে যুবকটি অতি সম্প্রতি এ শহরে এসেছে। তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, কিছুদিনের মধ্যেই প্রেমে উন্মাদ হয়ে যাওয়া একজন কেউ তোমাকে নিঃসন্দেহে একটা সুযোগ দেবে। কথাটি বলার পরই কিন্তু তিনি উপলব্ধি করলেন যে যতো অগণিত আত্মহত্যার কথা তার স্মৃতিতে আছে তার মধ্যে ভালবাসার যন্ত্রণা দ্বারা উদ্বোধিত না হয়ে সায়ানাইডের সাহায্যে নিজের প্রাণ হরণ করার মতো একটি ঘটনা এই প্রথম বারের মতো সংঘটিত হলো। এরপর তার কণ্ঠস্বরে একটা পরিবর্তন দেখা দিল।
তিনি তরুণ চিকিৎসককে উদ্দেশ করে বললেন, আর যখন ও রকম একজনকে পাবে তখন মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করো, এমনভাবে বললেন যেন ও তাঁর অধীনস্ত কর্মচারী। মৃতদেহ যেন আজ বিকালেই কবর দেয়া যায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সেই লক্ষ্যে তিনি তাকে সকল প্রকার প্রচলিত আইনি কার্যপ্রণালী পাশ কাটিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। দরকার হলে, তিনি বললেন, আমি গভর্নরের সঙ্গে কথা বলবো। সবাই জানে যে জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর আদিম কঠোরতার সঙ্গে জীবনযাপন করতেন, তার শিল্পকর্মের মাধ্যমে নিজের প্রয়োজনের চাইতে বেশি অর্থ তিনি রোজগার করতেন, তাই এই বাড়ির কোন একটা ড্রয়ারে তার শেষকৃত্যের খরচ যোগাবার মত যথেষ্ট টাকা অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর যদি না পাও তাহলেও কোন অসুবিধা হবে না, আমিই সব কিছুর ব্যবস্থা করবো, বললেন ডাক্তার উরবিনো।
তিনি পরিদর্শককে বললেন, আলোকচিত্রী স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে এ কথা যেন উনি প্রচার মাধ্যমকে জানিয়ে দেন, যদিও তিনি জানতেন যে এ নিয়ে ওদের কারো মনেই কোন কৌতূহলের জন্ম হবে না। পরিদর্শক একজন গম্ভীর প্রকৃতির বিনম্র সিভিল সার্ভেন্ট, তিনি জানতেন যে ডাক্তারের নাগরিক কর্তব্য জ্ঞান এতই প্রবল ছিলো সে জন্য তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুরাও মাঝে মাঝে অধৈর্য হয়ে উঠতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মৃতদেহ দ্রুত সমাধিস্থ করার জন্য যে রকম সহজভাবে তিনি আইনি আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তা তাকে বিস্মিত করলো। শুধু একটা কাজ করতে ডাক্তার উরবিনো রাজি হলেন না। জেরেমিয়াকে পবিত্র ভূমিতে কবর দেবার জন্য তিনি আর্চবিশপকে অনুরোধ করবেন না। পরিদর্শক, নিজেই নিজের ঔদ্ধত্যে অবাক হয়ে, জেরিমিয়ার পক্ষে কিছু বলার চেষ্টা করলেন।
পরিদর্শক বললেন, আমি শুনেছি যে মানুষটা একজন পুণ্যাত্মা ব্যক্তি ছিলেন, একজন সন্ত ছিলেন।
ডাক্তার উরবিনো বললেন, তার চাইতেও বিরল কিছু ছিলেন তিনি, তিনি ছিলেন একজন নাস্তিক সন্ত। কিন্তু এ সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার দায় ঈশ্বরের।
দূরে, ঔপনিবেশিক শহরটির অপর প্রান্ত থেকে, হাই ম্যাস উপাসনায় যোগদানের জন্য ক্যাথিড্রালের ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে এলো। ডাক্তার উরবিনো তার সোনার রিমের অর্ধচন্দ্রাকার চশমা চোখে দিয়ে সোনালি চেইনে আটকানো তার সুদৃশ্য ঘড়ির দিকে তাকালেন, ঘড়ির সুন্দর ডালাটি স্পর্শ করা মাত্র খুলে যেতো। ডাক্তার দেখলেন যে পেন্টেকস্ট ম্যাস-এ তিনি বোধ হয় আজ আর অংশ নিতে পারবেন না। জেরেমিয়ার বসার ঘরে ছিলো একটা বিশাল ক্যামেরা, চাকার ওপর বসানো, পাবলিক পার্কগুলিতে যেমন দেখা যায়, পেছনের পর্দায় সাগর বেলার গোধূলি লগ্নের আভা, ঘরে তৈরি রঙ-এ আঁকা, আর দেয়াল জুড়ে ছোটদের স্মরণীয় মুহূর্তের নানা ছবি : গির্জায় প্রথম ধর্মীয় অনুষ্ঠান, খরগোশের আকারের পোশাক, শুভ জন্মদিন। বছরের পর বছর, অপরাহ্ণে দাবা খেলতে খেলতে একটু থেমে চিন্তা করার ফাঁকে ফাঁকে, ডাক্তার উরবিনো লক্ষ করেছেন কিভাবে ঘরের গোটা দেয়াল ওই সব ছবিতে ছেয়ে যাচ্ছে, প্রায়ই গভীর বেদনার সঙ্গে শিউরে উঠে তিনি ভেবেছেন যে এই সব সাধারণ খাপছাড়া পোর্ট্রেটগুলির মধ্যেই নিহিত এই শহরের ভবিষ্যৎ বীজ, এই অজ্ঞাত শিশুরাই এ শহরকে দুঃশাসন ও দুর্নীতিতে ভরে দেবে, যেখানে তার গৌরবের ভস্মও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেরাজের ওপর একটা পাত্রে তামাক খাবার কয়েকটা পাইপের পাশে দেখা গেল একটা দাবার বোর্ড, খেলাটা শেষ হয় নি। ডাক্তার উরবিনোর তাড়া ছিলো, মনও ছিলো বিষণ্ন, তবু দাবার ছকটি ও ঘুঁটিগুলি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করার লোভ তিনি সামলাতে পারলেন না। তিনি জানতেন যে এটা ছিলো গত রাতের খেলা। জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর সপ্তাহের প্রতি সন্ধ্যায় অন্তত তিনজন পৃথক পৃথক প্রতিপক্ষ দাবাড়ু সঙ্গে খেলতেন, আর প্রতিটি খেলাই তিনি শেষ করতেন এবং শেষে দাবার বোর্ড এবং ঘুঁটিগুলি বাক্সে তুলে বাক্সটি দেরাজের একটি ড্রয়ারে রেখে দিতেন। ডাক্তারের জানা ছিলো যে তিনি খেলতেন সাদা ঘুঁটি দিয়ে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে আর চার চালের মাথায় তাঁর নির্দয় পরাজয় ছিলো অবশ্যম্ভাবী। উরবিনো আপন মনে বললেন, কোন অপরাধ ঘটে থাকলে এখানে ভালো একটা সূত্র ছিলো। আমি মাত্র একজন লোকের কথা জানি যে এ রকম সুনিপুণ একটা ফাঁদ পাততে পারে। নিজের জীবন দিয়ে হলেও ডাক্তার উরবিনোকে পরবর্তী সময়ে আবিষ্কার করতেই হবে কেন জেরেমিয়ার মতো একজন দুর্জয় যোদ্ধা, শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যিনি লড়তে অভ্যস্ত ছিলেন, কেন তিনি তার জীবনের শেষ লড়াইটা অসমাপ্ত রেখে দিয়েছিলেন।
রাতের পাহারাদার সেদিন শেষবারের মতো ঘুরে যাবার সময় সকাল ছটায় ওর বাড়ির দরোজায় লাগানো একটা চিরকুট দেখতে পায়। সে ঠিক করল, টোকা না দিয়ে ঢুকবে, তারপর পুলিশকে খবর দেবে। একটু পরেই পরিদর্শক এবং তরুণ প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক এখানে আসেন। কটু কাঠবাদামের নির্ভুল গন্ধকে বাতিল করে অন্য কোন একটা সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য ওরা দুজন সারা বাড়ি খুঁজে দেখেছিল। ডাক্তার এখন অসমাপ্ত দাবার খেলা পর্যবেক্ষণ করার জন্য যে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন তার মধ্যে পরিদর্শক দেরাজের ওপর রাখা কাগজপত্রের মধ্যে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে সম্বোধন করা একটা চিঠি আবিষ্কার করল। চিঠিটা গালা মোম দিয়ে এমন শক্তভাবে আটকানো ছিলো যে তাকে ছিন্নভিন্ন না করে চিঠির কাগজগুলি বের করা গেল না। আরেকটু আলোর জন্য ডাক্তার জানালার কালো পর্দা টেনে এক পাশে সরিয়ে দিলেন। এগারো পাতার চিঠি, দু’পৃষ্ঠাতে সযত্ন হাতের লেখা। প্রথম অনুচ্ছেদে দ্রুত চোখ বুলিয়েই ডাক্তার বুঝলেন যে আজ আর তার গির্জায় পেন্টেকস্ট অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া হবে না। তিনি চিঠিটা পড়তে লাগলেন, তাঁর নিঃশ্বাস দ্রুত হল, একটা উদ্বেগ ও উত্তেজনা দেখা দিল তাঁর মধ্যে, হারিয়ে ফেলা সূত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি কয়েক পাতা উল্টে আবার পেছনে ফিরে গেলেন। যখন শেষ করলেন তখন মনে হল তিনি যেন অনেক দূর থেকে, দীর্ঘকাল আগের একটা সময় থেকে, ফিরে এসেছেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর বিমর্ষতা প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। তাঁর ঠোঁট মৃতদেহের ঠোঁটের মতই নীলাভ দেখাচ্ছিল। চিঠিটা ভাঁজ করে কোটের পকেটে রাখার সময় তিনি তাঁর আঙুলের কাঁপুনি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলেন। তখন তাঁর মনে পড়লো পরিদর্শক ও তরুণ চিকিৎসকের কথা। বেদনার কুয়াশার মধ্য দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, বিশেষ কিছু না, ওর শেষ নির্দেশাবলী
কথাটা ছিলো অর্ধসত্য, কিন্তু ওরা তাকে পুরোপুরি বলেই ধরে নিল, কারণ ডাক্তারের নির্দেশে মেঝের একটা টালি সরাতেই তারা সেখানে একটা জীর্ণ হিসাবের খাতা পেল, সেখানে সিন্দুকের কম্বিনেশন লেখা ছিলো। যতটা প্রত্যাশা করেছিলো ততটা অর্থ তারা পেলো না বটে, তবে যা পাওয়া গেলো তা দিয়ে শেষকৃত্যের খরচপত্র ও অন্যান্য দায়দায়িত্ব মিটিয়েও বেশ কিছু বেঁচে যাবে। এই সময় ডাক্তার উরবিনো উপলব্ধি করলেন যে যে গসপেল পাঠের আগে আজ আর তিনি ক্যাথিড্রালে পৌঁছতে পারবেন না।
তিনি বললেন, জ্ঞানবুদ্ধি হবার পর এই তৃতীয় বারের মতো আমি রবিবারের প্রার্থনায় অনুপস্থিত থাকলাম। তবে ঈশ্বর বুঝবেন!
তাই তিনি এখানে আরো কয়েক মিনিট কাটাতে মনস্থ করলেন এবং করণীয় সব খুঁটিনাটি বিষয়ে নির্দেশ দিলেন, যদিও জেরেমিয়ার চিঠির গোপন কথাগুলো স্ত্রীর সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার অধীর আগ্রহ তিনি কিছুতেই সংবরণ করতে পারছিলেন না। তিনি কথা দিলেন যে শহরের প্রচুরসংখ্যক ক্যারিবীয় শরণার্থীদের তিনি খবর দেবেন, ইচ্ছা করলে তারা যেন জেরেমিয়ার উদ্দেশে তাদের শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারে, যে- জেরেমিয়া নিজেকে তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত বিবেচনা করতেন। তার আচার- আচরণের মধ্য দিয়ে সেটা সর্বদাই প্রকাশিত হত। তিনিই ছিলেন তাদের মধ্যে সবচাইতে সকর্মক, সবচাইতে প্রগতিবাদী ও আমূল সংস্কারে বিশ্বাসী, স্বপ্ন ও আশাভঙ্গের দুর্বহ ভারে তিনি যে বিধ্বস্ত এটা বোঝা যাবার পরও তিনি ছিলেন তাই। ডাক্তার ওর দাবা খেলার সঙ্গীদেরও খবরটা দেবেন, তাদের মধ্যে ছিল বিখ্যাত পেশাদার দাবাড়ু, অজ্ঞাতকুলশীল শ্রমিক এবং অন্যান্য লোকজন, কম অন্তরঙ্গ পরিচিতজনদেরও তিনি খবর দেবেন, তারাও হয়তো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকতে চাইবে। মরণোত্তর চিঠিটা পড়ার আগে তিনি ঠিক করেছিলেন যে ওই অনুষ্ঠানে যোগদানকারীদের মধ্যে তিনিই হবেন সর্বপ্রথম কিন্তু পরে এ বিষয়ে তিনি আর নিশ্চিত হতে পারলেন না। যাই হোক, জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর হয়তো শেষ মুহূর্তে অনুতাপ করে ত্রাণ লাভের জন্য প্রার্থনা করেছে এ কথা মনে করে তিনি তার শেষকৃতানুষ্ঠানে গার্ডেনিয়া ফুলের একটি মালা পাঠাবেন। মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হবে পাঁচটায়, গ্রীষ্মের এই সর্বাধিক গরমের মাসগুলিতে সেটাই ছিল সব চাইতে উপযুক্ত সময়। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে দুপুরের পর থেকে তাঁকে পাওয়া যাবে তাঁর প্রিয় শিষ্য ডাক্তার ল্যাসিডে অলিভেল্লার গ্রামের বাড়িতে। চিকিৎসা পেশায় তার রজত-জয়ন্তি উদযাপন উপলক্ষে সে আজ একটা আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করেছে।
প্রথম দিকের সংগ্রামমুখর বিক্ষুব্ধ বছরগুলি একবার অতিক্রম করার পর ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো একটা সুনির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করে তাঁর জীবন পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি এমন একটা শ্রদ্ধা ও মর্যাদার স্থান অর্জন করেন যার সমকক্ষ সমগ্র প্রদেশে আর কেউ ছিল না। তিনি ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শয্যা ছেড়ে উঠতেন, তারপর তাঁর গোপন ওষুধগুলি খেতে শুরু করতেন : চিত্তকে চাঙা করার জন্য পটাসিয়াম ব্রোমাইড, বর্ষার সময় হাড়ের ব্যথার জন্য স্যালিগাইলেটস, মাথা ঘোরার জন্য এরগোস্টেরল, ভালো ঘুমের জন্য বেলাডোনা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তিনি একটা না একটা কিছু খেতেন, সব সময়ই লুকিয়ে, কারণ ডাক্তার ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর দীর্ঘ জীবনে তিনি বার্ধক্যের রোগবেদনা উপশমের জন্য কোন রকম ওষুধ দেবার বিরোধী ছিলেন। নিজের ব্যথা-বেদনার চাইতে অন্যের ব্যথা বেদনা সহ্য করা ছিল তার পক্ষে সহজতর। তিনি তাঁর পকেটে সব সময় কর্পূরের একটা ছোট্ট পুঁটলি রাখতেন এবং সবার অলক্ষ্যে সেটা বের করে মাঝে মাঝে গভীর ভাবে তার ঘ্রাণ নিতেন। এতোগুলি ওষুধ এক সঙ্গে খাচ্ছেন তার ভয় প্রশমন করার জন্যই তিনি কর্পূর শুঁকতেন।
প্রতিদিন সকাল আটটায়, সোমবার থেকে শনিবার, তিনি মেডিক্যাল স্কুলে ক্লিনিকাল মেডিসিনের যে ক্লাশ নিতেন তার প্রস্তুতির জন্য তাঁর পড়ার ঘরে নিয়মিত এক ঘণ্টা কাটাতেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই ক্লাস নিয়েছেন। নতুন বইপত্রেরও তিনি ছিলেন একজন পরম উৎসাহী ও উন্মুখ পাঠক। তাঁর পারীর বই বিক্রেতা তাঁকে ডাকযোগে বই পাঠাতো। স্থানীয় বই-এর দোকানি তাঁর জন্য বার্সিলোনাতেও অর্ডার দিতো, সেখান থেকেও বই আসতো, যদিও ফরাসি সাহিত্যের মতো অতো নিবিড়ভাবে তিনি স্প্যানিশ সাহিত্য পড়তে পারতেন না। যাই হোক, এ সব বই তিনি কখনোই সকালে পড়তেন না। তিনি এগুলি পড়তেন তার দিবানিদ্রার পর, এক ঘণ্টার জন্য, আর রাতে ঘুমাতে যাবার আগে। পড়ার ঘরে পড়াশোনার কাজ শেষ করে তিনি বাথরুমে খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পনেরো মিনিট শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতেন, যে ধারে মোরগগুলি কক কক করে ডাকতে থাকে সব সময় সেই দিকে মুখ করে, কারণ ওখানেই বাতাস থাকতো সব চাইতে তাজা ও নির্মল। তারপর তিনি স্নান করতেন, দাড়ির চর্চা করতেন, গোঁফে মোম লাগাতেন, আর এই সবই হত ফারিনা গেজেন্যুবার থেকে আনা খাঁটি সুগন্ধি কোলোনের পরিমণ্ডলে। তারপর তিনি গায়ে চড়াতেন তাঁর সাদা লিনেনের পোশাক, কোটসহ, মাথায় নরম হ্যাট ও পায়ে কর্ডোভার বুট। ভয়াবহ কলেরা মহামারীর অল্পকাল পরে পারী থেকে ফিরে এসে তিনি যে রকম প্রশান্ত অথচ আনন্দোচ্ছল ভাবে চলাফেরা করতেন আজ একাশি বছর পরেও তিনি তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন, শুধু তার মাথার চুল ধাতব রঙ ধারণ করেছে, তবে তিনি তাঁর চুল এখনো যৌবনের দিনগুলির মতোই মাঝখানে সিঁথি করে সযত্নে আঁচড়াতেন। তিনি সকালের নাশতা করতেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে, একসঙ্গে, তবে নিজের স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়মানুযায়ী তাঁর বিশেষ খাবার গ্রহণ করতে কখনো ভুলতেন না, তিক্তস্বাদ একটা গুল্মের ফুল, পেটের জন্য, নিজের হাতে খোসা ছাড়িয়ে এক কোয়া রসুন আর একটা লবঙ্গ, রুটির সঙ্গে চিবিয়ে চিবিয়ে, যত্নের সঙ্গে, হৃদরোগের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। ক্লাসের শেষে প্রায় সব সময়ই তাঁর বিভিন্ন নাগরিক উদ্যোগ কিংবা ক্যাথলিক ধর্মীয় কোন কাজ অথবা শিল্পকলা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কারো না কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ-সূচি থাকতই।
প্রায় সব সময়ই তিনি দুপুরের খাবার খেতেন বাড়িতে, তারপর বাড়িসংলগ্ন বাঁধানো স্থানটির চত্বরে দশ মিনিটের জন্য দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা যেতেন, ঘুমের মধ্যে তিনি শুনতেন আম গাছগুলির পত্রপল্লবের নিচ থেকে ভেসে আসা কাজের মেয়েদের গানের কলি, রাস্তা থেকে ভেসে আসা ফেরিঅলাদের ডাক, আর উপসাগর থেকে ভেসে আসা সারা বাড়ির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া তেল আর ইঞ্জিনের গন্ধ ও শব্দ, যেন কোন দেবদূত শাপগ্রস্ত হয়ে গলে পচে যাচ্ছে। এরপর তিনি এক ঘণ্টা তাঁর নতুন বইগুলি পড়তেন, বিশেষ করে উপন্যাস ও ইতিহাসের বই, আর এরপর তিনি তাঁর পোষা তোতা পাখিটিকে শেখাতেন ফরাসি ভাষা আর গান। কয়েক বছর ধরে এই তোতা স্থানীয় একটি প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছিল। চারটার সময় বড় এক গ্লাস বরফ দেয়া লেমোনেড পান করে তিনি বেরিয়ে পড়তেন তাঁর রোগীদের দেখতে। বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনো তাঁর দফতরে রোগী দেখতেন না। চিরকাল যেমন করেছেন এখনও তেমনি তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের চিকিৎসা করতেন, আর শহরটা এমন পোষমানা ঘরোয়া পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে এখন এর সর্বত্রই একজন মানুষ নিরাপদে যাওয়া আসা করতে পারতো।
ইউরোপ থেকে প্রথম বার ফেরার পর তিনি সোনালি রঙের ঘোড়া টানা পারিবারিক ল্যান্ডো গাড়িটি ব্যবহার করেন, কিন্তু যখন তা আর ব্যবহারোপযোগী থাকলো না তখন তিনি ওটা বদলে নিলেন এক ঘোড়া টানা একটা ভিক্টোরিয়া। তারপর যখন ঘোড়ার গাড়ি পৃথিবী থেকেই অপসৃত হতে শুরু করে, এই শহরেও যখন তাদের ব্যবহার দেখা যেতো শুধু পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখানো আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় ফুল বহন করার ক্ষেত্রে, তখনো তিনি ফ্যাশনের প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে তাঁর ভিক্টোরিয়া ঘোড়ার গাড়িটিই ব্যবহার করতেন। আর অবসর গ্রহণ করতে রাজি না হলেও তিনি ঠিকই বুঝতেন যে এখন শুধু আশাহীন ও হাল ছেড়ে দেয়া রোগীর চিকিৎসা করতেই তাঁকে ডাকা হয়, কিন্তু তিনি এটাকে এক ধরনের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বলে মনে করতেন। রোগীকে এক নজর দেখেই তিনি বলে দিতে পারতেন তার রোগটা কি এবং কোথায়। তিনি ক্রমেই পেটেন্ট ওষুধ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন, আর শল্য চিকিৎসার স্থূলতা তাঁকে ক্রমেই বিচলিত করতে থাকে। তিনি বলতেন, ডাক্তারের ছুরি হচ্ছে ওষুধ ও ভেষজ বিদ্যার ব্যর্থতার সব চাইতে বড় প্রমাণ। তিনি মনে করতেন যে, খুব যথার্থ অর্থে, সকল ওষুধই আসলে বিষ, আর আমদের খাদ্যদ্রব্যের সত্তর শতাংশই মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। তিনি তাঁর ক্লাসে বলতেন, সে যাই হোক, ওষুধ-বিষুধের সামান্য যেটুকু আমরা জানি, তা শুধু কয়েকজন স্বল্পসংখ্যক ডাক্তারের জ্ঞান। তারুণ্যের উৎসাহ-উদ্দীপনা থেকে তিনি এখন এমন একটা অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন যাকে তিনি আখ্যায়িত করতেন নিয়তিবাদী মানবতাবাদ : প্রতিটি ব্যক্তিই তার নিজের প্রভু এবং আমরা যা করতে পারি তা হল সময় উপস্থিত হলে মানুষকে যন্ত্রণার ভয়মুক্ত করে মৃত্যুবরণ করতে সাহায্য করা। তাঁর এই সব চরম ধারণাগুলি সত্ত্বেও কিন্তু তাঁর প্রাক্তন ছাত্ররা, নিজেরা তাদের পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরও, নিয়মিত ভাবে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতো, কারণ তারা তাঁর মধ্যে আবিষ্কার করেছিল, যাকে তখনকার দিনে বলা হত, একটি ক্লিনিক্যাল চক্ষু। সে যাই হোক, তিনি সর্বদাই ছিলেন একজন ব্যয়বহুল ও অনন্য চিকিৎসক। তাঁর বেশিরভাগ রোগীই ছিল ভাইসরয়দের জেলার প্রাচীন পরিবারগুলিতে কেন্দ্ৰীভূত।
তাঁর দৈনন্দিন কর্মসূচি এতটাই নিয়মানুগ ছিল যে বিকালের দিকে কোন আকস্মিক প্রয়োজন ঘটলে তাকে কোথায় খবর পাঠাতে হবে তা তাঁর স্ত্রী নির্ভুল ভাবে জানতেন। তাঁর যৌবনকালে বাড়িতে ফেরার আগে তিনি প্যারিস ক্যাফেতে কিছুটা সময় কাটাতেন। সেখানে তাঁর শ্বশুরের ঘনিষ্ঠ সহচরবৃন্দ ও কয়েকজন ক্যারিবীয় শরণার্থীর সঙ্গে খেলার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর দাবা খেলাকে নিখুঁত করে তোলেন। কিন্তু নতুন শতাব্দি শুরু হবার পর তিনি আর প্যারিস ক্যাফেতে ফিরে যান নি। তিনি এই সময় সোশ্যাল ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় দাবা টুর্নামেন্ট সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। এ সময়েই জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর এখানে এসে উপস্থিত হন, তাঁর হাঁটু তখনই অক্ষম ও মৃত, তিনি তখনো শিশুদের আলোকচিত্রশিল্পী হন নি, তবু তাঁর আবির্ভাবের তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে যে লোকটি দাবার বোর্ডে ঘোড়ার একটা মাত্র চাল দিতে জানতো সে-ও জেনে ফেলেছিল জেরেমিয়াকে, কারণ তাকে একটি খেলাতেও কেউ হারাতে পারে নি। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর জন্য তাদের দুজনের সাক্ষাৎ ছিল একটা অলৌকিক ঘটনা, কারণ ঠিক ওই সময়ে, যখন দাবা তাঁর জন্য এক অদম্য নেশা হয়ে উঠেছিল, তখন সে নেশাকে তৃপ্ত করার মতো খুব বেশি প্রতিপক্ষ তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
তাঁর জন্যই জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর আমাদের মধ্যে যা হয়ে উঠেছিলেন তা হতে পেরেছিলেন। ডাক্তার উরবিনো ছিলেন তাঁর নিঃশর্ত রক্ষাকর্তা, সব কিছুতেই তাঁর জামিনদার, জেরেমিয়া কে ছিল, কি করেছে, কোন অগৌরবের যুদ্ধবিগ্রহে সে তার পা হারায় এবং সর্বস্বান্ত হয়, এ সব বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নেন নি। অবশেষে একটা আলোকচিত্র স্টুডিও করার জন্য তিনি তাকে প্রয়োজনীয় অর্থ ধার দেন, আর যে দিন জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর ম্যাগনেসিয়াম ফ্ল্যাশ দিয়ে একটি শিশুর প্রথম ছবি তুললো তারপর থেকে সে নিয়মিত ভাবে ডাক্তারের দেনা শোধ করে এসেছে, শেষ পাই-পয়সা পর্যন্ত।
এই সব কিছুর মূলে ছিল দাবা। প্রথমে তাঁরা নৈশ আহারের পর সাতটার সময় খেলতে বসতেন। তাঁর সর্বজনবিদিত শ্রেষ্ঠত্বের জন্য গোড়ার দিকে জেরেমিয়াকে একটা যুক্তিসঙ্গত হ্যান্ডিক্যাপ দেয়া হতো, পরে ঐ হ্যান্ডিক্যাপ কমতে কমতে এক সময় ওরা দুজন সম-অবস্থান থেকে খেলতে শুরু করেন। পরে ডন গ্যালিলিও দাকোঁত যখন এখানে তাঁর প্রথম বহিরাঙ্গন সিনেমা প্রদর্শন শুরু করলেন তখন জেরেমিয়া হলেন তাঁর সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য খদ্দের এবং তখন থেকে যে সব রাতে নতুন কোন ফিল্ম দেখানো হত না সে সব রাতের মধ্যে তাঁদের দাবা খেলা সীমিত হয়ে পড়ে। ততদিনে ডাক্তার ও জেরেমিয়া ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন এবং উভয়ে এক সঙ্গে ছায়াছবি দেখতে যেতেন, তবে ডাক্তারের স্ত্রী কখনই ওদের সঙ্গী হতেন না, অংশত এই কারণে যে কাহিনীর জটিল গতিধারা অনুসরণ করার মতো ধৈর্য তার ছিল না, আর অংশত এই কারণে যে তার মনে হয়েছিল, নিছক সহজাত অনুভূতির মাধ্যমে, যে জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর কখনই কারো জন্য একজন সঙ্গী হতে পারবেন না।
ডাক্তারের রবিবারগুলি ছিল ভিন্ন রকমের। তিনি হাই ম্যাস-এ যোগ দেবার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও চত্বরে বসে বই পড়ার জন্য নিজের বাড়ি ফিরে আসতেন। পুণ্য দিবসে তিনি কদাচিৎ কোথাও রোগী দেখতে যেতেন, বিশেষ জরুরি কেসের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম করতেন, আর বহু বছর ধরে এ সব দিনে, বাধ্যতামূলক না হলে, তিনি কোন সামাজিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন না। এবারকার পেন্টেকস্টে একটা আকস্মিক যোগাযোগ ঘটে গেল। একই দিনে দুটি অসাধারণ ঘটনা ঘটলো : এক বন্ধুর মৃত্যু এবং এক প্রখ্যাত ছাত্রের রজতজয়ন্তি। তবু, জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ- আমুরের মৃত্যুর সার্টিফিকেটে সই করার পরই সোজা বাড়ি ফিরে যাবার কথা মনে মনে ভাবলেও তিনি তা করলেন না, বাড়ি ফিরে না গিয়ে তিনি তাঁর কৌতূহলের হাতে নিজেকে সমর্পণ করলেন।
গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার মরণোত্তর চিঠিটা খুলে দেখলেন, তারপর গাড়োয়ানকে পুরনো ক্রীতদাস এলাকার এক অখ্যাত ঠিকানায় তাঁকে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। এটা তাঁর স্বাভাবিক অভ্যাসের এতই পরিপন্থী ছিল যে চালক নিশ্চিত হতে চাইলো, তাঁর প্রভুর কোন ভুল হয়নি তো? না, ভুল হয়নি : ঠিকানাটা সুস্পষ্ট, আর যিনি লিখে দিয়েছেন তিনি যে এটা ভাল ভাবে জানতেন তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। ডাক্তার উরবিনো আবার চিঠির প্রথম পাতায় ফিরে গেলেন এবং যে সব অরুচিকর ঘটনাবলী সেখানে উদ্ঘটিত হয়েছে তার মধ্যে ডুবে গেলেন। তিনি যদি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারতেন যে এসব একজন মৃত্যুপথযাত্রীর প্রলাপোক্তি নয় তা হলে, তাঁর এই বয়সেও, এ ঘটনাগুলি তাঁর জীবনকে পাল্টে দিতে পারতো। আজ খুব সকাল থেকে দিনটা অশুভ সঙ্কেত দিতে শুরু করেছিল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। তবু দুপুরের আগে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা নেই। একটা ছোট দ্রুততর পথে যাবার প্রয়াসে তাঁর চালক ঔপনিবেশিক শহরটির অমসৃণ খোয়া বাঁধানো রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এই সময় গির্জায় অনুষ্ঠিত পেন্টেকস্ট প্রার্থনা পর্ব শেষ করে ধর্মীয় সমিতিগুলির উচ্ছৃঙ্খল সদস্যবৃন্দ হইচই করতে করতে রাস্তা দিয়ে ফিরে আসছিল। পাছে ঘোড়া ভয় পায় সে জন্য কোচোয়ান প্রায়ই গাড়ি থামিয়ে রাখছিল। সমস্ত রাস্তায় পড়ে ছিল কাগজের মালা, ফুল, বহু মানুষ গানবাজনা করছিল, রঙিন ছাতা মাথায় আর মসলিনের চুনট দেয়া জামা পরে মেয়েরা ঝুলবারান্দায় দাড়িয়ে উৎসব দেখছিল। ক্যাথিড্রালের প্লাজায় মুক্তিদাতার যে স্ট্যাচুটি দাঁড়িয়েছিল সেটা আফ্রিকান তাল গাছ আর সড়কের নতুন আলোর গোলকগুলি দ্বারা প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে উপাসনা শেষ হয়ে যাওয়ার রাস্তায় এখন যানজট লেগে গেছে। হইচই ভরা প্যারিস ক্যাফেতে একটি আসনও খালি নেই। ঘোড়া টানা একটা মাত্র গাড়িই রাস্তায় দেখা গেল। ডাক্তার উরবিনোর। শহরে সামান্য যে কয়েকটি ঘোড়া গাড়ি ছিল তার মধ্যে ডাক্তারের গাড়িটি সহজেই চোখে পড়তো। সর্বদা চকচকে পালিশ করা তার ছাদ ছিল পেন্টেট চামড়ার, ফিটিংগুলি ছিল ব্রোঞ্জের যেন নোনায় ক্ষয়ে না যায়, চাকা আর দণ্ডগুলি ছিল লাল রঙ দিয়ে গিল্টি করা, ভিয়েনা অপেরার উৎসব রজনীর মতো মনে হত ব্যাপারটা। এর ওপর অধিকাংশ পরিবার যেখানে তাদের কোচোয়ানকে একটা পরিষ্কার জামা পরিহিত দেখলেই খুশি হত সেখানে ডাক্তার উরবিনোর কোচোয়ানকে অবধারিত ভাবে পরতে হত রঙচটে যাওয়া মখমলের একটা ইউনিফর্ম আর মাথায় চড়াতে হত সার্কাসের রিংমাস্টারের টুপির মতো একটা উঁচু লম্বা টুপি। এটা যে শুধু কালের সঙ্গে চরম অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল তাই নয়, এটাকে দেখা হত অবক্ষয় আক্রান্ত ক্যারিবীয় গ্রীষ্মের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতির অভাব রূপেও।
এ শহরকে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো পাগলের মতো ভালবাসতেন। এ শহর সম্পর্কে তাঁর চাইতে বেশি আর কেউ জানতো না। তবু শহরটির পুরনো দাস এলাকায় এই রকম বেপরোয়া ভাবে ঢুকে পড়ার প্রয়োজন তাঁর জীবনে খুব বেশি দেখা দেয় নি। আজকের এই রবিবার ছিল ভীষণ ভাবে ব্যতিক্রমী। কোচোয়ানকে অনেক মোড় ঘুরতে হল, বাড়িটি খুঁজে পাবার জন্য কয়েকবারই গাড়ি থামিয়ে লোকজনের কাছ থেকে পথনির্দেশ নিতে হল। জলাভূমির পাশ দিয়ে যাবার সময় ডাক্তার উরবিনো তার পীড়াদায়ক গুরুভার, তার অলুক্ষণে নৈঃশব্দ, তার শ্বাসরুদ্ধকারী গ্যাসের প্রভাব টের পেলেন। অনেক নিদ্রাহীন নিশি জাগরণের পর সকাল বেলা বিছানা ছেড়ে উঠে তিনি এ সব বহুবার টের পেয়েছেন, এ সবের সঙ্গে মিশে থাকতো তাঁর বাড়ির উঠান থেকে ভেসে আসা জুঁই-চামেলির গন্ধ, তাঁর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই বাতাসকে তাঁর মনে। যেন বিগত দিনের কোন বাতাস, যার সঙ্গে তাঁর জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আজ তাঁর গাড়ি যখন নোংরা জঞ্জালভরা রাস্তা দিয়ে দু’পাশে টলতে টলতে অগ্রসর হচ্ছিল তখন ওই মহামারীর মতো ব্যাপারটা, যাকে তিনি প্রায়ই তাঁর মধুর অতীত স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমে আদর্শায়িত করে নিয়েছিলেন, একটা অসহনীয় বাস্তবতা হয়ে তাঁর কাছে ধরা দিল। অপসৃয়মান ভাটার জলের সঙ্গে কসাইখানা থেকে রাস্তার ওপর এসে পড়ছিল জবাই করা পশুর অব্যবহার্য অংশগুলি, আর শকুনের দল তা নিয়ে খাবলাখাবলি করছে। ভাইসরয়-নগরীর বাড়িঘর ছিল ইট-পাথরের তৈরি কিন্তু এখানে তা তৈরি হয়েছে পাতলা তক্তা আর দস্তার ছাদ দিয়ে, আর বেশিরভাগ বাড়িঘর তোলা হয়েছে পাইলিং-এর উপরে, যেন স্পেনীয়দের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত খোলা নালা-নর্দমাগুলির উপচেপড়া জলস্রোত থেকে তারা রক্ষা পায়। সব কিছুই দেখাচ্ছিল বিধ্বস্ত, হতশ্রী, কিন্তু নোংরা পানশালাগুলি থেকে ভেসে আসছিলো হুলুড়ে গান-বাজনার বজ্রনিনাদ, দরিদ্র জনগোষ্ঠী কর্তৃক পেন্টেকস্টের এক ঈশ্বরবর্জিত মত্ত উৎসব উদযাপনের প্রকাশ। যখন তারা অন্বিষ্ট বাড়িটি খুঁজে পেল তখন দেখা গেল যে জীর্ণ ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় পরা একদঙ্গল ছেলেমেয়ে গাড়ির পেছন পেছন ছুটছে, কোচোয়ানের যাত্রার দলের মতো বর্ণাঢ্য পোশাক দেখে তাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে, আর কোচোয়ান ওদের তাড়িয়ে দেবার জন্য তার চাবুক হাঁকড়াচ্ছে। একটা গোপন সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত ডাক্তার উরবিনো বড় বেশি দেরিতে উপলব্ধি করলেন যে বার্ধক্যের সরলতার মতো এতো বিপজ্জনক সরলতা আর কিছু নেই।
নম্বরবিহীন বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখে তার চাইতে কম সৌভাগ্যবান প্রতিবেশীগুলির কাছ থেকে তাকে আলাদা করে চেনার কোন উপায় ছিল না। শুধু দুটি জিনিস ছাড়া। এ বাড়ির জানালায় ছিল লেসের পর্দা, আর এর সামনের দরজাটা ছিল জমকালো, কোন প্রাচীন গির্জা থেকে সংগৃহীত। কোচোয়ান সজোরে দরজার কড়া নাড়লো এবং তারা যে ঠিক বাড়িতেই এসেছে এটা নিশ্চিত করার পরই সে ডাক্তার উরবিনোকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করলো। নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরের ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় এক পূর্ণ বিকশিত রমণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল, কালো পোশাক পরিহিতা, কানের পাশে একটা লাল গোলাপ গোঁজা। বয়স চল্লিসের কম নয়; কিন্তু ওই বয়সেও সে এক অহঙ্কারী বর্ণসঙ্কর মেয়ে, নিষ্ঠুর সোনালি চোখ, চুল করোটির সঙ্গে আঁট করে বাঁধা যেন ইস্পাতের উলের একটা শিরস্ত্রাণ। ডাক্তার উরবিনো তাকে চিনতে পারলেন না, যদিও আলোকচিত্র স্টুডিওর আলো-আঁধারের মধ্যে দাবা খেলার সময় তিনি তাকে কয়েকবারই দেখেছিলেন, পালা জ্বরের জন্য একবার একটা চিকিৎসাপত্রও লিখে দিয়েছিলেন তাকে। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন, সে তার দু’হাতের মধ্যে ওই হাত গ্রহণ করলো, সাদর সম্ভাষণের জন্য ততটা নয় যতটা তাকে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সাহায্য করার জন্য। বসার ঘরটির পরিবেশ ছিল অরণ্যের কোন ফাঁকা জায়গার মতো, অদৃশ্য গুঞ্জনে পূর্ণ, আসবাবপত্র ও অপূর্ব সুন্দর দ্রবসামগ্রীতে ঠাসা, কিন্তু প্রতিটি জিনিস তার স্বাভাবিক জায়গায় স্থাপিত। কোন রকম তিক্ততা ছাড়াই ডাক্তার উরবিনোর মনে পড়লো এক প্রাচীন দ্রব্যসম্ভার বিক্রেতার দোকানের কথা, পারীর মোমার্তের ২৬ নম্বর বাড়ি, গত শতাব্দিতে শরতের এক সোমবার তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। মহিলা তার মুখোমুখি বসে একটা বিশেষ ঝোঁক দেয়া স্প্যানিশে তাঁকে উদ্দেশ করে বললো, এটা আপনার বাড়ি, ডাক্তার, তবে আপনাকে আমি এতো তাড়াতাড়ি প্রত্যাশা করিনি।
ডাক্তার উরবিনোর মনে হলো কেউ যেন তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি মহিলার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন, লক্ষ করলেন তার সুগভীর শোক, তার শোকের মর্যাদা এবং বুঝলেন যে তাঁর এই সাক্ষাৎ নিতান্তই অর্থহীন, কারণ জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরের চিঠিতে বর্ণিত ও ব্যাখ্যাত বিষয় সম্পর্কে তিনি যা জানেন তার চাইতে বেশি জানে এই রমণী। এটা সত্য। জেরেমিয়া মৃত্যুবরণ করার কয়েক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত সে তার সঙ্গে ছিল, যেমন ছিল তার সারা জীবনের অর্ধেকটা সময়, আর জেরেমিয়ার প্রতি তার গভীর অনুরক্তি ও একান্ত অনুগত মায়ামমতার রূপটি নিঃসন্দেহে প্রেম-ভালবাসার। অথচ এই নিদ্রাতুর প্রাদেশিক রাজধানিতে, যেখানে রাষ্ট্রের গোপন তথ্যও দ্রুত সাধারণ মানুষের গোচরীভূত হয়ে যায়, এই সম্পর্কের কথা কেউ জানতে পারেনি। তাদের দেখা হয়েছিল পোর্ট প্রিন্সের এক রোগমুক্তি-উত্তর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার কেন্দ্রে। সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিল মেয়েটি। সেখানেই একজন ফেরারি হিসেবে জেরেমিয়া তার জীবনের প্রাথমিক কয়েকটি বছর কাটায়। জেরেমিয়া এখানে আসার এক বছর পর মেয়েটি তাকে অনুসরণ করে এখানে চলে আসে, কয়েক দিন বেড়িয়ে যাবার জন্য, যদিও কেউ কিছু খোলাখুলি না বললেও উভয়েই জানতো যে মেয়েটি এখানে এসেছে চিরকালের মতো থাকার উদ্দেশ্যে। সপ্তাহে একদিন করে সে ল্যাবরেটরি পরিষ্কার করতো, সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতো, কিন্তু এলাকার সব চাইতে কু-মনের মানুষরাও বাইরের ছবি ও ভেতরের বাস্তবতা নিয়ে কোন বিভ্রান্তি বোধ করে নি, কারণ আর সবার মতো তারাও ধরে নিয়েছিল যে জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ- আমুরের পঙ্গুত্ব তাঁর হাঁটার ক্ষমতা ছাড়াও অন্য কিছুর ক্ষমতাও কেড়ে নিয়েছিল। ডাক্তার উরবিনোও নির্ভরযোগ্য ডাক্তারির কারণেই তাই ভেবে এসেছিলেন, এবং তাঁর বন্ধু যদি নিজে চিঠি লিখে এটা না জানাতেন তাহলে তাঁর সঙ্গে কোন মেয়ের যে ওই রকম সম্পর্ক ছিল এটা তিনি কখনই বিশ্বাস করতেন না। তা ছাড়া, দুজন অতীতবিহীন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই রকম বদ্ধ সমাজের সংস্কারের প্রান্তসীমায় বাস করেও একটা অবৈধ প্রেমের ঝুঁকি নেবে, এটা তাঁর পক্ষে বোঝা কঠিন হলো। মহিলা জানালেন, ওর তাই ইচ্ছা ছিল। তাছাড়া, একটা মানুষ, যে কখনো পুরোপুরি তার হবে না, তার সঙ্গে একটা গোপন জীবন ভাগ করে নেয়া, যে জীবনে তারা প্রায়ই আনন্দের আকস্মিক বিস্ফোরণে আপ্লুত হয়েছে, সে অবস্থাটা তার কাছে অবজ্ঞার মনে হয় নি। পক্ষান্তরে, জীবন তাকে দেখিয়েছে যে হয়তো সেটাই ছিলো আদর্শস্বরূপ এবং অনুসরণযোগ্য।
গত রাতে ওরা দুজন সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। দুজনে বসেছিল দু’জায়গায়। ইতালির অধিবাসী ডন গ্যালিলিও দাকোঁত এখানে সপ্তদশ শতকের ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মঠের একাংশে খোলা জায়গায় সিনেমা দেখার আয়োজন করার পর থেকে ওরা দুজন মাসে অন্তত দুবার এভাবে আলাদা আলাদা জায়গায় বসে ছায়াছবি উপভোগ করে এসেছে। গত রাতে তারা দেখেছিল অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। আগের বছর বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করা একটি উপন্যাসকে ভিত্তি করে এ-ফিল্ম নির্মিত হয়েছিল। ডাক্তার উরবিনো বইটি পড়েছিলেন। যুদ্ধের বর্বরতায় তাঁর হৃদয় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। ছবি দেখার পর তারা দুজন ল্যাবরেটরিতে মিলিত হয়, মহিলা জেরেমিয়াকে দেখতে পায় চিন্তান্বিত, অতীতের স্মৃতিবিধুর। সে ভেবেছিল এটা বোধ হয় কাদার মধ্যে যুদ্ধাহত মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের পড়ে থাকার নিষ্ঠুর দৃশ্যাবলি দেখার ফল। তার মনোযোগ ভিন্নমুখী করার জন্য সে তাকে দাবা খেলতে আমন্ত্রণ জানায়, ওকে খুশি করার জন্য জেরেমিয়া সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে, কিন্তু খেলায় সে কোন মনোযোগ দেয় নি। সাদা ঘুঁটি দিয়েই সে খেলেছিল, সব সময় যেমন খেলে, আর এক সময় জেরেমিয়া যখন আবিষ্কার করলো যে আর চারটি চালের মাথায় সে পরাজিত হতে যাচ্ছে, তখন সে নিজেই আত্মসমর্পণ করে। ডাক্তার এবার বুঝলেন যে ওই শেষ খেলায় জেরেমিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল এই রমণী, জেনারেল জেরোনিমো আর্গোট নয়; তাঁর ধারণা ছিল ভুল। তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ওই খেলাটি ছিল অসম্ভব ভালো। মহিলা জোর দিয়ে বললেন যে, না, তিনি কোন প্রশংসার যোগ্য নন। জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর, ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে আচ্ছন্ন, তাঁর ঘুঁটিগুলি চেলেছিলেন কোন রকম ভালবাসা ছাড়াই, রাত পৌনে ১১টার দিকে। বাইরের নাচ-গান থেমে যাবার পর, জেরেমিয়া খেলা বন্ধ করে দিয়ে তাকে চলে যেতে বলেন, তিনি ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে একটা চিঠি লিখতে চান। তার জীবনে তিনি যত মানুষ দেখেছেন তাদের মধ্যে ডাক্তারকেই তিনি সব চাইতে বেশি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি বলে বিবেচনা করেন, তাঁর আত্মার বন্ধু, ওভাবেই বলতেন তিনি, যদিও তাদের দুজনের মধ্যে সহমর্মিতার একমাত্র যোগসূত্র ছিল দাবার প্রতি উভয়ের আসক্তি, যে দাবা খেলাকে ওরা বিবেচনা করতো যুক্তির এক সংলাপ বলে, কোন বিজ্ঞান বলে নয়। মহিলা বললেন, তখনই তিনি বুঝেছিলেন জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর তাঁর কষ্টের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছেন, আর এখন তাঁর মধ্যে তাঁর শেষ চিঠি লিখার মতো জীবনী শক্তিটুকই আছে, তার বেশি নয়। ডাক্তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তাহলে আপনি জানতেন!
হ্যাঁ, তিনি শুধু জানতেনই না, তিনিই মমত্বভরে তাকে তার কষ্ট সহ্য করতে সাহায্য করেছেন, যেমন করেছিলেন সুখ ও আনন্দ আবিষ্কার করতে। কারণ গত এগার মাস ধরে জেরেমিয়া যে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন তা তিনি জানতেন।
ডাক্তার বললেন, তাঁর কথা জানানো আপনার কর্তব্য ছিল।
মহিলা যেন প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলেন। তিনি বললেন, আমি তা করতে পারতাম না। আমি ওকে বড় বেশি ভালবেসে ছিলাম।
ডাক্তার উরবিনোর ধারণা ছিল যে যা কিছু শোনার আছে তার সব কিছু তাঁর শোনা হয়ে গেছে, কিন্তু এ রকম একটা কথা তিনি কখনই শোনেন নি, এ রকম একটা উক্তি এবং এমন সহজ সারল্যের সঙ্গে উচ্চারিত। তিনি সোজা তার দিকে তাকালেন, তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে মহিলার ওই মুহূর্তের ছবিটি নিজের স্মৃতিতে অক্ষয় করে ধরে রাখতে চাইলেন। মহিলাকে মনে হল তার কালো পোশাকে অকুতোভয়, তার সর্পিল চোখ ও কানের পাশে গোঁজা গোলাপ নিয়ে যেন কোন নদীপ্রতিমা। অনেক কাল আগে, হাইতির এক নির্জন সমুদ্র সৈকতে প্রেম-সম্ভোগের পর তারা দুজন নগ্নদেহে শুয়ে ছিলেন, জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর তখন নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, আমি কখনো বুড়ো হবো না। মহিলা তখন ভেবেছিলেন এটা বুঝি বিধ্বংসী কালের বিরুদ্ধে তার অপ্রতিহত সংগ্রাম চালিয়ে যাবার বীরত্বপূর্ণ সঙ্কল্প। কিন্তু তিনি আসলে আরো সুনির্দিষ্ট কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন। তাঁর যখন ৬০ বছর হবে তখন তিনি নিজেই নিজের প্রাণ হরণ করার অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে এ বছরের ২৩ জানুয়ারি তারিখে তিনি ষাট বছর পূর্ণ করেন এবং তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁর প্রয়াণের তারিখ হবে পেন্টেকস্টের আগের রাত, যেটা ছিল নগরীর সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিন, যে নগরী হোলি স্পিরিটের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় উৎসর্গীত। গত রাতের ঘটনার মধ্যে এমন কিছুই ছিল না যা মহিলা আগে থেকে জানতেন না। বিষয়টা নিয়ে তারা দুজন প্রায়ই আলাপ করতেন, যে অপ্রতিরোধ্য গতিতে দিনগুলি ছুটে যাচ্ছিল, যা এখন থামাবার শক্তি বা সাধ্য তাদের দুজনের কারোরই ছিল না, তার যন্ত্রণা তারা দুজনে একত্রে ভোগ করেছিলেন। জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুর এক বিচারবুদ্ধিহীন তীব্র আবেগ দিয়ে জীবনকে ভালবাসতেন, তিনি ভালবাসতেন সাগর আর প্রেম, তিনি ভালবাসতেন তাঁর কুকুর আর তাকে, আর দিন যতই এগিয়ে আসতে থাকে ততই তিনি হতাশার মধ্যে ডুবে যেতে থাকলেন, যেন সিদ্ধান্তটি তাঁর নিজের নয়, বরং এক নির্মম অপ্রতিরোধ্য নিয়তির।
মহিলা বললেন, গত রাতে আমি যখন তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি তখন আর তিনি এই ধরণীর কেউ ছিলেন না।
মহিলা কুকুরটাকে তার সঙ্গে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি তার ক্রাচের পাশে ঝিমোতে থাকা পশুটির দিকে তাকান, তার আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে তাকে আদর করেন, তারপর বলেন, আমি দুঃখিত, কিন্তু মিস্টার উডরো উইলসন আমার সঙ্গেই আসছে। তিনি চিঠি লিখতে লিখতে তাকে বলেন সে যেন কুকুরটাকে তার খাটের একটা পায়ার সঙ্গে বেঁধে দেয়, আর তখন সে একটা ভুয়া গিঁট দিয়েছিল যাতে করে কুকুরটা নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারে। ওটাই ছিল তাঁর প্রতি ওর একমাত্র অবিশ্বস্ততার কাজ, আর পরবর্তী সময়ে কুকুরটার ঠাণ্ডা চোখের দিকে তাকিয়ে তার প্রভুকে স্মরণ করার আকাঙ্ক্ষা ওর কাজটিকে বৈধতা দিয়েছিল। ডাক্তার উরবিনো বাধা দিয়ে বললেন যে কুকুরটা তো নিজেকে মুক্ত করে নি। ও বললো, তাহলে তার কারণ কুকুরটা তা করতে চায় নি। আর ও খুশিই হয়েছে, কারণ গত রাতে, ইতিমধ্যে শুরু করা চিঠি লেখা একটু থামিয়ে তিনি ওর দিকে শেষ বারের মতো তাকিয়ে ওর মৃত প্রেমিককে যে ভাবে স্মরণ করার কথা বলেছিলেন, সেও তাকে সেভাবেই স্মরণ করতে চায় বলে মন্তব্য করেছিলেন।
তিনি ওকে বলেছিলেন, একটা গোলাপ দিয়ে আমাকে স্মরণ করো।
মাঝরাতের একটু পরে সে বাড়ি ফিরেছিল। সমস্ত জামা-কাপড় পরা অবস্থাতেই সে বিছানায় শুয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকে, তাঁকে চিঠিটা শেষ করার সময় দেয়, ও জানতো যে ওই চিঠি হবে দীর্ঘ এবং সেটা লেখাও হবে কঠিন। তারপর রাত তিনটা বাজার সামান্য আগে, যখন রাস্তার কুকুরগুলির চিৎকার শুরু হয়, সে স্টোভে কফির পানি বসায়, আর শোক পালনের সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিত অবস্থায় উঠানে গিয়ে ভোরের প্রথম গোলাপটি ডাল থেকে কেটে আনে। প্রতিকারের অসাধ্য এই মহিলার স্মৃতিকে যে ডাক্তার উরবিনো সম্পূর্ণ অস্বীকার করবেন তা তিনি ততক্ষণে ভালো করে জেনে ফেলেছিলেন এবং কেন তাও তাঁর মনে হলো। তিনি জানেন : একজন নীতিবর্জিত মানুষই শুধু শোকের প্রতি এ রকম আনুষ্ঠানিক সৌজন্য দেখাতে পারে।
এই সাক্ষাতের বাকি সময়টুকুতে তাঁর ধারণা যে সঠিক মহিলা তার আরো প্রমাণ দিলেন। তিনি জেরেমিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাবেন না, কারণ তার প্রেমিককে তিনি এ ব্যাপারে কথা দিয়েছেন, যদিও এইমাত্র পড়া জেরেমিয়ার চিঠির একটি অনুচ্ছেদে ডাক্তার বিপরীত কথাই লক্ষ করেছেন। তিনি এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করবেন না, স্মৃতির উষ্ণ জলে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে তিনি তার জীবনের বাকি দিনগুলি অপচয় করবেন না, তার কাফনের কাপড় সেলাই করার জন্য তিনি নিজেকে এই চার দেয়ালের মধ্যে জ্যান্ত সমাধিস্থ করে রাখবেন না, স্থানীয় বিধবাদের কাছ থেকে যা প্রত্যাশিত সে রকম কিছুই তিনি করবেন না। চিঠি অনুসারে এখন তিনি জেরেমিয়া দ্য সাঁৎ-আমুরের বাড়ি এবং তার যাবতীয় জিনিসপত্রের মালিক এবং কোন অভিযোগ না করেই তিনি এতদিন যেভাবে তার জীবন পরিচালনা করেছেন এখনো সে ভাবেই করবেন, গরিবের যে মরণ-ফাঁদে তিনি সুখী হয়েছেন সে মরণ-ফাঁদেই তিনি তাঁর জীবন কাটিয়ে দেবেন।
বাড়ি ফেরার পথে ওর কথাগুলি ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে তাড়া করে ফিরলো : গরিবের মরণ-ফাঁদ। এটা ছিলো বিনা পয়সায় প্রদত্ত একটা খাঁটি বর্ণনা। কারণ এই শহর, তাঁর শহর, দাঁড়িয়ে ছিল কালের প্রান্তে, পরিবর্তনহীন, তাঁর নৈশকালীন আতঙ্কের সেই জ্বলন্ত শুষ্ক শহর, বয়ঃসন্ধিকালের সেই একাকী নির্জন আনন্দের শহর, যেখানে ফুলে জং ধরে যায়, লবণ সব কিছু ক্ষয় করে ফেলে, যেখানে চার শতাব্দি ধরে কিছুই ঘটেনি, যেখানে শুধু বিবর্ণ হয়ে যাওয়া সবুজ জলপাই পাতা ও পচা জলাভূমির মধ্যে বয়োবৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া ধীর কিন্তু অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলে। শীতকালে আকস্মিক বিধ্বংসী বর্ষণ শৌচাগারগুলি জলে ডুবিয়ে দেয়, রাস্তাগুলি পরিণত হয় দুর্গন্ধময় কর্দমাক্ত জলাভূমিতে। গ্রীষ্মকালে উন্মাদ ঝড়ো হাওয়ায় বাড়িঘরের সর্বাপেক্ষা সুরক্ষিত কোণাও উষ্ণ-লাল চকের মতো কর্কশ অদৃশ্য ধুলায় ভরে যায়, আর সেই হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের চাল আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। প্রতি শনিবার গরিব বর্ণসঙ্কর মানুষগুলি তাদের গৃহপালিত পশু আর রান্নার সাজ-সরঞ্জামসহ জলাভূমির পাশে তাদের তক্তা আর টিনের ঝুপড়িগুলি ত্যাগ করতো আর উল্লসিত আকস্মিক হামলা চালিয়ে ঔপনিবেশিক শহরের পাহাড়ি সমুদ্র সৈকতগুলি দখল করে নিতো। অল্প কয়েক বছর আগেও এদের মধ্যে বয়োবৃদ্ধদের কারো কারো গায়ে রাজকীয় ক্রীতদাসের চিহ্ন দেখা যেতো, গনগনে তাতানো লোহা দিয়ে তাদের বুকে ছ্যাঁকা দিয়ে ওই চিহ্ন এঁকে দেয়া হতো। শনি-রবিবার তারা নির্দয় ভাবে নাচতো, ঘরে তৈরি মদ আকণ্ঠ গিলে চূর হয়ে থাকতো, ইকাকো গাছের আড়ালে উন্মত্ত প্রণয়লীলায় মত্ত হতো, তারপর রবিবার মাঝরাতে লাগামহীন রক্তাক্ত মারামারি করে নিজেরাই নিজেদের জলসা ভেঙে দিতো। সপ্তাহের বাকি দিনগুলি অগ্রপশ্চাত চিন্তাহীন সেই একই জনতা পুরনো এলাকা আর প্লাজাগুলিতে তাদের যা কিছু আছে সব নিয়ে আসতো বিক্রি করা আর নতুন কিছু কেনার জন্য, আর তখন তারা এই মৃত শহরে জাগিয়ে তুলতো ভাজা মাছের গন্ধে ম ম করা এক মানুষিমেলার উন্মত্ততা, একটা নতুন জীবন। স্পেন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি ও দাসপ্রথার বিলুপ্তি ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো যে সম্ভ্রান্ত অবক্ষয়ের পরিবেশে জন্ম নিয়েছিলেন ও বেড়ে উঠেছিলেন সে-অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। প্রাচীন মহান পরিবারগুলি তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের মধ্যে নিঃশব্দে ডুবে যায়। যে রুক্ষ খোয়া বাঁধানো রাস্তাঘাট আকস্মিক হামলা ও বোম্বেটেদের আক্রমণের সময় কাজে এসেছিল এখন সেখানে ঝুলবারান্দা থেকে ঝোলানো লতাগুল্ম এসে পড়ে, সযত্নে রক্ষিত প্রাসাদোপম বাড়িগুলির সাদা চুনকাম করা দেয়ালেও ফাটল দেখা যায়, আর সেখানে প্রাণের একমাত্র চিহ্ন লক্ষিত হয় অপরাহ্ দুটায়, দ্বিপ্রাহরিক ক্ষণিক নিদ্রার মৃদু আলোয় কারো পিয়ানো অনুশীলনের মধ্যে। গৃহাভ্যন্তরে তাদের ধূপধুনার গন্ধে পরিপূর্ণ শীতল শয়নকক্ষগুলিতে মেয়েরা নিজেদেরকে সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষিত করে রাখে, যেন ওই আলো লজ্জাজনক ছোঁয়াচে একটা কিছু, এমনকি গির্জায় সকালের প্রার্থনার সময়েও তারা ওড়নায় তাদের মুখ আবৃত করে রাখে। তাদের হৃদয়ঘটিত ব্যাপারগুলি ছিল মন্থর ও শ্রমসাধ্য, প্রায়ই অশুভ সঙ্কেত দ্বারা বিঘ্নিত, আর জীবন মনে হতো অন্তহীন। দিবাবসানে, ক্রান্তিকালের অসহনীয় মুহূর্তে, জলাভূমিগুলি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মাংশাসী মশার দল উঠে আসতো আর ভেসে আসতো মনুষ্য মলের গন্ধযুক্ত মৃদু বাতাস, উষ্ণ এবং দুঃখ ভারাক্রান্ত, যা অন্ত রাত্মার একেবারে গভীরে পৌঁছে দিত মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা।
আর, তাই, তাঁর প্যারিসীয় বিষণ্নতায় তরুণ জুভেনাল উরবিনো এই ঔপনিবেশিক শহরকে যেভাবে আদর্শায়িত করেছিলেন তা ছিল স্মৃতির এক মরীচিকা মাত্র। অষ্টাদশ শতাব্দিতে এই শহরের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল ক্যারিবীয় অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী। এর মূলে প্রধানত যা কাজ করেছিল সেটা অবশ্য খুব গৌরবজনক ছিল না। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার জন্য এখানেই ছিল আফ্রিকান ক্রীতদাসদের বৃহত্তম বাজার। তা ছাড়া এটা ছিল নবরাজ্য গ্রানাডার ভাইসরয়দের স্থায়ী আবাস স্থল। বহু শতাব্দির বৃষ্টিস্নাত হিম শীতল দূরবর্তী রাজধানীর পরিবর্তে পৃথিবীর মহাসাগরের তীরে এখানে বসেই তাঁরা তাঁদের শাসনকার্য পরিচালনা করতে বেশি পছন্দ করতেন। প্রতি বছরই, কয়েকবার, পটোসি, কুইটো এবং ভেরাক্রুজের ঐশ্বর্য নিয়ে স্পেনের পালতোলা জাহাজের সারি এ শহরের উপসাগরে এসে ভিড় করতো এবং তখন শহরটি যাপন করতো তার গৌরবোজ্জ্বল সময়। ১৭০৮ সালের ৮ জুন, শুক্রবার, বিকাল ৪টার সময় বহু মূল্যবান পাথর ও ধাতু নিয়ে সান হোসে জাহাজটি কার্ডিজের উদ্দেশে যাত্রা করে। বন্দরের প্রবেশ মুখে ইংরেজদের যুদ্ধ জাহাজের একটি দল সান হোসেকে ডুবিয়ে দেয়, আর দীর্ঘ দুই শতাব্দি পরে আজও সে সম্পত্তি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। ওই ঐশ্বর্য প্রবালের শয্যায় পড়ে আছে, জাহাজের অধিনায়কের মৃতদেহ জাহাজের সেতুর ওপর আড়াআড়ি ভাবে ভাসছে, স্মৃতিতে নিমজ্জিত এই শহরের প্রতীক হিসেবে ঐতিহাসিকরা এখনো ওই স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলেন।