ডং
আঁধার যখন থম্থমিয়ে নামে
ঘুমভুলিয়ার গ্রামে,
গুম্রে যখন ওঠে ক্ষণে ক্ষণ
সাগরপাড়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গরজন,
ভুস্ভুসো সব মেঘরা একে একে
চ্যাংলি পাহাড়চুড়োয় গিয়ে ঠেকে—
তখন তুমি দেখতে পাবে চেয়ে
অন্ধকারে জ্বলজ্বলে এক ফুল্কি আসে ধেয়ে;
চারদিকে সব কালো
মধ্যিখানে বিন্দু সে-এক আলো
এদিক পানে ওদিক পানে ছোটে
হঠাৎ থেমে ঝিলিক্ দিয়ে ওপর দিকে ওঠে,
আবার পরক্ষণেই
ঢুকল যেন বঙ্গীগাছের বনেই।
মাঝরাতেতে দেখছে যারা একে
ছাতের উপর থেকে,
সবাই মিলে চেঁচিয়ে তারা ওঠে—
‘ডং এসেছে! ওই দেখো ডং ছোটে!
বনের মধ্যে ডং
ডং-এর দেখো ঢং
নাকের ডগায় ঝিলিক্ মারা সং!’
অনেক বছর আগে,
ডং-এর মনে বড্ড আঘাত লাগে।
আপন মনে ঘুরত নেচে গেয়ে
এমন সময় এল সেথায় পাপাঙ্গুলের মেয়ে।
পাপাঙ্গুলের দল
ছাঁক্নি চড়ে ঘুরতেছিল সমুদ্র-অঞ্চল।
জম্জমারি ঘাটে
(চৌকোমুখো চিংড়ি যেথা চারপায়েতে হাঁটে)
বাঁধল এসে তাদের তরীখান।
সেই রাতেতে শুনল সবাই পাপাঙ্গুলের গান।
তারপরেতে কদিন
কাটল তাদের নেচে তাধিন্ তাধিন্।
সন্ধ্যে সকাল চাঁদ্নি রাতের বেলা
সবাই করে খেলা
সবার মুখে হাসি
ডং-এর মুখে করুণ-কাঁদা বাঁশি,
ডং-এর পাশে ডং-এর দিকে চেয়ে
পাপাঙ্গুলের মেয়ে
সবুজ বেণী বাঁধছে সে নীল হাতে।
এমন সময় হঠাৎ এক সকালে
লাগল হাওয়া ছাঁক্নি নায়ের পালে
ডং-কে একা রেখে
সবাই তারা চলল সেখান থেকে।
ডং বেচারি ফ্যালফেলিয়ে চায়
নাও চলেছে কোন সুদূরে—হায়!
কী হবে তার দশা—
এবার বুঝি হতাশ হয়ে ঘাসের উপর বসা!
সূর্যি নামে পাটে,
ডং এখনো ঘুমভুলিয়ার মাঠে।
ডং এখনো ঘুমভুলিয়ার মাঠে।
বললে সে, ‘মোর যাও-বা ছিল আশ,
এখন সর্বনাশ।’
সেই থেকে ডং মরছে ঘুরে ফিরে
বনবাদাড়ে, মাঠে, সাগরতীরে।
আর সে করে গান—
‘কোন্ দেশে তার বাড়ি, সে কোন্খান?’
হেথায় হোথায় সদাই দেখে চেয়ে
কোথাও যদি লুকিয়ে থাকে পাপাঙ্গুলের মেয়ে।
রাত্তিরেতে যায় না ভালো দেখা
তাই টেগুনগাছের ডাল নিয়ে এক ব্যাঁকা
বানিয়েছে অবাক
রঙবেরঙের মস্ত বড় নাক।
সেইটেকে সে বেঁধে মাথার সাথে
ঝিলিক্ বাতি ঝোলায় তার ডগাতে।
আলো যদি ঝড়ের রাতে নেভে
তাই সে অনেক ভেবে
ঘিরেছে তায় গামছা দিয়ে মোটা
তাতে ছিদ্র দশ বারোটা
ঝিলিক্ আলো ঠিক্রে যাতে পড়ে
খন্দরে গহ্বরে।
এখনও তাই নিশুতি রাত্তিরে
ডং সে খুঁজে ফিরে।
ডং-এর করুণ বাঁশি
ছাপিয়ে ওঠে বঙ্গীবনের বাঁদরগুলোর হাসি,
বাঁশির সুরে ডং চলে যায় গেয়ে—
‘কোথায় গেল, কোথায় আমার পাপাঙ্গুলের মেয়ে?’
মাঝরাতেতে ডং-কে যারা দেখে
ছাতের উপর থেকে
সবাই মিলে চেঁচিয়ে তারা বলে—
‘ওই দেখো ডং! ডং গেল ওই চলে!
ওই যে ঘাসে, ওই ও-পাশে ডং,
নাকের ডগায় ঝিলিক্ মারা সং।’
[The Dong with a Luminous Nose অবলম্বনে]