পিঙ্গল আকাশ – ৫

আমি এখন ফের একাকী। দাদু মারা যাবার পর আরও বেশি একাকী লাগছে নিজেকে। আমার মন ছেয়ে যে শূন্যতা নেমেছিলো, তা যেন কাটছে না কোনোমতেই। কাটতো হয়তো। যদি বাবা আসতেন বাড়িতে রোজ, যদি রাহুলের সঙ্গে আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু ওরা কেউ আসে না। আর যদি বা আসে, কখন যে চলে যায়, টেরও পাই না। প্রকাণ্ড বাড়িটা এখন সারাদিন খাঁ খাঁ করে। ওপর তলার ফাঁকা ঘরগুলোর ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ হাওয়া বয়ে যায়। মাঝে মাঝে হাওয়ার ঝাপটায় দরজা-জানালাগুলো আছাড় খায়। সেই শব্দ কেঁপে কেঁপে নামে দেয়াল বেয়ে নিচুতলা পর্যন্ত।

কী যেন একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্ক চেপে ধরেছে এতোবড় বাড়িটাকে। সেই ভয়ঙ্কর আশঙ্কা বুকে চেপে আছে আমার। ঠাণ্ডা পাথরের মতো। মম পুতুল পর্যন্ত ভয়ে কথা বলছে না। কী যে হয়েছে, কেউ জানে না। এখন এক একটা দিন তো নয় যেন এক একটা যন্ত্রণার যুগ। সেই নিঃস্ব ঠাণ্ডা নিঃস্তব্ধতার পাহাড়ে মাঝে মাঝে আকরাম কিংবা মায়ের হাসি মৃদু শব্দ করে হারিয়ে যায়।

আর আছে বেনু। বারবার আসে ও। এসে দাঁড়াতে চায় আমার সম্মুখে। মা এই নিয়ে কী যেন দু’ একটা কথাও বলে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনো সময়ই আমি কাছাকাছি যেতে পারি না। স্বাভাবিক হতে পারি না।

চৌধুরী বাড়ির ভেতরকার সাংসারিক কাজ মন্থর স্রোতের মতো আপন নিয়মে বয়ে চলেছে। আমাকেই সব কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু ভুলতে পারি না সেই অস্বস্তিকে, সেই আতঙ্ককে। যেটা প্রবল শক্তিতে বাড়িটাকে চারপাশ থেকে অষ্টবাহু দিয়ে জড়িয়ে চেপে ধরেছে নিষ্ঠুর ভাবে। কিছু যেন হবে, কিছু যেন হবে।

কী যে হবে, কেউ জানে না। তবু সবাই সন্ত্রস্ত। সবাই ভয়ে ভয়ে পা ফেলে। সবাই সবাইকে এড়িয়ে চলতে চায়। মম পুতুল পর্যন্ত আজকাল হাসতে পারে না। ছুটোছুটি করতে পারে না। আকরামের চলা-ফেরায় পর্যন্ত একটা সন্ত্রস্ত ভাব। বেন্দা উঁচু গলায় কথা বলতে সাহস করে না। শুধু চোখ মেলে তাকায়। সে চোখের ভেতরে কুটিল ঈর্ষা না উন্মুক্ত লোভ, বুঝতে পারি না। শুধু কালো একটা ছায়া যেন চোখের ভেতরে বুনো অন্ধকারের মতো থমকে আছে।

আমাকে পালাতে হবে, এ বাড়ি থেকে পালাতে হবে। নইলে আমি বাঁচবো না। দু’দিন আগে চিঠি লিখেছি আরও একটা। চাচা এলেই আমি চলে যাবো, অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যে। আর একটা কাজ করেছি। জানি না, ঠিক করেছি, না ভুল। আনিসকে চিঠি লিখেছি। না লিখে পারি নি। আমার সব কথা বলি নি। কিন্তু কিছুটা না জানিয়েও শান্তি পাচ্ছিলাম না। ও যদি আসতো একবার। আমাকে বলতে পারতো আমি কী করবো।

আজ সাত দিন হলো বাবা বাড়িতে আসছেন না।

হলো না। এ-বাড়ি ছেড়ে যাওয়া আমার হলো না। বুঝেছি, আমাকে মরতে হবে এদের সঙ্গে। এই বাড়ির মূল শিকড়ের সঙ্গে বোধ হয় আমিও জড়িয়ে গিয়েছি। আর নিশ্চিত প্রলয়ের দিনে আমাকে সুদ্ধ পড়তে হবে এদের সঙ্গে একই ধ্বংস স্তূপে। কিংবা ভেসেছি এদেরই সঙ্গে একই ভাঙা ভেলায় কোনো সর্বনাশা স্রোতে, যার শেষে রয়েছে অতল প্রপাত। কোনো পথ নেই আর।

চাচা চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন। আমি ওদের বাড়ির কেউ নই। ওঁরা আমার কোনো রকম দায়িত্ব নেবেন না। আর আইনতঃ আমি ও বাড়ির কিছু পাই না।

আমি জানি, চাচা কেন এসব লিখেছেন। ব্যবসায়ী মানুষ চাচা, শুধু ব্যবসায়ী নন, জোতদারও। জমিজমা করেছেন অনেক। জমিজমা বাড়াবার কায়দা কৌশল তাঁর ভালো করে জানা আছে। ব্যবসায়ী বুদ্ধি যদি এখন না বেরুবে, তাহলে আর কখন বেরুবে। দাদু যে সম্পত্তিটুকু আমার নামে লিখে দিয়েছেন সেটুকু এখন হাতছাড়া করতে চান না। আমি ও বাড়িতে থাকলে অসুবিধা হবে। তাই মিছিমিছি ঝামেলা বাড়াতে নারাজ তিনি।

সে দলিল যে রেজেস্ত্রী হয়েছে, তা প্রমাণ করে জমি দখল করতে তো আবার মামলা মোকদ্দমার দরকার। সেই মামলা মোকদ্দমা করার মতো ক্ষমতা হবে না আমার, সেই ভরসাতেই উনি বাড়িতে নিয়ে ঝামেলা বাড়াতে চান না।

আমি জানতাম, এ রকম হবে। দাদু যেদিন মারা গিয়েছেন, সেদিন থেকেই আমার নিজের বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকে গিয়েছে।

এরই নাম কি নিয়তি।

বারবার আমি বেঁচে থাকার জন্যে আকুল হাত বাড়িয়েছি আর বারবার ব্যর্থ হয়েছি। বারবার আঘাত এসে আমাকে হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমার সব সুখ, সব সাধ, এমনি করে ব্যর্থ হয়েছে একের পর এক।

এখন আমি শূন্য। মা আমার মা নয়। বাবার দিক থেকে কোনো সম্পর্ক থাকলো না। আমার এখন দাঁড়াবার জায়গা নেই এতোটুকু। অথচ সব তো ছিলো আমার। সব ছিলো নিজের, যেখানে আমার চিরকালের দাবি রয়েছে। এখন সেই দাবি থেকেও নেই। দাবি করবার সব শক্তি ফুরিয়েছে আমার। এবার শুধুই ভেসে চলা, দিকচিহ্নহীন অনির্দেশের দিকে।

আমার চার দিকে তরঙ্গের পর তরঙ্গ উঠবে। আমার জীবনকে মনে হয় গভীর সমুদ্রে নোঙ্গরহীন নৌকার মতো। যার চারদিকে তরঙ্গ ওঠে ঝড়ে, স্রোতের আলোড়নে।

এদিকে ফুল ফোটানোর পালা কবে যে ফুরোবে, কে জানে। বদলে যাচ্ছে বাইরের মাটি, আকাশ, গাছপালা আর সেই সঙ্গে মানুষের মন। কে জানে, আমিও হয়তো বদলে যাবো। বদলাবে আনিসও।

সেদিন পথ হাঁটতে হাঁটতে ফিরছিলাম, কিন্তু পথ যেন ফুরাতে চাইছিলো না আমার। আকাশের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিলো।

.

হায় হায় কি অদ্ভুত কথা! মীনার বিয়ে হয়ে গেলো। হ্যাঁ, ঢাকাতেই বিয়ে হলো। ছোটখালা খবরটা জানিয়ে গেলো মা’র কাছে। আমি শুনলাম। তারপর সরে আসবার সময় আরেকটা কথা শুনলাম। খালা বলছে মা’কে, মঞ্জুকেও বিদায় কর এবার।

জানতাম ছোটখালা একথা বলবে। এখন তো আর কোনো অসুবিধা নেই মা’র। বাবা বাড়িতে নেই, মা’কে কেউ বাধা দিতে আসবে না।

এসব কথা আজকাল আর ভাবি না আমি। বেনুকে ভয় করি না আর। জানি, মুখোমুখি দাঁড়ালে বেনু কাপুরুষের মতো মাথা নিচু করে চলে যাবে। ওর এখন সাহস নেই।

কেন নেই জানি না। তবে নেই যে, বুঝতে পারি। এখন কাউকে ভয় হয় না আমার। আমার সব যন্ত্রণা সব কান্না যেন শেষ হয়ে গেছে। ঝড়ের পরে যে শান্তি নামে, সেই শান্তি এখন আমার মনের ভেতরে আর বাইরে। আমার করবার কিছু নেই, ভাববার কিছু নেই। এখন চারটা দেয়াল আমার সীমানা। বাইরের খবর জানি না। কিন্তু তবু যেন বুঝতে পারি, শুধু আমি একা নই। সবারই ভিত্তি টলে গেছে তলে তলে। সবাই ভাসছে সেই বিপজ্জনক স্রোতে। আমাদেরই চারপাশে কোথায় যেন রয়েছে সেই স্রোতের উৎস। আমরা তা ধরতে পারছি না। দিন আর রাত্রির অসংখ্য মুহূর্তগুলোর মধ্যে আমরাই ভেসে চলেছি আর সেই ধ্বংস-স্রোতকে বেগবান করছি।

সেই স্রোতের উৎসে কে? কেউ জানে না, বলতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারি, সে রয়েছে আমাদেরই মাঝখানে। আর সবাই মিলে আমরাই সর্বনাশা স্রোতটাকে জোয়ারের মতো ফুলিয়ে তুলেছি। এখন আর রুখবার ক্ষমতা নেই কারো।

চৌধুরী বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে। সেই ধ্বংসের সূচনা যে আরম্ভ হয়েছে, সেও তো নিশ্চিত নিয়মেই। একটা একটা করে ইট খসে যাচ্ছে, দেখছে সবাই, কিন্তু কেউ বাধা দেয়ার নেই এই ধ্বংসের মুখে। অসংখ্য সূক্ষ্ম কীট যেন কুরে কুরে খাচ্ছে বিরাট একটা মহীরুহের সমস্ত শেকড় বাকড়। বুঝতে পারি, ছোট আপার এমনি চলে যাওয়া, বাবার এমনি বাড়ি না আসা, কিংবা মা’র এই বিশ্রী উন্মাদনা, রাহুলের অব্যক্ত যন্ত্রণা, আনিসের অস্থিরতা—সবকিছুর অন্তরালে রয়েছে সেই ধ্বংসের কীট যা কাজ করে চলেছে আপন নিয়মে। বেনুদা, আকরাম এদেরও সেই কীট খেয়ে খেয়ে ফোঁপরা করে রেখেছে।

বুঝতে পারি, মাঝে মাঝে শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছি আমি, রাহুল, আনিস, বাবা। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ভাবে আমরা তো ক্ষুদ্র। নিজেদেরই যে আমরা ভালো করে চিনি না। যদি সবাইকে ভালোবাসতাম, সংহত করতাম নিজেদের। সহজ হতাম, স্বাভাবিক হতাম—তাহলে হয়তো দাঁড়াতে পারতাম এই ধ্বংসের স্রোতের মাঝখানেও দ্বীপের -মতো। কিন্তু নিজেরা পরস্পরকে জানলাম না যে।

সোনা আর সোনা। রূপো আর রূপো। আর সেই সোনা রূপো মিলিয়ে শক্তি আর সম্মান। শক্তি আর সম্মানের দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছি আমরা। সেই লোভী হাত ফেরাতে পারি না বলেই আমরা সন্দেহ সংশয় লোভ আর ঘৃণার কুটিল আবর্তে পড়েছি। বেনু আর আকরাম যেন সেই আবর্তের তলায় দুটো মৃত প্রেতাত্মা। সোনা রূপোর জগতে যে উল্লাস রয়েছে। সেই উল্লাসকে পেতে চেয়েছে ওরা সারা জীবনে, আর জীবনকে বিক্রি করে হয়েছে সেই লোভেরই ক্রীতদাস।

মা’রও লোভ ছিলো। এ লোভ সোনা রূপো পাওয়ার জন্যে হাত বাড়ানো নয়। মার লোভ ছিলো রক্তে মাংসে। লোভের পৃথিবীতে বিকট উল্লাস রয়েছে। মা জীবনে পেতে চেয়েছিলো সেই উল্লাস। আর আজীবন সেই উল্লাসের ক্রীতদাসী হয়েছে মা। নিজের জীবন দিয়ে কিনেছে এমনি একটি শিকল। এখন উল্লাসের সেই অভ্যাস তাকে টেনে নামিয়েছে ঘৃণা আর লোভের তরঙ্গিত সমুদ্রে। যেখান থেকে মা আর কোনোদিন উঠতে পারবে না।

আমি জানি না, আমার ভাবনায় কোনো ভুল আছে কি না। কেন না বিশ্বাস করতে পারি না কোনো কিছুর ওপর। চারদিকেই যে সংশয়, চারদিকেই যে সংকট। স্থির নিশ্চয়তার কথা কেউ বলতে পারে না। কেউ না।

বহুদিন পর কাল রঞ্জু এসেছিলো। সঙ্গে এসেছিলো তাজিনা। ছোট খালার ভাসুরের মেয়ে।

মীনার কথা জিজ্ঞেস করলাম ওর কাছে।

তাজিনা চুপ করে গেলো। বোধ হয় গম্ভীর হলো, আমি ঠিক বুঝলাম না। খানিকটা বোকার মতো তাকিয়ে থেকে অন্য কথায় ফিরে গেলাম। কিন্তু সেই কৌতূহলটা জেগেই রইল।

তারপর উঠলো নাসিমার কথা। ওর কথা উঠতেই তাজিনা হেসে কুটিকুটি।

কি হলো? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

কি বেহায়া মেয়ে রে বাবা। রঞ্জু হেসে ফেললো। বললো, জানিস না তুই কী ব্যাপার হয়েছে ইতিমধ্যে। জামিল আর ও এক রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। অনেক রাতে বাড়িতে ফিরে আসার সময় নাসিমা ওর বাবার মুখোমুখি পড়ে। ওর বাবা ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। রেগে ছিলেন খুব। জামিলকে কিছু বলার আগেই, মেয়েটা কী বোকা, বলে ফেললো, বাবা আমি আর জামিল বিয়ে করব। ওর সঙ্গেই বাইরে ছিলাম এতক্ষণ। এ পর্যন্ত বলেই রঞ্জু মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে উঠলো খিলখিল করে।

বারে। এতে হাসবার কি হয়েছে! আমি অবাক হলাম, ঠিক কথাই তো বলেছে।

তাই নাকি কেউ করে। একটু লজ্জা করলো না, এমন বোকামি কেউ করে?

তাজিনাও হাসে। বলে, ভয়ানক বোকা মেয়েটা। একটা মেয়ের জীবনে কতো কিছু হয়ে যেতে পারে, সে সব কথা কি সব খুলে বলতে হয়!

বলবে না তো, জানবে কেমন করে! এ তো ভারি মজার! সবাই কি অন্তর্যামী নাকি! আমি অবাক না হয়ে পারি না।

হুঁ, তোমার ঐ বুদ্ধি নিয়ে থাকো তুমি। আমি বলেছি না, তুমি ঠকবে, ভীষণ ঠকবে।

কতো মেয়ে কতোজনের সঙ্গে রাত কাটাচ্ছে কতো জায়গায়, টাকা পয়সা রোজগার করছে তাই দিয়ে—সব বুঝি বলে বেড়াতে হবে?

তাহলেই তো চিত্তির। সে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে না আর।

এসব কী বলছো তোমরা। আমার তখন বিমূঢ় অবস্থা।

বাহ্ রে মেয়ে, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানো না, কচি খুকী।

আমি চুপ করে শুনলাম। তাজিনা নিজের কাপড় গয়না দেখিয়ে বললো, আমার বাবার না হয় টাকা পয়সা আছে। আমি এসব পরি। কিন্তু জোহরা হাস্না ওরা যে এ ধরনের কাপড় জামা পরে—কোথায় পায়? বাপ তো কেরাণী। কোথায় পায় শুনি?

কেন, ওর মাসুদ ভাই, নিজাম ভাইরা, অসীমদা’রা! ওরাই সব প্রেজেন্ট করে, রঞ্জু হাসতে হাসতে বলে।

তা বেশ তো, প্রেজেন্ট করতে পারে তো, আমি এবারও না বলে পারলাম না।

আরে বোকা, শুধু শুধু প্রেজেন্ট করবে কেন, কথা নেই বার্তা নেই একশো দেড়শো টাকার জিনিস প্রেজেন্ট করে বসবে। তার জন্যে কিছু দিতে হয় ওদের নিশ্চয়ই। রূপ আর যৌবন ছাড়া আর কি আছে ওদের। তুই তো বেরোস না। একবার যদি বেরিয়ে দেখতিস বাইরের দুনিয়াটা।

ও সব কথা শুনলে আগে হয়তো কানে আঙ্গুল দিতে হতো, কিন্তু ঠিক এরকম না হলেও এ ধরনের ঘটনা তো আমি বাড়ির ভেতরেই দেখছি। আমি চুপচাপ শুনলাম ওদের বিস্ময় আর রোমাঞ্চের গল্পগুলো।

তবে একটা গল্প বলি শোন, তাজিনা বললো, আমার সঙ্গে পড়ে জাহানারাকে চেনো তো, খুব সুন্দর দেখতে, চমৎকার স্বাস্থ্য, তাকে নিয়েই ঘটনা।

হঠাৎ একদিন কলেজ ছুটির পর শুনলাম, শেলীর জন্মদিন। শেলীকে মনে নেই। কয়েক বছর ধরে যে কলেজ ছাড়ছে না, ওদের বাড়িতে পার্টি, ক্লাশের সব মেয়েদেরই নিমন্ত্রণ।

সন্ধ্যার দিকে সবাই গেলাম। আলাপ হলো শেলীর এক বালাত ভাইয়ের সঙ্গে। ওমা, ওর খালাতো ভাইটা সব সময় জাহানারার কাছে কাছে থাকলো। এদিকে জাহানারা খুব বিরক্ত হচ্ছিলো, কিছু বলতেও পারে না। টেবিলের ওপর অনেকগুলো উপহারের বই ছিলো। জাহানারা একখানা পছন্দ করলো। শেলীকে বললো, ভাই একখানা বই যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো, পরে ফেরত দেবো।

সবাই আমরা যে যার মনে আছি। এক সময় লক্ষ্য করলাম, জাহানারা কোথা থেকে আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। সারা মুখ টকটকে লাল, রাগে না উত্তেজনায়, ঠিক বোঝা গেলো না।

সেদিন ফিরতি পথে এক রিক্সায় দু’জনে আসছিলাম। ওর হাত থেকে বইটা দেখার জন্যে নিয়ে খুলতেই দেখি, ওমা, একখানা একশো টাকার নোট। কী করে এলো? জাহানারার মুখ এখন কালো হয়ে গেছে। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি কিছু জানি না, বিশ্বাস কর।

বাসায় ফিরে তক্ষুণি ছোট ভাইকে দিয়ে বইখানা ফেরত পাঠালো, শেলীর খালাতো ভাই বখতিয়ার খানের কাছে।

কিন্তু কি আশ্চর্য জানিস! বখতিয়ার খান অস্বীকার করে বসলো, ও টাকা আমার নয়।

এটাই হলো কায়দা। জানা গেলো কে দিয়েছে টাকা। কিন্তু সে টাকা ফেরত দেয়া গেলো না। তার ঠিক দু’দিন পরই জাহানারাদের বাড়িতে বখতিয়ারকে দেখা গেলো। তারপর দু’ তিন সেট নেকলেস দেখলাম পরপর, জাহানারার গলায়।

রঞ্জু এক সময় বললো, কিচ্ছু জানতাম নারে মঞ্জু। ভারি মজার মজার ব্যাপার ঘটে সব। এমনি কতো ব্যাপার হয় আজকাল। তুই ভাবতেও পারবি না। শুনলে বিশ্বাস হবে না তোর।

ওর কথা শেষ হবার আগেই আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম। বললাম, থাক রঞ্জু। আর কতো নোঙরা কথা শুনবো। দু একটা ভালো কথা শোনা।

কিন্তু ভালো কী শোনাবে ওরা! মেয়েদের, বিশেষ করে ওদের মত বয়সের মেয়েদের যে কৌতূহল, সে কৌতূহলের মধ্যে তো আর অন্য কোনো কথা খুঁজে পায় না ওরা। ওদের চারপাশে যে অমনি একটা নগ্ন মত্ততা ফুলে ফেঁপে উঠছে।

ওরা চলে গেলে বিরক্ত হলাম নিজেরই ওপর। কেন ওদের কথা শুনলাম! কী লাভ এতে। এখন তো বিশ্রী লাগছে নিজেকেই। কেননা বুঝছিলাম, তাজিনা কিংবা রা ওদেরও বোধ হয় অমন ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা আছে। আমার চেয়ে আলাদা ওরা এসব ব্যাপারে। হ্যাঁ, একেবারে আলাদা। তাহলে কি আমিও ওদের সবার মতো হয়ে যাবো, টাকা পয়সার জন্যে আমিও………

আর কল্পনা করতে পারি না। ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। আমি, কেন জানি না, সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠলাম।

দমকের পর দমক কান্না আমার বুক ঠেলে উঠে আসতে লাগলো। আমার কান্না শুনে ছুটে এলো মা, ওদিক থেকে রাহুল। ওরা আমাকে নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লো। বারবার ডাকলো, এই মঞ্জু, কি হয়েছে? বল না কি হয়েছে।

কিছুক্ষণ পর আমার কান্না থেমে গেলো। বললাম পেটে ভয়ানক কামড়াচ্ছিল।

আমাকে একটা হাস্যকর মিথ্যা কথা বলতে হলো। না বলে যে উপায় ছিলো না।

একেকবার মনে হয়েছে, আমিই কি তবে অস্বাভাবিক, আর সবার থেকে আলাদা? সবারই তো জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা থাকে। সবারই জীবনে দেখছি, কেবল আমারই নেই। আমার এতো বিশ্রী লাগে সমস্ত ব্যাপার। তাহলে কি আমারই ভেতরে রয়েছে কোনো জটিলতা, যার জন্যে আমি ভয় পাই, ঘৃণা করি। না, আমার মনে এটা একটা বহু যুগের পুরনো কোনো কুসংস্কার বাসা বেঁধে রয়েছে। যা থেকে আমি মুক্ত হতে পারছি না। অথচ ওরা কত সহজ আর স্বাভাবিক।

আমার নিজেরই ওপরকার বিশ্বাসগুলো টলমল করতে থাকে। আমি লক্ষ্য করতে লাগলাম মাকে। মা মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে, কি রে কী দেখছিস?

মার চেহারার মধ্যে যেন কোথায় একটি তৃপ্তির আভাস দেখা যায়। শরীরের উজ্জ্বলতা বেড়েছে। চোখ দুটোতে কী যেন ভরে এসেছে। বেশ লাগে মাকে দেখতে—খুব সুন্দর মনে হয়।

আমি দেখি আর অবাক হই। মা কতো স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। সেই আগের মতো। কিন্তু পারে না। ঠিক পারে না কি? আবার আমারই মনের ভেতরে সন্দেহ ঘুলিয়ে ওঠে। মা ঠিকই আছে, আগের মতই সহজ আর স্বাভাবিক। আমি হয়তো বদলেছি আর অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছি। যদি আমি ওদের একজনের মতো হতাম, তা’হলে হয়তো মাকে আমার চোখেও স্বাভাবিক লাগতো।

আমি আর চিন্তা করতে পারি না। এ কী বিশ্রী কৌতূহল আমার। নিজেরই ওপর বিরক্তি ধরে একেক সময়। আমিই কি বিকৃত হয়ে যাচ্ছি না মনে মনে? কেন, কী লাভ এতবার করে এসব কথা ভেবে, এসব কথা চিন্তা করে?

এসব ভাবনা একেবারে বাদ দিলেই তো পারি। এছাড়াও তো জীবন অনেক বড়। জীবনের কতো রকমের দিক আছে।

আমার এই হয়েছে মুশকিল। চারটে দেয়ালের বাইরে যেতে পারি না। যারা বাইরে থেকে আসে, তাদের কাছ থেকে যে খবরগুলো পাই সেগুলো একই ধরনের।

সেদিন ছোট খালা এলো। মা’র সঙ্গে আলাপ করতে করতে বললো, মীনাকে ওর ফুফুর কাছে পাঠিয়ে দিলাম।

কেন?

একটু পড়াশোনা করুক। আর কী একটা অসুখ হয়েছে, তারও চিকিৎসা হবে। বিকেলে একটু পরই রঞ্জু এলো। সে খবর শুনে বললো, আরে চিকিৎসার জন্যেই যাচ্ছে। ঠিকই বলেছে তোর ছোট খালা।

বুঝলাম, সেদিন মীনার সম্বন্ধে এ কথা বলতে বলতেই তাজিনা চুপ হয়ে গিয়েছিলো। রঞ্জু সেদিনের মতোই যেন কী একটা কথা বলতে এসেছে বুঝলাম। সেদিন আমাকে একাকী পায় নি বলে সে কথা না বলেই চলে গিয়েছিলো।

পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ পর বললো, দেখ মঞ্জু, আমি বোধ হয় সুখী হতে পারবো না রে।

আমি অবাক হলোাম, হঠাৎ ক’দিনেই মত বদলে ফেললি? কেন কী হয়েছে।

না, কিছু হয় নি। ও আকাশের দিকে তাকায়। বলে, মনে হচ্ছে আহসান আলাদা। চিন্তায় ভাবনায়, কাজে কর্মে, এমনকি প্রকৃতির দিক থেকেও আলাদা। আজকাল আমাকে সন্দেহ করে। বাড়িতে শফিক ভাই আসে আর তাই নিয়ে ওর যত বাজে সন্দেহ।

আমি কিছুই বললাম না। এসব ঘটনা আর কতো শুনবো। এখন আমার ক্লান্তি লাগে।

রঞ্জু খানিক পর উঠে দাঁড়ালো। বললো, মানুষের মন এতো জটিল মঞ্জু, বোঝা ভয়ানক শক্ত।

তুই কি জানতিস না?

জানতাম, কিন্তু বুঝতে পারি নি। তখন কতো ছেলেমানুষ মনে হতো ওকে। কেমন সুন্দর হাসতো, অভিমান করতো। আমার একটা কথার জন্যে দিনরাত ভাবত।

কিন্তু এখন ও কেবলই সন্দেহ করে। কী যেন দেখতে চায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। কাল কী বলে গেলো জানিস? বলে গেলো, আমি যেন শফিকের সঙ্গে কথা না বলি।

একটু পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, মনটা এতো ছোট হয়ে যাচ্ছে ওর। আমারই লজ্জা করছিলো ওর সঙ্গে কথা বলতে। ভুল করেছি আমিই। যদি আমি নিজেকে ওর হাতে ছেড়ে না দিতাম। যদি এড়িয়ে যেতে পারতাম, তাহলে হয়তো ওর কাছে এত সহজে মূল্য হারাতাম না। আমার যেন এখন আর কোনো আকর্ষণ নেই। যে পিপাসায় ওকে আর্ত হয়ে উঠতে দেখেছি সে পিপাসা মিটেছে, এখন ও নিস্পৃহ। আমার কিছুই গোপন নেই ওর কাছে। যদি কিছু গোপন রাখতাম।

রঞ্জু দীর্ঘশ্বাস গোপন করল।

তুই অমন ভুল করবি না মঞ্জু।

আমার হাসি পেলো সেই মুহূর্তে। কিন্তু হাসলাম না। বললাম, নিশ্চিন্ত থাক তুই, প্রেম করতে যাচ্ছি না আমি। আর সেজন্যে ওসব চিন্তাও আমার আসবে না কোনোদিন।

রঞ্জু আমার দিকে চোখ রাখলো। আমার মুখ থেকে দৃষ্টি নামালো বুকে, তারপর তারও নিচে, একেবারে পা পর্যন্ত। আমার সমস্ত শরীরে স্পর্শ দিয়ে গেলো যেন সে দৃষ্টি। আমার স্নায়ুগুলো শিরশির করে উঠলো একটু। ও বললো, তুই কেমন করে পারিস তাই ভাবি। কেউ কি তোকে দেখে নি? কেউ কি ভালোবাসতে চায় নি।

কি জানি, অন্য কারো কথা কেমন করে জানবো! আমি হাসছিলাম তখন অস্বাভাবিক রকম। মনকে কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু তবু মনকে লুকানো ভারি শক্ত। আমার সেই ভয়। আর সেজন্যেই আমি অন্য কথায় ফিরে যেতে চাইলাম্।

রঞ্জু যাবার সময় আবার বললো, সত্যি, কী করবো আমি, বুঝতে পারছি না মঞ্জু। আমি কি ঐসব মেয়েদের মতোই হয়ে যাবো। একের পর এক ভালোবেসে যাবো, আর একের পর এক ঠকবো।

ও চলে গেলে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, কতো বয়স রঞ্জুর। আঠারো নয়তো উনিশ, কিংবা সতেরোও হতে পারে। এই বয়সে এতো সব কথা কেন ভাবে ও, ওর মন এতো জটিল হলো কেন?

আমাকে শুনতে হয় বাইরে এইসব বিচিত্র ঘটনার বিবরণ। আমার বন্ধুদের এই জীবনকে লক্ষ্য করতে হয়। না, আর অন্য কিছু বলে না ওরা। বলে না ওদের মা বাবার কী রকম সম্পর্ক। বলে না, ওদের ভাইরা বেকার থেকে কী অসুবিধায় রয়েছে। বলে না, ওদের যথেষ্ট টাকা না থাকার জন্যেই ওদের বিয়ে হচ্ছে কি না। কেন ওর বাবা মা বাইরের ছেলেদের সঙ্গে মেলা-মেশা করতে বাধা দিচ্ছে না। এসব ওরা কেউ বলে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। রঞ্জুর কথায়, নাসিমার কথায়, ছোট খালার কথায়, আমি বুঝতে পারি আভাসে, কি মিথ্যুক বাইরের মানুষগুলো।

ঘরে বাইরে বইছে ধ্বংসের অন্তঃস্রোত। সবার, হ্যাঁ সবার মনে এই আতঙ্ক গলা পর্যন্ত এসে ঠেকেছে।

নইলে এইসব ঘটনার আবর্ত দেখতে পাচ্ছি কেমন করে। আর এই আবর্তে এরা কেমন করে তলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। ছোট আপা তলিয়ে গেলো। রাহুল থেকেও হারিয়েছে। আর মরলো মীনা। কেউ ঠেকাতে পারছে না। এই প্রবল স্রোতের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে পারছে না কেউ শক্ত হয়ে।

অস্থির একটা পাহাড়ের চুড়ায় যেন সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। আর একে একে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। কেউ ধরবার নেই, কেউ বাঁচাবার নেই।

বাবা আসেন নি আজ দু’ সপ্তাহ হয়ে গেলো। আকরাম আসছে, বেনু আসছে। কিন্তু আগের মতো আর হাসির উচ্ছ্বাস শোনা যায় না। বেনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে আমাকে। সেই পুরনো দৃষ্টি, দু’চোখের ওপারে অরণ্যের বুনো অন্ধকার। না কান্না, না উল্লাস, না ঈর্ষা—কিছুই নেই সে দৃষ্টিতে। কিন্তু তবু যেন কিছু আছে। আমি দেখতে পাই মাঝে মাঝে। আর তখনই আমি সোজা এসে দাঁড়াই ওর মুখোমুখি। ওকে চোখ নামিয়ে নিতে হয়। কিছু একটা যেন বলতে চায় ও।

এক সময় নিচু স্বরে বলেছে, আমার ওপর খুব রেগে আছিস, তাই না?

আমি কথা বলি না, সরে এসেছি ওখান থেকে।

ওরা সবাই ভয় পেয়েছে। মা পর্যন্ত ভয়ে বাবার কথা বলতে পারে না আজকাল। বেনুর হাতে এক দুপুরে খাবার পাঠিয়েছিলো। বাবা সেটা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে পুতুল মম আর আমার জন্যে মিষ্টি কিনে পাঠিয়েছেন।

.

কটা দিন, কিন্তু কি অদ্ভুত বদলে গেল চৌধুরী বাড়ি।

মাঝে মাঝে প্রতিবেশী মেয়েরা আসে। এসে জিজ্ঞেস করে। চৌধুরী সাহেবকে দেখি না যে আজকাল?

বিশেষ করে সাকিনা খালা এমন প্রশ্ন করে আর মা’র দিকে তাকিয়ে কী যেন লক্ষ্য করে।

আমাকেই মিথ্যা কথা বলতে হয়। বলি, দোকান নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন। দিনে আসতে পারেন না।

খাওয়া দাওয়া?

বাড়ি থেকে যায়।

কিন্তু আমি জানি, ব্যাপারটা চাপা থাকবে না। বাবা দিনের পর দিন, হোটেল থেকে খাবার কিনে খাবেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবদের চোখে সেটা নিশ্চয়ই পড়বে। তারপর, তারপর কী হবে?

আমার এমনি অসংলগ্ন এলোমেলো দিনে একদিন আনিস এলো। আমিই দরজা খুলে দিয়েছি। তখন সন্ধ্যা। আমরা সেই মূর্ছিত ম্লান আলোয় মুখোমুখি দাঁড়ালাম।

অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ। গত কয়েকটা দিনের উদ্বেল যন্ত্রণা আর কান্নার কথা ভাবলাম। মাত্র কটা দিনে কতো বদলেছি আমি। এই কটা দিন আনিসের কথা মনে পড়ে নি সব সময়। আজ এই মুহূর্তে আশ্চর্য লাগলো, ওকে ভুলে ছিলাম কেমন করে? আমার বুক ভরে উঠলো গভীর শান্তিতে। এমন দিনে এলো আনিস। যখন আমার পাশে দাঁড়াবার আর কেউ নেই।

আনিস তার দুহাত আমার কাঁধে রাখল। আর সেই আবছা অন্ধকার ঘরের মেঝের ওপর আমি ওর বুকে মাথা গুঁজলাম। বললাম, এতো দেরি করলে কেন? আমার এদিকে যে দিন কাটতো না।

কেন?

এতো ঘটনা ঘটে গেল চারপাশে। শুধু ভাবছিলাম, এবার বুঝি আমাকে মরতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আমার সেই গভীর শান্তি ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে করছিলো না। দু’জনে দাঁড়িয়ে রইলাম, অমনি নিঃশব্দ।

এক সময় ও বললো, চলো বাড়ির ভেতরে যাই।

না, আরেকটু থাকো।

কোথায় যেন ছেলেমানুষী আবদার বেজে উঠলো আমার কথায়। ও হাসলো। সেই না-অন্ধকার না-আলোয় ওর হাসি কি সুন্দর জেগে উঠলো, আমার ভ্রূর ওপরে।

আরেকবার নিবিড় আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলাম বাড়ির ভেতরে। দরজার কাছে এসে বললাম, তুমি এক্ষুণি একবার বাবার ওখানে যাও। এ বাড়িতে অনেক কিছু ঘটে গেছে। বাবা দু’ সপ্তাহ ধরে বাড়িতে আসছেন না।

আনিস দাঁড়িয়ে পড়লো, সে কি! কেন?

আমি মা’র ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বললাম, জানি না কেন। কথাটা বলেই আমি সরে এলাম।

.

আনিস এলো আর চলে গেলো। সেদিন বাবা এসেছিলেন। এসে বসেছিলেন বাইরের ঘরে। বলেছিলেন আনিসকে, তুমি আরও ক’টা দিন থেকে যাও। বাড়ির ঝঞ্ঝাট ঝামেলাগুলো মিটিয়ে তার পরে যেও।

একটু থেমে আবার বলেছিলেন, রাহুলটা একেবারে মাটি হয়ে গেলো।

রাহুলকে না হয় আমিই নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখানে থাকবো কেমন করে। দু’দিনের বেশি ছুটি পাওয়া গেলো না।

আমার নিজের জন্যে ভাবছি না, বাবার চিন্তান্বিত স্বর শুনতে পেয়েছি আরেকটু পর। মঞ্জুর জন্যে ভাবতে হচ্ছে ক’দিন ধরে। এখানে রয়েছে বলে ওর চাচারা ওকে আর নিয়ে যাবে না। ওকে দেখে শুনে কারো হাতে তুলে দিতে পারলে একটু নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। পরের মেয়ে, এজন্যেই চিন্তা।

না, এ কথার জন্যেও আমি সেদিন দরজার আড়ালে কান পাতি নি। আমি জানতে চেয়েছিলাম, বাবা বলেছেন কি না সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির কথা। কান পেতে ছিলাম আমি, বাবা আনিসকে অন্ততঃ বলুন।

আনিস এক সময় জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু এভাবে খাটছেন কেন? বাড়িতে কেন থাকছেন না। শরীরের ক্ষতি হবে যে।

আরে নেবো বিশ্রাম, নেবো। বাবা প্রসন্ন হেসে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন। দোকানটাকে দাঁড় করিয়ে নি। তারপর শুধু সকাল সন্ধ্যা হিসেবপত্র দেখবো আর চলে আসবো।

বাবার কথা এপর্যন্ত শুনেই আমি চলে এসেছি। রাগ হয়েছে বাবার ওপর, কেন বলবেন না সে কথা!

আনিস চলে গেলো। যাবার সময় কোনো কথা বলতে পারলাম না। মা এসে দাঁড়িয়েছিলো দরজার কাছে।

আনিসকে সব কথা বলতে পারি নি। কেমন করে উচ্চারণ করবো সেই কথাগুলো। সেই লজ্জা আর ঘৃণার কথা। তবু মনে হয়েছে, আনিস যেন কিছু টের পেয়েছে। আমাকে কষ্ট পেতে দেখে বলেছে, অমন হয়ে যাচ্ছো কেন? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া তো জীবন নয়। নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছো কেন? স্রোতে গা ভাসিয়ে শুধু শুধু ভয় পাওয়ার কোনো মানে হয় না। যতোক্ষণ বেঁচে আছি, ততোক্ষণ যেন সুন্দর হয়ে বাঁচি।

আমিও জানতাম ঐকথা। কিন্তু তবু যেন জানতাম না। অন্ততঃ মনের দিক থেকে অনুভব করি নি। আজ যেন সাহস ফিরে পেলাম। আনিস চলে গেলে মনে হয়েছে, কী ছেলেমানুষের মতো আবোল-তাবোল ভেবেছি আর কষ্ট পেয়েছি। জীবনে কার সঙ্কট নেই?

এবং এই সাহস আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি এখন নিয়মিত পড়াশোনা করছি। নিজের ঘরটাকে মনের মতো সাজিয়ে রাখছি, দেখাশোনা করছি পুতুল মমের। ঠিক করেছি, কোনো ভাবনা আর ভাববো না। সহজ হবো আর হবো স্বাভাবিক। না ওদের মতো সহজ নয়। সেই পঙ্কিল লোভের স্রোতে গা ভাসিয়ে সহজ হওয়া নয়। নিজের মতো সহজ হওয়া। নিজেকে খুঁজে বের করে সহজ হওয়া। যেন স্রোতের মধ্যেও আমি একটি স্বতন্ত্র মানুষ, যে স্রোতের মধ্যে সাঁতরেও সহজে ফিরে আসতে পারে নিজের শক্ত তীরে, নিজেই নিজের গতির নিয়ামক হয়ে।

মাঝে মাঝে আমি এখনও ভাবি, যদি এ-বাড়িতে না আসতাম, তাহলে জীবনের কিছুই পেতাম না আমি। এই দুঃখ, এই যন্ত্রণা, এই ঘৃণা আর তার সঙ্গে এই শান্তি আর স্নিগ্ধতা আমাকে জীবনের বিরাট রূপ দেখিয়েছে। যখন আমি এমন কথা ভাবি, তখন আমার কোনো খেদ থাকে না, কোনো ক্ষোভ থাকে না।

আমি এখন নিজেকেই সাজাতে বসলাম। যে অপরিসীম শূন্যতা আমার বুকের ভেতরটা ছেয়ে রয়েছে, সেই শূন্যতা আমি ভরে তুলতে চাইলাম।

মনকে সাজাতে বসলাম আমার সব কাজ আর বিশ্রামের প্রহরে। বারবার বললাম, আমি সুন্দর হবো, শুভ্র হবো। আমাকে বাঁচতে হবে।

এর আগেও আমি বহুবার বলেছি, আমাকে বাঁচতে হবে এবং সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে মনে, কেন? কেন বাঁচতে হবে?

সঙ্গে সঙ্গে মন থমকে গিয়েছে? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা ছিলো না। আর ভয় পেয়েছি তখন। এখন যেন জোর পেয়েছি মনে। নিজেকে বলতে পারি, বাঁচব আনিসের জন্যে, আমার জীবনের জন্যে।

.

বাইরে এদিকে দিনের মনে দিন চলে যাচ্ছে। চৌধুরী বাড়ি সেই গতানুগতিক নিয়মে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা একদিন এসেছিলেন, মম আর পুতুলের জন্যে কিছু জামা-কাপড় নিয়ে—আমি দেখলাম তাঁকে। খুব ক্লান্ত মনে হলো। বসতে বললাম, বসলেন। তারপর সহজ আর সাধারণভাবে সংসারের খবরাখবর নিলেন। রাহুল করে যাচ্ছে পাবনা, তাও জিজ্ঞেস করলেন। তারপর, হ্যাঁ তারপর কী যেন জিজ্ঞেস করতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। সেই মুহূর্তে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিলো। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, হে খোদা! মার সম্বন্ধে যেন কিছু আমাকে জিজ্ঞেস না করে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন না, আর আমি বাঁচলাম।

এক সময় বাবা বললেন, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারিস মা?

পানি খাবেন, পানি, এক্ষুণি আনছি। ছুটে এলাম ঘরে। তাক থেকে কাঁচের গ্লাস নামালাম, চিনি বের করে লেবুর রস দিয়ে সরবত তৈরী করে প্লেট দিয়ে গ্লাসটা ডেকে বাবার সামনে এনে ধরলাম।

আর সেই সময়, ঠিক সেই সময় দেখলাম মাকে। তখন দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে, কিছু যেন বলবে।

বাবা গ্লাসটা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন, তক্ষুণি সরবত খেলেন না।

আমি বললাম, খেয়ে নিন বাবা।

আচ্ছা খাচ্ছি।

বাবা একটু পর জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আকরাম আসে না আজকাল?

কী জবাব দেব আমি? একথা আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন? একটু চুপ করে থেকে বললাম, হ্যাঁ, আসে।

বুঝলাম, মাকে শোনাতে চান বাবা কথাগুলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিদ্রূপে কঠিন হয়ে উঠেছে তাঁর মুখ। আর সেই ঘৃণায় ভরা মুখেও ফুটে উঠেছে এক টুকরো হাসি। সে হাসিতে তীব্র বিদ্রূপ। তারপর হঠাৎ গলা খুলে হেসে উঠলেন আব্বা। তারপর বললেন, তোর মা কেমন আছে মঞ্জু

আমি তখন বসে পড়েছি মেঝেতে দু’হাত পেতে। আর সেখানেই আর্তনাদ করে উঠেছি, বাবা!

বাবা আমাকে টেনে তুললেন, কি হয়েছে? কি হয়েছে মঞ্জু? বাবার উদ্বিগ্ন স্বর। আমার কান্না পেলো তখন। বললাম, কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছেন আমাকে!

বাবা চুপ করে দাঁড়ালেন কয়েক মুহূর্ত। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলেন। সরবত খেলেন কয়েক চুমুক, তারপর পা বাড়ালেন দরজার দিকে। আর তখনই ডাক শুনলাম, মা ডাকছে, শোন।

আমি ভয়ে পিছিয়ে এসেছি। দরজার সঙ্গে ধাক্কা লেগে আমার হাতের কাঁচের প্লাসটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে মেঝেময় ছড়িয়ে পড়লো।

আমি দাঁড়ালাম না। কেউ যেন তাড়া করে ছুটে আসছে।

আমার সাহস কোথায় গেলো। নিজের ওপরই দুঃখ হলো। কেউ যেন বললো আমাকে, তোর না বড় সাহস মঞ্জু! ছুটে গিয়েছিলি স্রোতের মুখোমুখি দাঁড়াতে। ভেবেছিলি সব বাধা পার হয়ে এগিয়ে যাবি, কোথায় তোর সেই সাহস? ভয় যে তোর মনের ভেতরে, ভয় যে তোর রক্তে রক্তে ছড়ানো।

হ্যাঁ, ভয় আমার সেই ভীষণ আর ভয়ঙ্কর নগ্নতাকে। ভয় আমার ঘৃণা আর হিংস্রতাকে। আমি কী করবো?

আমার মনের ভেতরকার চিরকালের প্রশ্নটা জেগে উঠলো, কী করবো, আমি কী করবো?

এই সেদিন আমি সঙ্কল্প করেছি, সাহস পেয়েছি মনে, আজ কোথায় গেল আমার সেই সাহস? আমি তো আগের মতোই দুর্বল। শুধু ভয় করছি চারিদিকের জগতকে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি আবার ফিরলাম। যাবো, মুখোমুখি দাঁড়াবো মা’র। বাবাকে বলবো আমার সব কথা। আমার ঘৃণার আর যন্ত্রণার আর কষ্টের কথা। বলবো, এভাবে কেউ বাঁচতে পারে না। এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে আমরা কেউ বাঁচবো না।

কিন্তু ঘরে এসে দেখি, মা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাবা নেই ঘরে।

মা আমাকে দেখে বললো, তোর বাবা লোকটা ভীষণ জেদী মঞ্জু, সত্যি সত্যি বোধহয় এ বাড়িতে আর আসবে না।

মা’র কথা বলার ভঙ্গী দেখে মনে হলো, বাবা যেন মা’র কেউ না, বাইরের লোক।

বুঝলাম, মা বাবাকে অনুরোধ করতে এসেছিলো। একটু আগেই হয়তো হাত পা ধরতে চেয়েছিলো। দেখি নি আমি, তবু মনে হলো, মা সব করতে পারে। আর সে কথা মনে হতেই ঘেন্নায় আমার গা রি রি করে উঠলো।

এত সব ঘটনা ঘটে যাবার পরও শুধু টাকা আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে কেমন করে পারছে বাবার সম্মুখে হাত বাড়াতে।

আমি সরে এলাম। মা’র সঙ্গে কোনো কথা না বলে।

.

এই তো আমার জগত, চারপাশে সীমানা দিয়ে ঘেরা। বাইরে বেরুলেই চারটে প্রাচীর আর ঘরে ঢুকলে চারটে দেয়াল। বাইরে কিছুই দেখতে পাই না। আর সে জন্যেই হয়তো দেখতে হচ্ছে আমাকে আমার চারপাশের মানুষগুলোকে। কেউ আমার বাইরে কোথাও নিয়ে যায় নি। কোথাও যেতে পারি না। আর কোনোদিন পারবো কিনা তাও জানি না।

এই গতানুগতিক জীবন আর পরিচিত পুরনো মানুষগুলোর ভেতরে এতো রয়েছে জানবার, এতো রয়েছে বুঝবার যে ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। তাই ঘুরেফিরে আবার ওদের কথাই আমাকে ভাবতে হয়।

বাবা চলে যাওয়ার পর মাকে বারান্দায় দেখে আমি ফিরে এলাম কোনো কথা না বলে। কিন্তু উঠোনে এসে মা’র কথাই ভাবলাম। এবং একটু আগে যে ঘৃণা হচ্ছিলো মা’র ওপর, সেই ঘৃণা যেন একটু একটু করে সরে গেলো মন থেকে।

মা তো অমন করবেই। দাঁড়াবার যে আর জায়গা নেই। আজ হোক, কাল হোক, বাবার পায়ে গিয়ে পড়তেই হবে।

আকরাম এলো সেদিন। লক্ষ্য করলাম, মা কোনো কথা বলছে না। বললেও খুব ধীরে ধীরে বলছে। আর একটু পরই বেনু এলো। ও যে কখন এসেছে, টের পাই নি। এক সময় আমার খুব কাছে এসে নিচু গলায় ডাকলো, মঞ্জু।

চমকে ফিরে তাকালাম, কি?

কতোদিন আর কষ্ট দেবে এভাবে?

আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আর সেই মুহূর্তে আনিসের কথা মনে পড়লো। একটু আগে আমি সাহসে বুক বেঁধে ছুটে গিয়েছিলাম। আর এই মুহূর্তে পালিয়ে এলাম। আমার নিজেরই ওপর বিরক্তি লাগলো। দরজা খুলে আবার বাইরে এলাম। এখন বেনু মা’র ঘরে গল্প করছে।

আবার আমি নিজের ঘরে বসে বইয়ে মন দিলাম।

বাবা নেই। ব্রেইন-এ এ্যাপোপ্লেক্সির স্ট্রোক হয়েছিলো।

দুদিন পর আনিস এলো। ছুটে গিয়ে ওর কাছে দাঁড়ালাম, ভয়ে আর আতঙ্কে কথা বেরুচ্ছিলো না আমার আগের মুহূর্তে পর্যন্ত। ওর কাছে কেঁদে ফেললাম। আনিসকে দেখে মা’ও কেঁদে ফেললো। মা’কে দেখে আনিস ধমকে উঠলো।

.

চৌধুরি বাড়ি তেমনি আছে। বাইরে থেকে এ বাড়িতে ঢুকতে গেলে প্রথমেই পার হতে হবে বড় দেউড়ি, তারপর ছোট দেউড়ি। চোখে পড়বে মস্ত প্রাচীর। বড় বড় ঘর। ওপর তলার ফাটা ছাদ, শূন্য ঘরগুলো, হাওয়ায় শোনা যাবে জানালাগুলোর ঝাপটানি। সেই মম্, পুতুল, রাহুল, মা, সব ঠিক তেমনি আছে।

এই সেদিন বাবা গ্লাসে করে সরবত খেয়েছেন, আমি তৈরি করে দিয়েছি সেই সরবত। বাবা বসেছিলেন বারান্দায়, আমার কান্নার সময় সান্ত্বনা দিয়েছেন পিঠে হাত বুলিয়ে।

আজ বাবা নেই। নেই কথাটা কতো সহজ। কিন্তু অনুভব করতে গেলেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এই তো ছিলেন, এখন নেই। এতো বড় বাড়িটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, নেই। এতোবড় এই বাড়িটার ভেতরে কী যেন ছিলো, তা নেই এখন। সেই পরম নির্ভরতা, সেই গাম্ভীর্য, সেই অহমিকা—এসব কিছু নেই যেন। এখন এটা পোড়ো বাড়ি। ভেঙ্গে পড়ার আগের মুহূর্তটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

.

সেদিন ভোরে বাবাকে নিয়ে এলো কয়েকজন লোক। জ্ঞান নেই বাবার। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। ধরাধরি করে এনে বিছানায় শোয়ানো হলো। মা এখন চিৎকার করে কান্না জুড়েছে। আমি ডাক্তার ডাকতে পাঠালাম।

একটু পরে রাহুল এলো। ও-ই ছুটোছুটি করে ডাক্তার ডেকে আনলো, ওষুধ আনতে ছুটল। আমার বুক ফেটে তখন কান্না আসছে, কোনো রকমে দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছি। কেন না বুঝতে পারছিলাম, বাবা আর সুস্থ হয়ে উঠবেন না। এই শেষ।

বাবা আমার কেউ না। তবু কান্না পেতে লাগলো। দাদুর মৃত্যুতে এমন করে বুক ভেঙ্গে কান্না আসে নি। তখন বারবার করে আমি চোখ মুছছি আর উদ্বেল কান্নার আবেগটাকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি। ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি তীব্র উদ্বেগ নিয়ে। দেখলাম ডাক্তারের জরাজীর্ণ মুখে নৈরাশ্যের ছায়া ফুটলো একটু। ফুটলো কি ফুটলো না, ঠিক বোঝা গেলো না। কিন্তু আমি বুঝলাম।

ডাক্তার পরে আমাকে ডেকে বললেন, এ্যাপোপ্লেক্সির স্ট্রোক হয়েছে, রোগীকে খুব সাবধানে রাখতে হবে। কোনো রকম শারীরিক মানসিক উত্তেজনা যেন না হয়। তাহলেই খারাপ হবে। আটচল্লিশ ঘণ্টা খুব সাবধান, খুব সাবধান!

আবার বললেন ডাক্তার, জ্ঞান হয়তো ফিরে আসতে পারে, তখন যেন কাছে এমন কেউ না থাকে যাকে উনি দেখতে পারেন না।

রোগীর ঘরে একজন ছাড়া অন্য লোক থাকা বারণ।

ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, কেন হলো এমন?

খুব দুশ্চিন্তা অথবা স্নায়বিক পরিশ্রম হয়ে থাকলে এমন ধরনের বিপর্যর হয়। বিশেষ করে যাদের বয়স হয়েছে।

ডাক্তারের কথায় আমি মা’র মুখের দিকে তাকালাম। মা মুখ নিচু করলো। বললো, আমি কতো নিষেধ করেছি, আমার কথা কোনোদিন শুনলো না। আমি এখন কী করবো, কী হবে আমারা

মা! ধমকে উঠলাম আমি, এ ঘর থেকে তুমি যাও।

অনেক দিন পর আমি মা বলে ডাকলাম।

মা চমকে উঠলো। তারপর একটু চুপ করে থেকে বললো, কেন এ ঘরে থাকবার অধিকার কি নেই আমার? তুই কি সব নাকি?

আমার সমস্ত মন ক্ষোভে দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গেলো।

মা এখন ডাক্তার সাহেবকে বলছে, দেখুন তো, আমি এ ঘরে না থাকলে কে দেখবে ওকে এখন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই তো, আপনারই তো থাকা উচিত, তবে এমনভাবে হতাশ হবেন না, মনে জোর আনবেন।

আমি কেমন করে বলি তখন, মা তুমি এ ঘরে থাকলে বাবা বেঁচে উঠবেন না, তুমি মেরে ফেলবে ওঁকে।

ডাক্তার মরফিয়া দিয়ে গেলেন। আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে। ব্রেন টিসু ছিঁড়ে হেমারেজ হয়েছে, যতক্ষণ না রক্তটা কুট করে যায়, ততক্ষণ কিছু বলা যায় না। মাঝে মাঝে অস্থির হলে কিছু গ্লুকোজ অথবা দুধ কিংবা ফলের রস খাওয়াতে হবে।

আমি বসে রইলাম ঘরের দরজার কাছে চেয়ার পেতে। আর ঘড়ির দিকে নজর রাখলাম। আটচল্লিশটা ঘণ্টা কখন পার হয় আর কখন বাবার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরলে মাকে যেন না দেখতে পান।

আনিসকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। কখন আসে কে জানে, যদি আসতো আজই।

অতন্ত্র জেগে রইলাম উৎকর্ণ হয়ে। যদি একটু শব্দ পাই বাবার জেগে ওঠার, তাহলে ছুটে গিয়ে দাঁড়াবো কাছে। বার বার প্রার্থনা করছি, দিনের বেলা যেন জ্ঞান না ফেরে, ফেরে মাঝ রাতে, যখন মা ঘুমিয়ে থাকবে, আর আমি গিয়ে দাঁড়াতে পারবো বাবার কাছে।

সব সময় রাহুল থাকলো কাছে কাছে। কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে।

বাড়িটা নিঃশব্দ। মম্ পুতুল ছায়ার মতো ঘোরাফেরা করছে। মাঝে মাঝে ওরা অল্প কেঁদে উঠলে রাহুলই ওদের দেখছে। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, ঘরের ভেতরে মা বাবার মাথার কাছে বসে। আর প্রতীক্ষা, ক্লান্তিকর উদ্বেগাকুল দুঃসহ প্রতীক্ষা।

দিনে তিনবার করে ডাক্তার আসেন, চলে যান। রাহুল পকেট থেকে টাকা বের করে দেয় নিঃশব্দে। অল্প একটু কথাবার্তা, ফিসফিস করে। তারপর আবার চুপ। আমি বাইরের ঘরের ঘড়িটার টক টক শব্দ শুনতে পাই। কেউ যেন আসছে। তার পায়ের শব্দ শক্ত মেঝেতে বেজে উঠছে। আর সেই শব্দ অনন্তকাল ধরে এগিয়ে আসছে।

মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক থাকার পর হঠাৎ সেই ঘড়ির শব্দে চমকে উঠেছি। ভয় শিউরে উঠছে মনের ভেতরে।

বোধহয় কোনো মৃত্যুদুতের পায়ের শব্দ। কোনো মানে হয় না, তবু আজে বাজে অবাস্তব কতগুলো চিন্তায় আমার মন আচ্ছন্ন থাকলো। থেকে থেকে চমকে উঠলাম।

মাঝ রাতে সেই শব্দটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে বাজতে থাকে। মনে হয়, ওপরতলার শূন্য ঘরগুলো থেকে শব্দটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। হেঁটে ফিরছে ওদিকে বারান্দায়। কিংবা ঘরে, কিংবা আবার উঠে যাচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে।

সারাটা বাড়ি নিঃশব্দ, আর সেই অসহ্য নিঃশব্দতার মাঝখানে একটা বিরতিহীন টকটক অন্ধকার শব্দ আসছেই, আসছেই।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *