১০
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার চিরাচরিত ধাতব ধৈর্যের সাথে সফরের যাবতীয় কষ্ট সহ্য করলো। এই ধৈর্যই তার মাকে নিদারুণ দুঃখ দিত আর তার বন্ধুদের করে তুলতো ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। কারো সঙ্গে সে কথা বলতো না। দিনের বেলা তার খুব কষ্ট হত না। রেলিং-এর পাশে বসে নদীর বালুকাময় তীরে রোদ পোহানো নিশ্চল কুমীরগুলি সে নিবিষ্ট চিত্তে দেখতো, প্রজাপতি গলাধঃকরণ করার জন্য প্রাণীগুলির মুখ হাঁ করা, জলাভূমি থেকে হঠাৎ, কোনো রকম আগাম আভাস ছাড়াই, সারসের ঝাঁকের উড়ে যাওয়া লক্ষ করতো সে, উদ জাতীয় জলজ প্রাণী গুলি তাদের শিশুদের স্তন্যদান করছে, মাঝে মাঝে মেয়েদের মতো চিৎকার করে যাত্রীদের চমকে দিচ্ছে, এসবও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। তারপর মাত্র একদিনের মধ্যে সে তিনটি মানুষের মৃতদেহ জাহাজের পাশ দিয়ে ভেসে যেতে দেখলো, ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, রঙ সবুজ বর্ণ, মৃতদেহগুলির ওপর শকুন বসে আছে। প্রথম মৃতদেহ দুটি ছিল পুরুষের, তাদের একজন ছিল মস্তক বিহীন। আর একটি মৃতদেহ ছিল একটি তরুণীর, তার মেডুসার মতো কেশরাশি জাহাজের পেছন দিকের উচ্ছ্বসিত জলরাশির মধ্যে দুলছিলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কখনোই জানতে পারে নি ওরা কলেরার শিকার ছিল, নাকি যুদ্ধের। কেউই জানতে পারে নি। কিন্তু তাদের গা গুলানো বিশ্রী গন্ধ ফারমিনা ডাজার যে স্মৃতি ছিল তার তাঁকে কলুষিত করে দেয়।
সব সময় এটাই ঘটেছে। যে কোন ঘটনা, ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক, কোনো না কোনো ভাবে ওর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। রাতের বেলায়, জাহাজ যখন নোঙর করা, বেশির ভাগ যাত্রী যখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে ডেকময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, তখন সে, সারা জাহাজে সকাল পর্যন্ত জ্বলতে থাকা একমাত্র কার্বাইড আলোটির নিচে বসে, তার বহুবার পড়া এবং মুখস্থ হয়ে যাওয়া সচিত্র উপন্যাসগুলি আবার পড়তো এবং নাটকীয় ঘটনাগুলি তখন তার কাছে আবার জীবন্ত ও মোহনীয় হয়ে উঠতো, কাল্পনিক চরিত্রগুলির জায়গায় সে তার চেনাজানা মানুষগুলিকে বসাতো, আর ফারমিনা ডাজা ও তার নিজের জন্য অবধারিত ভাবে সংরক্ষিত রাখতো নিয়তি-অভিশপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকার ভূমিকা দুটি। কোনো কোনো রাতে সে যন্ত্রণাদগ্ধ চিঠি লিখতো, তারপর চিঠির কাগজগুলি খণ্ড খণ্ড করে নদীর জলধায়ায় ভাসিয়ে দিতো, যে জলধারা বিরতিহীনভাবে ভেসে চলেছে ওর দিকে। এই ভাবে কেটে যেতো তার সব চাইতে দুঃসহ মুহূর্তগুলি, সে কখনো নিজেকে কল্পনা করতো এক ভীরু যুবরাজ, কখনো এক দুঃসাহসী বীর যোদ্ধা, আবার কখনোবা ভুলে যাবার প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকেপড়া এক ঝলসে যাওয়া প্রেমিক রূপে। তারপর এক সময় ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করতো আর তখন সে দু’দণ্ড চোখ বন্ধ করার জন্য চেয়ার টেনে রেলিং-এর পাশে গিয়ে বসতো।
এক রাতে অভ্যস্ত সময়ের চাইতে আগে তার পড়া শেষ হল। সে অন্যমনস্ক ভাবে টয়লেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় খাবার ঘরের ভেতর দিয়ে যখন সে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ পাশের একটা ঘরের দরজা খুলে গেল আর বাজপাখির থাবার মতো একটা হাত চকিতে বেরিয়ে এসে তার জামা খামচে ধরে তাকে ক্যাবিনের ভেতরে টেনে নিলো। অন্ধকারের মধ্যে সে একটি নগ্ন রমণীকে আবছাভাবে দেখতে পেল, তার কাল- বিহীন শরীর গরম ঘামে ভিজে গেছে, নিঃশ্বাস ভারি, সে তাকে তার শয্যায় চিৎ করে ঠেসে ধরলো, তার বেল্ট খুলে নিলো, প্যান্টের বোতামগুলি খুলে দিল, তারপর নিজেকে তার উপরে বিদ্ধ করলো, যেন একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ছে, তারপর কোনো রকম গৌরব ছাড়াই তার কুমারত্ব হরণ করে নিলো। কামনার এক অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দুজনই এক অতল গহ্বরের শূন্যতার ভেতর ডুবে গেল, যেখান থেকে ভেসে এলো চিংড়ি মাছে পূর্ণ লবণাক্ত এক জলাভূমির গন্ধ। তারপর ও তার ওপর এক মুহূর্ত শুয়ে থাকলো, হাঁপালো, আর তারপর অন্ধকারের মধ্যে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল।
‘এবার যাও’, সে বললো, ‘সব কিছু ভুলে যাও। এ ব্যাপারটা ঘটেই নি।’
আক্রমণটা এত দ্রুত এবং এত জয়যুক্ত হয় যে স্পষ্ট বোঝা গেল ব্যাপারটা একঘেয়েমি প্রসূত কোন আকস্মিক পাগলামির ফল নয়, বেশ সময় নিয়ে এটার পরিকল্পনা করা হয়েছে, সব কিছু ভালো ভাবে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে। এই তৃপ্তিদায়ক নিশ্চিতি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল, কারণ উপভোগের তুঙ্গে পৌঁছে একটি আশ্চর্য অনুভূতির অভিজ্ঞতা সে অনুভব করলো। ফারমিনা ডাজার জন্য তার অলীক ভালোবাসার স্থান নিতে পারে অত্যন্ত পার্থিব একটা কামনা। আর তাই যে বাঘিনী এই কাণ্ডটা ঘটালো তার পরিচয় উদঘাটনের জন্য সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, তার মাধ্যমেই সে নিজের দুর্ভাগ্যের নিরাময় খুঁজে পাবে। কিন্তু সে সফল হল না। সে যতো বেশি খোঁজাখুঁজি করলো তার মনে হল সে সত্য থেকে তত বেশি দূরে সরে যাচ্ছে।
আক্রমণটা সংঘটিত হয় সর্বশেষ ক্যাবিনে। কিন্তু ওই ঘরের ভেতরের একটা দরজা দিয়ে পাশের ঘরে যাওয়া যায়। দুটি ঘরের চার খাট মিলিয়ে একটি পারিবারিক শোবার ঘর করা হয়েছিল। এর অধিবাসী ছিল দুটি তরুণী, আরেকজন পরিণত বয়সের মহিলা কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং মাত্র কয়েক মাসের একটি শিশু। এরা বারাঙ্কো ডি লোবাতে জাহাজে ওঠে। নদীর খামখেয়ালিপনার জন্য বাষ্পচালিত জাহাজগুলি তাদের যাত্রাপথ থেকে এই শহর খারিজ করে দেয়, তখন থেকে এদের জাহাজ মমপোক্সের যাত্রী ও মালপত্র এই বন্দর থেকে তুলে নিতে আরম্ভ করে। ওই চার যাত্রী এখান থেকেই জাহাজে ওঠে। ওরা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার নজরে পড়ে শুধু একটি কারণে, তাদের সঙ্গে একটা বড় পাখির খাঁচায় ছিল একটি ঘুমন্ত শিশু।
রমণী তিন জনের জামা-কাপড় দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন কোন বিলাসী সামুদ্রিক জাহাজে ভ্রমণ করছেন। তাদের সিল্কের স্কার্টের ঝালর, গলায় লেস-এর কাপড়, চওড়া প্রান্তের টুপিতে কৃত্রিম ফুল, সবই চোখে পড়ার মতো। তরুণী দুজন দিনে কয়েকবার তাদের পোশাক পাল্টাচ্ছেন, অন্য যাত্রীরা যখন গরমে হাঁসফাঁস করছে তখন তাদের দেখে মনে হত তারা যেন বসন্তের পরিবেশে ফুরফুর করছেন। তিন রমণীই ছাতা ও পালক দেয়া পাখার ব্যবহারে ছিলেন সুপটু, কিন্তু তাদের মতিগতি ছিল মমপোক্সের সব মেয়েদের মতোই, দুর্বোধ্য ও রহস্যময়। একে অন্যের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক কি তাও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বুঝতে পারলো না, তবে ওরা যে এক পরিবারের সদস্য সে সম্পর্কে সে ছিল নিঃসন্দিগন্ধ। প্রথমে সে ভেবেছিল যে বড় জন বুঝি অন্য দুজনের মা, কিন্তু তারপরই সে উপলব্ধি করল যে তাঁর বয়স অতটা হয় নি। তাছাড়া তাঁর পোশাকে শোক পালনের কিছু নিদর্শন ছিল, যা অন্য দুজনের ক্ষেত্রে ছিল না। যে মহিলাই কাণ্ডটা ঘটিয়ে থাকুন না কেন, অন্য দুজন নিকটবর্তী বিছানায় ঘুমিয়ে থাকার সময়ে তিনি তা করতে সাহস করেছেন এটা সে কল্পনা করতে পারলো না। তাই যুক্তিসঙ্গত অনুমান একটাই করা যায়, ঘটনাচক্রে, কিংবা হয়তো পরিকল্পনা অনুযায়ী, মহিলা ক্যাবিনে একা থাকার সুযোগটা গ্রহণ করেছিলেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লক্ষ করেছিল যে মাঝে মাঝে ওদের দুজন ঠাণ্ডা বাতাসের লোভে ক্যাবিন ছেড়ে বাইরে অনেক রাত পর্যন্ত থাকতেন, তখন তৃতীয় জন ঘরে বাচ্চার দেখাশোনা করতেন, তবে এক অত্যধিক গরমের রাতে তারা তিনজনই ক্যাবিনের বাইরে চলে এসেছিলেন, ঘুমন্ত শিশুটি ছিল একটা বেতের খাঁচায়, পাতলা কাপড়ে ঢাকা।
সূত্রগুলির নানা জটিলতা সত্ত্বেও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা দ্রুত একটা সম্ভাবনা বাতিল করে দিল। সবার বয়োজ্যেষ্ঠ জন একাজ করেন নি, সর্বকনিষ্ঠ জনও নন, যিনি ছিলেন তিনজনের মধ্যে সব চাইতে সুন্দরী ও সব চাইতে সাহসী। কোন যথার্থ কারণ ছাড়াই সে এ সিদ্ধন্তে উপনীত হয়। তিন রমণীকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর তার মনে হল, যে রমণীটি শিশুর মা সে-ই তাকে ওই আকস্মিক ভালোবাসা দিয়েছিলেন। এই ধারণাটা তার কাছে এত আকর্ষণীয় মনে হয় যে সে ফারমিনা ডাজার চাইতেও বেশি তীব্র ভাবে ওই রমণীর কথা ভাবতে আরম্ভ করে, যদিও তাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে সদ্য মা হওয়া এই রমণীর কাছে তাঁর সন্তানই ছিল সব কিছু। তাঁর বয়স পঁচিশের বেশি হবে না, ক্ষীণাঙ্গী, সোনালি, তাঁর পর্তুগীজ চোখের পাতার জন্য তাঁকে আরো সুন্দর মনে হত, আর ছেলেকে তিনি যেভাবে তার ভালোবাসা উজাড় করে দিচ্ছিলেন তার সামান্য ছিঁটেফোঁটা পেলেও যে কোন মানুষ বর্তে যেতো। সকালের নাস্তার পর থেকে রাতে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে সেলুনে ব্যস্ত থাকতেন, অন্য দুজন তখন চাইনিজ চেকার্স খেলতেন, তারপর ছেলের মা যখন শেষ পর্যন্ত ছেলেকে ঘুম পাড়াতে সক্ষম হতেন তখন তিনি ছাদ থেকে ঝোলানো একটা বেতের খাঁচায় ছেলেকে শুইয়ে দিতেন, রেলিং-এর যে ধারটা অপেক্ষাকৃত বেশি ঠাণ্ডা সেই ধারে। ঘুমিয়ে থাকলেও তিনি কিন্তু শিশুটিকে উপেক্ষা করতেন না, তিনি খাঁচাটাকে দোলাতেন, চাপা গলায় গান গাইতেন, আর এই সফরের তাবৎ কষ্টের ঊর্ধ্বে তাঁর ভাবনারাশি অনেক উঁচুতে উড়ে বেড়াতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটা কাল্পনিক ধারণা আঁকড়ে বসে ছিল, কোন একটা ভঙ্গির মাধ্যমে তিনি, আগে হোক বা পরে হোক, নিজেকে প্রকাশ করে ফেলবেনই। সে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তন লক্ষ করতে শুরু করলো, তাঁর ব্লাউজের ওপর ঝোলানো ধর্মীয় কবচটি লক্ষ করতে লাগলো, কোন রকম ভানের আশ্রয় না নিয়েই তার হাতের বই-এর ওপর দিকে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর খাবার ঘরে সে সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যের সঙ্গে নিজের আসন বদলে নিলো যেন সে তাঁর মুখোমুখি বসতে পারে। কিন্তু এই রমণীই যে তার সে রাতের গোপন অভিসারের অন্য অর্ধাংশ তার সামান্যতম ইঙ্গিতও সে পেলো না। তাঁর সম্পর্কে সে একটি কথাই জানতে সক্ষম হল, তাও তাঁর কনিষ্ঠ সঙ্গী তাঁকে নাম ধরে ডাকার জন্য : রোসাল্বা।
অষ্টম দিনে জাহাজ খুব কষ্ট করে একটা তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ স্রোতস্বিনীর মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেল, দু’পাশে মার্বেলের উঁচু পাহাড়। আর তারপর দুপুরের খাবারের পর জাহাজ নোঙর ফেললো পুয়ের্তো নেয়ার-এ। যেসব যাত্রী এখান থেকে অ্যান্টিওকুইয়াতে যাবেন তাদের এখানে নামতে হবে। নতুন গৃহযুদ্ধ যেসব জায়গায় প্রবল ভাবে চলছিল তাদের মধ্যে অ্যান্টিওকুইয়া ছিল অন্যতম। বন্দর বলতে এখানে ছিল গোটা ছয়েক তালপাতার কুঁড়েঘর, কাঠের তৈরি একটা গুদাম, তার ছাদ জিঙ্কের, নগণ্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নগ্নপদ কয়েকটি সেনাদল ওই জায়গাটা পাহারা দিচ্ছে, কারণ বিদ্রোহীরা জাহাজ আক্রমণ করে লুট করবে এরকম একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। বাড়িগুলোর পেছনে প্রায় আকাশ পর্যন্ত উঠে গেছে একটা অন্তরীপ, সেখানে খাড়া পাহাড়ের পাশে অনাবাদী উচ্চভূমি আর খাঁজ কাটা একটা পাথরের চূড়া। সে রাতে জাহাজের বুকে যাত্রীদের কারো ভালো ঘুম হয় নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো আক্রমণ পরিচালিত হয় নি এবং পর দিন সকালে বন্দরটি রূপান্তরিত হয় এক রবিবাসরীয় মেলায়। আদিবাসী ইন্ডিয়ানরা তাগুয়া কবচ আর প্রেম সুধারস বিক্রি করছে। চারিদিকে গাধা খচ্চর-ঘোড়া, কেন্দ্রীয় পবর্তমালার অর্কিড অরণ্যানীর উদ্দেশে উপর দিকে ছয় দিনের সফরের জন্য তারা তৈরি।
কৃষ্ণাঙ্গ কুলিরা তাদের পিঠে বয়ে জাহাজের মাল খালাস করছিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাদের দিকে তাকিয়ে তার সময় কাটাচ্ছিল। কুলিরা নিয়ে যাচ্ছে কাঠের বাক্সভর্তি কাচের বাসনকোশন, এনভিগাদোর বিয়ে না হওয়া মহিলাদের জন্য পিয়ানো, আর এই সব দেখতে দেখতে ফ্লোরেন্টিনো খেয়ালই করে নি যে রোসাল্বা আর তার সঙ্গীরা আরো কতিপয় যাত্রীর সঙ্গে ওখানেই নেমে গেছে, তারা আর জাহাজে ফিরে আসে নি। সে যখন তাদের দেখতে পেল ততক্ষণে তারা এক পাশে দু’পা ঝুলিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে আসীন, পায়ে আমাজোনীয় বুট, ছাতায় বিষুব রেখা অঞ্চলের বর্ণবিভা, আর যে সাহসটুকু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিগত কয়েক দিনে দেখাতে পারে নি এই শেষ মুহূর্তে সে তা দেখালো, সে হাত নেড়ে রোসাল্বাকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো, আর তিন রমণীই অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তাদের হাত নাড়ালো, আর তখন ফ্লোরেন্টিনোর সমস্ত অন্তর ব্যথায় মুচড়ে গেল, এই সাহস তার মনে আগে জাগে নি কেন! সে তাদেরকে গুদাম ঘরের পাশ দিয়ে মোড় ঘুরতে দেখলো, পেছন পেছন খচ্চরের পিঠে চলেছে তাদের ট্রাঙ্ক, তাদের টুপির বাক্স, শিশুর খাঁচা, একটু পরেই তাদের দেখা গেল খাড়া পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে পিঁপড়ার সারির মতো তারা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, তারপর তারা তার জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন ফ্লোরেন্টিনোর মনে হল ত্রিভুবনে সে একা, আর ফারমিনা ডাজার যে স্মৃতি বিগত কয়েকদিন সুকৌশলে লুকিয়ে ছিল সেটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মারাত্মক ঘায়েল করলো।
সে জানতো যে ফারমিনা ডাজার বিয়ে হবে খুব জাঁকজমকের সাথে। আর তখন যে মানুষটা ওকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসে, চিরকাল বাসবে, ওর জন্য মরবার অধিকারও সে মানুষটার থাকবে না। এত দিন ঈর্ষা তার অশ্রুজলের নিচে চাপা পড়ে ছিল, এবার তা ফ্লোরেন্টিনোর সমস্ত হৃদয় অধিকার করে নিলো। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো যে ব্যক্তি ওকে শুধু একটা সামাজিক অলঙ্কার হিসাবে বিয়ে করতে যাচ্ছে, ও যে মুহূর্তে তার প্রতি ওর ভালোবাসা ও আনুগত্যের শপথ নিতে যাবে ঠিক তখনই যেন ঈশ্বরের স্বর্গীয় ন্যায়বিচারের বিদ্যুৎ-বাণ ওর ওপর নিক্ষিপ্ত হয়। সে উল্লাসে আত্মহারা হয়ে তার কল্পনার নেত্রে দেখলো যে বধূ, যে হয় তার বধূ হবে নয় তো কারোই নয়, ক্যাথিড্রালের টালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, তার কমলার পুষ্পমঞ্জরী মৃত্যুর শিশিরে সিক্ত, আর তার শুভ্র ফেনার মতো ওড়নার বন্যা যে চৌদ্দ জন বিশপ গির্জার মূল বেদির সামনে সমাহিত হয়েছিলেন তাদের সমাধির পাথরগুলির ওপর আছড়ে পড়ছে। কিন্তু একবার তার প্রতিশোধ চরিতার্থ হবার পর সে তার নিজের জঘন্য আচরণের জন্য অনুতপ্ত হল, আর তখন সে দেখলো ফারমিনা ডাজা মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, ওর আত্মা অক্ষত, সুদূর কিন্তু জীবিত, কারণ ওকে ছাড়া তার পক্ষে এ পৃথিবীকে কল্পনা করা ছিল অসম্ভব। সে আর ঘুমাতো না, খাওয়া দাওয়াও প্ৰায় ছেড়ে দেয়। মাঝে মাঝে দু’এক টুকরা মুখে দেবার জন্য সে টেবিলে এসে বসতো মাত্র দুটি কারণে। কে জানে, ফারমিনা ডাজা হয়তো এই টেবিলে এসে বসবে। অন্য একটা কারণও ছিল, সে ওকে দেখিয়ে দেবে যে ওর জন্য সে উপোস করছে না। কখনো কখনো একটা সুনিশ্চিত বিশ্বাসের মধ্যে সে শান্তি খুঁজে পেতো। ওর বিয়ের বিপুল উত্তেজনার মধ্যেও, ওর মধুচন্দ্রিমার উন্মাতাল রাতগুলোর মধ্যেও, এক মুহূর্তের জন্য হলেও ওর প্রত্যাখ্যাত, লাঞ্ছিত, অপমানিত প্রেমিকের কথা ওর মনে পড়বে, আর তখন ওর সমস্ত সুখ ও আনন্দ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
কারাকোলি বন্দরে তাদের যাত্রা শেষ হবে। সেখানে পৌঁছবার আগের রাতে কাপ্তান চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী বিদায়ী পার্টির আয়োজন করলেন, নাবিকদের দিয়ে অর্কেস্ট্রার দল তৈরি হল, কাপ্তান জাহাজের সেতুর ওপর থেকে বাজি পোড়ালেন। গ্রেট ব্রিটেন থেকে আগত মন্ত্রী অনুকরণীয় সহনশীলতার সঙ্গে সফরের যাবতীয় কষ্ট সহ্য করলেন, তাঁর রাইফেল দিয়ে যে সব প্রাণীকে মারবার অনুমতি তাঁকে দেয়া হয় নি সে সব প্রাণীকে তিনি বিদ্ধ করলেন তাঁর ক্যামেরা দিয়ে। খাবার ঘরে একটি রাতও তাঁকে তাঁর পুরো সান্ধ্যস্যুট ছাড়া দেখা যায় নি, কিন্তু পার্টির রাতে তিনি হাজির হলেন ম্যাকটাভিশ গোষ্ঠীর ডোরাকাটা নানা রঙের বর্ণাঢ্য জামাকাপড় পরে, সবার আনন্দবিধানের জন্য তিনি ব্যাগপাইপ বাজালেন, উৎসাহী ব্যক্তিমাত্রকেই তাঁর নিজের দেশের জাতীয় নাচ শিখিয়ে দিলেন এবং সকাল নাগাদ নিজের অবস্থা এমন করে ফেললেন যে তাঁকে কোলে করে তাঁর ঘরে নিয়ে যেতে হয়। দুঃখ-বেদনায় মৃতপ্রায় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ডেকের সুদূরতম প্রান্তে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো, আনন্দ- উল্লাসের হৈচৈ সেখানে পৌঁছবে না, ঠাণ্ডায় তার শরীর প্রায় জমে যাবার উক্রম হলে সে লোটারিও থুগুটের দেয়া ওভারকোটটা গায়ে চাপালো। সকাল পাঁচটায় সে জেগে উঠেছিল, যেভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া বন্দি দণ্ড কার্যকর করার ভোরে জেগে ওঠে, তারপর সারা দিন ধরে সে, মিনিট-মিনিট করে, ফারমিনা ডাজার বিয়ের প্রতিটি ঘটনা কল্পনা করা ছাড়া আর কিছুই করে নি। পরে, দেশে ফিরে, সে জানতে পারে যে সময়ের হিসাবে সে ভুল করেছিল এবং যা যা সে কল্পনা করেছিল তার কিছুই ওভাবে ঘটে নি এবং তখন নিজের কল্পনার বাহার দেখে হেসে উঠবার মতো সুবুদ্ধিও সে ফিরে পেয়েছিল।
তবে সে দিনের ওই শনিবার ছিল প্রচণ্ড আবেগমথিত। সে যখন কল্পনা করলো যে নবদম্পতি বিয়ের প্রথম রাতের অনির্বচনীয় আনন্দের স্বাদ নেবার জন্য চোরা দরজা পথে একটা গোপন জায়গায় পালিয়ে যাচ্ছে তখন একটা নতুন সঙ্কটের উদয় হল। হু হু করে তার জ্বর এলো। তাকে জ্বরে কাঁপতে দেখে একজন কাপ্তানকে খবর দিল। কলেরা-আক্রান্ত হতে পারে আশঙ্কা করে কাপ্তান জাহাজের ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে পার্টি ত্যাগ করলেন, আর ডাক্তার অগ্রিম সাবধানতা অবলম্বন করে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে জাহাজের কোয়ারান্টাইন ক্যাবিনে পাঠিয়ে দিলেন। তার আগে তিনি তাকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিলেন। পর দিন সকালে কারাকোলির পাহাড়ের শৃঙ্গগুলি দেখা গেল, ফ্লোরেন্টিনোর জ্বরও অন্তর্হিত হল, তার মন-মেজাজেও খুশির হাওয়া বইলো, কারণ ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, টেলিগ্রাফের ভবিষ্যৎ যত উজ্জ্বলই হোক তার কিছু এসে যায় না তাতে, সে এই জাহাজেই ফিরে যাবে তার পুরনো ‘জানালার সড়কে।’
সে মহারানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধিকে তার ঘর ছেড়ে দিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ওরা সহজেই তার ফিরতি যাত্রার ব্যবস্থা করে দিল। কাপ্তান অবশ্য তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, জোর দিয়ে বলেছিলেন যে টেলিগ্রাফ হল ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁরা ইতিমধ্যে তাদের জাহাজগুলিতে ওই ব্যবস্থা প্রবর্তনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু সে কোনো যুক্তিতর্কে কর্ণপাত করলো না। শেষ পর্যন্ত কাপ্তান তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন, তার অব্যবহৃত ক্যাবিনের ভাড়ার মূল্য হিসাবে ততটা নয়, যতটা ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির সঙ্গে তার চমৎকার সম্পর্কের জন্য।
ভাটির পথে তাদের ফেরত যাত্রায় ছয় দিনও লাগলো না। জাহাজ খুব ভোরে মার্সিডিজের অগভীর জলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরেন্টিনোর মনে হল সে আবার ঘরে ফিরে এসেছে। সে জাহাজের পেছনে ঢেউ-এর দোলায় মাছ ধরার নৌকাগুলির আলোকমালার দোলানি দেখলো। উপসাগর থেকে কয়েক মাইল দূরে ওদের জাহাজ যখন নিনো পার্ডিডোর খালের মুখে ভিড়লো তখনও চারিদিক অন্ধকার। পুরনো স্পেনীয় খালগুলি নতুন করে খনন করে চলাচলের যোগ্য করার আগ পর্যন্ত নৌযানগুলির জন্য এটাই ছিল সর্বশেষ বন্দর। সকাল ছ’টা বাজা পর্যন্ত যাত্রীদের এখানে ছোট ছোট পালের নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ওই সব ভাড়া করা নৌকা তাদের চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বাড়ি পৌঁছবার জন্য এত ব্যগ্র হয়ে পড়েছিল যে সে ডাক বিভাগের নৌকায় ছ’টার অনেক আগেই রওনা হয়ে যায়। ওই নৌকার মাঝিরা তাকে নিজেদের লোক বলেই মনে করে। জাহাজ থেকে নামার আগে সে একটি প্রতীকী কাজ করার লোভ সংবরণ করতে পারলো না, সে তার বালিশ-বিছানা চাদর সব জলে ভাসিয়ে দিল, সেগুলি অদৃশ্য জেলেদের আলোকমালার পাশ দিয়ে ভাসতে ভাসতে খাল পেরিয়ে সমুদ্রের বুকে মিলিয়ে গেল। তার মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে তার সমগ্র জীবনের বাকি দিনগুলিতে তার আর এসবের প্রয়োজন কোন দিন হবে না। কারণ সে আর কোন দিন, কোন দিন, ফারমিনা ডাজার শহর ছেড়ে যাবে না।
সূর্য যখন উঠলো তখন উপসাগর শান্ত। ভাসমান কুয়াশার জালের ওপর দিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ক্যাথিড্রালের গম্বুজ দেখতে পেল, প্রভাতের প্রথম আলোকরশ্মি পড়ে ওই গম্বুজ সোনার মত জ্বলছে। সে সমতল ছাদগুলির ওপর পায়রাগুলির বাড়িঘর দেখতে পেল, আর তারই সূত্র ধরে মার্কুইস ডি কাসালডুয়েরোর প্রাসাদের বারান্দার অবস্থান নির্ণয় করলো। তার মনে হল তার দুর্ভাগ্যের হোত্রী বোধ হয় এখন ওই ভবনে তার পরিতৃপ্ত স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। একথা ভাবতেই তার বুক ভেঙ্গে গেল কিন্তু সে ওই ভাবনা তার মন থেকে দূর করার কোন চেষ্টা করল না, বরং তার যন্ত্রণার মধ্যে সে যেন আনন্দ পেল। বেশ ক’টি জাহাজ চারদিকে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্য দিয়ে সন্তর্পণে পথ করে ডাক বিভাগের নৌকা এগিয়ে চলেছে। প্রভাত সূর্য ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সরকারি বাজার এলাকা থেকে অগণিত বিচিত্র গন্ধ উঠে আসছে, এর সঙ্গে এসে মিশেছে উপসাগরের তলায় অনন্তকাল ধরে পচতে থাকা নানা জিনিসের দুঃসহ গন্ধ। রিওহাচার জাহাজ সবে মাত্র ভিড়েছে। মাল খালাস করা কুলীরা কোমর জল ভেঙ্গে জাহাজের পাশ দিয়ে যাত্রীদের কোলে করে তুলে এনে তীরে নামিয়ে দিচ্ছে। ডাক বিভাগের নৌকা থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সবার আগে লাফ দিয়ে তীরে নামলো, আর সেই মুহূর্ত থেকে সে আর এই শহরের উপসাগর এলাকার বিশ্রী নোংরা গন্ধ তার নাকে পেলো না, সে শুধু অনুভব করলো ফারমিনা ডাজার একান্ত ব্যক্তিগত সৌরভ। সবখানে সে ওর গন্ধ পেল।
সে টেলিগ্রাফ আপিসে ফিরে গেল না। মনে হল, সে শুধু একটি ব্যাপারেই এখন উৎসাহী। তার মা এখনো পপুলার লাইব্রেরির বইগুলি তাকে নিয়মিত কিনে দিতেন। সে ওই সব বই এবং ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত প্রেমের উপন্যাসগুলি রাত-দিন তার দোলনায় শুয়ে শুয়ে পড়তো, বারবার পড়ার ফলে সেগুলি তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সে তার বেহালার খোঁজও করলো না। সে তার সব চাইতে নিকট বন্ধুদের সঙ্গে আবার সম্পর্ক স্থাপন করলো, কখনো কখনো তাদের সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলতো, কখনো কখনো ক্যাথিড্রাল চত্বরে খোলা আকাশের নিচের ক্যাফেতে বসে ওদের সঙ্গে গল্প করতো, তবে সে আর শনিবারের নাচের আসরে কখনো যোগ দিতো না, ওকে ছাড়া সেখানে যাবার কথা সে কল্পনা করতে পারতো না।
তার নিষ্ফল সফরের শেষে শহরে ফিরে এসে প্রথম দিনেই সে শুনলো যে ফারমিনা ডাজা ইউরোপে মধুচন্দ্রিমা যাপন করছে। তার বিচলিত অন্তর তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে ও হয়তো সেখানেই বাস করবে, সারা জীবন না হলেও অনেক অনেক বছর তো বটেই। এই নিশ্চয়তা ওকে ভুলে যাবার আশা তার মনে প্রথম বারের মতো জাগিয়ে তুললো। তার মনে পড়লো রোসাল্বার কথা। একজনের স্মৃতি যত ধূসর হয়ে ওঠে অন্য জনের স্মৃতি তত উজ্জ্বল হতে থাকে। এই সময়েই সে গোঁফ রাখতে শুরু করে, তার প্রান্তদেশে মোম লাগায়, সারা জীবন সে ওই ভাবে গোঁফ রাখে আর তার পরিচর্যা করে, আর ওটাই তার সমস্ত সত্তাকে যেন রূপান্তরিত করে দেয়। আর, এক প্রেমের জায়গায় অন্য প্রেমকে বসানোর ব্যাপারটি তাকে নানা বিস্ময়কর পথে নিয়ে গেল। ধীরে ধীরে সে ফারমিনা ডাজার গন্ধ কম পেতে লাগলো, সে গন্ধের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে কমে এলো, অবশেষে সেটা সীমিত থাকলো শুধু গার্ডেনিয়া ফুলের মধ্যে।
তখনো যুদ্ধ চলছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অনির্দিষ্ট পথে ভেসে চলছে। তার জীবনকে নিয়ে কি করবে তা সে জানে না। এই সময়ে হঠাৎ একদিন বিধবা নাজারেত তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এলেন, তাঁর বাসভবন বিদ্রোহী সেনাপতি রিকার্ডো গাইতাম ওবেসোর কামানের গোলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ট্রানসিটো আরিজা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিলেন নিজের হাতে, বাড়িতে তাঁর জন্য অন্য কোথাও জায়গা নেই এই অজুহাতে তিনি তাঁকে ছেলের শোবার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন, যদিও মায়ের আসল আশা, অন্য একটা ভালোবাসার সাহায্যে যে-ভালবাসার তার ছেলেকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে সে ভালোবাসা থেকে সে মুক্তি পাবে। রোসাল্বার কাছে জাহাজের ক্যাবিনে তার কৌমার্য খোয়াবার পর ফ্লোরেন্টিনো আর কোন রমণীর সঙ্গ লাভ করে নি, তাই সে স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিয়েছিল যে বিধবা নাজারেত তার বিছানায় ঘুমাবে এবং সে নিজে শয্যা পাতবে তার দোলনায়। কিন্তু মহিলা তার হয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বিছানার এক কিনারায় বসলেন, ফ্লোরেন্টিনো তখন শুয়েছিল, সে কি করবে বুঝতে পারছিলো না, আর তখন মহিলা তিন বছর আগে প্রয়াত তাঁর স্বামীর জন্য নিজের গভীর শোকের কথা বলতে শুরু করলেন এবং কথা বলবার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর পোশাকে বৈধব্যের নিদর্শনগুলি একে একে খুলে ফেলতে লাগলেন। সব তিনি এদিকে-ও দিকে ছুড়ে ফেললেন, তাঁর বিয়ের আংটিও আর তাঁর আঙ্গুলে রইলো না। কাচবসানো এম্ব্রয়ডারি করা তাঁর ট্যাফেটার ব্লাউজটি খুলে ঘরের এক কোণে রাখা ইজিচেয়ারের উপর তিনি সেটা ছুড়ে দিলেন, এক টানে তিনি তার কুঁচিদেয়া লম্বা স্কার্টটি খুলে ফেললেন, পিঠের উপর দিয়ে তাঁর বডিস ছুড়ে দিলেন বিছানার অন্য পাশে, তিনি খুলে ফেললেন তাঁর সার্টিন গার্টারের বেল্ট আর কালো মোজা, সব তিনি ছুড়ে ফেললেন ঘরের মেঝের উপর, তাঁর শোকের শেষ নিদর্শনগুলিতে ঘরের মেঝে অবকীর্ণ হয়ে গেল। আর এই সব কিছু তিনি করলেন আনন্দের সঙ্গে, চমৎকার হিসেব করা বিরতি দিয়ে। ওদিকে আক্রমণকারী সেনাদলের কামানের গোলায় শহরের ভিত কেঁপে উঠলেও, মনে হল, ওই গোলাধ্বনি যেন রমণীর প্রতিটি ভঙ্গিকে অভিবাদন জানাচ্ছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাঁর ব্রা খুলতে তাকে সাহায্য করতে যাচ্ছিল কিন্তু তিনি তার আগেই দ্রুত নিপুণ হাতে কাজটা সমাধা করে ফেললেন। পাঁচ বছরের বিবাহিত আনুগত্যের সময় প্রেমের প্রতিটি পর্বে তিনি স্বনির্ভর হতে শিখেছিলেন, এমনকি প্রাথমিক পর্বেও কারো কাছ থেকে তাঁর কোন সাহায্য নিতে হয় নি। এবার সাঁতারুর নিপুণ ভঙ্গিতে তিনি এক ঝটকায় তাঁর পা গলিয়ে তাঁর লেসের প্যান্টি মাটিতে ফেলে দিলেন। তিনি এখন সম্পূৰ্ণ নগ্ন।
আঠাশ বছর বয়স তাঁর, তিন বার সন্তানের জন্ম দিয়েছেন কিন্তু তাঁর নগ্ন দেহে এখনো বিরাজ করছে এক অনূঢ়া মেয়ের উন্মাতাল উত্তেজনা। মাত্র কয়েকটি শোকার্ত কাপড় জামা এই উদ্দাম ঘোটকীর গোপন যৌনতাড়না কিভাবে লুকিয়ে রেখেছিল তা ফ্লোরন্টিনো আরিজা কোন দিন বুঝতে পারে নি। নিজের উত্তপ্ত কামনায় প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তিনি আপন হতে ফ্লোরেন্টিনোর কাপড় খুলে দিলেন, যে-কাজটি তাঁর স্বামীর ক্ষেত্রে কোন দিন করতে পারেন নি, কারণ তাহলে তাঁর স্বামী ভাবতো তিনি বিকৃত রুচির, পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মেয়ে মানুষ। এখন তিনি পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনের বিভ্রান্তি ও বিশ্বস্ততা আর গত তিন বছরের শোকপালনের কঠোর সংযমের মূল্য তুলে নিতে চাইলেন একটা তীব্র আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে। অথচ তাঁর মা তাঁকে জন্মদানের পর থেকে আজ রাতের আগে পর্যন্ত তাঁর মৃত স্বামী ছাড়া আর কারো শয্যাসঙ্গিনী তিনি হন নি। অনুশোচনার কুরুচিকে তিনি প্রশ্রয় দিলেন না। বরং উল্টোটা করলেন। বাড়ির উপর দিয়ে তখন শত্রুপক্ষের গুলি-গোলা হুশ হুশ করে ছুটে যাচ্ছে, আর তিনি সকাল পর্যন্ত সারা রাত ধরে তাঁর প্রয়াত স্বামীর গুণগান করলেন, তাঁর বিরুদ্ধে শুধু একটা অভিযোগই জানালেন, কেন তিনি তাঁকে ছেড়ে আগে চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর দুঃখ প্রশমিত হল একটা কারণে। এখন তাঁর স্বামী তিন ইঞ্চি লম্বা একডজন পেরেক পোঁতা কফিনে দুই মিটার মাটির নিচে শুয়ে আছেন, আর বিধবা নাজারেতের মনে হল এখন তিনি তাঁর যতোটা নিজস্ব, একান্ত ভাবে তাঁর যতোটা আপনার, তেমন তিনি কখনো ছিলেন না।
তিনি বললেন, ‘আমি সুখী, কারণ এখনই আমি নিশ্চিত জানি তিনি যখন বাড়িতে নেই তখন কোথায় আছেন।’
ওই রাতেই তিনি বৈধব্যের সব নিদর্শন পরিত্যাগ করেন, চিরকালের জন্য। তিনি কোন মধ্যবর্তী অবস্থা অতিক্রম করলেন না, ছোট ছোট ধূসর ফুল বসানো ব্লাউজ গায়ে দিলেন না। তিনি তাঁর জীবনকে পূর্ণ করে তুললেন প্রেমসঙ্গীত আর বর্ণাঢ্য টিয়াপাখি ও ঝুঁটিদার প্রজাপতির ছবি আঁকা সাজপোশাক দ্বারা, আর যে কেউ প্রার্থনা করলেই তিনি তার সঙ্গে তার দেহের আনন্দ দ্বিধাহীন চিত্তে ভাগ করে নিতে লাগলেন। তেষট্টি দিন অবরোধের পর জেনারেল গাইতাম ওবেসোর সেনাদল যখন পরাজয় বরণ করল তখন তিনি কামানের গোলাবর্ষণে ধ্বংসপ্রাপ্ত তাঁর বাসভবন পুনর্নির্মাণ করলেন, সেখানে নতুন যোগ করলেন একটা সমুদ্র-চত্বর, ওখান থেকে একেবারে কাছেই দেখা যায় সমুদ্রের উচ্ছল তরঙ্গমালা, ঝোড়ো দিনে তার শুভ্র ফেনা উচ্ছ্বসিত হয়ে এ জায়গাটা ভিজিয়ে দেয়। কোন রকম ব্যঙ্গ ছাড়াই তিনি এ জায়গাটি আখ্যায়িত করতেন তাঁর প্রেমনীড় বলে এবং এখানেই তিনি অভ্যর্থনা জানাতেন শুধু সেসব পুরুষকে যাদের তিনি পছন্দ করতেন, যখন তিনি চাইতেন, যেভাবে তিনি চাইতেন, আর এই সঙ্গদানের জন্য তিনি তাদের কাছ থেকে একটি পয়সাও নিতেন না, কারণ তাঁর চোখে ওরাই তাঁকে অনুগৃহীত করছিল। মধ্যে মধ্যে দু’একটা উপহার তিনি গ্রহণ করতেন, তবে কখনোই কোন সোনার জিনিস নয়। তিনি তাঁর ইত্যাকার কর্মকাণ্ড এমন সুকৌশলে পরিচালিত করতেন যে তাঁর অশোভন আচরণ সম্পর্কে কারো পক্ষেই কোন প্রামাণিক সাক্ষ্য উপস্থিত করা সম্ভব ছিল না। শুধু একবার তিনি একটা বড়ো রকম কলঙ্কের পদপ্রান্তে এসে পড়েছিলেন, যখন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে আর্চবিশপ দান্তে ডি লুনা ভুলক্রমে, না জেনে, বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা খেয়ে মারা যান নি, আসলে তিনি জেনেশুনেই সেটা খান, কারণ বিধবা নাজারেত তাঁকে শাসায়, তিনি যদি তাঁকে তাঁর ধর্মবিগর্হিত প্রেম নিবেদন বন্ধ না করেন তাহলে তিনি তাঁর ওই আচরণের কথা সবাইকে বলে দেবেন। নাজারেত গলা ফাটিয়ে হাসতে হাসতে প্রায়ই বলতেন যে সমগ্র প্রদেশে তিনিই একমাত্র মুক্ত স্বাধীন রমণী।
মাঝে মাঝে তিনি পূর্ব নির্ধারিত সময় ও স্থানে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে মিলিত হতেন। সব চাইতে ব্যস্ত থাকার সময়েও তিনি তা থেকে বিরত থাকতেন না, আর এই মিলনের পেছনে ভালোবাসা দেবার বা পাবার কোনো ভান ছিল না, যদিও তার মধ্যে সর্বদা ভালবাসার মতোই অথচ ভালোবাসার সমস্যামুক্ত একটা কিছু পাবার আশা সর্বদাই বিরাজ করতো। কখনো কখনো ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাঁর বাড়ি যেতো, তখন তারা সমুদ্র-চত্বরে বসতো, সমুদ্রের লবণাক্ত হাওয়া আর ফেনাপুঞ্জে সিক্ত হত, আর দিগন্তের কোলে সমগ্র পৃথিবীর জন্য জেগে উঠতে দেখতো রক্তিম প্রভাতী সূর্যকে। তার সকল অধ্যবসায় নিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অস্থায়ী হোটেলের ঘুলগুলি দিয়ে দেখা কমাকলার বিবিধ প্রক্রিয়া তাঁকে শেখাবার চেষ্টা করে, লোটারিও থুগুটের লাম্পট্য বিষয়ক তত্ত্বাবলী তাঁকে ব্যাখ্যা করে শোনায় কিন্তু এসব কোনো কাজে এলো না। আসলে বিধবা নাজারেত নিঃশঙ্ক শিক্ষানবিস হলেও পরিচালিত যৌনকর্মের ক্ষেত্রে তাঁর কোন প্রতিভা ছিল না। বিছানার মধ্যে যে একটা স্নিগ্ধ মাধুর্য আছে তা তিনি কখনো উপলব্ধি করেন নি, এক মুহূর্তের জন্যও তিনি কোন উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেন নি, আর তাঁর যৌন উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছে যেতো অসময়ে, শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে তার মধ্যে কোনো অনুপ্রেরণার বিদ্যুৎঝলক ছিল না। বহুকাল যাবৎ ফ্লোরেন্টিনো ভাবতো সেই বুঝি তাঁর একমাত্র প্রেমিক, তিনিও তার ওই বিশ্বাসে সমর্থন যুগিয়ে যেতেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একদিন ঘুমের মধ্যে তাঁর অস্ফুট উচ্চারণ ফ্লোরেন্টিনোর ভুল ভাঙ্গিয়ে দিল। একটু একটু করে সে তাঁর কথাগুলি জোড়া দিয়ে তাঁর প্রেমযাত্রার একটা মানচিত্র এঁকে ফেলে এবং তখন সে তাঁর গোপন জীবনে অগণিত দ্বীপের মধ্য দিয়ে তার নৌযান চালিয়ে নেয়। এই ভাবে সে অবহিত হয় যে তিনি তাকে বিয়ে করতে চান না, কিন্তু তিনি অনুভব করেন যে তাঁর জীবন ফ্লোরেন্টিনোর জীবনের সঙ্গে যুক্ত, আর এই দুর্নীতির সাগরে তাঁকে নিক্ষেপ করার জন্য তিনি তার কাছে অপরিসীম কৃতজ্ঞ। তিনি তাঁকে লক্ষ্য করে প্রায়ই বলতেন, ‘আমি তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি, কারণ তুমিই আমাকে বারাঙ্গনা বানিয়েছো।’
অন্য দিক থেকে দেখলে, নাজারেতের কথা যথাযথই। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটা গতানুগতিক বিয়ের শূচিতা থেকে তাঁকে মুক্ত করেছে, যেটা ছিল জন্মগত অথবা বৈধব্যের বাধ্যতামূলক শূচিতার চাইতেও ক্ষতিকর। তার কাছ থেকেই তিনি শেখেন যে শয্যায় একটি মানুষ যা করে তা যদি প্রেমকে স্থায়িত্ব দিতে সাহায্য করে তা হলে সেটা কোনক্রমেই অনৈতিক নয়। তিনি তার কাছ থেকে আরো একটি জিনিস শেখেন : প্রতিটি মানুষ একই পৃথিবীতে জন্ম নেয় একটা প্রাক-নির্ধারিত সংখ্যক যৌনক্রিয়া সম্পাদনের জন্য এবং কেউ যদি তার কারণে বা অন্য কারো কারণে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তার জন্য নির্ধারিত দিনক্ষণ ব্যবহার না করে তাহলে তা চিরতরে হারিয়ে যায়। মহিলার কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি তার কথা আক্ষরিক অর্থে সত্য বলে ধরে নেন। ফ্লোরেন্টিনোর ধারণা, সেই তাকে সবার চাইতে বেশি ভালো জানে, তবু একটা জিনিস সে বুঝতে পারে না। তাঁর মতো অকিঞ্চিৎকর সম্পদের অধিকারী এক মহিলা, যিনি আবার ঘুমের মধ্যে তাঁর মৃত স্বামীর জন্য তাঁর বেদনার কথা বিড়বিড় করে সারাক্ষণ বলেন, তিন কি করে এতো জনপ্রিয় হন। সে এর একটা ব্যাখ্যাই খুঁজে পেলো, দাম্পত্যকলায় তাঁর যেটুকু ঘাটতি ছিল তিনি সেটা পূরণ করে নিতেন তাঁর কোমলতা ও মমত্ব দ্বারা। তিনি যখন ধীরে ধীরে তাঁর দিগন্ত প্রসারিত করলেন, সেও যখন তার সম্ভাবনাগুলি কাজে লাগাতে আরম্ভ করলো, তখন তাদের সাক্ষাতের পালা ক্রমে কমে আসে এবং এক সময় কোন দুঃখবোধ ছাড়াই তারা পরস্পরকে ভুলে গেল।
ওটাই ছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজার শোবার ঘরে প্রথম প্রেম। কিন্তু ওর মার প্রত্যাশানুযায়ী তাদের মধ্যে কোন স্থায়ী মিলনের সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরিবর্তে তারা দুজন নিজ নিজ ধারায় একটা উচ্ছৃঙ্খল অমিতাচারের পথে অগ্রসর হল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিল কৃশকায় ও স্বল্পভাষী, সে কাপড় জামা পরতো পুরনো যুগের কোনো বুড়ো মানুষের মতো। সে সাফল্যের সঙ্গে যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করলো তা বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। অবশ্য তার দুটো সুবিধা ছিল। এক, সে ভিড়ের মধ্যেও সঠিক রমণীটিকে নির্ভুল ভাবে চিনে নিতে পারতো, বুঝতে পারতো যে সে তারই জন্য অপেক্ষা করে আছে, যদিও তা সত্ত্বেও সে তার ভালোবাসা চাইতো বেশ সতর্কতার সঙ্গে, কারণ প্রত্যাখ্যাত হবার মত অবমাননাকর কোন কিছু সে কল্পনা করতে পারতো না, মানুষকে তা খুবই ছোট করে দেয়। দুই, রমণীরা দ্রুত তাকে চিহ্নিত করে ফেলতো একজন নিঃসঙ্গ পুরুষ রূপে, ভালোবাসা যার জন্য খুবই দরকারি, যে বেত্রাহত কুকুরের মতো এক পথের ভিখারি এবং এর ফলে নিঃশর্ত ভাবে তারা তার কাছে নিজেদের সমর্পণ করতো, তার কাছে তারা কিছুই চাইতো না, তারা যে তাকে অনুগ্রহ করছে এইটুকু জানার প্রশান্তির অতিরিক্ত তাদের আর কোন চাহিদা ছিল না। এ দুটোই ছিল তার একমাত্র অস্ত্র এবং এই অস্ত্র সম্বল করে সে চরম গোপনীয়তার সঙ্গে তার ঐতিহাসিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হল। একজন দলিল লিখিয়ের অধ্যবসায় ও যত্ন নিয়ে সে একটা সাংকেতিক বই-এ তার ওই সংগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করলো, আর ওই বইটির নাম দিল : ‘রমণীরা।’ তার প্রথম ভুক্তি হল বিধবা নাজারেত। পঞ্চাশ বছর পর, ফারমিনা ডাজা যখন তাঁর ধর্মীয় অনুজ্ঞা থেকে মুক্ত, তখন তার নোট বই- এর সংখ্যা দাঁড়ায় পঁচিশে, দীর্ঘকালীন সম্পর্কের ভুক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়শো বাইশে, আর ক্ষণিক দ্রুত-বিস্মৃত অনুল্লেখযোগ্য সম্পর্কের সংখ্যা হয় অগণিত।
বিধবা নাজারেতের সঙ্গে ছয় মাসের প্রচণ্ড প্রেমলীলার পর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে এবার সে ফারমিনা ডাজার দহন যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। ফারমিনা ডাজার দু’বছর বিবাহোত্তর ইউরোপ ভ্রমণের সময় সে এ ব্যাপারে এতটাই আস্থাবান ছিল যে ট্রান্সিটো আরিজার সঙ্গেও সে এ নিয়ে কয়েকবার আলাপ করেছে। একটা সীমাহীন মুক্তির অনুভূতি নিয়ে সে তার ওই বিশ্বাসে অটল ছিল, কিন্তু এক নিয়তি-নির্ধারিত রবিবারে, কোন রকম প্রাক-সতর্ক সঙ্কেত ছাড়াই, তার ওই বিশ্বাস ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। সে ফারমিনা ডাজাকে তার স্বামীর বাহুলগ্না হয়ে, উপাসনা শেষে, গির্জা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলো, তার নতুন ভুবনের ঔৎসুক্য ও চাটুকারিতা তাকে চারপাশে থেকে ঘিরে ধরেছে। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন অভিজাত পরিবারের যেসব রমণীরা একদিন তার প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেছিল, তাদের সমকক্ষ হওয়ার প্রত্যাশী এক ভূঁইফোড় মেয়ে বলে বিদ্রূপ করেছিল, তাদেরকেই সে আজ তার মাধুর্য ও আকর্ষণীয় ক্ষমতা দিয়ে বিহ্বল করে ফেলেছে। একজন অভিজ্ঞ সাংসারিক মহিলার ভাবভঙ্গি এখন তার এতটাই নিখুঁত আয়ত্তাধীন দেখা গেল যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার তাকে চিনতে একটু সময় লাগে। পায়ে লম্বা বুট, মাথার হ্যাটে সামনের দিকে পাতলা কাপড় আর প্রাচ্যের কোন পাখির রঙিন পালক, ভাবভঙ্গিতে একজন পরিণত বয়স্ক মহিলার স্থৈর্য : সে এক ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। তার সব কিছুই ছিল বৈশিষ্ট্যময় আর আত্মপ্রত্যয়ী, যেন জন্ম থেকেই সে এই পরিবেশে বড় হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনোর কাছে তাকে মনে হল আগের চাইতে বেশি সুন্দর, বেশি তারুণ্য ভরা, কিন্তু সেই সঙ্গে মনে হল যে সে তার কাছ থেকে আরো দূরে সরে গেছে, যদিও এর প্রকৃত কারণটা বুঝতে তার একটু সময় লাগে। যখন ফারমিনা ডাজার সিল্কের জামার নিচে ওর পেটের ডৌলটা তার চোখে পড়লো তখন সে উপলব্ধি করলো যে ও ছয় মাসের গর্ভবতী। কিন্তু একটা জিনিস তার মনের ওপর সব চাইতে বেশি দাগ কাটলো : ওরা স্বামী-স্ত্রী এক অসম্ভব সুন্দর দম্পতি হয়ে উঠেছে, এবং সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে তারা এমন একটা সাবলীল ও স্নিগ্ধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে যে, মনে হল, বাস্তবতার কোন বিপদই তাদের কখনো স্পর্শ করতে পারবে না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোন ক্রোধ বা ঈর্ষা অনুভব করল না, শুধু নিজের প্রতি চরম অবজ্ঞায় তার হৃদয় পূর্ণ হল। সে দরিদ্র, কুদর্শন, ক্ষুদ্র, শুধু তাই নয়, এই পৃথিবীতে কোন মেয়েরই সে যোগ্য নয়।
তাহলে সে ফিরে এলো। তার জীবনের আকস্মিক পরিবর্তনের জন্য কোন অনুতাপের কারণ ছাড়াই সে ফিরে এলো। তার প্রথম দিকের জীবনের অসুবিধাগুলি সে যেভাবে অতিক্রম করে তা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সে তার বিয়ের রাতে উপস্থিত হয়েছিল অত্যন্ত সরল অনভিজ্ঞতা নিয়ে, তবু সে সব কিছু সামলে নেয় এবং ধীরে ধীরে দুঃখিত বা অনুতাপ বোধ করার কারণ ক্রমেই কমে আসতে থাকে। খালাতো বোন হিল্ডাব্রান্ডার প্রদেশে বেড়াবার সময় সে প্রথম ওই বোধ থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। অবশেষে ভালেদুপারে পৌঁছে সে বুঝতে শিখলো কেন রাতামোরগ মুরগিগুলির পেছন পেছন ছোটে, সে গর্দভদের নিষ্ঠুর আনুষ্ঠানিক উৎসব প্রত্যক্ষ করল, বাছুরের জন্মগ্রহণ প্রক্রিয়া দেখল, আর তার জ্ঞাতি-বোনদের অতি স্বাভাবিক ভাবে আলোচনা করতে শুনলো পরিবারের বিভিন্ন দম্পতিবর্গের যৌন জীবন সম্পর্কে, কারা এখনো তাদের মিলন অব্যাহত রেখেছে, কারা তা বন্ধ করে দিলেও এখনো একসঙ্গে বাস করছে। এই সময়েই সে একক নিঃসঙ্গ ভালোবাসায় প্রথম দীক্ষা লাভ করে, যদিও তার সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে এটা তার প্রথম থেকেই জানা ছিল, সে বিছানায়, আধডজন বোন একই ঘরে শুয়ে আছে, আর সে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে আছে পাছে অন্যরা ব্যাপারটা টের পেয়ে যায়, আর তার পর আগ্রহ ও দুশ্চিন্তা নিয়ে সে ওই অনুভূতির স্বাদ গ্রহণ করে বাথরুমের মেঝেতে এলিয়ে পড়ে থেকে, চুল খোলা, ঠোঁটের দু’ফাঁকে খচ্চর চালকদের সিগারেট। কিন্তু সে সর্বদাই এ কাজটা করার সময় তার বিবেক কর্তৃক দংশিত হত, একমাত্র বিয়ের পরই সে তা থেকে মুক্ত হয়। ফারমিনা ডাজা সব সময় একান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ওটা করতো, যদিও তার কাজিনরা দিনে কার কতোবার যৌন উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছিল শুধু যে তাই আলোচনা করতো তাই-নয়, তার আকার ও প্রকৃতি নিয়েও গল্প করতো। কিন্তু ওই সব প্রথম আনুষ্ঠানিকতার জাদুকরি আকর্ষণ সত্ত্বেও কুমারিত্ব বিসর্জন দানের ব্যাপারটা একটা রক্তাক্ত বলিদানের মতোই তার কাছে সর্বদা মনে হয়েছে।
তার বিয়ে ছিল বিগত শতাব্দির সব চাইতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম, কিন্তু তার জন্য সেটা ছিল একটা মহা আতঙ্কের পূর্বসূরি। সে সময়ের অতুলনীয় ও সব চাইতে আকর্ষণীয় যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে, এই ঘটনা সমাজে একটা বিরাট আলোড়ন তুলেছিল কিন্তু তার মধুচন্দ্রিমার ভাবনা তাকে ওর চাইতে বেশি আলোড়িত করেছিল। ক্যাথিড্রালে হাই ম্যাস প্রার্থনার শেষে তার বিয়ের বিজ্ঞপ্তি ঘোষিত হবার পর ফারমিনা ডাজা বেনামী চিঠি পেতে শুরু করে, কয়েকটা চিঠিতে তাকে মৃত্যুর ভয় দেখানো হয়, কিন্তু সে তখন তার আশু কুমারিত্ব খোয়াবার ভয়ে এত কাতর ছিল যে ওইসব চিঠিকে সে পাত্তা দেয় নি, অসচেতন ভাবে করলেও সেটাই ছিল ওই জাতীয় চিঠি মোকাবেলা করার সর্বোত্তম পন্থা। ওই জাতীয় চিঠির লেখকরা ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য ঘটনার সামনে নতি স্বীকারে ছিল অভ্যস্ত। তারা যখন দেখলো যে ওই বিয়ে কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না তখন তাদের আচরণ পরিবর্তিত হল। ক্ষোভ, বিদ্বেষ ও বাতে জর্জরিত বিবর্ণ রমণীরা তাদের সকল ষড়যন্ত্রের নিরর্থকতা উপলব্ধি করার পর কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই ইভানজেলস পার্কে এসে সমবেত হল, যেন ওটা তাদের নিজের বাড়ি, আর তারা সঙ্গে আনলো বাগদানের নানা উপহার ও বিভিন্ন রকম রান্নার ব্যবস্থাপত্র। এই জগতের সঙ্গে ট্রান্সিটো আরিজা সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর খদ্দেররা যে বিরাট কোন অনুষ্ঠানের আগে সর্বদা তাঁর দরজায় এসে হাজির হয়, বন্ধক দেয়া নিজেদের অলঙ্কারই চব্বিশ ঘণ্টার জন্য আবার ধার নেয়, তার জন্য বাড়তি সুদ দেয়, এটা তাঁর জানা ছিল, কিন্তু এবার তিনি নিজে সম্পর্কিত হয়ে গেলেন এর সঙ্গে। আর এতো ব্যাপক আকারে এটা আগে কখনো ঘটে নি। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দীর্ঘ পারিবারিক নামধারী মহিলারা তাঁদের ছায়াচ্ছন্ন আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের অলঙ্কার পুনর্বার ধার করে উদ্ভাসিত মুখে ফিরে গেলেন, একটা অসাধারণ গৌরবদীপ্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁরা হাজির হবেন, শতাব্দির বাকি সময়ের মধ্যে যে রকম অনুষ্ঠান আর দেখা যাবে না। গৌরবটা চূড়ান্ত রূপ নিলো যখন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির আসনে তিনবার আসীন ডক্টর রাফায়েল নুনেজ, কবি, দার্শনিক, জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, ফারমিনা ডাজার ধর্মপিতা হিসাবে উপস্থিত হলেন। ফারমিনা তার বাবা লোরেঞ্জো ডাজার বাহু জড়িয়ে ক্যাথিড্রালের প্রধান বেদিতে এসে দাঁড়ালো। ওই বিশেষ দিনের জন্য পরা আনুষ্ঠানিক পোশাক লোরেঞ্জো ডাজাকে একটা দ্ব্যর্থবোধক মর্যাদায় ভূষিত করেছে। হোলি ট্রিনিটির দিন সকাল এগারোটায় ক্যাথিড্রালের প্রধান বেদিতে ফারমিনার বিয়ে হয়ে গেল চিরকালের জন্য, আর ওই সময়ে তার মনে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জন্য একটি সহৃদয় ভাবনাও জাগে নি। ওই মুহূর্তে ফ্লোরেন্টিনো জ্বরে প্রলাপ বকছিল, তার জন্য মরতে বসেছিল, ছাদবিহীন একটা নৌকায় শুয়ে, যে নৌকা তাকে বিস্মৃতির সাগরে নিয়ে যেতে পারবে না। বিয়ের অনুষ্ঠান এবং তার পরবর্তী অতিথি আপ্যায়নের সময় ফারমিনার মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ঝুলেছিল, একটা নিষ্প্রাণ ভঙ্গি দেখা যায় সেখানে, কেউ কেউ সেটাকে মনে করে বিজয়ীর ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গি অথচ আসলে তা ছিল একটি কুমারী অক্ষতযোনি বধূর আতঙ্ক ঢাকবার একটা দুর্বল প্রয়াস।
সৌভাগ্যবশত কয়েকটি অদৃষ্টপূর্ব পরিস্থিতি এবং তার স্বামীর বিবেচনা বোধের জন্য প্রথম তিন রাত্রি কোন রকম ব্যথা-বেদনা ছাড়াই কেটে যায়। এটা ছিল দৈবের অনুগ্রহ। ক্যারিবীয় অঞ্চলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য জেনারেল ট্রান্স-আটলান্টিক কোম্পানির যাত্রাসূচির পরিবর্তন করতে হয়। আগে কথা ছিল বিয়ের পর দিনই জাহাজ বন্দর ত্যাগ করবে এবং বরবধূ ওই জাহাজে লা রোশেল যাত্রা করবে। এই সিদ্ধান্ত ছয় মাস আগেই নেয়া হয়। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাত্রার সময় এগিয়ে আনা হয়, মাত্র তিন দিনের আগাম নোটিশে। নতুন সূচি অনুসারে বিয়ের রাতেই জাহাজ যাত্রা করবে। এই বিয়ে ইতিমধ্যে এত চমৎকার সব বিস্ময় উপহার দিয়েছিল যে এটাও যে সে রকম কিছু নয় কেউ তা বিশ্বাস করতে চাইলো না। অতিথি আপ্যায়ন শেষ হল উজ্জ্বল আলোচিত সমুদ্রগামী জাহাজের বুকে। এই সমুদ্র যাত্রায় সুরশিল্পী য়োহান স্ট্রাউসের নতুন কয়েকটি ওয়াল্টজ প্রথম বারের মতো বিশ্ব-উদ্বোধন হিসাবে ভিয়েনার একটি অর্কেস্ট্রা দল কর্তৃক পরিবেশিত হয়। জাহাজের বুকে অনুষ্ঠিত এই আপ্যায়ন অনুষ্ঠানে অতিথিবর্গ প্রচুর শ্যাম্পেন পানে টলোমলো হয়ে যান, স্ত্রীরা স্বামীদের হাত ধরে জাহাজ থেকে তাদের নামিয়ে আনেন, কোন কোন অতিথি স্টুয়ার্ডদের কাছে খোঁজ নিতে থাকেন, খালি ঘর আছে নাকি, তাহলে তারাও এই জাহাজে আনন্দ উৎসব করতে করতে পারী পর্যন্ত যাবে। জাহাজ থেকে সবার শেষে যারা নেমে এলেন তারা বন্দরের সরাইখানার বাইরে রাস্তার মধ্যখানে মাটির উপর বসে থাকতে দেখলেন লোরেঞ্জো ডাজাকে, তার পোশাকের অবস্থা করুণ, তিনি হাউ হাউ করে উচ্চ কণ্ঠে কাঁদছেন, আরবরা যেভাবে তাদের স্বজন বিয়োগে কাঁদে সেই ভাবে, তিনি বসে আছেন নোংরা কাদা জলের মধ্যে, যে জল তার নিজের অশ্রুসঞ্জাত হতেই পারে।
উত্তাল সমুদ্রবক্ষে প্রথম রাতে নয়, প্রশান্ত সমুদ্রযাত্রার পরবর্তী রাতগুলিতেও নয়, বস্তুতপক্ষে তার দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের কোন সময়েই, ফারমিনা ডাজা যে বর্বরোচিত অভিজ্ঞতার ভয় করছিলো তাকে সে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পার হতে হয় নি। জাহাজটির বিশাল আকার ও রাজকীয় কক্ষের বিলাসবাহুল্য সত্ত্বেও সফরের প্রথম রাত ছিল রিওহাচার সেই পালের জাহাজের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি। ফারমিনা ডাজা প্রবল সমুদ্রপীড়ায় আক্রান্ত হল। তার দক্ষ চিকিৎসক স্বামী নিজে সারা রাত জেগে তার দেখাশোনা করলেন, যে কাজটি তিনি খুব ভালো ভাবে করতে জানতেন। তৃতীয় দিনে, গুইয়ারা বন্দর অতিক্রম করার পর, ঝড়ের দাপট কমে আসে, কিন্তু ততক্ষণে তারা দুজন একত্রে এতটা সময় কাটিয়ে দিল এবং এত গল্প করেছিল যে তাদের মনে হল তারা যেন অনেক দিনের বন্ধু। চতুর্থ রজনীতে, যখন উভয়ে তাদের স্বাভাবিক অভ্যাসে আবার ফিরে যান তখন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে তাঁর তরুণী ভার্যা শোবার আগে কোন প্রার্থনা করল না।
ফারমিনা তাঁর কাছে কিছু লুকালো না। সে তাঁকে বলল যে নানদের তথা গির্জার সন্ন্যাসিনীদের কপটতা তার মনে আনুষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কিন্তু তার ধর্মবিশ্বাস অক্ষুণ্ণ ও অটুট আছে এবং নীরবতার মধ্যে সে তা ধরে রাখতে শিখেছে। সে বলল, ‘আমি ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেই বেশি পছন্দ করি।’ ডাক্তার তার যুক্তি অনুধাবন করেন এবং এর পর থেকে তারা উভয়েই একই ধর্ম পালন করতে থাকেন, কিন্তু নিজ নিজ পদ্ধতিতে। এই সময়ে ইতিপূর্বে তাদের একটা সংক্ষিপ্ত বাগদান পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ডাক্তার প্রতি দিন সন্ধ্যায় ফারমিনাদের বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতেন, কোন অভিভাবকের উপস্থিতি ছাড়াই, তবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবার আগে ফারমিনা ডাজা ভাবী স্বামীকে তার আঙ্গুলের ডগা স্পর্শ করার অনুমতিও দিত না, এবং তিনি তা করার চেষ্টাও করেন নি। সমুদ্রবক্ষে প্রথম শান্ত রাতে ডাক্তার তাকে আদর করতে শুরু করেন। দুজনেই বিছানায় শুয়ে আছে কিন্তু দুজনেই কাপড়জামা পরা। ডাক্তার এত কোমলতার সঙ্গে আদর করতে করতে তাকে তার রাতকামিজ পরে নিতে বললেন যে ওর কাছে ওই পরামর্শ খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হল। সে কাপড় বদলাবার জন্য বাথরুমে গেল কিন্তু যাবার আগে শোবার ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিল, তারপর শুধু শেমিজ গায়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার সব ফাঁক-ফোকর নানা কাপড় গুঁজে বন্ধ করে দিল যেন সে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বিছানায় ফিরতে পারে। সে সহাস্যে বলল, ‘আপনি কি আশা করেন, ডাক্তার? আমি এই প্রথম একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে শুতে যাচ্ছি।’
ডাক্তার উরবিনো অনুভব করলেন যে একটা চমকিত ছোট্ট জন্তুর মতো সে তার পাশে শুয়ে পড়েছে। বাঙ্কটা ছিল ছোট, সরু, পরস্পরকে স্পর্শ না করে সেখানে দুজন মানুষের পক্ষে শোয়া ছিল কষ্টকর। ফারমিনা যথাসম্ভব দূরে সরে থাকতে চেষ্টা করল। ডাক্তার তার হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন, ভয়ে ঠাণ্ডা ও থরথরো কম্পমান হাত, তিনি তার আঙ্গুলের মধ্যে নিজের আঙ্গুল জড়ালেন, তারপর মৃদু কণ্ঠে প্রায় কানে কানে বলার মতো করে তাঁর বিভিন্ন সমুদ্রযাত্রার স্মৃতিকথা ওকে শোনাতে লাগলেন। ও ইতিমধ্যে আবার শক্ত ও সতর্ক হয়ে গিয়েছিল, কারণ সে বিছানায় ফিরে এসে বুঝলো, সে যখন বাথরুমে তখন ডাক্তার তাঁর সব কাপড়জামা খুলে ফেলেছিলেন এবং ফারমিনার আগের ভয় আবার তাকে চেপে ধরলো, এবার কি হবে? কিন্তু যা হবার সেটা হতে আরো কয়েক ঘণ্টা দেরি হয়, কারণ ডাক্তার উরবিনো খুব আস্তে আস্তে কথা বলতে থাকলেন, মিলিমিটার মিলিমিটার করে ওর দেহের আস্থা অর্জন করলেন। তিনি ওর কাছে পারীর গল্প করলেন, পারীর প্রেমের কথা বললেন, কিভাবে পারীর প্রেমিক যুগল রাস্তায়, বাসে, খোলা আকাশের নিচে পুষ্পশোভিত ক্যাফের চত্বরে একে অন্যকে চুমু খায়, চারপাশে উষ্ণ বাতাস বয়ে যায়, অ্যাকর্ডিয়ন-বাদকরা বাজনা বাজায়, সেন নদীর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই প্রেমিকরা মিলিত হয় পরস্পরের সঙ্গে, কেউ তাদের বিরক্ত করে না, ডাক্তার ওকে এই সব গল্প শোনালেন। অন্ধকারের মধ্যে কথা বলতে বলতে তিনি ওর ঘাড়ের পেছনে তাঁর আঙ্গুলের ডগা দিয়ে আলতো করে চাপ দিলেন, ওর বাহুর সিল্কের মতো নরম লোমের ওপর দিয়ে কোমলভাবে হাত বুলিয়ে দিলেন, ওর ছলনাময় পেটের ওপর নিজের হাত রাখলেন এবং যখন দেখলেন যে ওর টানটান অবস্থা কেটে গেছে তখন তিনি ওর নৈশাবাশটা টেনে খুলে দেবার প্রথম প্রয়াস নিলেন, কিন্তু ও তার নিজস্ব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁকে নিরস্ত করে বললো, ‘এটা আমি নিজেই করতে পারবো’, বলেই সে তার কাপড় খুলে ফেললো। কিন্তু তারপর সে এমন নিথর নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলো যে অন্ধকারের মধ্যে ওর শরীর চকচক করে না উঠলে ডাক্তার নিশ্চিত ভাবে মনে করতেন যে ও আর এখানে নেই।
একটু পরে তিনি আবার ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন। এবার ওর হাত উষ্ণ, শিথিল-কোমল, যদিও তখনো ভেজা ভেজা, যেন শিশিরের ফোঁটায় স্নাত। দুজনেই নির্বাক, অনড়, ডাক্তার পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ খুঁজছেন, ফারমিনাও ওই পদক্ষেপটি কি রূপ নিয়ে আসবে তার জন্য অপেক্ষমান, এদিকে উভয়ের নিঃশ্বাস ভারি ও তীব্র হয়ে উঠতে লাগলো আর অন্ধকার হতে লাগলো প্রসারিত। কোন রকম সাবধান না করে দিয়েই ডাক্তার হঠাৎ ওর হাত ছেড়ে দিয়ে শূন্যে ঝাঁপ দিলেন, তিনি নিজের জিহ্বা দিয়ে তাঁর হাতের আঙ্গুল ভিজিয়ে নিয়ে আচমকা ওর স্তনাগ্র ঘষে দিলেন, আর ওর মধ্যে তখন একটা মর্মান্তিক বিস্ফোরণ ঘটে গেল, যেন কেউ তার একটা রক্তাক্ত শিরার ওপর হাত রেখেছে। অন্ধকারের জন্য ও খুশি হল, নইলে ওর মুখে আগুনের মতো লজ্জার রক্তিমাভা তাঁর চোখে ধরা পড়তো, ওই লজ্জা তার করোটি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে। ডাক্তার প্রশান্ত গলায় বললেন, ‘চিন্তা কোরো না, ভুলে যেও না যে এর সঙ্গে আমার ইতিপূর্বেই পরিচয় হয়েছে।’ সে বললো, ‘সে কথা আমার খুব ভালো মনে আছে, এবং তার জন্য আমি এখনো রেগে আছি।’
এবার ডাক্তার বুঝলেন যে তিনি সাফল্যের সঙ্গে উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে এসেছেন। আবার তিনি ওর বড়সড়ো কোমল হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাকে ছোটখাটো চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলেন, প্রথমে শক্ত করতল, তারপর দীর্ঘ সূক্ষ্মদর্শী আঙ্গুল, স্বচ্ছ নখ, আর তারপর তার ঘামে ভেজা করতলে নিয়তির রেখাগুলি। ফারমিনা বুঝতেই পারলো না কেমন করে ওর হাত তাঁর বুকের ওপর একটা শক্ত জায়গায় গিয়ে পড়লো, ওটা কি সে বুঝতে পারলো না। ডাক্তার বললেন, ‘ওটা একটা অস্থি।’ সে তাঁর বুকের লোমগুলির ওপর কোমল ভাবে তার হাত বুলালো, একটা একটা করে, তারপর সবগুলি তার হাতের মুঠোয় ধরে সজোরে টান দিলো, একেবারে গোড়া থেকে তাদের উপড়ে আনতে চাইলো। ডাক্তার বললেন, ‘আরো জোরে।’ ও চেষ্টা করলো, শেষে বুঝলো যে ডাক্তারকে সে কোন ব্যথা দিতে পারছে না, আর তখন তার হাত অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া ডাক্তারের একটা হাত খুঁজে নিল। কিন্তু ডাক্তার এবার ওকে আঙ্গুল আঙ্গুলে জড়াতে না দিয়ে ওর কব্জি চেপে ধরে ওর হাতকে নিজের দেহের ওপর দিয়ে অদৃশ্য কিন্তু সুপরিচালিত এক শক্তি দ্বারা টেনে নিয়ে চললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না ও একটা নগ্ন জন্তুর ঘন তীব্র নিঃশ্বাস অনুভব করলো, তার কোন দৈহিক আকর নেই, কিন্তু জিনিসটা উদগ্রীব ও ঋজু। এরপর যা হল ডাক্তার তা কল্পনা করেন নি, সেও করে নি, ডাক্তার যেখানে ওর হাত স্থাপন করেছিল সেখান থেকে ও হাত সরিয়ে নিল না, তাকে ওখানে অসাড় ভাবে রেখেও দিল না, বরং নিজেকে দেহমন আত্মাসহ ব্লেসেড ভার্জিনের কাছে উৎসর্গ করে, দাঁতে দাঁত টিপে, পাছে সে নিজের উন্মত্ততাতেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, সে তার উত্তোলিত প্রতিপক্ষকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার পরিচয় নিতে শুরু করলো, কেমন তার আকার, কি রকম শক্তিশালী তার স্তম্ভদণ্ড, তার পক্ষ কতদূর বিস্তৃত, আর ও তার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখে অবাক হল, কিন্তু তার একাকিত্ব দেখে তার জন্য একটু অনুকম্পাও জাগলো ওর মনে, এমন একটা ব্যাপক ঔৎসুক্যের সাথে সে জিনিসটাকে তার নিজের করে নিল যে তার স্বামীর চাইতে কম অভিজ্ঞ কেউ হয়তো ওটাকে আদরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতো। ওর নির্দয় অনুসন্ধানের তীব্রতা সহ্য করার জন্য ডাক্তারকে তাঁর শক্তির সর্বশেষ কণা পর্যন্ত কাজে লাগাতে হয়, তারপর এক সময় ও একান্ত শিশুসুলভ নিস্পৃহতার সঙ্গে জিনিসটা ছেড়ে দিল, যেন সে ওটাকে ময়লার বাক্সে ছুড়ে দিচ্ছে।
ও বললো, ‘ওটা কিভাবে কাজ করে তা কখনো আমার বোধগম্য হয় নি।’
তখন ডাক্তার বিশেষজ্ঞের জ্ঞান ও পদ্ধতি সহকারে চরম গাম্ভীর্যের সঙ্গে ওর হাত তাঁর উক্তির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বিভিন্ন বিন্দুতে নিয়ে গেলেন এবং সেও একান্ত অনুকরণীয় এক ছাত্রের মতো তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করে চললো। একটা অনুকূল মুহূর্তে ডাক্তার বললেন যে আলো জ্বালানো থাকলে বিষয়টা অনেক সোজা হবে। কিন্তু তিনি যখন আলো জ্বালাবার উপক্রম করলেন তখন তাঁর স্ত্রী তাঁর হাত ধরে বাধা দিলেন, বললেন, “আমি হাত দিয়েই বেশি ভালো দেখি।” সেও কিন্তু আলো জ্বালাতে চেয়েছিল তবে সেটা সে নিজে করতে চেয়েছিল, কারো নির্দেশ অনুযায়ী নয় এবং তাই করলো সে। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলে ডাক্তার তাঁর স্ত্রীকে দেখলেন বিছানার চাদরে নিজেকে মুড়ে সে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের মতো পড়ে আছে, কিন্তু সে অনুসন্ধানের বিষয়টি শক্ত হাতে ধরে সেটাকে এদিকে-ওদিকে ঘোরালো এবং ব্যাপারটাকে তখন ডাক্তারের কাছে বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের চাইতে আরো বেশি কিছু বলে মনে হল। তার পর্যবেক্ষণ শেষ করে অবশেষে সে মন্তব্য করল, ‘কী বিশ্রী! মেয়ে মানুষেরটার চাইতেও বিশ্রী দেখতে।’ তিনি একমত হলেন, বললেন যে বিশ্রী দেখতে হওয়ার চাইতেও এটার আরো বেশি কিছু অসুবিধা আছে। তারপর বললেন, ‘এটা হচ্ছে কারো প্রথম ছেলের মতো। তুমি সারা জীবন তার জন্য পরিশ্রম কর, তার জন্য সব কিছু উৎসর্গ কর, তারপর সময় এলে সে তার যা খুশি তাই করে। তাঁর স্ত্রী ওটাকে পরীক্ষা করতে থাকলো, প্রশ্ন করল এটা কি জন্য, ওটা কি জন্য, তারপর সব তথ্য জেনে সন্তুষ্ট হয়ে ওটা দু’হাতে তুলে ধরে তার ওজন পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে ওটাকে নিয়ে ভাবনার কিছু নেই, তখন সে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ওটা তার হাত থেকে ছেড়ে দিল। তারপর ও বলল, “তাছাড়া আমার মনে হয় ওটার মধ্যে বড় বেশি জিনিস আছে।’
ডাক্তার বিস্ময়াভিভূত হলেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের মূল, বিষয়ই ছিল এটা : মানবদেহের কাঠামোর সরলীকরণের সুবিধা। তাঁর কাছে ওই গঠন মনে হয়েছিল অতি প্রাচীন, সেখানে অনেক বাহুল্য ও নিষ্প্রয়োজনীয় জিনিসের সমাহার ঘটেছে, মানবজাতির বিভিন্ন স্তরে হয়তো এসবের দরকার ছিল, কিন্তু এখন আমাদের কালে তার আর কোন দরকার নেই। হ্যাঁ, এটা আরো সহজ ও সরল হতে পারতো এবং সেই সূত্রে কম আক্রমণেরও শিকার হত। শেষে তিনি বললেন, ‘কিন্তু এ কাজটা একমাত্র ঈশ্বরই করতে পারেন, তবে তাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ভালোই হবে।’
সে মজা পেয়ে এত স্বাভাবিক ভাবে হেসে উঠলো যে ডাক্তার ওই সুযোগ গ্রহণ করে ওকে আলিঙ্গন করলেন এবং প্রথমবারের মত ওর ওষ্ঠচুম্বন করলেন। সেও তার উত্তর দিল আর তখন তিনি আলতো ভাবে চুম্বন করতে থাকলেন ওর গাল, ওর নাক, ওর চোখের পাতা : তিনি চাদরের নিচে হাত ঢুকিয়ে ওর যোনির চারপাশের সোজা অকুঞ্চিত কেশরাশিতে হাত বুলালেন। ও তাঁর হাত সরিয়ে দিল না, কিন্তু নিজের হাতটা সতর্কাবস্থায় রাখলো যেন তিনি আর অগ্রসর হতে না পারেন।
ফারমিনা বললো, ‘অনেক হয়েছে, আর চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষা দানের দরকার নেই।’
‘না’, তিনি বললেন, ‘এবার শিক্ষাদান হবে প্রেমলীলায়।’
তিনি চাদরটা সরিয়ে নিলেন, ও যে বাধা দিল না শুধু তাই নয়, পায়ের এক দ্রুত ঝটকায় খাট থেকেই সে ওটা ফেলে দিল। ওর অসহ্য গরম লাগছিল। ওর শরীর ছিল নমনীয় ও ঢেউখেলানো, পোশাক পরা অবস্থায় যেমন দেখাতো তার চাইতে বেশি ধীর ও অচপল, ওই শরীরে অরণ্যের প্রাণীর একটা নিজস্ব গন্ধ পাওয়া গেল, ওই গন্ধ ওকে বিশ্বের আর সব রমণী থেকে স্বতন্ত্র করে তুললো। আলোর মধ্যে প্রতিরক্ষাহীন ফারমিনা অনুভব করলো যে তার সারা মুখ একঝলক রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে এবং সেটা লুকাবার একটা পথই সে দেখলো, সে দুই হাতে তার স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে তাঁকে একটা সুদীর্ঘ গাঢ় চুম্বনে সিক্ত করলো, দুজনের প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম হলেই তার সমাপ্তি ঘটে।
তিনি যে ওর প্রেমে পড়েন নি এ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তিনি ওকে বিয়ে করেছিলেন কারণ তার অহঙ্কারী মেজাজ আর গাম্ভীর্য আর শক্তিমত্তা দ্বারা তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাছাড়া তাঁর নিজের অহমিকা দ্বারাও তিনি তাড়িত হয়েছিলেন, কিন্তু ও তাঁকে প্রথম বার চুম্বন করার পরই তিনি নিশ্চিত হন যে পরস্পরকে সত্যিকার ভালোবাসার কারণ আবিষ্কারের পক্ষে তাঁরা কোন অন্তরায়ের সম্মুখীন হবেন না। সে- রাতে সকাল পর্যন্ত তারা অনেক কথা বলেছিলেন, কিন্তু ওই প্রথম রাতে কিংবা পরবর্তী কোন সময়ে তারা ওই বিষয় নিয়ে কখনো কোন আলাপ করেন নি। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত, তাদের দুজনের কেউই ভুল করেন নি।
অবশেষে সকালের দিকে তারা যখন ঘুমিয়ে পড়লেন, ফারমিনা তখনো কুমারী, কিন্তু আর বেশিক্ষণ সে তা থাকলো না। পরের রাতে ডাক্তার তাকে নক্ষত্রখচিত ক্যারিবীয় আকাশের নিচে ভিয়েনার ওয়াল্টজ নাচ শেখালেন, তারপর তিনি বাথরুমে ঢুকলেন। ফারমিনা আগেই গিয়েছিল। ডাক্তার বাথরুম থেকে শোবার ঘরে ফিরে দেখলেন যে তাঁর স্ত্রী শয্যায় তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, নগ্নদেহে। এবার সে অগ্রণী ভূমিকা নিল এবং নিজেকে উজাড় করে দিল, কোন রকম দুঃখ বা শঙ্কা ছাড়া, উত্তাল সমুদ্রে কোন অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ নিয়ে, বহুশ্রুত রক্তাক্ত উৎসবের কোন চিহ্ন ছাড়াই, শুধু চাদরে লেগে থাকলো মর্যাদার একটা গোলাপ। তারা দুজনই সঙ্গম করতো চমৎকার ভাবে, প্রায় একটা অলৌকিক ব্যাপারের মতো এবং এটা তারা করতে থাকে দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত, গোটা সফর ব্যাপী এবং প্রতিবারই তা ক্রমান্বয়ে উন্নততর হতে থাকে, তারা যখন লা রোশেলে এসে পৌঁছল তখন তাদের দেখে মনে হল তারা যেন অনেক দিনের পুরনো প্রেমিক যুগল।