প্রেম ও কলেরা – ১২

১২

আসেনসিয়া সান্তাদারের বয়স প্রায় পঞ্চাশ, তাকে দেখাতোও ওই বয়সী, কিন্তু তার মধ্যে ভালোবাসার এমন একটা সহজাত প্রবণতা ছিল যাকে বাধা দেবার ক্ষমতা কোন ঘরোয়া বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ছিল না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কখন তার ওখানে যেতে পারবে সেটা সে কাপ্তানের জাহাজের সফরসূচি থেকে জেনে নিতো। সে ওখানে সব সময়ই, আগে কোন খবর না দিয়ে, উপস্থিত হত, যখন তার ইচ্ছা হত তখনই, আর দিন কিংবা রাতের যে কোন সময় গিয়ে উপস্থিত হলেই সে দেখতো যে আসেনসিয়া সান্তাদার তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, এর কোন ব্যতিক্রম সে দেখে নি। আসেনসিয়ার মা তার সাত বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত তাকে যেভাবে লালনপালন করেছিলেন সে ওভাবেই দরজা খুলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে অভ্যর্থনা জানাতো, গায়ে কোনো জামা-কাপড় নেই, সম্পূর্ণ নগ্ন, শুধু চুলে একটা অর্গান্ডির ফিতা জড়ানো। ফ্লোরেন্টিনোকে আরেক পা এগুতে না দিয়ে সে তার কাপড় খুলে ফেলতো, কারণ সে মনে করতো যে কাপড়-জামা পরা কোন মানুষ বাড়িতে ঢুকলে গৃহের অকল্যাণ হবে। এই একটা ব্যাপার নিয়ে কাপ্তান রোজেন্দো ডি লা রোজার সঙ্গে তার সারাক্ষণ ঝগড়া হত। কাপ্তানের কুসংস্কার ছিল অন্য রকম। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নগ্ন অবস্থায় ধূমপান করলে সেটা দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে, তাই তিনি কখনো কখনো তাঁর অপরিহার্য কিউবান চুরুট বাদ দেবার পরিবর্তে তাঁর প্রণয়পর্বকে স্থগিত করে দিতেন। পক্ষান্তরে নগ্নতার মাধুর্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে মুগ্ধ করতো। আসেনসিয়া বাড়ির বাইরের দরজা বন্ধ করে দেয়ায় সঙ্গে সঙ্গে পরম আনন্দ নিয়ে ফ্লোরেন্টিনোর কাপড় খুলতে শুরু করতো, তাকে সম্ভাষণ করার কিংবা টুপি ও চশমা খোলার সময় পর্যন্ত দিতো না, তাকে চুমু খেতে খেতে ও তার চুম্বন গ্রহণ করতে করতে, সে মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার সমস্ত জামা-কাপড় খুলে ফেলতো, একটা চুমু খায় আর তার প্যান্টের একটা বোতাম খোলে, তারপর চুমুর ফাঁকে ফাঁকে খুলে ফেলে তার বেল্টের বকলস্, সব শেষে তার কোট আর শার্ট, মনে হত সে যেন মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত চিরে ফাঁক করা একটা জ্যান্ত মাছ। তারপর সে তাকে ড্রয়িং রুমের একটা চেয়ারে বসিয়ে টান দিয়ে খুলে ফেলতো তার প্যান্ট আর লম্বা আন্ডারওয়্যার, আর তারপর তার মোজা। তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে চুম্বন করা ও তার চুম্বন গ্রহণ বন্ধ করে দিয়ে এই উৎসবে যে একমাত্র কাজের দায়িত্ব সে নিয়েছিল সেই কাজটি সম্পন্ন করত। সে তার কোটের বোতামের ফুটো থেকে তার ঘড়ি ও ঘড়ির চেইন ও চশমা খুলে সেগুলি তার জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতো যেন ভুল ক্রমে এখানে ফেলে না যায়। যখনই অন্য কারো বাড়িতে তাকে কাপড় খুলতে হতো তখনই সে অবধারিত ভাবে এই সতর্কতা অবলম্বন করতো।

ফ্লোরেন্টিনোর এই কাজটা শেষ হওয়া মাত্র আসেনসিও তাকে আর অন্য কিছু করার সুযোগ না দিয়ে তার ওপর চড়াও হত, যে সোফায় বসিয়ে সে তার জামা-কাপড় খুলে দিয়েছিল সেই সোফাতেই, কদাচিৎ সে তাকে তার শোবার ঘরের বিছানায় নিয়ে যেত। সে তার ওপর চড়ে বসে নিজের সব কিছু দিয়ে তার সব কিছুর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করতো, সে সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন হয়ে যেতো, চোখ বন্ধ, তার পরিপূর্ণ অভ্যন্তরীণ অন্ধকারের মধ্যে সে অবস্থান অনুমান করে নিতো, কোথাও অগ্রসর হত, কোথাও পিছু হঠতো, তার অদৃশ্য পথ সংশোধন করতো, আরো তীব্র ভিন্ন কোন পথ বেছে নিতো, তার গর্ভ থেকে উচ্ছৃত পিচ্ছিল জলাভূমিতে নিমজ্জিত হবার পরিবর্তে অন্য কোন পথে এগুবার প্রয়াস পেতো সে, ডাঁশ মাছির মতো গুনগুন করে তার নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় নিজেকে প্রশ্ন শুধাতো, নিজেই তার উত্তর দিতো, ছায়ার মধ্যে ওই বস্তুটা কোথায় যার খবর একমাত্র সেই জানে, যার জন্য সে ব্যাকুল, শুধু তার নিজের জন্য, তারপর সে এক সময় কারো জন্য অপেক্ষা না করে অবদমিত হয়ে যেতো, সে একা তার নিজের অতল গহ্বরে ডুবে যেতো, পরিপূর্ণ বিজয়ের একটা আনন্দোচ্ছল বিস্ফোরণ ঘটতো তার মধ্যে, যার অভিঘাতে সারা পৃথিবী যেন কেঁপে উঠতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকতো, অসম্পূর্ণ, নিজেদের ঘামের ডোবার মধ্যে ভাসমান, কিন্তু নিজেকে তার মনে হত আনন্দের একটা হাতিয়ার মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। সে বলতো, তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করো যেন আমি যে কোন একটা মানুষ। আর তখন আসেনসিয়া তার মুক্ত স্বাধীন রমণীর হাসি হেসে বলতো, মোটেই না, আমি তোমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করি যেন তুমি কেউই নও। ফ্লোরেন্টিনোর মনে হত একটা নীচুমনা লোভ নিয়ে সে তার সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে, তার অহঙ্কার বিদ্রোহী হয়ে উঠতো, সে আর কখনো এখানে না আসার সঙ্কল্প নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু তারপর কোন কারণ ছাড়াই রাত দুপুরে তার ঘুম ভেঙ্গে যেতো, আসেনসিয়া সান্তাদারের আত্মনিমগ্ন স্মৃতি তার মনে জেগে উঠতো, আর তখন তার যথার্থ রূপ তার কাছে ধরা পড়তো : ওটা ছিল সুখের এক চোরাবালি যাকে সে একই সঙ্গে ঘৃণা করে, আবার কামনাও করে, যার হাত থেকে পালানো তার পক্ষে কদাচ সম্ভব নয়।

দু’বছর পর এক রবিবারে যখন তাদের দেখা হল তখন আসেনসিয়া তার কাপড় খুলে ফেলার আগে তার চশমা খুলে নিল, যেন সে ভালো ভাবে তাকে চুমু খেতে পারে, আর তখনই ফ্লোরেন্টিনো বুঝলো যে সে তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। প্রথম দিন থেকেই ফ্লোরেন্টিনো এ বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম বোধ করে এসেছে, নিজের বাড়ির মতোই সে এ বাড়িকে ভালোবেসে, তবু সে কখনো এখানে দু’ঘণ্টার বেশি কাটায় নি, একবার ছাড়া কখনো এখানে খায় নি, সেই একবারও সে এখানে খাদ্য গ্রহণ করে কারণ আসেনসিয়া সান্তাদার তাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে আহার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিল। প্রকৃতপক্ষে, সে একটা উদ্দেশ্যেই ওখানে যেত, সব সময়ই তার একমাত্র উপহার নিয়ে উপস্থিত হত, একটা গোলাপ, তারপর উধাও হয়ে যেত, পরবর্তী সাক্ষাৎ পর্যন্ত তাকে আর দেখা যেত না, এবং সেটা কখন হবে কারো তা জানা ছিল না। কিন্তু ওই রবিবার আসেনসিয়া যখন চুমু খাবার সুবিধার জন্য তার চশমা খুলে নিলো, কতকটা সেই কারণে, কতকটা তাদের শান্ত স্নিগ্ধ যৌন মিলনের কারণে, ওরা দুজনেই নগ্নদেহে কাপ্তানের বিশাল খাটে ঘুমিয়ে পড়লো, এবং সারাটা অপরাহ্ণ ওইভাবে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলো। যখন ফ্লোরেন্টিনোর ঘুম ভাঙ্গলো তার মনে পড়লো যে সে একবার কাকাতুয়াটার তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনেছিল, এখনও তার কানে সে চিৎকার লেগে আছে, পাখিটার সৌন্দর্যের সাথে তার চিৎকারের কোন মিলই ছিল না। কিন্তু এখন অপরাহ্ চারটার গরমের মধ্যে নীরবতাটা মনে হল স্বচ্ছ-তরল, শোবার ঘরের জানালা দিয়ে পুরনো শহরের আভাস দেখা যাচ্ছে, পেছনে বিকালের সূর্য, সোনালি গম্বুজগুলি, সমুদ্রের বুকে যেন আগুন জ্বলছে, সে-আগুন দেখা যাচ্ছে একেবারে জ্যামাইকা পর্যন্ত। আসেনসিয়া সান্তাদার তার দুঃসাহসী হাত বাড়িয়ে নিদ্রামগ্ন পশুটার সন্ধান করলো কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘এখন না। আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, কেউ যেন আমাদের দেখছে।’ আসেনসিয়া হো হো করে হেসে উঠলো। তার হাসি কাকাতুয়াটাকে আবার উত্তেজিত করে তুললো। আসেনসিয়া হাসতে হাসতে বললো, “স্বয়ং জোনাহ-র স্ত্রীও এরকম আজগুবি কথা বিশ্বাস করতো না।’ সে-ও বিশ্বাস করে নি, তবে সে স্বীকার করলো যে চিন্তাটা ভালোই, তারপর তারা দুজন, আবার সঙ্গমে লিপ্ত না হয়েও, পরস্পরকে দীর্ঘ সময় ধরে ভালোবাসলো। পাঁচটার সময় আসেনসিয়া লাফ দিয়ে খাট থেকে নামলো, সব সময়ের মতো এখনো সম্পূর্ণ নগ্ন, চুলে অর্গান্ডির একটা ফিতা জড়ানো, সন্ধ্যা নামতে দেরি আছে এখনো, কিছু একটা পানীয়ের খোঁজে সে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু এক পা না যেতেই তার গলা চিরে বেরিয়ে এল একটা তীক্ষ্ণ আতঙ্কিত চিৎকার।

সে বিশ্বাস করতে পারলো না। দেয়ালের সাথে সংযুক্ত বাতিগুলি ছাড়া সারা বাড়িতে আর একটা জিনিসও নাই। আসবাবপত্র, আদিবাসীদের তৈরি কার্পেট, মূর্তি, ভাস্কর্য, হাতে বোনা পর্দা, চাদর, মূল্যবান পাথর ও ধাতু নির্মিত অসংখ্য ছোটখাটো জিনিস, যা কিছু তার এই গৃহকে শহরের সব চাইতে মনোরম, প্রীতিপ্রদ ও সুশোভিত গৃহে পরিণত করেছিল তার কিছুই নাই, এমনকি পবিত্র কাকাতুয়াটাও নাই, সব, সব অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাদের প্রেমলীলায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে জিনিসগুলি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সমুদ্রের দিকের বারান্দা দিয়ে। যা পড়ে আছে তা হল শূন্য ঘরগুলি, চারটা খোলা জানালা, আর পেছনের দেয়ালে রঙ দিয়ে লেখা একটা বার্তা : লাম্পট্যের পরিণতি এরকমই হয়। আসেনসিয়া কেন যে এই চুরির ঘটনা কর্তৃপক্ষকে জানায় নি, কিংবা চোরাই মাল কেনা-বেচার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নি, কিংবা তার এই দুর্ভাগ্যের কথা দ্বিতীয় বার উল্লেখের অনুমতি কাউকে দেয় নি সেটা কাপ্তান রোজেন্দো ডি লা রোজা কোন দিন বুঝতে পারেন নি।

ফ্লোরেন্টিনো ওই লুণ্ঠিত বাড়িতে আসেনসিয়ার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য তার যাতায়াত অব্যাহত রাখে। আসবাবপত্র বলতে এখন ওই বাড়িতে আছে তিনটা চামড়া মোড়ানো টুল, তস্কর বাহিনী রান্নাঘরে রাখা ওগুলির কথা খেয়াল করেনি, আর আছে শোবার ঘরের জিনিসগুলি যেখানে তারা দুজন শুয়ে ছিল। ফ্লোরেন্টিনো অবশ্য এখন আর আগের মত ঘন ঘন ওখানে যেতো না, বাড়ির জিনিসপত্র কমে গেছে, এখন আর অত সুন্দর নেই, সে জন্য নয়। আসেনসিয়া তাই ভেবেছিল, তাকে জিজ্ঞাসাও করেছিল, কিন্তু না, সেজন্য সে তার যাতায়াত কমায় নি। সে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল শতাব্দির শুরুতে খচ্চরচালিত ট্রলি গাড়ির আবির্ভাবের নতুনত্বে। বন্ধনমুক্ত ক্ষুদে পাখিদের প্রেমলীলার চমৎকার জায়গা হয়ে উঠে ছিল ওই ট্রলিগাড়ি। সে দিনে চার বার ওই গাড়িতে চড়তো, দু’বার আপিসে যাওয়ার জন্য, দু’বার অফিস থেকে ফেরার জন্য, আর মাঝে মাঝে ওখানেই সে ভবিষ্যতে মিলিত হবার দিনক্ষণ স্থান ঠিক করে নিতো। পরে কাকা দ্বাদশ লিও তার ব্যবহারের জন্য দুই খচ্চরটানা একটা গাড়ি বরাদ্দ করে দেন, সোনালি নানা সাজসজ্জায় সজ্জিত ছিল গাড়িটি, রাষ্ট্রপতি রাফায়েল নুনেজের গাড়ি যেমন ছিল হুবহু সেই রকম, কিন্তু তখনো ফ্লোরেন্টিনো মাঝে মাঝেই সতৃষ্ণ চিত্তে ওই ট্রলি গাড়ির দিনগুলির কথা মনে করতো, তার শিকারি তীরন্দাজের ভূমিকায় তখনই সে সব চাইতে বেশি সাফল্য দেখাতে পেরেছিল। তার মূল্যায়ন ঠিকই ছিল। দোর গোড়ায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকার চাইতে গোপন প্রেমের বড় শত্রু আর কিছু নেই। বস্তুতপক্ষে, সে সব সময় তার গাড়ি নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখে পায়ে হেঁটে তার শিকার অভিযানে বেরুতো, যেন পথের ধুলায় গাড়ির চাকার কোন দাগ পড়ে না থাকে। এই সব কারণেই সে গাঢ় স্মৃতিবিধুরতা নিয়ে শীর্ণদেহ ঘায়ে-ভর্তি খচ্চরটানা ট্রলি গাড়িটির কথা মাঝে মাঝেই মনে করতো, আড় চোখে ওখানে এক নজর তাকালেই প্রেমের অবস্থান কোথায় তা স্পষ্ট বোঝা যেতো। কিন্তু অনেক অনেক স্মৃতির মধ্যেও একটা মধুর স্মৃতি এখনো তার সারা মন জুড়ে আছে, একটা অসহায় বাচ্চা মেয়ের স্মৃতি, যার নাম সে জানে না, যার সঙ্গে মাত্র একবার আধ-রাত সে পাগলের মতো কাটিয়েছিল, কিন্তু তাই কার্নিভালের নিষ্পাপ উন্মত্ত হুল্লোড়ের মোহমায়া থেকে তাকে তার বাকি জীবনের জন্য সম্পূর্ণ মুক্তি দিয়েছিল।

সাধারণ উৎসবের হুল্লোড় ও উচ্ছৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সে যে রকম নিঃশঙ্ক ভাবে ট্রলিতে যাতায়াত করে সেটাই ফ্লোরেন্টিনোর নজর কাড়ে। ওর বয়স বিশ বছরের বেশি হবে না, কার্নিভালের আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে তার আচার-আচরণ সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হল না, যদি না সে ইচ্ছা করে অসুস্থতার ভান করে থাকে। তার চুল ছিল দীর্ঘ, হাল্কা রঙের, অকুঞ্চিত, পরনে সাধারণ নিরলঙ্কার লিনেনের জামা। রাস্তা জুড়ে নানা বিচিত্র সুরের গান-বাজনা চলছে, মুঠি মুঠি চালের গুঁড়ো ছিটানো হচ্ছে, ট্রলির যাত্রীদের ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে রঙের বন্যায়, ট্রলিটানা খচ্চরের শরীর ময়দার মাড়ে সাদা হয়ে গেছে, মাথায় ফুল আঁকা টুপি, কিন্তু ওকে মনে হল এই সব কিছু থেকে অনেক দূরে। তিন দিনের এই উন্মত্ততা তাকে যেন একটুও স্পর্শ করছে না। চারপাশের হইচই-এর সুযোগ নিয়ে ফ্লোরেন্টিনো মেয়েটিকে তার সঙ্গে একটা আইসক্রিম খেতে আমন্ত্রণ জানালো, তার মনে হল এর চাইতে বেশি কিছুর জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতো না। মেয়েটি বলল, ‘আমি সানন্দে আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি, তবে একটা ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করে দেয়া দরকার, আমি কিন্তু পাগল।’ ওর রসবোধ দেখে ফ্লোরেন্টিনো হেসে উঠলো, তারপর শোভাযাত্রার সুসজ্জিত চলমান যানগুলি দেখার জন্য সে তাকে আইসক্রিমের দোকানের বারান্দায় নিয়ে গেল। সে একটা ভাড়া করা পোশাক গায়ে চাপালো, শুল্কভবনের চত্বরে নৃত্যরত উৎসব-মুখর জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে তারা দুজন নাচলো, সদ্য জন্ম নেয়া প্রেমিক যুগলের মতো ওরা পরম আনন্দ উপভোগ করল এবং ওই রাতের উচ্ছলতার মধ্যে মেয়েটির পূর্ব-ঔদাসীন্য এবার তার বিপরীত প্রান্তে গিয়ে উপনীত হল। একজন পেশাদার নর্তকীর মতো সে নাচতে লাগলো, আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের ক্ষেত্রে সে ছিল সাহসী ও কল্পনাসমৃদ্ধ, আর তার মধ্য থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এক বিধ্বংসী আকর্ষণের ক্ষমতা।

কার্নিভালের উন্মাতাল আবহাওয়ায় মেয়েটি হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে বলল, ‘আমাকে নিয়ে আপনি যে কী ঝামেলায় পড়েছেন তা আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি পাগলাগারদ থেকে বেরিয়ে এসেছি, আমি একটা পাগলী।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জন্য এই রাত হয়ে উঠল তার কৈশোরের নিষ্পাপ বেপরোয়া দিনগুলির মতো, যখন সে ভালোবাসায় শরাঘাতে আহত হয় নি। কিন্তু, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার চাইতে বেশি লোকমুখে শুনে তার জানা ছিল যে এ ধরনের সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই, শ্রেষ্ঠ পোশাকের জন্য পুরস্কার বিতরণের পর এই ধরনের রাত যখন অবধারিত ভাবে অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যেতো তার আগেই, ফ্লোরেন্টিনো মেয়েটির কাছে বাতিঘরে যাবার প্রস্তাব করলো, তারা দুজন সেখান থেকে সূর্যোদয় দেখবে। মেয়েটি খুশি হয়ে রাজি হল, কিন্তু সে বলল যে পুরস্কার বিতরণ পর্যন্ত সে এখানে থাকতে চায়।

ওই দেরিটুকুই যে তার প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল সে সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কোন সন্দেহ নাই। যখন মেয়েটি তাকে বলল যে, হ্যাঁ, এবার তারা বাতিঘরে যেতে পারে, ঠিক তখনই ডিভাইন শেপার্ডেস উন্মাদ আশ্রমের দুজন প্রহরী ও একটি নার্স মেয়েটিকে পাকড়াও করে। পাগলা গারদ থেকে ও বিকাল তিনটার সময় পালিয়ে যায়। তখন থেকে এরা, বস্তুতপক্ষে গোটা পুলিশ বাহিনী, তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পালাবার আগে সে বাগানের মালীর হাত থেকে তার লম্বা ধারালো কাঁচি ছিনিয়ে নিয়ে এক আঘাতে একটি প্রহরীর মাথা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আরও দুজনকে মারাত্মক ভাবে আহত করে, কারণ সে কার্নিভালের নাচে যোগ দিতে চেয়েছিল। ওদের কারোই মনে হয় নি যে সে রাস্তায় নাচতে থাকতে পারে। ওরা ভেবেছিল যে নিশ্চয়ই কোন একটা বাড়িতে লুকিয়ে আছে, ওরা জলের চৌবাচ্চাগুলি পর্যন্ত খুঁজে দেখেছিল।

ওকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কাজটা সহজ হয় নি। বডিসের মধ্যে ও বাগানে ফুল কাটার একটা কাঁচি লুকিয়ে রেখেছিল। ওকে পাগলা গারদের বিশেষ পোশাক পরাবার জন্য ছয় জন লোকের দরকার হয়। আর ওদিকে শুল্ক বিভাগের চত্বরে জমায়েত লোকজন হাততালি ও শিস দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করতে থাকে, তারা মনে করে যে ওই সাংঘাতিক মেয়ে লোকটিকে পাকড়াও করা কার্নিভালের নানা প্রহসনের একটা অঙ্গ মাত্র। কিন্তু এই ঘটনায় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মর্মাহত হয়। অ্যাশ ওয়েনেসডের পর দিন থেকে সে ডিভাইন শেপার্ডেস সড়ক দিয়ে হেঁটে যেতে শুরু করে, তার হাতে থাকতো ওই মেয়েটির জন্য এক বাক্স বিলেতি চকোলেট। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভেতরের বাসিন্দাদের দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর ওরা জানালা দিয়ে তাকে লক্ষ করে কেউ বিশ্রী গালাগাল আর কেউ মধুর প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। সে ওদেরকে চকোলেটের বাক্সটা দেখাতো, সৌভাগ্যক্রমে ওই মেয়েও যদি গারদের মধ্য দিয়ে ওকে দেখতে পায়। বেশ কয়েক মাস পর সে একদিন খচ্চর-টানা ট্রলি গাড়ি থেকে নেমে একটি ছোট মেয়েকে তার বাবার সঙ্গে হেঁটে যেতে দেখে। বাচ্চা মেয়েটি তার কাছে তার চকোলেটের বাক্স থেকে একটা চকোলেট চায়, বাবা তাকে ধমক দিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো মেয়েটিকে গোটা বাক্সটাই দিয়ে দেয়, তার মনে হল এই কাজটির মধ্য দিয়ে সে এর সঙ্গে যুক্ত সকল তিক্ততার হাত থেকে মুক্তি পাবে। সে বাবার পিঠে আলতো ভাবে একটা চাপড় মেরে বলল, এগুলি যে ভালোবাসার জন্য আমি কিনেছিলাম তা হেজে মজে মরে ভূত হয়ে গেছে।

নিয়তি এক ধরনের ক্ষতিপূরণ হিসাবে এই ট্রলি গাড়িতেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে লিওনা কাসিয়ানির সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেয়। লিওনা কাসিয়ানিই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জীবনে সত্যিকার নারী হয়ে ওঠে যদিও ওদের দুজনের কেউই এটা কখনো জানতে পারে নি, আর যদিও ওরা কখনো প্রেম করে নি। বিকাল পাঁচটায় কাজের শেষে ফ্লোরেন্টিনো ট্রলিতে করে বাড়ি ফিরছিলো, দেখার আগেই সে ওর উপস্থিতি অনুভব করে, তার দিকে ওর দৃষ্টিপাত ছিলো আঙ্গুল দিয়ে তাকে স্পর্শ করার মতো বাস্তব। চোখ তুলে তাকাতেই সে ওকে দেখলো, ট্রলির একেবারে শেষ দিকে দাঁড়িয়ে আছে, অন্য যাত্রীদের চাইতে সুস্পষ্ট ভাবে আলাদা হয়ে। ও তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো না। বরং ঠিক তার উল্টো : ও এমন স্পষ্ট সরাসরি ভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো যে সে যা ভাবলো তা না ভেবে তার উপায় ছিলো না : কৃষ্ণাঙ্গ, অল্প বয়েসী, সুন্দরী ওই মেয়ে নিঃসন্দেহ যৌনকর্মী। সে ওকে তার জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিলো, কারণ ভালোবাসার জন্য পয়সা দেওয়ার চাইতে বেশি ঘৃণ্য সে আর কোন কিছু কল্পনাও করতে পারতো না : জীবনে সে কখনো তা করে নি।

এই পথের শেষ স্টেশন ছিল ‘যানবাহনের চত্বর’। ট্রলি সেখানে পৌঁছতেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা দ্রুত নেমে পড়ে হাটবাজারের ভিড়ের গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিল, তার মা ছ’টার সময় তার প্রত্যাশা করছিলেন। ভিড়ের ওপাশে গিয়ে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে সে তার পেছনে শান বাঁধানো পথের উপর একটি অসৎ মেয়ের জুতার খটখট শব্দ শুনতে পেল। সে বুঝেছিল, তবু নিশ্চিত হবার জন্য ঘুরে তাকাতেই সে ওকে দেখলো। খোদাই করা কাজে ক্রীতদাসীদের যে রকম পোশাক পরিহিত দেখায় ও সেই রকম কাপড়-জামা পরে আছে, রাস্তায় জমে থাকা কাদাজলের ছোট ডোবাটি পার হবার জন্য সে তার ঘাগরার প্রান্তদেশ নাচনেওয়ালীর ভঙ্গিতে উঁচু করে তুলে ধরেছে, ঊর্ধ্বাঙ্গের জামা নিচু করে কাটা, পিঠের প্রায় সবটাই উন্মুক্ত, গলায় এক গাদা রঙিন পাথরের কণ্ঠহার, মাথায় একটা সাদা পাগড়ি প্যাঁচানো। অস্থায়ী হোটেলে সে এদের অনেক দেখেছে। প্রায়ই বিকাল ছ’টার সময় দেখা যেত যে ওরা তখনো সকালের নাস্তা খাচ্ছে, তারপর তাদের যৌনতাকে ব্যবহার করার জন্য যা কিছু করা দরকার তারা তাই করতো, ডাকাতের ছুরির মতো তারা তাদের যৌনতাকে রাস্তার প্রথম মানুষটির গলায় উঁচিয়ে ধরতো : দাও তোমার পুরুষাঙ্গ, নয়তো মর! চূড়ান্ত ভাবে নিশ্চিত হবার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার গতিপথ পরিবর্তন করে নির্জন অয়েল ল্যাম্প গলি ধরে এগিয়ে গেল, মেয়েটিও তাকে অনুসরণ করলো, ক্রমে উভয়ের দূরত্ব কমে এল। তখন ফ্লোরেন্টিনো থেমে, ঘুরে দাঁড়িয়ে, ফুটপাথের উপর ওর পথ রুদ্ধ করে, ছাতার উপর তার দু’হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালো। মেয়েটি সোজা তার মুখের দিকে তাকালো!

ফ্লোরেন্টিনো বলল, ‘তুমি ভুল করছো, সুন্দরী। আমি ওসব করি না।’

“অবশ্যই করো। তোমার মুখ দেখেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়।”

তার শৈশবে তাদের পারিবারিক চিকৎসক তার ধর্মপিতার একটা কথা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে পড়লো। তিনি বলতেন, ‘পৃথিবীর তাবৎ মানুষ’কে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যারা হাগতে পারে আর যারা পারে না।’ এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তিনি মানব চরিত্রের একটা পুরো তত্ত্ব নির্মাণ করেছিলেন, তিনি বলতেন যে তার ওই তত্ত্ব জ্যোতিষতত্ত্বের চাইতে অভ্রান্ত। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার বহু বছরের অভিজ্ঞতার পর ওই বিভাগটা একটু ভিন্ন ভাবে করতে শুরু করে। তার মতে ‘পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যারা যৌন সঙ্গম করে আর যারা করে না।’ যারা করে না, তারা সঙ্কীর্ণ ও সরল পথ থেকে একবার ভ্রষ্ট হলে ব্যাপারটার অসাধারণত্বে অভিভূত হয়ে যায় এবং তা নিয়ে তারা তখন এমন গর্ব করতে থাকে যেন তারাই এটা আবিষ্কার করেছে। পক্ষান্তরে, যারা এ কাজটা প্রায়ই করে তারা তাদের ঠোঁট এমনই টিপে বন্ধ করে রাখে যেন সেটা কবরের দরজা, কারণ তারা জানে যে সতর্কতা ও সুবিবেচনার ওপরই তাদের জীবন নির্ভর করে। তারা তাদের চমকপ্রদ কাজের কথা কখনো বলে না, কারো কাছে তাদের কীর্তিকলাপ প্রকাশ করে না, এ কাজে এতোটাই ঔদাসীন্য দেখায় যার জন্য অনেকে তাদের মনে করে নপুংশক কিংবা মাত্রাতিরিক্ত শীতল, এমনকি ভীরু সমকামী পর্যন্ত, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ক্ষেত্রে তাই ভাবতো অনেক। কিন্তু ওরা এই ভ্রান্তিতে আনন্দ পেতো, কারণ ওই ভ্রান্তিই তাদের রক্ষা করতো। ওরা একটা গুপ্ত সমিতির মতো হয়ে ওঠে, এর সদস্যরা পৃথিবীময় তাদের সদস্যদের সহজেই চিনে নিতো, তার জন্য তাদের কোন সাধারণ ভাষার দরকার হত না। এবং এজন্যই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মেয়েটির উত্তরে অবাক হল না, সে তাদেরই দলের একজন, আর তাই ও বুঝেছে যে সে জানে যে ও জানে।

কিন্তু এটা ছিল তার জীবনের একটা বড় ভুল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টা তার বিবেক তাকে এটা মনে করিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি তার কাছ থেকে ভালোবাসা চায় নি, বিশেষ করে যে ভালোবাসা পয়সা দিয়ে বেচা-কেনা হয় সেটা একেবারেই চায় নি, সে চেয়েছিল ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানিতে একটা চাকরি, যে কোন চাকরি, যে কোন বেতনে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিজের আচরণের জন্য এত অনুতপ্ত হয় যে সে ওকে কর্মচারী নিয়োগ বিভাগের প্রধানের কাছে নিয়ে যায় এবং তিনি তাকে সাধারণ শাখায় সব চাইতে কম বেতনের চাকরিতে নিয়োগ করেন। মেয়েটি সেখানে তিন বছর আন্তরিকতা, বিনয় ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আর. সি. সি.-র অফিস ছিল জাহাজঘাটার উল্টো দিকে। উপসাগরের অপর দিকে সামুদ্রিক জাহাজের বন্দরের সঙ্গে এটার কোন মিল ছিল না, লাস অ্যানিমাস উপসাগরের ওপর যে সেতু তার সঙ্গেও এটার কোন মিল ছিল না। আর. সি. সি.-র দপ্তর ছিল একটা কাঠের দালানে, ঢালু টিনের ছাদ, দীর্ঘ একটা বারান্দা, বড় বড় স্তম্ভ, চারপাশটা তারের জাল দিয়ে ঘেরা, তার মধ্য দিয়ে ঘাটের জাহাজগুলি স্পষ্ট দেখা যায়, মনে হয় যেন দেয়ালের গায়ে ঝোলানো ছবি। কোম্পানির জার্মান প্রতিষ্ঠাতারা বাড়িটা বানাবার সময় টিনের ছাদে দিয়েছিল লাল রঙ আর কাঠের দেয়ালগুলিতে উজ্জ্বল সাদা, যার ফলে বাড়িটাকে দেখাতো অনেকটা নদীর বুকে চলাচলকারী জাহাজের মতো। পরে গোটা বাড়িতে লাগানো হয় নীল রঙ; ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন কোম্পানির কাজে যোগ দেয় তখন এটা পরিণত হয়েছিল ধূলিধূসরিত কোন সুস্পষ্ট রঙহীন গুদামঘরের মতো একটা বাড়িতে, তার টিনের ছাদে জায়গায় জায়গায় আদি টিনের পাতের ওপর নতুন টিনের পাতের তালি লাগানো হয়েছে। দালানটার পেছন দিকে আছে একটা পাকা উঠান, সরু তারের জাল দিয়ে ঘেরা, ওই উঠানে রয়েছে দুটি বড় বড় গুদামঘর, সেগুলি নির্মিত হয়েছে অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালে। গুদামঘর দুটির পেছনে আছে আবৃত পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপ, নোংরা, দুর্গন্ধময়, অর্ধশতাব্দির নৌ চলাচলের আবর্জনা সেখানে পচে চলেছে, পুরনো দিনের এক-চিমনির ঐতিহাসিক জাহাজগুলির ধ্বংসাবশেষ থেকে শুরু করে ক্যাবিনে বৈদ্যুতিক পাখা বিশিষ্ট একেবারে আধুনিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পর্যন্ত জমা হয়েছে ওখানে। অন্যান্য জাহাজ বানাবার কাজে ব্যবহারের জন্য এর বেশির ভাগ থেকেই জিনিসপত্র খুলে নেয়া হয়েছে, তবে অনেকগুলি আবার এমন ভালো অবস্থায় আছে যে যত্নসহকারে নতুন রঙ লাগিয়ে দিলেই তারা আবার নদীর বুকে চলাচল করতে পারবে বলে মনে হয়, গোসাপগুলিকেও বিরক্ত করতে হবে না, বড় বড় হলুদ ফুল আর লতাপাতার ঝাড়কেও সরাতে হবে না, সেগুলি বরং একটা স্মৃতিবিধুরতা জন্ম দেবে।

কোম্পানির প্রশাসনিক শাখা ছিল ভবনের দোতলায়, অফিস ঘরগুলি ছিল ছোট কিন্তু আরামদায়ক ও সুপরিকল্পিত, জাহাজের ক্যাবিনের মত, তার কারণ এগুলি বানিয়েছিল নৌ-প্রকৌশলীরা, সিভিল স্থপতিবিদরা নয়। বারান্দার শেষ প্রান্তে, অন্য কর্মচারীদের অফিস ঘরের মতোই তাঁর অফিস ঘরে, অন্য কোন কর্মচারীর মতোই, কাকা দ্বাদশ লিও তাঁর ব্যাবসায়িক কাজকর্ম সম্পাদন করতেন, শুধু একটি ব্যতিক্রম ছিল, রোজ সকালে তিনি তাঁর টেবিলে দেখতে পেতেন একটা কাচের ফুলদানিতে সুগন্ধ-ছড়ানো কিছু ফুল। নিচের তলায় ছিল যাত্রী বিভাগ, পাশে একটা অপেক্ষা কক্ষ, সেখানে সাদামাটা কয়েকটা বেঞ্চি আর টিকিট বিক্রি ও মালপত্রের ব্যবস্থা করার জন্য একটা কাউন্টার। একেবারে শেষে ছিল বিভ্রান্তিকর সাধারণ বিভাগ, নাম থেকেই এর কাজের অস্পষ্টতার বিষয়টি ধরা পড়তো, কোম্পানির যেসব সমস্যার সমাধান আর কোথাও হত না এখানে এসে সেগুলির অগৌরবের মৃত্যু ঘটতো। সেখানেই বসতো লিওনা কাসিয়ানি, ছাত্রছাত্রীদের ডেস্কের মতো একটা ডেস্কের ওপাশে। জাহাজে চালান যাবার জন্য চারিদিকে সাজানো ভুট্টার বস্তা, আর নিষ্পত্তি না হওয়া কাগজপত্রের স্তূপ। সাধারণ বিভাগকে কিভাবে কার্যকর কিছুতে রূপান্তরিত করা যায় সেটা দেখার জন্য স্বয়ং কাকা দ্বাদশ লিও যেদিন ওখানে যান সেদিন তিনি লিওনা কাসিয়ানিকে ওই অবস্থাতেই আবিষ্কার করেন। তিনি সেখানে তিন ঘণ্টা কাটান, বহু প্রশ্ন করেন, অনেক তাত্ত্বিক অনুমান নিয়ে আলোচনা করেন, বেশ কিছুর বাস্তব প্রমাণ দেখেন, সকল কর্মচারী ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল, তিন ঘণ্টা পরে নিজের অফিস ঘরে ফিরে এসে একটা নিশ্চয়তা দ্বারাই তিনি যন্ত্রণাপীড়িত হলেন, অতগুলি সমস্যা সমাধান করার পরিবর্তে তিনি ঠিক তার উল্টোটা করেছেন, তিনি আবিষ্কার করেছেন নতুন ও ভিন্ন ধরনের কয়েকটি সমস্যা, যার কোন সমাধান নেই।

পরদিন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার আপিসে পৌঁছে লিওনা কাসিয়ানির পাঠানো একটা স্মারকলিপি পেলো। সে তাকে ওটা ভালো করে পড়ে দেখতে অনুরোধ করেছে, তারপর যুক্তিযুক্ত মনে করলে ওটা তার কাকাকে দেখাতে বলেছে। গতকাল অপরাহ্নের পরিদর্শনকালে সকল কর্মচারীদের মধ্যে একমাত্র সেই কোন কথা বলে নি। দয়া করে চাকরি দেয়া একজন কর্মচারীর তাবৎ সচেতনতা নিয়ে সে সারাটা সময় চুপ করে ছিল, কিন্তু স্মারক লিপিতে সে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেয় যে সে বিভাগের অন্য কর্মচারীদের পদমর্যাদার স্তরবিন্যাসের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই চুপ করে ছিল, তার কর্তব্য পালনে কোন রকম অবহেলার কারণে নয়। তার স্মারকলিপিতে ছিল একটা ভয়াবহ সরলতা। কাকা দ্বাদশ লিও বিভাগটির পূর্ণাঙ্গ পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু লিওনা তাঁর সঙ্গে একমত নয়, অত্যন্ত সহজ একটি কারণে, বাস্তব ক্ষেত্রে সাধারণ বিভাগ বলে কোন কিছুর অস্তিত্বই নেই। যে সব বিরক্তিকর ছোটখাটো সমস্যা অন্য বিভাগগুলি তাদের হাত থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইতো সেগুলি সব এসে এখানে জমা হত। ফলে, প্রকৃত সমাধান হচ্ছে সাধারণ বিভাগটা উঠিয়ে দেয়া এবং সমস্যাগুলি যেখানে উদ্ভূত হয়েছিল সমাধানের জন্য আবার সেই সব বিভাগেই ফেরত পাঠিয়ে দেয়া।

কে এই লিওনা কাসিয়ানি সে সম্পর্কে কাকা দ্বাদশ লিওর সামান্যতম ধারণা ছিল না। গতকালের আলোচনা সভায় যাদের তিনি দেখেছিলেন তাদের মধ্যে কে লিওনা কাসিয়ানি হতে পারে তা তিনি মনে করতে পারলেন না, কিন্তু তার স্মারকলিপি পড়ার পর তিনি তাকে তাঁর আপিসে ডেকে পাঠান এবং রুদ্ধদ্বার কক্ষে তার সঙ্গে দু’ঘণ্টা কথা বলেন। একটা মানুষ সম্পর্কে জানার জন্য তিনি সর্বদা যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন এক্ষেত্রেও তাই করলেন। তাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয় সব কিছু। স্মারকলিপিটির মধ্যে ছিল নির্ভুল সাধারণ জ্ঞানের স্বাক্ষর, আর তার পরামর্শ অবশ্যই আকাঙ্ক্ষিত ফল প্রদান করবে। কিন্তু সেটা কাকা দ্বাদশ লিওর মনোযোগ বা কৌতূহল আকর্ষণ করেনি। তাঁর মনোযোগ সব চাইতে বেশি আকর্ষণ করে একটি বিষয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর লিওনা কাশিমানির একমাত্র শিক্ষা ছিল মেয়েদের টুপি, টুপির ফিতা, ঝালর ইত্যাদি বানাবার একটি প্রতিষ্ঠানে। তাছাড়া সে বাড়িতে ইংরেজি শিখছিল, শিক্ষক ছাড়াই একটি নতুন দ্রুত পদ্ধতিতে, গত তিন মাস ধরে সে রাতে টাইপিং-এর ক্লাস করছিল, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় একটা নতুন ধরনের কাজ শিখছিল সে, যে রকম সম্ভাবনার কথা মানুষ এক সময় টেলিগ্রাফ ও তারও আগে বাষ্পচালিত ইঞ্জিন সম্পর্ক বলাবলি করতো।

সে যখন কাকা দ্বাদশ লিওর ঘর থেকে বেরুলো তার আগেই তিনি তাকে একটা নামে ডাকতে শুরু করেন, পরবর্তীকালে তিনি তাকে সর্বদা ওই নামেই উল্লেখ করবেন : আমার মিতা লিওনা। তিনি এক কলমের খোঁচায় জ্বালাতনকারী বিভাগটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন, তারপর লিওনা কাসিয়ানির পরামর্শ অনুযায়ী যারা সমস্যাগুলি সৃষ্টি করেছিল সমাধান করার জন্য সেগুলি তাদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন, আর লিওনার জন্য একটা নতুন পদ সৃষ্টি করলেন, যার কোন নাম ছিল না, কোন সুনির্দিষ্ট কাজের তালিকাও ছিল না, কিন্তু সেটা আসলে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর কাজ। সেদিন বিকালে সাধারণ বিভাগকে লজ্জাকর ভাবে সমাহিত করার পর কাকা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে জানতে চাইলেন ও লিওনা কাসিয়ানিকে কিভাবে পেল। ফ্লোরেন্টিনো সত্য কথাটা জানালে কাকা তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তাহলে আবার ট্রলিতে ফিরে যাও আর ওর মতো যে মেয়েকে পাবে তাকেই আমার কাছে নিয়ে আসবে। ওর মতো আর দু’তিন জনকে পেলে আমরা তোমার নিমজ্জিত জাহাজটা পুনরুদ্ধার করতে পারবো।’

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ভেবেছিল এটা বুঝি তার কাকার নিজস্ব ধরনের রসিকতা, কিন্তু পরদিন সে দেখলো যে ছ’মাস আগে তাকে যে গাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছিল সেটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে, যেন সে আবার ট্রলিতে যাতায়াত করার সময় সুপ্ত প্রতিভা আবিষ্কার করতে পারে। আর তার দিক থেকে, লিওনা কাসিনিয়া তার প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে, প্রথম তিন বছর পরম কুশলতার সঙ্গে সে যা লুকিয়ে রেখেছিল তা প্রকাশ করে দিল। তখন পর্যন্ত সে যাবতীয় নির্দেশাবলী ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছ থেকে গ্রহণ করে আসছিল, সে চেয়েছিল ওই ব্যবস্থাই চালু থাকুক, যদিও, সত্যি কথা বলতে গেলে, ফ্লোরেন্টিনো উপলব্ধি করতে পারেনি যে আসলে ফ্লোরেন্টিনো নিজেই লিওনার নির্দেশাবলী গ্রহণ ও সে-অনুযায়ী কাজ করছিলো। বস্তুতপক্ষে, বোর্ড অব ডিরেক্টকরদের সভায় সে লিওনা কাসিয়ানির পরামর্শের বাইরে কিছুই করতো না এবং তার ফলেই তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য তার গুপ্ত শত্রুদের সকল পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়ে সে ধাপে ধাপে পদোন্নতি লাভ করতে থাকে।

গোপন তথ্য কাজে লাগাবার একটা নারকীয় দক্ষতা ছিল লিওনা কাসিয়ানির সে সব সময় নির্ভুল ভাবে জানতো কখন কোথায় তাকে উপস্থিত থাকতে হবে। সে ছিল প্রচণ্ড উদ্যমী, কিন্তু ধীরস্থির এবং প্রাজ্ঞ মাধুর্যের অধিকারী। কিন্তু অপরিহার্য হলে, মনে বেদনা নিয়েও, সে তার লৌহ কঠিন চরিত্রকে অবাধে ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হত না, তবে এ কাজটি সে কখনো নিজের জন্য করতো না। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, যে কোন মূল্যে, দরকার হলে রক্ত দিয়েও, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার উন্নতির সোপানকে বাধামুক্ত করা। নিজের শক্তির বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে না দেখেই ফ্লোরেন্টিনো ধাপে ধাপে উঠে গিয়ে যে-পদটিতে উপনীত হবে বলে ঠিক করেছিল, তাকে সেখানে পৌঁছে দেয়াই ছিল লিওনার একমাত্র লক্ষ্য। লিওনা এ কাজটা করতোই, কারণ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার ছিল একটা অদম্য ইচ্ছা শক্তি, কিন্তু, সত্য কথা হল, সে সচেতন ভাবে এ কাজটা করে, নিছক কৃতজ্ঞতার বশে। তার সঙ্কল্প এতটাই দৃঢ় ও ব্যাপক ছিল যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতো এবং একটি দুর্ভাগ্যজনক ক্ষেত্রে সে লিওনার একটা প্রস্তাবে বাধা দান করে, সে ভেবেছিল লিওনা বুঝি তার একটা প্রস্তাব বানচাল করতে চাইছে। লিওনা কাসিয়ানি তখন তাকে তার অবস্থাটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

সে ফ্লোরেন্টিনোকে বলেছিল, ‘শোনো, কোন রকম ভুল ভেবো না, তুমি যখনই চাইবে আমি তখনই নিজেকে এসব কাজ থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নেবো, তবে ব্যাপারটা তুমি ভালো করে ভেবে দেখো।’

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আসলে এটা নিয়ে কখনো ভাবে নি, এখন ভাবলো, যতটা তার পক্ষে সম্ভব, আর তারপর সে তার অস্ত্র সমর্পণ করলো। তার কোম্পানিতে চলছিল বিরামহীন সঙ্কট ও বিশ্রী অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আর সে নিজে ব্যস্ত ছিল তার অক্লান্ত পাখি শিকারির নানা বিপর্যয় আর ফারমিনা ডাজার ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিতিভরা স্বপ্ন নিয়ে, এত সব কিছুর মধ্যে সে যখন প্রেম ও নোংরা কাদামাটি মাখানো যুদ্ধের উত্তাপের মধ্যে ওই তীব্র কৃষ্ণাঙ্গ রমণীর মোহন রূপের মুখোমুখি হত তখন সে আর নিজের ভেতর এক মুহূর্তের শান্তি খুঁজে পেতো না। গোপনে সে অনেক বার আক্ষেপ করেছে, সে দিন অপরাহ্নে ওর সঙ্গে প্রথম দেখার সময় ওকে সে যা ভেবেছিল ও যথার্থই তা কেন হয় নি, তাহলে সে তার ব্যক্তিগত নীতিমালা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে ওর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হত, স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়েও। ওই অপরাহ্ণে ট্রলিগাড়িতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওকে যেরকম দেখেছিল এখনো ও সেই রমণীই আছে, সেই একই পোশাক পরা, প্রবৃত্তিতাড়িত পালিয়ে আসা কোন ক্রীতদাসীর উপযুক্ত পোশাক, মাথায় উদভ্রান্ত পাগড়ি জড়ানো, কানে ও হাতে হাড়ের দুল ও চুড়ি, গলার হার আর হাতের প্রত্যেকটি আঙ্গুলে নকল পাথর বসানো : রাস্তার এক বাঘিনী। তার চালচলনে পরিপক্বতার অপূর্ব আকর্ষণ, তার রমণীয় মাধুর্য আগের চাইতেও উত্তেজক, আর তার আকুল আফ্রিকান শরীর আরো বেশি ঘন বিন্যস্ত হয়ে উঠছিলো। দশ বছরের মধ্যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে কোন প্রস্তাব বা ইঙ্গিত দেয় নি, প্রথমে সে যে নিদারুণ ভুল করেছিল তার জন্য সে কঠোর প্রায়শ্চিত্ত করেছে, আর লিওনা এই একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর সব ব্যাপারে তাকে অকৃপণ সাহায্য দান করেছে।

একদিন সে অনেক রাত পর্যন্ত তার আপিসে বসে কাজ করছিল, মা মারা যাবার পর প্রায়ই এরকম করতো। সেদিন বেরিয়ে যাবার পথে লিওনা কাসিয়ানির আপিসে আলো জ্বলতে দেখে টোকা না দিয়েই সে তার ঘরের দরজাটা খুললো : লিওনা একা নিমগ্ন চিত্তে গাম্ভীর্য সহকারে কাজ করে চলেছে, নতুন চশমা নেয়ার জন্য তার চেহারায় একটা শিক্ষায়তনিক ভাব ফুটে উঠেছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একটা সানন্দ ভয়ের অনুভূতি নিয়ে উপলব্ধি করলো যে ভবনটিতে এখন তারা দুজন একা, জাহাজঘাটা জনশূন্য, সমগ্র শহর নিদ্রামগ্ন, কালো সাগরের ওপর অনন্ত রাত্রি, দূরে একটা জাহাজের বিষণ্ণ ভেঁপু শোনা যাচ্ছে, ঘাটে ভিড়তে এখনো এক ঘণ্টা দেরি হবে। অনেক দিন আগে তৈল প্রদীপ গলিতে সে যেভাবে ওর পথরুদ্ধ করে তার ছাতার ওপর দু’হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল আজও ঠিক সেই ভাবে দাঁড়ালো, তবে এখন সে তা করলো তার হাঁটুর কাঁপুনি লুকাবার জন্য।

ফ্লোরেন্টিনো বললো, “হে আমার আত্মার বাঘিনী কন্যা, এবার বলুন কখন আমরা এসব বন্ধ করবো।

ও কোন রকম বিস্ময় প্রকাশ না করে, নিশ্ছিদ্র আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে, চোখ থেকে তার চশমা খুলে, তার সূর্যের মতো হাসি দিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। তারপর প্রথম বারের মতো ঘরোয়া ভঙ্গিতে তাকে সম্বোধন করে বললো, ‘হ্যাঁ, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, কখন তুমি এ প্রশ্নটা করবে তার জন্য আমি দশ বছর ধরে এখানে অপেক্ষা করে বসে আছি।’

বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল : তার দিক থেকে সুযোগ ছিল খচ্চরটানা ট্রলি গাড়িতে, যে-চেয়ারে সে এখন বসে আছে সেখানেও ওই সুযোগটা ছিল সব সময়, কিন্তু এখন তা চিরদিনের জন্য অন্তর্হিত হয়ে গেছে। আসলে ফ্লোরেন্টিনোর উন্নতির জন্য সে বহু নোংরা কূট কৌশল প্রয়োগ করেছে, তার জন্য অনেক কুশ্ৰী লাঞ্ছনা সে সহ্য করেছে, তার ফলে এখন সে জীবনের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, ফ্লোরেন্টিনোর বিশ বয়সের জ্যেষ্ঠতার সুবিধার চাইতে অনেক বেশি দূর। ফ্লোরেন্টিনোর জন্য সে এখন খুব বেশি বুড়ো হয়ে গেছে। সে ওকে এতো বেশি ভালোবাসতো যে তাকে ঠকাবার পরিবর্তে সে নিজের ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ ও অব্যাহত রাখতে চাইলো, যদিও অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবেই ফ্লোরেন্টিনোকে তার কথাটা বলতে হবে। ‘না’, সে বললো, ‘তা হয় না, আমার মনে হবে, যে-পুত্র আমার হয় নি আমি যেন তার শয্যাসঙ্গিনী হচ্ছি।’

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মনের মধ্যে কাঁটার মতো একটা সন্দেহ নিয়ে প্রস্থান করলো। তার মনে হল এটা নিশ্চয়ই লিওনার শেষ কথা নয়। সে মনে করতো মেয়েরা যখন না বলে তখন তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রস্তাবকের কাছ থেকে আরেকটু পীড়াপীড়ি প্রত্যাশা করে, কিন্তু লিওনার ক্ষেত্রে সে দ্বিতীয়বার ভুল করার ঝুঁকি নিতে চায় নি। কোন রকম প্রতিবাদ না জানিয়ে সে পিছু হটে আসে, এক রকম মর্যাদার সঙ্গেই, যা করা তার পক্ষে সহজ ছিল না। ওই রাতের পর তাদের দুজনের মধ্যে যদি কোন মেঘ জমেও থাকে তা তিক্ততা ছাড়াই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অবশেষে বুঝলো যে বিছানায় না নিয়ে গিয়েও একটি মেয়ের বন্ধু হওয়া সম্ভব।

লিওনা কাসিয়ানি ছিল একমাত্র মানুষ যার কাছে ফারমিনা ডাজার প্রতি তার গোপন ভালোবাসার কথা বলার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজার লোভ হয়। যে অল্প কয়েকজন ব্যক্তি একথা জানতো তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে সে কথা ভুলে যেতে শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে তিন জন যে এখন মাটির নিচে কবরে শায়িত সে সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই : তার মা, যিনি মৃত্যুর বেশ আগেই তাঁর স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন; গালা প্লাসিডিয়া, যিনি তার মাকে মেয়ের মতো দেখতেন এবং যার সেবায় সারা জীবন কাটিয়ে যিনি বুড়ো হয়ে মারা যান; এবং অবিস্মরণীয় এস্কোলাস্টিকা ডাজা, যিনি তাঁর প্রার্থনা-পুস্তিকার মধ্যে লুকিয়ে তার জীবনে প্রথম প্রাপ্ত প্রেমপত্রটি তাকে এনে দিয়েছিলেন, এত বছর পরে এখন যিনি নিশ্চিতভাবেই আর বেঁচে নাই। লোরেঞ্জা ডাজা (তিনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন কেউ জানে না) হয়তো ফারমিনা ডাজার স্কুল থেকে বহিষ্কারাদেশ বন্ধ করার চেষ্টায় যখন সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজের সঙ্গে দেখা করেন তখন কথাটা তাঁকে বলতে পারেন, তবে সেটা আর বেশি দূর ছড়াবার সম্ভাবনা ছিল খুব কম। বাকি থাকলো হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজের প্রদেশের এগারো জন টেলিগ্রাফ কর্মী, যারা পুরো নাম ও নির্ভুল ঠিকানাসহ টেলিগ্রামগুলি গ্রহণ ও প্রেরণ করেছিল, আর হিল্ডাব্রান্ড সাঞ্চেজ নিজে এবং তার দুর্দমনীয় কাজিনকুল।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার যা জানা ছিল না তা এই যে ওই তালিকায় ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর নামও তার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। প্রথম বছরগুলিতে হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ মাঝে মাঝেই ওদের ওখানে বেড়াতে আসতো, তখন সেই ওই গোপন কথাটা ডাক্তারকে বলেছিল। কিন্তু তার বলার ভঙ্গি ছিল এমনই খাপছাড়া এবং সে বলেও ছিল এমনই অসময়োচিত মুহূর্তে যে ও মনে করেছিল কথাটা ডাক্তারের এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যাবে, প্রকৃতপক্ষে কিন্তু কথাটা ডাক্তারের কানে আদপে ঢোকে নি। হিল্ডাব্রান্ডা উল্লেখ করেছিল যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে, এবং তার বিবেচনায় এবারকার কবিতা উৎসবে সে হয়তো পুরস্কৃত হবে। ডাক্তার উরবিনো লোকটা যে কে তা মনে করতে পারেন নি, তখন হিল্ডাব্রান্ডা তাকে বলেছিল- বলার কোন দরকার ছিল না- তবে কোন রকম বিদ্বেষের ভাব ছিল না তার কথায়, বলেছিল যে ফারমিনা ডাজার প্রাক-বিবাহ কালে সেই ছিল তার একমাত্র প্রেমিক। হিল্ডাব্রান্ডার চোখে ব্যাপারটা ছিল নিষ্পাপ, ক্ষণস্থায়ী, ঈষৎ মর্মস্পর্শীও। ডাক্তার উরবিনো তার দিকে চোখ না তুলে শুধু বলেছিলেন, ‘লোকটা যে কবি তা আমার জানা ছিল না।’ তিনি তখনই তাঁর স্মৃতি থেকে তাকে মুছে ফেলে দিয়েছিলেন, কারণ ওই সময়, অনেক কিছুর মধ্যে, তাঁর পেশা তাঁকে বিস্মৃতির নৈতিক ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত করে তুলেছিল।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লক্ষ করেছিল যে তার গোপন কথাটি সংরক্ষিত আছে ফারমিনা ডাজার জগতে। ফ্লোরেন্টিনো এর দুর্বহ ভার একাকী আর বহন করতে পারছিল না, কারো কাছে কথাটা বলার জন্য সে অস্থির হয়ে ওঠে, কিন্তু তার ওই গোপন কথা দিয়ে বিশ্বাস করার মতো উপযুক্ত মানুষ সে এতদিন পায় নি। এবার মনে হল লিওনা কাসিয়ানিই হতে পারে সেই মানুষ, এখন শুধু একটা সুযোগ ও উপায় চাই। সেদিন গ্রীষ্মের উত্তপ্ত অপরাহ্ণে তার অফিস ঘরে বসে সে যখন এসব কথা ভাবছিল তখন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো আর.সি.সি.-র খাড়া সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসছিলেন, বিকাল তিনটার প্রচণ্ড গরমে কাবু না হবার জন্য প্রতি সিঁড়িতে তিনি একটু থামছিলেন, তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলেন, হাঁপাচ্ছেন তখন, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, একেবারে প্যান্টের পা অবধি, একটা ভারি নিঃশ্বাস ফেলে তিনি কোন রকমে উচ্চারণ করলেন, ‘আমার মনে হয় ঝড় আসছে।’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওঁকে অনেকবার দেখেছে, কাকা দ্বাদশ লিওর খোঁজে করেছেন তিনি, কিন্তু আজ এই অনাহূত অতিথিকে এখানে দেখার আগে সে কখনো উপলব্ধি করে নি তিনি তার জীবনের সঙ্গে কতোখানি জড়িয়ে আছেন।

ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো এই সময়ে তাঁর পেশাগত অসুবিধাগুলি সুষ্ঠুভাবে কাটিয়ে উঠেছিলেন। এখন তিনি তাঁর সাংস্কৃতিক উদ্যোগগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য টুপি হাতে ভিখারির মতো দুয়ারে দুয়ারে হাজির হচ্ছিলেন। কাকা দ্বাদশ লিও সর্বদাই তাঁর একজন বিশ্বস্ত ও উদার সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করতেন, কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি তাঁর টেবিলের পাশের আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসে তাঁর দৈনন্দিন দশ মিনিটের দিবানিদ্রা শুরু করেছিলেন। ফ্লোরেন্টিনোর ঘর ছিল কাকা দ্বাদশ লিওর ঘরের পাশেই, এক হিসাবে এটা কাকার সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থীর অপেক্ষা করার ঘর হিসাবেও ব্যবহৃত হত। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে তার ঘরে অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলো।

এর আগেও বিভিন্ন জায়গায় তাদের দেখা হয়েছে কিন্তু এখনকার মতো মুখোমুখি সাক্ষাৎ তাদের কখনো হয় নি। এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আবারো অনুভব করলো যে সে ওঁর চাইতে নিকৃষ্ট এবং এই বোধ তাকে মর্মান্তিক ভাবে পীড়িত করলো। দশ মিনিট তার কাছে মনে হল অনন্তকাল, সে এর মধ্যে তিনবার উঠে দাঁড়িয়েছে, তার আশা ছিল কাকা বোধ হয় আজ আগেই তাঁর দিবানিদ্রা থেকে জেগে উঠবেন, গোটা এক থার্মস কালো কফি সে শেষ করে ফেললো। ডাক্তার উরবিনো এক পেয়ালাও খেলেন না, বললেন ‘কফি হলো বিষ’, তারপর তিনি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গিয়ে কথা বলে বললেন, কেউ তাঁর কথা শুনছে কিনা সেদিকে দৃকপাতও করলেন না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা লক্ষ করলো তাঁর স্বাভাবিক স্বাতন্ত্র্য, তাঁর নিখুঁত শব্দ চয়ন ও সাবলীল বাচন ভঙ্গি, তাঁর মৃদু কপূরের গন্ধ, তাঁর ব্যক্তিগত মাধুর্য, নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়ও চমৎকার ভাবে বলার ক্ষমতা, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে এই সব কিছু অসহনীয় হয়ে উঠলো। তারপর, কোন রকম সতর্ক-সঙ্কেত ছাড়াই ডাক্তার হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি সঙ্গীত ভালোবাসেন?’

হঠাৎ এরকম প্রশ্নের জন্য ফ্লোরেন্টিনো প্রস্তুত ছিল না। আসলে শহরে যত কনসার্ট ও অপেরা পরিবেশিত হত তার প্রত্যেকটিতে সে উপস্থিত থাকতো, কিন্তু সঙ্গীত বিষয়ে সমালোচনামূলক কিংবা বিজ্ঞ কোন আলোচনায় অংশগ্রহণের যোগ্য বলে সে নিজেকে মনে করলো না। জনপ্রিয় সঙ্গীতের প্রতি তার একটা বিশেষ দুর্বলতা ছিল, বিশেষ ভাবে ভাবালুতা পূর্ণ ওয়ালটজ সম্পর্কে, নিজের কৈশোর জীবনে সে নিজে যেসব গান লিখতো কিংবা লুকিয়ে লুকিয়ে যেসব কবিতা রচনা করতো তার সঙ্গে ওই সব গানের মিল ছিল অনস্বীকার্য। ওই সব গান ও সুর একবার শুনলেই তা তার মাথার মধ্যে স্থায়ীভাবে ঢুকে যেতো, পৃথিবীর কোন শক্তির সাধ্য ছিল না তাকে সেখান থেকে অপসারণ করে। কিন্তু একজন বিশেষজ্ঞের একটা রাশভারি প্রশ্নের এরকম উত্তর দেয়া যায় না।

সে শুধু বললো, ‘আমি গার্ডেলকে পছন্দ করি।’

ডাক্তার উরবিনো বুঝলেন। ‘হ্যাঁ, ও বেশ জনপ্রিয়’, মন্তব্য করলেন তিনি। তারপর তিনি তাঁর নানা নতুন পরিকল্পনার কথা বলতে লাগলেন। আগের মতোই সরকারি সাহায্য ছাড়াই তাঁকে সেসব বাস্তবায়িত করতে হবে। গত শতাব্দির চমৎকার গান-বাজনার জায়গায় বর্তমানের হতাশাব্যঞ্জক অনুষ্ঠানগুলির প্রতি তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন। কথাটা সত্য : তিনি ‘নাটকীয় থিয়েটারে’ অত্যন্ত গুণী কর্তোত-কামাল-থিবো ত্রয়ী শিল্পীকে আনবার জন্য এক বছর ধরে চাঁদা তোলেন, আর সরকারি কর্মকর্তারা ওদের নামই শোনে নি। একদিকে এই অবস্থা, অন্যদিকে এ মাসেই র‍্যামান কারাল্ট কোহানি কর্তৃক পরিবেশিত গোয়েন্দা নাটক, ডন ম্যানোলা ডি লা প্রেস-এর অপেরাট্টা ও জারজুয়েলা কোম্পানির অনুষ্ঠান, অনির্বচনীয় অনুকরণ ও জাদুশিল্পীদের কীর্তিকলাপ, মঞ্চে চোখের পলকে পোশাক পাল্টাবার খেলা, ফোলি-বার্জারের প্রাক্তন নৃত্যশিল্পী রূপে প্রচারিত ডানি দালতেঁইর নৃত্যানুষ্ঠান, এমনকি বাস্ক-এর উন্মাদ জঘন্য উরসুসের একরোখা ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই দেখার জন্য ও সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে, একটি আসনও খালি নাই। তবে অভিযোগ করবার কোন কারণ নাই। আমরা গত অর্ধশতকে নয়টি গৃহযুদ্ধের পর শান্তিতে বাস করতে শুরু করেছি, আর ইউরোপ এই সময়ে একটা বর্বর যুদ্ধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। অবশ্য, সত্যি কথা বলতে হলে, আমাদের ওই সব যুদ্ধই ছিল একটা যুদ্ধ, এবং সর্বদা তা ছিল এই যুদ্ধ। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর এই জটিল কৌতূহলোদ্দীপক বক্তৃতার মধ্যে একটা জিনিসই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ডাক্তারের অতীতের নানা কর্মোদ্যোগের মধ্যে সব চাইতে বিখ্যাত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল তাঁর কবিতা উৎসবের পুনরুজীবনের উদ্যোগ। ফ্লোরেন্টিনো ডাক্তারের কথার মধ্যে তার নতুন সম্ভাবনা দেখলো। তার ভীষণ ইচ্ছা করছিল যে সে তাঁকে জানায় যে ওই উৎসবের গোড়ার দিকে সেই ছিল তার একজন অন্যতম উৎসাহী ও নিষ্ঠাবান অংশগ্রহণকারী, ওই বার্ষিক প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত শুধু তাদের দেশের নয়, সমগ্র ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিখ্যাত কবিদের আকৃষ্ট করেছিল। অনেক কষ্টে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একথা বলা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখে।

ডাক্তার তাঁর কথা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ তাতানো ভাঁপানো গরম বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে আসে, এলোমেলো ঝড়ো বাতাসের ঝাপ্টায় ঘরের দরজা জানালাগুলি কেঁপে উঠে, অফিস বাড়িটা যেন তার ভিত পর্যন্ত কঁকিয়ে উঠলো, মনে হল ওটা যেন দিকহারা হয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে চলা একটা জাহাজ। ডাক্তার, মনে হল, এটা লক্ষই করলেন না, তিনি জুলাই মাসের পাগলা ঝড় সম্পর্কে একটা অমনোযোগী মন্তব্য করলেন, তারপর বলা নেই কওয়া নেই, অকস্মাৎ তাঁর স্ত্রীর কথা বলতে শুরু করলেন। স্ত্রীকে তিনি তাঁর সব চাইতে উৎসাহী সহযোগী বলেই মনে করতেন না, সে ছিল তাঁর সকল প্রয়াসের অন্তরাত্মা। ডাক্তার জানালেন, ‘ও ছাড়া আমি কিছুই হতাম না।’ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা পাথরের মতো মুখ করে তাঁর কথা শুনলো, মাঝে মাঝে একটু মাথা নেড়ে তাঁর কথায় সায় দিল, পাছে তার গলার স্বর তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই ভয়ে কোন কথা বলতে সাহস পেলো না। ডাক্তার আরো দু’একটি বাক্য উচ্চারণ করার পরই ফ্লোরেন্টিনো নিঃসংশয়ে বুঝতে পারলো যে তাঁর অজস্র কাজের মধ্যেও এখনো স্ত্রীকে ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট সময় তাঁর হাতে থাকে, আর তিনি তাকে ভালোবাসেন সে নিজে ওকে যতখানি ভালোবাসে প্রায় ততখানিই, আর এই উপলব্ধি ফ্লোরেন্টিনোকে বিবশ করে দিলো। সে একটা মনের মতো উত্তর দিতে চাইলো কিন্তু পারলো না, কারণ ওই মুহূর্তে মানুষের হৃদয় মাঝে মাঝে যে রকম বারবনিতাসুলভ চালাকি করে তার হৃদয়ও তার সঙ্গে তাই করলো : এই লোকটি, যাকে সে সর্বদা তার একান্ত ব্যক্তিগত শত্রু বলে বিবেচনা করে এসেছে, আসলে এই লোকটি আর সে উভয়েই একই নিয়তির বলি, উভয়েই একই তীব্র অনুরাগের অংশীদার, এক জোয়ালে বাঁধা দুটি পশু। অন্তহীন সাতাশ বছর ধরে সে যে জিনিসটার জন্য অপেক্ষা করছিলো এই প্রথম বার তার মনে হল যে সে ওই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না, ফ্লোরেন্টিনোর সুখের জন্য এই চমৎকার মানুষটিকে মরতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *