পিপলি বিলের ধারের সাতটি পরিবারের ইতিকথা

পিপ্‌লি বিলের ধারের সাতটি পরিবারের ইতিকথা

* প্রথম পরিচ্ছেদ *

ভূমিকা

দ্যিকালের এক কালে গ্রামভোমলায় সাতটি পরিবার বাস করত। তাদের একটি পরিবার ছাড়া সব কটিই থাকত পিপ্‌লি বিলের ধারে। অন্যটি থাকত একেবারে বিলের জলের মধ্যে। জায়গাটা টাশপুর থেকে পোয়াটাক পথ। অমাবস্যায় বলা কঠিন, কিন্তু চাঁদনি রাতে আর দিনের বেলায় দূর থেকেও শহরটাকে পষ্ট চেনা যেত। উপরে যেসব জায়গার নাম করলাম সেগুলো তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। ভূগোলের বই না ঘাঁটলেই তোমরা এসব জায়গা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবে।

এর পরের পরিচ্ছেদে পিপ্‌লি বিলের এই সাতটি পরিবারের পরিচয় দেওয়া হল।

* দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ *

সাতটি পরিবারের পরিচয়

একটি পরিবারে ছিল বাবা-টিয়া মা-টিয়া আর তাদের সাতটি ছানা-টিয়া।

একটি পরিবারে ছিল বাবা-টিয়া মা-টিয়া আর তাদের সাতটি ছানা-টিয়া।

আরেকটি পরিবারে ছিল বাপ-সারস মা-সারস আর তাদের সাতটি ছানা-সারস।

আরেকটি পরিবারে ছিল বাপ-সারস মা-সারস আর তাদের সাতটি ছানা-সারস।

আরেকটি পরিবারে ছিল কর্তা-হাঁস গিন্নী-হাঁস আর তাদের সাতটি ছানা-হাঁস।

আরেকটি পরিবারে ছিল কর্তা-হাঁস গিন্নী-হাঁস আর তাদের সাতটি ছানা-হাঁস।

আরেকটি পরিবারে ছিল বাবু-হুতোম বিবি-হুতোম আর তাদের সাতটি ছানা-হুতোম।

সাতটি ছানা-হুতোম

আরেকটি পরিবারে ছিল বুড়ো-গিনিপিগ বুড়ি-গিনিপিগ আর তাদের সাতটি ছানা-গিনিপিগ।

সাতটি ছানা-গিনিপিগ

আরেকটি পরিবারে ছিল হুলো বেড়াল মেনি বেড়াল আর তাদের সাতটি ছানা-বেড়াল।

সাতটি ছানা-বেড়াল

আরেকটি পরিবারে ছিল ধেড়ে-মাছ ধাড়ি-মাছ আর তাদের সাতটি ছানা-মাছ।

সাতটি ছানা-মাছ

* তৃতীয় পরিচ্ছেদ *

সাতটি পরিবারের আচার ব্যবহার

টিয়াদের বাসা ছিল ফুস্‌পুস্‌কি গাছে। তারা খেত সেই গাছের ফল, কুচো এলাচ আর কাঁচপোকা।

সারসগুলো বিলের জল থেকে ডাঙায়, আর ডাঙা থেকে বিলের জলে ঘোরা ফেরা করত, আর সকাল বেলা কোলাব্যাঙ আর বিকেল বেলা পাঁউরুটি খেত। তাদের ঠ্যাঙগুলো ছিল এত ঠ্যাঙঠ্যাঙে যে তারা বাবু হয়ে বসতে পারত না। তাই তারা অষ্টপ্রহর টহল ফিরত।

হাঁসগুলো তাদের চ্যাটালো পা দিয়ে চট্‌পট্‌ মাছি ধরে কপ্‌ কপ্‌ মুখে পুরে খেয়ে ফেলত, আর তাতেই তাদের পেট ভরে যেত।

হুতোমগুলো ওৎ পেতে থাকত ইঁদুরের জন্য। যখনই ইঁদুর পেত, তখনই সেটাকে সাবুর জলে গুলে পায়স করে খেয়ে নিত।

গিনিপিগগুলো বাগানে ঘুরঘুর করত আর লেটুস পাতা আর ছানার বরফি খেত।

বেড়ালগুলো ঝাঁঝাঁ রোদে বসে ঝিমুত, আর খিদে পেলেই নেড়ে বিস্কুট খেত। মাছগুলো থাকত বিলের জলে, আর খেত পিড়িং সেদ্ধ।

এইভাবে সাতটি পরিবার একসঙ্গে থেকে যারপরনাই আহ্লাদে তাদের জীবন যাপন করত।

* চতুর্থ পরিচ্ছেদ *

সাত পরিবারের সন্তান-সন্ততির দেশ ভ্রমণের উদ্যোগ

একদিন সাত কর্তা ও সাত গিন্নীর সাধ হল তাদের ছানাদের দেশ দেখতে পাঠাবে। তখন তারা তাদের সব্বাইকে কাছে ডেকে এনে তাদের প্রত্যেকের মাথায় একটু করে বুদ্ধি, আর হাতে একটা করে আধুলি, এক তাল তালমিছরি আর একখানা করে সবুজ খেরোয় বাঁধানো হিসাবের খাতা দিয়ে দিল।

তারপর প্রত্যেক বাপ মা তাদের ছানাদের একটি করে মূল্যবান উপদেশ দিয়ে দিল।

টিয়া তাদের ছানাদের বলল, ‘গাছে জামরুল দেখলে সেটা কে নিবি তাই নিয়ে চুলোচুলি করিসনি।’

সারস বলল, ‘ব্যাঙ দেখলে সেটাকে সাত ভাগ করে খেয়ে নিস। এই নিয়ে যেন বচসা না হয়।’

হাঁস বলল, ‘আর যেখানে যাস না কেন—ছানাবড়া পোকা দেখলেই তফাৎ যাস।’

হুতোম বলল, ‘যদি দেখিস ইঁদুর, চোখ কান বুজে সেটাকে সাত জনে সাত টুকরো করে খেয়ে হজম করে নিবি।’

গিনিপিগ বলল, ‘লেটুস খেতে লেট করিসনি। তবে সাবধান—গোগ্রাসে গিলিসনি যেন।’

বেড়াল বলল, ‘দোহাই বাছারা—কেলেহ্যাংলাকে ঘাঁটাসনি কক্ষনো।’

মাছ বলল, ‘খাওয়া নিষেধ শুধু নীল বোসফুঁশি। ওটা মাছেদের ধাতে সয় না!

সব শুনেটুনে, সাত সাত্তে ঊনপঞ্চাশটা ছানা তাদের সাতদুগুনে চোদ্দ জন বাপ-মাকে সাত সাত্তে ঊনপঞ্চাশটা কুর্নিশ ঠুকে দুগ্‌গা বলে দেশ দেখতে বেরিয়ে পড়ল।

* পঞ্চম পরিচ্ছেদ *

সাতটি ছানা টিয়ার কাহিনী

টিয়াদের সাত ছানা কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখল একটা জামরুল গাছে একটি মাত্র পাকা জামরুল ফলে আছে। যেই না দেখা, অমনি সাত জনের মধ্যে যে বড়, সে সেটাকে খপ্‌ করে পেড়ে নিল। এদিকে আর ছ’টিরও ক্ষিদে পেয়েছে, তাই দেখতে দেখতে লেগে গেল হাতাহাতি—

আর তার থেকে লাগল মাতামাতি

গুঁতোগুঁতি
লাথালাথি
কাটাকাটি
হুটোপাটি
ঠোঁটাঠুটি

আর তার থেকে সে কী চীৎকার, কী চেঁচানি, কী চিল্লানী! আঁচড় কামড় কীল চড় ঘুঁসি গাঁট্টার চোটে, খামচানি আর ঠোক্‌রানির ঠেলায়, সব ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেঁড়ে ফুঁড়ে শেষটায় বাকী রইল শুধু একটা পাকা জামরুল, আর খান সাতেক কচি সবুজ ছেঁড়া পালক।

এই বীভৎস ও বিভীষণ ভাবেই টিয়াদের সাতটি ছানার জীবন সাঙ্গ হল।

* ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ *

সাতটি সারস ছানার কাহিনী

সারস ছানারা রওনা হয়ে খানিক হেঁটে খানিক দৌড়ে প্রথম হপ্তা অ্যাঁকা রাস্তায় গিয়ে তারপরের ছ’ হপ্তা ব্যাঁকা রাস্তায় চলল। তারপর তারা একশো আট ক্রোশ ধরে বেদম দৌড়ে হঠাৎ থম্‌কে থেমে সব্বাই একসঙ্গে ঠোঁট ঠোঁটে পিটিয়ে একটা খিট্‌খিটে চিট্‌পিড়পট্‌পটাং শব্দ করল।

এমন সময় তাদের চোখে পড়ল একটা ব্যাঙ, যেটার পিঠে সবুজ বুটি আর কানের দুপাশে আসমানি ডোরা। দেখামাত্র খিদের চোটে সাতটা ছানা একসঙ্গে ব্যাঙটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাকে সাতভাগে ভাগ করতে লেগে গেল। কিন্তু গোলমাল বাধল ব্যাঙের ঠ্যাঙ নিয়ে। কোন ঠ্যাঙটা আগে কাটা হবে? এ বলে ও-ঠ্যাঙ, ও বলে এ-ঠ্যাঙ, আর এই বলাবলির ফাঁকে ব্যাঙ বাবাজীও থপ-থপিয়ে চম্পট, আর ব্যাঙ নেই দেখে ছানাদের মধ্যেও লেগে গেল কচ্‌কচি গজ্‌গজি খ্যাঁচাখেঁচি চেঁচামেচি কিচির কিচির খিটির খিটির, আর চলল ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্ ঠক্‌ ঠোঁটের ঠোক্কর। সাতদিন ধরে সাত ছানা সমানে এ ওকে ঠুক্‌রে শেষ পর্যন্ত শুধু সাত জোড়া ঠোঁট ছাড়া আর তাদের কারুর কিচ্ছু বাকি রইল না।

এইভাবেই শেষ হল সারস ছানাদের জীবন।

* সপ্তম পরিচ্ছেদ *

সাতটি হাঁসের ছানার কাহিনী

হাঁসের ছানারা একটা মাঠের উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দেখল এক জায়গায় একটা বিটকেল গাছ একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ছানাদের মধ্যে চার জন গাছটার মগডালে বসে এদিক ওদিক দেখতে লাগল, বাকি তিনটে মাটিতে নেমে ডাইনে বাঁয়ে হেলে দুলে ছড়া কাটতে লাগল, আর অঙ্ক, পাটিগণিত আর ভূগোলের নামতা আওড়াতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর তারা বেশ খানিকটা দূরে একটা ভারী আশ্চর্য নিটোল ফুল্‌কো জিনিস দেখল । সেটা অবিকল ছানাবড়ার মত দেখতে, যদিও তার দুপাশে দুটো ডানা, সামনের দিকে এক জোড়া ঠোঁট, মাথার উপর তিনটে টিকি আর নীচের দিকে একটা মাত্র ঠ্যাঙ!

একটা মাত্র ঠ্যাঙ

জিনিসটার দিকে কিছুক্ষণ দেখেটেখে হাঁসের ছানারা এ-ওর দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মত বলল, ‘বোঝাই যাচ্ছে ইনি হচ্ছেন স্বয়ং ছানাবড়া পোকা।’

তারপর তারা একটু বেআক্কেল ভাবেই হঠাৎ গান জুড়ে বসল—

ছানাবড়া পোকা
ওরে ছানাবড়া পোকা,
দূরে কেন, চলে আয় কাছে
উড়ে আয় গাছে
তোর সাথে ফিস ফিস কত কথা আছে!

গান শোনামাত্রই পোকাটা প্রচণ্ড তৎপরতার সঙ্গে তার একটা মাত্র ঠ্যাঙে তিড়িং বিড়িং তিড়িং বিড়িং তিড়িং বিড়িং লাফাতে লাফাতে একেবারে গাছের কাছে এসে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থেমে গম্ভীর হতভম্বভাবে এদিক ওদিক দেখতে লাগল।

তাইনা দেখে সাতটি হাঁসের ছানা-তো থরহরি কম্পমান! একটার আবার কী খেয়াল হল, গলা বাড়িয়ে ঠোঁটের ডগাটা দিয়ে পোকাটাকে টুক করে একটু ছুঁয়ে দিল। আর যায় কোথা! যেই না ছোঁয়া, অমনি পোকাটা আবার বেগুন বেগে লম্ফঝম্ফ লাগিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ হাঁ করে এমনি বিকট বেসুরো বিতিগিচ্ছিরি চীৎকার আরম্ভ করল যে হাঁসের ছানারা সাতজনের কেউই সেটা সহ্য করতে না পেরে একের পর এক ভির্মি দিয়ে মুখ থুবড়ে মরে গেল।

সাতটি হাঁসের ছানার মৃত্যু হয় এইভাবেই।

* অষ্টম পরিচ্ছেদ *

সাতটি হুতোম ছানার কাহিনী

সাতটি হুতোম ছানা একটানা বেশিদূর না গিয়ে মাঝে মাঝে বুড়ো বুড়ো গাছের ডাল বেছে নিয়ে তাতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল।

এইভাবে ডালে বসে থাকতে থাকতে এক ঘুরঘুটি রাত্তিরে একটা আওয়াজ শুনে তারা মনে করল—এটা নিশ্চয়ই ইঁদুর। লণ্ঠন নেই তাই দেখার জো নেই, তাই তারা সাতজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল—ইঁদুর নাকি?

এর জবাবে কোখেকে জানি একটা নেংটি ইঁদুর বলে উঠল—আঁই মাঁই কাঁই ভাঁই তাঁই তো!

যেই না শোনা, সাত হুতোম ছানা তৎক্ষণাৎ ঝপাৎ করে গাছ থেকে নেমে গোঁৎ খেল। মনে ভাবছে ভূঁইয়ে নামছি, কিন্তু পড়ল গিয়ে এক পেল্লায় পাতকোর ভেতর, আর সেই পাতকোর ঘোলা জলে হুতোমের সাত পোলা সাত পলকের মধ্যেই ঘপাৎ ঘপাৎ করে কুপোকাত।

এইভাবেই সাত হুতোমছানা প্রাণ হারালো।

* নবম পরিচ্ছেদ *

গিনিপিগের সাত ছানার কাহিনী

সাত গিনিপিগের ছা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে হাজির হল এক বনে যেটা বনধুঁধুলের ঝোপড়া আর তাগড়াই গাছের ঝাড়ে বোঝাই। এই গাছেরই একটার তলায় তারা পড়ল ঘুমিয়ে। যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখে কি কোন ফাঁকে জানি তাদের কাছেই একটা সবুজ পাতায় গিজগিজে লেটুস গাছ গজিয়ে উঠেছে। সেই না দেখে অমনি তারা মহা উল্লাসে একসঙ্গে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল—

পাতা টুস্‌ টুস্‌
লেটুস লেটুস
কুটুস কুটুস
খেয়ে মন খুশ!

তারপর তারা সাতজনে একসঙ্গে প্রবল বেগে ও প্রচণ্ড বিক্রমে গাছটাকে আক্রমণ করার ফলে ব্রহ্মতালুতে চোট পেয়ে ঘোর জ্বর-বিকার ও নাকফুলির প্রকোপে তিলে তিলে ধুঁকতে ধুঁকতে মরে গেল।

এইভাবেই গিনিপিগের সাত ছানার জীবনাবসান হল।

* দশম পরিচ্ছেদ *

সাত বেড়ালছানার কাহিনী

সাতটি বেড়ালছানা ভারি ফুর্তিতে দেশভ্রমণ করতে করতে একটা পাহাড়ের চুড়োয় এসে দেখে কি দূরে একটা কেলেহ্যাংলা (হেলেক্যাংলা বললেও ভুল হয় না) দাঁড়িয়ে আছে।

এখানে কেলেহ্যাংলার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আবশ্যক। এরা ভারি তুখোড় ও অর্বাচীন জানোয়ার। সহজে এদের সাক্ষাৎ মেলে না। এরা জলচরও বটে, শিলচরও বটে—অর্থাৎ, এক কথায়, গুপ্তচর। জলে চলাকালীন এরা এদের পুচ্ছটিকে পাল হিসাবে ব্যবহার করে। এদের গতি ক্ষিপ্র, বিধি বাম, আচার তেঁতুলেরও ব্যবহার অমায়িক। গ্রীষ্মকালে এদের পিপ্‌লি বিলের ধারে শূন্যে ঠ্যাঙ তুলে গান গাইতে দেখা যায়। এরা ঘোর নিরামিশাষী হলেও, প্রয়োজনে শুয়োরের মাংস, ছাগলের মাংস, গরুর মাংস, মাছের মাংস ও নানখাটাই খাওয়া এদের স্বভাববিরুদ্ধ নয়।)

বেড়ালছানা

বেড়ালছানা দেখেই কেলেহ্যাংলা দিল ছুট, আর অমনি ছানারাও তাকে ধাওয়া করে ছুটতে লাগল। কিন্তু একটানা চার মাস ধরে ছুটেও তারা কেলেহ্যাংলার নাগাল ত পেলেই না, তাকে টেক্কাও দিতে পারল না। লাভের মধ্যে ক্রমে তারা হাঁপিয়ে হাঁসফাঁসিয়ে দম ফুরিয়ে সেই যে মরল, তাদের আর কোন রকমেই বাঁচান গেল না।

এইভাবেই অক্কা পেল সাতটি বেড়ালছানা।

* একাদশ পরিচ্ছেদ *

সাতটি মাছের ছানার কাহিনী

সাতটি মাছের ছানা পিপ্‌লি বিলের জলে সাঁতার দিতে দিতে ক্রমে নদীতে, এবং অবশেষে সমুদ্রে গিয়ে পড়ল। এই সমুদ্রের জলেই হপ্তাখানেক ইতস্তত বিচরণের পর একদিন তারা দুর্ভাগ্যক্রমে এক ব্যাটা ক্যাটক্যাটে নীল বোসফুঁশিকে দেখতে পেয়ে তার দিকে তাগ করে এগিয়ে গেল। নীল বোসফুঁশিটা তখন দিব্যি একটা চৌকস চক্কর মেরে একটা তেকোনা সুড়ঙ্গ দিয়ে সুড়ুৎ করে সটান পাঁকের মধ্যে তার ডেরায় পৌঁছে গেল। মাছের ছানারাও কেৎরে সাঁতরে গিয়ে পড়ল সেই পাঁকে। কিন্তু অভ্যেস ত নেই, কাজেই কিছুক্ষণ আঁকুপাঁকু করে হাবুডুবু খেয়ে তারা যে শেষটায় দম আটকে ছটফটিয়ে মরে যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী?

মাছের ছানার মহাপ্রয়াণ এইভাবেই।

মাছের ছানার মহাপ্রয়াণ

* দ্বাদশ পরিচ্ছেদ *

পরবর্তী ঘটনার বিবরণ

যখন জানা গেল যে টিয়ার সাত ছানা
আর সারসের সাত ছানা
আর হাঁসের সাত ছানা
আর হুতোমের সাত ছানা
আর গিনিপিগের সাত ছানা
আর বেড়ালের সাত ছানা
আর মাছের সাত ছানা

সব মরেটরে ভূতটুত হয়েটয়ে গেছে, তখন ব্যাঙ আর ছানাবড়া পোকা আর নেংটি ইঁদুর আর কেলেহ্যাংলা আর নীল বোসফুঁশি সব একসঙ্গে এক জায়গায় জড় হয়ে তাদের পরম সৌভাগ্যের কথা ভেবে উৎসব করতে লাগল। তারা সাত টিয়াছানার সাতটা পালক, আর সাত সারস ছানার সাত জোড়া ঠোঁট, আর লেটুস গাছ আর পাকা জামরুলটা নিয়ে, জামরুলটাকে লেটুস গাছের উপর রেখে, আর বাকি স্মৃতিচিহ্নগুলো গাছের চারিদিকে সাজিয়ে গাছটাকে ঘিরে বেশ খানিকক্ষণ ধেই ধেই করে নেচে বেশ খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারপর তারা অনেক লোকটোক ডেকে তাদের খুব খাতির করে নেমন্তন্ন খাইয়ে যে যার বাড়িতে গিয়ে নিশ্চিন্তে হাঁফ নিয়ে মুখ ব্যাজার করে বসে রইল।

* ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ *

ঊনপঞ্চাশ শাবকের পিতামাতাদিগের দুর্গতি

যখন টিয়া বাপ-মা
আর সারস বাপ-মা
আর হাঁস বাপ-মা
আর হুতোম বাপ-মা
আর গিনিপিগ বাপ-মা
আর বেড়াল বাপ-মা

আর মাছ বাপ-মা খবরের কাগজ পড়ে তাদের ছানাদের শোচনীয় পরিণামের কথা জানতে পারল; তখন তাদের উপোস ছাড়া আর কোন উপায় রইল না। তারা দোকান থেকে গুচ্ছের ধানি লঙ্কা, প্রচুর রেঢ়ির তেল, অঢেল কাসুন্দি আর কাঁড়ি কাঁড়ি কালশিরীষের আঠা আনাল, আর আনাল গুনে গুনে সাতখানা ছিপি আঁটা রাবুণে বৈয়াম! তারপর আমসত্ত্ব ও পুঁইশাকে সামান্য জলযোগ সেরে তাদের যত হোমরা চোমরা হেঁজি পেঁজি পাড়াপড়শী ও কাটুমকুটুমদের ডেকে ভারী ধুমধাম করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিল।

* চতুর্দশ পরিচ্ছেদ *

উপসংহার

তারপর সাত বৈয়ামে আচারের মাল-মশলা ভরে সাত বাপ-মা জোড়ায় জোড়ায় এক একটা বৈয়ামে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বলা বাহুল্য, এর ফলেই তাদের মৃত্যু হল। আর মৃত্যুর মিনিট খানেকের মধ্যেই তারা সবাই আচারে পরিণত হল।

মারা যাবার আগে তারা যে উইল করে গিয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল যে বৈয়ামের ছিপি যেন কালশিরীষের আঠা দিয়ে টাইট করে আটকানো হয়, আর আচারশুদ্ধ বৈয়ামগুলোকে যেন টাশপুরের সেরা যাদুঘরে চালান দেওয়া হয়, আর বৈয়ামের গায়ে যেন লেবেল মারা থাকে, আর লেবেল সমেত বৈয়ামগুলো যেন একটা চারপায়া গোল আবলুশের টেবিলে সারবেঁধে সাজিয়ে রাখা হয়, যাতে লোকে বুঝতে পারে যে এটা চেখে দেখার জিনিস নয়, দেখে শেখার জিনিস।

তোমরা যদি কখনো গ্রামভোমলা হয়ে টাশপুরের জাঁদরেল যাদুঘর দেখতে যাও, তাহলে কিন্তু যাদুঘরের দক্ষিণ-পশ্চিমের বারান্দার বায়ু কোণের বাঁদিকে চারশো সাতাশ নম্বর ঘরের আঠার নম্বর টেবিলের দিকে না দেখলে আসল জিনিসটাই দেখতে পাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *