৬
দুটো দিন গেলো। আমার চোখ জ্বালা করছে। মাথা তুলতে পারছি না যন্ত্রণায়। যা ঘটছে চারপাশে, আবছা আবছা দেখছি সব। মাঝে মাঝে ঝাপসা মনে পড়ছে, এক সময় বাবার জ্ঞান ফিরবে আর তখনই আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে সম্মুখে। শুধু এইটুকু মনে রয়েছে, আর সব এলোমেলো।
এক সময় রাহুল এসে ডাকলো, যা ঘুমো একটু, নইলে অসুখ বাধিয়ে বসবি।
মা অনেকবার এসে আমাকে ঘুমোতে বলে গিয়েছে। মা’র কথায় কান দিই নি। কিন্তু সেই মুহূর্তে এতো ক্লান্ত লাগলো নিজেকে, রাহুলের হাত ধরে ঘরে এসে বিছানার ওপর গড়িয়ে পড়লাম তারপর আর কিছু জানি না। নিঃশব্দ অন্ধকারেও মাঝে মাঝে সেই ভুতুড়ে শব্দটা শুনতে পেলাম।
ঘুম ভাঙল রাহুলের ডাকাডাকিতে। উঠে এস্তে ছুটে এলোাম এ ঘরে। রাহুল বলছে, বাবার জ্ঞান ফিরে এসেছে।
আমি এসে দেখলাম বাবা মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন।
ভোরের দিকে জ্ঞান ফিরে এসেছিলো, মা জানাল, আমাকে দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন, আর এদিকে তাকান নি।
কিন্তু আমি বুঝলাম, সব শেষ হয়ে গেছে। দুরন্ত কান্না বুকের ভেতরে তোলপাড় করে উঠলো। এরা জানে না কী হয়েছে। বাবা এদিকে আর কোনোদিন ফিরে তাকাবেন না। ঘৃণায় আর দুঃখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চিরকালের জন্যে। যদি মা জানতো। যদি রাহুল জানতো!
আমি ডাক্তার ডাকতে পাঠালাম। রাহুল নিয়ে এলো ডাক্তার। আমাকে ডেকে বললেন, তোমার মা’র সঙ্গে কি তোমার বাবার সম্পর্ক ভালো ছিলো না।
মাথা নাড়ালাম আমি, সেই মুহূর্তে মিথ্যে কথা বলতে বাধল আমার। জানুক, অন্ততঃ একজন লোকও জানুক, বাবা মরে নি, বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। বললাম, বাবা মা’কে ঘৃণা করতেন।
ডাক্তার স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ালেন। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। তারপর বললেন, আশ্চর্য!
দেখলাম, তিনি রাহুলকে ডাকলেন, কী যেন বললেন, আর রাহুল ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলো।
সব শেষ হবে। এবার প্রায় নিশ্চিত জানা গেলো ভবিষ্যতের কোনো ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পাবো আমরা।
আমি একাকী দাঁড়িয়ে রইলাম। সারা বাড়ির লোক ছুটোছুটি করছে। ডাক্তারের পর ডাক্তার আসছে। উদ্বেগ আর আশঙ্কা! যে মামারা কোনোদিন আসেন নি, তাঁরা এলেন। বাবার বন্ধুরা এলেন, বড় খালা এলেন। খালু সাহেবরা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললেন। আর প্রতীক্ষা করলো সবাই। কখন বাবা বামে হেলানো মাথাটা আবার ডাইনে ফেরান।
সকাল গেলো, দুপুর গেলো, তারপর বিকেল। এক সময় গেটে রিক্সা থামবার শব্দ শুনতে পেলাম। সেই সঙ্গে ব্যস্ত পায়ের শব্দ। আমি সেই মুহূর্তে ছুটে গেলাম। দরজা খুললাম। আনিস।
ও উঠে এলো ঘরে। ওকে দেখে আমি তখনো দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠতে চেয়েছি। ও কিছু বললো না। পিঠে হাত রাখলো। তারপর ধীরে ধীরে উঠোনের দিকে এলো। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে। বোধ হয় আশঙ্কা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসেছিলো ও, সেই আশঙ্কার শেষ সীমানা দেখতে পেলো আমার মুখের ওপর।
ওকে দেখে ঘরের ভেতরে মা কেঁদে উঠলো। আর তক্ষুণি, ঠিক তক্ষুণি ধমকে উঠলো আনিস, চুপ করুন। কাঁদবার অনেক সময় পাবেন পরে।
এই দুটো দিন আমি দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছিলাম আমার সব কান্না। আজ আনিসের কাছে আমার সেই সংযম ভেঙে গেলো।
সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত হলো। আমি বারান্দায়। আনিসের মুখ দেখা যাচ্ছে। চিবুকে দৃঢ় কাঠিন্য দেখতে পাচ্ছি। ওর কপাল ঘামে চক্চক করছে। লালচে হয়ে উঠেছে দুটি চোখই। বোধ হয় রাতে ঘুমোতে পারে নি।
তারপর এক সময় সব শেষ। ডাক্তার কাছে বসে ছিলেন, উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনিসকে ডেকে বললেন, আনিস উই হ্যাভ ট্রায়েড আপ টু দি লাষ্ট, নাউ ইট ইজ এগুেড়। আই এ্যাম সরি।
আনিস ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে দেখলো বাবাকে। তারপর চাদর দিয়ে বাবার মুখ ঢেকে দিলো।
আরেকবার আর্তনাদ করে উঠলো ওদিকে মা। মম, পুতুল, ক’দিন ধরে বুক চাপা ভয় বুকে নিয়ে বেড়াচ্ছিলো, ওরাও কেঁদে উঠলো। আনিস ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমি মম ও পুতুলকে নিয়ে একপাশে চলে গেলাম। পরে শুনলাম, মা আর্তনাদ করছে, আমার কী হবে!
মৃত্যুর পরও থাকে বিস্ময়। মৃত্যুর পরও থাকে জন্মের ইশারা।
খালার মুখেই শুনলাম। বলাবলি করছে, দুটি ছেলেমেয়ে, আরও একটি আসছে।
কী নিষ্ঠুর মৃত্যু। আর কী কুৎসিত জন্ম।
কিন্তু কেউ জানে না, কেউ জানে না। সবার অলক্ষ্যে জীবন আর মৃত্যুর কোন লীলা ঘটে গিয়েছে, তা কেউ জানে না।
.
আনিস তার পর দিনই চলে গেলো।
এবং চৌধুরী বাড়ি যেন তার পেছনে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো, কাদামাটিতে, ধ্বংস স্তূপের মধ্যে মাথা গুঁজে। তার সব অহঙ্কার সব দম্ভ আর সব অহমিকা একেবারে শূন্য হয়ে গেলো। আমি দেখলাম, অনুভব করলাম, কিন্তু বলতে পারলাম না।
এদিকে দোকানের চাবি মা নিজের আঁচলে বাঁধলো। ব্যাঙ্কের এ্যাকাউন্ট বার করে এনে দিলো আকরাম। পোস্টাপিসের পাস বই দু’খানা খুঁজে নিয়ে এলো বেনু।
আমি দেখলাম আর ভাবলাম, এবার হুড়মুড় করে মস্ত দালানটা ভেঙ্গে পড়বে। যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে।
কটা তো দিন মোটে, বাবা নেই। তাঁর দরাজ গলার ভরাট স্বর ঘরগুলোর দেয়ালে দেয়ালে গম-গম করছে না। তাঁর পায়ের বলিষ্ঠ শব্দ বারান্দায় হেঁটে ফিরছে না। মোটে ক’টা দিন, আর এরই মধ্যে সম্পূর্ণ বদলে গেলো চৌধুরী বাড়ি। কী নিষ্ঠুর রকমের শূন্য, কেউ নেই যেন বাড়িটাতে। কেউ না। যতো লোক দেখছি, সব বাইরের। দু’দিনের জন্যে এসেছে যেন, আবার চলে যাবে। মাঝ রাতে যখন প্রবল হাওয়া বয়ে যায়, তখোন দোতলার ভাঙা ঘরগুলো থেকে হুহু করে শব্দ ছুটে আসে। আর আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন করে ওঠে। কোনো প্রেতাত্মা যেন একটার পর একটা পাথর চাপিয়ে দিচ্ছে বাড়িটার ওপর। সারারাত আমার ঘুম আসতে চায় না।
কোন একটা অন্য মেয়ে যেন আমার মনের ভেতরে কথা বলে সব সময়। এখন, এখন কী করবি তুই? কোথায় যাবি? তোর না বড় সাহস ছিলো। ছুটে যেতে চেয়েছিলি শহরের দিকে। নিজের বুদ্ধির ওপর নিজের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে ঘেন্না করেছিলি গাঁয়ের মেয়েদের জীবনকে। তোর না বড় সাহস, তুই ভালোবাসতে গিয়েছিলি। মঞ্জু, এখন? এখন কী করবি তুই! এখন তো করবার মতো কিছু নেই তোর। স্রোতের মুখে কুটোর মতো ভেসে যাওয়া ছাড়া।
আমি সেই মেয়েটার কথা শুনতে পাই, আর ভয়ে সারা বুক হিম হয়ে যায়।
সত্যি তো, কী করবো!
বার বার আমি সাহস করেছি। আর সম্মুখে হাত বাড়িয়েছি সুন্দর হবার জন্যে, আর বার বার বাধা এসেছে একের পর এক। একে একে সেই বাধার পাহাড়, কষ্টের প্রান্তর পার হয়েও দেখতে পেয়েছি সম্মুখে আবার বাধা। আমি আর কতো পারবো। আমার সব সুখ, সব সাধ একে একে মরেছে —হায়রে, মরেই যদি ফুরাতো তাহলে তো কথা ছিলো না। আবার আমি হাত বাড়িয়েছি সম্মুখে, নতুন করে সুখ এসেছে মনে, নতুন করে সাধ জন্ম নিয়েছে হৃদয়ে।
এখন কী করবো আমি!
.
তবু দিনের মনে দিন চলে গেলো। দেখলাম, সেই কখন চৈত্র এসেছিলো আকাশে প্রচুর ভ্রূকুটি আর বুকজোড়া পিপাসা নিয়ে। সেই পিপাসা ছড়িয়েছিলো তীব্র হাওয়ায়। ফুটিয়ে ছিলো শিমুল পলাশ। এখন আসন্ন বর্ষা। মাঝখানে কখন যে ফুটিফাটা গ্রীষ্ম গিয়েছে, দেখতে পাই নি। এখনও কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায় ফুল। দূর দক্ষিণে ঘন সবুজ দেবদারু গাছের মাথার ওপর দিয়ে কালো কালো মেঘ ধেয়ে আসে। কোথাও যেন বৃষ্টি হয়। হাওয়ায় ভাসে সেই বৃষ্টির গন্ধ। আর দেখি আমাদের বাড়ির প্রাচীরের ফাটলে সবুজ শ্যাওলা গজিয়েছে, সেই সবুজ শ্যাওলা শ্যাওলার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বেগুনি রঙের ফুল। লাল লাল ঘাস ফুল ফুটেছে উঠোনের দুপাশে। মাঝে মাঝে যখন চোখ পড়ে, এখন বুঝতে পারি, বড় রাস্তার দু’পাশে জারুল গাছগুলোতে প্রমত্ত হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, এখন বেগুনি রঙের ফুল ঝরে পড়বে রাস্তার ওপর আর দুলবে দূরের শিরিষ ফোটা হলদে রঙের ডালগুলো।
নিঃশব্দ চৌধুরী বাড়ির শান বাঁধানো উঠোনে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখি বাইরের আকাশটাকে, দূরের গাছপালাগুলোকে। ধূসর আকাশে মেঘ ডাকে, ঝিম ঝিম বৃষ্টি পড়ে আর এলোমেলো হাওয়া বয়।
আমার আর কিছু ভালো লাগে না। রান্না ঘরে ইচ্ছে হলে যাই, নইলে যাই না। এখন আমাদের অনেক টাকা। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পাওয়া গেছে কিছু, ইনসিওরেন্সের টাকাও পাওয়া গেছে। আকরাম দোকানে বসছে আজকাল। সেই টাকা খরচ হচ্ছে। রান্নার জন্যে ঝি আছে, মম পুতুলকে দেখবার জন্যে একটা বাচ্চা ছেলে রাখা হয়েছে। আমার প্রচুর অবসর আজকাল।
মা উজ্জ্বল হয়েছে আরও। দেখতে ইচ্ছে করে একেক সময়। দুটো চোখে কালো কালো ক্লান্তি দেখি, তবু ভালো লাগে। মা যেন আবার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আকরাম কোনো কোনোদিন রাতে দোকান থেকে এ বাড়িতে আসে। সকাল বেলা চলে যায়।
কদিন হলো? বাবা মারা যাবার পর কদিন হলো? আমি দেয়ালের ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকাই।
এক মাসও পুরো হয় নি। কিন্তু মনে হয়, যেন কতো দিন হয়ে গেছে।
চল্লিশ দিনে ফাতেহা পড়ানো হবে। তার আয়োজনের কোনো চিহ্ন নেই।
আর এজন্যে আমাকে চিঠি লিখতে হলো আনিসের কাছে।
.
আমার সব ভাবনার মধ্যেও আমি চোখ ফেরালাম বাইরের দিকে। বদলে যাচ্ছে বাইরের জগতটাও। মানুষই শুধু বদলে যায় না। বদলায় প্রকৃতিও। বৃষ্টি এলো, বৃষ্টি গেলো, যে সব গাছে ফুল দেখি নি, সে সব গাছে ফুল ফুটলো। রাস্তার মোড়ে, সেই যে আনিসের সাহিত্যিক বন্ধু চন্দনদের বাড়ি, সেদিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম রঞ্জুর সঙ্গে কদিন আগে। ওদের বাড়ির পাশের বকুল গাছটায় অজস্র ফুল ফোটে। মৌমাছির গুন গুন সারাদিন, তার সঙ্গে মিষ্টি গন্ধ। সেই গুন্ গুন্ স্বর আর মিষ্টি গন্ধে নেশা ধরে আসে। সেদিন আসতে আসতে দেখলাম একটা চাঁপা গাছ। সেখানেও গন্ধের ছড়াছড়ি—মৌমাছির গান। ফুটছে আর নিজেদের ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। এই কি ফুটে ওঠার ধর্ম। শুধু নিজেকে ছড়িয়ে দেয়া। বিলিয়ে দেয়া।
আমি ভাবি আর আমার অবাক হওয়ার পালা। আনিসের সেই বন্ধুকে দেখেও অবাক হলাম। দিনরাত আজকাল লিখছেন।
চন্দনও ফুটে উঠছেন ফুলের মতো। নিজেকে চারপাশে বিলিয়ে দিচ্ছেন। ওঁদের বাড়িটাও কতো আশ্চর্য। এতো লোক বাড়িতে, তবু কারো সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ আছে বলে মনে হলো না। সবাই যেন বিলিয়ে দিয়েছে নিজেদের স্নেহ, প্রীতি আর ভালোবাসায়। ওরা চার ভাই, বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। দু’বোনের এক বোনের বিয়ে হয়েছে, সেও ওদের সঙ্গেই থাকে। ওদের নিজের মা নেই, সৎ মা। তবু ওদের বাড়িটা যেন শান্তিতে ছাওয়া। রঞ্জু কথা বলে যাচ্ছিলো, আমি শুধু দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম এরা কতে। সুখী। সে বাড়ির বৌটি অনেকক্ষণ গল্প করলো রঞ্জুর সঙ্গে। আমাকে দু’একটি কথা জিজ্ঞেস করলো, স্বল্প উত্তর দিলাম, কিন্তু আলাপ জমলো না।
আমি যে দেখছিলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করছিলাম এরা সুখী-কিন্তু কোথায় এদের সুখ? এরা সুখী কিন্তু আমরা সুখী হতে পারলাম না কেন? আর সবার থেকে এরা কেমন করে আলাদা থাকতে পারছে। ধ্বংসের স্রোতের মাঝখানে এরা যেন সুখের একটুখানি দ্বীপ।
পথে রঞ্জু জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগলো।
মনে হলো ওরা খুব সুখী।
সুখী না ছাই। ঠোঁট উল্টালো রঞ্জু। যা দেখছিস ঐ বাইরেই। আমি তো প্রায়ই আসি, সব জানি। ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট ওদের। টাকা পয়সার অভাবে কতোদিন রান্না চড়ে না। ওই বউটার সঙ্গে কারো বনিবনা হয় না। বড় ছেলে সংসারের দিকে উদাসীন।
আমি ওর কথায় বিস্ময় বোধ করছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেসে উঠলাম। বললাম, এমনি বনিবনা না হলে কিংবা সংসার সম্বন্ধে উদাসীন হলেই বুঝি সুখী হওয়া যায় না। ওরা কেমন সুন্দর একে অন্যের জন্যে ভাবে। আমার খুব ভালো লাগলো। আমার থাকতে ইচ্ছে করছিলো ওদের ওখানে আরও কিছুক্ষণ।
রঞ্জু চোখ বড় বড় করলো, ওমা, তাই নাকি! না দেখেই এমন, দেখলে না জানি কী করবি?
আমি ওর ঠাট্টা বুঝছিলাম না। ওর দিকে তাকাতেই ও বললো, বুঝলি না?
না।
ও-বাড়ির মেজো ছেলে চন্দনকে দেখেছিস?
না।
ওর তো বিয়ে হয় নি। যদি রাজি থাকিস, তা’হলে-
তাহলে কী?
চেষ্টা করে দেখি।
পারবি? আমি এবার পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
পারবো না মানে?
না পারবি না, আমি হাসলাম।
কেন পারবো না!
প্রাণ থাকতে পারবি? কোনো মেয়ে তো পারে না।
থাক বাপু থাক, আর বলতে হবে না। রঞ্জু লজ্জায় রাঙা হলো। জানিস আব্বা সেদিন বলছিলেন……
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, ওর কথা শোনার জন্যে।
তক্ষুণি আহসানের কথা মনে পড়েছিলো আমার। রঞ্জু যেন লক্ষ্য করলো আমাকে, তারপর সহজ হাসিতে উড়িয়ে দিতে চাইলো, এতক্ষণের আলাপ। বললো, যাক ভাই ওসব কথা, আমার ঘর তো ঠিক হয়েই আছে। আহসানকে না পেলে মরতে হবে আমাকে। কিন্তু জানিস? রঞ্জু বেন কিছু জানাতে চাইলো একটু পর।
কি।
লোকটা বড় বেহায়া। আর চালচলন কি বিচ্ছিরি। বারান্দার ওপর কায়দা করে বসে থাকবে আর ড্যাব ড্যাব করে চোখ মেলে তাকাবে। আমি একবার ও-পথ দিয়ে গেলেই হয়েছে। যতোক্ষণ দেখতে পাবে, ততোক্ষণ তাকিয়ে দেখবে। আমার গা জ্বালা করে একেক সময়।
মিথ্যুক, তুই মিথ্যুক রঞ্জু, আমি তখন মনে মনে বলেছি। নিজেকে শুধু লুকোতে চাস। সাহস নেই তোর সত্যি কথা স্বীকার করে নেবার। আহসানের কাছে মিথ্যুক তুই, আমার কাছে মিথ্যুক, আর তোর নিজের কাছে, নিজের কাছেও তুই মিথ্যুক। ওকে কোনো কথা বললাম না। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুধু।
ও একটু হোঁচট খেলো পথ হাঁটতে। বললো, কিরে কী দেখছিস?
না, কিছু না।
না ভাই, তুই কিছু ভাবছিস?
হ্যাঁ ভাবছিলাম, আহসান খুব ভাগ্যবান।
কেন?
তুই ওকে কতো গভীরভাবে ভালোবাসিস তা যদি জানতো!
রঞ্জুর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। অবশ্যি ততক্ষণে আমার বোঝা হয়ে গিয়েছে যে, আমি যদি আহসানের কথা না তুলে আনিসের লেখক বন্ধুর কথা বলতাম, আর জানাতাম ও তোর প্রেমে পড়ে গেছে বলেই অমন করে তাকিয়ে দেখে, তাহলে খুশি হতো খুব।
রঞ্জুকে আজ আমার অবাক লাগলো। আমি বুঝতে পারি, জামিলের এখন আর কোনো আকর্ষণ নেই যে ওকে কাছে টানতে পারে। এরই নাম কি প্রেম, এরই নাম কি ভালোবাসা? শুধু একটুখানি ছেলেমানুষী? জীবনের ওপরকার একটুখানি কাঁপন শুধু! তাহলে, এদের জীবন কি ছোট্ট একটুখানি শান্ত জলাশয়, যেখানে একটু ঢিল ফেললেই কাঁপন জাগবে?
.
আজ দুপুরে আনিসের চিঠি এলো। আমার মন এতো খুশি তখন। নিজের খুশি লুকোবার কোনো চেষ্টাই করলাম না। পিয়ন চিঠিটা দিয়েছিলো মম-এর হাতে। মম মায়ের হাতে দিতে যাচ্ছিলো। আমি মম-এর হাত থেকে ছোঁ মেরে নিলাম। দেখলাম ওর হাতের লেখা, সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আমার তখন লজ্জা। কোথায় লুকোই এ লজ্জা! নিজেরই কাছে লজ্জা লাগছিলো। চোখ তুলতেই দেখি, মা দাঁড়িয়ে আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। জিজ্ঞেস করল, কার চিঠি?
জানি না, কেমন করে, কিভাবে, সহজেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল- আনিস লিখেছে।
আনিস ভাই নয়, বড় ভাই নয়, শুধু আনিস। মা বোধহয় বুঝতে পারে নি প্রথম। আবার জিজ্ঞেস করলো, কোন আনিস?
আনিস ভাই, আমাদের আনিস ভাই। কথাটা বলে পায়ে পায়ে চলে এলাম আমার নিজের ঘরে।
সেই চিঠিটায় আমার সারাজীবনের ভাবনা রয়েছে। আনিস নতুন কথা লিখেছে। আর সে কথার পর আমার আর কোনো কথা থাকবার নয়।
“মঞ্জু, তোমার চিঠি পেয়ে উত্তর লিখছি। কিছুদিন ধরেই আমি একটা কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু পারি নি। নানা রকমের চিন্তা, নানা রকমের সমস্যা আমার চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাবা মারা যাবার পর আমি নতুন করে বিচার করলাম সবকিছু। আর বুঝে দেখলাম, এই প্রথম অনুভব করলাম-এ ছাড়া আর অন্য কোনো পথ নেই।
তুমি তো জানো, মানুষের মন বড় বিচিত্র। আমাদের জীবনের চারপাশে এতো জটিলতা, এতো সমস্যা, এতো সঙ্কট যে একেক সময় আমরা নিজেদেরও চিনে উঠতে পারি না। আমি কোনোদিন ভাবি নি তোমার কথা আমাকে এমন গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে। ঢাকা থেকে ফিরে এসে তোমায় দেখে আমার যখন ভালো লাগলো, তখনও না। কেন না তখন পর্যন্ত তুমি সুন্দর বলেই তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছি। আমি আর দশজন পুরুষ মানুষ থেকে আলাদা ছিলাম না। পরে আমার এ মনোভাব আমি বিচার করে দেখেছি।
।হ্যাঁ, তুমি দেখতে সুন্দর, এটাই যেন মস্ত আকর্ষণ ছিলো আমার কাছে। তোমাকে যে হাতে স্পর্শ করেছি, তখন সেটা ক্লেদাক্ত লোভী হাত। জানি না, তুমি তা টের পেয়েছো কি না।
তারপর আমি পালাতে চেয়েছি আমার সেই লোভ থেকে, আমার নিজের ব্যক্তিত্বের আত্মাবমাননা থেকে। কিন্তু পালাতে চাইলেই তো আর তা পারা যায় না। আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারি নি।
যখন জানলাম পারবো না, তখনই আমার কাছে বড় হয়ে উঠলো বাইরের লোকের সমালোচনা। কিন্তু সেটাও হয়তো অস্বীকার করতে পারতাম। কিন্তু আরও বড় হয়ে দেখা দিলো, আমার নিজেরই শিক্ষিত মনের সংস্কার। বার বার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি, এ আমি কী করলাম। যে পথে কোনোদিন হাঁটতে পারবো না, সে পথের ওপর পা রাখলাম কেন?
দিনের পর দিন ভাবলাম। যুদ্ধ করলাম নিজেরই সঙ্গে। চেষ্টা করলাম তোমার কথা না ভেবে থাকতে, কিন্তু পারলাম না। তোমাকে নিজের থেকে আলাদা ভাবতে গেলেই নিজেকে ভয়ঙ্কর শূন্য লাগতো। দিনের পর দিন ঢেউয়ের জল সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম, আর সেই বিপুল আর অজস্র জলের ঢেউ আমাকে আচ্ছন্ন করে দিতে চাইলো। এ যে কি যন্ত্রণা কেমন করে বোঝাবো। অবশেষে সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে হলো। এছাড়া অন্য কোনো সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছানো সম্ভব ছিলো না আমার পক্ষে।
মঞ্জু ভুল বুঝো না। আবেগের মুখে যেমন দু’টি মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি এসে বলে, ভালোবাসি–আমার এ সিদ্ধান্ত তেমন আবেগের মুখে আসে নি। কেন না আবেগের সেই তীব্র যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো অতিক্রম করে আসার পরও আমি ভেবেছি। চিন্তা করেছি। আর বারবারই আমাকে একই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছতে হয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে চাই।
এমন কথা বলি না যে, তোমাকে জীবনের কাছাকাছি না পেলে আমি বাঁচবো না। আজীবন আকাঙ্ক্ষা করেও মানুষ কোনো জিনিস পায় না, এবং তারপরও বেঁচে থাকে। কিন্তু বেঁচে থাকা এক আর সুন্দরভাবে, জীবনকে ভালোবেসে বাঁচা অন্য কিছু। জীবনে তোমাকে না পেয়েও আমি বাঁচবো। কেননা বেঁচে থাকাটা আমাদের জীবনের স্বাভাবিক অভ্যাস। কিন্তু সেই বাঁচায় আমার লাভ কী। সব আনন্দ, সব সুখ, সব সাধ যদি আমার মরে যায়, তাহলে নিঃশ্বাস নিয়ে আর কতগুলো খাদ্য চিবিয়ে বেঁচে থাকায় কী লাভ? এ সিদ্ধান্তে এসেও আমি অপেক্ষা করেছি—কেমন করে তোমাকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানাবো। আবেগের মুখে তোমাকে যেভাবে জেনেছি, সেটা আমার সব জানা নাও তো হতে পারে। তোমাকে সম্পূর্ণভাবে জেনেছি—এমন বিশ্বাস এখনও মনে আসে নি। আর সে জন্যেই আমি সারা মনে ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছি।
সেবার গিয়ে দেখে এলাম—তুমি আমার চেয়েও অনেক বেশি ভেবে বসে আছো। তোমার মা, আকরাম, বেনু –এদের দেখেছো, আর যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছো। এই অপমান আর যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো অতিক্রম করতে করতে নিজের অলক্ষ্যেই কি না কে জানে, তোমার মনের ভয়, দ্বিধা, সন্দেহ সব বাধা পার হয়ে সিদ্ধান্তের শক্ত ভূমিতে এসে দাঁড়িয়েছো।
তারপর বাবার মৃত্যু। সে মৃত্যু যে স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলো না, বাবাকে হত্যা করা হয়েছিলো- তা তোমার মুখ দেখেই বুঝেছিলাম আমি। এবং তখনই লোভের আর বিকৃতির শেষ সীমানার সঙ্গে পরিচয় হলো। বুঝলাম, আমার সুখ সাধ আর ভালোবাসাকে যদি হত্যা করি, তাহলে হয়তো আমিও শেষে অমন বিকৃত হয়ে যাবো। তোমার মা’র ওপর প্রথম প্রথম ঘৃণা হয়েছিলো আমার। পরে আমার দুঃখ হয়েছে। জীবনে সুন্দরকে যে খুঁজে পায় নি, চেষ্টাও করেও সে কেমন করে সুন্দর হবে, সুস্থ হবে।
জানো, আমার সব ভাবনার মাঝখানে ছড়িয়ে রয়েছো তুমি। মাঝে মাঝে এতো দেখতে ইচ্ছে করে।
কি ভাবছো জানতে দিও।–আনিস।
.
চিঠিটা পড়েছি বারবার। আরও কতগুলো পারিবারিক খবরাখবর ছিলো। আমি সেগুলোর কোনো গুরুত্ব দিই নি। এই অংশটুকু নিয়েই ভেবেছি। প্রথমে কান্না পেয়েছিলো আমার ক্ষোভে। আনিসকে এত সাধারণ আর ছোট ভাবতে আমার দারুণ কষ্ট হচ্ছিলো। বার বার প্রশ্ন তুলেছি—কেন এতো কথা লিখলো আনিস, কী দরকার ছিলো। তারপর আবার পড়লাম। তারপর আবার। আর ধীরে ধীরে, একটু একটু করে বুঝলাম; আনিস নিজের মনকে খুলে ধরেছে। নিজের ভুল-ত্রুটি সংশয়-সন্দেহ সবকিছু লিখে জানিয়েছে। এতোখানি আপন তো কোনো মানুষ হতে পারে না সহজে। চিঠিটা এতো সুন্দর লাগলো তখন। নির্জন ঘরে অস্ফুট স্বরে, শুধু নিজের মনকে শুনিয়ে শুনিয়ে ডাকলাম, আনিস, তুমি এতো সুন্দর হলে কেমন করে!
আমার এখন শুধু লেখা। কোনো কাজ নেই হাতে।
আনিসের ওখান থেকে রাহুল এলো। ওর হাতে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছে আনিস। নিজে আসতে পারবে না। কয়েকদিন পরই ওকে লাহোর যেতে হবে মাস কয়েকের জন্যে।
.
বাবার ফাতেহা হলো। কয়েকটা দিন বেশ কাজে কাজে গেলো। তারপর আবার সেই নিরুদ্বেগ নিঃস্রোত জীবন। ছোট আপা বৈরুত থেকে চিঠি লিখেছে এরই মাঝখানে। লিখেছে, “মঞ্জুরে আমার সব চাওয়া যদি পূর্ণ হতো, তাহলে আমি এতো দূরে আসতাম না। দেশে ফিরে গিয়ে এরপর ভালো চাকরি করবো, উঁচু সোসাইটিতে মিশবো। কিন্তু আমার যে বড় সাধ ছিলো সুখী হবার, যে কথা কোনো মতে ভুলতে পারি না।
চিঠি পড়তে পড়তে ছোট আপার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। বিদেশে আসার জন্যে স্বাস্থ্য আর যৌবন থাকলে মেয়েদের যা যা করতে হয়—আমাকেও তা করতে হয়েছে। কতখানি নরকে নামতে হবে জানতাম। তবু আমি করেছি। এও নিজেকে হত্যা করা। সবচেয়ে কি আশ্চর্য জানিস, যে আমাকে নিয়ে পুতুল পুতুল খেলছে—সেই আমাকে এখন ঘরের স্বপ্ন দেখায়। মঞ্জু রে, সেইখানে যে আমাৱ সব চাইতে বড় অপমান। আমার মতো ভুল তুই করিস না। জীবনকে সুন্দর করে তুলিস, যে কোনো মূল্যেই হোক।”
কেউ জানতো না ছোট আপা কোথায়। বাবার অসুখের টেলিগ্রাম ছোট আপার হাতে পৌঁছায় নি। তার অনেক আগেই ছোট আপা বিদেশ গিয়েছে। বাবার মৃত্যুর খবরও বোধ হয় জানে না। ছোট আপাকে সব খবর জানিয়ে চিঠি লিখলাম।
আর লিখলাম আনিসকে। লিখলাম, আমার সব ভাবনা, সব চিন্তা থেকে ছুটি নিয়েছি। আমি আর কিছু জানি না। জানি শুধু তোমাকে। আর কিছুই ভালো লাগে না আমার। কবে আসবে?
রাহুল ফিরে গেল পাবনা। আবার আমার একাকী সময়। বই আর খাতা নিয়ে সময় কাটাই। মাঝে মাঝে দুঃখ হয়, কেন লেখাপড়া শিখলাম না। দু’একটা পাস থাকলে তবু যাহোক কিছু কাজটাজ করতে পারতাম। পাশ না থাকলে তো আর চাকরি পাওয়া যায় না। আর কী অসহ্য লাগে একেক সময়।
কিন্তু কে জানতো, এই সময়টুকু স্রোতের শুধু বাঁক ফেরা স্তব্ধতা। গভীর প্রবাহে আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্তটুকু, যখন ওপরের স্রোত অচঞ্চল অথচ ভেতরে ভেতরে তীব্র টানে টানছে অনেক নিচের মাটি।
আমার দুচোখ ভরে এত দেখবার আর ভালোবাসবার সময়টুকু মেঘলা আকাশে একটি তারার আলোর মতো একাকী আর স্বল্প।
আকরাম দোকান দেখতো আর এ বাড়িতে রাতে থাকতো। এমনি বেশ কিছুদিন গিয়েছে। এখন আসে না নিয়মিত। মাঝে মাঝে আসে। দোকান থেকে যে টাকা দিতো আগে, আজকাল আর তা দেয় না। ব্যাংক থেকে টাকা আনতে হয়। ইনসিওরেন্সের টাকাটা পেতে দেরি হবে। পোস্টাপিসের এ্যাকাউন্ট এখন সব ব্যাঙ্কে জমা হয়েছে।
ক’দিন ধরেই শুনছি, আকরাম নতুন ব্যবসায়ে হাত দেবে। তার জন্যে টাকা দরকার। দোকান থাকবে বেনুর হেফাজতে আর আকরাম নামবে ব্রিক ফিল্ড করতে।
দোকান থেকে কিছু টাকা পাওয়া গেছে, এখন বাকী হাজার দশেক পেলেই আরম্ভ করতে পারে ব্যবসাটা। মাকে বুঝিয়েছে, দেখো না, মোটে তো একটা সিজন, দেখো তোমার দশ হাজারই পনেরো হাজার হয়ে ফিরে আসে কি না।
আমি ওদের পরামর্শ শুনেছি। মা ইতস্ততঃ করেছে একটু একটু। আর সেই অবকাশে মম আর পুতুলকে মা’র সামনে এনে ধরেছি। বলেছি, টাকা বাড়াবার চিন্তা না করে এদের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করো, তাহলেই ভালো কাজ হবে।
মা দেখেছে মম পুতুলকে। মনে মনে কষ্ট পেয়েছে—এও ঠিক। কিন্তু আমি জানি, মা’র এমন শক্তি নেই যে ওকে টাকা না দিয়ে পারে। আকরাম কয়েকদিন এলো না, আর যা ওর খোঁজে লোকের পর লোক পাঠালো। দিনের পর দিন ঘরবার করলো। উদ্বাস্ত হলো। কয়েকদিন পর আকরাম নিজেই এলো। এসে বললো, আমি অন্য জায়গা থেকে টাকা পাচ্ছি, আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা।
মা সেই রাতেই আট হাজার টাকার চেক কেটে দিয়েছে।
মা এখন আকরামের জন্যে সব করতে পারে। হ্যাঁ, সব। শরীরের আবেগ আর উল্লাসকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে একটা উৎকট চেষ্টা রয়েছে মা’র। আর সে সেজন্যই মা আকরামের পায়ে সবকিছু ঢেলে দিয়ে বসে আছে।
টাকাটা ফিরে এলো না। ইট কাটা হলো, কিন্তু পোড়াবার অনেক আগেই নাকি বৃষ্টিতে ইট গলে ক্ষতি হয়ে গেলো। মা শুনল। ব্রিকফিল্ড বন্ধ করে দাও, বললো।
কিন্তু এখন আর পিছিয়ে আসবে কি। পেছোবার উপায় থাকলে তো? টাকাটা অমনি অমনি গেলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম দূর থেকে। বাবা অতিকষ্টে টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকা নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা হবে যদি জানতেন?
তারপর দোকান। আবার দোকানে ফিরে এসেছে আকরাম। এই মাস দুয়েক ছিলো বেনু। এখন দু’জনায় দিনরাত খিটিমিটি লেগেই আছে। আকরাম এসে জোর গলায় চিৎকার করে এ বাড়িতে। বলে, বেনু ধ্বংস করে দেবে দোকানটা। আজকাল ও জুয়ার টেবিলে অনেক টাকা-পয়সা নষ্ট করছে, দোকানে কোনো স্টক নেই।
এরই মাঝে মা’র সাথে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল আকরামের। মা গালাগালি দিয়ে যেতে লাগলো, আর আকরাম গজরাতে লাগলো ঘরের ভেতরে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম। সে রাতে ঠিক বুঝতে পারি নি। পারলে কি আর আমাকে বিপদে পড়তে হয়। যদি বুঝতাম আমাকে নিয়েই এতো ঝগড়ার সূত্রপাত।
আকরাম গোঁয়ার লোক। ধীরে কাজ করে না। সে জন্যেই বোধ হয় বোকা আর নিষ্ঠুর।
একদিন সকালে হঠাৎ আমার কাছে এসে বললো, আজকে চল, আমার বাড়িতে তোরা বেড়িয়ে আসবি।
আমি মাথা নাড়লাম, না, আজ নয়। অন্য কোনোদিন দেখা যাবে। আকরাম আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সেদিন বিদায় নিয়েছে। ওর অমন দৃষ্টি আমি কোনোদিন দেখি নি। সেদিন নিঝুম দুপুর, ঘরের মেঝেতে শানের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমের মাঝখানেই হঠাৎ মনে হলো, কেউ যেন আমাকে চেপে ধরেছে। জেগে উঠেই ধড়মড় করে উঠতে গেলাম। পারলাম না। তখন আমার ঘুমের ঘোর কেটেছে আর আমি চিৎকার করে উঠেছি প্রাণপণে। আমার দু’কাঁধের ওপর দু’হাত রেখে জোর করে মেঝেতে ধরে রাখতে চেষ্টা করছে আকরাম। আমি প্রাণপণ চিৎকার করছি আর নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছি।
কোথা থেকে কী হলো জানি না। বাইরে দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেলো এবং ঘরের ভেতরে কেউ যেন এলো। তার একটু পরই আকরাম আর্তনাদ করে গড়িয়ে পড়লো। আমি ততোক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছি। দেখি আমার সামনে ঘুম ভাঙ্গা চোখে মা দাঁড়িয়ে, সঙ্গে বেনু। ওর হাতে কয়লা ভাঙা লোহাটা।
বেনু তখনও আপসাচ্ছে রাগে। আমি এদিকে থরথর করে কাঁপছি। ওদের দিকে তাকাবার মতো অবস্থা ছিলো না আমার।
আঘাতটা জোরে দেয় নি বেনু। জখম হয়েছে সামান্য। বেনুই আকরামের মাথায় পানি ঢেলে ওকে সুস্থ করে তুললো। একটু পর জ্ঞান ফিরলো আকরামের। উঠে বসলো। মা গালাগাল দিয়ে চললো একটানা। বললো, বলে দিই নি ওসব এখানে চলবে না। বেরিয়ে যাও এ বাড়ি থেকে। তোমার মুখ দেখলেও পাপ হয়। ছোটলোক, কুকুর কোথাকার।
থেমে থেমে বললো মা, আমার সর্বনাশ তো করেছ, এখন মেয়েটার জীবনও নষ্ট করতে চাও।
বেনু জোর গলায় হেসে উঠলো। ওর গলায় বিদ্রূপ। বললো, এ যাত্রা বেঁচে গেলি, পরের বার কিন্তু হাতটা বেসামাল হবে না।
আকরাম চলে গেলো। কতগুলো টাকা আর দোকানটা শেষ করে ও চলে গেলো। আর এখন মা’র সর্বগ্রাসী পিপাসা শান্ত হয়েছে। মা আজকাল কেবল কাঁদে। টাকা পয়সার বড় অভাব। বেনু কোনোদিন টাকা দিয়ে যায়—কোনোদিন যায় না। একেকদিন উনুনে হাঁড়ি চড়ে না।
এ সঙ্কট বাড়লো একদিন দু’দিন করে। এ কাউকে দেখানোও চলে না। বোঝানোও চলে না। যদি আমার হাতের দু’গাছি চুড়ি বিক্রি করতে হয় কিংবা কারুর কাছে হাত পাততে হয় –তাহলে সেটা চারপাশের পরিচিত আর দশটা ঘটনার মতই মামুলি মনে হবে। কিন্তু এ ঘটনার ভেতরকার যে জ্বালা রয়েছে, যে নিঃস্ব অসহায়তা রয়েছে, তা শুধু দেখে বোঝা যায় না।
অভাব দারিদ্র্য এসব কতো পরিচিত শব্দ। কিন্তু ক্ষুধা-একটা ক্লান্তিকর অস্বাভাবিক রকমের দীর্ঘ সময়কে উদ্দেশ্যহীনভাবে অতিক্রম করে যাওয়া অথবা ধৈর্যের শেষ ধাপে পা রেখে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুভব করা, কেমন করে আমার সমগ্র চেতনা হলুদে একটা গুহার মধ্যে নেমে যাচ্ছে, আর যতোই নেমে যাচ্ছে, ততোই গভীর অবসাদ শরীরের পেশিতে পেশিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে, দেহের প্রতিটি গ্রন্থি শিথিল হয়ে মিশে যাচ্ছে স্বাদহীন, বর্ণহীন, নিরবোধি একটা ধূসরতায়—এই ক্ষুধা চিনতাম না, বুঝতাম না। সুস্থ অবস্থায় যে ক্ষুধাকে বোঝা যায় না, এখন সেই ক্ষুধাকে বুঝলাম। মম পুতুলকে ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদতে দেখতাম, কষ্ট হতো আমার প্রথম প্রথম। তারপর এক সময় সেই চেতনাও হারিয়ে ফেললাম। দশটা স্বাভাবিক ঘটনার মতোই মনে হতে লাগলো।
ঝি আর চাকরটা বিদায় নিয়েছিলো। তবে বেনু ঠিক আসতো। ওরই মারফত আমার দু’টো একটা গয়না বিক্রি করতে পাঠাতাম। গয়না বিক্রির টাকায় কিছুদিন বেশ চললো, তারপর আবার সেই ক্ষুধা। আবার সেই বাচ্চাদের কান্না। বেনু যে দোকানটা শেষ করে দিচ্ছে তা বুঝতাম কিন্তু কিছু বলবার কোনো ক্ষমতা নেই এখন আমাদের। কেমন করে বলবো। ও-ই এখন আমাদের শেষ আশ্রয়।
এরই মাঝখানে চিঠি আসতো আনিসের। অন্য সময় হলে যে মা কী হাঙ্গামা বাধাতো বলতে পারি না। একটা কিছু গোলমাল বাধাতো নিশ্চয়ই। কিন্তু এই দুঃখের দিনে মা অন্যদিকে লক্ষ্য রাখে নি। দেখেও যেন দেখতে পায় নি। সেই চিঠি টেবিলে পড়ে থেকেছে। মা আনিসের হাতের লেখা চিনতে পেরেছে, বেনু সেই চিঠি হয়ত খুলেও পড়েছে-দেখেছি এখন ওর মুখে বিচিত্র হাসি, ঈর্ষায় কালো আর শক্ত হয়ে উঠেছে মুখের ভঙ্গি—কিন্তু কিছু বলে নি। না বেনু, না মা।
.
একটি মানুষের মধ্যেই যে বাস করে একাধিক মানুষ। একজনের ভেতরেই থাকে অনেক কয়টি ব্যক্তি। তা যদি না হতো, তাহলে মানুষকে জানবার আগ্রহ থাকতো না আমাদের। কোনো পরিবেশে কার যে কোন রূপ ফুটে উঠবে কেউ তা বলতে পারে না। একজনের মধ্যেই অনেক মানুষ বাস করে বলেই তো মানুষ বড় বিচিত্র।
বেনুকে লক্ষ্য করে দেখছি — আজকাল মাঝে মাঝে ও কিছু যেন ভাবে। মম-পুতুলের দিকে চোখ পড়লেই ও চোখ ফিরিয়ে নেয়। যেদিনই মমকে পুতুলকে দেখে সেদিনই কিছু না কিছু খাবার জিনিস ওদের হাতে এনে দেয়।
সব চাইতে অসহায় দেখায় এখন মা’কে। দিনের পর দিন যাচ্ছে মা’র মুখে জীবনের যে পরিপূর্ণতার ছায়া দেখেছিলাম, তা যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। মা মাঝে মাঝে কাঁদে। কোনো কোনো দিন খায় না। দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে। শরীরে রক্ত নেই, চোখমুখ হলদে হয়ে এসেছে— হাত-পা ফুলে উঠেছে-চোয়ালের শক্ত হাড়টা বিশ্রী রকম জেগে উঠেছে।
এই এ্যাডভান্সড স্টেজ-এ এসব ভালো লক্ষণ নয়—ডাক্তার সেদিন মন্তব্য করলেন। খুব ভালো নিউট্রিশন দরকার এখন ওঁর। আপনি ওঁকে দেখবেন একটু নিজের থেকে। নতুন ডাক্তার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে গেলো।
জীবনের এও এক রূপ। মাঝে মাঝে সোনা বিক্রি করা টাকায় বাড়িতে যখন দু’দিনের স্বচ্ছলতা আসে তখন আমি ভাবতে বসি। শরীরময় আজকাল এতো ক্লান্তি আমার। সেইসব ক্লান্তির মুহূর্তে একাকী থাকতে ইচ্ছে করে। আর সেই একাকী সময়েই ভাবনাগুলো আসে একে একে। জীবনকে দেখি আর আশ্চর্য লাগে। জীবনের বাইরে ভেতরে কি অদ্ভুত পরিবর্তনের ধারা সব সময় বইছে। আমরা কখনও তা দেখতে পাই না-বোধহয় তা কখনোই দেখা যায় না। কোনো কোনো সময় অশেষ স্তব্ধতা নিয়ে যদি লক্ষ্য করা যায় চারপাশে, যদি অনুভব করা যায় চারপাশের ঘটনাগুলোকে, তাহলেই বোঝা যায়—তাহলেই চোখে পড়ে—পরিবর্তনের এই সূক্ষ্ম আর ধীর প্রবাহকে।
ক’টা তো মোটে মাস—কিন্তু কী দ্রুত পরিবর্তন ঘটলো চৌধুরী বাড়িতে। আমার চোখের সামনেই দেখলাম পরিচিত লোকগুলো কী রকম বদলে গেলো।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে–কী সেই শক্তি যা আমাদের এমন নিষ্ঠুর হাতে বদলে দিচ্ছে। নিয়তিই মানুষের মনকে নতুন থেকে নতুনতর ছাঁচে ফেলছে আর সেই ছাঁচ থেকে অন্য আদলে, অন্য চেহারায় এনে ধরছে চোখের সম্মুখে। এরই নাম কি সময়! শুধু কি সময় নামের সেই যাদুকরী শক্তিই সব কিছুর নিয়ামক। না আছে অন্য কোনো শক্তি সবারই ভেতরে? যা চারপাশের ঘটনা বা জগতকে বদলে দিচ্ছে, আর সেই রূপান্তরিত জগতই আবার শক্তিমান হয়ে বদলে দিচ্ছে মানুষকে। পরিবর্তনের এই নিরবোধি প্রসারকেই হয়তো বলা যায় সময়—কিন্তু কী সেই শক্তি যার এতো লীলা।
যন্ত্রণা, আনন্দ, ক্ষুধা, পিপাসা – তারপর আবার উদার আকাশ, সবুজ গাছপালা, উতরোল হাওয়া—শরীরের ভেতরে রক্তে রক্তে কতো ঝঙ্কার, অনুভূতির গহনে কতো অশেষ গান—আমি সব অনুভব করি আর মুগ্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে আমার। কী বিচিত্র পৃথিবী। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, সব কিছুর অন্তরালে যেন একটি গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে, যা আমি জানি না, কোনো দিন কেউ জানে নি অথচ যা জানবার জন্যে মানুষ চিরকাল ধরে উন্মুখ হয়ে চেষ্টা করেছে। একেক সময় মনে হয়, আমিও যেন কিছু বলতে চাই। আমারও কিছু জানাবার আছে।
আমি এই ভাবনার কথা আনিসকে লিখি। ও চিঠি লেখে আরো দীর্ঘতর। লেখে, তোমার এই ভাবনার কথা কাগজে লেখো না কেন তুমি? উত্তর দিই, না নাম করবার সাধ নেই। যতো তাড়াতাড়ি পারো, ফিরে এসো তুমি কত দিন দেখি নি! আর কতোদিন? আমার সব সাধের কথা লিখি, কিন্তু কক্ষনো লিখি নি আমার এই ক্ষুধার কথা—এই ক্লাস্তির কথা। কেননা জানি, এখনকার অবস্থা জানলে ও ট্রেনিং শেষ হবার অনেক আগেই চলে আসবে উদ্বিগ্ন হয়ে। হয়তো চাকরি ছেড়ে দেবে। তার চেয়ে, তার চেয়ে—এই ভালো।
গভীর রাতে মা’র কান্না শুনি। করুণ কাতরানি ভেসে আসে কোনো কোনো রাতে। আমার ঘরে শুয়ে শুনতে পাই। আমার ঘুম আসে না সে রাতে। মনে হয় চৌধুরী বাড়ি ভেঙে তলিয়ে গিয়েছে মাটির নিচে। আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যেন কোনো শিশুর অভিশপ্ত আত্মার করুণ আর কাতর কান্না ধ্বংসস্তূপের ইট বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে।
মা নিজেকেই শুনিয়ে শুনিয়ে বিলাপ করে-এ আমি কী করলাম, আমার বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটোর কী হবে। কোথায় দাঁড়াবে ওরা।
বেনু সে কান্না শুনেছে কিনা কে জানে। একদিন বেনু আকরামকে ধরে নিয়ে এলো। আকরাম এখন অনেক বদলেছে। ঝকঝকে চেহারা। দামী স্যুট পরণে, পায়ে নজর-পিছলানো জুতো, গলায় রঙিন টাই, চোখে সানগ্লাস। ওর বয়স যেন দশ বছর কমে গিয়েছে। ওর মুখে ছিলো দামী সিগ্রেট। বাড়ির চারপাশটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। মার ঘরে বসলো কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেলো।
ও চলে যাবার পর মা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে।
কেন এমন হয় জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, যা বোধহয় বাবার কাছে ভীষণ অসুখী ছিলো। আর সুখ পেয়েছিলো বাইরের এইসব লোকদের কাছে। আর সেজন্যেই হয়তো মা আকরামের জন্য সবকিছু করতে পারে।
জটিল, বড় জটিল এই জীবন আর মানুষের মনের এই ভেতরটা।
.