প্রেম ও কলেরা – ১৮

১৮

ওর নাম ছিল আমেরিকা ভিসুনা। পুয়ের্টো পার্ডির জেলেদের গ্রাম থেকে দু’বছর আগে সে এখানে এসেছিল। তার পরিবার তাকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার হেফাজতে দিয়ে যায় তার অভিভাবক এবং রক্ত সূত্রে স্বীকৃত আত্মীয় রূপে। সে এখানে আসে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য, একটা সরকারি বৃত্তি নিয়ে, সঙ্গে আনে পুতুলের বাক্সের মত ছোট্ট একটা টিনের ট্রাঙ্ক। যে মুহূর্তে সে তার উঁচু সাদা জুতা ও সোনালি বেণী নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে আসে সে মুহূর্তেই ফ্লোরেন্টিনোর একটা ভয়ঙ্কর পূর্ববোধ হয়, তারা দুজন বহু রবিবার দুপুরের খাওয়ার পর একসঙ্গে বৈকালিক নিদ্রা যাবে। সে তখনো একটি শিশু, শব্দটার সকল অর্থে, দাঁতে তার জড়ানো, হাঁটুতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘর্ষণের দাগ, কিন্তু শিগগিরই সে যে কী ধরনের রমণী হয়ে উঠবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে দেখামাত্র সেটা বুঝেছিল। সে তাকে তার সাহচর্য দিল, তার যত্ন নিল, একটি মন্থর বছর জুড়ে, শনিবার সার্কাসে নিয়ে গেল, রবিবার পার্কে আইসক্রিম খাওয়ালো, ছেলেমিভরা দীর্ঘ অপরাহ্ণ কাটালো তার সঙ্গে, এই ভাবে তার আস্থা ও মমত্ব অর্জন করলো, সে ওর হাত ধরে ওকে চালিত করলো, একজন স্নেহপ্রবণ পিতামহের মত, তার প্রচ্ছন্ন বধ্যভূমির দিকে। ওর দিক থেকে ব্যাপারটা ছিল তাৎক্ষণিক, স্বর্গের দ্বার যেন তার জন্য খুলে গেল। সে আকস্মিক ভাবে প্রস্ফুটিত হল একটি ফুলের মত, সুখের সমুদ্রে সে ভাসতে লাগলো, এর মধ্যে সে তার পড়াশোনার জন্যও প্রেরণা পেলো। সে ক্লাসে প্রথম হতে লাগলো যেন শনি-রবিবার বাইরে যাবার সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত হতে না হয়। আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দিক থেকে এটা ছিল তার বার্ধক্যের উপসাগরে সব চাইতে সুন্দর সুরক্ষিত খাড়ি। এত বছরের হিসেব করা প্রেমের পর এই নিষ্পাপ সারল্যের মৃদু আনন্দের মধ্যে সে লাভ করলো একটা বলকারক বিকৃতির মাধুর্য।

তাদের মধ্যে বিরাজ করতো সম্পূর্ণ মতৈক্য। ও যা ছিল সে রকমই আচরণ করতো, একজন ভক্তিভাজন বৃদ্ধের কাছ থেকে, যিনি কোনো কিছুতেই চমকিত বা বিচলিত হতেন না, জীবন সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণে প্রস্তুত, আর ফ্লোরেন্টিনো ও ইচ্ছাকৃত ভাবে আচরণ করতো এক অতিবৃদ্ধ জরাগ্রস্ত প্রেমিকের মতো, বাস্তব জীবনে যে অবস্থাকে সে সবচাইতে বেশি ভয় করতো। তরুণ ফারমিনা ডাজার সঙ্গে ওর বেশ মিল ছিল, ভাসাভাসা নয়, ওদের বয়স, স্কুলের ইউনিফর্ম, চুল, পোষনামানা হাঁটার ভঙ্গি · এমনকি ওদের অহঙ্কারী ও অনিশ্চিত ব্যবহারের চাইতেও অন্য কোথাও, কিন্তু এসব সত্ত্বেও সে কখনো ওকে ফারমিনা ডাজার সঙ্গে এক করে দেখে নি। তাছাড়া স্থান পূরণের যে ধারণা তাকে এতোদিন সার্থক ভাবে এক ভিক্ষুকের মতো প্রেমিকে পরিণত করেছিল তা এখন তার মন থেকে সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়ে গিয়েছিলো। সে ওকে পছন্দ করতো ও যা সেই জন্যই, সে ওকে ভালোবাসতে শুরু করলো ও যা সেই জন্যই, একটা প্রদোষকালীন উন্মাতাল উল্লাসের সঙ্গে সে ওর মধ্যে হারিয়ে গেল। একমাত্র ওর ক্ষেত্রেই সে আকস্মিক গর্ভ সঞ্চারের বিরুদ্ধে কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করে। বার ছয়েক মিলিত হবার পর তাদের দুজনের কারো জন্যই রবিবারের অপরাহ্ণগুলি ছাড়া আর কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব রইলো না।

বোর্ডিং স্কুল থেকে ওকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার অধিকার দেয়া হয়েছিল একমাত্র ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে। তাই সে ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির ছয় সিলিন্ডারের হাডসন গাড়িতে ওকে তুলে নিতো আর, বিকালের রোদ খুব চড়া না হলে, হুড ফেলে দিয়ে সমুদ্র সৈকত দিয়ে গাড়ি চালাতো। ফ্লোরেন্টিনোর মাথায় তার অনুজ্জ্বল হ্যাট, আর ওর মাথায় ওর স্কুল-ইউনিফর্মের নাবিকদের মতো টুপি, দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে যেন বাতাস ওটা উড়িয়ে না নিয়ে যায়, আর খিল খিল করে ও হেসে ভেঙে পড়ছে। কে একজন ওকে বলেছিল ও যেন তার অভিভাবকের সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো সময় না কাটায়, সে মুখ দিয়েছে এমন কোনো খাবার না খায়, নিজের মুখ তার মুখের খুব কাছে যেন কখনো না নেয়, কারণ বার্ধক্য হল সংক্রামক, কিন্তু ও সেসব কথাকে কোনো পাত্তা দেয় নি। লোকে ওদের সম্পর্কে কি ভাবে না ভাবে সে সম্পর্কে ওরা ছিল পরম উদাসীন, ওদের পারিবারিক আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা ছিল সর্বজনবিদিত, তার চাইতেও বড় কথা, ওদের বয়সের বিরাট ব্যবধান ওদেরকে সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছিল।

সেদিন পেন্টেকস্টের রবিবারে যখন বিকাল চারটার সময় গির্জার ঘণ্টাগুলি বেজে ওঠে তখন ওরা সবেমাত্র ওদের প্রেম পর্ব শেষ করেছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার তোলপাড় করে ওঠা বুককে সে কোনো রকমে শান্ত করলো। তার যুবা বয়সের সময় শেষকৃত্যানুষ্ঠানের মূল্যের মধ্যেই ঘণ্টা বাজানোর কাজটা অন্তর্ভুক্ত থাকতো, শুধুমাত্র দীন জীবিকাহীনদের জন্য সে ব্যবস্থা করা হতো না। কিন্তু বিগত যুদ্ধের পর, শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে রক্ষণশীল শাসকরা ঔপনিবেশিক প্রথাসমূহ দৃঢ়ভাবে চালু করলেন, আর তখন শেষকৃত্যের খরচ এতো বেড়ে গেল যে অতিবিত্তশালী পরিবার ছাড়া তখন আর কারো পক্ষে উপরোক্ত আয়োজন করা সম্ভব হতো না। আর্চ বিশপ দান্তে দি লুনা যখন মারা গেলেন তখন সারা প্রদেশের গির্জার ঘণ্টাগুলি বিরতিহীন ভাবে বেজেছিল নয় দিন ও নয় রাত ধরে, আর ওই সময় জনগণের কষ্ট এতো চরমে পৌঁছেছিল যে তাঁর উত্তরসূরি বিধান করে দেন যে মৃত্যুবরণ করা একমাত্র সর্বোচ্চ খ্যাতিমান ব্যক্তিদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সময়েই গির্জা ঘণ্টা বাজাবে। তাই ওই পেন্টাকস্ট রবিবার বিকাল চারটায় ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাধ্বনি শুনে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হয়েছিলো তার হারানো অতীত থেকে বুঝি কোনো প্রেতাত্মা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে কল্পনাও করে নি যে এটা ছিল সেই ঘণ্টাধ্বনি যার জন্য সে কতো বছর ধরে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করে আছে, বহু’ আগের এক রবিবারে যখন সে ছয় মাসের গর্ভবতী ফারমিনা ডাজাকে হাই ম্যাস-এর পর বেরিয়ে আসতে দেখেছিল সেই তখন থেকে।

প্রায়ান্ধকারের মধ্যে সে বলে উঠলো, ‘যাচ্ছেলে! ক্যাথিড্রালের ঘণ্টা বাজাচ্ছে যখন তখন নিশ্চয়ই হোমরা চোমরা কেউ পটল তুলেছে।’

আমেরিকা ভিসুনা, সম্পূর্ণ নগ্ন, এই মাত্র তার ঘুম ভেঙেছে। সে বলল, ‘নিশ্চয়ই পেন্টেকস্টের জন্য।’ ধর্মীয় ব্যাপারে ফারমিনা ডাজার কোনো বিশেষ জ্ঞানই ছিল না। তার জার্মান শিক্ষকের সঙ্গে গির্জার বাদক দলের একজন হয়ে বেহালা বাজাবার জন্য সেই যে গির্জায় গিয়েছিল তার পর সে আর ওখানে ম্যাস-এ যোগদান করে নি, প্রার্থনায় উপস্থিত থাকে নি। ওই জার্মান ভদ্রলোকই তাকে টেলিগ্রাফ বিজ্ঞানে শিক্ষিত করে তুলেছিলো। তার যে কি হল সে সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনো কোনো নির্ভরযোগ্য খবর সংগ্রহ করতে পারে নি। কিন্তু আজ এই ঘণ্টাধ্বনি যে পেন্টেকস্টের জন্য নয় সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ ছিল না। আজ যে নগরীতে জনসাধারণের একটা শোক- অনুষ্ঠান আছে তা সুনিশ্চিত। আজ সকালে ক্যারিবীয় শরণার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল তার বাসায় এসেছিল, তারা তাকে জানায় যে জেরেমিয়া দ্য সাঁত আমুরকে তার আলোকচিত্র স্টুডিওতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। জেরেমিয়া তার অন্তরঙ্গ বন্ধু না হলেও ফ্লোরেন্টিনো আরো অনেক শরণার্থীর ঘনিষ্ঠ জন ছিল, তারা তাকে তাদের নানা অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে, সর্বদা আমন্ত্রণ জানাতো। কিন্তু আজকের গির্জার ঘণ্টাধ্বনি যে জেরেমিয়া দ্য সাঁত-আমুরের জন্য নয় সে বিষয়ে সে নিশ্চিত ছিল। জেরেমিয়া ছিল ধর্মের ক্ষেত্রে একজন জঙ্গি অবিশ্বাসী, একজন অঙ্গীকৃত নৈরাজ্যবাদী, তাছাড়া সে মৃত্যুবরণ করেছে আত্মহননের মাধ্যমে। ফ্লোরেন্টিনো বললো, ‘না, এ ঘণ্টা ধ্বনি অন্তত কোনো গভর্নরের জন্য।’

আমেরিকা ভিসুনার যে বয়স তা মৃত্যুর কথা ভাবার বয়স নয়। অযত্নে টানা জানালার পর্দার মধ্য দিয়ে বাইরের আলো তার শরীরে আলো-ছায়ার ছবি সাজিয়েছে। তারা দুপুরের খাবার পর প্রেম করেছে, এখন দিবানিদ্রার শেষে দুজনে একসঙ্গে শুয়ে আছে, দুজনই নগ্নদেহ, উপরে পাখা ঘুরছে, বাইরে উত্তপ্ত টিনের ছাদে কয়েকটা শকুন হাঁটার সময় শিলা বৃষ্টির মতো যে রকম শব্দ করছে তাতেও পাখার গুনগুন ধ্বনি চাপা পড়ে নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার দীর্ঘ জীবনে আরো অনেক মেয়েকে যেভাবে ভালোবেসেছে, আমেরিকা ভিসুনাকেও সেই ভাবেই উপভোগ করেছে, কিন্তু এক্ষেত্রে জড়িয়ে ছিল একটা গভীর যন্ত্রণার বোধ যা অন্য কারো ক্ষেত্রেই সে অনুভব করে নি, কারণ তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে ও মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করার আগেই সে মৃত্যুবরণ করবে।

তাদের এই ঘরটি ছিল জাহাজের ক্যাবিনের মতো, দেয়ালগুলি কাঠের, কয়েক পোচ রঙ দেয়া হয়েছে তাদের গায়ে, জাহাজে যেমন দেয়া হয়। তবে অপরাহ্ণ চারটার সময় খাটের উপরে বৈদ্যুতিক পাখা চলতে থাকলেও গরম ছিল নদীপথে চলাচল করা জাহাজের ক্যাবিনের চাইতে বেশি, কারণ এখানে টিনের ছাদ থেকে উত্তাপ ভেতরে সঞ্চারিত হত। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার আর.সি.সি.র আপিসের পেছনে এই ঘরটি বানিয়ে নিয়েছিলো একটিমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে, তার বৃদ্ধ বয়সের প্রেমের জন্য এখানে সে একটা সুন্দর আশ্রয়স্থল খুঁজে পাবে, তাই এটা ডাঙায় একটা ক্যাবিনের মতো কোনো আনুষ্ঠানিক শোবার ঘর ছিল না। সাধারণ দিনগুলিতে এখানে ঘুমানো ছিল বেশ শক্ত, চারদিকে কুলিদের হৈচৈ, নদীবন্দরে ক্রেনের সাহায্যে মাল নামানো- উঠানোর শব্দ, আর ঘাটে দাঁড়ানো জাহাজগুলির বিকট ভোঁ-র আওয়াজ। কিন্তু আমেরিকা ভেসুনার জন্য রবিবারগুলি ছিল স্বৰ্গসদৃশ।

তারা ঠিক করেছিল যে পেন্টেকস্টের দিন সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার পাঁচ মিনিট আগে স্কুলে ফিরে যাবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা দুজন একসঙ্গে থাকবে, কিন্তু গির্জার ঘণ্টাধ্বনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলো, তাকে সাঁত-আমুরের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে, তাই সে সাধারণ সময়ের চাইতে একটু বেশি তাড়াতাড়ি করে তার কাপড়-জামা পরে নিলো। তবে প্রথমে, সব সময় যেমন করতো, সে ওর চুল এক বেণী করে বেঁধে দিলো, প্রেম করার আগে সে-ই নিজের হাতে ওই বেণী খুলে দিতো, তারপর সে ওকে টেবিলের উপর বসিয়ে ওর স্কুলের জুতার ফিতা ফুলের মতো করে বেঁধে দিতো, এ কাজটা ও কখনোই ভালো করে করতে পারতো না। সে ওকে সাহায্য করতো কোনো রকম বিরক্তি বোধ না করে, আর মেয়েটিও ওকে সাহায্য করার জন্য ফ্লোরেন্টিনোকে সাহায্য করতো, যেন এ ছিল একটা কর্তব্যকর্ম। ওদের প্রথম কয়েকটি সাক্ষাতের পরই ওরা পরস্পরের বয়সের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়, তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে স্বামী-স্ত্রীর মতো একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, যে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের কাছে সারা জীবন এতো জিনিস গোপন রেখেছে যে এখন আর তাদের পরস্পরকে বলার কিছুই অবশিষ্ট নাই। ছুটির দিন বলে অফিসগুলি ছিল বন্ধ এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। জনশূন্য জাহাজঘাটে মাত্র একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে ছিলো, তার বয়লারগুলি ঠাণ্ডা। গুমোট আবহাওয়া বছরের প্রথম বর্ষণের আভাস দিচ্ছিল, কিন্তু পোতাশ্রয়ে রবিবারের নৈঃশব্দ এবং বাতাসের স্বচ্ছতা দেখে মাসটিকে তত কঠোর হবে বলে মনে হল না। এখানে বাইরের পৃথিবী ছিল ছায়াচ্ছন্ন ক্যাবিনটির চাইতে অধিকতর কর্কশ, ঘণ্টাধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছিল আরো বেশি শোক, যদিও কার জন্য এ ধ্বনি তারা কেউ তখনো তা জানে না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আর তরুণীটি সল্টপিটারের চত্বরে নেমে গেল, স্পেনীয়রা এ জায়গাকে কৃষ্ণাঙ্গদের বন্দর রূপে ব্যবহার করতো। এখনো এখানে পড়ে আছে ওজন করার জিনিসপত্র, আর দাস ব্যবসায়ের মরচেপড়া শৃঙ্খল ও অন্যান্য মালমশলা গুদামগুলির পাশের ছায়ায় তাদের জন্য তাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িতে ঢুকে আসন গ্রহণ করার আগে ওরা স্টিয়ারিং-এর চাকায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া ড্রাইভারকে জাগালো না। তারপর গাড়ি তার দিয়ে ঘেরা গুদামগুলির পেছন দিয়ে ঘুরে লাস অ্যানিমাস উপসাগরের পুরনো বাজার এলাকা অতিক্রম করলো, সেখানে অর্ধনগ্ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরা বল খেলছিলো। তারা উত্তপ্ত ধুলোর মেঘ সৃষ্টি করে নদী বন্দরের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিশ্চিত ছিল যে এই মৃত্যুউত্তর সম্মান জেরোমিয়া দ্য সাঁত-আমুরের জন্য হতে পারে না, কিন্তু বিরতিহীন ঘণ্টাধ্বনি তাকে অত্যন্ত সন্দিহান করে তুললো। সে ড্রাইভারের পিঠে হাত রেখে তার কানের কাছে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কার জন্য ঘণ্টা বাজছে। ড্রাইভার বললো, ‘ছুঁচোলো দাড়িওয়ালা ডাক্তার সাহেবের জন্য, কি যেন নাম ওঁর?’

তিনি যে কে তা নিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে চিন্তা করতে হল না, কিন্তু ড্রাইভার যখন তাকে ওঁর মৃত্যুর ঘটনাটা বললো তখন তার আশা তাৎক্ষণিক ভাবে অন্তর্হিত হয়ে গেল, কারণ সে যা শুনলো সেটা সে বিশ্বাস করতে পারলো না। একটা মানুষ যেভাবে মৃত্যুবরণ করে অন্য কোনো কিছু দিয়ে তাকে তার চাইতে ভালো ভাবে চেনা যায় না, আর সে যে মানুষটির কথা ভাবছে তার সঙ্গে এরকম মৃত্যুর কোনো মিল ছিল না। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও মানুষটা তিনিই ছিলেন, শহরের সব চাইতে বয়োবৃদ্ধ, সব চাইতে গুণান্বিত চিকিৎসক, শহরের শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের অন্যতম, তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, একাশি বৎসর বয়সে, একটা তোতা পাখিকে ধরতে গিয়ে, আমগাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙে।

ফারমিনা ডাজার বিয়ের পর থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যা কিছু করেছে তা ছিল এই আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যখন ওই ঘটনাটা ঘটলো তখন তার বিনিদ্র রজনীগুলিতে সে যে আনন্দের শিহরণ অনুভব করবে বলে প্রায়ই ভেবেছিল তা সে অনুভব করলো না। তার পরিবর্তে এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক তাকে আক্রমণ করলো : তার এক অদ্ভুত অনুভূতি হল, তার জন্যও তো এই রকম মৃত্যুঘণ্টা বাজতে পারতো। তাদের গাড়ি খোয়া বাঁধানো রাস্তায় ধাক্কা খেতে খেতে চলছিলো, তার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আমেরিকা ভিসুনা ভয় পেলো, সে তাকে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো নিজের বরফের মতো ঠাণ্ডা হাতে ওর হাত চেপে ধরে, নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘সোনা মেয়ে, তোমাকে সে কথা শোনাতে গেলে আমার আরো পঞ্চাশ বছর লাগবে।

সে জেরেমিয়া দ্য সাঁত-আমুরের শেষকৃত্যের কথা ভুলে গেল। আমেরিকাকে তার স্কুলের দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে সে দ্রুত প্রতিশ্রুতি দিল যে আগামী শনিবার সে ওকে তুলে নেবার জন্য আবার আসবে, তারপর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল তাকে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ির সামনে সে দেখতে পেলো অনেককটা মোটর গাড়ি, চারপাশের রাস্তায় অনেকগুলি ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি, বাড়ির বাইরে কৌতূহলী জনতার ভিড়। ডাক্তার লাসিডাস অলিভেল্লার অতিথিরা যখন দুঃসংবাদটা পান তখন তাদের আনন্দ উৎসব তুঙ্গে পৌঁছে ছিল, তারা সঙ্গে সঙ্গে এখানে ছুটে আসেন। ভিড়ের জন্য বাড়ির ভেতরে নড়াচড়া করা কষ্টকর ছিল, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কোনোক্রমে প্রধান শয়নকক্ষে গিয়ে পৌঁছলো, দরজার সামনে যারা দাঁড়িয়েছিলো তাদের মাথার উপর দিয়ে নিজের পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে সে ভেতরে তাকালো, সে জুভেনাল উরবিনোকে তাদের দাম্পত্য শয্যায় শুয়ে থাকতে দেখলো, তার কথা শোনার পর থেকেই সে যাকে ওখানে মৃত্যুর অমর্যাদার মধ্যে ডুবে থাকতে দেখার আশা করে এসেছে। কাঠমিস্ত্রি এই মাত্র শবাধারের জন্য তাঁর মাপ নিয়েছে, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফারমিনা ডাজা, অন্তর্মুখীন এবং হতোদ্যম, তার পরনে এখনো কোনো নববিবাহিতা ঠাকুরমার মতো একটা পোশাক, পার্টির জন্য সেদিন সে যা পরেছিল।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার যৌবনের দিনগুলি থেকে আজ পর্যন্ত তার এই হঠকারি ভালোবাসার জন্য সে কি কি করেছে তার সব কিছু, যাবতীয় খুঁটিনাটিসহ, এই মুহূর্তে ওখানে দাঁড়িয়ে একবার কল্পনা করে নিলো। তার জন্য সে খ্যাতি ও বিত্ত অর্জন করেছে, কোন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে তা নিয়ে বিশেষ ভাবে নি; তার জন্য সে নিজের স্বাস্থ্য ও চেহারার এমন কঠোর যত্ন নিয়েছে যা সমসাময়িক অনেক পুরুষের কাছে খুব পুরুষোচিত বলে মনে হয় নি; সে এই দিনটির জন্য যে ভাবে অপেক্ষা করেছে এ পৃথিবীতে কোনো জিনিসের জন্য আর কেউ এভাবে অপেক্ষা করতে পারতো না, আর এই অপেক্ষাকালীন সময়ে সে এক মুহূর্তের জন্যও নিরুৎসাহিত বোধ করে নি। মৃত্যু যে শেষ পর্যন্ত তার পক্ষালম্বন করেছে এই প্রমাণ তাকে ফারমিনা ডাজার বৈধব্যের প্রথম রাতেই তার কাছে তার চিরন্তন বিশ্বস্ততা ও অন্তহীন ভালোবাসার শপথ পুনর্ব্যক্ত করার সাহস যোগালো।

কাজটা যে সুচিন্তিত হয় নি, সঙ্গত হয় নি, নিজের বিবেকের এই অভিযোগ সে অস্বীকার করতে পারলো না কিন্তু সে দ্রুত এ কাজটি করে কারণ তার ভয় ছিল সে হয়তো আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পাবে না। সে আরেকটু কম নিষ্ঠুর ভাবে কাজটা করতে পারলে খুশি হত, কিভাবে করবে তা নিয়ে সে অনেক ভেবেছিলো, কিন্তু নিয়তি তাকে কোনো সুযোগ দিল না। নিজের বিপর্যস্ত মনের অবস্থা এবং ওকে যে অনুরূপ বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে গেল সে কথা ভাবতে ভাবতে সে শোকাচ্ছন্ন বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু এটা প্রতিহত করার কোনো উপায় সে খুঁজে পায় নি। তার মনে হল এই বর্বরোচিত রাত তাদের উভয়ের নিয়তির ওপর এক অনপেনয় দাগ কেটে রেখে গেল চিরদিনের জন্য।

এরপর দু’সপ্তাহ ধরে একটি পুরো রাতও সে ঘুমিয়ে কাটাতে পারে নি। সে হতাশ চিত্তে আপন মনে ভাবলো, তাকে ছাড়া ফারমিনা ডাজার কি হবে, কি চিন্তা করবে সে, তার জীবনের বাকি বছরগুলিতে, তার হাতে সে যে ভয়ঙ্কর বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এসেছে তা কিভাবে বহন করবে। তার কোষ্ঠকাঠিন্য সঙ্কটজনক অবস্থায় পৌঁছাল, পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেল, এনিমার চাইতে কম সুখকর চিকিৎসার শরণাপন্ন হতে হল তাকে। বার্ধক্যের কষ্টগুলি সে তার সমসাময়িকদের চাইতে ভালো ভাবে সহ্য করতে পারতো, কারণ যৌবনকাল থেকেই সে এসবে অভ্যস্ত ছিল, কিন্তু এখন ওই সব কষ্ট তাকে একযোগে আক্রমণ করলো। এক সপ্তাহ বাড়িতে কাটাবার পর বুধবার সে যখন আপিসে এলো তখন লিওনা কাসিয়ানি তার দুর্বল বিবর্ণ অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হল, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো তাকে আশ্বস্ত করে বললো যে ও কিছু না, সব সময় যেমন হয় তাই, অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে। তার বুকের রক্তাক্ত ক্ষত থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসতে উদ্যত সত্যটিকে চেপে রাখার জন্য তাকে আরো একবার তার জিভ কামড়ে ধরে রাখতে হয়। বৃষ্টির জন্য বাইরে রোদে গিয়ে বসে একা একা ভাববার সময় সে পেল না। সে আরো একটি অবাস্তব সপ্তাহ কাটিয়ে দিল, কোনো কাজে মনোসংযোগ করতে পারলো না, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারলো না, ঘুমের অবস্থা হল আরো খারাপ, সে একটা গোপন ইঙ্গিতের জন্য প্রতীক্ষা করে রইলো যা তাকে মুক্তির পথ দেখাবে। কিন্তু শুক্রবার দিন এক অযৌক্তিক প্রশান্তিতে তার মন ভরে গেল, সে এটাকে ধরে নিল একটা অশুভ সঙ্কেত বলে, আর নতুন কিছু ঘটবে না, সারা জীবন সে যা কিছু করেছে সব ব্যর্থ হয়ে যাবে, আর সে এই জীবনের ভার বইতে পারবে না, সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সোমবার দিন সে যখন জানালার সরণীতে তার বাড়িতে ফিরলো তখন সে দরজার ঠিক ওপাশে কাদাজলের মধ্যে একটা চিঠিকে ভাসতে দেখেলো, সে সঙ্গে সঙ্গে ভেজা খামের উপর উদ্ধত হাতের লেখাটা চিনতে পারলো, যে হস্তাক্ষর তার জীবনের এতো পরিবর্তনের মধ্যেও বদলায় নি, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হল সে যেন শুকনো গার্ডেনিয়া ফুলের নৈশকালীন সুরভির আভাস পাচ্ছে, কারণ প্রথম ধাক্কার পর তার হৃদয় তাকে সব কিছু বলে দিল : এক মুহূর্তের বিরাম ছাড়া অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে সে যে চিঠিটার জন্য অপেক্ষা করছিল এটা হল সেই চিঠি।

অন্ধ ক্রোধঅনুপ্রাণিত তার চিঠি যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রেমপত্র হিসাবে গ্রহণ করবে ফারমিনা ডাজা তা কল্পনাও করতে পারে নি। তার চিঠিতে সে প্রকাশ করেছিল তার যথাসাধ্য ক্ষমতা অনুযায়ী প্রচণ্ড ক্রোধ, ব্যবহার করেছিল নিষ্ঠুরতম ও সর্বাধিক আঘাত দেয়া শব্দাবলী, ওর প্রতি ছুড়ে দিয়েছিল চরম মিথ্যা অপযশ, তবু তার মনে হয়েছিল যে ওর বিশাল অপরাধের তুলনায় সে খুব সামান্যই বলতে পেরেছিলো। সে চেষ্টা করেছিলো তার নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে, তার ওপর চেপে বসা ভূতকে তাড়াতে এবং সে-লক্ষ্যে তার চিঠিটা ছিলো একটা চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সে চেয়েছিলো আবার নিজের মতো হতে, অর্ধশতাব্দীর দাসত্বের সময় যে সব জিনিস সে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো আবার তা ফিরে পেতে, ওই সময়টুকু তাকে নিঃসন্দেহে সুখী করেছিল, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সে দেখলো যে তার নিজস্ব পরিচিতির জন্য কিছুই তা রেখে যায় নি। একটা অচেনা বাড়িতে সে এক প্রেতাত্মা, রাতারাতি এই বাড়ি হয়ে উঠেছে বিশাল, নিভৃত-নির্জন, যার মধ্যে সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চরম বেদনার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করছে : কে বেশি মৃত, যে লোকটি মারা গেছে সে, নাকি যাকে সে এখানে ফেলে রেখে গেছে সে।

মাঝ-দরিয়ায় তাকে একা ফেলে রেখে চলে যাবার জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে একটা তীব্র বিদ্বেষ অনুভব করা থেকে সে নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। তাঁর সব কিছু ওর চোখে জল এনে দিতো : বালিশের নিচে রাখা তাঁর পাজামা, তাঁর চটিজোড়া যাকে ওর সব সময়ই একজন দুর্বল রুগ্ন মানুষের জুতা বলে মনে হত, ও শুতে যাবার আগে চুল আঁচড়াবার সময় তিনি যখন তাঁর কাপড় বদলাতেন এবং আয়নায় যে ভাবে তাঁর মূর্তি প্রতিবিম্বিত হত সেই স্মৃতি, তাঁর ত্বকের গন্ধ যা তাঁর মৃত্যুর পরও বহু দিন ওর গায়ে লেগে ছিলো এই সবই ওর চোখে জল এনে দিতো। কোনো একটা কাজ করতে করতে সে হঠাৎ থেমে গিয়ে কপালে করাঘাত করতো, কারণ স্বামীকে তার একটা কথা বলার ছিলো, সে ভুলে গিয়েছিলো, এইমাত্র তার মনে পড়েছে। প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য প্রশ্ন ওর মনে উদিত হত যার উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারতেন। একবার তিনি ওকে একটা কথা বলেছিলেন যা সে কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে নি, পা কেটে ফেলা একটা মানুষ নাকি তার অনুপস্থিত পায়ের মধ্যে ব্যথা, খিল ধরা, চুলকানি প্রভৃতি অনুভব করে। এখন তাঁকে হারিয়ে, তিনি যখন আর এখানে নেই, তখনও যেন সে তাঁর উপস্থিতি অনুভব করছে।

বিধবা হিসাবে প্রথম দিন সকালে ঘুম ভাঙার পর সে চোখ না খুলেই পাশ ফিরলো, আরেকটু আরামদায়ক অবস্থান খুঁজলো যেন আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারে, আর তখনই সে তার স্বামীর মৃত্যু যথার্থ অনুধাবন করতে পারলো। কারণ তখনই তার কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট ধরা পড়লো, বহু বৎসরের মধ্যে এই প্রথম তার স্বামী বাড়ির বাইরে রাত কাটালেন। তাঁর অনুপস্থিতি আরেকটি জায়গায় তাকে মর্মপীড়া দিল, সেটা হল খাবার টেবিলে, তার যে একা লাগছে সেজন্য নয়, সে তো এখন যথার্থই একা, বরং তার অন্য একটা অদ্ভুত অনুভূতির জন্য, তার মনে হচ্ছিল সে যেন এমন একজনের সঙ্গে বসে খাচ্ছে যার কোনো অস্তিত্ব নাই। নিউ অর্লিয়ান্স থেকে স্বামীকে নিয়ে তার মেয়ে ওফেলিয়া না আসা পর্যন্ত সে টেবিলে বসে কিছু খায়নি এবং তার পরও সে আগের টেবিলের পরিবর্তে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট টেবিল বানিয়ে নেয় এবং তা স্থাপন করে করিডরে। তার আগে পর্যন্ত সে নিয়মিত কিছুই খায় নি। ক্ষুধার্ত বোধ করলে, দিনের যে কোনো সময়ে, সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকতো, রান্না করা পাত্রের মধ্যে কাঁটা ডুবিয়ে সব কিছু একটু একটু খেতো, কিছুই প্লেটে তুলে নিতো না, উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে খাবার মুখে দিতো, কাজের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতো, একমাত্র ওদের সঙ্গেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। কিন্তু, তবু, যত চেষ্টাই সে করুক, তার মৃত স্বামীর উপস্থিতি সে কিছুতেই এড়াতে পারলো না : যেখানেই সে যেতো, যে দিকেই সে তাকাতো, যে কাজেই সে ব্যস্ত থাকতো কিছু না কিছু তার সামনে পড়তোই যা তাকে তার স্বামীর কথা মনে করিয়ে দিতো। যদিও তাঁর জন্য শোক করার প্রকৃত অধিকার ছিলো তার, তবু শোকের কাদা-জলের মধ্যে যেন তাকে লুটোপুটি খেতে না হয় সেজন্য সে সম্ভাব্য সব কিছু করার চেষ্টা করলো। আর তাই সে একটা চরম সিদ্ধান্ত নিলো। তার মৃত স্বামীর কথা মনে করিয়ে দিতে পারে এরকম সব কিছু সে এ বাড়ি থেকে বিদায় করে দেবে। তার মনে হল একমাত্র ওই ভাবেই সে তার স্বামীকে ছাড়া এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারবে।

এটা ছিল মূলোৎপাটনের একটা শাস্ত্রীয় পদ্ধতির মতো। ছেলে তার বাবার লাইব্রেরিটা নিজের কাছে নিয়ে যেতে রাজি হলো। এখন ফারমিনা ডাজা স্বামীর অফিসকে সেলাইঘর বানাতে পারবে, বিয়ের পর থেকে তার কোনো সেলাইঘর ছিল না। মেয়ে কিছু আসবাবপত্র নিয়ে যাবে, আর অসংখ্য দ্রব্যসামগ্রীও তার সাথে করে সে নিউ অর্লিয়ান্সে নিয়ে যাবে, সেখানকার পুরনো জিনিসের নিলামে এগুলির খুব আদর হবে। এসব কিছুই ফারমিনা ডাজাকে বিশেষ স্বস্তি দিলো, কিন্তু তার মধুচন্দ্রিমার সময়ে সংগৃহীত জিনিসপত্র যে এখন পুরাতত্ত্ববিদের বিষয় হয়ে উঠেছে এটাতে সে আমোদ পেল না। সে তার বাড়ির দাসদাসী, পাড়াপ্রতিবেশী, যে সব মহিলা বন্ধুরা এসময়ে তার ওখানে বেড়াতে আসতো সবাইকে বাক্যহীন ও বিস্মিত করে বাড়ির পেছনে খালি জায়গায় একটা অগ্নিকুণ্ড নির্মাণ করলো, তারপর তার স্বামীর স্মৃতিবাহী সব কিছু ওখানে পুড়িয়ে ফেললো : তাঁর দামি রুচিশীল পোশাক, চমৎকার জুতা ও টুপি, যে দোলচেয়ারে বসে তিনি দুপুরের খাবার পর একটু ঘুমিয়ে নিতেন সেই দোলচেয়ার, যেখান থেকে শেষ বারের মতো উঠে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন, ফারমিনার জীবনের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি জড়িয়ে থাকা অসংখ্য জিনিস যা তার অস্তিত্ব হয়ে উঠেছিলো, সব সে ওই অগ্নিকুণ্ডে আহুতি দিলো। ওর স্বামী যে তার এ কাজটা অনুমোদন করবেন এবং শুধু স্বাস্থ্যগত কারণে নয়, সে সম্পর্কে তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তিনি প্রায়ই বলতেন যে তার ইচ্ছা তাঁর মৃতদেহ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হোক, একটা নিশ্ছিদ্র দেবদারু কাঠের বাক্সে যেন তা বন্ধ করে রাখা না হয়। অবশ্য তাঁর ধর্ম এটা অনুমোদন করবে না, তবু তিনি সাহস করে প্রস্তাবটা আর্চবিশপের কাছে পেড়েছিলেন, কি জানি যদি হয়ে যায়, কিন্তু আর্চবিশপ সরাসরি তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তাছাড়াও এটা ছিল এক মায়াকল্পনা, কারণ তাদের চার্চ তাদের সমাধিক্ষেত্রে শবদাহ করার জন্য কোন অগ্নিচুল্লি স্থাপনের অনুমতি দেয় নি, ক্যাথলিকদের বাইরে অন্য ধর্মালম্বনকারীদের জন্যও নয়, যদিও ওই রকম একটা ব্যবস্থার সুবিধার কথা ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ছাড়া আর কারো মনে উদিত হতো না। ফারমিনা ডাজা তার স্বামীর আতঙ্কের কথা ভুলে যায় নি, তাই প্রথম দিকের ওই চরম বিভ্রান্তিকর সময়ের মধ্যেও সে কাঠমিস্ত্রিকে বলে দিয়েছিল, শবাধারের একপাশে যেন একটু ফাঁক রাখা হয় যাতে তার স্বামী একটু সান্ত্বনা পেতে পারেন।

কিন্তু ওই ধ্বংসযজ্ঞ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। অল্প কালের মধ্যেই ফারমিনা ডাজা উপলব্ধি করলো যে তার মৃত স্বামীর স্মৃতিকে আগুন মুছে ফেলতে পারবে না, কালের অগ্রযাত্রাও না : তার চাইতেও খারাপ : তার স্বামীর মধ্যে তাঁর বহু ভালো যে সব জিনিস সে ভালোবাসতো শুধু তার অভাবই সে বোধ করতে লাগলো না, যে সব জিনিস তাকে খুব বিরক্ত করতো, যেমন ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠার পর তিনি যে সব আওয়াজ করতেন, তার অভাবও সে অনুভব করতে লাগলো। এইসব স্মৃতি তাকে তার কণ্টকাকীর্ণ শোকের জলাভূমি অতিক্রম করতে সাহায্য করলো। সর্বোপরি, সে তার জীবন তার নিজের মতো করেই যাপন করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, সে মনে করতে লাগলো তার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন নি। সে জানতো যে প্রতিদিন প্রভাতে ঘুম থেকে ওঠার ব্যাপারটা কষ্টকর হয়েই থাকবে, কিন্তু সে এটাও জানতো যে ওই কষ্ট ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে।

বস্তুতপক্ষে তিন সপ্তাহ পরে সে প্রথম আলো দেখতে শুরু করে। কিন্তু সে আলো বৃহত্তর ও উজ্জ্বলতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে উপলব্ধি করলো যে তার জীবনে এক অশুভ অপছায়া আছে যে তাকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি দেয় না। এটা সেই করুণ অপছায়া নয় যে ইভাঞ্জেলস পার্কে তাকে তাড়না করে বেড়াতো, বার্ধক্যে পৌঁছবার পর সে ওই প্রাণীটি সম্পর্কে এক ধরনের মমত্ব অনুভব করতে শুরু করেছিলো, এটা অন্য একটা ঘৃণ্য প্রাণী, তার পরনে জল্লাদের ফ্রক-কোট, বুকের কাছে টুপি চেপে ধরা, যার চরম বিবেচনাহীন ঔদ্ধত্য তাকে এতই বিচলিত করেছিল যে ওর কথা না ভেবে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। আঠারো বছর বয়সের সময় ফ্লোরেন্টিনোকে প্রত্যাখ্যান করার পর থেকেই তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে সে তার মধ্যে একটা প্রচণ্ড ঘৃণার বীজ রোপণ করেছে যা ক্রমান্বয়ে শুধু বেড়ে উঠতে থাকবে। সে সর্বদা ওই ঘৃণার কথা ভেবেছে, অপছায়াটা কাছে এলেই সে বাতাসে তার উপস্থিতি টের পেয়েছে, তাকে দেখামাত্র সে ভীত বিচলিত হয়েছে, কখনোই তার সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে ব্যবহার করতে পারে নি। যে দিন রাতে তার জন্য ভালোবাসার কথা সে আবার উচ্চারণ করে, বাড়িতে তখনো তার মৃত স্বামীর জন্য আনা ফুলের গন্ধ ম’ ম’ করছে, তখন সে বিশ্বাস না করে পারে নি যে তার ওই ঔদ্ধত্য ছিল একটা প্রথম পদক্ষেপ, এর পর প্রতিশোধ নেবার জন্য তার যে আর কী অশুভ পরিকল্পনা আছে তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার নাছোড় স্মৃতি তার ক্রোধ আরো প্রজ্বলিত করলো। শেষকৃত্যের পর সে যখন সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে ওঠে তখন শুধু একটা ইচ্ছা- শক্তির সাহায্যে সে তার মন থেকে ওকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়, কিন্তু তার ক্রোধ বার বার ফিরে আসতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই সে বুঝতে পারলো যে ওকে ভুলে যাবার ইচ্ছাই হচ্ছে ওকে স্মরণ করবার সব চাইতে বড় উৎসাহদাতা। তখন, স্মৃতিবিধুরতার কাছে পরাজয় বরণ করে, সে এই প্রথম বারের মতো সাহস ভরে তার অবাস্তব প্রেমের অলীক দিনগুলির কথা স্মরণ করলো। সে মনে করতে চেষ্টা করলো ছোট পার্কটি তখন কেমন দেখতে ছিল, মলিন বাদাম গাছগুলি কেমন ছিল, কেমন ছিল ওই বেঞ্চটা যেখানে বসে ও তাকে ভালোবাসতো, কারণ ওগুলির কিছুই আর এখন তাদের পূর্ব রূপে বিরাজমান ছিল না। ওরা সব কিছু পাল্টে দিয়েছে, গাছগুলি কেটে ফেলেছে, হলুদ পাতার কার্পেট আর নাই, মুণ্ডুহীন বীরের মূর্তির জায়গায় অন্য এক মূর্তি স্থাপিত হয়েছে, তাঁর পরনে পুরো সামরিক পোশাক, কিন্তু কোনো নাম নাই, তারিখ নাই, বর্ণনা নাই, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক জমকালো স্তম্ভমূলের ওপর, আর ওরা সেখানে স্থাপন করেছে এই জেলার বৈদ্যুতিক কন্ট্রোলসমূহ। ফারমিনা ডাজার বাড়ি কয়েক বছর আগের প্রাদেশিক সরকারের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল, বাড়িটি এখন প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তখন কেমন দেখতে ছিল তা কল্পনা করা তার পক্ষে সহজ ছিল না। আর ওই অল্পভাষী বালক, বৃষ্টির মধ্যে এতো অসহায়, সেই যে ওই কীটদষ্ট জীর্ণ বৃদ্ধ, তার পরিস্থিতির কথা কিছুমাত্র বিবেচনা না করে, তার শোকের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা না দেখিয়ে, তার আগুনের মতো অপমানকর উক্তি দ্বারা তার আত্মাকে ঝলসে দিয়েছিল, একথা বিশ্বাস করা তার জন্য ছিল আরো কঠিন। ওই অপমানের ফলে এখনো তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ফারমিনা ডাজা ফ্লোর ডি মারিয়াতে তার খালাতো বোন হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজের খামারে গিয়েছিল মিস লিঞ্চ জনিত দুর্ভাগ্যের ধকল থেকে তার শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য। এবার বুড়ো, মোটা, পরিতৃপ্ত হিল্ডাব্রান্ডা তার এখানে এলো কয়েকদিন বেড়াবার জন্য, তার সঙ্গে আসে তার বড় ছেলে, সেও বাবার মতোই সেনাবাহিনীতে এক কর্নেল ছিল কিন্তু সান হুয়ান ডি লা সিনেগার কলাক্ষেতের শ্রমিকদের হত্যাযজ্ঞের সময় তার ঘৃণ্য আচরণের জন্য তার বাবা তাকে ত্যাগ করে। হিল্ডাব্রান্ডা আর ফারমিনা ডাজা স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুরনো দিনের কথা বলে কাটিয়ে দিতে, প্রথম যখন তাদের দেখা হয় সেই দিনগুলির স্মৃতিচারণ করতো তারা। হিল্ডাব্রান্ডা গতবার যখন এখানে আসে তখন তাকে আরো বেশি স্মৃতিকাতর দেখায়, বার্ধক্যের ভারে আরো বেশি পীড়িত। তাদের স্মৃতিচারণায় আরেকটু তীক্ষ্ণতা যুক্ত করার জন্য হিল্ডাব্রান্ডা ও ফারমিনা বহু দিন আগে প্রাচীন যুগের মহিলাদের সাজে সেজে বেলজিয়ান আলোকচিত্রশিল্পীকে দিয়ে যে ফোটো তুলিয়েছিলো সেটা সঙ্গে নিয়ে আসে। সেদিন বিকালে জুভেনাল উরবিনো একটা বাজে পরিস্থিতি থেকে একগুঁয়ে ফারমিনা ডাজাকে উদ্ধার করেছিলেন। ফারমিনা ডাজার কাছে ছবির কপিটা হারিয়ে গিয়েছিলো, হিল্ডাব্রান্ডার কপিও প্রায় মুছে যায়, তবু সেই সব মায়াবী দিনের মোহমুক্ত কুয়াশার মধ্য দিয়েও তারা তাদের দুজনকে চিনতে পারলো, যৌবনদীপ্ত এবং সুন্দরী, যে রকম তারা আর কখনো কোনো দিন হবে না।

হিল্ডাব্রান্ডার পক্ষে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা না বলা ছিল অসম্ভব, কারণ সে সবসময় ওর নিয়তিকে তার নিজের নিয়তির মতো করে দেখেছে। তার প্রথম টেলিগ্রাম পাঠাবার দিনটির কথা যখন তার মনে পড়ে তখনই তার স্মৃতিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা জেগে ওঠে। বিস্মৃতির কোলে নির্বাসিত ছোট্ট বিষণ্ণ পাখিটির কথা সে তার হৃদয় থেকে কখনোই মুছে ফেলতে পারে নি। পক্ষান্তরে, ফারমিনা ডাজা ওকে প্রায়ই দেখেছে কিন্তু কখনো তার সঙ্গে তার কথা হয় নি এবং ফ্লোরেন্টিনোই যে তার প্রথম প্রেমিক এটা সে কল্পনা করতে পারে নি। সে সব সময়ই তার সম্পর্কে নানা খবর পেয়েছে, শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব মানুষের খবরই যেমন, আগে হোক কিংবা পরে হোক, তার কাছে এসে পৌঁছতো। লোকে বলতো যে তার ব্যতিক্রমী অভ্যাসের জন্য সে বিয়ে করে নি, কিন্তু ফারমিনা ডাজা ওসব কথায় কান দেয় নি, অংশতঃ এই কারণে যে সে কখনো গুজবে কান দিতো না, তাছাড়া সন্দেহের ঊর্ধে যে সব মানুষ তাদের সম্পর্কেই এ জাতীয় কথা প্রচার করা হয়। অন্য দিকে এতো চমকপ্রদভাবে, সম্মানের সঙ্গে, জীবনে উন্নতি করার পর কেন সে আধ্যাত্মিক ঢং-এর পোশাক পরবে, বিরল লোশান গায়ে মাখবে, রহস্যজনক ভাবে চলাফেরা করবে এটা ফারমিনা ডাজার কাছে অদ্ভুত মনে হল। সে যে ওই একই ব্যক্তি ফারমিনা ডাজা তা বিশ্বাস করতে পারলো না, হিল্ডাব্রান্ডা যখন নিঃশ্বাস ফেলে বলতো, ‘বেচারা! কী কষ্টই না ও পেয়েছে!’ তখন ফারমিনা ডাজা সর্বদাই অবাক হয়ে যেতো। কারণ সে দীর্ঘকাল ধরে তার মধ্যে কোনো শোকের চিহ্ন দেখে নি, সে ছায়া অপসৃত হয়ে গিয়েছিলো।

তথাপি, ফ্লোর ডি মারিয়া থেকে ফেরার পরই সেদিন রাতে মুভি থিয়েটারে ওর সঙ্গে যখন তার দেখা হয় তখন তার বুকের মধ্যে কিছু একটা ঘটে যায়। ওর সঙ্গে যে একটি মেয়ে আছে আর সে যে কৃষ্ণাঙ্গিনী তাতে সে বিস্মিত হয় নি। ওর শরীর স্বাস্থ্য যে এতো ভালো আছে, ও যে এতো পরিপূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে চলাফেরা করছে তাই তাকে বিস্মিত করে, তার একথা মনে হল না যে তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে মিস লিঞ্চের বিপর্যয়কারী বিস্ফোরণের পর হয়তো সে-ই বদলে গেছে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নয়। এর পর থেকে এবং পরবর্তী পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে, সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে অধিকতর সদয় দৃষ্টিতে দেখেছে। মৃত স্বামীর জন্য জেগে থাকার রাতে সেখানে ওর উপস্থিতি তার কাছে শুধু যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হল না, সে এটাকে দেখলো বিদ্বেষের একটা স্বাভাবিক সমাপ্তি রূপে, ক্ষমা করবার এবং ভুলে যাবার একটা নিদর্শন হিসাবে। আর তাই ও যখন তার ভালোবাসার নাটকীয় পুনরুচ্চারণ করলো, তার দিক থেকে যে ভালোবাসার অস্তিত্ব কখনোই ছিল না এবং এমন এক বয়সে যখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজার এবং তার জীবনের কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার আশা নাই, তখন সে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলো।

প্রথম ধাক্কার পর স্বামীর প্রতীকী শবদাহের শেষেও তার মারাত্মক ক্রোধ অব্যাহত থাকে। যখন সে তা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হল তখন তা আরো বৃদ্ধি পেলো, আরো ব্যাপক হল। তার চাইতেও খারাপ : তার মনের যে সব স্থানে সে তার স্বামীর স্মৃতিকে প্রশান্ত আশ্রয় দিয়েছিল সে সব স্থান এখন ধীরে কিন্তু অপ্রতিহত ভাবে অধিকার করে নিচ্ছিলো পপি ফুলের ক্ষেত, একদা যেখানে সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার স্মৃতিকে কবর দিয়েছিল। না চাইলেও সে ওর কথা ভাবতে লাগলো, যত ভাবলো তত বেশি ক্রুদ্ধ হল, যত ক্রুদ্ধ হল তত বেশি করে ওর ভাবনা তার মনকে অধিকার করলো, শেষে অবস্থা এমন অসহনীয় হল যে সে তার কথা নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারলো না। তখন সে তার মৃত স্বামীর টেবিলে বসে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে তীব্র অপমান ও বিশ্রী অভিযোগ ভরা তিন পৃষ্ঠার এক অযৌক্তিক চিঠি লিখলো। আর ওই চিঠি তার দীর্ঘ জীবনে সচেতন ভাবে হীনতম কাজ করার সান্ত্বনা এনে দিলো তাকে।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জন্যও ওই ক’সপ্তাহ ছিল পরম যন্ত্রণার। সে রাতে ফারমিনা ডাজার কাছে নিজের ভালোবাসার কথা পুনর্ব্যক্ত করার পর সে অপরাহের প্রবল বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্ত রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়, নিজেকে প্রশ্ন করে, অর্ধশতাব্দী ধরে সে যে বাঘের আক্রমণ প্রতিহত করেছে এখন তাকে বধ করার পর তার চামড়া নিয়ে সে কি করবে। ভয়ঙ্কর বর্ষণের জন্য শহরে জরুরি অবস্থা বিরাজ করছিলো। কোনো কোনো বাড়িতে অর্ধউলঙ্গ মেয়ে-পুরুষ বন্যার জলে ভেসে যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্য থেকে যা কিছু সম্ভব তুলে নেয়ার চেষ্টা করছিলো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হয়েছিলো প্রত্যেকের বিপর্যয়ের সঙ্গে তার নিজের বিপর্যয়ের যেন কোনো একটা যোগ আছে। কিন্তু বাতাস ছিল শান্ত আর ক্যারিবীয় আকাশে নক্ষত্ররাজি ছিল আপন আপন স্থানে নীরব নিষ্পন্দ। অনেক কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ একটা নীরবতা নেমে এলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কানে অনেকদিন আগের একটা চেনা কণ্ঠস্বর এসে বাজলো, বহু বছর আগে ঠিক এই সময়ে রাস্তার ঠিক এই মোড়ে লিওনা কাসিয়ানি আর সে একটি লোককে গান গাইতে শুনেছিল, ‘আমি সেতুর উপর থেকে ফিরে এসেছি অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে।’ ওই রাতে গানটি, কোনো না কোনো ভাবে, শুধু তার একার জন্য, মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছিলো।

সে ট্রান্সিটো আরিজার অভাব গভীর ভাবে অনুভব করলো। সে ব্যাকুল হল তাঁর প্রাজ্ঞ কথাবার্তার জন্য, কাগজের ফুলের মুকুট শোভিত তাঁর নকল রানীর মাথার জন্য। এটা সে পরিহার করতে পারলো না। যখনই সে কোনো বিপর্যয়ের কিনারে এসে পৌঁছেছে তখনই তার প্রয়োজন হয়েছে কোনো নারীর সাহায্য। তাই, হাতের কাছে কাদের পাওয়া যেতে পারে সেকথা ভাবতে ভাবতে সে যখন আমেরিকা ভিসুনার হোস্টেলের দীর্ঘ জানালার সারিতে একটা আলো দেখলো তখন তার ইচ্ছা হয়েছিল, পিতামহের উন্মত্ততা নিয়ে, এই রাত দুটোর সময় ঘুমে কাদা হয়ে থাকা একগাদা কাপড় জড়ানো, তখনো গায়ে দোলনার হুটোপুটির গন্ধ মাখা, ওই মেয়েকে নিয়ে সে কোথাও উধাও হয়ে যায়। বহু কষ্টে সে তার সে-ইচ্ছা দমন করেছিলো।

শহরের অপর প্রান্তে ছিল লিওনা কাসিয়ানি, একা এবং মুক্ত এবং যে স্নেহ-দয়া মায়া তার প্রয়োজন তা দেখাতে প্রস্তুত, রাত দু’টা কি তিনটায় কি যে কোনো সময়ে এবং যে কোনো অবস্থায়। তার নিদ্রাহীন রাতগুলির নিষ্ফলা পোড়ো জমিতে এই প্রথম সে তার দরজায় করাঘাত করবে না, কিন্তু সে জানতো যে লিওনা অতিশয় বুদ্ধিমতী এবং তাকে কারণটা না বলে তার কাছে ছুটে গিয়ে তার কোলে মুখ গুঁজে অশ্রু বিসর্জন করা সম্ভব নয়। নির্জন শহরের রাস্তায় ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সে অনেক চিন্তার পর ঠিক করলো, এখন তার জন্য সর্বোত্তম হল ‘দুজনের বিধবা’, বয়সে তার চাইতে ছোট, প্রুডেনসিয়া পিটারের কাছে যাওয়া। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় গত শতকে, পরবর্তী সময়ে তাদের যে আর দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছিল না তার একটাই কারণ ছিল, প্রায়- অন্ধ এবং বার্ধক্যের অক্রমণে বিধ্বস্ত প্রুডেনসিয়া তার ওই চেহারা কাউকে দেখাতে দিতে রাজি ছিল না। তার কথা মনে হওয়া মাত্র ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জানালার সরণীতে ফিরে এসে একটা বাজারের থলির মধ্যে দুবোতল পোর্ট সুরা এবং এক শিশি আচার ভর্তি করে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য রওনা হল, সে এখনো তার পুরনো বাসায় আছে কিনা, সে একা আছে কিনা, সে বেঁচে আছে কিনা কিচ্ছু না জেনেই।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার সঙ্কেত হিসাবে ওর দরজায় আঁচড় কাটার শব্দ করতো, ওই ভাবেই সে তার পরিচিতির জানান দিত, তখনো তারা নিজেদের তরুণ বলেই মনে করতো যদিও তারা আসলে তেমন ছিলো না আর। প্রুডেনসিয়া ওই সঙ্কেতের কথা ভোলে নি। আঁচড়ানোর শব্দ শুনে কোনো প্রশ্ন না করে সে তার দরজা খুলে দিয়েছিলো। রাস্তা ছিল অন্ধকার, তার কালো স্যুট, অনমনীয় হ্যাট, বাহুতে ঝোলানো বাদুড়ের ছাতা নিয়ে তাকে প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না, জোরালো আলো ছাড়া তাকে দেখা প্রুডেনসিয়ার পক্ষে ছিল প্রায় অসম্ভব, কিন্তু তার চশমার ধাতুর ফ্রেমের উপর পড়া রাস্তার বাতির আভায় সে তাকে চিনতে পারলো। তাকে দেখাচ্ছিল একটা খুনির মতো, যার হাতে এখনো রক্ত লেগে আছে। সে বলল, ‘এক বেচারা এতিমের জন্য নিরাপদ আশ্রয় চাই।’

একটা কিছু বলার জন্যই ওই কথাটাই তার তখন মনে আসে। ওকে শেষ বার দেখার পর ও যে ইতিমধ্যে এতো বুড়ো হয়ে গেছে তা দেখে সে অবাক হল। সে বুঝলো যে প্রুডেনসিয়াও নিশ্চয়ই তার সম্বন্ধে একই কথা ভাবছে। কিন্তু সে নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দিলো যে অল্পক্ষণের মধ্যেই, প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলেই, জীবন তাদের যে সব আঘাত দিয়েছে তা তারা ক্রমেই কম দেখতে পাবে এবং তখন, প্ৰথম সাক্ষাতের সময় তারা যেমন তরুণ ছিল আবার তারা নিজেদের সেই রকম তরুণ বলে অনুভব করবে।

প্রুডেনসিয়াল বললো, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি যেন কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাচ্ছো।’

কথাটা ছিলো যথার্থ। প্রায় সকল নগরবাসীর মতো সেও এগারোটা থেকে তার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আর্চবিশপ ডি লুনার মৃত্যুর পর এযাবৎকালীন সব চাইতে বড় ও সব চাইতে জমকালো শোক শোভাযাত্রা দেখছিলো। মাটি কাঁপিয়ে দেয়া কামানের বজ্রগর্জনে, মার্চ করা বাদকদলের বেসুরের বাজনায় আর গতকাল থেকে অব্যাহত ভাবে বেজে চলা সবগুলির গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি ছাপিয়ে আজ এই শোকগীতির ডামাডোলে তার দিবানিদ্রা ভেঙে গিয়েছিলো। তার বারান্দা থেকে সে দেখতে পায় পুরো ধরাচূড়া পরা অশ্বারোহী সেনাদল, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের লোকজন, অদৃশ্য আমলাতন্ত্রের কালো বিরাট মোটরগাড়ির বহর, পালকের শিরাভরণ ও সোনালি ঝালরে সজ্জিত ঘোড়ার গাড়িগুলি, একটা ঐতিহাসিক কামান বসানো কামানবাহী গাড়ির উপরে পতাকায় মোড়া হলুদ শবাধারটি, আর সব শেষে কয়েকটি হুড নামানো ভিক্টোরিয়া গাড়ি, যেগুলি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সমাধির উপর বিছিয়ে দেবার জন্য অনেকগুলি ফুলের মালা। এরা প্রুডেনসিয়া পিটারের বারান্দা ছাড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে, মধ্যাহ্নের সামান্য পরেই, শুরু হয় তুমুল বর্ষণ, আর তার প্রচণ্ডতায় একটা বিশৃঙ্খল হুড়াহুড়ির মধ্যে শোক শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

প্রুডেনসিয়া বললো, ‘কী উদ্ভট ভাবে মারা গেল!’

ফ্লোরেন্টিনো বললো, ‘হাস্যকরতা সম্পর্কে মৃত্যুর কোনো বোধ নাই’, তারপর বেদনাভরা গলায় যোগ করলো, “বিশেষ করে আমাদের মতো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে। ওরা বসেছিলো সামনের বারান্দায়, মুখের সামনে উন্মুক্ত সাগর, তারা তাকিয়েছিলো অর্ধাকাশ জুড়ে বিরাজিত গোল চাঁদের দিকে, দিকচক্রাবাল রেখায় চলমান জাহাজের আলোকমালার দিকে, তারা উপভোগ করলো ঝড়ের পরের কোমল সুরভিত বাতাস। প্রুডেনসিয়া পিটার রান্নাঘরে গিয়ে দেশী রুটি কেটে কয়েকটা টুকরা নিয়ে এলো, তার ওপর আচার মাখিয়ে তারা তা খেলো, আর পান করলো পোর্ট সুরা। প্রুডেনসিয়ার নিঃসন্তান বিধবার জীবনযাপন কালে তারা দুজন অনেক রাত এই ভাবে কাটিয়েছিল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার দেখা পায় এমন একটা সময়ে যখন যেকোন লোক তার সঙ্গ কামনা করলেই সে তাকে স্বাগত জানাতো, তাকে যদি ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া করতে হত তবুও, আর এই সময়ে তারা দুজন এমন একটা গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে যা সম্ভবপর বলে মনে হয় নি।

যদিও ও কখনো বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত দেয় নি তবু ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বিয়ে করার জন্য সে শয়তানের কাছে তার আত্মা পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে পারতো। সে জানতো তার কৃপণতা, তার অকালবৃদ্ধের চেহারা, তার পাগলের মতো শৃঙ্খলা বোধ, কিছুই না দিয়ে সব কিছু চাইবার ব্যগ্রতা প্রভৃতির সামনে নতিস্বীকার করা সহজ হবে না, কিন্তু এই সব কিছু সত্ত্বেও ওর চাইতে ভালো সঙ্গী আর কেউ হতে পারতো না, কারণ এ পৃথিবীতে তার চাইতে ভালোবাসার বেশি প্রয়োজন আর কোনো মানুষের ছিল না। কিন্তু তার মত এতো পলায়নপরও কেউ ছিল না, তাই, তার দিক থেকে, ওদের ভালোবাসা একটা বিন্দুর পর আর অগ্রসর হয় নি। ফারমিনা ডাজার জন্য তাকে মুক্ত থাকতে হবে, তার এই সিদ্ধান্তে বাধা হতে পারে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছবার আগেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে থামতে হত। তবু প্রুডেনসিয়া পিটারের সঙ্গে তার সম্পর্ক বহু বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এক ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যানের সঙ্গে সে প্রুডেনসিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়, ওই ভদ্রলোক তিন মাস বাড়িতে থাকতেন, পরের তিন মাস ঘুরে বেড়াতেন। প্রুডেনসিয়ার বিয়ের পরও তার সঙ্গে ফ্লোরেন্টিনোর সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। প্রুডেনসিয়ার এক মেয়ে ও চার ছেলে হয়, সে জোর দিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে জানায় যে একটি সন্তান তার।

ওরা দুজন কথা বলে চলে, সময়ের কোনো হিসাব না রেখে। তাদের যৌবনকালের বহু নিদ্রাহীন রাত তারা এই ভাবে গল্প করে কাটিয়েছে, আর এখন তো এই বৃদ্ধ বয়সে নিদ্রাহীনতা তাদের সামান্য ক্ষতিই করতে পারবে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রায় কখনোই দু’গ্লাসের বেশি সুরাপান করতো না, কিন্তু আজ তিন গ্লাসের পরও তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো অসুবিধা দেখা গেল না। দরদর করে সে ঘামছিলো, ‘দুজনের বিধবা’ তাকে তার কোট খুলে ফেলতে বললো, গেঞ্জি, প্যান্ট, ইচ্ছা করলে সব সে খুলে ফেলতে পারে, কিসের ভাবনা তাদের, তারা দুজন তো পরস্পরকে জামা-কাপড় পরা অবস্থার চাইতে নিরাভরণ অবস্থাতেই বেশি দেখেছে। ফ্লোরেন্টিনো রাজি হল কিন্তু বললো যে সে ক্ষেত্রে প্রুডেনসিয়াকেও তা করতে হবে, কিন্তু প্রুডেনসিয়া সম্মত হল না, কিছুকাল আগে সে তার পোশাকের আলমারির আয়নায় নিজেকে দেখেছিল, আর তখনই সে অকস্মাৎ উপলব্ধি করে যে আর কারো সামনেই, কখনোই, সে নিরাভরণ অবস্থায় নিজেকে দেখাতে পারবে না, ফ্লোরেন্টিনোর সামনে নয়, কারো সামনেই নয়।

চার গ্লাস সুরা পান করেও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার চিত্তের অস্থিরতা দমন করতে ব্যর্থ হল, বারবার সে একই বিষয় নিয়ে বিশদ ভাবে কথা বলে চললো : অতীত, অতীতের মধুর সব স্মৃতি নিয়ে। তাকে স্বস্তি দেবে অতীতের মধ্যে ওই রকম একটা গোপন পথ খুঁজে পাবার জন্য সে মরীয়া হয়ে উঠেছিল। কারণ ওটাই তার দরকার ছিল, তাহলেই তার মুখের মধ্য দিয়ে তার আত্মা অন্তর্হিত হয়ে যাবে। সে যখন দিকচক্রবালে ঊষার প্রথম আলো ফুটতে দেখলো তখন সে একটা পরোক্ষ পথে অগ্রসর হল। হঠাৎ করেই সে যেন ওকে একটা প্রশ্ন করলো, ‘শোনো, তোমার বয়সের একজন বিধবাকে, তুমি যেমন আছো তেমন অবস্থাতে, কেউ যদি বিয়ের প্রস্তাব করে তাহলে তুমি কি করবে?’ তার কথা শুনে সে তার কুঞ্চিত বৃদ্ধার মুখ নিয়ে হেসে উঠলো, তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘তুমি কি বিধবা উরবিনোর কথা বলছো?’

মেয়েদের ক্ষেত্রে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সব সময় একটা বিষয় ভুলে যেতো, যেটা ভোলা তার উচিত হত না, বিশেষ করে প্রুডেনসিয়া পিটারের মতো মেয়েদের ক্ষেত্রে : তাদের কেউ কোনো প্রশ্ন করলে তারা সব সময়ই প্রশ্নের চাইতে বেশি মনোযোগ দেয় প্রশ্নের আড়ালে লুকানো অর্থের দিকে। প্রুডেনসিয়ার মর্মান্তিক লক্ষ্যভেদে আতঙ্কিত হয়ে সে পিছু হটে বললো, ‘আমি তোমার কথা বলছিলাম।’ ও আবার হেসে উঠে বললো, ‘যাও, তোমার ওই হতচ্ছাড়ি মায়ের সঙ্গে গিয়ে ঠাট্টা-তামাশা কর। ঈশ্বর তাঁকে শান্তি দিন।’ তারপর ও কি সত্যি সত্যি বলতে চায় সেকথা তাকে খুলে বলতে বললো। সে জানতো যে ও, কিংবা যে কোনো মানুষ, এতো বছর একে অন্যকে না দেখার পর শুধু সুরা পান আর আচার সহযোগে দেশি রুটি খাবার জন্য রাত তিনটার সময় তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো না। সে বললো, ‘এক সঙ্গে কাঁদবার জন্যই শুধু কেউ এটা করে।’

ফ্লোরেন্টিনো বললো, ‘একবারের জন্য হলেও এবার তুমি ভুল করেছো। আজ আমি এখানে এসেছি গান গাইবার জন্য।’

“তাহলে গাওয়া যাক’, সে বললো।

আর বলেই সে গাইতে শুরু করলো, সুন্দর গলা, তখনকার দিনের একটা জনপ্রিয় গান ধরলো সে : ‘রামোনা, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।’ যামিনী শেষ হয়ে গিয়েছিল। যে নারী বহুবার প্রমাণ দিয়েছে যে চাঁদের কালো দিকটা তারা জানা সে নারীর সঙ্গে নিষিদ্ধ খেলায় অবতীর্ণ হতে ওর সাহস হল না। সে বেরিয়ে এলো ভিন্ন এক নগরীতে, তার যৌবনের এক সড়ক, জুন মাসের শেষ ডালিয়ার সুরভিতে সুবাসিত এই নগরী, সকাল পাঁচটার উপাসনা শেষে ছায়ার মতো বিধবা নারীরা সারি বেঁধে চলেছে। কিন্তু এখন ওরা নয়, সে রাস্তা পার হয়ে অন্য পাশে চলে গেল, যে- অশ্রু সে রোধ করতে পারছিলো না তা যেন ওরা না দেখতে পায়, এ তার মধ্যযামিনীর অশ্রু নয়, অন্য অশ্রু, যা সে তার বুকের মধ্যে চেপে রেখে আসছে একান্ন বছর নয় মাস চার দিন ধরে।

সে সময়ের সব হিসাব হারিয়ে ফেলেছিল। সে যখন একটা বড় ঝলমলে জানালার সামনে জেগে উঠলো তখন সে যে কোথায় তা বুঝতে পারলো না। সে আমেরিকা ভিসুনার গলা শুনতে পেলো, ও বাগানে কাজের মেয়েদের সঙ্গে বল খেলছে। ওই শব্দ তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। সে শুয়ে আছে তার মায়ের বিছানায়। সে তাঁর বিছানা আগের মতোই রেখেছিলো, নিজের নিঃসঙ্গতায় খুব খারাপ লাগতে শুরু করলে সে এই বিছানায় ঘুমতো, এতে তার একাকিত্ব একটু কমতো। খাটের এক মাথায় ছিলো ডন সাঙ্কোর সরাই থেকে আনা বিরাট দর্পণটি, ঘুম থেকে জেগে ওদিকে তাকানো মাত্রই সে তার গভীরে প্রতিবিম্বিত দেখতে পেতো ফারমিনা ডাজাকে। সে বুঝলো যে আজ শনিবার, কারণ তার ড্রাইভার প্রতি শনিবার আমেরিকা ভিসুনাকে তার বোডিং স্কুল থেকে ফ্লোরেন্টিনোর বাড়িতে নিয়ে আসতো। সে উপলব্ধি করলো যে নিজের অজান্তেই সে ঘুমিয়েছে, ঘুমাতে পারছে না ওই স্বপ্ন দেখতে দেখতে, আর তার স্বপ্নকে বিঘ্নিত করেছে ফারমিনা ডাজার ক্রুদ্ধ মুখ। সে স্নান করলো, এর পর কি করবে চিন্তা করলো, খুব ধীরে ধীরে তার সব চাইতে ভালো পোশাক পরলো, কোলোন মাখলো, সাদা গোঁফের প্রান্তদেশ মোম দিয়ে ছুঁচলো করলো, শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, দোতলার হলঘর থেকে ইউনিফর্ম পরা সুন্দরী বালিকাটিকে দেখলো, অপরূপ ভঙ্গি করে বল ধরছে, ওই ভঙ্গি কতো শনিবার তার বুকের মধ্যে কাঁপন ধরিয়েছে, কিন্তু আজ সকালে তা তাকে একটুও চঞ্চল করলো না। সে ওকে তার সঙ্গে যেতে ইঙ্গিত করলো, তারপর গাড়িতে ওঠার আগে ওকে বললো, যদিও তার দরকার ছিল না, ‘আজ আমরা আমাদের নিয়মিত কাজগুলি করবো না।’ সে ওকে আমেরিকান আইসক্রিম বিপণীতে নিয়ে গেল। তখন ওখানে, মসৃণ ছাদ থেকে ঝোলানো পাখার লম্বা লম্বা ব্লেডের নিচে বসে, অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের সঙ্গে আইসক্রিম খাচ্ছেন। আমেরিকা ভিসুনা বড় এক গ্লাস নানা স্তর বিশিষ্ট আইসক্রিম অর্ডার দিল, একেক স্তরের একেক রঙ, তার প্রিয় ডিশ, এই সময়ের খুব জনপ্রিয় আইসক্রিম, তার মায়াবী আভার জন্য। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কালো কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে, কোনো কথা না বলে, ওকে লক্ষ করলো। সে একটা লম্বা হাতলের চামচ দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে যেন তলা পর্যন্ত খেতে পারে। তাকে লক্ষ করতে করতেই, কোনো রকম সতর্কতা সঙ্কেত না দিয়ে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বললো, ‘আমি বিয়ে করছি।’

ও একটা অনিশ্চয়তার ঝিলিক দিয়ে তার চোখের দিকে তাকালো, ওর চামচ শূন্যে ধরা, তারপরই সামলে নিয়ে হাসলো, বললো, ‘যাঃ! মিছে কথা! বুড়ো মানুষরা বিয়ে করে না।’

সেদিন তারা দুজন পার্কে পুতুল নাচ দেখলো, জাহাজঘাটে ভাজা মাছের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাওয়া খেলো, শহরে সদ্য আগত সার্কাসের জায়গায় গিয়ে খাঁচায় আটকানো প্রাণীগুলি দেখলো, মুক্তাঙ্গনের স্টল থেকে নানা রকম লজেন্স, টফি, চকোলেট কিনলো, ও স্কুলে ফিরবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবে, গাড়ির হুড নামিয়ে দিয়ে শহরে কয়েকবার চক্কর খেলো, তারপর শেষ বিকালে গির্জায় যখন সান্ধ্যকালীন উপাসনার ঘণ্টাধ্বনি হল তখন এক হারে ঝরে পড়া প্রবল বর্ষণের মধ্যে ফ্লোরেন্টিনো ওকে ওর বোর্ডিং স্কুলে নামিয়ে দিলো। আজ সারাদিন সে ওকে একটা বিষয়ে অভ্যস্ত হবার সময় ও সুযোগ দিল, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আর ওর প্রেমিক নয়, শুধু ওর অভিভাবক। রবিবার সে ওর জন্য তার গাড়ি পাঠিয়ে দিলো, যেন ইচ্ছা করলে ও তার বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে যেতে পারে, কিন্তু সে নিজে ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলো না, কারণ গত সপ্তাহে সে ওদের দুজনের বয়স সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠেছিলো। সে রাতে সে স্থির করলো, ফারমিনা ভাজাকে সে একটা চিঠি লিখবে, তার ক্ষমা প্রার্থনা করে, ওই চিঠির একমাত্র উদ্দেশ্য হবে শুধু এটুকু বোঝানো যে সে হাল ছেড়ে দেয় নি, আগামী দিনের জন্য শুধু একটু পিছিয়ে দিলো। তারপর, সোমবার, ঠিক তিন সপ্তাহের অসম্ভব যন্ত্রণা ভোগের পর, বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপ হয়ে, বাড়িতে ঢুকেই সে ওর চিঠিটা পেলো।

তখন রাত আটটা। কাজের মেয়ে দুটি শুয়ে পড়েছে। ওরা হলঘরের আলোটা জ্বালিয়ে রেখেছে যেন সে সহজে তার শোবার ঘরে হেঁটে যেতে পারে। সে জানতো যে তার বাহুল্যবর্জিত নিতান্ত সাদামাটা খাবার টেবিলে সাজানো থাকবে। অনেক দিন অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার পর আজ তার কিছুটা ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছিল কিন্তু এখন ওই চিঠি তাকে প্রচণ্ড আবেগতাড়িত করলো, তার ক্ষুধা সম্পূর্ণ উবে গেল। তার হাত এতো কাঁপতে থাকে যে শোবার ঘরে মাথার উপর দিকের বাতিটা সে জ্বালাতে পারছিলো না। বৃষ্টিতে ভেজা চিঠিটা সে বিছানার উপর রাখলো, রাতের টেবিলের উপরে আলোটা জ্বালালো, একটা প্রশান্তির ভান করে সে এসব করলো, নিজেকে শান্ত করার এটাই ছিল তার চিরাচরিত পন্থা। সে তার ভেজা কোট খুলে চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে দিলো, তার ভেস্ট খুললো, সযত্নে সেটা ভাঁজ করে কোটের উপর রাখলো, তার কালো সরু টাই খুললো, তার সেলুলয়েডের কলার খুললো যা আজকাল খুব কমই কেউ ব্যবহার করে, কোমর পর্যন্ত সে তার শার্টের বোতামগুলি খুললো, তার কোমরের বেল্ট শিথিল করলো যেন আরেকটু আরাম করে নিঃশ্বাস নিতে পারে এবং সব শেষে সে তার মাথার টুপিটা খুলে শুকাবার জন্য জানালার পাশে রেখে দিলো। তারপরই সে কাঁপতে শুরু করলো কারণ কোথায় চিঠিটা রেখেছে তা সে মনে করতে পারলো না। তার স্নায়বিক উত্তেজনা এতো প্রবল হয়ে ওঠে যে চিঠিটা যখন পেলো তখন সে অবাক হয়ে গেলো। খামটা খুলবার আগে সে তার রুমাল দিয়ে ওটা শুকিয়ে নিলো, সযত্নে, যেন কালি লেপ্টে না যায়, ওই খামের উপর তার নাম লেখা আছে, আর তখনই তার মনে হল এই গোপন ব্যাপারটা এখন আর দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অন্তত তিনজন এর কথা জানে। যে লোকই এ চিঠি এখানে দিয়ে গিয়ে থাকে সে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে যে বিধবা উরবিনো স্বামীর মৃত্যুর মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই তার নিজস্ব ভুবনের বাইরের একটি মানুষের কাছে চিঠি লিখেছে এবং তা এমন জরুরি ছিল যে সে ওই চিঠি সাধারণ ডাকে পাঠায় নি এবং সে এ ব্যাপারে এমন গোপনীয়তা অবলম্বন করেছে যে চিঠিটা কারো হাতে না দিয়ে দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে, যেন এটা কোনো বেনামি পত্র। তাকে খামটা ছিঁড়তে হল না, কারণ বৃষ্টিতে ভিজে আঠা গলে গিয়েছিল, কিন্তু ভেতরের চিঠি ছিল শুষ্ক : ঘন করে লেখা তিন পৃষ্ঠা, সম্বোধনহীন, সই- -এর জায়গায় তার বিবাহিত নামের আদ্যাক্ষরগুলি।

সে বিছানায় বসলো, তারপর যত দ্রুত সম্ভব একবার চিঠিটা পড়লো, বিষয়বস্তুর চাইতে চিঠির সুর তার বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করলো, আর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় পৌঁছবার আগেই সে বুঝলো যে এটা যথার্থই তার প্রত্যাশিত অপমানজনক পত্রই। সে চিঠিটা ভাঁজ না করে, বিছানার পাশের বাতি যেখানে আলো ফেলেছিলো সেখানে রাখলো, তার জুতা ও ভেজা মোজা খুললো, দরজার কাছে গিয়ে সুইচ টিপে উপরের বাতিটা নিভিয়ে দিলো, তারপর তার শ্যাময় চামড়ার আভরণ দিয়ে তার গোঁফ জোড়ার প্রান্তদেশ ঢেকে, প্যান্ট এবং শার্ট না খুলে বিছানায় শুয়ে পড়লো, মাথা রাখলো দুটো বৃহাদাকার বালিশের উপর যার গায়ে সে পড়ার সময় তার পিঠ হেলান দিতো। তখন সে চিঠিটা আবার পড়লো, এবার প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, চিঠির মধ্যে গোপন কোনো উদ্দেশ্য থাকলে তা যেন কিছুতেই তার দৃষ্টি এড়িয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখলো, তারপর সে চিঠিটা চার বার পড়লো, অবশেষে লিখিত শব্দের ভারে সে এতোই মুহ্যমান হয়ে পড়ে যে কথাগুলি অর্থহীন হয়ে উঠতে শুরু করে। অবশেষে সে চিঠিটা, খাম ছাড়াই, তার রাতের টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে, মাথার পেছনে দু’হাত দিয়ে চিৎ হয়ে শুলো, চোখের পলক না ফেলে চার ঘণ্টা ওই ভাবে শুয়ে থাকলো, নিঃশ্বাস পর্যন্ত যেন ফেললো না, একজন মৃত ব্যক্তির চাইতেও বেশি মৃত, দর্পণের যে জায়গায় ও ছিলো সে জায়গাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। ঠিক রাত বারোটায় সে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে এক থর্মেস কালো কফি বানালো, অপরিশোধিত তেলের মতো ঘন, সেটা নিয়ে তার ঘরে ফিরলো, তার রাতের টেবিলে সব সময় বোরিক অ্যাসিড মেশানো যে এক গ্লাস জল ঠিক করা থাকতো তার মধ্যে নিজের নকল দাঁত রেখে দিলো, তারপর মর্মর মূর্তির মতো আবার তার আধশোয়া অবস্থায় ফিরে গেলো, শুধু কফিপানের মুহূর্তে সে তার ওই অবস্থান পরিবর্তন করলো। সকাল ছ’টায় পরিচারিকা নতুন এক থর্মেস কফি নিয়ে আসা পর্যন্ত সে ওই ভাবেই রাত কাটিয়ে দিলো।

ততক্ষণে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলির একটা কী হবে তা ঠিক করে ফেলেছিলো। আসলে, অপমানগুলি তাকে বিশেষ কষ্ট দেয় নি। ফারমিনা ডাজার স্বভাব ও তার পরিস্থিতির গুরুত্বের বিবেচনায় ও যেসব অন্যায় অভিযোগ করেছে তার চাইতে আরো খারাপ কিছু করতে পারতো, তাই সে সব খণ্ডন করার জন্য সে বিশেষ চিন্তিত হল না। চিঠিটা, শুধু চিঠিটাই, তার সকল মনোযোগ আকর্ষণ করলো, এটা তাকে সুযোগ দিলো, এমনকি অধিকার দিলো, উত্তর প্রদানের। তার চাইতেও বেশি : এটা একটা উত্তর দাবি করলো। অতএব সে জীবনকে যেখানে চেয়েছিলো জীবন এখন সেই খানে এসে দাঁড়িয়েছে। বাকি সব কিছু নির্ভর করছে তার ওপর। সে নিশ্চিত জানতো যে তার অর্ধশতাব্দীর বেশি ব্যক্তিগত নরক তাকে আরো অনেক মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, কিন্তু সে এখন আগের চাইতে বেশি উদ্যম, বেশি দুঃখ, বেশি ভালোবাসা নিয়ে তার মুখোমুখি হবে, কারণ এ হবে তার শেষ প্রয়াস।

ফারমিনা ডাজার চিঠি পাবার পাঁচ দিন পর সে যখন তার আপিসে গেল তখন তার মনে হল সে যেন টাইপ রাইটারগুলির কোলাহলবর্জিত এক আকস্মিক ও অস্বাভাবিক নীরবতার মধ্যে ভাসছে। ওই শব্দ, বৃষ্টির ধ্বনির মতো, নীরবতার চাইতেও কানে কম বাজতো। শব্দটা যখন আবার শুরু হল ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তখন লিওনা কাসিয়নির দপ্তরে গেল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে তাকে দেখলো তার নিজস্ব টাইপ রাইটারের সামনে বসা, তার আঙ্গুলের চাপে সেটা এমনভাবে সাড়া দিচ্ছিল যেন সেটা একটা মানুষ। লিওনা টের পেলো যে কেউ তাকে দেখছে, কিন্তু অনুচ্ছেদটি শেষ না করা পর্যন্ত সে টাইপ করা বন্ধ করলো না। তার মুখে লেগে থাকে তার ওই ভয়ঙ্কর সূর্যের মতো হাসি।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জিজ্ঞাসা করলো, ‘ওগো আমার আত্মার সিংহকন্যা, আমাকে একটা কথা বলো, তুমি যদি ওই যন্ত্রে লেখা একটা প্রেমপত্র পেতে তা হলে তোমার কি রকম লাগতো?”

ও এখন আর কোনো কিছুতে অবাক হতো না, কিন্তু এ প্রশ্ন শুনে ও সত্যিই অবাক হলো।

‘কী কাণ্ড!’ ও উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলো, ‘এটা আমার কখনো মনেই হয় নি।’

ওই কারণেই সে আর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও এই মুহূর্তটির আগে এ বিষয়ে কখনো কিছু ভাবে নি, কিন্তু এখন কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই সে ঝুঁকিটা নেবার সিদ্ধান্ত নিলো। সে আপিসের একটা টাইপ রাইটার বাড়ি নিয়ে গেল, তার অধস্তন কর্মচারীরা খোশমেজাজে ঠাট্টা করলো, ‘বুড়ো কুকুরকে নতুন খেলা শেখানো যায় না।’ নতুন যে কোনো বিষয়ে পরম উৎসাহী লিওনা কাসিয়ানি বললো যে সে তার বাড়ি গিয়ে তাকে টাইপ করা শেখাতে রাজি আছে। কিন্তু বহুকাল আগে লোটারিও থুগুট যখন তাকে স্বরলিপির সাহায্যে বেহালা বাজানো শেখাতে চেয়েছিলো তখন সে তাকে সাবধান করে বলেছিল যে বাজাতে শুরু করতে তার পাঁচ বছর লাগবে, তারপর পেশাদার অর্কেস্ট্রা দলে বাজাবার উপযুক্ত হতে আরো পাঁচ বছর লাগবে, তারপর ভালো করে বাজাবার জন্য জীবনের বাকি সময় প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে অনুশীলন করতে হবে, তখন থেকেই সে নিয়ম মেনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিরোধী হয়ে উঠেছিল। তবু সে তার মাকে রাজি করায়, মা এক অন্ধ বেহালা বাদকের কাছ থেকে তার বেহালা কিনে ওকে দেয় এবং লোটারিও থুগুট তাকে যে পাঁচটি মূল নীতির কথা বলেছিল তার সাহায্যে সে এতোটাই পারদর্শিতা অর্জন করে যে এক বছর পুরো না হতেই সে সাহস করে ক্যাথিড্রালের গানের দলের সঙ্গে বেহালা বাজায়, আর নিঃসদের সমাধিক্ষেত্র থেকে বাতাসের গতিপথ অনুসরণ করে ফারমিনা ডাজাকে সেরেনাদ করতে সমর্থ হয়। সেই সময় থেকেই সে নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধমে কিছু আয়ত্ত করার বিরোধী হয়ে ওঠে। বিশ বছর বয়সের সময় যদি সে বেহালা বাদনের মতো একটা কঠিন কাজ ওই ভাবে শিখতে পারে তাহলে ছিয়াত্তর বছর বয়সে টাইপ রাইটারের মতো এক আঙ্গুলের একটা যন্ত্র কেন সে আয়ত্ত করতে পারবে না?

সে ঠিকই ভেবেছিলো। কিবোর্ডে অক্ষরগুলির অবস্থান শিখতে তার তিন দিন লাগে, টাইপ করতে করতে চিন্তা করতে শিখতে তার লাগে আরো ছয় দিন, তারপর নির্ভুল ভাবে তার প্রথম চিঠি লিখতে আরো তিন দিন লাগে তার, অবশ্য তার আগে তাকে আধ রিম কাগজ নষ্ট করতে হয়। সে তার চিঠি শুরু করলো একটা গম্ভীর সম্ভাষণ দিয়ে- ‘সিনরা’- এবং সই করলো তার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে, তার যৌবনের সুরভিত প্রেমপত্রগুলিতে যেভাবে করতো ঠিক সেই ভাবে। একটা শোকের প্রতীক চিহ্ন সংবলিত খামে ভর্তি করে সে চিঠিটা ডাকে দিল। সদ্য বিধবার কাছে লেখা চিঠির জন্য ওই রকম খাম ব্যবহার করাই ছিল রীতিসম্মত। খামের উল্টো দিকে সে প্রেরকের কোনো নাম ঠিকানা দিলো না।

ওটা ছিল ছয় পৃষ্ঠার একটা চিঠি। ওরকম কোনো চিঠি সে আগে কখনো লেখে নি। এর মধ্যে তার অল্প বয়সের প্রেমপত্রগুলির সুর কিংবা ভঙ্গি কিংবা কাব্যিক আবহ ছিলো না, আর তার বক্তব্য ছিল এতো যুক্তিসঙ্গত, এতো ওজন করা, যে এর মধ্যে গার্ডেনিয়া ফুলের গন্ধ যোগ করলে তা হতো খুবই বেমানান। এক দিক থেকে যে ব্যবসায়িক চিঠি লিখতে সে কখনো সক্ষম হয় নি, এটা ছিল তার খুব কাছাকাছি একটা চিঠি। বহু বছর পরে টাইপ করা ব্যক্তিগত চিঠি অপমানকর বলে বিবেচিত হত, কিন্তু ওই সময়ে টাইপ রাইটারকে একটা দাপ্তরিক জন্তুর মতো দেখা হত, যার নিজের কোনো নৈতিক নীতিমালা নেই এবং ব্যক্তিগত কাজে তার গার্হস্থ্যকরণ বিষয়ে ভদ্র আচার-আচরণের নিয়মকানুনের কেতাবেও কিছু লিপিবদ্ধ ছিলো না। ফারমিনা ডাজার কাছে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই একটা সাহসী আধুনিকতা বলে মনে হয়েছিল, কারণ সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে লেখা তার দ্বিতীয় চিঠি শুরু করে তার হাতের লেখা পড়তে যদি কোনো অসুবিধা হয় সে জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, কিন্তু তার ইস্পাতের কলমের চাইতে উন্নততর কিছু তো তার কাছে নাই।

ফারমিনা তাকে যে ভয়ানক চিঠিটা লিখেছিল ফ্লোরেন্টিনো তার উল্লেখই করলো না, প্রথম থেকেই তাকে কাছে টানার জন্য সে প্রলোভনের একটা নতুন পন্থা ধরলো, পুরনো প্রেমের কথা, এমনকি পুরনো দিনের কথাই, সে তুললো না : একেবারে নতুন ভাবে শুরু করলো সে। নারী-পুরুষের সম্পর্ক সম্বন্ধে তার নিজস্ব ধারণা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে সে মানব জীবন নিয়ে একটা দার্শনিক লেখা লিখলো। ‘প্রেমিকদের সঙ্গী’-র একটি সহযোগী পুস্তিকা হিসাবে সে এক সময় এই রকম একটা রচনার কথা ভেবেছিলো। শুধু এখন সে এটা লিখলো জনৈক বৃদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক প্রবীণ পাণ্ডিত্যভরা ভঙ্গিতে, এটা যে আসলে একটা প্রেমের দলিল তা যেন খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা না পড়ে। প্রথমে সে তার পুরনো ভঙ্গিতে অনেক ক’টি খসড়া করে কিন্তু সেগুলি আগুনে ছুড়ে ফেলতে যত সময় লাগলো মাথা ঠাণ্ডা করে পড়তে তার চাইতে বেশি সময় নিলো। সে জানতো যে একটা গতানুগতিক ভ্রান্তি, স্মৃতিবিধুরতা আক্রান্ত সামান্যতম অবিবেচনা, ওর বুকে অতীতের অপ্রীতিকর অনুরণন জাগিয়ে তুলবে। তার এও মনে হল যে সাহস করে তার প্রথম চিঠিটা খুলবার আগে ও হয়তো তার একশো চিঠি ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু সে চাইলো একবারও যেন তা না ঘটে। অতএব সে শেষ বিস্তারিত খুঁটিনাটি পর্যন্ত পরিকল্পনা করলো, যেন এটা হতে যাচ্ছে চূড়ান্ত যুদ্ধ : এক রমণী যে ইতিমধ্যে একটা ভরাট এবং পরিপূর্ণ জীবন যাপন করেছে তার মধ্যে নতুন আশা ও নতুন কৌশলের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে হবে। এটাকে হতে হবে একটা পাগল করা স্বপ্ন, যে শ্রেণীর সংস্কারসমূহ সর্বদা তার ছিল না কিন্তু পরে আর সবার চাইতে তারই বেশি নিজস্ব হয়ে ওঠে সেই সব সংস্কারের জাল ছিন্ন করার সাহস তার মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। তাকে এটা ভাবতে শেখাতে হবে যে প্রেম হচ্ছে একটা পবিত্র ত্রাণপ্রাপ্ত অবস্থা, কোথাও পৌঁছবার উপায় নয়, বরং আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ, জীবনের সারসত্তা।

তাৎক্ষণিক উত্তর প্রত্যাশা না করার মতো সুবুদ্ধি তার ছিল, চিঠিটা তাকে ফেরত না পাঠিয়ে দিলেই সে আপাতত খুশি হবে। চিঠিটা ফেরত আসে নি, সেটা না, তার পরবর্তীগুলিও না, এবং যত দিন গড়াতে লাগলো তত তার উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলো কারণ চিঠি ফেরত না দেবার দিনের সংখ্যা যত বাড়তে লাগলো ততই তার মনে উত্তর পাবার আশা বাড়তে থাকলো। প্রথম দিকে তার চিঠি লেখার হার নিয়ন্ত্রিত হত তার আঙ্গুলের নৈপুণ্য দ্বারা : প্রথমে সপ্তাহে একটা, তারপর দু’টা এবং শেষে দিনে একটা। তার সময়ের চাইতে ডাক বিভাগের যে উন্নতি হয়েছে তাতে সে খুশি হল, কারণ প্রতিদিন একই ব্যক্তির কাছে চিঠি লিখছে নিজেকে ওই অবস্থায় ডাকঘরে দেখাবার ঝুঁকি সে নিতো না, কাউকে দিয়ে পাঠালেও সেই হয়তো গল্প ছড়াতো। কিন্তু এখন অন্যভাবে ব্যাপারটার খুব সহজ সমাধান হয়ে যায়, সে তার এক কর্মচারীকে এক মাসের মতো ডাক টিকেট কিনে আনতে বলে, তারপর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার চিঠি পুরনো শহরের তিনটি ডাক বাক্সের একটাতে ফেলে দেয়। সে শিগগিরই এটাকে তার রুটিনের একটা অংশ করে নেয়। চিঠিগুলি লেখার জন্য সে তার অনিদ্রা রোগের সুযোগ নিলো। তারপর, পরের দিন আপিসে যাবার পথে সে ড্রাইভারকে মোড়ের ডাকবাক্সের সামনে এক মিনিটের জন্য থামতে বলতো, তারপর নিজে নেমে গিয়ে চিঠিটা ডাকে দিতো। কখনোই সে ড্রাইভারকে দিয়ে এ কাজটা করাতো না, একদিন বৃষ্টি পড়ার সময় ড্রাইভার করতে চেয়েছিল, সে দেয় নি, আর মাঝে মাঝে সে শুধু একটা নয়, একাধিক চিঠি ডাক বাক্সে ফেলতো, যেন ব্যাপারটা স্বাভাবিক দেখায়। ড্রাইভার অবশ্য জানতো না যে বাকি খামগুলিতে ছিল শুধু সাদা কাগজ, আর তার উপর ঠিকানায় লেখা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার নিজের নাম। সে কখনোই কারো কাছে চিঠি লেখে নি, ব্যতিক্রম ছিল শুধু একটি। প্রতি মাসের শেষে সে আমেরিকা ভিসুনার মা-বাবার কাছে তার অভিভাবক হিসাবে একটা রিপোর্ট পাঠাতো, পড়ালেখায় তার অগ্রগতি, তার মনের অবস্থা ও স্বাস্থ্য, তার আচার-ব্যবহার সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনোর নিজের মতামত এই সব সে লিখে জানাতো।

প্রথম মাসের পর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার চিঠিগুলিতে নম্বর দিতে আর প্রতি চিঠির শুরুতে আগের চিঠির একটা সংক্ষিপ্তসার জুড়ে দিতে শুরু করে, খবরের কাগজে প্রকাশিত ধারাবাহিক উপন্যাসের মতো। তার ভয় হয় তার চিঠিগুলির মধ্যে যে একটা ধারাবাহিকতা আছে ফারমিনা ডাজা হয়তো তা লক্ষ করবে না। চিঠিগুলি যখন দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে উঠলো তখন সে শোকের প্রতীক সংবলিত খামের পরিবর্তে লম্বা সাদা খাম ব্যবহার করতে শুরু করলো, এর ফলে চিঠিগুলি ব্যবসায়িক চিঠির নৈর্ব্যক্তিকতা লাভ করলো। শুরু করার সময় সে তার ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষার দেবার জন্য প্রস্তুত ছিল, অন্তত তার এই নতুন প্রয়াস দ্বারা সে শুধু সময় নষ্ট করছে তার নিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত। যৌবনে এই রকম অপেক্ষা করার সময়ে সে বহু প্রকার যন্ত্রণা ভোগ করেছে, কিন্তু এখন সে অপেক্ষা করছে পাথরে তৈরি এক বৃদ্ধের একগুঁয়েমি নিয়ে, যার চিন্তা করবার আর কিছু নাই, নৌযান কোম্পানিতে যার এখন কোনো কাজ নাই, অনুকূল হাওয়া পেয়ে জাহাজগুলি এখন তার সাহায্য ছাড়াই সুন্দর চলাচল করছে, যে বৃদ্ধ এখন দৃঢ় আস্থাবান যে আগামীকাল অথবা তার পর দিন অথবা যেদিনই ফারমিনা ডাজা উপলব্ধি করবে যে তার নিঃসঙ্গ বিধবা জীবনের আকুতি নিরসনের জন্য তাকে তার দুয়ার খুলে দিতেই হবে ততদিন পর্যন্ত এই বৃদ্ধকে তার সকল পুরুষালি ক্ষমতা অটুট রেখে বেঁচে থাকতে হবে।

ইত্যবসরে সে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখলো। ফারমিনা ডাজার কাছ থেকে একটি অনুকূল উত্তরের প্রত্যাশায় সে আবার নতুন করে তার বাড়ির সংস্কার করলো, যেন এটা তার যোগ্য হয়, যদিও কেনার পর দিন থেকেই সে নিজেকে এই বাড়ির কর্ত্রী বলে বিবেচনা করতে পারতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আবার বেশ কয়েকবার প্রুডেনসিয়া পিটারের ওখানে গেল, বয়সের ধ্বংসযজ্ঞের পরেও সে যে এখনো ওকে ভালোবাসে সেটা প্রমাণ করার জন্য, তাকে ভালোবাসে শুধু নিঃসঙ্গ রাত্রির হাহাকার মেটাবার জন্য নয়, ফ্লোরেন্টিনো তাকে ভালোবাসে দরজা-জানালা খোলা উজ্জ্বল দিনের আলোতেও। অ্যান্ড্রিয়া ভারোনের বাড়ির সামনে দিয়ে তার যাতায়াত সে অব্যাহত রাখলো, বাথরুমের আলো নেভানো থাকলে ভেতরে ঢুকে ওর শয্যার উন্মত্ততার মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলার চেষ্টা করতো, ভালোবাসার অভ্যাস যেন হারিয়ে না যায় শুধু সেটা নিশ্চিত করার জন্য, তার আরেকটা কুসংস্কারের সঙ্গে যা ছিল সঙ্গতিপূর্ণ, যেটা এখনো ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় নি, সেটা এই যে একটা মানুষের শরীর ততক্ষণই চলে যতক্ষণ সে তাকে চালিয়ে নিয়ে যায়।

একমাত্র অসুবিধা দেখা দিল আমেরিকা ভিসুনার সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে। সে তার ড্রাইভারকে বলে দিয়েছিল আগের মতো প্রতি শনিবার সকাল দশটার সময় ওকে ওর স্কুল থেকে তার এখানে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু সপ্তাহের ছুটির দুটো দিন ওকে নিয়ে কি করবে তা সে ভেবে পেল না। এই প্রথম সে নিজেকে ওর সঙ্গে জড়ালো না, আর ও এই পরিবর্তন লক্ষ করে অসন্তুষ্ট হল। সে ওকে তার কাজের মেয়েদের হাতে ছেড়ে দিল, তারা ওকে অপরাহ্ণে ফিল্ম দেখাতে নিয়ে গেল, শিশু পার্কে ব্যান্ড কনসার্ট শোনাল, মীনা বাজারে ঘোরাল কিংবা রবিবার সে তার ও তার সহপাঠী বন্ধুদের জন্য নানা রকম খেলাধুলার আয়োজন করল নিজের বাড়িতেই যেন তার আপিসের পেছনের গোপন স্বর্গে ওকে তার নিয়ে যেতে না হয়। ওকে প্রথম বার সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ও আবার সেখানে ফিরে যাবার জন্য ব্যগ্র হয়ে ছিল। তার নতুন মোহের কুয়াশার জালে ধৃত হয়ে সে উপলব্ধি করে নি যে মেয়েরা তিন দিনের মধ্যেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যেতে পারে, আর এক্ষেত্রে পুয়ের্টো পাড়ির জাহাজ থেকে নেমে আসার পর ওর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের পর তিন বছর পার হয়ে গেছে। সে আঘাতটা যত কোমল করার চেষ্টাই করুক ওর জন্য এই পরিবর্তন ছিল খুবই নিষ্ঠুর, আর এর কোনো কারণ ও খুঁজে পেল না। আইসক্রিমের দোকানে যেদিন সে ওকে বলেছিল যে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে, যখন সে ওর কাছে সত্যটি উদ্ঘাটিত করে, তখন ও ভয়ে কেঁপে উঠেছিল, কিন্তু তারপরই ওর কাছে সে সম্ভাবনা মনে হয় চরম উদ্ভট এবং তখন ও ব্যাপারটা ভুলে যায়। কিন্তু কয়েকদিন পরেই ও লক্ষ করে যে ফ্লোরেন্টিনো দুর্বোধ্যভাবে ওকে এড়িয়ে চলছে, যেন যথার্থই সে ওর চাইতে ষাট বছরের বড় নয়, বরং ষাট বছরের ছোট।

শনিবারের এক বিকালে সে ওকে তার শোবার ঘরে টাইপ করতে দেখলো, মোটামুটি ভালোই করছিল, কারণ স্কুলে ও তখন টাইপ করা শিখছিল। ও আধ পৃষ্ঠার বেশি কোনো রকম চিন্তাভাবনা না করে টাইপ করে ফেলেছিল কিন্তু দু’একটি শব্দ থেকে তার মনের অবস্থা বোঝা কঠিন হল না। তার পুরুষ মানুষের উত্তাপে, তার অসমান নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে, তার পোশাকের গন্ধে, যে গন্ধ ছিল তার বালিশের গন্ধের মতোই, ও চঞ্চল হয়ে উঠল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওর কাঁধের উপর দিয়ে একটু সামনে ঝুঁকলো। ও আর এখন সেই নবাগত ছোট মেয়েটি নেই যাকে সে একে একে নিরাভরণ করেছিল, বাচ্চাদের খেলার মতো করে, প্রথমে ছোট্ট ভালুকের জন্য তার ছোট্ট জুতা, তারপর ছোট্ট কুকুরের জন্য তার ছোট্ট শেমিজ, তারপর ছোট্ট খরগোশটার জন্য তার ফুলের নকশা আঁকা প্যান্টি, তারপর তার পাপার মিষ্টি ছোট্ট নাজুক পাখিটার উপর একটা ছোট্ট চুমো। না : ও এখন পূর্ণবিকশিত নারী, যে প্রথম পদক্ষেপ নিতে ভালোবাসে। ও ডান হাতের এক আঙ্গুলে টাইপ করে চললো, আর ওর বাঁ হাত দিয়ে তার পা স্পর্শ করলো, খুঁজে বেড়ালো, তাকে পেলো, অনুভব করলো তাকে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে, বড়ো হতে, শুনলো তার উত্তেজিত নিঃশ্বাসের শব্দ, এক বুড়ো মানুষের নিঃশ্বাস, যা হয়ে উঠেছে ছন্দহীন ও কষ্টকর। ও জানতো যে এখন থেকে সে তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করবে, তার কথাবার্তা হয়ে উঠবে অসংলগ্ন, সে চলে আসবে তার হাতের মুঠোয় এবং শেষ বিন্দুতে পৌঁছবার আগে সে আর ফিরে যাবার পথ খুঁজে পাবে না। ও তার হাত ধরে তাকে বিছানায় নিয়ে গেল যেন সে পথের এক অন্ধ ভিক্ষুক, তারপর ওর বিদ্বেষভরা মমতা দিয়ে তাকে টুকরো টুকরো করে কাটলো, আন্দাজ মতো লবণ দিল, মরিচ গুঁড়া আর একটু রশুন দিল, পেঁয়াজ দিল কুচি কুচি করে কেটে, একটু লেবুর রস যোগ করলো, তারপর সব ঠিকঠাক করে তাকে প্লেটে ঢাললো, আর উনুনটাকে তাতিয়ে নিল ঠিক তাপমাত্রায়। বাড়িতে কেউ নেই। কাজের মেয়েরা বাইরে গেছে, বাড়ি সংস্কার করা রাজমিস্ত্রি ও কাঠমিস্ত্রিরা রবিবার কাজে আসে না, সমস্ত পৃথিবী এখন তাদের দুজনের করতলে। কিন্তু খাদের একেবারে কিনারে পৌঁছে সে তার পরমানন্দ থেকে ফিরে এলো, ওর হাত ঠেলে দিয়ে উঠে বসলো, তারপর স্খলিত কণ্ঠে বললো, ‘সাবধান, আমরা রবার ব্যবহার করছি না।’

ও অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকল, ছাদের দিকে মুখ করে, চিন্তা করল, তারপর যখন এক ঘণ্টা আগেই স্কুলে ফিরে গেল তখন তার কান্নার সব ইচ্ছা মরে গিয়েছিল। ও তার নখের সঙ্গে সঙ্গে গন্ধ নেবার শক্তিও তীক্ষ্ণ করে তুলেছিল এবং ও নির্ভুলভাবে শনাক্ত করলো ওই হতচ্ছাড়ি বেশ্যাকে যে ওর জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পক্ষান্তরে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আরেকবার পুরুষজনোচিত ভুল করলো, সে ভাবলো যে ও তার কামনা-বাসনার নিষ্ফলতা উপলব্ধি করে তাকে ভুলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফ্লোরেন্টিনো ফিরে গেল তার নিজস্ব উপাদানে। ছ’মাস পার হয়ে গেল কিন্তু সে কোনো খবর পেল না, বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে সে সারা রাত কাটিয়ে ভোর করে দিল, এক নতুন ধরনের অনিদ্রা রোগের পতিত জমিতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেললো। তার মনে হল ফারমিনা ডাজা খামের চেহারা দেখে তার প্রথম চিঠিটা খুলেছিল, তারপর বহুকাল আগের চিঠিগুলির স্মৃতি থেকে সই-এর আদ্যাক্ষরগুলি চিনতে পারে, আর তখনই সে অন্যান্য জঞ্জালের সঙ্গে ওই চিঠি আগুনের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেয়, চিঠিটা ছেঁড়ার কষ্টও করে নি। তারপর থেকে খামগুলি দেখা মাত্র সে ওই একই কাজ করেছে, খুলেও দেখে নি এবং এটা সে করতে থাকবে নিরবধি কাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত, আর ইতিমধ্যে সে পৌছে যাবে তার দার্শনিক চিন্তাভাবনার শেষ লিখিত বক্তব্যে। অর্ধশতাব্দী ধরে প্রায় প্রতিদিন চিঠি পেতে থাকবে, কোন রঙের কালি দিয়ে লেখা তাও জানে না, তবু তার কৌতূহল দমন করে রাখবে এমন কোনো নারীর অস্তিত্বে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিশ্বাস করতো না, কিন্তু যদি কেউ থেকেও থাকে তবে তাকে ফারমিনা ডাজাই হতে হবে।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হল তার বার্ধক্য কোনো ধেয়ে আসা স্রোত নয় বরং একটা তলাবিহীন চৌবাচ্চা যার মধ্য দিয়ে তার স্মৃতি চুইয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তার উদ্ভাবন পটুতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। লা মাঙ্গার বাসভবনের চারপাশে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করার পর সে বুঝলো যে তার যৌবনের কৌশল দিয়ে সে শোক পালন দ্বারা রুদ্ধ করা এই বাড়ির দরজা খুলতে পারবে না। একদিন টেলিফোন নির্দেশিকায় একটা নম্বর খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ ওর নম্বর তার চোখে পড়ে যায়। সে ডায়াল করলো। কয়েকবার বাজার পর সে ওর গম্ভীর, ঈষৎ রুক্ষ কণ্ঠস্বর শুনলো : ‘হ্যালো?’ কোনো কথা না বলে সে ফোন নামিয়ে রাখলো, কিন্তু ওই অনভিগম্য কণ্ঠস্বরের অন্তহীন দূরত্ব তার নৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।

এই সময় লিওনা কাসিয়ানি তার জন্মদিন উপলক্ষে তার বাসায় অল্প কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিল বিক্ষিপ্তচিত্ত, মুরগির স্যুপ খেতে গিয়ে সে তার কাপড়ে ফেলে দিল। লিওনা তার ন্যাপকিনের একটা কোণা গ্লাসের জলে ভিজিয়ে তার কাপড় পরিষ্কার করে দিয়ে ন্যাপকিনটা একটা বিবের মত করে তার গলায় বেঁধে দিল যেন সে আরো গুরুতর কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে না ফেলে। তাকে দেখতে লাগলো একটা বুড়ো বাচ্চার মত। লিওনা তাকে খাওয়ার মধ্যে কয়েকবার তার চশমা খুলে চশমার কাচ মুছতে দেখলো, তার চোখে জল আসছিল। কফির সময় হাতে কফির পেয়ালা ধরা অবস্থায় সে ঘুমিয়ে পড়লে লিওনা তাকে না জাগিয়ে আস্তে পেয়ালাটা তার হাত থেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে কিন্তু সে ব্রিত ভাবে বলে ওঠে, ‘আমি আমার চোখকে একটু বিশ্রাম দিচ্ছিলাম।’ তার বার্ধক্য যে কী রকম স্পষ্ট হয়ে উঠছে একথা ভাবতে ভাবতে লিওনা কাসিয়ানি সেদিন শয্যা গ্রহণ করে।

জুভেনাল উরবিনোর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ক্যাথিড্রালে স্মারক প্রার্থনায় যোগ দেবার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণলিপি পাঠানো হয়। তখনো ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার চিঠির কোনো উত্তর পায় নি, কিন্তু তার ভেতরের তাগিদের প্রচণ্ডতার ফলে সে, আমন্ত্রিত না হলেও, ওই উপাসনা অনুষ্ঠানে যোগদানের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এটা ছিল একটা সামাজিক অনুষ্ঠান, যতখানি আবেগপ্রসূত তার চাইতে বেশি লোক দেখানো, জাঁকালো। গির্জার প্রথম কয়েক সারি বেঞ্চি তাদের আজীবন মালিকদের জন্য সংরক্ষিত ছিল, আসনের পেছন দিকে তামার নাম ফলকে তাদের নাম খোদাই করা ছিল। তাকে না দেখে ফারমিনা ডাজা যেন পাশ দিয়ে চলে না যায় সেজন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটা ভালো জায়গায় বসার উদ্দেশ্যে একেবারে প্রথম দিকে এসে উপস্থিত হয়েছিল। সে ভেবেছিল যে সব চাইতে ভালো আসনগুলি হবে গির্জার মধ্যবর্তী মূল অংশে, সংরক্ষিত আসনগুলির ঠিক পেছনে, কিন্তু এত লোক সমাগম হয় যে সেখানে সে জায়গা পেলো না, অতএব তাকে বসতে হল গরিব আত্মীয়দের অংশে। সেখান থেকে সে ফারমিনা ডাজাকে দেখলো একটা অনলঙ্কৃত লম্বা হাতার গলা থেকে জুতা পর্যন্ত বোতাম আঁটা কালো মখমলের পোশাক পরা, বিশপের আলখাল্লার মতো, তার ছেলের বাহু ধরে হেঁটে আসছে, অন্য বিধবরা যে রকম ওড়নায় ঢাকা হ্যাট মাথায় দিতো তার পরিবর্তে সে ব্যবহার করেছে ক্যাম্বিলীয় লেসের একটা স্কার্ফ। তার অনাবৃত মুখ মর্মরসদৃশ কোমল পাথরের মত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, গির্জার মূল কেন্দ্রীয় অংশের বিশাল ঝাড়বাতিগুলির নিচে তার চোখ দুটি যেন নিজস্ব একটা প্রাণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে, সে এমন সোজা হয়ে অহঙ্কারি ভঙ্গিতে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে হাঁটছিল যে তাকে তার ছেলের চাইতে বেশি বয়সের বলে মনে হচ্ছিল না। ফ্লোরেন্টিনো উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার মাথাটা ঘুরে ওঠে, সে তার সামনের বেঞ্চির পেছনে আঙ্গুল চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে দেখলো যে তার আর ফারমিনার মধ্যে ব্যবধান মাত্র সাতটি পদক্ষেপের নয়, তাদের দুজনের বাস দুটি ভিন্ন সময়ে।

অনুষ্ঠান চলাকালীন প্রায় সম্পূর্ণ সময়টা ফারমিনা ডাজা মূল বেদির সামনে তার পরিবারের জন্য নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়েছিল, অপেরায় যাবার সময় যেমন শোভন সুন্দর ভাবে এখনো সেই ভাবে। অনুষ্ঠান শেষ হলে সে একটা প্রচলিত প্রথা ভাঙলো। রীতি অনুযায়ী শোক পালন করা মহিলা তাঁর আসনে বসে থেকে অতিথিদের কাছ থেকে নতুন করে সমবেদনার উচ্চারণ শুনতেন, কিন্তু ফারমিনা ডাজা তার পরিবর্তে নিজের আসন থেকে উঠে প্রত্যেক অতিথিকে ধন্যবাদ জানাবার জন্য ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেল, একটা নতুন রীতি, যা ছিল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যময় আচার-আচরণ ও চরিত্রের সঙ্গে সুসঙ্গতিময়। একের পর এক অতিথিকে সম্ভাষণ করতে করতে অবশেষে সে গরিব আত্মীয়-স্বজনের এলাকায় এসে পৌঁছয়, তখন সে একবার চারিদিকে তাকায়, পরিচিত কেউ তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কিনা যাচাই করে নিতে চাইলো। আর ওই মুহূর্তে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হল একটা অলৌকিক হাওয়া যেন তাকে তার নিজের ভেতর থেকে ঊর্ধ্বে তুলে নিচ্ছে : সে লক্ষ করলো যে ফারমিনা ডাজা তাকে দেখেছে। সকল সামাজিক কাজে ফারমিনা ডাজা যে আত্মপ্রত্যয় দেখাতো এখানেও সে তা প্রদর্শন করলো। সে সঙ্গীদের কাছ থেকে সরে এসে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে খুব মিষ্টি করে হেসে বললো, ‘আপনি এসেছেন, অনেক ধন্যবাদ।’

এর কারণ ছিল। ফারমিনা ডাজা যে শুধু তার চিঠিগুলি পেয়েছিল তাই নয়, সে সেগুলি মনোযোগ দিয়ে পড়েছে এবং সে তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে বেঁচে থাকার জন্য গভীর ও সুচিন্তিত নানা যুক্তি। প্রথম চিঠিটা পাওয়ার সময় সে খাবার টেবিলে বসে মেয়ের সঙ্গে সকালের নাস্তা খাচ্ছিল। টাইপ করা চিঠির নতুনত্ব দেখে সে সঙ্গে সঙ্গেই খামটা খোলে, তারপরই নিচে নামের আদ্যাক্ষর তার চোখে পড়ে, আর এক আকস্মিক লজ্জার ঝলক এসে তার গাল আগুনের মতো রাঙিয়ে দেয়, তবে মুহূর্তের মধ্যে সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চিঠিটা তার অ্যাপ্রনের পকেটে রেখে দেয়। সে বললো, ‘সরকারের কাছ থেকে এসেছে, সমবেদনার চিঠি।’ মেয়ে অবাক হয়ে বললো, ‘সে সব চিঠি তো আগেই এসেছে।’ ফারমিনা নির্বিকার কণ্ঠে জানাল, ‘এটা আরেকটা।’ সে ঠিক করে, মেয়ের প্রশ্ন শেষে, এখান থেকে উঠে গিয়ে, সে চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলবে, কিন্তু তার আগে সেটা একবার পড়ে দেখার কৌতূহল সে দমন করতে পারে নি। তার অপমানজনক চিঠির একটা উপযুক্ত উত্তর সে প্রত্যাশা করেছিল, ওই চিঠি পাঠাবার পরই তার অনুতাপ হতে থাকে, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার এই চিঠির রাজকীয় সম্বোধন এবং তার প্রথম অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু থেকেই সে স্পষ্ট অনুভব করলো যে এই পৃথিবীতে একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। তার কৌতূহল এত জাগ্ৰত হয় যে সে শোবার ঘরে গিয়ে দরজা তালাবন্ধ করে পুড়িয়ে ফেলার আগে সুস্থির ভাবে আবার পড়ে। আর সে ওই চিঠি পড়লো, বিরতি না দিয়ে, তিন তিন বার।

সেখানে ছিল জীবন, ভালোবাসা, বার্ধক্য ও মৃত্যু সম্পর্ক দার্শনিক চিন্তা যে সব ধারণা ফারমিনা ডাজার মাথার চারপাশে রাতের পাখির মতো প্রায়ই পাখা ঝাপটিয়েছে কিন্তু ধরতে গেলেই কয়েকটা পালকের মতো তার হাতের ফাঁক দিয়ে গলে গেছে। এখন সে সেগুলি তার সামনে দেখতে পেলো, সুনির্দিষ্ট, সরল, যেভাবে সে তুলে ধরতে চাইতো ঠিক সেই ভাবে। আবারো স্বামীর কথা মনে করে তার কষ্ট হল, তিনি বেঁচে থাকলে এসব বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা যেতো, ঘুমাতে যাবার আগে তারা যেমন সারা দিনের ঘটনা নিয়ে আলাপ করতেন। ফারমিনা ডাজার সামনে এক অচেনা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার রূপ ফুটে উঠলো, যার স্বচ্ছ দৃষ্টির সঙ্গে তার যৌবনের অতি ব্যাকুল প্রেমপত্র কিংবা তার সমগ্র জীবনের নিরানন্দ রূপের কোনো মিল ছিল না। একথাগুলি, বরং, মনে হল এমন একজন মানুষের যে, পিসি এস কোলাস্টিকার মতে, হোলি স্পিরিট দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই চিন্তা ফারমিনাকে বিস্ময়াভিভূত করে, কথাটা প্রথম বার শোনার সময় যেমন বিস্ময়াভিভূত করেছিল ঠিক তেমনি ভাবে। যাই হোক, যা তার মনে সুগভীর প্রশান্তি এনে দিল তাই এই নিশ্চিতি যে এই চিঠি এসেছে একজন প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে, একটি মৃতদেহ নিয়ে রাত্রি জাগরণের সময় সে যে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল তার কোনো পুনরুক্তি এখানে নাই, বরং এটা হল অতীতকে মুছে ফেলার অত্যন্ত মহৎ একটি পন্থা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *