পিঙ্গল আকাশ – ৮

উঃ সেই দিন কী ভয়ঙ্কর দিন!

শরতের সকাল ছিলো সেদিন। কিন্তু পরিষ্কার ঝকঝকে রোদ্দুর ওঠে নি। আকাশ ছিলো মেঘলা মেঘলা। আগের দিন তাজিনা জানিয়ে দিয়েছিলো, কাল সকালে যেতে হবে, তৈরি থেকো।

সকালে বেনু এলো। এসেই বললো, তাড়াতাড়ি নাও। আমি কাপড় চোপড় পরে রাস্তায় নামবো, বেনু বাধা দিলো। বলে উঠলো পেছনে থেকে, আহা তুমি যাচ্ছো কেন। ওরাই তো আসবে এপথে।

এপথে কেন? পলাশপুর তো ওদিকে!

হেসে উঠলো ফের বেনু, আরে তোমার কি সম্মান নেই নাকি। তোমার জন্যে কাসেম খান তো কাসেম খান, রাজা মহারাজা পর্যন্ত আসতে পারে।

কথাটা বিশ্রী। কিন্তু আনন্দের এই দিনে ওর কথাটা আমলে আনলাম না।

একটু পর এলো ওরা। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে দুলু ভাবীর স্বামী মতিন সাহেব। ভদ্রলোককে আগে দেখিনি, আজ দেখলাম। মন্দ বয়স হয় নি। চুলে বেশ পাক ধরেছে। কাসেম সাহেবের অন্তরঙ্গ বন্ধু। দুলু ভাবী স্বামীর পাশে বসে। ভেতরে একপাশে তাজিনা আর বেনু পাশাপাশি বসলো। গাড়িতে ওঠার আগে একটু ইতস্ততঃ করলাম। মেয়েরা একপাশে বসলেই বোধহয় ভালো হতো।

তাজিনাই কথাটা তুললো। বললো, আরে বসো বসো। এখন অতো সঙ্কোচ করলে চলে না।

গাড়ি চলতে লাগলো। শহর ছাড়ালাম। কাঁচা রাস্তায় নামল গাড়ি। বিষম ঝাঁকুনি লাগতে আরম্ভ করলো। আমি কেবলি চেপে বসছিলাম একদিকে। কাসেম সাহেব আমাকে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আরে পড়ে যাবে যে!

এদিকে একটা করে ঝাঁকি লাগছে আর তাজিনা হেসে উঠছে খিলখিল করে। বেনুকে বলছে, ধরো আমাকে বেনুদা, পড়ে গেলাম যে।

বেনুদা ওকে ধরলো দু’হাতে জড়িয়ে। তাজিনার কাপড় এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। গোটা আঁচলটা লুটোচ্ছে পায়ের কাছে। বেনুর দু’হাত চেপে বসেছে ওর বুকের ওপর দিয়ে। কিন্তু তার সেদিকে যেন লক্ষ্য নেই। পাগলের মতো হেসেই যাচ্ছে। আর থেকে থেকে এক একটা ঝাঁকুনির পর পরই বলে উঠছে, ধরো শক্ত করে, পড়ে গেলাম যে!

ওদিকে দুলু ভাবী আর মতিন সাহেবও হেসে হেসে কুটিপাটি তাজিনার কাণ্ড দেখে। মাঝে দু’একবার বলে উঠলো, ওহ্ মাই গুডনেস।

ওরা সবাই যেন মজা পেয়েছে। কেবল আমারই অস্বস্তি লাগছে। আমার পিঠের ওপর দিয়ে ডানদিকে এসেছে কাসেম সাহেবের মোটা বেঁটে আর শক্ত হাতখানা। মোটা আঙুল ক’টা বুকের একপাশে নড়ছে একটু একটু।

ওদের দিকে না দেখে উপায় নেই। মুখোমুখি বসেছি। বাইরের দিকে তাকাতে পারছি না। আর যতোবার দেখছি, ততোবারই রাগে গা-টা রি-রি করে উঠছে। এ কী সর্বনাশা আনন্দ ওদের।

কাসেম সাহেব ধীর স্থির। যেন কিছুই ঘটে নি। মনে মনে কী যেন ভাবছে লোকটা। তাজিনা আর বেনুকে বললো, তোমাদের ওজন যদি আমার মতো হতো তাহলে এতো ঝাঁকি লাগতো না। মতিন, জোরে চালাও।

গাড়ির গতি বাড়লো আরও। মেঠো রাস্তায় গাড়ি লাফিয়ে উঠছে থেকে থেকে। আর মেয়েটার হাসি যেন ফুরোতে চায় না। দু’হাতে বেনুর গলা জড়িয়ে ধরে বলছে, আরও জোরে চালাও, দেখি কত স্পীডে চালাতে পারো।

গাড়ির গতি বাড়লো আরও। দু’পাশের গাছপালা যেন চোখের সম্মুখে চমকে চমকে উঠতে লাগলো। পেছনে ধুলোটে ধোঁয়ার পুঞ্জ।

লাইফ ইজ এ টেরিবল স্পীড, কাসেম সাহেব চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর বললো, উই আর এনজয়িং আওয়ার সেলস। নো ফর্মালিটিজ নাউ। উই আর এ্যাজ ইনোসেন্ট এ্যাজ চিলড্রেন, গোয়িং ব্যাক টু আওয়ার গুড ওল্ড ডেজ। কথা কটা বলে আমাকে কাছে টানতে চেষ্টা করলো। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। রাস্তাটা যে কতক্ষণে শেষ হবে।

ওদিকে তাজিনা বেনুর কাঁধে মাথা রেখে ওকে জাপটে ধরে রয়েছে। গাড়িখানা বুনো মোঘের মত দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে।

কেবল হাসি আর হাসি। তার সঙ্গে ঝাঁকুনি। রাস্তা ক্রমেই নিচুতে নামছে। রাস্তা তো নয়, ধাপের পর ধাপ নেমে আমরা যেন নরকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার তখন ভয় ধরেছে মনে। ভয়ঙ্কর একটা আশঙ্কা হচ্ছে সময় সময়। মাঝে মাঝে আবার বাইরে দিনের আলো দেখে সাহস ফিরে আসছে মনে। এতোগুলো লোক আছে সঙ্গে, কেউ নিশ্চয়ই বিশ্রী কিছু করতে সাহস পাবে না। তবু একেক বার ইচ্ছে করছে ওদের বলি, আমাকে নামিয়ে দাও, আমি ফিরে যাই। কিন্তু এখন যে সে কথাও বলা যায় না।

হঠাৎ গাড়ির গতি থেমে গেলো। আর সেই ঝাঁকুনিতে আমি গিয়ে পড়লাম কাসেম খানের ওপর। লোকটা আমাকে এবার দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। আর সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো মতিন সাহেবের উদ্দেশে, ওয়েল ডান মাই বয়। ইটস ইয়োর ডে।

ও মাগো। অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠেছে তাজিনা সেই ধাক্কায়। ধাক্কাটা সামলে না উঠতেই গাড়িটা আবার প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ছুটতে আরম্ভ করলো।

আমার দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করছে তখন। জোর করে নজর ফিরিয়ে রাখলাম। বুকের ভেতরে ভয় আর বিশ্রী একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম। কেমন করে দেখা যায় তাকিয়ে! বেনু আৱ তাজিনা এমন বিশ্রী রকমের এলোমেলো যে তাকিয়ে দেখা যায় না। আমার ভীষণ ঘেন্না হচ্ছে তখন মেয়েটার ওপর। মনের ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল, ছি ছি মেয়েটা এমন কেন?

এবার মরিয়া হয়ে বলে উঠলাম, বেনুদা তোমরা আমাকে নামিয়ে দাও। গাড়ি থামাও।

বোধহয় জোরেই বলে উঠেছিলাম কথাটা। গাড়ির গতি হঠাৎ থেমে গেলো। সবাই এক সঙ্গে প্রশ্ন করলো, কি হয়েছে? সবাই আমার দিকে ফিরে তাকালো। তারপর এক সঙ্গে হেসে উঠলো সকলে। আমি খুব হাস্যকর কোনো রসিকতা করে বসেছি যেন।

ওদের হাসি থামলে মতিন সাহেব বলে উঠলেন, এই তোমরা এমন ছেলেমানুষী করছো কেন? দেখছো না, মেয়েটা এসব দেখতে অভ্যস্ত নয়। ওর হয়তো খারাপ লাগছে।

কেন খারাপটা কোথায়? কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছি—তাজিনা মুখিয়ে উঠলো।

মতিন সাহেবের চোখেমুখে বিচিত্র একটা হাসি খেলে গেলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এসব দেখতে মতিন সাহেবও অভ্যস্ত। তখন শুধু আমার জন্যেই কথাটা বললেন। ভদ্রলোক তবু বললেন, চেঁচামেচিটা কম করলেই তো হয়।

তাজিনা অসহিষ্ণু গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, হয়েছে হয়েছে, আপনি পেছনে তাকাবেন না। গাড়ি চালান।

আমার দিকে তাকিয়ে বললো—এই মঞ্জু অমন মুখ গোমড়া করে কেন। পিকনিকে যাচ্ছো, একটু হাসিখুশি না থাকলে পিকনিকে এসে কি লাভ। বাড়িতে বসে থাকলেই তো হতো।

একটু ছেলেমানুষী মন্দ কি! দুলু ভাবী মন্তব্য করলো। বললো, ওর আবার একটু বেশি বেশি সব ব্যাপারে।

আমার সারা গা হিম হয়ে গেছে। এই কি ছেলেমানুষী নাকি! এ নোংরামির নাম ছেলেমানুষী!

আমি ডেকে বললাম, মতিন সাহেব, গাড়ি থামান। আমি নামবো।

নামবে। মতিন সাহেব অবাক হলেন যেন। বললেন, এখানে কোথায় নামবে? এই তো এসে গেলাম। আর একটু সময়।

কতক্ষণ? তাজিনা প্রশ্ন করলো।

মিনিট চল্লিশ, গীয়ার বদলাতে বদলাতে উত্তর করলেন মতিন সাহেব।

এত শীগগীর রাস্তা ফুরিয়ে গেলো। আপনি বেশি স্পীডে গাড়ি চালিয়েছেন, তাজিনা আফসোস করে।

তাজিনা আবার গলা জড়িয়ে ধরেছে বেনুর। দু’জনের মুখ চোখ লাল হয়ে গেছে। রাস্তাটা কিছুদূর পর্যন্ত ভালো ছিলো একটু পর আবার সেই খারাপ রাস্তা। আবার ঝাঁকুনি। সেই সঙ্গে হাসি আর আদিম সেই উল্লাস। গাড়ি এপাশে ওপাশে ঝাঁকি খাচ্ছে তখন ক্রমাগত। কাসেম খান আমাকে জড়িয়ে ধরেছে বুকের কাছে। আমি ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছি। ওদিকে ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে, ভুলু ভাবী পর্যন্ত। দেখছে আর ভারি মজার হাসি হাসছে।

কাসেম খান ওর ঠোঁট ছোঁয়াল আমার কাঁধের ওপর। জোঁকের মত মোটা মোটা থলথলে দুখানা ঠোঁট। শিউরে উঠলাম। ঘেন্নায় সারা শরীর বিজবিজ করে উঠলো। মোটা হাতখানার বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না কোনোমতেই। তাজিনা সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো, কাসেম, দিস টাইম ফ্যু হ্যাভ ইট অর লুজ ইট ফর এভার।

আমি মাথা নিচু করে রেখেছি আর কাসেম খান বাম হাতে আমার চিবুক তুলে ধরতে চেষ্টা করছে। কী প্রচণ্ড শক্তি লোকটার। জোর করে মাথা নামিয়ে রেখেছি। এদিকে গাড়িটাও ক্রমাগতই ঝাঁকি খাচ্ছে। আমি পারছি না দৈত্যটার সঙ্গে। তখন সজোরে ওর ডান হাত কামড়ে ধরলাম।

কাসেম খান অস্ফুট আর্তনাদ করে ছেড়ে দিলো আমাকে।

কী হলো? সবাই ফিরে তাকিয়েছে তখন। গাড়িটা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেলো।

কিছু না, কিছু না, হাসতে হাসতে কাসেম খান বললো, দ্য ওয়াইন্ড ক্যাট হ্যাজ বিটেন মি।

তাজিনা খিলখিল করে উঠলো কাসেম খানের অবস্থা দেখে। বললো, দেন যা মাস্ট হ্যাভ হার। য়্যু নো হাউ টু টেম ওয়াইল্ড ক্যাটস।

ও ইয়েস আই নো, এন্ড আই মাস্ট ডু ইট।

গাড়ি চললো আবার। আমি মাথা নিচু করে রেখেছি। একবার চেঁচিয়ে উঠলাম, গাড়ি থামাও নইলে লাফিয়ে পড়বো গাড়ি থেকে। কাসেম আমার দুটো হাত চেপে ধরেছে শক্ত করে। গাড়িটা ছুটে চলেছে উঁচু নিচু রাস্তার ওপর দিয়ে। ওরা মাঝে মাঝে হেসে উঠছে তখনও। যেন কিছুই হয় নি। এরকম ঘটনা যেন হরদমই ঘটে ওদের কাছে। দেখলাম আর উপায় নেই। চুপ করে বসলাম। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তখন আমার। একেকবার ভাবছি, লোকটার গায়ে কী ভীষণ জোর। কাসেম খান এক সময় আমার হাত দুটো ছেড়ে দিলো। কিছু পর বললাম, আপনি আমার বাপের বয়সী, যদি জানতাম আপনি এরকম লোক, তাহলে আমি কখনো আসতাম না।

কাসেম খান হো হো করে হেসে উঠলো। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, আরে বাপু তোমার বয়সী হলে এতো পয়সা খরচ করতাম নাকি? বাপের বয়সী বলেই তো এত পয়সা খরচ করেছি।

আমি বেনু আর তাজিনার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আমি এখন বুঝে ফেলেছি। কেন ওরা আমায় পিকনিকে আনার জন্যে এতো উৎসাহী হয়ে উঠেছিলো। দুলু ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সে আমার দিকে পেছন ফিরে একবারও তাকিয়ে দেখছে না।

বেনু আর তাজিনা চুপ চাপ বাইরে মুখ ফিরিয়ে বসে রয়েছে। যেন এই বিশ্রী ঘটনাটা এই নিষ্ঠুর আর নোংরা ব্যাপারটা কিছুই নয়।

গাড়ি থেমে গেল। আর কি আশ্চর্য। গাড়ি থেকে টপ টপ করে নেমে একে একে ছুটে গেল ওরা সবাই। পেছনে তাকিয়ে দেখলো না পর্যন্ত। আমি নামতে গেলাম। দেখি কাসেম খান হাত ধরে রেখেছে। আস্তে করে বললো, আমি তোমাকে নামিয়ে নিয়ে যাবো।

আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জোর করে নিজেই নামতে যাবো। পারলাম না। কাসেম খান তার লোহার মতো শক্ত দুই হাতে আমাকে বুকের কাছে টেনে আনলো। আমার এখোন দম বন্ধ হয়ে আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছি। প্রচণ্ড যুদ্ধ করছি। কাসেম খানের বীভৎস মুখখানা ক্রমেই নেমে আসছে আমার মুখের ওপর। এক সময় আমার সব জোর ফুরিয়ে এলো। আর পারলাম না। কাসেমের সেই কালো মোটা ঠোঁট দুটো আমার সারাটা মুখ আবিলতা আর ঘেন্নায় ভরে দিলো।

কাসেম যখন আমায় ছেড়ে দিলো তখন আমি কাঁদছি। না, কোনো কথা বলছি না। আমার সারা গায়ে তখন কাদা, সারা মুখের ভেতরে রাশ রাশ থুথু, দু’চোখে শুধু ঝাপসা কান্না। কিন্তু করার কিছু নেই আমার। পাথরের মতো গাড়িতে বসে থাকলাম। অদূরে ডাকবাংলা থেকে খুশির চিৎকার ভেসে এলো। তাজিনার গলা শুনলাম।

ঘেন্না আর কান্না ছাপিয়ে আরেকটা কী যেন অনুভূতিতে ঘোর লেগেছে তখন আমার। কিংবা আসলে সেটা কোনো অনুভূতিই নয়। আমি যেন তখন আর আমি নেই। সেইভাবে বসে থাকতে থাকতেই এক সময় আমার কান্না থেমেছে। এখন মনে হয়, সেই প্রাণহীন নিরনুভব দেহের মধ্যে যেন আরও কিছু ছিলো যা আমার সব অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো।

সেদিন সেই নরক যাত্রার শেষ হয়েছিলো। ভেবেছিলাম ওদের কৌতুকের ওখানেই শেষ। মনে হয়েছিলো, ওদের হৈ-হুল্লোড়ের ওখানেই শেষ। লোকের হাতে টাকা পয়সা থাকলে কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল হয়—ওদেরও তাই হয়েছে। কাসেম খান এখন ওদের সঙ্গে কিছু ঠাট্টা মস্করা করবে, খাওয়া দাওয়া হবে, তারপর আবার শহরে ফিরে যাবে।

গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। সম্মুখে ডাকবাংলো। মস্ত এক আম বাগানের এক পাশে। পেছনে কাছেই নদী। ওরা কজনা ছুটোছুটি করছে বাচ্চা ছেলেমেয়ের মতো। মতিন সাহেব দুলু ভাবী পর্যন্ত এক ঝাঁক প্রজাপতির পেছন পেছন ছুটছে।

এক সময় দুলু ভাবী প্রস্তাব করলো, চলো আমরা লুকোচুরি খেলি।

ওদের দেখে মনে হচ্ছিলো, সবাই যেন শৈশবে ফিরে গিয়েছে। পরিণত বয়সের কয়েকজন মানুষ হঠাৎ একেবারে ছেলেমানুষ হয়ে উঠতে চাইলো। একবার বেনু গায়ের উপর একটা গাং ফড়িং ছেড়ে দিয়ে দুলু ভাবীকে খুব নাকাল করলো। সবাই হো হো করে হাসলো। আমারও হয়তো হাসি পেতো অন্য কোথাও হলে। এখোনে হাসতে পারলাম না। কেননা কী রকম যেন ভয় ভয় আশঙ্কা বুকের ওপর চেপে ছিলো। আমি লক্ষ্য করে দেখছিলাম বেনুর দিকে, তাজিনার দিকে, সত্যি সত্যি শিশুর মতো সরল আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে কি না ওদের। দেখলাম বার বার করে। মম্ পুতুলকে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছি। আমি কতোবার আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে। ওরা যখন নিজে নিজে কোনো ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায় অথবা কোনো কৌতুকের খেলায় দুরন্ত ছুটোছুটি করে আর হাসে, তখন ওদের আশ্চর্য পবিত্র মনে হয়।

মিলিয়ে দেখলাম আমার সহযাত্রীদের। এদের তো তেমন মনে হচ্ছে না। কেমন করে মনে হবে। ওরা বারবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে। কী যেন লক্ষ্য করছে। আর আমার মনে হলো সেই মুহূর্তে, ওদের এই লুকোচুরি খেলায় যেন আমি যোগ দিই এক সময় সহজভাবে, তেমনি একটা আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখছে।

ওদের এমনি আমন্ত্রণ যদি খোলাখুলি হতো, তহলে হয়তো আমার ভালো লাগতো। কিন্তু আমার চোখে যে ধরা পড়লো অন্য চেহারা। আমি যে ওদের লক্ষ্য করে দেখছি, এ ব্যাপারটা কারুর চোখে এড়ালো না। ওদের সবার চাপা ঠোঁটের নিচে, চিবুকের ডৌলের আড়াল দিয়ে, দেখলাম কুটিল কী একটা অভিসন্ধি ফুটে বেরুচ্ছে।

লুকোচুরি খেলা, কিংবা এই যে সহজ ছেলেমানুষী করার ভান, এটা আর কিছু নয়, বিবেকের সম্মুখে মুখোসের আড়ালে লুকনো। কিংবা তাও নয়। ওদের কি বিবেক বলে কারুর কিছু আছে? আসলে এটা ভান। সবাই জানে ভান—আসলে অন্য কোনো উদ্দেশ্য লুকনো রয়েছে আর সেই উদ্দেশ্যটাও ওদের সবার জানা।

চলো, আমরা সবাই বাইরে ছড়িয়ে পড়ি।

হ্যাঁ, তাই চলো। ঘরের ভেতরে বিশ্রী গরম।

তোমাদের কি মত বেনু? কাসেম খান জিজ্ঞেস করলো, সিগ্রেটের ধোঁয়া ছেড়ে।

হ্যাঁ, সবাই রাজি আমরা। চলো বাইরে যাই।

তুমি দৌড়তে পারো তো? কাসেম খান আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো।

আমি কোনো জবাব দিলাম না। কাসেম খান পাশ থেকে উঠে চলে গেলো বাঙলোর ভেতরে।

তাজিনা ধাক্কা মেরে বললো, কথার জবাব তো দিতে পারতে। একটু ভদ্রতাও শেখো নি।

আমি এ কথারও কোনো উত্তর দিলাম না।

ওর হয়তো খারাপ লাগছে, ওকে বিশ্রাম করতে দাও, কাসেম খান পেছন থেকে বললো। লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। খাবারের ঝুড়ি নিয়ে এসেছে হাতে করে। ওরা হাতে হাতে তুলে নিলো স্যাণ্ডুইচ আর কলা। আমার হাতে তুলে দিল দুলু ভাবী। আমি নিলাম না। কাসেম খান হেসে উঠলো, এখোনও রাগ পড়ে নি দেখছি।

তাজিনা পাশ থেকে বলে উঠল, আচ্ছা কী এমন হয়েছে যে এমনি হয়ে থাকতে হবে? হাসি-ঠাট্টা মানুষে করে না! আর আমরাই তো সবাই, বাইরের তো কেউ নেই আর।

আমি তখনও কিছু বললাম না। বারান্দার রেলিঙের দিকে উঠে গেলাম। বাইরে অজস্র রোদ। বেলা দুপুর হয়েছে নিশ্চয়ই। দূরে কি একটা পাখি অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে। চারপাশ দিয়ে এলোমেলো হাওয়া বইছে। পেছনে ওরা আবার হৈ হৈ করে উঠল আরেক প্রস্থ।

কিছুক্ষণ পর ওরা সবাই ছড়িয়ে পড়লো বাইরে। ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে। ওদের চলাফেরার ভঙ্গি দেখে মনে হলো, ওরা এ জায়গাটার সঙ্গে বহুদিন ধরে পরিচিত।

দুলু ভাবী আর কাসেম খান এক ঝোপের আড়ালে লুকিয়েছে। ঘাসের উপর উবু হয়ে শুয়ে পড়েছে দু’জনে। বেনু খুঁজে বার করল তাজিনাকে। তাজিনা ছুটে চলে গেলো অন্যদিকে। ওদের হাসির শব্দ কানে এলো। এপাশ থেকে ওরাও হেসে উঠলো। দেখলাম দুলু ভাবীর বুকের উপর মাথা রেখে কাসেম খান চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে।

আমি ফিরে এসে বসলাম। এর নাম খেলা? এরা এমনি করার জন্যে ছেলেমানুষীর ভান করে?

বাঙলোর বারান্দায় বসে রইলাম। মেঝেতে জিনিসপত্র একাকার করে ছড়ানো। কাসেম খান তার ট্রানজিস্টার জুড়ে দিয়েছে। কোনো এক বিদেশী ভাষার গান হচ্ছে।

আমি তখনও স্বাভাবিকতা ফিরে পাই নি। কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব ঘিরে ধরেছে সারাটা দেহ। মাথার ভেতরে কোথায় যেন ঝিম ঝিম করছে। একেকবার মনে হচ্ছে বোধহয় বমি করব।

চারপাশ থেকে তখন ওদের কলকণ্ঠ হাসির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। ট্রানজিস্টারের গানের শব্দ ছাপিয়ে ওদের হাসি শোনা যাচ্ছে।

আমি ব্যাকুল চোখে তখন কাউকে খুঁজছি। খুঁজছিলাম যে কোনো একটি মানুষ। যার কাছে আমি আশ্রয় নিতে পারি। কিন্তু সে জায়গার চারপাশে একটি মানুষ দেখতে পেলাম না, দূরে অদূরে কোনো ঘরবাড়ির চিহ্ন দেখলাম না। যতোবার দেখতে চেষ্টা করলাম, ততোবারই শুধু চোখে পড়লো আম গাছের ডালপালার আর তারও পেছনে ঘন আসামী ঝাড়ের জঙ্গল। তার মাঝে মাঝে যদি বা নতুন কিছু চোখে পড়ছে, তা হলো দুলু অথবা তাজিনার ছুটোছুটি করতে থাকা রঙিন কাপড়ের চকিত উদ্ভাস। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হতে লাগলো।

কিন্তু কে জানতো সেই অসহায়তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে ছিলো আমার অপেক্ষায়। ওরা সবাই শিশুর মতো অবোধ খেলায় মেতে উঠেছে আর আমি এদিকে বারান্দায় সব অনুভূতি নিঃশেষ করে বসে রয়েছি।

আমি সেখান থেকেই দেখলাম। এক সময়, তাজিনা বেনুকে নদীতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। দুলু ভাবী মতিন সাহেবকে। তারপর সেই কাদামাখা কাপড়-জামা ভেজা দুটো মানুষ মেয়ে দুটোকে ছুটে এসে ধরলো। তারপর ওদের তুলে নিয়ে নেমে গেলো নদীর পানিতে। একটু পর আর দেখতে পেলাম না কাউকে।

ঘরের ভেতরে হঠাৎ হাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। পর্দাগুলো উড়ছিলো সেগুলো এখন স্থির। আমি ওদের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার কোনো কৌতূহলো ছিলো না। কোনো অনুভূতি ছিলো না। বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় এসেছি, কিসের জন্যে এভাবে বসে রয়েছি। মনের ভেতরটা ঐ সময় লতাপাতা গাছপালা ভরা এই অরণ্যের মতোই হয়ে পড়েছিলো হয়তো। না, কোনো মানুষের কথা মনে পড়ে নি।

এখনো বুঝতে পারি না, আমি কেন সব বোধ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কেন আমার সব শক্তি বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো সেদিন।

কতোক্ষণ জানি না। হঠাৎ আমার কাঁধে কার হাত এসে পড়লো। না, চমকে উঠি নি। আমার মন বলছিলো, হয়তো আমার নিজের অজ্ঞাতে, যে এরকম কেউ এসে আমার কাঁধে হাত রাখবে। সেই মোটা হাতের বেঁটে বেঁটে আঙুলগুলো আমার চেনা হয়ে গিয়েছে।

এসো, ঘরের ভেতরে যাই, খসখসে উত্তেজিত স্বর লোকটার।

আমি শক্ত হয়ে বসলাম। রেলিং চেপে ধরে।

আমার উপর রেগে আছো কেন? বলো কি লাভ ওতে। আমি তো আর কোনোদিন তোমায় আনতে যাবো না। আর তুমি যে এখানে এসেছো, এটাই বা কয়জনে জানে। এস, লজ্জা কিসের?

আরও কী কী যেন বলেছিলো কাসেম খান। লোকটা কথা বলছিলো আর আমার গায়ে জ্বালা ধরছিলো একটু একটু করে। তবু আমি কিছু বলছিলাম না।

তুমি কি মনে করো তোমার ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি?

কাসেম খানের এ প্রশ্নে চমকে উঠলাম। ফিরে তাকালাম লোকটার মুখোমুখি। কী বলতে চায় ও?

আমি জানি আনিসের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক। যদি মনে করো, আমাদের সঙ্গে এসে নিজের মতো থাকবে, তাহলে কি পার পাবে ভেবেছো? আনিসকে জানিয়ে দিতে কতোক্ষণ? আর একবার আনিস জানতে পারলে তোমার এই অহঙ্কারটা কোথায় থাকবে?

না, না, আমি যাবো না। আমি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠেছি।

আনিসকে তাহলে জানাবো যে এখানে এসেছিলে তুমি আমার সঙ্গে। একটা দিন থেকে গিয়েছো।

আমি কী করবো এখন? ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলাম। শরীরে মনে আর এতোটুকু শক্তি নেই এখন আমার। মনের সব চাইতে শক্ত জায়গায় আঘাত খেয়ে আমি হেৱে গেলাম। কাসেম খান আমার হাত ধরে টেনে তুলতে গেলো, আমি ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলাম হয়তো। শরীরের সমস্ত শক্তি গলায় এনে চিৎকার করে উঠতে চাইলাম।

তারপর জানি না, আমি কোথায় গেলাম। শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছিলো, কেউ যেন বারান্দায় ছুটে এসেছিলো। খুব সম্ভব বেনু ছুটে এসেছিলো বাধা দিতে। সেও আমার দুঃস্বপ্নের মাঝখানে মুহূর্তের জন্যে দেখা। তারপর এক নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। বাঙলোর সেই সময়ের ছবিটা আমার কাছে এখন ঝাপসা। কখন যে সেই ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো বলতে পারবো না। চোখের সম্মুখে শুধু পুঞ্জ পুঞ্জ হলদে হলদে অন্ধকার দেখেছি। আর সেই অন্ধকার দেখতে দেখতে, ঘর্মাক্ত পাশব আর হিংস্র নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে শুনতে, মনে হচ্ছিল, তীক্ষ্ণ এবং তীব্র একটা যন্ত্রণার ছুরি দিয়ে কেউ যেন আমার অস্তিত্বের কেন্দ্র থেকে আমাকে আলাদা করে ফেলছে। আমি শেষবারের মতো চিৎকার করে মরে গেলাম।

আবার আমি জেগে উঠেছিলাম। এবং জেগে উঠে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনেছি। নিজের শরীরটাকে অনুভব করেছি। কি আশ্চর্য, শরীরটা আমার মরে গেলো না। সেই না-আলো, না-অন্ধকার ঘরের মধ্যে আমার মৃত্যু হলো। বেঁচে থাকলো শুধু শরীরটা।

কী করবো আমি। ভাবতেও আমার এখন ভয় করে, সেই ভয়ঙ্কর দুপুরের কথা। কাউকে জানাতে পারছি না।

আমার বাঁচবার কতো সাধ ছিলো। এই সাধটাকে কতো কষ্টে কত যত্নে কতো গোপনে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলাম। কতো কান্না, কতো অপমান, কতো স্নিগ্ধ-সুখের স্মৃতি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। সেই সাধটা আমার মরে গেলো।

এখন বাঁচবো কোন সাহস নিয়ে? শক্ত পায়ে দাঁড়াবো কোন বিশ্বাসের ওপর। কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো? হায়রে! আর আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারবো না, আর আমি গাছপালার সবুজ রঙকে আপন বলে ভাবতে পারবো না, আর আমি কোনোদিন আনিসের জন্যে অপেক্ষা করতে পারবো না।

লোভ লোভ, ঘৃণা ঘৃণা, কান্না আর কান্না। আর সব মিলিয়ে বিশ্রী নগ্ন একটা আবিলতা। যার তলায় আমাকে চাপা পড়তে হলো চিরকালের জন্যে।

আমার কথা কেউ জানবে না। কাউকে জানাতে পারবো না। বাড়িতে থাকি, ঘর থেকে বেরুতে পারি না। এখন ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়াও বুক ভরে নিতে পারি না। সকালের প্রসন্ন রোদ মুখে নিয়ে হাসতে পারি না। বাড়িতে কোনো লোক এলে তার সম্মুখে সহজভাবে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না।

এ বাড়িটাই এখন মরে গিয়েছে। মা এখন অন্য রকম। যেন কিছুই দেখতে পায় না। সংসারটা চলেছে কোনো রকমে ধুঁকে ধুঁকে। সেই ঘটনার পরদিন বেনু এসেছিলো। এসে মা’র হাতে কতগুলো টাকা দিয়ে গেছে। বলেছে, কাসেম খানের কাছ থেকে ধার নিয়ে দোকান চালাচ্ছি।

তাজিনা এসেছিলো, ওর সামনে বের হই নি।

আমার ঘেন্না এখন সবার ওপরে। ঘো মাকে, বেনুকে তাজিনাকে সব মানুষকে এখন আমি যেনা করি। নিজের এই যে সুন্দর শরীরটা, এটার ওপরেও আমার ঘেন্না জমে রয়েছে।

এই কি আমি? কতোবার করে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি। আমার ভেতরে কি কোন শক্তি নেই! এমনি দুর্বল যে একটা পশুর কাছ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না। আমার নিজের ভেতরকার জানোয়ারটা আমাকেই হত্যা করে শক্তিমান হয়ে উঠতে পারলো। নিজের দেহটাই বিচিত্র স্বাদ পেয়ে আমাকে ঘৃণার অতল ঘূর্ণিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। এই সমুদ্রে এখন ডুবে মরা ছাড়া আর অন্য কোন গতি নেই? কে বলে দেবে আমাকে।

মমকে সহ্য করতে পারি না, পুতুলকে পারি না। আর মা’কে তো নয়ই। মা’র শরীর খারাপ হয়েছে আরো অনেক বেশি। বোধহয় এযাত্রা বাঁচবে না। অথচ আমি দেখেও যেন দেখতে চাই না। আনিসের সেই চিঠি শেষ পর্যন্ত খুলেছি। শুধু একটি কথাই লেখা সে চিঠিতে, জানো তোমার ভাবনায় সারা মন ভরে থাকে সব সময়।’

ভাবছি, এই ডায়েরী লেখার এখানেই শেষ হলো। আমার নিজের বলার মতো আর কোনো কথা নেই। এ ডায়েরী কেউ পড়বে না। প্রাণ থাকতে কোনো মেয়ে তার জীবনের এই সব ঘটনা আর কাউকে জানতে দেয় না। আমিও পারি না। কিন্তু আমার রাগ হয়। নিজের এই সঙ্কোচ আর ঘেন্নার ওপর আমি রাগে জ্বলে উঠি। মনে হয়, জানুক আর সবাই। জানুক, আমাকে কেমন করে হত্যা করেছে মানুষের লোভ আর ঘৃণা।

আমার বেঁচে থাকার মূল্য কি এখন? যদি বাঁচি, তাহলে আমাকে এখন লুকিয়ে লুকিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। ঘেন্নায় এখন সমস্তটা মন কালো হয়ে উঠেছে। কোনোদিন আর আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না। শুনেছি সময়ের অতিক্রান্তিতে সবকিছু হারিয়ে যায়। হয়তো আমিও এক সময় এমনি ঘৃণার মধ্যে বেঁচে থাকার অভ্যস্ততায় সহজ হয়ে উঠবো, হয়তো তখন বেঁচে থাকতে ইচ্ছেও করবে। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে- যেমন বেঁচে থাকতে পারছে তাজিনা, দুলু, মীনা, রঞ্জু–ওদের মতো, কিন্তু সমস্ত জীবন ধরে আমি কি অমন জীবন চেয়েছি?

আমি যে কোনো মতে ভুলতে পারি না, আমি শুভ্র ছিলাম, পবিত্র ছিলাম। জীবনকে ভালোবেসে আমি সুন্দর শুভ্র আর পবিত্র করতে চেয়েছিলাম। আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলাম সেই পবিত্র শুভ্রতার মধ্যে। জন জন ধরে এমনি ভাবে বাঁচবার বড়ো সাধ ছিলো আমার জীবনের কাছে আমি কিছুই চাইনি, শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু ওরা কেউ আমায় বাঁচতে দিলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *