পিঙ্গল আকাশ – ২

হায়রে! মরণই ছিলো আমার ভালো। আজীবন আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে, কেউ যেন আমার মনের ভেতরে এই কষ্টের দিনেও বেঁচে থাকতে বলে, তবু আমি নিজেকেই বলি, মরণই যে ছিলো ভালো। আনিস ভাইয়ের কথা যখনই মনে হয়, তখনই বলি। আর ওর কথা মনে হয় সব সময়, সব সময়।

আমার শরীরটাই হয়েছে কাল। বেনুদা কোনো কোনো দিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে আমাকে। আমি জানি, বুঝতে পারি, ওকে চোখে না দেখতে পেলেও। সব মেয়েই নাকি পারে। ওর চোখের ভেতরে যেন একটা সাপ আছে। যে কেবলই আমার শরীরের চারপাশ ঘিরে ঠাণ্ডা দেহ দিয়ে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরতে চায়।

সেদিনের সেই ঘটনার পর আনিস ভাই আসে না বাড়ির ভেতরে। আমার কাছে এসে দাঁড়ায় না। দূর থেকে আমাকে দেখে সরে যায়। বুঝতে পারি, অস্বস্তি আর গ্লানি ওর সারা মন ছেয়ে আছে। নিজেরই ওপর বোধ হয় ভর শুধু ঘৃণা হচ্ছে। ক’দিন ধরে ওর খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, মা শুধালো, ছোট আপা ডাকলো—কারুর কথায় কান দিলো না। একদিন ও কোথায় যেন চলে গেলো। ক’দিন থেকে আর ওকে দেখা যায় না। বাড়ির কেউ সঠিক জানে না, কোথায় গিয়েছে। কেউ বলে রংপুর, কেউ বলে ঢাকা, কেউ বলে মফঃস্বলে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।

ওর জন্যে আমার দিনরাতের সব ভাবনা। যদি এই যন্ত্রণার সময় ওকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম, যদি বোঝাতে পারতাম—ওর কোনো দোষ নেই। এসব ঘটনার জন্যে দায়ী থাকে মেয়েরাই। তা’হলে আবার স্বাভাবিক হতে পারতো। কিন্তু এ সময়ে কোথায় পাব ওকে আমি।

শুধু ভাবছি ক’দিন ধরে। আজ বেনুদা অপমান করলো আমাকে। মতো কাল হয়েছে আমার এই শরীরটা।

জানতাম, বেনুদা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। কিন্তু সেটা সব সময় খেয়াল রাখতে পারি নি। আমার এই ভাবনার দিনে অন্য দিকে মন দেবো কেমন করে! দেখেও দেখি নি কখন মম-এর খিদে পায়, কখনও পুতুল কাঁদলো, কখন এলো বেনুদা, কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো বারান্দায়, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে—কিছুই খেয়াল ছিলো না আমার। কেননা আমি কান পেতে ছিলাম সর্বক্ষণ বাইরের দিকে। কখন দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শুনতে পাব। কখন একজোড়া ক্লান্ত পায়ের পরিচিত শব্দ ধীরে ধীরে উঠে আসবে বারান্দায়, তারপর হারিয়ে যাবে উত্তরের ঘরের চারটে দেওয়ালের ভেতরে।

তখন সারাটা বাড়ি নির্জন। ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বেনুদা এলো। ওই সময় ও রোজ আসে। হ্যাঁ, প্রায় রোজ। এসে মা’র সঙ্গে গল্প করে, মম্ আর পুতুলের সঙ্গে দু’একটা কথা বলে, তারপর চলে যায়। ওর থাকবার সময়টা সমস্তক্ষণ ওর চোখে আমি দেখেছি, কী যেন খুঁজছে ও। আজও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে হাসলো। তারপর এগিয়ে এলো দরজার দিকে, যেন ঘুরে ঢুকবে। আমি একদিকে সরে গেলাম। আমাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় একমুহূর্ত ও দাঁড়াল, আমার শরীর ঘেঁষে তার পরই ছিটকে পড়তে হলো আমাকে। ওর একটা হাতের কতকগুলি ক্লেদাক্ত আঙ্গুল আমার বুকের ওপর চেপে বসতে চাইছিলো।

আমি কয়েক পা পিছিয়ে ওর দিকে তাকাতেই ও নির্লজ্জের মতো হাসলো। বললো, কি হলো তাতে আর! ও-সব কিছু না, মনে করো না কিছু।

আমার এখন বলবার মতো কথা নেই কোনো। ক্রোধে ঘৃণায় আর প্রতিহিংসায় আমি একাকার হয়ে গিয়েছি। প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিলো, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা কামড়ে ধরি।

আর সেই মুহূর্তের পর নিজেকে আমার অশুচি মনে হতে লাগলো। আমাকে স্নান করতে হলো। সারা গায়ে সাবান মাখলাম। তবু ওর আঙ্গুলের ঘৃণ্য স্পর্শ কিলবিল করতে লাগল আমার সর্ব অনুভূতির মাঝখানে।

স্নানের পর শান্ত হতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথায় শান্তি! ঘরে এখনও মা’র সঙ্গে বেনুদা গল্প করছে। ওর প্রত্যেকটা স্বর আমাকে কেবলি একটার পর একটা ঘৃণার আবর্তের মধ্যে এনে ফেলছে। শুধুই ঘৃণা আর ঘৃণা, বাড়ির সবাইকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছিলো আমার ঐ মুহূর্তে।

আনিস ভাইয়ের জন্যে সারা দিনরাতের এত যে ভাবনা—ঘৃণার এই প্রবল স্রোতে সেই ভাবনাও আবিল হয়ে উঠতে লাগল। আনিস ভাইয়ের ওপরও ঘৃণা হতে লাগলো। বেনুদা আর ওর মধ্যে পার্থক্য কোথায়! সবাই তো আমার এই রক্তমাংসের শরীরটার দিকেই হাত বাড়িয়েছে। আমার এই আঠারো বছরের বয়সটাকে অভিশপ্ত করে তুলতে চেয়েছে। কাকে আমি শ্রদ্ধা করবো, কাকে আমার ভালো লাগবে!

রাহুল, ছোট আপা এরা সম্পর্কে ভাই বোন হয় আমার। কিন্তু এরা তো আমাকে এ-বাড়িতে চায় না। বাবা’ও যে এ-বাড়িতে রাখছেন আমাকে, সেও তো কাজকর্মে মায়ের সাহায্য হবে বলেই। মা’ই বা কখন আমাকে আপন করে নিলো? সবাই স্বার্থ খুঁজছে। লোভ আর ঘৃণা—এ ছাড়া যেন এদের আর কোনো অনুভূতি নেই।

সারা বিকেল আমার একাকী কাটলো? কারুর সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারলাম না। বেনুদা’র কি সাহস, আমাকে ঘরে ডাকলো, পান সেজে দেয়ার জন্যে। ওর ডাকে সাড়া দিলাম না।

রাতে, গতকাল রাতে, আমাকে নিয়ে আর এক ঘটনার সূত্রপাত হলো। জানি না, ছোট খালাই আসলে সূত্রপাত করে গিয়েছিলো কি না।

আকাশে তখন অনেক তারা ছিলো। হাওয়া দিচ্ছিলো বাইরে। বাইরের অশ্বত্থ আর লিচু গাছের পাতা কাঁপার সরসর শব্দ হয়ে চলেছিলো। আমি জেগে ছিলাম। ঘুম আসছিলো না। শুধু শূন্য একটা অনুভূতি। রাতের অন্ধকারের মতো গভীর এবং শূন্য। আলো নেই, কোলাহল নেই। শান্ত আর রহস্যময় শূন্যতার মধ্যে আমি যেন ভাসছিলাম তখন।

এমন সময় পাশের ঘরে মা আর বাবার কথা কানে এলো। আমি প্রথমটা শুনেও শুনতে চাই নি। কিন্তু আমার নাম শুনে আমাকে সজাগ হতে হলো।

শুনলাম, মা বলছে, আর দেরি নয়, মঞ্জুকে ওর দাদুর ওখানেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।

কেন?

এমনি। ও কি তোমার সংসারে বাঁদিগিরি করতে এসেছে নাকি? ওর কী লাভ এখানে থেকে। ওর দাদুরা ওর বিয়ে ঠিক করছেন, হলে হয়ে যাক। নইলে কে দেবে ওর বিয়ে।

আহা কি দরকার এতো তাড়াতাড়ি! বাবা যেন বোঝাতে চাইলেন। মেয়ের বয়স বসে নেই। ও বয়সের অনেক আগে আমি মা হয়েছিলাম। তোমরা তো আর বিয়ে দেবে না। ওর যাওয়াই ভালো।

আহা বুঝছো না কেন, বাবা যেন হাত নেড়ে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, ফরিদার বিয়ে না হলে—ওর বিয়ে কেমন করে দেয়া যায়?

সে তো যাবেই না! মা’র স্বরে তীব্র শ্লেষ, তুমি তো মেয়ের বিয়ের কথা ভাবো না। লেখাপড়া শিখিয়ে মেয়েকে বিদ্যাধরী বানাতে চাও। আমার মেয়ের বিয়ে আমি আগেই দেবো।

যা ভালো বোঝো করো—বাবার স্বর ক্লান্ত।

তারপরই মা’র একটানা কথা। বুড়ো হয়ে যাচ্ছো তবু তোমার খাম-খেয়ালী গেলো না। একটা কিছু করো।

কী করবো?

তবে কি তোমার ছেলেমেয়েদের দেখা-শোনা করার জন্যে আমি আমার জীবনপাত করবো! ওরা আমার কে? মা’র কণ্ঠস্বর তীব্র হয়ে উঠলো।

একটু পর দরজা খোলার শব্দ হলো। বাবার ক্যাম্প-খাট পাতার শব্দ পেলাম বারান্দায়।

মা ঘরের ভেতরে এখন গজ গজ করছে, যাও না, কোনো চুলোয় যেতে পারো দেখি। আমাকে মারবার জন্যে এনেছো তুমি এখানে, হ্যাঁ, মেরে ফেলার জন্যে।

এমনই হচ্ছে বছর খানেক ধরে। অথচ যখন প্রথম এসেছিলাম এ বাড়িতে, মার চোখে তখন জীবনের সব তৃপ্তির ছায়া দেখেছিলাম। মনে হয়েছিলো, মা’র জীবনে বোধ হয় আর কোনো খেদ নেই, দুঃখ নেই। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কোন সূত্র থেকে যে এলো এমন তিক্ততা টেরও পেলাম না। কেবল দেখলাম, দু’জনের মাঝখানে যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল উঠে দাঁড়াচ্ছে। আর দিনের পর দিন অদৃশ্য একটা সম্পর্কের মধ্যে মা, বাবা, আর তাদের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু দেখলাম, আসলে তাও নয়। সবাই একাকী। বাবা আর ছোট আপা, ছোট আপা আর আনিস ভাই, রাহুল আর আমি এ বাড়ির সঙ্গে কারো যোগ নেই। এই যে সম্পর্কের বাঁধন দেখি, এ যেন শুধু বাইরের। ভেতরে ভেতরে সবার চোখে সন্দেহের ছায়া। এদের সব সম্পর্কের মূলে কেউ যেন একের থেকে অন্যকে কেটে কেটে বাদ দিয়ে রাখছে।

আর যতো যন্ত্রণা, যতো কষ্ট, সব বোধ হয় এই জন্যেই। একে অন্যকে জানতে চেষ্টা করেও পারছে না। একে অন্যের দিকে হাত বাড়ায়—কী যেন এক পরম প্রত্যাশায়। কিন্তু কারো দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। এ এক আশ্চর্য বাড়ি। যেন শহরের হোটেল। পাশাপাশি থাকছে এরা, এক সঙ্গে বাস করছে, ফুটে উঠছে জীবনে—কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারছে না, জানতে পারছে না।

এ সবই তো গেলো গতকালের কথা। আমার কেবলই চিন্তা হচ্ছে, ছোট আপা হয়তো একদিন বাবার সঙ্গে জগড়া করবে। কিংবা রাহুল হয়তো একদিন বাবার সঙ্গে ঝগড়া করবে। রাহুল বাসায় থাকে না। মা ওকে দেখতে পারে না, ছোট আপা কেবল বকে, বাবা সব সময় রেগে আছেন। শুধু খাওয়ার সময় আসে ও। তার পরেই চলে যায়। ওর ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে, অথচ পড়াশোনা একদম করছে না।

বলছি তো, এটা এক অদ্ভুত বাড়ি এখন। কেউ কারো দিকে কোনো সময় তাকাতে চায় না। আজই রাহুল বেনুদাকে ধরেছে বিকেলে। সোজা বললো, খবরদার, এ বাড়িতে পা রাখবি না, মেরে ফেলবো তাহলে। মা বেনুদাকে ডেকে আনতে গেলো। ও ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো। রাহুল ধমকে উঠলো, যদি পা বাড়িয়েছিস, তাহলে আজ রাতে যখন রাস্তা দিয়ে যাবি, তখনই মজা দেখিয়ে দেবো।

বেনুদা দরজার কাছ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে গেলো। ভেতরে এলো না। আনিস ভাইয়ের সমান বয়সী বেনুদা, তবু ভয় করছে রাহুলকে। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম ওদের কাণ্ড। আমাকে ডাকলো বেনুদা, তুই তাহলে রাহুলকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিস?

অবাক হতে হলো। লোকটা উন্মাদের মতো এসব কী কথা বলছে। ওদিকে মা’র চোখ ফিরলো আমার দিকে। মা যেন নিভে গেলো সেই মুহূর্তে। আমার ওপর কী যেন কুটিল সন্দেহ রয়েছে মা’র মনে, সেই চিহ্ন দেখলাম মা’র মুখে।

কেন রাহুল বেনুদার ওপর হঠাৎ অমন মারমুখো হয়ে উঠলো, বুঝলাম না। আর জানি তো, ও কাউকেই কিছু খুলে বলবে না। তাই জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না।

আজ বুঝতে পারলাম, আগের মতো সহজেই আর আমি ঘরের বাইরে বেরুতে পারবো না। খাঁচার পাখি হয়ে ঢুকতে হবে খাঁচাতেই। আনিস ভাই যে কোথায়! রাহুল ও থাকতে পারবে না হয়ত। ডায়েরি লেখার সময় শুধু কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রাহুল থাকবে না, আনিস থাকবে না। আর হয়তো, আমি যে, আমিও থাকবো না। সন্দেহ আর সংশয়, ঘৃণা আর হিংসা, সবাইকে আবিল করে তুলবে।

আমি যদি এ বাড়ির কেউ হতাম। যদি ওরা আমাকে ছোট আপার মতো আপন করে দেখতো। সবাই আমার অধিকার স্বীকার করে নিতো, ওদের সবার হাত ধরে আমি ফেরাতাম। সবাইকে ভালোবাসতে বলতাম। বোঝাতে চেষ্টা করতাম। যখন বাবা আর মা একবারও মুখোমুখি হতো, বলতাম, তোমরা ঝগড়া করো না। সুখী হতে চেষ্টা করো। জীবনের চারপাশে অনেক যন্ত্রণা, তোমরা মনের দিক থেকে অন্তত সুখী হতে চেষ্টা করো।

কিন্তু পারি না। আমাকে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমার অমন মিনতি দেখে পাগল ভাববে। আমাকে কেউ বুঝবে না। না বাবা, না মা, না ছোট আপা, না রাহুল, না আর কেউ। ওদের যদি মা থাকত।

.

আমার চারপাশে সারাদিন কতো ঘটনা ঘটে। আমাকে দেখতে হয়, শরিক হতে হয় সে সব ঘটনায়। কতো কাজ, কতো সাংসারিক ভাবনা। হয়তো অন্য কোনো কিছু ভাবনার অবসর পাই না। কিন্তু রাতে, যে মুহূর্তে আমার অবকাশ হলো, সেই মুহূর্তে মনে পড়লো আনিসের কথা। এই এখন ডায়েরী লেখার সময় কেবলি ভাবছি। আনিস ভাই, ফিরে এসো তুমি। আমাকে যা ইচ্ছে শাস্তি দিও। তোমার কোনো দোষ নেই। আমারই ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে পাপ। আমার অজ্ঞাতেই ও আমাকে দিয়ে লোভের পশরা সাজায়। আমি জানি না কখন, কী ভাবে। কিন্তু তবু ও আমাকে পুতুল বানিয়েছে। এই শরীরের ভেতরেই রয়েছে আমার সব চাইতে বড় শত্রু। আনিস ভাই, ফিরে এসো।

.

রাহুল আমাকে দেখতে পারে না। অপমান করছে যখন তখন। কথায় কথায় বলে, কেন আছিস তুই এখানে? চলে যেতে পারিস না?—ওর গলার স্বরে শ্লেষ বিরক্তি ঘৃণা হিংসা সব এক সঙ্গে শুনতে পাই।

রাহুলের কথা যখন প্রথম শুনি, তখোন ভেবেছিলাম রাহুলের মতো শান্ত সুন্দর ছেলে বোধহয় হয় না। ছোট আপা ওর সম্বন্ধে ভারি সুন্দর গল্প বলেছিলো। সেটা ওর নাম রাখার কাহিনী।

বৈশাখী পূর্ণিমায় জন্ম হয় ওর। গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন সেটা। আনিস ভাই ওর নাম বুদ্ধ রাখতে চেয়েছিলো। সবাই তখন আপত্তি করে। নামটা বিচ্ছিরি, বড় হলে ওর বন্ধুরা ওকে বুদ্ধ বলে ক্ষ্যাপাতে পারে। তখন বেছে বেছে নাম রাখা হলো রাহুল, গৌতমের ছেলে। ওর মা ছেলেমেয়েদের কাছে গল্প করতেন, এই ছেলে আমার লোভ, হিংসা, রাগ—এসব থেকে অনেক দূরে থাকবে। আর ছোটবেলাতে ও অমনই ছিলো। সুন্দর, শুভ্র, শান্ত আর সহজ। ছোট আপা বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিন্তু এই কটা বছরে ও যে কেন এমন হলো, কে জানে।

ও যখন গালাগাল করে, তখন সহ্য করতে চেষ্টা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে ওঠে, যখন ও বলে, কেন এখানে আছিস তুই, চলে যেতে পারিস না?

তখন আমি আর সহ্য করতে পারি না। বলি, চলে তো যাবোই। তোদের এখানে চিরকাল থাকতে আসি নি। তোরাই তো ডেকে আনিয়েছিস এখানে, এখন লজ্জা করে না?

আমার কথায় কী থাকে জানি না। ও ক্ষেপে ওঠে একেবারে। বলে, তোর মরে যাওয়া উচিত। তোর বাবা নেই, ঘরবাড়ি নেই, বাঁদীর মতো এ বাড়িতে আছিস তুই মরে গেলে শান্তি পাবি।

রাহুলের কথা আমাকে কাঁদায় না। যদি আর কেউ বলতো, বাবা কিংবা ছোট আপা, তাহলে হয়তো মনে লাগতো। কিন্তু রাহুল যে আমারই মতো একাকী। ওকে কেউ ভালোবাসে না। ওর বাবা থেকেও নেই। ভাই বোন থেকেও নেই। চারদিক থেকে শুধু ও আঘাত পায়। ও যে সবাইকে আঘাত করবার জন্যে আক্রোশে ফুলে উঠবে এতে আর আশ্চর্য কি। ওর জন্যে আমার দুঃখ হয়। একদিন ওর কাছে গিয়ে বললাম, আচ্ছা রাহুল, কেন আমার ওপর তোর এতো রাগ? আমি কি কিছু করেছি তোর? মিছিমিছি রাগারাগি করে এতো কষ্ট পাস কেন তুই? আয় না আমরা বন্ধু হয়ে যাই।

আমার কথা শুনে অদ্ভুত চোখ তুলে তাকালো রাহুল। সেই অন্ধকার দুচোখের আড়াল দিয়ে যেন স্নিগ্ধ আলো ফুটলো একটু একটু করে। কিন্তু সেও মুহূর্তের জন্যেই। পরক্ষণেই ওর চোখ আবার অন্ধকার হয়ে উঠলো। চিবুকে দৃঢ় রুক্ষতার আভাস দেখা গেলো। বললো, নে রাখ, অতো আদিখ্যেতা অন্য কাউকে দেখাস।

ও চলে যাওয়ার আগেই মা এসে দাঁড়িয়েছিলো পেছনে।

আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলো আমাকে। রাহুল পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই মা জিজ্ঞেস করলো, কি করছিস এখানে?

রাহুল আমার সঙ্গে কেন ঝগড়া করে, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।

কী দরকার তোর ওসবে! বড় বাড় বেড়েছে না? এসব কি বেহায়াপনা, ফের যদি তোকে ওর সঙ্গে কথা বলতে দেখি—তোকে আস্ত রাখবো না আমি, জবাই করে রাখবো ঘরের ভেতরে।

আমি মুখ নিচু করে চলে আসছিলাম। সেই মুহূর্তে মনে পড়েছিলো ছোট বেলাকার একটা দৃশ্য। নিঝুম দুপুরে এক ঘরে মা আর কবির চাচা গল্প করছে। কথাটা মনে এলো আর চলে এলাম। আমি কিছু বলতে পারলাম না। কী বলবো আমি? এরা কেউ আমার আপনার নয়। কেউ না। সবাই শুধু সন্দেহ নিয়ে আছে। রাহুলের কথাই ঠিক, আমার মরে যাওয়াই ভালো। হ্যাঁ, মরে যাওয়াই উচিত। আমি কোথায় যাবো! আমার কোনো আশ্রয় নেই। কেউ আমাকে চায় না।

চলেই যাচ্ছিলাম। বারান্দায় আবার থমকে দাঁড়াতে হলো। মার কথা এখনও ফুরোয় নি। গজ গজ করে বলছে, কেন বেনুর উপর রাহুলের এতো আক্রোশ, এখন বুঝতে পারছি, আসুক আজ ওর বাবা। ওকে যদি বাড়ি থেকে না তাড়িয়েছি তো আমার নাম বদলে রাখবো।

আমার মনের ভেতর থেকে শুধু একটা ধিক্কার বেরুলো, ছিঃ এদের মন এতো ছোট কেন? কেন খালি সব কিছুর একটাই অর্থ দেখতে পায় এরা?

.

এ বাড়ি অসহ্য হয়ে উঠছে আমার কাছে। হ্যাঁ, এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আর যাবোই বা কোথায়। মনের ভেতরে রাগ মেশানো একটা কান্না ফুলে ফুলে উঠছে। কিন্তু কাঁদতেও যে পারছি না। আমার এ কান্না আমি কোথায় লুকাবো। আর কেঁদেই বা লাভ কি! এমনই তো আমার জীবন।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর খাতা খুলে ইংরেজি লিখতে বসলাম। আমার ইংরেজি লিখতে ইচ্ছে করে। অবসর সময় আমার কল্পনার বন্ধুদের ইংরেজি ভাষায় সুন্দর সুন্দর শব্দ সাজিয়ে চিঠি লিখতে ভালো লাগে। চিঠি লিখতে লিখতেই হঠাৎ স্মরণ হলো, যদি দাদুকে অথবা চাচাকে একটা চিঠি লিখি, তাহলে হয়তো ওঁরা আমাকে নিয়ে যাবেন এখান থেকে। সারা দুপুর বসে বসে চিঠি লিখলাম। লিখে রেখে ছোট আপার কাছ থেকে খাম চেয়ে নিয়ে এলাম। ঠিকানা লিখে চিঠিটা বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে রাখলাম। সময় মতো ডাক-বাক্সে ফেলে দেবো।

মা বসে ছিলো অদূরে। মম আর পুতুলের জামা সেলাই করছিলো। মার পাশে গিয়ে বসলাম। জানালাম, আমি দাদুর ওখানে যাবো মা। খুব ইচ্ছে করছে যেতে। কতদিন কোথাও যাই না।

মা শুনলো চুপ করে। তারপর বললো, আচ্ছা দেখি জিজ্ঞেস করে তোর বাবাকে, উনি কী বলেন।

ঐ পর্যন্ত। আর কথা বলতে পারলাম না। আমার দু’মাসের স্কুল-জীবনের বন্ধুরা বেড়াতে এলো।

ঈশ, আজকালকার মেয়েরা কি ভীষণ পাকা। রঞ্জু তো অতটুকু মেয়ে। ও এক পাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোর আনিস ভাই কলেজে চাকরি করবে না?

না, কেন? পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

করলে আমাদের তো ওর কাছে পড়তে হবে, তাই জিজ্ঞেস করছি। একটু থেমে আবার বললো, আচ্ছা ও কি প্রেম করছে কারো সাথে?

ওর কথা শুনে, জানি না কেন, বুকের ভেতরে দুরু দুরু কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল আমার। প্রেম! আশ্চর্য হতে চেষ্টা করলাম, কোথায়, জানিস নাকি কিছু?

না, না, আমরা কেমন করে জানবো? রঞ্জু একেবারে লক্ষ্মী মেয়েটি হয়ে যেতে চাইলো। নাসিমা এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো। সোৎসাহে এগিয়ে এসে বললো, জানিস না? ক’দিন ধ’রে তোর আনিস ভাই ওর মামার বাড়িতে যাচ্ছে। ওর মামাতো ভাই আহসানের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব তোর আনিস ভাইয়ের। ওদের বাড়িতে রঞ্জুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

আগাগোড়াই ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগছিলো। ভালো করে কথা বলতে পারলাম না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ও তোর সাথে কথা বলে?

হ্যাঁ, রঞ্জু মাথা নাড়াল।

তোকে বলেছে ও তোকে ভালোবাসে? নাসিমা হঠাৎ মুখিয়ে উঠে প্রশ্ন করলো

হ্যাঁ, মাথা নাড়লো আবার রঞ্জু। তারপর বললো, আমাকে চিঠি লিখেছে।

আমার হাসি পেলো। কী চালবাজ মেয়ে রে বাবা! এতো মিথ্যে কথাও বলতে পারে! হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম, কবে দেখেছিস তুই?

কালই তো গিয়েছিলো।

এবার হেসে ফেল্লাম। বললাম তবু অতি কষ্টে, আনিস ভাই এক সপ্তাহ ধরে নীলফামারী নেই।

বাঁচলাম ওরা চলে গেলে। মনের ভেতরে কী যেন একটা ঝড় এসে গিয়েছিলো হ্যাঁ, ঝড়। কোনো মানে হয় না, তবু। একটু আগে মনে হয়েছিলো, ওদের সবাইকে আমি তাড়িয়ে দেবো। কিন্তু ঝড়টা শেষ পর্যন্ত এলো না। মেঘের গুড়গুড় ডাক শুনিয়েই দূর থেকে চলে গেল।

আনিস ভাই আজো এলো না। ও আসবে কিনা তাই বা কে জানে। চাচা যদি নিতে আসতো, তাহলে চলেই যেতাম আমি। একমাস পর চাচা আসবে নিয়ে যেতে। এই একটা মাস কেমন করে যে কাটাবো এই যন্ত্রণার পুরীতে!

রাহুল আজ বাড়িতে আসে নি সারাদিন।

তখন সকাল। ঘুম থেকে উঠে বাইরের দিকে এলাম। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিলো। সারা শরীর জুড়িয়ে গেলো হাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তখন ফর্সা হয়েছে শুধু, রোদ ওঠে নি। পাশের আম গাছ থেকে মুকুলের গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়।

ঘরের ভেতরে ঈজি চেয়ার পাতা। জানালা দিয়ে আবছা দেখা যায় শুধু। হঠাৎ রাহুলের গলা শুনলাম, ও ডাকলো আমাকে। ঘরের ভেতরে গেলাম। ও ঈজি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।

জিজ্ঞেস করলাম, কাল সারাদিন কোথায় ছিলি? কখন এসেছিস?

বাইরে বাইরে ঘুরেছি কাল সারাটা দিন।

একটু পর কী যেন ভেবে ও মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো, আমাকে মাফ করবি?

মাফ, কেন? অবাক হলাম। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা!

হ্যাঁ, আমি শুধু শুধু তোকে খারাপ কথা বলি। আমরা বন্ধু হ’তে পারি না? ও সহজ ভাবে দেখলো এতক্ষণে আমার দিকে।

কেন পারবো না। আমি ওর হাত ধরলাম, তাছাড়া আমি তোর বোন।

রাহুল অদ্ভুত সুন্দর আর স্বচ্ছ হাসলো। ওর না-ঘুমানো ঘোলাটে চোখে অপরূপ আলো এসে লাগলো।

সকালের আলো তখন জানালার ভেতর দিয়ে ঘরের দেয়ালে এসে পড়েছে। ওকে বললাম, তোর পরীক্ষা সামনে, এবার পড়াশোনায় মনোযোগ দে। মিছিমিছি কষ্ট পাস কেন এতো?

আমার ভালো লাগলো ভাবতে যে রাহুল হয়তো আর কষ্ট পাবে না। হয়তো বেঁচে যাবে একটা যন্ত্রণা থেকে। কি সুন্দর এমনি ভাবে কারো বন্ধু হয়ে যাওয়া, কেমন অপরূপ এমনি একজনের বোন হওয়া। মনের ভেতরে কোথায় যেন আশ্বাস আর স্নিগ্ধতা ছেয়ে এলো।

কিন্তু ঘটনা যে মানুষকে স্থির থাকতে দেয় না। যে সুন্দর সকালটা আমার ভালো লাগছিলো। সেই সকালটা মরে গেলো দুপুরেই। হ্যাঁ, একেবারে দুপুরেই আমার সব ভালো লাগার সমাধি হয়ে গেলো।

ছোট আপা বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বসলো। ব্যাপারটা তুচ্ছ, একেবারেই তুচ্ছ। ছোট আপার মায়ের সেই ফটো এলার্জের ব্যাপার। ছোট আপা কয়েক দিন ধরেই বাবাকে বলছিলো, সেই ফটো থেকে একটা পোর্ট্রেট করিয়ে দিতে। ঢাকায় পাঠিয়ে কোনো আর্টিষ্টকে দিয়ে প্রোর্ট্রেট করানো হবে। ফটোটা আপা এখনই পাঠাতে চায়। বাবা এখন রাজি হচ্ছেন না, হাতে এখন টাকা পয়সার অভাব। আর তাই নিয়ে ঝগড়া। ছোট আপা এক সময় বলে উঠলো, তুমি স্বার্থপর, নিজের এতোটুকু কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই তোমার। নিজের সুখের জন্যে বুড়ো বয়সে তুমি বিয়ে পর্যন্ত করতে পারো। ছেলেমেয়ে কারো সুখ-সুবিধার দিকে দেখতে পারো না তুমি। এখন অন্ধ হয়ে গিয়েছো একেবারে।

বাবা দোকান থেকে ফিরে এসেছিলেন খানিক আগে। মেজাজ ঠিক ছিলো না। বললেন, তবু তো এই স্বার্থপর অন্ধ লোকটাকেই বাবা বলে ডাকতে হবে। যদি বাবা বলে ডাকতে অসুবিধা হয়, ডেকো না। এ বাড়িতে থেকো না। রাস্তা খোলাই আছে।

এবং সত্যি সত্যি আপা একটু পর সুটকেস হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

মা দেখলো, বাবা দেখলো, আমি দেখলাম —কিন্তু কেউ কিছু বললাম না। এ যে হবে, আমি জানতাম। এর সূত্রপাত অনেক আগে। আমি এ বাসায় আসারও অনেক আগে।

ছোট আপা পড়াশোনা করে। কিন্তু আমি জানি, পড়াশোনোর দিকে ওর ঝোঁক নেই। ওর ইচ্ছে ঘর-সংসার করার। ওর বন্ধুদের এক এক করে বিয়ে হয়ে গেলো। ছোট আপা কারো বিয়েতে যেতো না নিমন্ত্রণ পেয়েও। ওদের বিয়ের দিনগুলোতে সারাদিন বাড়ি থেকে বেরুতো না। আর খুব রেগে থাকতো। ও ছেলেদের দেখতে পারতো না। বলতো, ছেলেরা সবাই শয়তান, ওদের কখনও বিশ্বাস করবি না। বাবা, ভাই, কাউকে না।

আর কতোদিন ও পাশের ঘরে অনেক রাত অবধি জেগে থেকেছে। পরদিন বাবাকে ডেকে বলেছে, আমার সারারাত মাথা ধরে ছিলো। একটুও ঘুম হয় নি।

বাবা শুনেছেন, তারপর চুপ করে চলে গিয়েছেন। বাবা বুঝতেন। কিন্তু কোনো উপায় দেখতে পান নি। ছোট আপার বিয়ের জন্যে কম চেষ্টা করেন নি। কিন্তু কী করবেন। ছোট আপার রংটা ফর্সা নয় বলে সব জায়গা থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে। টাকার চমক দিয়ে রংটা যে ঢেকে দেবেন, তারও সামর্থ্য ছিলো না তাঁর কাছে। আর চার পাশের এই ব্যর্থতা, হতাশা, সমস্ত ব্যাপারটাকে এমনি একটা বিশ্রী অবস্থায় টেনে আনলো।

রাহুল ছিলো না। যখন এলো, তখন বললাম, যা শীগগির ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। রাহুল কিছু বললো না, চুপ করে একটু দাঁড়িয়ে থেকে কান্না চাপতে চাপতে আমার কাছ থেকে সরে গেল।

.

ছোট আপার জন্য কষ্ট হলো আমার। আর নিজের জন্যে ভয়। তবে এ ভয়টা অস্পষ্ট। ছোট আপার মধ্যে অস্পষ্ট হলেও, আমারই একটা চেহারা দেখতে পেলাম। আমিও হয়তো ছোট আপার মতো হয়ে যাবো এক সময়। আমারও যদি বিয়ে না হয়, আমারও যদি পড়াশোনা নিয়ে থাকতে গিয়ে শুধু ক্লান্তি লাগে। আর ছেলেদের কাউকে যদি কোনোদিন বিশ্বাস না করতে পারি, তাহলে আমিও একদিন বেরিয়ে যাবো। এমনি একটা অস্পষ্ট ধারণা আমার নিজের সম্বন্ধে মনের ভেতরে পাক খেয়ে উঠলো।

কিন্তু কেউ কিছু করতে পারে না এজন্যে। বাবাকে ছোট আপা ঘেন্না করে, ঘেন্না করে মা’কে, আনিসকে, এমন কি রাহুলকেও। আর আমাকে তো বাড়ির লোক বলেই মনে করে না ও। ওর কী যেন একটা অভিযোগ রয়েছে। যে অভিযোগ ও মুখ ফুটে কোনোদিন করতে পারে নি। আর পারে নি বলেই মনে মনে ও হিংসায় জ্বলে উঠেছে। এবং ঘৃণার শেষ ধাপে পৌছে শেষটা ঝাঁপ দিল সম্মুখের অগাধ অনিশ্চিত ভবিষ্যতে।

শুধু কি তাই! শুধুই কি ঘৃণা আর হিংসা? না, শুধু তা নয়। তার সঙ্গে আছে নিজের সুখ আর সাধ নিয়ে জীবনে বেঁচে থাকবার আকাঙ্ক্ষা। আর সে আকাঙ্ক্ষাই ওকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে গেল নিশির ডাকের মতো।

এখন হয়তো, কোথাও স্কুলের দিদিমণি হবে—কিংবা হয়তো বিয়ে করবে কাউকে। এমন তো কতো হয়। হে খোদা, যেন তাই হয়। ছোট আপা জীবনে যেন সুখী হয়।

দীর্ঘ স্রোতের পথে একটুখানি যেন আবর্ত। চৌধুরী বাড়ির গতানুগতিক জীবন ছোট আপার চলে যাওয়াতে একটুখানি চঞ্চল হলো, তারপর আবার গতানুগতিক ধারায় চৌধুরী বাড়ির জীবন চলতে থাকলো। কারুরই মনে থাকলো না–কে আছে এ-বাড়িতে, কে নেই।

এমনই নাকি হয়। একবার দূরে চলে গেলে তার কথা মনে থাকলেও কেউ তার জন্যে ভাবতে বসে না। ও নেই কিন্তু এই কথা কারো বুকে বাজবে না।

বেনুদার লোভ থেকে কবে যে মুক্তি পাবো!

একমাস পর আবার লিখবার মতো কথা হলো। চাচারা কেউ আমাকে নিতে আসেন নি। ওঁদের সময় হবে না এখন। যদি সময় হয়, তাহলে সেই বৈশাখে। ওঁদের ব্যবসা নিয়ে ওঁরা এখন খুব ব্যস্ত। আমি কী করতে পারি? জোর করে নিজের দাবি জানাবো যে, সে অধিকার আছে কি না তাতো বুঝতে পারি নি কোনোদিন। আর দাবি কার কাছেই বা জানাবো? ও বাড়িতেও তো আমাকে ওদের অনুগ্রহের ওপরই বাস করতে হয়

একেক সময় মনে হয়, মানুষের বোধ হয় ভিখিরী হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। আমার দরকারী জিনিসের কথা কাউকে বলতে পারি না। নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হয়। মনে হয়, আমি যেন ভিক্ষা চাইছি। এমন মনে হওয়া উচিত নয়, আমি বুঝি। কিন্তু তবু আমার মনে হয়।

আর হবেই বা না কেন! বাবার কাছে চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করেন মাকে, জিনিসটা সত্যিই আমার দরকারী কি না। আর দরকারী হলে যদি এনে দেন, তো কতো দাম হলো সেকথাও শোনান সঙ্গে সঙ্গে। আমাকে নয়, মাকে। মার কাছে বলেন, মা চুপ করে শোনে। আর আমার ওপর মিছিমিছি রাগ করে। সময় সময় আমাকে গালাগাল করতে থাকে। আমি শুনি। চোখ ফেটে পানি পড়তে চায় আমার। কিন্তু কি করতে পারি। এ শরীরটাই যে হয়েছে আমার কাল। এর জন্য কাপড় জামা দরকার। আর এর অসুখ করলে বেঁচে ওঠার জন্যে আবার অষুধেরও যে প্রয়োজন।

এদিকে বেনুদা রোজই আসছে। ওর দৃষ্টি এখনও আমার শরীরের চারপাশে পিচ্ছিল হয়ে কিবিল্ করতে থাকে। কেবলি মনে হয়, আমার শরীরে কী যেন ঘৃণ্য আর কিবিলে জিনিস লেগে থাকছে। ওর চোখ তাকিয়ে থাকে আমার গায়ে গায়ে। সম্মুখে দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখতে পাই ওর চোখ জ্বল্ জ্বল্ করে জ্বলছে।

স্নান সেরে সেদিন ঘরে ঢুকেছিলাম। চুল ঝাড়বো, গায়ে ভালো করে জামা দেব। তখন শুধু শাড়িটাই গায়ে জড়ানো। আমি উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকবো, এমন সময় বারান্দায় ওকে দেখলাম। ওকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় শুনলাম, ও নিচু গলায় বললো, তোকে দেখতে ফাইন লাগছে।

ওর কথা শুনে দাঁড়ালাম না, সাড়া দিলাম না। ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার তখন বিচ্ছিরি লাগছিলো নিজেকে। কেন বলে ওরা আমাকে, শুধু আমাকেই। দুনিয়াতে কি আর কোনো মেয়েকে দেখে নি ওরা। ওরা কী চায় আমার কাছে?

কাপড়-জামা পড়ে, চুল আঁচড়ে বাইরে এলাম। তখনও দেখি বেনুদা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে!

এই শোন, ও ডাকলো আমাকে।

কিছু বলবেন, কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, মুখোমুখি।

আচ্ছা মঞ্জু, ওর স্বরে কী রকম যেন অস্বাভাবিকতা ছিলো। বললো, আমি কেন এ-বাড়িতে আসি জানো না?

জানি, আমার জন্যে আপনি আসেন। আমি ওর মুখের ওপর শব্দ কটা বললাম। আমার দু’চোখে তখন ঘৃণা জ্বলছিলো।

সত্যি, তোমার জন্য এতো ভাবি। ওর স্বর এবার আবেগে গাঢ় হয়ে উঠলো।

আমার এতো বিরক্তি লাগছিলো তখন। বললাম, আপনি যদি এমনি পাগলামি করেন, তাহলে আমি বাবা আর রাহুলকে জানাবো। জুতো দিয়ে পিটেয়ে এসব ভূত ঝেড়ে দেবে।

কিন্তু কী দোষ করেছি আমি। এতো নিষ্ঠুর হতে পারো তুমি!

অমন নাটুকেপনা বরদাস্ত করা কঠিন। ওর সঙ্গে কোনো কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না। মানুষ যে মানুষকে কতখানি ঘৃণা করতে পারে, সেদিন প্রথম অনুভব করলাম। কোনো মানুষকে খুন করার আগে মানুষের মনে যে কতখানি ঘৃণা থাকে তা বুঝলাম।

কিন্তু না, আমার মা-ই যেন আমার ঘৃণা আনন্দ ভালোলাগা মন্দ লাগা আর ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে খেলা করছে। মা কী যেন দেখতে চায় আমার ভেতরে। যেন বুঝতে চায় কিছু আমাকে দেখে। জানি না আমি, তা ঠিক কী।

নইলে সেদিন মা কেন বলবে, যা তুই সিনেমা দেখে আয়।

জিজ্ঞেস করলাম, কে যাবে সঙ্গে?

কেন, বেনু।

আমি কোনো জবাব দিই নি। কী জবাব দেবো! আমার কী ভালো লাগে, কী লাগে না—মা কি এ খবর জানে না? জানে, তবু এরকম করছে। মা’র ভেতরে যেন কোথায় একটা লোভী লোক হাত বাড়িয়ে দেয় সম্মুখের দিকে বারবার। আর বারবার তাকে হাত ফিরিয়ে নিতে হয়। সে জন্যেই কি না কে জানে, মা’র মনের ভেতরে অমন জটিলতা জমে উঠেছে। আমি দেখতে পাই না। কিন্তু অস্পষ্ট হলেও বুঝতে পারি।

এই তো কিছুদিন আগে সাকিনা খালা ছিলো পাশের বাড়িতে। তাঁর স্বামী রহিম সাহেব স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। আর সাকিনা খালার বাড়িতে গিয়ে মা অনেকক্ষণ বসে বসে গল্প করতো। ওদের দু’জনের ঘরকন্নার সব খুঁটিনাটি ব্যাপার লক্ষ্য করতো। একেবারে বিকেল শেষ হয়ে গেলে সাকিনা খালা তার স্বামীকে নিয়ে রোজ বেড়াতে বের হতেন, ওদের কলকল হাসির গল্প শোনা যেতো আমাদের বারান্দা থেকে। মা জানালায় দাঁড়িয়ে ওদের দেখত। আর সেদিন বাবার ওপর মা রেগে থাকত। বাবা বাড়িতে এলেই কিছু না কিছু কথা কাটাকাটি হতো। আমি বুঝতাম না। কেন এরকম হতো। আরও আশ্চর্য হতাম, যখন দেখতাম, মা অন্য কেউ বাড়িতে এলে তার কাছে সাকিনা খালার নামে যাচ্ছেতাই কথা বলছে।

বুঝতাম না, কী কারণে এমন হয়। তবে এটুকু বুঝতে পারতাম, মার মনের ভেতরে কী যেন রয়েছে, যার জন্যে মা কখনও সহজ হতে পারে না।

মা জানে, বেনুদাকে আমি পছন্দ করি না। ওকে এড়িয়ে চলি। তবু মা আমাকে ওরই কাছে পাঠাবে। দরকারে অদরকারে ও আসবে আর আমাকে যেতে হবে ওরই কাছাকাছি।

আমি যাবো না, এ কথা মুখ ফুটে বলতেও পারবো না। ‘যদি বলি, তাহলে আমাকে কতকগুলো নোংরা কথা শুনতে হবে। দেখতে হবে মা’র কুটিল দু’টি চোখ।

ক’দিন আগে বেনুদাকে বাজারে পাঠিয়েছিলো। বাজার থেকে ফিরে এসে দুপুর বেলা মা’র কাছে এসে বললো, এক কাপ চা খাওয়ান খালা।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি তখন বই পড়ছিলাম। মা চা তৈরী করতে বললো। একটু পর চা তৈরী করে পুতুলের হাতে পাঠিয়ে দিলাম।

এবং একটু পর শুনলাম, মা পুতুলকে বলছে, তুই কেন? মঞ্জু আনতে পারলো না?

মঞ্জু নিজের হাতে চা করে এনে দেবে আমাকে? তবেই হয়েছে, বেনুদা মন্তব্য করল। সেই সঙ্গে ওর হাসির শব্দ শুনলাম।

মা কিছু বললো না ওকে। আমার ঘরে এসে বললে, কী করছিস?

বই পড়ছিলাম, উঠে বসলাম। মা ডাকলো, এ ঘরে আয়।

গেলাম মার ঘরে। বেনুদা আমাকে দেখে হাসলো। যাক, মহারাণীর দেখা পাওয়া গেলো। না হলে দুয়োর থেকেই দীন ভৃত্যকে ফিরে যেতে হতো।

কথাটা কি বিশ্রী! কিন্তু মা কিছু বললো না।

আমিই বললাম, আপনার ওসব কথা বলবেন না আমার সামনে।

বেনুদা চোখ নাচিয়ে বললো মাকে, দেখছেন, কেমন চটে গেছে?

মা বিরক্ত হলো যেন। চট্টার কি হয়েছে এতে। এটুকু হাসিঠাট্টা না করতে পারলে ভাই-বোন সম্পর্ক কেন?

মার কথা স্তব্ধ হয়ে শুনতে হলো আমাকে। আর ভাবলাম, ভাই-বোন সম্পর্কের মধ্যে এই বুঝি স্বাভাবকি কথা? আমি ওদের কাছ থেকে সরে আসছিলাম। মা ডাকলো, কোথায় যাস? বাজার খরচের হিসেবটা নে বেনুর কাছ থেকে।

আমি কাগজ-কলম এনে দিয়ে বললাম, আপনি লিখে রাখুন, পরে আমি মিলিয়ে নেবো।

পরে কেন? মা মুখিয়ে উঠল যেন। এক জায়গায় বসে দুই ভাই-বোনে মিলে হিসেবটা মিলিয়ে নেবে, তা না, যতো গণ্ডগোল পাকানো!

এবং একটু পর আমাকে আর বেনুদাকে বসতে হলো দক্ষিণের ঘরে। মা গেল স্নান করতে।

তারপর দুটো কি একটা জিনিসের দাম লিখেছি কাগজে আর তখন হঠাৎ ও আমার হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে আমাকে কাছে টানতে চেষ্টা করলো। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম, বিরক্ত করবেন না।

আহা তাতে কি হয়েছে। বেনুদা আমার কাঁধে হাত রাখলো।

আর তক্ষুণি, হ্যাঁ তক্ষুণি। ঠিক কী যেন ঘটে গেলো। আমার সারা শরীরে কিছু ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো শুধু। বিদ্যুতের মতো আমার ডান হাত ওর কানের কাছে আছড়ে পড়লো। তারপরই আমি সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলোম।

আমাকে নিজের ঘরে এসে কাঁদতে হয়েছে। কেন যে কান্না, জানি না।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *