প্রেম ও কলেরা – ১১

১১

পারীকে কেন্দ্র করে তারা ইউরোপে সময় কাটাল, মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে বেড়াতে গেল। ওই সময়ে তাঁরা প্রতিদিন সঙ্গম করেছে, শীতের রবিবারগুলিতে একাধিকবার, তখন তাঁরা দুপুরের খাওয়ার আগ পর্যন্ত শয্যায় হুটোপুটি করতো। ডাক্তার ছিলেন প্রবল আবেগ-অনুভূতির মানুষ, তাছাড়া তিনি ছিলেন নিয়ম- শৃঙ্খলার অনুবর্তী, ওদিকে ফারমিনা ডাজাও কাউকেই তার ওপর কর্তৃত্ব করতে দিতে রাজি ছিল না, তাই শয্যায় তারা ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিল। তিন মাস প্রচণ্ড দাম্পত্য মিলনের পর ডাক্তারের মনে হল যে তাদের দুজনের একজন নিশ্চয়ই বন্ধ্যা, তখন দুজনেই, নিজেদের কঠোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করালে গল পেট্রিয়ার হাসপাতালে, যেখানে উরবিনো এক সময় ইন্টার্নি ডাক্তার হিসাবে কাজ করেছিলেন, কিন্তু কোন ফল হল না। তারপর, যখন কেউই কিছু প্রত্যাশা করে নি তখন, কোন রকম বৈজ্ঞানিক হস্ত ক্ষেপ ছাড়াই, অলৌকিক ঘটনাটি ঘটলো। দেশে ফেরার সময় ফারমিনাকে দেখা গেল ছ’মাসের গর্ভবতী, আর নিজেকে তার মনে হলো পৃথিবীর সব চাইতে সুখী রমণী। তাদের অতি কামনার ধন শিশুটি নির্বিঘ্নে জন্ম নিল, কুম্ভরাশির চিহ্ন নিয়ে। তার নামকরণ করা হল পিতামহের নামে, যিনি মারা গিয়েছিলেন কলেরা হয়ে।

ইউরোপ না প্রেম, কোনটা তাদের রূপান্তরিত করে দিয়েছিল সেটা বলা ছিল অসম্ভব, কারণ দুটোই ঘটে একই সময়ে। ব্যাপরটা শুধু তাদের দুজনের মধ্যে সীমিত ছিল না, তার প্রভাব পড়ে সর্বত্র। তাদের প্রত্যাবর্তনের দু’সপ্তাহ পরে তার দুর্ভাগ্যের ওই রবিবারে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন ওদেরকে গির্জা থেকে উপাসনার শেষে বেরুতে দেখে তখন সেও সেটা লক্ষ্য করে। তাঁরা জীবনের এক নতুন ধারণা নিয়ে ফিরে এসেছেন। তারা তাঁদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন দুনিয়ার আধুনিকতম প্রবণতাসমূহ, নেতৃত্ব দানের জন্য তৈরি হয়ে এসেছেন তাঁরা; সাহিত্য, সঙ্গীত, বিশেষ করে তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিকতম অগ্রগতির সঙ্গে সুপরিচিত হয়ে ফিরে এসেছেন ডাক্তার। তিনি লা ফিগারো পত্রিকার চাঁদা দিয়ে এসেছেন, কারণ বাস্তবতার সঙ্গে যোগসূত্র তিনি হারাতে চান নি, রেভ্যু দ্য ডু মঁদ-এর গ্রাহক হয়ে এসেছেন তিনি, যেন কবিতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে না যায়। তাছাড়া তিনি তাঁর পারীর গ্রন্থবিক্রেতার সাথে ব্যবস্থা করে এসেছেন, সে তাঁকে সমকালের সর্বাধিক পঠিত লেখকদের বই পাঠিয়ে দেবে, যেমন আনাতোল ফ্রাঁস ও পিয়ের লোতির, আর তাঁর বিশেষ প্রিয় লেখক রেমি দ্য গুরমঁ আর পল বুর্গের বই, কিন্তু কোন অবস্থাতেই, দ্রেফ্যুস ঘটনায় তাঁর সাহসী হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও, এমিল জোলার কোনো বই যেন তাঁকে পাঠানো না হয়, কারণ জোলার বই তাঁর কাছে অসহনীয় মনে হত। ওই একই গ্রন্থবিক্রেতা তাঁকে ডাকযোগে রিকোর্ডির ক্যাটালগ থেকে সব চাইতে আকর্ষণীয় গানের স্বরলিপি, বিশেষ করে চ্যাম্বার মিউজিক, পাঠিয়ে দিতে রাজি হয়, যেন তাঁর পিতা এ শহরের কনসার্টের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু বলে যে সুঅর্জিত পদবি লাভ করেছিলেন তিনি তা রক্ষা করতে পারেন।

ফারমিনা ডাজা কিন্তু সমকালীন ফ্যাশানকে বিশেষ সুনজরে দেখত না। সে ফিরে এলো বিভিন্ন যুগের ছয় ট্রাঙ্ক ভর্তি কাপড় জামা নিয়ে। খ্যাতনামা দোকানের লেবেল দ্বারা সে প্রভাবিত হল না। ওয়ার্থ নামের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান মধ্য-শীতে তাদের সংগ্রহ বাজারে এনেছিল, সে তা দেখতে ট্যুইলেরিসে যায়, কিন্তু কেতাদুরস্তদের ওই জমায়েত থেকে সে নিয়ে আসে শুধু ব্রঙ্কাইটিস, যার জন্য পাঁচ দিন তাকে শয্যাশায়ী থাকতে হয়। লা ফেরিয়ারকে তার কম জাঁক-দেখানো ও সর্বগ্রাসী বলে মনে হয়, কিন্তু সেখানেও সে তার সর্বাধিক পছন্দের জিনিসগুলি সেকেন্ডহ্যান্ড দোকান-পাট থেকেই কেনে, যদিও তার স্বামী হতাশার সঙ্গে মন্তব্য করেন যে এসব তো মরা মানুষের জামা- কাপড়। একই ভাবে, কোনো বিখ্যাত ব্র্যান্ড-নাম নেই এমন একগাদা ইতালীয় জুতা নিয়ে সে দেশে ফেরে, বিখ্যাত ফেরির নামজাদা জুতার চাইতে ওইগুলিই তার বেশি পছন্দ হয়, আর দুপ্যুই থেকে নরকের মতো আগুন-লাল একটা ছাতা সে কিনে নিয়ে আসে, যা সামাজিক ঐতিহাসিকদের রীতিমত শঙ্কিত করে তুলেছিল এবং যে বিষয়ে তারা পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখিও করেছিল। মাদাম রেব্য থেকে সে মাত্র একটা হ্যাট কেনে, পক্ষান্তরে সে যেসব হ্যাট দিয়ে তার ট্রাঙ্ক ভর্তি করে ফেলেছিল তাদের গায়ে লাগানো ছিল পত্রপল্লব দিয়ে সাজানো চেরি ফুলের গুচ্ছ, পশমের তৈরি বিভিন্ন রকমের ফুল, উটপাখির পালক, ময়ূরের ঝুঁটি, এশীয় মোরগের পুচ্ছ, একটা গোটা ফেজেন্ট পাখি, হামিংবার্ড, অসংখ্য বিদেশী বর্ণাঢ্য পাখি, কেউ উড়ে যাচ্ছে, কেউ ডাকছে, কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে : হ্যাটের চেহারায় নতুনত্ব আনার জন্য গত বিশ বছরে যা করা হয়েছে সব কিছুই ফারমিনা সংগ্রহ করে ফেলে। পৃথিবীর সকল দেশের সংখ্যাহীন পাখা সে নিয়ে আসে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের পাখা। চ্যারিটি বাজারের সুরভি-দোকান থেকে সে অনেক কাছাকাছির পর একটা সেন্ট কিনলো যার গন্ধ মনকে এলোমেলো করে দেয়, কিন্তু সে ওটা মাত্র একবারই ব্যবহার করে, কারণ ওই নতুন গন্ধের মধ্যে সে তার নিজেকে খুঁজে পায় নি। সে তার সঙ্গে একটা প্রসাধনী-বাক্সও নিয়ে আসে, প্রলোভনের সর্বশেষ অবদান, আর পার্টিতে সে ওটা তার সঙ্গে নিয়ে যেতো, যে সময়ে জনসমক্ষে নিজের মেক-আপ পরীক্ষা করার মতো সাধারণ ব্যাপারকেও অশালীন বিবেচনা করা হত।

তাছাড়া তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে আসে তিনটি অক্ষয় স্মৃতি : পারীতে দি টেইলস অব হফম্যানের অপূর্ব উদ্বোধন, ভেনিসে সেইন্ট মার্ক চত্বর সংলগ্ন গণ্ডোলাগুলির ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যাওয়া, তাদের হোটেলের জানালা দিয়ে তারা ওই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখেছিল, আর জানুয়ারির প্রথম তুষারপাতের সময় চকিত একঝলকের জন্য অস্কার ওয়াইল্ডকে দেখতে পাওয়া। কিন্তু এই সব এবং আরো অনেক স্মৃতির মধ্যে তিনি যে তার একটা পুরনো স্মৃতি স্ত্রীর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলেন না তা তাঁকে চিরদিন দুঃখ দেয়। তিনি তখন পারীতে বি.এ. ক্লাসের ছাত্র। তাঁর ওই স্মৃতি ছিল ভিক্তর হিউগোর। আমাদের এখানে তাঁর আবেগপূর্ণ খ্যাতির সঙ্গে তাঁর বইপত্রের কোন সম্পর্ক ছিল না, তার মূলে ছিল অন্য একটা জিনিস। তিনি নাকি বলেছিলেন, যদিও কেউ তাকে প্রকৃতই ওই কথা বলতে শোনে নি, আমাদের শাসনতন্ত্র কোনো মনুষ্যকুলের জন্য নয়, এটা হল দেবদূতদের জন্য। সেই থেকে তাঁর প্রতি আমরা বিশেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আসছি। আমাদের কোন স্বদেশবাসী ফ্রান্সে এলে খেয়াল করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। একটা সময় অ্যাভিনিউ ইলাউ-এ তাঁর বাসভবনের সামনে জনা ছয়েক ছাত্র প্রহরী হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকতো, জুভেনাল উরবিনো ছিলেন তাদের একজন। যে-ক্যাফেতে তিনি নিয়মিত আসতেন বলে শোনা গিয়েছিল তার সামনেও ওই ছাত্রদল দাঁড়িয়ে থাকতো, যদিও তাঁকে কখনো সেখানে যেতে দেখা যায় নি। অবশেষে রিওনিগ্রোর সংবিধানের দেবদূতদের নামে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে একটি লিখিত অনুরোধপত্র পাঠানো হয়, কিন্তু তার কোন উত্তর তারা কখনো পায় নি। এই সময় একদিন জুভেনাল উরবিনো হঠাৎ তাঁকে দেখতে পেল। জুভেনাল উরবিনো তখন লুক্সেমবুর্গ উদ্যান অতিক্রম করছিল, সে ভিক্তর হিউগোকে সিনেট ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলো, এক তরুণী তাঁর বাহুলগ্ন। তাঁকে মনে হল খুব বৃদ্ধ, তাঁর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল, ছবিতে তাঁর চুল-দাড়ি যত উজ্জ্বল দেখায় বাস্তবে তত উজ্জ্বল নয়, পরনে যে ওভারকোট সেটা বেশ ঢোলা, যেন সেটা ছিল তাঁর চাইতে বড়সড়ো কোন ব্যক্তির। জুভেনাল উরবিনো কোন উদ্ধত সম্ভাষণ দ্বারা ওই স্মৃতিকে নষ্ট করতে চায় নি, সে যে তাঁকে দেখতে পেয়েছে ওই অলীক দৃশ্যটি সে তাঁর বাকি জীবনের স্মৃতিতে অটুট করে রাখবে। সে যখন পারীতে আবার আসে, একজন বিবাহিত ব্যক্তি রূপে, এবং আরো একটু আনুষ্ঠানিক পরিবেশে তাঁর সাক্ষাৎ লাভের যোগ্যতা অর্জনের পর, তখন আর ভিক্তর হিউগো এ ধরণীতে বেঁচে নেই।

সান্ত্বনা স্বরূপ, জুভেনাল উরবিনো ও ফারমিনা ডাজা একটা যুগ্ম স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। সেদিন বিকালে বরফ পড়ছিল। ওরা দেখলো কাপুচিন বুলভারের ওপর একটা ছোট বই-এর দোকানের সামনে বেশ ভিড়। তুষার-ঝড় উপেক্ষা করে একটা জনতা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলী হয়ে তারা আবিষ্কার করল যে দোকানের ভেতর অস্কার ওয়াইল্ড আছেন। তিনি যখন বেরিয়ে এলেন, শোভন-সুন্দর ও রুচিশীল, তবে হয়তো একটু আত্মসচেতন, তখন অনেকেই তাদের খাতায় তাঁর অটোগ্রাফ নেবার জন্য এগিয়ে গেল। ডাক্তার উরবিনো শুধু তাঁকে দেখার জন্য দাঁড়িয়েছিল কিন্তু তাঁর উত্তেজনাপ্রবণ স্ত্রী রাস্তা পেরিয়ে অস্কার ওয়াইল্ডের সামনে যেতে চাইলো। তার সঙ্গে কোন খাতা ছিল না, তাই সে ঠিক করলো তার লম্বা, মসৃণ, কোমল, তার নববিবাহিত বধূর ত্বকের মতো হরিণীর চামড়ার দস্তানার ওপর সে ওঁর সই নেবে। ওঁর মতো পরিশীলিত একজন মানুষ নিশ্চয়ই এ প্রস্তাবকে অভিনন্দিত করবে, কিন্তু তার স্বামী দৃঢ়তার সঙ্গে আপত্তি করলেন। ফারমিনা যখন তাঁর যুক্তি ও আপত্তি উপেক্ষা করে যাবার উদ্যোগে নিল তখন অনিবার্য চরম বিব্রতকর অবস্থা তাঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তুমি যদি রাস্তা পেরিয়ে ওখানে যাও তবে ফিরে এসে আমাকে এখানে মৃত দেখতে পাবে।’

তার পক্ষে অনুরূপ আচরণ ছিল স্বাভাবিক। তখনো তার বিয়ের এক বছর পূর্ণ হয় নি, কিন্তু তখনই তার বালিকা বয়সে সে যে রকম আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সান হুয়ান ডি লা সিনেগার মাঠে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতো সেই একই আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তার নতুন জগতে চলাফেরা করতে থাকে, যেন এই পরিবেশেই তার জন্ম হয়েছিল। অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে তার ব্যবহারের স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীলতা দেখে তার স্বামীর মুখে কথা সরতো না। যে কোন মানুষকে, যে কোন জায়গায়, তার নিজের স্প্যানিশ ভাষা বোঝাবার তার একটা রহস্যময় প্রতিভা ছিল। ব্যঙ্গ মেশানো হাসি হেসে সে তার স্বামীকে বলতো, ‘তুমি যখন কিছু বিক্রি করতে চাও তখন ভাষা জানার দরকার হয়, কিন্তু তুমি যদি কিছু কিনতে চাও তখন তোমার ভাষা বুঝবার জন্য যা কিছু করা দরকার বিক্রেতা তাই করবে।’ এত তাড়াতাড়ি এবং এত সানন্দে যে একজন পারীর দৈনন্দিন জীবন আত্মস্থ করতে পারে কারো পক্ষে এটা কল্পনা করাও ছিল কঠিন। বিরামহীন বৃষ্টি সত্ত্বেও সে পারীর স্মৃতির অনুরাগী হয়ে পড়ে। তথাপি, বহু অভিজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে, ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে, গর্ভাবস্থার ঘুমঘুম শরীরে দেশে ফেরার পর, বন্দরে তাকে যখন ইউরোপের আশ্চর্য কীর্তিমালা সম্পর্কে কিছু বলার জন্য প্রথম প্রশ্নটি করা হল তখন সে তার বেশ দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার কথা উচ্চারণ করল ক্যারিবীয়দের একান্ত দেশজ ভঙ্গিতে :

‘তেমন কিছু নয় গো!’

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যেদিন ক্যাথিড্রাল প্রাঙ্গণে ছয় মাসের গর্ভবতী, সাংসারিক সকল কাজকর্ম পরিচালনার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জনকারী, ব্যক্তিত্বময়ী ফারমিনা ডাজাকে দেখলো তখনই সে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার যোগ্য হয়ে উঠবার জন্য সে প্রয়োজনীয় খ্যাতি ও বিত্তের মালিক হবে। ফারমিনা যে বিবাহিত এবং এটা যে একটা প্রতিবন্ধকতা তা সে বিবেচনার মধ্যেই আনলো না। কারণ সে তখনই এই সিদ্ধান্তও নেয়, যেন ব্যাপারটা তার ওপরই নির্ভরশীল, যে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোকে মরতে হবে। কখন এবং কিভাবে, তা সে জানে না, কিন্তু ওই অনিবার্য ঘটনার জন্য সে অধৈর্য না হয়ে, সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে, অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল, দরকার হলে কালের শেষ বিন্দু পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে।

একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলো ফ্লোরেন্টিনো। একদিন সে, আগে কোন খবর না দিয়েই, ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ও বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এর সভাপতি তার কাকা দ্বাদশ লিও-র আপিসে গিয়ে হাজির হল এবং তাঁকে জানালো যে সে কাকার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে রাজি আছে। কাকা তার ওপর চটে ছিলেন। যেভাবে সে ভিলা ডি লেভিয়ার টেলিগ্রাফ অপেরেটবের ভালো চাকরিটা ছুড়ে ফেলে দেয় তা তিনি একটুও পছন্দ করেন নি, কিন্তু তাঁর একটা নিজস্ব দৃঢ় বিশ্বাস তাঁকে নমনীয় করে তোলে। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটা মানুষ যেদিন মাতৃগর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করে শুধু সেদিনই তার জন্ম হয় না, জীবন তাকে বারবার নিজের নতুন জন্মদানে বাধ্য করে। তা ছাড়া গত বছর তাঁর বিধবা ভ্রাতৃবধূর মৃত্যু হয়, আর কোন উত্তরাধিকারীও ছিল না তাঁর। তাই তিনি তাঁর খেয়ালী ভ্রাতুষ্পুত্রকে চাকরিটা দিলেন।

ডন দ্বাদশ লিওর চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। এই হৃদয়হীন ব্যবসায়ীর কঠিন খোসার আড়ালে লুকানো ছিল একটা খোশমেজাজি পাগল, গুয়াজিরা মরুভূমিতে লেমোনেডের একটা ঝর্ণা সৃষ্টি করতে যেমন ইচ্ছুক, তেমনি কারো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হৃদয় বিদারক ভঙ্গিতে ‘ইন কোয়েস্টা টুম্বা অসকিউরা’ পরিবেশন করে সবাইকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে দিতেও তিনি ছিলেন সমান প্রস্তুত। তাঁর মাথা ভর্তি ছিল কোঁকড়ানো চুল, ঠোঁট ছিল বনদেবতার ঠোঁটের মতো, হাতে একটা বীণা আর মাথায় লরেল ফুলের মালা জড়ানো থাকলেই একেবারে আগুন জ্বালানো নিরোর প্রতিমূর্তি হতে পারতেন। তাঁর জরাজীর্ণ জাহাজগুলি নিয়তির নিতান্ত অমনোযোগের কারণে তখনও নদীর বুকে চলাচল করছিল, নৌচালনার ক্ষেত্রে প্রতিদিনই সঙ্কট বাড়ছিল, এসব সম্ভ্রান্ত প্রশাসনিক কাজে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হত, কিন্তু একটু অবসর পেলেই তিনি সেই সময়টুকু ব্যয় করতেন তাঁর সঙ্গীতকলার সম্ভার বৃদ্ধির কাজে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে গান গাইবার চাইতে প্রিয়তর তাঁর কাছে আর কিছুই ছিল না। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল দাস-জাহাজের মাল্লাদের মতো, একটুও প্ৰশিক্ষণপ্রাপ্ত নয় কিন্তু শক্তিশালী, মনে দাগ কাটার মতো। তাঁকে কেউ একজন বলেছিল যে এনরিকো কারুসো নাকি তাঁর প্রবল কণ্ঠস্বর দিয়ে ফুলদানি গুঁড়ো করে ফেলতে পারতেন। কারুসোকে অনুকরণ করার জন্য তিনি বহু বছর চেষ্টা করেন, কিন্তু সফলকাম হতে পারেন নি। তাঁর বন্ধুরা তাদের দুনিয়াব্যাপী সফর থেকে ফিরে আসার সময় তাঁর জন্য অত্যন্ত সুন্দর পাতলা ফুলদানি নিয়ে আসতো, তারা বিশেষ পার্টির ব্যবস্থা করতো, যেন তিনি তাঁর কণ্ঠস্বর দিয়ে ওই সব ফুলদানি চূর্ণ করে তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করতে কোন দিন সফল হন নি। এ সত্ত্বেও তাঁর বজ্রকণ্ঠের মধ্যে কোমলতার এমন একটা উজ্জ্বল ঝিলিক ছিল যে শেষকৃত্যানুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে শ্রোতার বুক ভেঙে যেতো, যেন তাদের হৃদয় ছিল মহান কারুসোর স্ফটিকের ফুলদানি। শুধু একবার একটা ব্যতিক্রম ঘটে। তিনি যখন একটি অনুষ্ঠানে লুইসিয়ানার আবেগময় সঙ্গীত ‘আমি যখন সগৌরবে আবার জেগে উঠবো’ পরিবেশন করতে শুরু করেন গির্জার পুরোহিত তখনই তাঁকে থামিয়ে দেন, কিভাবে তাঁর গির্জায় ওই রকম একটি প্রোসেট্যান্ট বিষয় নিয়ে আসা সম্ভব হল তা তিনি বুঝতেই পারলেন না।

এইভাবে অপেরার গান ও নিয়াপলিটান সেরেনাদ চর্চার ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাঁর সৃজনী প্রতিভা ও অদম্য ব্যবসায়িক উদ্যম দিয়ে নদীপথে নৌযান চলাচলের স্বর্ণযুগের এক বীর নায়ক হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রয়াত ভাইদের মতো তিনিও উঠে এসেছিলেন সম্পূর্ণ কপর্দকহীন অবস্থা থেকে, পিতৃপরিচয়হীন অবৈধ সন্তানের কালিমা সত্ত্বেও, কারো কাছ থেকে পিতৃত্বের স্বীকৃতিও যিনি পান নি। সে যুগে যাদের বলা হত দোকানি অভিজাত এরা ছিল তার শ্রেষ্ঠ সারাংশ। এদের পবিত্র আশ্রয়স্থল ছিল কমার্শিয়াল ক্লাব। তবু, যে রোমান সম্রাটের চেহারার সঙ্গে তাঁর মিল ছিল সেই রোমান সম্রাটের মতো বর্ণাঢ্য বিলাসী জীবনযাপন করবার সব রকম সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাকা দ্বাদশ লিও পুরনো শহরেই বাস করতেন, কারণ সেটা ছিল তাঁর কর্মস্থলের পক্ষে সুবিধাজনক। তিনি এমনই একটা সাধারণ বাড়িতে বাস করতেন এবং এতটাই অনাড়ম্বরতার সঙ্গে যে অন্যায় ভাবে আরোপিত কৃপণের দুর্নাম থেকে তিনি কখনো নিজেকে মুক্ত করতে পারেন নি। তাঁর একমাত্র বিলাসিতা ছিল অত্যন্ত সরল : সমুদ্রের পাশে একটা বাড়ি, তাঁর অফিস থেকে মাইল ছয়েক দূরে। হাতে তৈরি ছ’টি টুল আর মৃন্ময় পাত্র সাজিয়ে রাখার জন্য একটি তাক আছে সেখানে, আর একটা দোলনা, যেখানে শুয়ে শুয়ে রবিবার দিন তিনি আপন মনের ভাবনায় ডুবে থাকতে পারতেন। যখন একজন তাঁকে ধনী বলে অভিযুক্ত করেছিল তখন তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন নিজের সম্পর্কে তার চাইতে ভালো বর্ণনা দেয়া যায় না। তিনি বলেছিলেন, ‘না, ধনী নয়, আমি একজন গরিব মানুষ যার অনেক টাকা আছে। দুটো এক জিনিস নয়।’

তাঁর স্বভাব ও প্রকৃতি ছিল অদ্ভুত। জনৈক বক্তা তাঁর এক ভাষণে সেটাকে প্রশংসা করে স্বচ্ছ পাগলামি বলে অভিহিত করেন। তার বদৌলতেই তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মধ্যে একটা জিনিস দেখতে পান যা আর কেউ দেখতে পায় নি। তার বিষণ্ণ চেহারা ও ছাব্বিশ বছরের নিষ্ফল জীবন নিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যেদিন চাকরির আবেদন নিয়ে প্রথম তাঁর আপিসে আসে সেই দিন থেকেই তিনি সামরিক ট্রেনিং শিবিরের কঠোরতা নিয়ে তাকে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করেছেন। সব চাইতে শক্ত মানুষকেও তা কাবু করে ফেলতে পারতো, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনোর কিছু হল না। তার সাহসের উৎস যে টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তা নয়, উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত নিষ্ঠুর কোন ঔদাসীন্যও নয়, এটা যে ভালোবাসার জন্য এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা, সেটা তার কাকা দ্বাদশ লিও কখনো উপলব্ধি করতে পারেন নি। ওই ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করবার শক্তি এই মরলোকে বা অমর্ত্যলোকে কারো বা কোন কিছুর ছিল না।

তাকে বোর্ড অব ডিরেক্টরদের কেরানি পদে নিযুক্ত করা হয়। ওই পদ যেন তারই জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। তার কাকার এক সময়কার সঙ্গীত শিক্ষক লোটারিও থুগুট তাঁকে বলেছিলেন ওকে যেন কোন একটা লেখার কাজ দেয়া হয়, কারণ ও ছিল সাহিত্যের এক সর্বগ্রাসী পাঠক, যদিও উত্তম গ্রন্থের চাইতে নিকৃষ্ট গ্রন্থের প্রতিই তার আকর্ষণ ছিল বেশি। সাহিত্যে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রের নিম্ন রুচি সম্পর্কে লোটারিও থুগুটের মন্তব্যকে কাকা পাত্তা দিলেন না, কারণ থুগুট তাঁকেও তাঁর গানের ছাত্রদের মধ্যে সব চাইতে খারাপ কণ্ঠস্বরের অধিকারী বলে অভিহিত করতেন যদিও তিনি সমাধি ফলককেও অশ্রুসিক্ত করে তুলতে পারতেন। তবে একটা বিষয়ে লোটারিও যুগুট ঠিক বলেছিলেন, যদিও সেটাকে তিনি কোন গুরুত্ব দেন নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সব কিছু এমন আবেগের সঙ্গে লিখতো যে দাপ্তরিক চিঠিকেও মনে হত প্রেমপত্র। সে ছন্দ এড়াতে চাইলেও তার তৈরি বিল অব লেডিং ছন্দবদ্ধ কবিতা হয়ে উঠতো, আর দৈনন্দিন ব্যবসায়িক চিঠিপত্রের মধ্যে এমন একটা গীতিকবিতার সুর যুক্ত হত যে তার ভেতরে কর্তৃত্বের দিকটি দুর্বল হয়ে পড়তো। একদিন তার কাকা এক গাদা চিঠি নিয়ে স্বয়ং তার আপিসে ঘরে এসে উপস্থিত হলেন, ওই সব চিঠিতে সই দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। তিনি তাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, ‘যদি একটা ব্যবসায়িক চিঠি তুমি লিখতে না পারো তাহলে তোমাকে জাহাজ ঘাটে ময়লা পরিষ্কারের কাজ করতে হবে।’

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলো। যে অধ্যবসায়ের সঙ্গে সে একদা জনপ্রিয় কবিদের রচনাশৈলী অনুকরণের চেষ্টা করেছিল সেই একই অধ্যবসায়ের সঙ্গে সে উকিলের নথির অনুকরণে ব্যবসায়িক গদ্যের একান্ত পার্থিব সরল রচনারীতি আয়ত্ত করার চেষ্টা করল। এই সময়েই সে কলমপেশাজীবিদের চত্বরে তার অবসর সময় কাটাতে শুরু করে, শুল্ক বিষয়ক রিপোর্টে ভালোবাসার যে সব বাক্য ও শব্দাবলী ব্যবহার করে সে তার হৃদয়কে হাল্কা করতে পারতো না এখানে সে অশিক্ষিত প্রেমিকদের তাদের প্রেমিকাদের কাছে চিঠি লেখার কাজে সাহায্য করে সেটা করতে পারলো। কিন্তু তার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ছ’মাসের শেষে দেখা গেল যে ব্যবসায়িক চিঠি লেখার ব্যাপারে সে কিছুই শেখে নি। তখন কাকা দ্বাদশ লিও তাকে দ্বিতীয় বারের মত তিরস্কার করলে সে পরাজয় স্বীকার করে কিছুটা উদ্ধত ভঙ্গিতেই বলল, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর কোন কিছুতেই আমি উৎসাহ পাই না।’ কাকা বললো, ‘কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, নৌ চলাচল বাদ দিলে ভালোবাসাও যে থাকবে না।’

তিনি তাঁর কথা মতো কাজ করলেন, ফ্লোরেন্টিনোকে জাহাজঘাটে ময়লা পরিষ্কারের কাজে লাগিয়ে দিলেন, তবে কথা দিলেন যে বিশ্বস্ত চাকরির ম‍ই দিয়ে তিনি তাকে ধাপে ধাপে পদোন্নতি দেবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার উপযুক্ত স্থানটি খুঁজে পায়। সে তা পেয়েছিল। কোন কাজের সামনে সে হার মানে নি, সে-কাজ যত কঠিন বা যত অপমানজনকই হোক, বেতন যাই হোক, যত কষ্টকর হোক, কিছুই তাকে কাবু করতে পারে নি, আর উপরওয়ালাদের উদ্ধত আচরণের সামনে সে কখনোই তার সহজাত নিৰ্ভীকতা বিসর্জন দেয় নি। তাই বলে সে বোকা ছিল না। গোবেচারী চেহারার আড়ালে সে ছিল অসম্ভব দৃঢ়চেতা, এমন কিছুই ছিল না যা সে করতে পারতো না, তাই কেউ তার অহেতুক বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকে তার মূল্য দিতে হত। কাকা দ্বাদশ লিও যা ভেবেছিলেন তাই ঘটলো। তিনি চেয়েছিলেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র যেন এই ব্যবসায়ের কোন গোপন খুঁটিনাটি সম্পর্কেই অজ্ঞ না থাকে। আর তাই গত ত্রিশ বছরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সর্বপ্রকার প্রতিকূলতা জয় করে, তার স্থির প্রতিজ্ঞা ও নিবেদিতচিত্ততা দিয়ে, ধাপে ধাপে সমস্ত পদ পেরিয়ে উপরে উঠে যায়। সে প্রশংসনীয় দক্ষতার সঙ্গে তার ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পালন করে, যে রহস্যময় জটিলতা কবিতা রচনাকে ঘিরে থাকে সেই রকম জটিলতার জাল সে ছিন্ন করতে সমর্থ হয়, কিন্তু যে সম্মানের সে সব চাইতে বেশি প্রত্যাশী ছিল, একটা, শুধু একটা, গ্রহণযোগ্য ব্যবসায়িক চিঠি লেখা, তার ওই প্রত্যাশা কখনো পূর্ণ হয় নি। ইচ্ছাকৃত ভাবে নয়, এমনকি নিজের অজ্ঞাতেই, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বাবা যে কথা বারবার বলতেন তা ছিল পুরোপুরি সত্য। তিনি বলতেন যে একজন কবির চাইতে বেশি একগুঁয়ে কোন পাথর কাটার শ্রমিক, কোন স্বচ্ছ জ্ঞানসম্পন্ন অথবা বিপজ্জনক ম্যানেজার, কোন সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী মানুষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাবালুতাময় অবসর সময়ে ফ্লোরেন্টিনোর কাকা ফ্লোরেন্টিনোর বাবার কথা বলতে গিয়ে তাকে এ কথাই বলেছিলেন একদিন। এর ফলে যে ছবিটির সৃষ্টি হয় তার সঙ্গে একজন ব্যবসায়ীর চাইতে একজন স্বপ্নদ্রষ্টার সাদৃশ্যই ছিল বেশি

তিনি তাকে বলেন যে পায়াস পঞ্চম লোয়াইজা ব্যবসার কাজের চাইতে অধিকতর আনন্দময় কাজে তাঁর অফিসগুলি ব্যবহার করতেন। প্রত্যেক রবিবার তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন, বলতেন যে কোন একটা জাহাজ যাত্রা করার বা এসে পৌঁছবার সময় তাঁকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে। অধিকন্তু, তিনি তাঁদের গুদামের উঠানে বাষ্পচালিত বাঁশি-সংযোজিত একটা বয়লার বসিয়ে ছিলেন, তাঁর স্ত্রীর কোন রকম সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে টের পেলেই কেউ একজন ওই বাঁশি বাজিয়ে নৌ চলাচলের সঙ্কেত দিতো। কাকা দ্বাদশ লিও-র হিসাব অনুযায়ী তিনি নিশ্চিত যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার মায়ের গর্ভে আসে কোন এক রবিবারের উষ্ণ অপরাহ্ণে, একটি অফিস ঘরে, যখন তার বাবার স্ত্রী নিজের বাড়িতে বসে একটা জাহাজের বন্দর ত্যাগের বিদায় বাঁশি শুনছিলেন, যে-জাহাজ আদপেই কোন দিন ছাড়ে নি। এ খবর যখন ভদ্রমহিলা জানতে পান তখন আর স্বামীকে দোষারোপ করার কোন উপায় ছিল না, কারণ ততদিনে তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পরও তিনি অনেক দিন বেঁচে ছিলেন, নিঃসন্তান হওয়ার তিক্ততা তাঁর জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছিল, তিনি ঈশ্বরের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেন তাঁর স্বামীর জারজ সন্তানের যেন অনন্ত নরকবাস ঘটে।

তার বাবার চিত্র ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বিচলিত করতো। তার মা বাবা সম্পর্কে যা বলতো তা ছিল এই রকম : তিনি ছিলেন একজন মহান মানুষ, কোন বাণিজ্যিক পেশা ছিল না তাঁর বড় ভাই-এর কারণে, যিনি নদী পথে নৌ যান চলাচলের জনক স্বরূপ জার্মান কমোডোর জোহান বি. এলবার্সের একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তাঁরা ভাইরা ছিলেন একই মায়ের অবৈধ সন্তান, কিন্তু তাঁরা জন্মগ্রহণ করেন বিভিন্ন পিতার ঔরসে। মা ছিলেন পেশায় রাঁধুনি, ছেলেদের সবাই গ্রহণ করে মায়ের গোত্রনাম, তাদের আসল নাম দেয়া হয় সন্তদের দিনপঞ্জী দেখে এলোমেলো ভাবে নির্বাচিত কোন একজন পোপের নামে, ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু কাকা দ্বাদশ লিও, তাঁর নাম দেয়া হয় তাঁর জন্মের সময় গদীনসীন পোপের নামে। ফ্লোরেন্টিনো নামটি ছিল তার মাতামহের, অতএব ট্রান্সিটো আরিজার পুত্র তার নামটি লাভ করে পুরো এক প্রজন্মের পোপদের টপকে এসে।

তার বাবা প্রেমের কবিতা লিখতেন। কয়েকটি কবিতার প্রেরণার উৎস ছিল ট্রান্সিটো আরিজা। তিনি যে খাতায় কবিতাগুলি লিখেছিলেন ফ্লোরেন্টিনো সব সময় তা সযত্নে রক্ষা করেছে। খাতার পাতার পাশে পাশে অঙ্কিত ছিল ভগ্ন হৃদয়ের ড্রয়িং। দুটি জিনিস তাকে ভীষণ অবাক করে। একটা হল তার বাবার হাতের লেখার ঢং, হুবহু তার মতো, যদিও সে তার হাতের লেখার ভঙ্গিটি নির্বাচন করে একটা হস্তলিপির বই থেকে, এই ঢংটিই তার সব চাইতে বেশি পছন্দ হয়েছিল। দ্বিতীয়টি হল, ফ্লোরেন্টিনো তার বাবার কবিতার খাতায় একটা লাইন দেখতে পায় যা তার জানা মতে সে নিজে রচনা করেছে, অথচ এখন দেখা যাচ্ছে যে তার জন্মের বহু আগে তার বাবা এ লাইনটি লিখেছিলেন : ‘আমার মৃত্যু যদি প্রেম ছাড়া অন্য কোন কারণে ঘটে তাহলে মরণে তাই হবে আমার একমাত্র দুঃখ।’

সে তার বাবার দুটি ছবিও দেখে। একটা তোলা হয়েছিল সান্টা ফেতে। তখন খুব অল্প বয়স তাঁর, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আলোকচিত্রটি প্রথম দেখার সময় যে বয়সের ছিল তিনি ছিলেন সেই বয়েসী। তাঁর পরনে ছিল একটা ওভারকোট, মনে হচ্ছিল তাঁকে যেন একটা ভল্লুকের খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি একটা পা-ভাঙা মূর্তির পাদস্ত ম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর পাশের ছোট ছেলেটি হচ্ছে কাকা দ্বাদশ লিও, তাঁর মাথায় একজন জাহাজের কাপ্তানের টুপি। অন্য ছবিটিতে তার বাবাকে দেখা যাচ্ছে কতিপয় সৈনিকের সাথে, অসংখ্য যুদ্ধের মধ্যে কোন যুদ্ধে তারা অংশ নিয়েছিল কে জানে, তার বাবার হাতে ছিল সব চাইতে লম্বা রাইফেলটি, তাঁর গোঁফে ছিল বারুদের গন্ধ এবং সে গন্ধ যেন ছবির মধ্য থেকে ভেসে আসছিল। তিনি ছিলেন উদারপন্থী এবং ধর্ম বিশ্বাসে একজন মেসন, তাঁর আর সব ভাইদের মতোই, তবু তিনি তাঁর ছেলেকে স্কুলে পড়াতে চেয়েছিলেন। অন্যরা তার ও তার বাবার মধ্যে যে সাদৃশ্য দেখতো ফ্লোরেন্টিনো তা দেখতে পেতো না, কিন্তু কাকা দ্বাদশ লিওর কথা অনুযায়ী তিনিও তাঁর লেখা দাপ্তরিক চিঠিপত্রে গীতি কবিতার সুরের জন্য তিরস্কৃত হন। যাই হোক ফটোতে কিংবা ফ্লোরেন্টিনোর স্মৃতিতে, কিংবা প্রেম দ্বারা রূপান্তরিত তার মায়ের আঁকা বাবার ছবিতে, কিংবা তাঁর কাকার নিষ্ঠুর কৌতুকজাত না আঁকা বাবার ছবিতে সে তার বাবার সঙ্গে নিজের কোন সাদৃশ্য খুঁজে পায় নি। তবে, বহু বছর পর, একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াবার সময় সে ওই সাদৃশ্য আবিষ্কার করে এবং তখনই সে বুঝতে পারে যে একজন মানুষ যখন দেখে যে সে তার বাবার মতো হয়ে উঠছে কেবল তখনই সে উপলব্ধি করে যে সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।

জানালার সড়কে বাস করাকালীন বাবার কোন স্মৃতি নেই তার। তার মনে হয় একবার বাবা ওখানে রাত কাটিয়েছিলেন, ট্রান্সিটা আরিজার সঙ্গে তাঁর প্রেমপর্বের একেবারে প্রথম দিকে, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনোর জন্মের পর আর ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি এখানে আসেন নি। বহু বছর যাবৎ ফ্লোরেন্টিনোর বৈধ পরিচয়পত্র ছিল একটাই, সেন্ট টাইরার্টিয়াস গির্জার খাতায় লিপিবদ্ধ তার জন্মের সার্টিফিকেট। সেখানে শুধু লেখা ছিল যে সে ট্রান্সিটো আরিজা নাম্নী এক অবিবাহিতা জারজ কন্যার এক জারজ পুত্র। ওই কাগজে তার বাবার নামের কোন উল্লেখ ছিল না, যদিও পঞ্চম পায়াস তাঁর মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত পুত্রের যাবতীয় প্রয়োজন মিটাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তার সামাজিক অবস্থার কারণে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জন্য বিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তবে ওই একই সূত্রে আমাদের গৃহযুদ্ধের সব চাইতে রক্তাক্ত সময়ে সে মিলিটারি সার্ভিস থেকেও অব্যাহতি পায়, কারণ সে ছিল একজন অবিবাহিত রমণীর একমাত্র সন্তান।

প্রতি শুক্রবার স্কুল শেষে সে ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানির আপিসের উল্টো দিকে বসে একটা পশুপাখির ছবির বই দেখতো। বারবার দেখার ফলে বই-র পাতাগুলি প্রায় খুলে পড়ে যেতে বসেছিল। তার বাবা তার দিকে একবারও দৃষ্টিপাত না করে আপিসে ঢুকে যেতেন, তাঁর পরনে থাকতো সেই ফ্রককোট যা পরবর্তী সময়ে ট্রান্সিটো আরিজা তার জন্য কেটে ছোট করে দিয়েছিলেন। তাঁর মুখ ছিল গির্জার বেদির পাশে আঁকা হুবহু ইভাঞ্জেলিস্ট সেন্ট জনের মুখের মতো। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর তিনি যখন অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেন তখন সতর্কতার সঙ্গে চারদিকে দেখে নিতেন, কেউ যেন তাঁকে লক্ষ না করে, এমনকি তাঁর নিজের গাড়ির কোচোয়ানও যেন না দেখে, তারপর তিনি তার হাতে সপ্তাহের খরচের টাকাটা তুলে দিতেন। দুজনের কেউ কোন কথা বলতো না, বাবা যে কথা বলার কোন চেষ্টা করতেন না শুধু সেজন্য নয়, সেও ছিল বাবার ভয়ে প্রচণ্ড ভীত। একদিন স্বাভাবিক সময়ের চাইতে অনেক বেশি সময় তাকে অপেক্ষা করতে হয়। সেদিন বাবা তার হাতে টাকা তুলে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও, তারপর আর এখানে এসো না।

তাঁর সাথে ফ্লোরেন্টিনোর ওই শেষ দেখা। কিন্তু পরে সে জেনেছে যে কাকা দ্বাদশ লিও, যিনি তার বাবার চাইতে বছর দশেকের ছোট ছিলেন, ট্রান্সিটো আরিজাকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসতেন এবং পঞ্চম পায়াসের মৃত্যুর পর তিনিই তার দেখা- শোনা করেন। পঞ্চম পায়াসের মৃত্যু ঘটে পেটের শূল ব্যাধিতে বিনা চিকিৎসায়, মৃত্যুর আগে তিনি কোন কিছুই লিখিত দিয়ে যান নি, একমাত্র পুত্রের সংস্থানের কোন ব্যবস্থা করার সময় পান নি তিনি : সে পরিণত হল রাস্তার ছেলেতে।

ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানিতে কেরানির কাজ করার সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজার নাটকটা ছিল এইখানে যে সে কখনোই গীতিকাব্যিক রচনা এড়াতে পারতো না, কারণ সারাক্ষণ সে ফারমিনা ডাজার কথা ভাবতো এবং তার কথা চিন্তা না করে সে কিছুই লিখতে পারতো না। পরে, সে যখন অন্য পদে চাকরিরত, তখন সে তার মধ্যে প্রেম এত বেশি সঞ্চিত হয়ে গেছে দেখতে পেল যে তা নিয়ে কী করবে ভেবে পেলো না। আর তখনই সে, বিনা পারিশ্রমিকে, নিরক্ষর প্রেমিকদের হয়ে তাদের প্রেমপত্র লিখে দেবার জন্য মসীজীবিদের চত্বরে যেতে শুরু করে। দিনের কাজের শেষে সে ওখানে গিয়ে উপস্থিত হত। সে সযত্নে তার ফ্রককোট খুলে চেয়ারের পেছনে ঝুলিয়ে রাখতো, শার্টের হাত গুটিয়ে নিতো যেন ময়লা না হয়ে যায়, চিন্তার স্বচ্ছতার জন্য কোটের বোতাম খুলে দিতো, আর উন্মত্ত প্রেমের কথা লিখে হতাশ প্রেমিকদের উৎসাহিত করার জন্য সে মাঝে মাঝে সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত থাকতো। কখনো সেখানে কোন দরিদ্র রমণী তার পুত্রের কোন সমস্যা নিয়ে তার কাছে আসতো, কোন বয়স্ক প্রাক্তন সৈনিক তার অবসর ভাতার আবেদন করার জন্য আসতো, টাকা চুরি হয়ে গেছে তার জন্য সরকারের কাছে অভিযোগপত্র লেখাবার জন্য কেউ আসতো, কিন্তু সে ওদের সন্তুষ্ট করতে পারতো না, কারণ বিশ্বাস উৎপাদনে সক্ষম শুধু এক ধরনের চিঠিই সে লিখতে পারতো : প্রেমপত্র। নতুন খদ্দেরদের সে কোন প্রশ্ন পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতো না, তাদের চোখের সাদা অংশের দিকে একপলক তাকিয়েই সে তাদের সমস্যা উপলব্ধি করতো, আর তখন সে পাতার পাতা উদ্দাম প্রেমের বাণী লিপিবদ্ধ করে যেতো, এই লেখার সময় তার অব্যর্থ ফর্মুলা ছিল একটাই, সে ভাবতো যে সে ফারমিনা ডাজাকে লিখছে এবং তার মনে ওই সময় ফারমিনা ডাজা ছাড়া আর কারো স্থান থাকতো না। প্রথম মাসের পর আকুল প্রেমিকদের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাকে আগাম সময়সূচি তৈরি করতে হল।

তার ওই সময়ের সব চাইতে মধুর স্মৃতি ছিল অল্প বয়েসী অত্যন্ত ভীরু একটি মেয়ের, প্রায় বালিকা, সে এই মাত্র একটা অপ্রতিরোধ্য চিঠি পেয়েছে, ফ্লোরেন্টিনোকে তার উত্তর লিখে দিতে বলার সময় সে রীতিমত কাঁপছিলো। চিঠিটা দেখেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বুঝতে পারলো যে গতকাল অপরাহ্নে সেই এই চিঠি লিখে দিয়েছিল। এবার সে তার উত্তর লিখলো, ভিন্ন ভঙ্গিতে, ওই মেয়ের বয়স ও আবেগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে, এবং তার হাতের লেখাও এমন করলো যেন মনে হয় ওটা ওই মেয়ের লেখা। সে বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন ধরনের হাতের লেখা আয়ত্ত করে নিয়েছিল, লেখকের চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। এখন ফ্লোরেন্টিনো কল্পনা করলো, এই অসহায় মেয়েটি তার পাণিপ্রার্থীকে যেরকম ভালোবাসে ফারমিনা ডাজা যদি তাকে সে রকম ভালোবাসতো তাহলে সে কি লিখতো? দু’দিন পরে তাকে আবার ছেলেটির উত্তর লিখে দিতে হল, প্রথম চিঠির হাতের লেখা ও ভঙ্গি এক রেখে, সে চিঠিতে যে রকম প্রেমের কথা লিখেছিল তার পুনরাবৃত্তি করে, যার ফলে সে নিজেই নিজের সঙ্গে একটা উন্মত্ত পত্রালাপে লিপ্ত হয়ে পড়লো। এক মাস পরে ছেলেটি ও মেয়েটি আলাদা ভাবে এসে তাকে ধন্যবাদ জানালো, ছেলেটির চিঠিতে সে যে প্রস্তাব করেছিল তার জন্য, মেয়েটির চিঠিতে সে যে প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল তার জন্য : তারা শিগগিরই বিয়ে করছে।

তাদের প্রথম সন্তানের জন্মের পরই, আকস্মিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে, তারা উপলব্ধি করে যে তাদের দুজনের চিঠি একই লিপিকার লিখে দিয়েছিল, তখন তারা দুজন একসঙ্গে মসীজীবিদের চত্বরে গিয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে তাদের শিশুর ধর্ম- পিতা হবার অনুরোধ জানায়। বাস্তব জীবনে তার স্বপ্নকে এরকম সত্য হয়ে উঠতে দেখে ফ্লোরেন্টিনো আনন্দে এতটা আত্মহার হয়ে গেল যে সময়ের প্রচণ্ড অভাব সত্ত্বেও সে ‘প্রেমিকের নিত্যসঙ্গী’ নামে একটি বই লিখে ফেললো। সে-সময় এ জাতীয় একটি বই বিশ সেন্টাভো দামে রাড়ির দরজায় দরজায় বিক্রি হত। শহরের অর্ধেক মানুষের তা ছিল মুখস্থ। ফ্লোরেন্টিনোর সঙ্কলন ছিল তার চাইতেও ব্যাপক ও কাব্যময়। সে আর ফারমিনা ডাজা যে সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে বলে সে কল্পনা করল তার প্রত্যেকটি সে তার বই-এ তুলে ধরে প্রতিটি পরিস্থিতির জন্য উপযোগী মডেল ও তার বিকল্প পরিবেশন করল। বইটি শেষ হলে দেখা গেল যে সেখানে তিন খণ্ডে কয়েক হাজার চিঠি সঙ্কলিত হয়েছে। কোভারুবিয়াস অভিধানের চাইতে সেটা পূর্ণাঙ্গ হল, কিন্তু শহরের কোন প্রকাশকই সেটা প্রকাশের ঝুঁকি নিতে রাজি হল না। ট্রান্সিটো আরিজা এই রকম একটি উন্মাদ প্রকাশনা প্রকল্পে বিভিন্ন পাত্রে সারা জীবন ধরে তিনি যে সঞ্চয় গড়ে তুলেছেন তা ব্যয় করতে সম্মত হলেন না, তাই ফ্লোরেন্টিনোর ওই রচনা অতীতের আরো কাগজপত্রের সঙ্গে বাড়ির চিলেকোঠায় আশ্রয় পায়। বহু বছর পর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার যখন নিজের টাকা-পয়সা হল তখন সে বইটি প্রকাশ করে, কিন্তু তখন সে দেখলো যে প্রেমপত্রের রীতি প্রায় লোপ পেয়ে গেছে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে তার বেশ কষ্ট হয়েছিল।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন ক্যারিবীয় রিভার কোম্পানিতে কাজ করতে এবং বিনা পারিশ্রমিকে মসীজীবিদের চত্বরে প্রেমপত্র লিখতে শুরু করে তখন তার যৌবনের বন্ধুরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে, ওকে বুঝি আর রক্ষা করা যাবে না। ওরা ঠিকই ধরেছিল। নদী পথে সফর শেষ করে শহরে ফেরার পর, ফারমিনা ডাজার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলার আশায়, সে তখনো কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হত, তাদের সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলতো, নাচেও যেতো, মেয়েদের সঙ্গেও মিশতো, তার মনের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করলো সে। অনেক পরে, কাকা দ্বাদশ লিও তাকে তাঁর আপিসে চাকরি দেয়ার পর, সে আপিসের সহকর্মীদের সঙ্গে কমার্শিয়াল ক্লাবে ডমিনো খেলতে লাগলো, তাদের সঙ্গে নৌ-কোম্পানি ছাড়া আর কোন বিষয় নিয়েই সে আলাপ করতো না এবং পুরো নামে কোম্পানির উল্লেখ না করে সে সর্বদা ব্যবহার করতো তার আদ্যাক্ষর : আর. সি. সি., সে তার খাদ্যাভ্যাসও পাল্টে ফেলল। এ যাবৎ খাওয়ার ব্যাপারে সে ছিল উদাসীন, কোন নিয়ম মানতো না, এখন সে নিয়ম মত খায়, অল্প খায়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে এই ধারা বজায় রাখে : সকালের নাস্তা শুধু বড় এক পেয়ালা কালো কফি, দুপুরের খাবার এক টুকরো মাছ ও সাদা চালের ভাত, রাতে আবার কফি ও এক টুকরো পনীর। সে কালো কফি পান করতো যখন-তখন, যে কোন স্থানে, সব রকম পরিবেশে, দিনে ছোট্ট পেয়ালার ত্রিশ পেয়ালা পর্যন্ত, অপরিশোধিত তেলের মতো একটা পানীয়, যা সে নিজের হাতে বানাতে পছন্দ করতো এবং যা সে সর্বদা একটা ফ্লাস্কে হাতের কাছে রাখতো। প্রেমের সঙ্গে তার মারাত্মক সাক্ষাৎপর্বের আগে সে যে-মানুষ ছিল আবার সেই মানুষ হবার কঠোর সিদ্ধান্ত ও প্রাণান্তকর প্রয়াস সত্ত্বেও সে আর তা হতে পারলো না, সে পরিবর্তিত হল এক ভিন্ন মানুষে।

সত্যি কথা হল, সে আর কখনোই আগের মত হয় নি। ফারমিনা ডাজাকে আবার জয় করা হল তার জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য। এবং, তাড়াতাড়ি হোক কিংবা দেরিতে হোক, সে যে ওই লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহই ছিল না। এটা সে ট্রান্সিটো আরিজাকেও বিশ্বাস করিয়ে ছাড়লো, তার মা যেন তাদের বাড়ি সংস্কারের কাজটা আবার হাতে নেন, ওই অলৌকিক ঘটনাটা ঘটলে বাড়িটা যেন ফারমিনা ডাজাকে অভ্যর্থনা করার জন্য তৈরি থাকে। ‘প্রেমিকের নিত্যসঙ্গী’ প্রকাশের সময় ট্রান্সিটো আরিজার যে মনোভাব ছিল এবার তা হল তার উল্টো রকম, তিনি বাড়িটা কিনেই ফেললেন, তারপর তার ব্যাপক সংস্কারে ব্রতী হলেন। শোবার ঘরের জায়গায় তারা একটা অভ্যর্থনা কক্ষ নির্মাণ করলেন, দোতলায় নির্মাণ করলেন দুটি বড় বড় খোলামেলা ঝলমলে শোবার ঘর, একটা বিবাহিত যুগলের জন্য, অন্যটা তাদের যেসব ছেলেমেয়ে হবে তাদের জন্য, আর যেখানে পুরনো দিনের তামাকের কারখানা ছিল সেখানে তারা তৈরি করলেন একটা বড় গোলাপ বাগান, নানা জাতের গোলাপ দিয়ে, সকাল বেলার অবসর সময়ে ফ্লোরেন্টিনো নিজ হাতে ওই বাগানের দেখাশোনা করতো। অতীতের প্রতি কৃতজ্ঞতার সাক্ষ্য হিসাবে একটা জিনিসই তারা আগের মতো রেখে দিলো : টুকিটাকি জিনিসের ছোট্ট দোকানটা। পেছনের যে ঘরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার দোলনা-শয্যায় ঘুমাতো, পাশের যে টেবিলে তার বই-এর স্তূপ এলোমেলো ছড়ানো থাকতো, তাও ওই ভাবেই পড়ে থাকলো, তবে দোতলার যুগল-শয়নকক্ষ হিসাবে পরিকল্পিত ঘরে ফ্লোরেন্টিনো উঠে গেল, সেখানেই সে থাকতে লাগলো। ওই ঘরই ছিল বাড়ির মধ্যে সব চাইতে বড় ও সব চাইতে বেশি হাওয়া চলাচলের উপযোগী, তার সঙ্গে একটা ঢাকা বারান্দা ছিল, রাতের বেলা সেখানে বসে থাকতে খুব ভালো লাগতো, সমুদ্রের বাতাস আর গোলাপ কুঞ্জের সুগন্ধ ভেসে আসতো, তবে ওই ঘরের মধ্যেই আবার মূর্ত হয়ে উঠতো ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কঠোর তাপস- সুলভ প্রবণতা। ঘরের সাদা চুনকাম করা দেয়াল ছিল রুক্ষ, কোন রকম কারুকাজ ছিল না তার গায়ে, আসবাব বলতে সেখানে ছিল একটা জেলখানার কয়েদিদের খাট, একটা টেবিল, তার ওপর বোতলে বসানো একটা মোমবাতি, একটা পুরনো কাপড়ের আলমারি, আর মুখ-হাত ধোবার জন্য একটা বেসিন ও একটা গামলা!

বাড়ির কাজ শেষ হতে প্রায় তিন বছর লেগে যায়। ওই একই সময়ে নৌ চলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্য ফেঁপে ওঠে, তার ফলে একটা সংক্ষিপ্ত নাগরিক পুনরুজ্জীবনও ঘটে যায়। ঔপনিবেশিক যুগে ঠিক অনুরূপ কারণেই এই শহর তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং এসব কারণেই দুই শতাব্দির বেশিকাল ধরে এটা আমেরিকার প্রবেশদ্বারে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ওই ব্যবসা-বাণিজ্যিক তৎপরতার কালেই এবার ট্রান্সিটো আরিজার আরোগ্যাতীত অসুখের প্রথম উপসর্গগুলি ধরা পড়ে। তাঁর টুকিটাকির দোকানে প্রতিবার আসার সময় তাঁর নিয়মিত খদ্দেরদের আরো বৃদ্ধ, বিবর্ণ ও জীর্ণ দেখালো, জীবনের অর্ধেক সময় তাদের সঙ্গে কারবার করার পরও এখন আর তিনি তাদের চিনতে পারছিলেন না, একজনের জিনিস আরেক জনের জিনিসের সঙ্গে তিনি মিশিয়ে ফেলতে লাগলেন, এবং তাঁর ব্যবসায়ের মতো একটা ব্যবসায়ে এটা ছিল মারাত্মক একটা ব্যাপার, কারণ এখানে তাঁর কিংবা তাঁর খদ্দেরদের সম্মান রক্ষার জন্য কোন কাগজপত্রে সই করা হত না, মুখের কথাই ছিল সব, তাকেই গ্রহণ করা হত অলঙ্ঘনীয় চুক্তি বলে। প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি বুঝি কানে কম শুনছেন কিন্তু অল্প কালের মধ্যেই তাঁর স্মৃতি শক্তির অবক্ষয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে হয়ে উঠল। তখন তিনি তাঁর বন্ধকি কারবার তুলে দিলেন। বিভিন্ন পাত্রে জমানো ঐশ্বর্যরাশি দিয়ে তিনি বাড়ির সংস্কার কাজ সম্পন্ন করলেন, উপযুক্ত আসবাবপত্র দিয়ে সেটা সাজালেন, তারপরও এই শহরের সব চাইতে দামি গহনাপাতির অনেকগুলিই তাঁর ভাণ্ডারে থেকে যায়, তার মালিকদের পক্ষে টাকা দিয়ে সে সব ছাড়াবার সামর্থ্য ছিল না।

তার জীবনের এই পর্বে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে একই সময়ে বড় বেশি কাজ করতে হয়, কিন্তু গোপন শিকারি হিসাবে তার কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করার ব্যাপারে তার উদ্যমে কখনো ঘাটতি পড়ে নি। বিধবা নাজারেতের সঙ্গে তার অনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা তার সামনে পথের প্রেমের দরজা খুলে দিয়েছিল, বেশ কয়েক বছর ধরে সে রাতের পরিত্যক্ত ক্ষুদে পাখিদের শিকার করে বেড়ায়, তখনো তার আশা যে এভাবেই সে ফারমিনা ডাজার ব্যথা-বেদনার হাত থেকে মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু তত দিনে তার এই অবৈধ যৌন সঙ্গমের ব্যাপারটা একটা মানবিক প্রয়োজনে ঘটছে নাকি এটা তার শরীরের একটা নিছক পাপ, সে সম্পর্কে সে আর নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছিল না। সে তার অস্থায়ী হোটেলে যাওয়াও কমিয়ে দিল, এখন তার আগ্রহ যে অন্যত্র শুধু সেজন্য নয়, অতীতের যে বিশুদ্ধ গার্হস্থ্য পরিবেশে ওরা তাকে দেখতে অভ্যস্ত ছিল এখন তাকে তারা ভিন্ন রূপে দেখবে এটা তার কাম্য ছিল না বলেও বটে। তবু, তিনটি জরুরি পরিস্থিতিতে তাকে তার আগের যুগের একটা কৌশলের দ্বারস্থ হতে হয়। তার বান্ধবীরা ভয় পায় যে লোকজন হয়তো তাদের চিনে ফেলবে, তাই সে তাদেরকে পুরুষের পোশাক পরিয়ে হোটেলে নিয়ে যায়, যেন তারা দুই ভদ্রলোক, শহরে বেরিয়েছে ফুর্তি করার জন্য। তবু দু’ক্ষেত্রে একজন লক্ষ করে যে ফ্লোরেন্টিনো তার তথাকথিত পুরুষ বন্ধুকে নিয়ে হোটেলের সুরাপানের ঘরে না ঢুকে একটা থাকার ঘরে প্রবেশ করে। ফলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার দুর্নামের ওপর কলঙ্কের আরেক পোঁচ পড়লো। অবশেষে সে ওখানে যাওয়া বন্ধই করে দিল, পরে অল্প যে দু’চার বার গেছে তা হারানো সুযোগ পুষিয়ে নেবার জন্য নয়, বরং ঠিক তার উল্টো কারণে, তার বাড়াবাড়ির পর সুস্থতা ফিরে পাবার জন্য একটা আশ্রয় স্থল হিসাবে ও সেখানে যায়।

ঠিকই করে সে। বিকাল পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়েই বাচ্চা মুরগি-শিকারি বাজপাখির মতো সে শিকারে বেরিয়ে পড়তো। প্রথম দিকে রাত তাকে যা জুটিয়ে দিতো তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকতো। পার্কে কাজের মেয়ে, দোকানে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে, সমুদ্র সৈকতে কেতাদুরস্ত তরুণী, নিউ অর্লিয়ান্স থেকে জাহাজে এসে নামা ভিনদেশী মেয়ে- যাকে পেতো তাকেই সে বগলদাবা করতো। রাত নামার পর অর্ধেক শহর যে জাহাজঘাটে গিয়ে জমায়েত হত সে ওদের সেখানে নিয়ে যেত, যেখানে পারতো সেখানে নিয়ে যেত, কখনো কখনো যেখানে পারা যেত না সেখানেও, যখন পারা যেত তখনই, যখন পারা যেত না তখনও, প্রায়ই তাকে কোন বাড়ির দরজার প্রবেশ পথের অন্ধকারে দ্রুত ছুটে যেতে হত, যতটুকু করা যেত ততটুকুই করতা, যেভাবে সম্ভব হত সেভাবেই তোরণের আড়ালে কাজ সারা করতো।

ঝড়ের সময় বাতিঘরটি সর্বদাই ছিল এক আশীষধন্য আশ্রয় স্থল। বৃদ্ধ বয়সের ঊষা লগ্নে, যখন তার সব কিছু গোছানো হয়ে গেছে, তখন এই বাতিঘরের কথা সে মধুর স্মৃতিবিধুরতার সঙ্গে স্মরণ করতো, কারণ সুখী হবার জন্য চমৎকার জায়গা ছিল ওটা, বিশেষ করে রাতের বেলায়, তার মনে হত বাতির প্রতিটি আলোক প্রক্ষেপণের মধ্য দিয়ে তার সেই সময়ের সব ভালোবাসা যেন নাবিকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তাই অন্য যে কোন জায়গার চাইতে ওখানেই সে বেশি যেত, আর তার বন্ধু বাতিঘরের রক্ষক মুখে একটা সরল বোকার হাসি নিয়ে তাকে সানন্দে অভ্যর্থনা করতো, আর ক্ষুদে ভয়ার্ত পাখিরা তার ওই ভঙ্গি দেখেই আশ্বস্ত বোধ করতো। মিনারের পাদদেশে একটা বাড়ি ছিল, বজ্রগর্জনের মতো তরঙ্গমালা পাহাড়ের বুকে এসে যেখানে ভেঙ্গে পড়তো তার কাছেই, আর ওইখানেই প্রেম সব চাইতে গাঢ় ও তীব্র হয়ে উঠতো, কারণ ব্যাপারটা মনে হত জাহাজডুবির মতো। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার বেশি পছন্দ ছিল, অনেক রাতে, মিনারটাই, কারণ ওখানে থেকে গোটা শহর, সমুদ্রের বুকে জেলে নৌকাগুলির আলোর মালা, এমনকি বহু দূরের জলাভূমি পর্যন্ত দেখা যেত।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এই সময়েই একটি মেয়ের চেহারা আর প্রেমলীলায় ওই মেয়ের পটুত্বের বিষয়ে তার সরলীকৃত তত্ত্বগুলি নির্মাণ করে। যে সব মেয়েকে দেখলে মনে হত যে তারা একটা কুমিরকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারে, যাদের খুবই ইন্দ্রিয়পরায়ণ দেখাতো, শয্যায় তারাই ছিল সব চাইতে নিষ্ক্রিয় ও অনুত্তেজক। এদের ওপর তার কোন আস্থা ছিল না। সে পছন্দ করতো ঠিক এর বিপরীত ধাঁচের মেয়েদের, কাঠির মতো রোগা, রাস্তায় তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না, কাপড়- জামা খুললে যারা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়, প্রথম সংঘাতে তাদের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কায় তোমার দুঃখ বোধ হয়, তারাই কিন্তু নিজের পুরুষত্ব নিয়ে গর্ব করা একটা মানুষকে কর্মশেষে একেবারে বিধ্বস্ত করে ফেলতো। এই সব অকালপক্ক পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনো নোট নেয়, তার ইচ্ছা ছিল “প্রেমিকের নিত্যসঙ্গীর” জন্য সে একটা কর্মোপযোগী সংযোজন রচনা করবে, কিন্তু তার সে প্রকল্প আগের প্রকল্পের মতোই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এবার এ কাজটি করেন আসেনসিয়া সান্তাদার। তিনি তাঁর বৃদ্ধা কুক্কুরীর প্রজ্ঞা দিয়ে তাকে হাবুডুবু খাওয়ালেন, তাকে তার মাথার উপর দাঁড় করালেন, তাকে নিয়ে হুটোপুটি খেললেন, লোফালুফি করলেন, তাকে একেবারে ঝকঝকে নতুন করে দিলেন, তার বিশুদ্ধ তত্ত্বগুলি গুঁড়ো করে ফেললেন এবং ভালোবাসা সম্পর্কে যে একটি মাত্র জিনিস তার জানা দরকার ছিল তাকে তা শিখিয়ে দিলেন, তা হল কেউ জীবনকে কিছুই শেখায় না।

আসেনসিয়া সান্তাদার বিশ বছর গতানুগতিক বিবাহিত জীবনযাপন করেছিলেন। তিন সন্তানের জন্ম দেন তিনি, ওই সন্তানরা জন্ম দেয় তাদের সন্তানদের, আর আসেনসিয়া গর্ব করে বলতেন যে সারা শহরে তিনিই একমাত্র দাদিমা যিনি সর্বোত্তম শয্যার অধিকারিণী। একটা জিনিস কখনো স্পষ্ট হয় নি, তিনি তাঁর স্বামীকে ছেড়েছেন, নাকি তাঁর স্বামী তাঁকে, নাকি একই সময়ে পরস্পর পরস্পরকে, তবে স্বামী তাঁর নিয়মিত রক্ষিতার সঙ্গে বাস করার জন্য তার বাড়িতে চলে যান, আর তখন আসেনসিয়া সান্তাদার অনুভব করলেন যে তিনি মুক্ত-স্বাধীন, ভরদুপুরে তিনি তাঁর বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে নৌ-জাহাজের কাপ্তান রোজেন্দো ডি লা রোজাকে অভ্যর্থনা করলেন, যাকে তিনি ইতিপূর্বে প্রায়ই রাত দুপুরে বাড়ির পেছনের খিড়কি দরজা দিয়ে অভ্যর্থনা করতেন। দ্বিতীয় বার চিন্তা না করে কাপ্তান একদিন ফ্লোরেন্টিনোকে মহিলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য তার বাড়িতে নিয়ে এলেন।

তিনি তাকে আমন্ত্রণ জানান দুপুরের আহারে, সঙ্গে নিয়ে আসেন মস্ত এক বোতল ঘরে তৈরি সুরা আর এক মহাকাব্যিক খানাদানার জন্য অপরিহার্য বিভিন্ন অত্যুৎকৃষ্ট উপাদান : গৃহস্থ বাড়ির উঠান থেকে ধরে আনা বাচ্চা মুরগি, কচি হাড়ওয়ালা গরুর মাংস, ময়লার মধ্যে ঘুরে বেড়ানো শুয়োরের সুস্বাদু মাংস, নদী তীরের শহরগুলি থেকে সংগৃহীত তরিতরকারি, সবুজ শাকসব্জী ইত্যাদি। কিন্তু এ সত্ত্বেও, প্রথম থেকেই, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা খাবারের চমৎকারিত্ব কিংবা গৃহকর্ত্রীর উচ্ছ্বাসের চাইতে বেশি আকৃষ্ট হয় বাড়িটার নিজস্ব সৌন্দর্য দ্বারা। সে মহিলাকে পছন্দ করলো তাঁর বাড়ির জন্য, ঝলমলে, খোলামেলা, সমুদ্রের দিকে মুখ করা চারটা বড় বড় জানালা, গোটা পুরনো শহর দেখা যায় এই বাড়ি থেকে। ড্রয়িংরুমটা অজস্র দ্রব্য সামগ্রীতে পূর্ণ, অতি চমৎকার সেসব জিনিস, সেগুলি ঘরটাকে একই সঙ্গে বিভ্রান্ত ও কঠোর একটা রূপ দিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের হাতে তৈরি জিনিস নিয়ে আসতেন কাপ্তান রোজেন্দো ডি লা রোজা, তাঁর প্রতি সফর থেকে ফিরে আসবার সময় নানা জিনিস নিয়ে আসতেন তিনি আসেনসিয়ার জন্য, ফলে এক সময় দেখা গেল যে ঘরে নতুন একটা জিনিস রাখারও আর জায়গা নাই। সমুদ্রের দিকের বারান্দায় তার নিজস্ব খাঁচায় বসে আছে মালয়ের একটি কাকাতুয়া, অবিশ্বাস্য সাদা তার পালক, তার শান্ত বিষণ্নতার মধ্যে নিহিত ছিল মানুষের নানা ভাবনার উপাদান। পশুপাখির মধ্যে এত সুন্দর একটি প্রাণী ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এর আগে তার জীবনে কখনো দেখে নি।

অতিথির উৎসাহ দেখে কাপ্তানও বিশেষ উৎসাহী হয়ে উঠলেন, তিনি প্রতিটি জিনিসের বিশদ ইতিহাস তাকে শোনাতে শুরু করলেন। কথা বলতে বলতে চলতে থাকলো তাঁর বিরতিহীন সুরা পান। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন নিরেট কংক্রিটে তৈরি : বিশাল আকার, মাথা ছাড়া সর্বত্র প্রচুর চুল, রাজমিস্ত্রির বুরুশের মতো গোঁফ, বাজখাঁই গলার আওয়াজ, অথচ সৌজন্য প্রদর্শনে অতিশয় পারঙ্গম। কিন্তু যেভাবে তিনি সুরা পান করছিলেন সেটা তাঁর ওই শরীরও সইতে পারলো না। খাবার টেবিলে বসার আগেই তিনি ওই মস্ত বড় বোতলটার অর্ধেক শেষ করে ফেলেছিলেন, টেবিলে বসেই তিনি গ্লাস-বোতল ভর্তি ট্রের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন, ধ্বংসযজ্ঞের একটা ধীরগতি শব্দ হল। আসেনসিয়া সান্তাদারকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সাহায্য চাইতে হল। তারা দুজন কাপ্তানের অসাড় দেহকে, সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসা একটা তিমি বিশেষ, শোবার ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত মানুষটার জামা-কাপড় খুলে দিল। তারপর ওদের দুজনের মধ্যে যেন অনুপ্রেরণার একটা বিদ্যুৎ ঝলসে গেল, উভয়েই সেটাকে তাদের নিয়তি নক্ষত্রের যোগসাজশ বলে ধরে নিল। তারা কেউ কাউকে কিছু না বলে, কোন ইঙ্গিত না করে, কোন রকম প্রস্তাব না দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে নিজেদের কাপড় খুলে ফেললো, এবং পরবর্তী সাত বছর ধরে, কাপ্তান তার জাহাজ নিয়ে বাইরে গেলে যেখানে সম্ভব সেখানেই তারা পরস্পরকে নিরাভরণ করে দিতে থাকে। তাদের অতর্কিতে আবিষ্কৃত হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না, কারণ একজন সুনাবিকের মতো কাপ্তান সর্বদাই জাহাজের ভেঁপু বাজিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে তাঁর আগমন বার্তা পৌঁছে দিতেন, খুব ভোরে এলেও প্রথমে তাঁর স্ত্রী ও নয় সন্তানের জন্য তিনটি দীর্ঘ শব্দ, তারপর তাঁর রক্ষিতা-প্রণয়িনীর জন্য দু’বার হ্রস্ব বিষণ্ণ দুটি আওয়াজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *