আদ্যি বুড়োর পদ্যি
বলবার আছে যা’ তা’ বলি আজ তোরে
(বলবার বেশি কিছু নেই)
দেখেছিনু বুড়ো এক ফটকের পরে,
সব্বার থুত্থুড়ে যেই।
আমি তারে শুধোলাম, ‘বুড়ো তুই কেরে?
দিন তোর কাটে কোন কাজে?
জবাবেতে বুড়ো কথা বলে তেড়েমেড়ে
মোর কানে কিছু ঢোকে না যে!
বুড়ো বলে, ‘ধরি আমি ফড়িং-এর ছানা
যেই ছানা ঘুম দেয় মাঠে,
তাই দিয়ে রেঁধে নিয়ে মোগলাই খানা
ফেরি করি গঞ্জের হাটে;
সেই খানা খেয়ে নিয়ে খালাসির বেটা
পাড়ি দেয় সাগরের জলে—
এই করে কোনমতে খেয়ে আধপেটা
কায়ক্লেশে দিন মোর চলে।’
বুড়ো বকে; আমি পড়ি চিন্তার ফেরে—
দাড়ি যদি কারো হয় সবুজই,
থুৎনির সামনেতে হাতপাখা নেড়ে
সেই দাড়ি ঢাকা যায় না বুঝি?
বুড়ো দেখি চেয়ে আছে কাঁচুমাচু মুখে,
আমি ভাবি কী যে বলি তারে,
তারপরে মেরে এক কীল তার বুকে।
বলি, ‘বল্, আয় কিসে বাড়ে।’
বুড়ো বলে, ‘শোন, আমি পাহাড়ের বুকে
খুঁজে ফিরি ঝরণার জল,
সেই জল পেলে পরে চক্মকি ঠুকে
চট করে জ্বালি দাবানল।
তার ফলে সেই জল টগ্বগ্ ফুটে।
হয়ে যায় মকরধ্বজ,
কোবরেজে এসে তায় নেয় লুটেপুটে,
আমি পাই কী বা সেটা বোঝ!’
এদিকেতে আমি ভাবি, আর সব ছেড়ে
খাই যদি শুধু পাটিসাপটা,
ওজনটা দিন দিন যাবে না কি বেড়ে?
বাড়বে না উদরের মাপটা?
এইবার বুড়োটার কাঁধ দুটো ধরে
বেশ করে দিয়ে তিন ঝাঁকি
বলি, ‘তোকে বারবার শুধোনোর পরে
প্রশ্নটা বুঝছিস না কি?’
বুড়ো বলে, ‘কেয়া বনে—কাঞ্চির তীরে
খুঁজে আমি শুশুকের চোখ,
সেই চোখে গাঁথি হার মাঝ রাত্তিরে,
সেই হার কেনে বাবুলোক।
এইভাবে বলো কেবা হয় লাখপতি,
সোনাদানা হয় আর কজনের?
এই হার বেচে কার হয় উন্নতি,
দেড় পাই দাম যার ডজনের?’
‘খন্দেতে খুঁজি আমি খাস্তা কচুরি,
ফাঁদে ধরি কাঁকড়ার ছানা,
জঙ্গলে জঙ্গলে করি ঘোরাঘুরি,
পাই যদি হংসের ডানা।
বোঝো তবে,’ বলে বুড়ো এক চোখে হেসে,
‘কত খেটে হয় মোরে খেতে।
বাবা তুমি বেঁচে থাক। অ্যাদ্দুরে এসে
মোর কথা শোন কান পেতে।’
আমি ভাবি বকবক করে বুড়ো কী যে,
একবার মন দিয়ে ভাবে কি—
মর্চেই ধরে যদি হাবড়ার ব্রীজে,
সরবৎ ঢাললেই যাবে কি?
যাক্, তবু বলবই বুড়ো লোক খাশা,
খাশা তার রোজগার ফন্দী,
বেঁচে থাকে সেও যেন—এই মোর আশা।⋯
এইবার নিজ কাজে মন দিই।
সেই থেকে কভু যদি বুড়ো আঙ্গুলে
লেগে যায় শিরীষের আঠা,
অথবা যদিবা দেখি হিসেবের ভুলে
ডান বুটে ঢোকে বাম পা-টা,
কিম্বা হঠাৎ যদি বাটখারা ভারী
পায়ে পড়ে থেঁৎলায় নখটা
তক্ষুনি মনে পড়ে মুখখানা তারই
সেই থুত্থুড়ে বুড়ো (তারে ভুলতে কি পারি?)
যার চুল সব সাদা, যার সাদা গোঁফদাড়ি,
যার হাবভাবে মনে হয় যেন গোবেচারী,
যার বুক ভরা দুঃখেতে ধুক্ ধুক্ নাড়ী,
যার চোখ দুটো জ্বলজ্বলে মুখখানা হাঁড়ি,
যাকে দূর থেকে মনে হয় দাঁড়কাক ধাড়ি,
যার ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস পড়ে তাড়াতাড়ি—
সেই ফটকেতে বসা বুড়ো লোকটা।
[The White Knight’s Song অবলম্বনে]