প্রেম ও কলেরা – ১৩

১৩

অবশেষে ঝড় থামলো, তবে পনেরো মিনিটের বিধ্বংসী উত্তর-পশ্চিমের বাতাস জলাভূমি সংলগ্ন মহাল্লাগুলিসহ শহরের অর্ধেক অংশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। কাকা দ্বাদশ লিওর ঔদার্যে ডাক্তার আবারও পরিতৃপ্ত হলেন, আকাশ পরিষ্কার হবার জন্য তিনি অপেক্ষা করলেন না, গাড়ি পর্যন্ত যাবার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাঁকে যে ছাতাটা ধার দিলো তা তিনি অন্যমনস্ক চিত্তে গ্রহণ করলেন। ফ্লোরেন্টিনো কিছু মনে করলো না। পক্ষান্তরে, ফারমিনা ডাজা যখন ওই ছাতার মালিক কে জানবে তখন ও কি ভাববে এটা চিন্তা করে ফ্লোরেন্টিনো খুশি হয়ে উঠলো। ডাক্তারের সঙ্গে এই অনিশ্চিত সাক্ষাৎকারের ফলে সে যখন একটু অস্থির ঠিক তখনই লিওনা কাসিয়ানি তার ঘরে ঢুকলো। ফ্লোরেন্টিনোর মনে হল আর ধানাইপানাই না করে তার গোপন কথাটি ওকে বলার এখনই সর্বোত্তম সময়, ওটা যেন একটা ফোঁড়া, জোরে টিপে শেষ না করে দেওয়া পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না : হয় এক্ষুনি না হয় আর কক্ষনো না। ডাক্তার উরবিনো সম্পর্কে তার কি ধারণা, একথা জিজ্ঞাসা করে সে শুরু করলো। লিওনা কাসিয়ানি, প্রায় কিছু চিন্তা না করেই, বললো, ‘তিনি এমন একটা লোক যিনি অনেক কাজ করেন, সম্ভবত বড় বেশি কাজ করেন, কিন্তু আমার মনে হয় তিনি কি ভাবছেন সেটা কেউ জানে না।’ তারপর সে একটু ভাবলো, তার কৃষ্ণাঙ্গ রমণীর বড় বড় তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে একটা পেন্সিলের মাথার রবার কুচি কুচি করে কাটলো, তার পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে গোটা বিষয়টা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল, এটা তার কোন ব্যাপার নয়।

তবু লিওনা বললো, ‘যেন কিছু ভাবতে না হয় বোধ হয় সেজন্যই উনি অত কাজ করেন।’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে ধরে রাখতে চেষ্টা করলো। সে বললো, “আমার কষ্ট হচ্ছে একথা চিন্তা করে যে ওঁকে মরতে হবে

‘সবাইকেই মরতে হবে’, লিওনা বললো।

‘হ্যাঁ, তবে অন্য সবার চাইতে বেশি তাঁকে।

লিওনা কাসিয়ানি এর কিছুই বুঝলো না। সে আবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কোন কথা না বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল। তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিশ্চিত ভাবে জানলো যে ভবিষ্যতে কোন এক রাতে ফারমিনা ডাজার সঙ্গে আনন্দোচ্ছল শয্যায় শুয়ে সে তাকে বলবে যে তার গোপন ভালোবাসার কথা সে কারো কাছে কখনো প্রকাশ করে নি, এমনকি যে কথা জানার সব চাইতে বেশি অধিকার যার ছিল তার কাছেও নয়। না : এই গোপন কথাটি সে কাউকে বলবে না, এমনকি লিওনা কাসিয়ানিকেও নয়, অর্ধেক জীবন ধরে একথা বন্ধ করে রাখা বাক্সটা যে সে খুলতে চায় নি সেজন্য নয়, কিন্তু এই কারণে যে সে এই মাত্র উপলব্ধি করলো ওই বাক্সের চাবিটা সে হারিয়ে ফেলেছে।

তবে সেটাই ওই বিকালের সব চাইতে বেশি বিপর্যয় ঘটানো ব্যাপার ছিল না। তখনও তার যৌবন কালের অতীত স্মৃতিবিধুরতা তাকে ঘিরে ছিল, কবিতা উৎসবের কথা তার স্পষ্ট মনে আছে, প্রতি বছর ১৫ই এপ্রিল উৎসব উদ্বোধনের বজ্রধ্বনি তার কানে এখনও বাজে। সর্বদাই সে ছিল ওই উৎসবের একজন মুখ্য ব্যক্তি, যদিও সব কাজে যেমন তেমনি এখানেও সে নিজের ভূমিকা গোপন রাখতো। উদ্বোধনী প্রতিযোগিতার পর থেকে সে অনেকগুলি প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও কখনো সম্মানিত উল্লেখের তালিকাতেও নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে পারে নি, কিন্তু সেটা তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, কারণ সে কোন পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতো না, প্রতিযোগিতায় তার একটা বাড়তি আকর্ষণ ছিল অন্যত্র নিহিত! প্রথম অধিবেশনে ফারমিনা ডাজা মুখবন্ধ খামগুলি খুলে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছিল এবং তারপর থেকে এটাই প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হয়ে যায়, পরবর্তী বছরগুলিতে সেই ওই কাজটি করতে থাকে।

অর্কেস্ট্রা-আসনের এক অন্ধকার কোনায় সে বসে ছিল, তার কোটে লাগানো সাদা ক্যামেলিয়া তার আকাঙ্ক্ষার তীব্রতায় থরথর করে কাঁপছিলো, পুরনো জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে প্রথম উৎসব রজনীতে সে ফারমিনা ডাজাকে ওখানে দাঁড়িয়ে খামগুলি খুলতে দেখেছিল। সে মনে মনে ভাবছিলো, খাম খুলে ও যখন দেখবে যে সোনালি অর্কিডের বিজয়ী সে, তখন ওর মনের অবস্থা কি হবে? ফ্লোরেন্টিনো নিশ্চিত ছিল যে ফারমিনা তার হাতের লেখা চিনবে, আর তখনই তার মনে পড়বে ছোট পার্কের সেই বাদামগাছের নিচে বসে এম্ব্রয়ডারি করার কথা, ফ্লোরেন্টিনোর চিঠিগুলিতে ক্ষীণ হয়ে আসা গার্ডেনিয়া ফুলের গন্ধের কথা, ঊষালগ্নে ঝড়ো বাতাসের মধ্যে মুকুটশোভিত দেবীর উদ্দেশে নিবেদিত তার ব্যক্তিগত ওয়ালটজ-এর সুরগীতির কথা। কিন্তু তা হয় নি। আরো বিশ্রী ব্যাপার, দেশের সকল কবির কাম্য সোনালি অর্কিড লাভ করে জনৈক চীনা অভিবাসী। এই অকল্পনীয় সিদ্ধান্তে একটা গণনিন্দার ঝড় ওঠে, প্রতিযোগিতার তাৎপর্য সম্পর্কেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তটি আসলে সঠিকই ছিল এবং সংশ্লিষ্ট চতুর্দশপদী কবিতাটির উৎকর্ষের মধ্যেই বিচারকদের ঐক্যমত্যের রায়ের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়।

যে চীনা কবি পুরস্কারটি লাভ করে সেই যে কবিতাটির সত্যিকার রচয়িতা কেউ তা বিশ্বাস করে নি। গত শতকের শেষ দিকে পীত জ্বরের মহামারীতে যখন পানামা অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল তখন অনেক চৈনিক এদিকে পালিয়ে আসে। দুই সাগরের মাঝখানে রেলপথ নির্মাণে বহু শ্রমিক তখন কাজ করছিল। এই চৈনিকও পালিয়ে- আসা ওদের সঙ্গে ছিল। তারা অনেকেই এখানে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত তাদের সারা জীবন কাটিয়ে দেয়, জীবন যাপন করে চৈনিক পদ্ধতিতে, বংশবৃদ্ধি করে চৈনিকদের, এবং তাদের চেহারা এত এক রকম হয় যে কোন একজনকে অন্য আরেকজনের কাছ থেকে আলাদা করে চেনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দিকে তারা জনা দশেকের বেশি ছিল না, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে ছিল তাদের স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি এবং খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করার মতো কয়েকটি কুকুর। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তাদের সংখ্যা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পায়, বন্দরের পাশের সরু গলিগুলি চীনাদের বস্তিতে ভরে যায়, আর অপ্রত্যাশিত চীনাদের দল শুল্ক দপ্তরের কাগজপত্রে বিন্দুমাত্র উল্লেখ ছাড়াই এদেশে ঢুকে পড়ে। কতিপয় তরুণ চৈনিক এত দ্রুততার সঙ্গে শ্রদ্ধাভাজন কুলপতিতে রূপান্তরিত হয় যে কেমন করে এত অল্প সময়ে তাদের বয়স এতটা বেড়ে যায় কেউ তা ব্যাখ্যা করতে পারতো না। সাধারণ মানুষ ওদের দু’শ্রেণীতে ভাগ করতো : খারাপ চৈনিক ও ভালো চৈনিক। খারাপ চৈনিকরা সমুদ্র তীর সংলগ্ন বিষণ্ন রেস্তোরাঁ চালাতো, সেখানে একজন রাজার মতো খেতে পারতো আবার টেবিলের উপর আকস্মিক মৃত্যুর শিকারও হতে পারতো, সেখানে সূর্যমুখী ফুলের সঙ্গে ইঁদুরের মাংস পরিবেশিত হত। অনেকেই মনে করতো যে রেস্তোঁরার ছত্রছায়ায় এগুলি ছিল দেহ বিক্রির ব্যবসাসহ আরো নানা কুকর্মের আখড়া। আর ভালো চৈনিক ছিল তারা যারা লন্ড্রি চলাতো, যারা ছিল এক পবিত্র জ্ঞানভাণ্ডারের উত্তরাধিকারী, যারা আপনার শার্ট নতুনের চাইতেও পরিষ্কার করে ধুয়ে দিতো, কলার আর হাতের কাফের ইস্ত্রি দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে যেতেন। যে ব্যক্তিটি কবিতা উৎসবে বাহাত্তর জন সুপ্রস্তুত প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে সে ছিল ওই ভালো চৈনিকদের একজন।

বিভ্রান্ত ফারমিনা ডাজা যখন নামটি ঘোষণা করল তখন কেউ তা বুঝতে পারল না, নামটি অপ্রচলিত হওয়ার জন্যই শুধু নয়, চৈনিকদের নাম কেমন হয় সে সম্পর্কেও কেউ সুনিশ্চিত ছিল না। কিন্তু এ নিয়ে বেশি ভাববার দরকার হয় নি, কারণ বিজয়ী চৈনিক নাট্যশালার পেছনের দিক থেকে মুখে এক স্বর্গীয় হাসি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন, স্বাভাবিক সময়ের চাইতে আগে ঘরে ফিরলে চীনাদের মুখে এরকম হাসিই ফুটে ওঠে। তিনি বিজয় সম্পর্কে এতটাই সুনিশ্চিত ছিলেন যে পুরস্কার গ্রহণের জন্য বসন্তকালীন ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের উপযোগী একটা হলুদ সিল্কের আলখাল্লা পরে উৎসব সভায় এসেছিলেন। তিনি আঠারো কারাটের সোনালি অর্কিডটি গ্রহণ করে তাকে সানন্দে চুমু খেলেন, আর ওদিকে অবিশ্বাসী জনতা ঠাট্টা-বিদ্রূপে ফেটে পড়লো, কিন্তু তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখালো না। তিনি মঞ্চের মাঝখানে অবিচলিত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন, ঈশ্বর প্রেরিত একজন ধর্মপ্রচারকের মতো, আমাদের প্রচারকের চাইতে কম নাটকীয় ভাবে, তারপর সব শান্ত হলে তিনি বিজয়ী কবিতাটি পাঠ করলেন কিন্তু কেউ তার একটি অক্ষরও বুঝলো না। আবার নতুন করে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও শিসের ধ্বনি উঠলো, তারপর নির্বিকার ফারমিনা ডাজা কবিতাটি আবার পড়লো, তার ঈষৎ ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইঙ্গিতময় কণ্ঠস্বর, আর প্রথম চরণের পরেই সকলে বিস্মিত হল। শুদ্ধতম পারনেসীয় ঐতিহ্যে রচিত এ একটা নিখুঁত সনেট, আর এর মধ্যে অনুপ্রেরণার এমন একটা ছোঁয়া ছিল যে স্পষ্টই বোঝা গেল এখানে নিশ্চিত ভাবে কোন সেরা কবির হাত রয়েছে। এর একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল, কোন একজন বড় কবি কবিতা উৎসবকে নিয়ে কৌতুক করার জন্য এই কাজটি করেছেন, আর ওই চৈনিক তাঁর সহযোগী হিসাবে কাজ করেছে এবং আমৃত্যু সে ব্যাপারটি গোপন রাখবে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র ‘কমার্শিয়াল ডেইলি’ আমাদের নাগরিক সম্মান রক্ষার প্রয়াসে ক্যারিবীয় অঞ্চলে চৈনিক প্রভাবের প্রাচীনত্ব ও সাংস্কৃতিক বিষয় প্রসঙ্গে এবং কবিতা উৎসবে চীনাদের অংশগ্রহণ করার অধিকার নিয়ে একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গোলমেলে প্ৰবন্ধ প্রকাশ করে। যিনি সনেটটির লেখক হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন তিনিই যে তার যথার্থ রচয়িতা প্রবন্ধ লেখক সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ প্রকাশ করেন নি, বরং তিনি খুব সহজ ও সরাসরি ভাবে তাঁর পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর প্রবন্ধের নামকরণেই তিনি ব্যাপারটি স্পষ্ট করে দেন : ‘সব চৈনিকই কবি।’ যদি কোন ষড়যন্ত্র হয়েই থাকে তাহলে তার উস্কানিদাতারা এখন তাদের গোপন তথ্য নিয়ে কবরে পচে মরছে। তাঁর নিজের দিক থেকে, পুরস্কার বিজয়ী চৈনিক ব্যক্তিটি কোন প্রকার ধর্মীয় স্বীকারোক্তি ছাড়াই একটি প্রাচ্য বয়সে উপনীত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর কফিনে সোনালি অর্কিডসহ তাঁকে সমাহিত করা হয়। তবে সারা জীবন তিনি কবি হিসাবে স্বীকৃতি লাভের যে কামনা করেছিলেন তা না পাওয়ার তিক্ততা নিয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সংবাদ মাধ্যম কবিতা উৎসবের সেই বিস্মৃত ঘটনাকে পুনরুজ্জীবিত করলো এবং সংশ্লিষ্ট রচনাটির মধ্যে আধুনিকতা আনার লক্ষ্যে চারপাশে মাংসল কুমারীদের ছবি ও সোনালি রঙের ছাগলের শিং ও ফুললতা পাতার অলঙ্করণসহ ওই সনেটটি পুনর্মুদ্রিত করলো। কবিতার দেবদূত-অভিভাবকবর্গ এই সুযোগে কতিপয় বিষয় পরিষ্কার করে দিলেন : তরুণ প্রজন্মের কাছে সনেটটা এতই নিকৃষ্ট মানের মনে হল যে এখন আর কারো কোন সন্দেহ রইলো না যে সেটা আসলেই ওই মৃত চৈনিক কর্তৃক রচিত হয়েছিল।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই কেলেঙ্কারির ঘটনাকে তার স্মৃতিতে সেদিন তার পাশে বসা এক প্রাচুর্যভরা রমণীর সঙ্গে সর্বদা সম্পৃক্ত করে রেখেছিল। উৎসবের শুরুতেই সে তাকে লক্ষ করেছিল, কিন্তু তারপর কি হবে না হবে তার ভয়ঙ্কর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে সে তার কথা ভুলে যায়। রমণীটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তার ত্বকের অপরূপ শুভ্রতা, মোটাসোটা মেয়ের সুখী সুরভি, এবং তার কৃত্রিম ম্যাগনোলিয়া আটকানো উচ্চ সপ্তকে বাঁধা গায়িকার বিশাল বক্ষের জন্য। তার পরনে ছিল খুব আঁটোসাঁটো কালো মখমলের পোশাক, তার ব্যগ্র উষ্ণ আঁখির মতোই কালো, আর ঘাড়ের কাছে একটা জিপসি চিরুনি দিয়ে আটকানো তার চুল ছিল আরো কালো। তার কানে ছিল লম্বা ঝোলানো দুল, তার সঙ্গে মানানসই কণ্ঠহার, ঝলমলে গোলাপের আকারে নির্মিত কয়েকটি আঙ্গুলেই একই রকমের অঙ্গুরীয়। তার ডান গালে পেন্সিল দিয়ে একটা সৌন্দর্য বর্ধক ফোঁটা আঁকা ছিল। উৎসব শেষে প্রচণ্ড করতালির মধ্যে আন্তরিক দুঃখের সঙ্গে সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি বলছি, আপনার জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অবাক হল, তার সমবেদনা প্রকাশের জন্য নয়, সে- সমবেদনা তার প্রাপ্য বলেই সে মনে করে, কিন্তু কি করে তার গোপন কথা আর কেউ জানলো সেটা ভেবেই সে সাংঘাতিক অবাক হয়ে গেল। মহিলা ব্যাখ্যা করে বলল, ‘খামগুলি খোলার সময় আপনার কোটে লাগানো ফুল যেভাবে কাঁপছিলো তাতেই আমি সব বুঝে ফেলি।’ সে ফ্লোরেন্টিনোকে তার হাতের মখমখলের ম্যাগনোলিয়া ফুলটি দেখিয়ে তার হৃদয় ওর কাছে উন্মুক্ত করে বললো, ‘সেজন্যই আমি আমার ফুলটি খুলে ফেলি।

ফ্লোরেন্টিনোর পরাজয়ের কারণে তার চোখে প্রায় জল এসে যাচ্ছিল কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো তার নৈশকালীন সহজাত বুদ্ধি দিয়ে তাকে উৎফুল্ল করে তুললো। সে তাকে বললো, ‘চলুন, আমরা অন্য কোথাও গিয়ে দুজনে একসঙ্গে কাঁদি।’

সে তার সঙ্গে তার বাড়ি পর্যন্ত গেল। ওরা যখন তার বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছলো তখন প্রায় মাঝ রাত, রাস্তায় কেউ কোথাও নাই, তাই ফ্লোরেন্টিনোকে ভেতরে ডেকে নিয়ে এক পাত্র ব্র্যান্ডি পান করতে ও তার স্ক্র্যাপবুক ও ফোটো অ্যালবামগুলি দেখতে আমন্ত্রণ জানাতে সে মহিলাকে রাজি করালো। তার স্ক্র্যাপবুক ও অ্যালবামের কথা সে-ই ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বলেছিল। এটা ছিল একটা পুরনো কৌশল, সেই সময়েও, তবে এক্ষেত্রে তার মধ্যে কোন প্রতারণা ছিল না, কারণ জাতীয় নাট্যশালা থেকে এখানে হেঁটে আসতে আসতে মহিলাই স্ক্র্যাপবুক ও অ্যালবামের কথা তুলেছিল, ফ্লোরেন্টিনো নয়। তারা বাড়িতে ঢুকলো। ঢুকেই বসবার ঘর থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার চোখে পড়লো বাড়ির একমাত্র শোবার ঘরটি, তার দরজা খোলা, ঘরে বিশাল একটা বিছানা, সেখানে রয়েছে একটা বিলাসবহুল আরামদায়ক ব্রোকেডের লেপ, খাটের মাথার কাছে পিতলের লতাপাতার কারুকাজ। ওই দৃশ্য তাকে ঈষৎ বিক্ষিপ্ত করলো। মহিলা নিশ্চয়ই ব্যাপারটি বুঝেছিলেন, কারণ তিনি বসবার ঘর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর তিনি তাকে ফুল-আঁকা সুতি কাপড়ের একটা সোফায় বসতে আহ্বান করলেন। সেখানে একটা নিদ্রামগ্ন বিড়াল শুয়েছিল। মহিলা পাশের কফি টেবিলের ওপর তার অ্যালবামগুলি রাখলেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ধীরে সুস্থে সেগুলির পাতা উল্টাতে লাগলো, কী দেখছে তার চাইতে সে বেশি মনোযোগ দিল তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সে-চিন্তায়। সে যখন মুখ তুলে তাকালো তখন দেখলো যে মহিলার চোখ জলে ভরা। সে তাকে প্রাণ খুলে কাঁদতে বললো, কোন রকম লজ্জা বা কুণ্ঠা বোধ না করে, কারণ কান্নার চাইতে বেশি শান্তি আর কিছুই দিতে পারে না, কিন্তু সে তার আগে তার বডিসটা ঢিলা করে দেবার পরামর্শ দিল। সে তাকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত এগিয়ে গেল, কারণ তার বডিস ছিল লম্বা কোণাকুণি লেস দিয়ে পিঠের পেছন দিকে শক্ত করে বাঁধা। তাকে সব গুলি লেস খুলতে হয় নি, কারণ নিছক অভ্যন্তরীণ চাপে বডিসটা ফেটে যায়, আর তখন তার অবিশ্বাস্য বক্ষ আবার সহজে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সক্ষম হয়।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিশেষ আরামদায়ক পরিবেশেও তার শিক্ষানবিসী ভীরুতার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে নি। সে মহিলার ঘাড়ে তার আঙ্গুলের অগ্রভাগ আলতোভাবে বুলিয়ে আদর করার একটা প্রাথমিক ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিলো, আর মহিলা অত্যধিক আদরে নষ্ট হওয়া একটা বাচ্চার মতো আঁকুপাঁকু করলো, তার মুখ থেকে নিঃসৃত হল হাল্কা গোঙানির শব্দ, কিন্তু তার অশ্রু বিসর্জন সে বন্ধ করলো না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই একই স্থানে ওকে এবার চুমু খেল, একই রকম কোমলতার সঙ্গে, তারপর দ্বিতীয়বার চুমু খাবার আগেই ও তার বিশাল শরীর নিয়ে তার দিকে ঘুরলো, আকুল আর উষ্ণ, এবং দুজনেই তখন জড়াজড়ি করে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় মেঝের ওপর পড়ে গেল। সোফার নিদ্রামগ্ন মার্জার চিৎকার করে জেগে উঠে ওদের দুজনের ওপর লাফ দিয়ে পড়লো। ওরা দুই অক্ষতযোনি মানব মানবীর মতো একে অন্যকে হাতড়ালো, যেভাবে সম্ভব পরস্পরকে খুঁজে পেলো, কাপড়-জামা পরা অবস্থাতেই ছেঁড়া অ্যালবামগুলির মধ্যে হুটোপুটি করলো, ঘামে তাদের সারা শরীর সিক্ত, তাদের বিপর্যয়কারী প্রেমের চাইতে তারা বেশি মনোযোগ দিল বিড়ালের হিংস্র নখের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার দিকে। কিন্তু ওই রাত থেকে শুরু করে, তখনো বিড়ালের থাবার আঘাতে তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো, বহু বছর ধরে তারা পরস্পরকে উপভোগ করতে থাকে।

যখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা উপলব্ধি করলো যে সে তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে তখন মহিলা বয়সের দিক থেকে পরিপূর্ণতায় টুইটম্বুর, আর সে তার ত্রিশতম জন্মদিনের দ্বারপ্রান্তে। ওর নাম ছিল সারা নরিয়েগা, নিঃস্বদের মধ্যে প্রেম বিষয়ক একটা কাব্য সঙ্কলন নিয়ে সে একটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে পনেরো মিনিটের জন্য বিখ্যাত হয়েছিল, ওই সঙ্কলন অবশ্য কোনদিন প্রকাশিত হয় নি। সে ছিল সরকারি বিদ্যালয়ে আচরণ ও পৌরনীতির শিক্ষক, তার বেতনের টাকায় সে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে বাস করতো। সেটা ছিল পুরনো গার্থসিমান জেলার পাঁচমিশালী সুইটহার্টস মিউস-এ। মাঝে মাঝে তার সাময়িক প্রেমিক জুটেছে কিন্তু তারা কেউই তাকে বিয়ে করতে উৎসাহ দেখায় নি। ওই কালে ওই স্থানে যে মেয়েকে তুমি বিছানায় নিয়ে গেছো তাকে কোন পুরুষের পক্ষে বিয়ে করা কঠিন ছিল। সারা নরিয়েগা তার প্রথম বাগদত্তকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, একমাত্র অষ্টাদশীর পক্ষেই সেরকম ভালোবাসা সম্ভব, কিন্তু ওই লোক বিয়ের তারিখের এক সপ্তাহ আগে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয় এবং তাকে নিক্ষেপ করে পরিত্যক্ত বিয়ের কনেদের অবহেলিত স্তূপে। কিংবা, সে সময় যেমন বলা হত, ব্যবহৃত মালপত্রের আস্তানায়। কিন্তু তার ওই প্রথম অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠুর এবং ক্ষণস্থায়ী, তাকে তিক্ত করে তোলে নি, বরং তার মধ্যে এই সুদৃঢ় বিশ্বাসের জন্ম দেয় যে বিয়ের মাধ্যমে হোক কিংবা বিয়ে ব্যতিরেকে হোক, ঈশ্বর অথবা আইনের অনুমোদন নিয়ে হোক কিংবা না নিয়ে হোক, শয্যায় কোন পুরুষ মানুষ না থাকলে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। তার একটা জিনিস ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সব চাইতে বেশি ভালো লাগতো। প্রেম করার সময় গৌরব তুঙ্গে ওঠার জন্য তাকে বাচ্চাদের একটা চুষনি চুষতে হত। এক সময় দেখা গেল যে তার খাটের মাথার কাছে বাজারে পাওয়া যায় এমন সব আকার, আকৃতি ও রঙের চুষনি সারি দিয়ে সাজানো রয়েছে, যেন চরম জরুরি মুহূর্তে তাকে ওটার জন্য যেখানে-সেখানে খুঁজতে না হয়।

সে ছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মতোই বন্ধনমুক্ত এবং তার সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা জনসাধারণ্যে প্রকাশ করতে তার কোন আপত্তি ছিল না, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো প্রথম থেকেই ব্যাপারটাকে একটা গোপনীয় অভিযান রূপে বিবেচনা করে এসেছে। সে পেছনের দরজা দিয়ে সুট করে ঢুকে পড়তো, প্রায় সর্বদাই গভীর রাতে, আর প্রত্যুষের আলো ফুটবার আগে আগে পা টিপে টিপে বেরিয়ে যেতো। তারা উভয়েই জানতো যে ওই রকম একটি জনাকীর্ণ বহুধা বিভক্ত ভবনে প্রতিবেশীরা যে রকম ভান করতো তার চাইতে অনেক বেশি জানতো। কিন্তু ব্যাপারটা একটা আনুষ্ঠানিকতা হলেও ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ছিল ওই ধরনের একটি মানুষ এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার সকল সঙ্গিনীদের সঙ্গে তার আচরণ ছিল ওই রকমই। সারা কিংবা অন্য কোন রমণীর সঙ্গে সে কখনো কোন ভুল করে নি, তাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা সে কখনো করে নি। সে কোন রকম বাড়াবাড়িও করতো না, শুধু একবার সে ধরা পড়বার মতো একটা চিহ্ন, একটা লিখিত প্রমাণ, রেখে দিয়েছিল এবং এর জন্য তার প্রাণও যেতে পরতো। বস্তুতপক্ষে সে ফারমিনা ডাজার চিরদিনের স্বামীর মতোই আচরণ করতো, অবিশ্বাসী কিন্তু নাছোড়বান্দা, তার মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা- জনিত অসন্তোষ না জাগিয়ে তুলে যে ওই দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছিল।

ওই রকম গোপনীয়তা রক্ষা করতে গেলে নানা ভ্রান্ত আশঙ্কার জন্ম দেয়া ছিল অবধারিত। ট্রান্সিটো আরিজা এই বিশ্বাস নিয়েই মৃত্যুবরণ করেন যে, যে-পুত্রকে তিনি ভালোবাসার মধ্য দিয়ে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন, সেই পুত্র তার যৌবনের প্রথম দুর্ভাগ্যের কারণে সব রকম ভালোবাসার প্রভাবমুক্ত হয়ে যায়। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার অনেক ঘনিষ্ঠজন, যারা তার রহস্যময় প্রকৃতি ও মরমীয়া অনুষ্ঠান ও বিচিত্র লোশনের প্রতি তার দুর্বলতার কথা ভালো ভাবে জানতো সেই সব কম উদার ব্যক্তিরা অবশ্য বলতো, সব রকম ভালোবাসা নয়, শুধু মেয়েদের ভালোবাসার প্রভাব থেকে সে ছিল মুক্ত। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এটা জানতো, কিন্তু এটা যে ভুল তা প্রমাণ করার কোন চেষ্টা সে কখনো করে নি। এ নিয়ে সারা নরিয়েগারও কোন মাথাব্যথা ছিল না। যেসব অসংখ্য রমণী ফ্লোরেন্টিনোকে ভালোবেসেছে, এমনকি না ভালোবেসেও যারা তাকে আনন্দ দিয়েছে এবং তার কাছ থেকে আনন্দ পেয়েছে, তাদের মতো সারা নরিয়েগাও তাকে তার যথার্থ স্বরূপেই গ্রহণ করেছিলো : একজন চলতি পথের বন্ধু।

শেষ পর্যন্ত দিন কিংবা রাতের যে কোন সময়ে ফ্লোরেন্টিনো তার বাড়ি এসে হাজির হত, তবে বেশির ভাগ সময় রবিবার সকালে, সব চাইতে শান্তিপূর্ণ সময়ে। সারা তখন হাতের সব কাজ ফেলে, যাই সে করতে থাকুক না কেন, বিশাল পৌরাণিক খাটটিতে, যেটা সর্বদা তার জন্য প্রস্তুত থাকতো, তাকে সুখী করার জন্য তার সমস্ত শরীরকে নিয়োজিত করতো। ওই খাটে সে কখনো কোন রকম আনুষ্ঠানিক বিধি পালন করতে দিতো না। অতীত-বিহীন একজন নিঃসঙ্গ অবিবাহিতা রমণী পুরুষদের রীতিনীতি ও হালচাল সম্পর্কে কেমন করে এতটা প্রাজ্ঞ হতে পারে ফ্লোরেন্টিনোর কাছে তা ছিল খুবই দুর্বোধ্য। কেমন করে সে তার মধুর শুশুক-শরীর ওই রকম লঘু ও কোমলভাবে নাড়াতে পারে, যেন সে জলের নিচে নড়ছে? সারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলতো, ভালোবাসার ক্ষমতা হল একটা সহজাত প্রতিভার ব্যাপার। সে বলতো, “কেমন করে করতে হয় সেটা তুমি হয় জন্ম থেকেই জানো, নয় তো কখনোই জানো না।” ফ্লোরেন্টিনো আরিজা পতনমুখী ঈর্ষায় যন্ত্রণাবিদ্ধ হত, ভাবতো সে যে রকম ভান করতো তার চাইতে বেশি অতীত আছে তার, কিন্তু তার সব কথাই তাকে নির্বিবাদে বিশ্বাস করতে হত, কারণ সে তাকে বলেছিল, যেমন ওদের সবাইকেই সে বলতো, সেই-ই তার প্রথম প্রেমিকা। আরো যেসব জিনিস তার খুব অপছন্দ ছিল তাও তাকে মেনে নিতে হয়। তার মধ্যে একটি ছিল : রাগী বিড়ালটাকে তাদের বিছানায় জায়গা দিতে হত। তবে ওরা দুজন প্রেম করার সময় বিড়ালটা যেন ওদের ছিন্নভিন্ন না করে ফেলে সেজন্য সারা নরিয়েগা তার নখ খুব ভালো ভাবে কেটে দিয়েছিল।

তবে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা বিছানায় দাপাদাপি করলেও প্রেমলীলার শেষে সারা নরিয়েগা নিজেকে সমস্ত মন দিয়ে কাব্য চর্চায় নিয়োজিত করতো। তার কৈশোর যৌবনের ভাবালুতাময় কবিতাগুলি তার কণ্ঠস্থ ছিল। সেসময় রচিত হবার পরপরই সেগুলি পুস্তিকাকারে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দুই সেন্টাভো দামে বিক্রি হত। সারা যেগুলি বিশেষ ভালোবাসতো সেগুলি সে তার ঘরের দেয়ালে পিন দিয়ে আটকে রাখতো, যেন ইচ্ছা হওয়া মাত্র সে ওই সব কবিতা উচ্চ কণ্ঠে পড়তে পারে। সে নিজে বানান শেখানোর জন্য ছন্দোবদ্ধ ছড়ার আকারে আচরণ মালা ও পৌরনীতির পাঠ্য পুস্তকের জন্য কবিতা রচনা করেছিল কিন্তু সেগুলির জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পায় নি। উচ্চ কণ্ঠে বক্তৃতার ঢং-এ আবৃত্তির নেশা তার এতই প্রবল ছিল যে মাঝে মাঝে রতিকর্মে নিয়োজিত থাকার সময়ও সে জোরে জোরে আবৃত্তি করতে আরম্ভ করতো, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে তখন বাচ্চাদের কান্না থামাবার জন্য যেমন করা হত সেই রকম তার মুখে জোর করে চুষনি গুঁজে দিতে হত।

তাদের সম্পর্কের প্রাচুর্যের মধ্যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিজেকে প্রশ্ন করেছিল, এই দুটির মধ্যে কোনটি ছিল প্রেম : ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিছানা, নাকি রবিবারের প্রশান্ত অপরাহ্। সারা নারিয়েগা একটা সহজ যুক্তি দিয়ে তাকে শান্ত করেছিল, নগ্নদেহে তারা যাই করে সেটাই প্রেম। সে বলেছিল, “কোমরের উপরে হল আধ্যাত্মিক-মানসিক প্রেম আর কোমরের নিচে দৈহিক প্রেম।” সারা নরিয়েগার মনে হল এই সংজ্ঞাকে ভিত্তি করে বিভক্ত প্রেমের ওপর একটা চমৎকার কবিতা লেখা যেতে পারে, দুজনে মিলে একটা কবিতা তারা লিখেও ফেললো। পঞ্চম কবিতা উৎসবে ওরা তা জমা দিয়েছিল, তার মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে আর কোন অংশগ্রহণকারী এরকম মৌলিক কবিতা জমা দিতে পারবে না। কিন্তু এবারও সে বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয়।

সেদিন ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সে ছিল ভয়ানক রাগান্বিত। যদিও সে কোন কারণ দেখাতে পারছিলো না তবু তার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে তার কবিতা যেন প্রথম পুরস্কার না পায় সেজন্য ফারমিনা ডাজা তার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র করেছিল। ফ্লোরেন্টিনো তার কথায় কর্ণপাত করে নি। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের পর থেকেই তার মনে একটা গম্ভীর নিরানন্দ ভাব জেগে উঠেছিল। ফারমিনা ডাজাকে সে অনেক দিন দেখে নি। সেদিন রাতে ফ্লোরেন্টিনোর মনে হল যে ফারমিনার মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এই প্রথম তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে একজন জননী। এতে ফ্লোরেন্টিনো অবাক হয় নি, কারণ ওর ছেলে যে ইতিমধ্যে স্কুলে যাচ্ছে তা তার জানা ছিল। কিন্তু আজ রাতে ওর জননীসুলভ বয়সটা তার কাছে যতো স্পষ্ট প্রতিভাত হল এমন আগে কখনো হয় নি। তার কোমরের আকৃতি, হাঁটবার সময় একটু দ্রুত নিঃশ্বাস পতন, বিজয়ীদের নাম ঘোষণার সময় ঈষৎ ভাঙ্গা গলার উচ্চারণ, সব কিছুর মধ্যেই বিষয়টা প্রকট হয়ে উঠেছিল।

তার স্মৃতির প্রামাণিক দলিল আবিষ্কারের চেষ্টায় সে কবিতা উৎসবের অ্যালবামগুলির পাতা উল্টে দেখছিলো। সারা নরিয়েগা তখন তাদের খাওয়ার আয়োজন করছিলো। ফ্লোরেন্টিনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রঙিন ফোটো, আর বিভিন্ন চত্বরে স্যুভেনির হিসাবে বিক্রি করা হলুদ হয়ে আসা পোস্টকার্ড দেখলো, তার মনে হল সে যেন তার নিজের যুক্তিহীন জীবনের অপার্থিব এক পর্যালোচনা করছে। এ পর্যন্ত সে একটা কাল্পনিক সত্যকে আঁকড়ে ধরে ছিল, পৃথিবী বদলাচ্ছে, তার রীতিনীতি ও চালচলন পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু ফারমিনা ডাজা থাকছে একই রকম। কিন্তু সেদিন রাতে সে প্রথম বারের মত সচেতন ভাবে দেখলো কিভাবে ফারমিনা ডাজার জীবন কাটছে আর কিভাবে তার জীবন কাটছে, সময় বয়ে যাচ্ছে আর সে শুধু অপেক্ষা করে থাকার চাইতে বেশি কিছুই করছে না। সে ওর কথা কখনোই কাউকেই বলে নি, কারণ সে জানতো যে ওর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ওরা তার ওষ্ঠের বিবর্ণতা লক্ষ্য করবে। কিন্তু সেদিন, রবিবারের অপরাহ্নের একঘেয়েমি কাটাবার জন্য, সে যখন অ্যালবামগুলি নাড়াচাড়া করছিল তখন সারা নরিয়েগার একটা উক্তি শুনে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। সারা বলল, “ও একটা বেশ্যা।’

ফ্লোরেন্টিনোর একটু আগে হেঁটে যেতে যেতে পাশের একটা দোকানে ফারমিনা ডাজার একটা ফোটো দেখে ও এই মন্তব্য করে। কোন একটা মুখোশ নাচের আসরে ফারমিনা ডাজা কালো চিতার সাজ করে এসেছিল। সারা নরিয়েগা কার কথা বলছে সেটা ফ্লোরেন্টিনোকে বোঝাবার জন্য কোন নাম উল্লেখের দরকার হয় নি। পাছে কোন গোপন ঘটনা উন্মোচিত হয়ে তার জীবনের ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয় সেই ভয়ে ফ্লোরেন্টিনো সতর্ক প্রতিরক্ষায় দ্রুত এগিয়ে এলো। সে জানালো যে ফারমিনা ডাজাকে সে শুধু দূর থেকে দেখেছে, আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছা সম্ভাষণের বেশি তারা কখনো অগ্রসর হয় নি, তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সে কিছুই জানে না, কিন্তু ফারমিনা ডাজা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রশংসনীয় এক রমণী, অজানা-অচেনা একটা জায়গা থেকে এখানে এসে সে নিজ গুণে উচ্চ শিখরে উপনীত হয়েছে।

তাকে বাধা দিয়ে সারা নরিয়েগা বললো, “ভালোবাসে না এমন একজনকে টাকার জন্য বিয়ে করে সে ওই জায়গায় উঠেছে।” ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দুর্ভাগ্যের জন্য তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তার মা-ও এই একই কথা বলেছিলেন, তবে কম স্থূল-ভাবে কিন্তু একই রকম নৈতিক কঠোরতা নিয়ে। ফ্লোরেন্টিনোর অন্তরাত্মা পর্যন্ত এখন কেঁপে উঠলো। সারা নরিয়েগার মন্তব্যের কোন সদুত্তর না দিতে পেরে সে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করলো, কিন্তু নিজের আবেগ-অনুভূতির পূর্ণ প্রকাশ না ঘটানো পর্যন্ত সারা তা হতে দিল না। অনুপ্রেরণার এক ঝলকানিতে, কেমন করে তা সে ব্যাখ্যা করতে অপারগ, সারার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মাল যে তাকে তার পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করার পেছনে ছিল ফারমিনা ডাজার ষড়যন্ত্র। এ রকম ভাবার অবশ্য কোন কারণ ছিল না : তারা পরস্পরকে চিনতো না, কখনো তাদের দেখা হয় নি, তাছাড়া বিচারকদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ফারমিনা ডাজার কোন ভূমিকা থাকতো না, যদিও তাদের গোপন আলোচনার সংবাদ সে রাখতো। সারা নরিয়েগা তর্কাতীত সুরে বললো, “আমরা মেয়েরা আমাদের সহজাত জ্ঞান দিয়ে এসব বুঝতে পারি।” ওই আলোচনা এখানেই শেষ হয়।

ওই মুহূর্ত থেকে ফ্লেরেন্টিনো সারা নরিয়েগাকে ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করে। তারও বয়স হয়ে যাচ্ছিল। তার প্রাচুর্য ভরা যৌবন গৌরববর্জিত ভাবে শুকিয়ে আসছিলো, কান্নার কারণে তার প্রেমলীলা স্তিমিত হয়ে পড়ছিল, পুরনো তিক্ততা তার চোখের পাতাকে কালো করে দিতে শুরু করেছিল। গতকালের বাসি ফুল সে। তাছাড়া প্রতিযোগিতায় পরাজিত হবার তীব্র ক্ষোভে সে তার সুরাপানের হিসাব হারিয়ে ফেলেছিল। এ রাত তার নয়। গরম করা নারকেলের ভাত খেতে খেতে সারা চেষ্টা করলো পরাজিত কবিতাটির কোন কোন অংশ ওদের দুজনের কার রচনা তা নির্ধারণ করতে, এর মাধ্যমে সোনালি অর্কিডের কতগুলি পাপড়ি কে পেতো তার একটা হিসাব পাওয়া যাবে। এর আগেও তারা এ জাতীয় বাইজান্টানীয় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আনন্দ পেয়েছে, কিন্তু এখন ফ্লোরেন্টিনো তার নব-উন্মোচিত ক্ষতের তাড়নায় কিছু তীব্র মন্তব্য করার সুযোগ নিল। দেখতে দেখতে তারা একটা হীন তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়লো এবং প্রায় পাঁচ বছরের বিভক্ত প্রেমের তিক্ততা দুজনের মধ্যেই সবেগে জেগে উঠলো।

বারোটা বাজার দশ মিনিট আগে সারা নরিয়েগা একটা চেয়ারের উপর উঠে পেন্ডুলাম ঘড়িটায় দম দিলো, কাঁটাটা বারোটায় নিয়ে গেল, সম্ভবত ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে, মুখে না বলেও, জানাতে যে এবার তার যাবার সময় হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তখন তাদের এই প্রেমহীন সম্পর্কের একটা সুস্পষ্ট ও চূড়ান্ত ইতি টানার প্রবল ও জরুরি তাগিদ নিজের মধ্যে অনুভব করলো। এ কাজে প্রথম পদক্ষেপ নেবার জন্য সে একটা সুযোগের অপেক্ষা করলো। এরকম ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ সেই সর্বদা নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও নেবে। মনে মনে সে প্রার্থনা করলো সারা নরিয়েগা তাকে শয্যায় আহ্বান করবে আর তখন সে বলবে, না, আমাদের মধ্যে যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। ঘড়িতে দম দেয়া শেষ হলে সে ওকে তার পাশে এসে বসতে বলল কিন্তু সারা একটু দূরে অতিথির আরাম কেদারায় গিয়ে বসলো। তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওর দিকে তার ব্র্যান্ডিসিক্ত তর্জনীটা বাড়িয়ে দিল যেন সে ওটা চুষতে পারে। অতীতে প্রেমলীলায় লিপ্ত হবার আগে সূচনা হিসাবে সে এ কাজটি করতে ভালোবাসতো। কিন্তু আজ সে বললো, ‘এখন না, আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি, তার আসবার কথা আছে।’

ফারমিনা ডাজা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবার পর থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার কিভাবে নিজের হাতে রাখতে হয় তা শিখে নিয়েছিল। আজকের পরিস্থিতি আরেকটু কম তিক্ত হলে সে সারা নরিয়েগার পিছু ছাড়তো না, কারণ সে বিশ্বাস করতো একবার কোন মেয়ে যদি কারো সঙ্গে বিছানায় যায় তাহলে ওই পুরুষ চাইলেই আবারো সে তার শয্যাসঙ্গিনী হবে, শুধু কেমন করে মেয়েটির মধ্যে কামনার শিখা জাগিয়ে তুলতে হবে সেটা তার জানা থাকা চাই। এই বিশ্বাসের কারণেই সে সব কিছু সহ্য করেছে, সব কিছু উপেক্ষা করেছে, প্রেমের ক্ষেত্রে সব চাইতে নোংরা কাজ-কারবারও, শুধু এই জন্য যেন রমণীর গর্ভজাত কোন রমণীকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তাকে কখনো দিতে না হয়। কিন্তু আজ রাতে সে এত অপমানিত বোধ করলো যে সে এক চুমুকে তার ব্র্যান্ডির গ্লাস খালি করে ফেললো, রাগ দেখাবার জন্য সে ওটাই শুধু করতে পারলো, তারপর কোন রকম বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই সে বিদায় নিলো। তাদের আর কোন দিন দেখা হয় নি।

এই জাতীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সারা নরিয়েগার সঙ্গে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সম্পর্ক ছিল সব চাইতে দীর্ঘকালীন ও সব চাইতে স্থিতিশীল যদিও ওই পাঁচ বছরের মধ্যে সেটাই তার একমাত্র প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক ছিল না। যখন সে বুঝলো যে তার সঙ্গ তাকে সুখী করছে, বিশেষ করে শয্যায় কিন্তু সে কখনোই ফারমিনা ডাজার স্থান নিতে পারবে না, তখন তার মধ্যে তার নৈশকালীন নিঃসঙ্গ শিকারির প্রবৃত্তি আবার জেগে উঠলো। সে তখন তার সময় ও শক্তি তার সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভাগ করে নিলো। সারা নরিয়েগা কিছু কালের জন্য তাকে সারিয়ে তুলেছিল। অন্তত এখন, দিনের যে কোন সময়ে সে যে কাজ করছিল তা বন্ধ করে দিয়ে, তার নিজের অপ্রীতিকর পূর্বানুভূতির অনিশ্চিত পথ ধরে, সব চাইতে অপ্রত্যাশিত রাস্তাগুলিতে, সব চাইতে অবাস্তব জায়গাগুলিতে, যেখানে ফারমিনা ডাজার থাকবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না, অকারণেই ওই সব জায়গায় ওকে আর খুঁজে না বেড়িয়ে সে বেঁচে থাকতে পারছিলো। ফারমিনা ডাজাকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও একবার না দেখা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না তার মনের ওই আকুল অবস্থা থেকে সে মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু সারা নরিয়েগার সঙ্গে বিচ্ছেদ তার সুপ্ত বেদনাকে পুনর্জাগরিত করলো, ছোট্ট পার্কটিতে বিকাল বেলায় অনিঃশেষ কবিতা পড়ার সময় তার যে রকম মনের অবস্থা হত এখন আবার তার মনের অবস্থা সেরকম হল, শুধু ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর মৃত্যুর জন্য তার জরুরি প্রয়োজন তার মনের সে অবস্থার আরো অবনতি ঘটালো।

সে বহুদিন আগে থেকেই জানতো যে এক বিধবাকে সুখী করা এবং সেই বিধবার তাকে সুখী করা তার পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি। এ নিয়ে তার কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। পক্ষান্তরে, এটার জন্য সে তৈরি ছিল। নৈশকালীন নিঃসঙ্গ শিকারি হিসাবে অভিযানকালে ফ্লোরেন্টিনো বহু বিধবার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল এবং তখন সে দেখে যে এই পৃথিবী বহু সুখী বিধবায় পূর্ণ। সে অনেক বিধবাকে তাদের স্বামীর মৃতদেহের সামনে শোকে প্রায় উন্মাদ হয়ে যেতে দেখেছে, তারা কাতর অনুনয় করেছে তাদের যেন স্বামীর কফিনে একই সঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়, স্বামী ছাড়া ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়ানো তাদের পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু এক সময় তাদের নতুন অবস্থার বাস্তবতার সঙ্গে তাদের মানিয়ে নিতে দেখেছে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে ভস্মস্তূপ থেকে তাদের উঠে দাঁড়াতে দেখেছে সে। তাদের বড় বড় শূন্য বাড়িতে তারা নিরানন্দের পরগাছার মতো বাস করতে থাকে, বাড়ির দাস-দাসীদের অন্তরঙ্গ আনন্দ- বেদনার কথা শোনে তারা, নিজেদের উপাধানের প্রেমে পড়ে, এত বছরের বন্ধ্যা বন্দি জীবনের পর তাদের আর কিছুই করার থাকে না। যে সব কাজ করার জন্য তারা ইতিপূর্বে সময় পায় নি এখন সেই সব কাজে নিযুক্ত থেকে তারা তাদের বিশাল অবসর সময়ের অপচয় করে, মৃত মানুষটার জামায় বোতাম লাগায়, তার শার্ট নিখুঁত অবস্থায় রাখার জন্য সেটার শক্ত কলার আর হাতের কাফ একাধিক বার ইস্ত্রি করে। তারা নিয়মিত ভাবে তার জন্য বাথরুমে সাবান রেখে দেয়, শয্যায় বিছিয়ে রাখে তার নামাঙ্কিত বালিশের ঢাকনা, খাবার টেবিলে তার জায়গায় সব কিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে, জীবিত থাকতে যেমন করতো এখনও যদি সেই ভাবে আগে কোন রকম সতর্ক না করে হঠাৎ মৃত্যুর জগত থেকে ফিরে আসে তা হলে যেন সব কিছু ঠিকঠাক পায়। কিন্তু গির্জায় নিঃসঙ্গ উপাসনার শেষে তারা নতুন করে কিছু বিষয়ে সচেতন হতে থাকে। এক সময় একটা নিরাপত্তার বিনিময়ে তারা শুধু তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচিতিও বিলিয়ে দিয়েছিল, যে নিরাপত্তা নববধূর নানা অলীক স্বপ্নের মতো আরো একটা স্বপ্নের চাইতে বেশি কিছু ছিল না। এখন, এতদিন পর, তারা নিজেদেরকে তাদের নিয়তির যথার্থ কর্ত্রী বলে অনুভব করলো। শুধু তারাই জানতো যে মানুষটিকে তারা পাগলের মতো ভালোবেসেছে, সে-ও হয়তো তাদের ভালোবেসেছে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত, তাদেরকে যে মানুষটির সেবা যত্ন করতে হয়েছে, যেন সে একটা ছোট্ট শিশু, তাকে দুধ খাওয়াতে হয়েছে, তার ময়লা কাপড় বদলে দিতে হয়েছে, রোজ সকালে বাস্তবতার মুখোমুখি হবার জন্য বেরিয়ে যাবার সময় একটা মায়ের বিবিধ কৌশল দিয়ে তাদের আতঙ্ক দূর করতে হয়েছে- এসব যে কী কান্তিকর সেটা শুধু তারাই জানে। তবু, তাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে দেখতে দেখতে, যাকে তারাই বিশ্ব জয় করতে তাগিদ দিয়েছে, তারা এখন যারা ঘরে পড়ে রয়েছে, একটা ভীষণ আতঙ্ক তাদের গ্রাস করতো, কি জানি সে যদি আর কখনো ফিরে না আসে। এই ছিল তাদের জীবন। যদি কোথাও প্রেমের অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে সেটা ছিল ভিন্ন জিনিস : অন্য এক জীবন।

পক্ষান্তরে, একাকিত্বের সঞ্জীবনী আলস্যের মধ্যে, বিধবা মহিলারা জীবনযাপনের একটা সম্মানজনক পথ আবিষ্কার করে ফেললো। সে পথ হল শরীরের নির্দেশ মেনে চলা, ক্ষুধা পেলে খাওয়া, মিথ্যাচার বর্জিত প্রেম করা, আনুষ্ঠানিক ভালোবাসার কুশ্রীতা এড়াবার জন্য ঘুমের ভান করার পরিবর্তে সত্যিকার ঘুমানো। আর, এখন, চাদরের অর্ধেকের জন্য, যে বায়ু থেকে তারা নিঃশ্বাস নেয় তার অর্ধেকের জন্য, তাদের নিশীথের অর্ধেকটা সময়ের জন্য তাদের সঙ্গে লড়াই করার মতো কেউ আর নেই, এখন গোটা বিছানার পুরো মালিক তারা, তারা এখন নিজেদের স্বপ্ন দেখে, পরিতৃপ্ত শরীর নিয়ে, একা জেগে ওঠে তাদের নিদ্রা থেকে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাদের দেখেছে সকাল সাতটার উপাসনা শেষ করে গির্জা থেকে বেরিয়ে আসতে, কালো পোশাক পরা নিয়তির চকচকে কালো ছায়া তাদের কাঁধে, প্রত্যুষের আলোয় তাকে দেখামাত্র তারা রাস্তা পেরিয়ে অন্য পাশে চলে যায়, যেন একটা পুরুষ মানুষের পাশ দিয়ে হাঁটলেই তাদের সম্ভ্রমের গায়ে কলঙ্কের স্পর্শ লাগবে। তবু সে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতো যে অন্য যে কোন রমণীর চাইতে একজন শোকার্ত বিধবাই তার মধ্যে ধারণ করে সুখের বীজ।

বিধবা নাজারাতের পর তার জীবনে আরো অনেক বিধবার আগমন ঘটেছে। তাদের মাধ্যমেই সে বুঝেছে স্বামীদের মৃত্যুর পর তারা কতোটা সুখী হতে পারে। এতোদিন যা শুধু একটা স্বপ্ন ছিল, তা বাস্তবে রূপান্তরিত হবার সম্ভাবনা তাদের বদান্যতার কারণেই সে উপলব্ধি করলো। তাদের মতোই ফারমিনা ডাজা কেন আরেকজন বিধবা হয়ে উঠতে পারবে না তার কোন কারণ সে দেখলো না। ফ্লোরেন্টিনো যেমন তেমনি ভাবেই তাকে গ্রহণ করতে জীবন ফারমিনাকে প্রস্তুত করবে, মৃত স্বামীর জন্য কোন কাল্পনিক অপরাধ বোধ তাকে পীড়িত করবে না, তার সঙ্গে সে আবার সুখের সন্ধান পাবে, সে সুখী হবে দু’বার, প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য একটা ভালোবাসার সুখ, যা দিন দিন শুধু বেঁচে থাকার অলৌকিকত্বের আলোকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকবে, আর অন্য একটা ভালোবাসা, যা একান্তভাবে শুধু তারই হবে, যে ভালোবাসা মৃত্যুর মাধ্যমে সকল সংক্রমণের হাত থেকে সর্বদা মুক্ত থাকবে।

ওই মুহূর্তে ফারমিনা ডাজা এই সব কাল্পনিক হিসাব-নিকাশ থেকে কতো দূরে অবস্থান করছিল তার বিন্দুমাত্র আভাস পেলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এত উৎসাহিত হত না। সে তখন সবেমাত্র একটা জগতের দিগন্ত দেখতে শুরু করেছিল যেখানে দৈব দুর্বিপাক ছাড়া আর সব কিছুই ছিল আগাম জানা। সে যুগে বিত্তশালী হবার অনেক সুবিধা ছিল, অনেক অসুবিধাও অবশ্য ছিল, কিন্তু দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ বিত্তের জন্যই হাপিত্যেস করে থাকতো, অনন্ত জীবন লাভের জন্য সেটাই ছিল সর্বাপেক্ষা সম্ভাব্য পথ। পরিপক্বতার এক বিদ্যুৎ ঝলকে ফারমিনা ডাজা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই অনুকম্পার এক সঙ্কটে পতিত হয়ে তাকে তার মূল্য দিতে হয়, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা নিয়ে তার মনে কখনো কোন সন্দেহের উদ্রেক হয় নি। তার যুক্তির কোন গোপন প্রণোদনা যে তাকে ওই মুহূর্তের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি যুগিয়েছিল তার কোন ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না, কিন্তু বহু বছর পর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রসঙ্গে একটা সাধারণ গুরুত্বহীন কথাবার্তার সময়, কেমন করে তার কথা ওঠে সেটা ওর মনে নেই, ওর কাছে ব্যাপারটা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে ওঠে I ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির সর্বোচ্চ সমৃদ্ধির কালে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে তার উত্তরাধিকারী হবে সেটা সবাই জানতো। তাদের কারো সন্দেহ ছিল না যে তাকে ওরা অনেক বার দেখেছে, তার সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত বহু কাজ করেছে, কিন্তু সে যে কি রকম দেখতে তা কেউই মনে করতে পারলো না। আর তখনই যে অবচেতন প্রেরণা ফ্লোরেন্টিনোকে ভালোবাসা থেকে তাকে বিরত রেখেছিল তার স্বরূপ তার সামনে উন্মোচিত হয়। সে আলোচনায় যোগ দিয়ে বলে, ‘মনে হয় ও যেন মানুষ নয়, শুধু একটা ছায়া।’ তাই ছিল সে : কোন একজনের ছায়া, যাকে কেউ দেখে নি। কিন্তু যখন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তাকে দখল করার চেষ্টা করছিলেন আর সে চেষ্টা করছিল তাঁকে প্রতিহত করতে, তখন সে লক্ষ করে যে ডাক্তার হলেন ফ্লোরেন্টিনোর ঠিক বিপরীত, আর তখনই একটা অপরাধবোধের অলীক মূর্তি তাকে পীড়া দিতে শুরু করে, আর ওই একটি মাত্র অনুভূতিই সে কখনো সহ্য করতে পারতো না। সেটা আসছে বুঝতে পারলেই এক ধরনের আতঙ্ক তাকে আচ্ছন্ন করতো। সে সময় তার বিবেককে শান্ত করার মতো কাউকে কাছে পেলেই শুধু সে ওই আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। বালিকা বয়স থেকেই রান্নাঘরে একটা বাসন ভেঙে গেলে, কেউ পড়ে গেলে, দরজার ফাঁকে নিজের আঙ্গুল আটকে গেলে সে হতাশাক্রান্ত হয়ে নিকটতম প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলতো, ‘আপনার দোষ।’ যদিও, আসলে, কে দায়ী কিংবা সে যে নির্দোষ নিজেকে সেটা বিশ্বাস করানো নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা ছিল না, ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত করেই সে সন্তুষ্ট হতো।

.

অশরীরী মূর্তিটি ছিল ভয়ঙ্কর। ডাক্তার উরবিনো দেখলেন যে ওটা তাঁর গৃহের শান্তির জন্য একটা বড় হুমকি। তাই তিনি ওটাকে আসতে দেখলেই দ্রুত তাঁর স্ত্রীকে বলতেন, “এ নিয়ে একটুও ভেবো না, সোনা, দোষটা ছিল আমার।” স্ত্রীর আকস্মিক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের চাইতে বেশি ভয় আর তিনি কোন কিছুকে পেতেন না, আর তাঁর মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে ওই সিদ্ধান্তগুলি সর্বদাই উৎসারিত হত একটা অপরাধের বোধ থেকে। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে প্রত্যাখ্যান করার পর তার মধ্যে যে বিভ্রান্তি দেখা দেয় কোন সান্ত্বনাসূচক স্তোক বাক্যে তার নিরসন হয় নি। কয়েক মাস ধরে ফারমিনা ডাজা প্রতিদিন সকাল বেলা বারান্দায় এসে দাঁড়াতো, যে নিঃসঙ্গ ভূতের মতো প্রাণীটি নির্জন ছোট্ট পার্কটির মধ্যে থেকে তাকে দেখতো তার অনুপস্থিতি সে অনুভব করতো। যে গাছটি ছিল তার, অন্ধকারাচ্ছন্ন বেঞ্চে বসে তার কথা ভাবতে ভাবতে যে কবিতা পড়তো, তার অভাব সে সব সময় বোধ করতো। তখন সে জানালা বন্ধ করে দিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলতো, বেচারা!’ যখন অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার পক্ষে বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল তখনও, এমনকি সে যেমন ভেবেছিল ফ্লোরেন্টিনো ততখানি নাছোড়বান্দা প্রেমিক ছিল না এটা জানার পর মোহমুক্তির যন্ত্রণা ভোগ করা সত্ত্বেও, তার মন মাঝে মাঝে একটা বিলম্বিত চিঠি, যে চিঠি কখনো আসে নি, পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতো। কিন্তু যখন তাকে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হয় তখন সে একটা বড় সঙ্কটের সামনে পড়ে বশীভূত হয়ে যায়। সে উপলব্ধি করে যে কোন রকম সঙ্গত কারণ ছাড়া ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে প্রত্যাখ্যান করার পর ডাক্তারের প্রস্তাব গ্রহণের কোন সঙ্গত কারণ তার নাই। বস্তুতপক্ষে ফ্লোরেন্টিনোকে যেমন সে ভালোবাসে নি তেমনি ডাক্তারকেও সে ভালোবাসে নি। তাছাড়া ডাক্তার সম্পর্কে সে আরও অনেক কম জানতো, ডাক্তারের চিঠি ফ্লোরেন্টিনোর চিঠির মতো আবেগময় ছিল না, আর ফ্লোরেন্টিনো তার দৃঢ় সঙ্কল্পের যতগুলি প্রাণস্পর্শী প্রমাণ দিয়েছিল ডাক্তার তা দেয় নি। বস্তুতপক্ষে, জুভেনাল উরবিনো কখনোই ভালোবাসার কথা বলে বিয়ের প্রস্তাব করেন নি। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত, তাঁর মতো একজন জঙ্গি ক্যাথলিক ফারমিনা ডাজাকে যা দেয়ার প্রস্তাব করেন তা ছিল একান্ত জাগতিক বস্তু : নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, সুখ, কতিপয় নিকট সংলগ্ন সংখ্যা যার যোগফলের সঙ্গে হয়তো ভালোবাসার সাদৃশ্য আছে, যা হয়তো প্রায় ভালোবাসাই। কিন্তু সেটা ভালোবাসা ছিল না, আর এইসব সন্দেহ ফারমিনার বিভ্রান্তি আরো বাড়িয়ে তোলে, কারণ বাঁচার জন্য যে ভালোবাসাই তার সব চাইতে বেশি প্রয়োজন এ বিষয়েও সে তখনো সুনিশ্চিত হয় নি তবে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর বিরুদ্ধে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল অন্য একটি জিনিস। লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর মেয়ের জন্য যেরকম আদর্শ পুরুষ চাইছিলেন তার সঙ্গে ডাক্তারের মাত্রাতিরিক্ত সাদৃশ্য দেখা যায়। তিনি যে একটা পৈতৃক ষড়যন্ত্রের ফসল নন সেটা বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না, যদিও আসলে তিনি তা ছিলেন না। ফারমিনা ডাজা তাঁকে যেদিন তাদের বাড়িতে অনাহূত ভাবে চিকিৎসক হিসাবে এক মুহূর্তের জন্য দেখে সেদিন থেকেই তার মনে ওই বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে জন্মে। শেষে, হিল্ডাব্রান্ডার সঙ্গে কথাবার্তা তাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। হিল্ডাব্রান্ডা নিজে ওই ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল, সে এখানে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করল, ভুলে গেল যে লোরেঞ্জো ডাজা সম্ভবত তার এখানে বেড়াতে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন যেন সে ডাক্তারের পক্ষে কিছু প্রভাব খাটাতে পারে। হিল্ডাব্রান্ডা যেদিন টেলিগ্রাফ আপিসে ফ্লোরেন্টিনোর সঙ্গে দেখা করতে যায় সেদিন তার সঙ্গী হতে না পারার জন্য ফারমিনা যে কী কষ্ট পেয়েছিল তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। তার ভীষণ ইচ্ছা করেছিল ওর কাছে সে তার দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা খুলে বলবে, তার সঙ্গে একা আলাপ করবে, তাকে ভালো করে চেনার চেষ্টা করবে, যেন তার একটা আবেগতাড়িত সিদ্ধান্ত আরেকটা আরো গুরুতর দ্রুত সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে না দেয় সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হতে পারে : সেটা ছিল বাবার বিরুদ্ধে নিজের ব্যক্তিগত যুদ্ধে তার আত্মসমর্পণের ব্যাপার। কিন্তু তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সে সময়ে তাই করে ছিল। তার পাণি- প্রার্থীর সুন্দর মুখশ্রী, কিংবা তার বিপুল ধন সম্পদ কিংবা তার যৌবনদীপ্ত খ্যাতি কিংবা তার আরও নানা গুণাবলীর কথা সে বিন্দুমাত্র বিবেচনা করে নি, বরং একটা সুযোগ তার সামনে থেকে অপসৃত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল, সে এখন তার একুশতম জন্মদিনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, আর নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণের জন্য ওটাই ছিল তার স্বনির্ধারিত ব্যক্তিগত সময়সীমা। ওই এক মুহূর্তই তার সিদ্ধান্ত নেবার জন্য যথেষ্ট ছিল, ঈশ্বর ও মানুষের বিধান যা ছিল পূর্বদৃষ্ট : যতদিন পর্যন্ত না মৃত্যু তোমাকে তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আর তখনই তার সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব অপসৃত হয়ে যায়, তার যুক্তি-বুদ্ধি তাকে যেপথ সব চাইতে শোভন-সুন্দর বলে নির্দেশ করলো সে তা কোন রকম অনুতাপ-অনুশোচনা ছাড়াই অনুসরণ করতে সক্ষম হল। কোন অশ্রু বিসর্জন না করে সে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার স্মৃতি তার মন থেকে মুছে ফেললো, পুরোপুরি, এবং তার স্মৃতিতে সে যে জায়গা দখল করে ছিল সেখানে সে ফুটতে দিল রাশি রাশি পপি ফুল। সে শুধু একটি শেষ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, সাধারণের চাইতে গাঢ় ছিল সেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস, বললো, ‘বেচারা!’

তবে মধুচন্দ্রিমা থেকে ফিরে আসার পরই তার মধ্যে সব চাইতে ভীতিপ্রদ সন্দেহগুলি জাগতে শুরু করে। তাদের তোরঙ্গগুলি খোলা হল, আসবাবপত্রের প্যাকিং খোলা হল, এগারোটি বাক্সের জিনিসপত্র বের করা হল। ফারমিনা এইসব নিয়ে এসেছে, এবার সে মার্কুই ডি কাসালডুয়েরোর প্রাক্তন প্রাসাদের মালকানী ও অধিশ্বরী হবে, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার মাথা মারাত্মক ভাবে ঝিমঝিম করে উঠলো, সে উপলব্ধি করলো যে সে একটা ভুল বাড়িতে বন্দিনী মাত্র, আরো খারাপ যা তা হল তার স্বামী বন্দি নয়। এ বাড়ি ছাড়তে তার ছ’বছর লেগে ছিল, তার জীবনের সব চাইতে খারাপ বছরগুলি। শাশুড়ি ডোনা ব্লাঙ্কার তিক্ততা, ননদদের মানসিক আলস্য ও নিস্পৃহতা, যারা পচে মরবার জন্য মঠের কোনো কুঠুরিতে যায় নি কারণ নিজেদের মধ্যেই তারা ওই কুঠুরি বয়ে নিয়ে চলতো, এই সব কিছু ফারমিনাকে চরম হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *