৭
বর্ষা শেষ হয়েছে সেই কবে। এখন প্রকৃতি পরিপূর্ণ। সাদা সাদা মেঘ দেখি আকাশে ভাসতে। আমাদের বাড়ির দুয়ারে কামিনী ফুলের গাছে অজস্র ফুল ফোটে, সারারাত গন্ধে গন্ধে মাতাল থাকে হাওয়া। আমি অলস দৃষ্টিতে শুধু দেখি। আর তো কিছু করবার নেই। এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকা। নিজের অনেক আশার আর সাধের ভবিষ্যৎটার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা।
এমনি দিনে আমার বন্ধুরা আসে। বন্ধু বলতে পাড়ার মেয়েরা। পুরনো জানাশোনাদের মধ্যে আসে তাজিনা। ওর স্বামী তিন বছরের জন্যে বিদেশ গিয়েছে। ও এসে প্রেমের গল্প জমায়। সব ওর নিজের প্রেমের গল্প।
যদি আমি এ ব্যাপারে কিছু বলি তো হাসে ও। বলে, তুমি অতো সিরিয়াসলি দেখো কেন ব্যাপারটা। আমার স্বামী বিদেশে যে তিন তিনটা বছর কাটাবে, তা কি শুধু ব্রহ্মচর্য পালন করে। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মেয়ের সঙ্গে ওর জানাশোনা হবে। জীবনের উপভোগটা কি ও বাদ দিয়ে রাখবে! আফটার অল লাইফ ইজ সামথিং টু এনজয়।
এ যুক্তির ওপর ও সিদ্ধান্ত টানে। বলে, তাহলেই দেখো, আমারও শুধু চিঠি লিখে আর চোখের জল ফেলে তিন তিনটে বছর কাটিয়ে দেয়ার কোনো মানে হয় না।
ওর কথা শুনে ভয় করে আমার। এমন কথা কেউ বলে নি আমাকে। কোথাও শুনি নি। ইস্ কি ভয়ঙ্কর কথা ওর!
রঞ্জুর যে খবর বললো সেটাও অবাক করে দেয়ার মতো। রঞ্জুরা ঢাকায় রয়েছে। ওর চিঠি খুলে দেখায় তাজিনা। সে চিঠিতে ওর বন্ধুদের কথা। সবগুলো এখন পুরুষ বন্ধু ওর। ওর চিঠি পড়ে শেষটা মন্তব্য করে তাজিনা, মেয়েটা ভীষণ বোকা ছিলো এখানে, এবার যদি কিছুটা চালাক হয়।
চেষ্টা করেও আমি চুপ থাকতে পারি না। জিজ্ঞেস করি, তাহলে ওকে যে ভালোবেসেছে—তার কি হবে।
আমার কথায় সে কি হাসি তাজিনার। যেন আমি খুব হাসির কোনো কথা বলছি বললো, অমন প্রেম কে না করেছে দু’চারটা। স্কুল ছাড়াতে ছাড়াতেই একটা মেয়ে কতবার করে প্রেম করে। ওর তো মোটে একটা—তুমিও যেমন!
ও একেকদিন টেনে নিয়ে গিয়েছে ওদের বাড়িতে। গিয়ে দেখি, কোনো কোনোদিন চায়ের জমজমাট আসর বসেছে। একদিন বেনুকেও দেখলাম। তাজিনা সেদিন ওর এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো। আমি তো অবাক। এই নাকি বন্ধু। বছর চল্লিশের বিরাট একটা পুরুষ মানুষ। কোথাকার যেন ব্যবসায়ী। এখানে এসেছে দিন কয়েকের জন্যে।
মেয়েদের যে পুরুষ বন্ধু হয়, এই যেন প্রথম জানলাম। না, জানলাম না, দেখলাম। গল্পে পড়েছিলাম এতোদিন। এখন দেখলাম সত্যি সত্যি। তাজিনা আমার কাছে যেমন সহজ হতে পারে, একটুতেই গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে—তেমনি সহজ হতে পারে কাসেম সাহেবের কাছেও, তেমনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে তার গায়ের ওপর। কথায় কথায়, কারণে অকারণে হাসতে পারে খিলখিল করে।
আমি যতোই দেখি, ততোই অবাক হই। আশ্চর্যের বিষয় মনে হলো, বেনু ওদের সাথে অনেক দিনের পুরনো বন্ধুর মতো ব্যবহার করছে।
আরও আশ্চর্য ব্যাপার, সে ঘরে এতো খিলখিল হাসি, এতো কথা – কিন্তু কেউ ভুল করেও উকি দিয়ে দেখলো না, ঘরের ভেতর কী হচ্ছে।
জানলাম একটু পর আরও ভালো করে, কাসেম খান ব্যবসায়ী নয় তেল কোম্পানীর চাকুরে। তাজিনার বাবা একটা ফিলিং স্টেশন বসাবেন সেই ব্যাপারে প্রায়ই আসতে হয় ভদ্রলোককে।
ফিলিং স্টেশন কি? একটু আড়াল পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাজিনাকে।
ও-মা, জানো না। মেয়েটা আমার অজ্ঞতা দেখে করুণা করলো যেন। বললো পেট্রোল পাম্প-এর আমেরিকান নাম ওটা।
ভদ্রলোকের কথায় আরও অনেক বিদেশী শব্দ ছিলো। কতক বুঝলাম, কতক বুঝলাম না। আমি জানতাম না মোটর গাড়িকে অটোমবিল বলে, ভাড়াটে ট্যাক্সির নাম ক্যাব, পুলিশের নাম ক’প। আরও যেন কী কী সব শব্দ।
আই’ড লাইক টু গেট য়ু এ পিকনিক দ্য মোমেন্ট আই গেট থ্রু মাই জব হিয়ার আইল জাম্প আপন এ ক্যাব এ্যান্ড পিক্ য়ু অল্ আপ্।
এই নাকি ইংরেজি। তবু তো এ অংশটুকু বোঝা যায়। এমন ইংরেজি কিন্তু খবরের কাগজেও থাকে না। আমার হাসি পাচ্ছিলো ভীষণ। কাসেম সাহেবের কালো আর মোটা মোটা ঠোঁট আর শক্ত মাংসল ঘাড় থেকে যেন শব্দগুলো খসে খসে পড়ছিলো। দেখছিলাম ভদ্রলোক গলা খুলে হাসছেন আর আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। তারপর হঠাৎ, হ্যাঁ হঠাৎ দেখলাম ভদ্রলোকের চোখ দুটো। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম মনে মনে। সেই হাসি আর উল্লাসের মাঝখানে কেন জানি না আমার ভয় লাগলো। ভদ্রলোকের চোখে কি বিশ্রী রকমের একটা আবিলতা। মানুষের নজরেও যে গা ঘিনঘিন করে ওঠা নোংরামি থাকতে পারে—এই প্রথম দেখলাম।
একটু পর আবার হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। আমাকে ডেকে বললেন, তুমি আসতে পারবে না?
না, না, আমি কেন আবার, আমি বিব্রত হয়ে উঠেছি তখন।
হ্যাঁ হ্যাঁ যাবে ও। কেন যাবে না। আমি যখন যাচ্ছি, দুলু ভাবী যখন যাচ্ছে—তখন ও যাবে না কেন?
বেও হেসে হেসে বলেছে দূর থেকে, যাবে না কেন। নিশ্চয় যাবে। ও তো বাইরে বেরুবার সুযোগই পায় না আজকাল।
আমি সেদিন বাড়িতে ফিরলাম অনেকটা সহজ আনন্দ নিয়ে। আজ বহুদিন পর একটু হেসেছি। হাল্কা মন নিয়ে বাড়ি ফিরে বহুদিন পর আমার সেদিন ভালো লাগলো। মনের ভেতরে কোথায় যেন একটুখানি অস্বস্তি খচ খচ করছিলো। সেটা হয়তো কাসেম সাহেবকে ঠিক বুঝতে না পারার জন্যে। কিন্তু মানুষকে অতো সহজে আর কেই বা বুঝতে পেরেছে কবে। আজকের এই বিকেলটা আমার ভালো লাগলো, এই তো যথেষ্ট। ওদের মধ্যেকার যে অস্পষ্ট সম্পর্কই থাক, তাতে আমার কি?
যদি তেমন মনে করি তো না হয় যাবো ওদের সঙ্গে পিকনিকে। কতোদিন আমি বাইরে যাই না।
হায়রে। যদি না যেতাম। তখন বুঝেও যেন বুঝতে চাই নি। আমার ভেতরে যে হ্যাংলা মেয়েটা রয়েছে সে-ই আমাকে নিয়ে গিয়েছে। সেই মেয়েটা, যে একটুতেই অবুঝের মতো খুশি হয়ে উঠতে পারে, লোভে হাত বাড়াতে পারে—সেই আমার সর্বনাশ করলো। যদি জানতাম, হায়রে! যদি জানতাম!
আনিসের চিঠি এলো আবার। ও লিখেছে, রাহুলের কাছে বাড়ির সব খবর পেলাম। আমার ট্রেনিং শেষ হয়ে এলো। এ মাসের শেষেই ফিরছি। কী আনবো তোমার জন্যে?
আনিস আসবে। আমার সারা মন খুশিতে ছলছল করে উঠলো। এ যেন জীবনের সব চাইতে পরম সার্থকতার জন্যে অধীর হওয়া। আমার সারা মনে গান হয়ে বাজতে লাগলো তার আসার খবর। রাতে আমার ঘুম এলো না সেদিন, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশটাকে দেখলাম। আনিস আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিলো আকাশের কতগুলো তারাকে। সবগুলোকে খুঁজে খুঁজে বার করলাম। উত্তরের সেই গ্রেটবিয়ার, মাঝ আকাশের ক্যাসিওপিয়া, পূর্ব আকাশে অরিয়ন, তার পাশে গ্রেট ডগ আর একপাশে রক্তিম উজ্জ্বল অরাগল।
কিন্তু সব ছাড়িয়ে দৃষ্টি বারবার গিয়ে পড়লো পশ্চিম আকাশে স্কোপিও নক্ষত্রের উপর। বৃশ্চিক রাশির দাঁড়া দু’টো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। কে জানে কেন, কেবলই মনে হতে লাগলো সারা আকাশে বুঝি একটি কাঁকড়া বিছে তার বিশাল বিষাক্ত দাঁড়া দুটো ছড়িয়ে দিয়েছে কোনো কিছুকে ধরবার জন্যে।
সেই প্রকাণ্ড আকাশ আর নিঃশব্দ রাত্রি—মাঝখানে একা আমিই জেগে। আমার সেই জেগে থাকা নিঃস্ব সময়ে এক সময় আমি আনিসকে ভুলে গেলাম। ওর চিঠির কথা মনে এলো না। কেবলই মনে হতে লাগলো কাঁকড়া বিছেটা ক্রমেই যেন স্পষ্ট হচ্ছে, ক্রমেই যেন নিচে নেমে আসছে আর যতোই নিচে নামছে, ততই তার বিশাল দাঁড়া দুটো আরও বড় হয়ে উঠছে।
জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। সরে এলাম বিছানার কাছে। শিয়রের জানালার কাছ থেকে দেখলাম অরাগল নক্ষত্রটাকে। শুয়ে শুয়ে একেক বার বৃশ্চিক রাশির ছায়াটা ভাসতে দেখলাম চোখের ওপর। আমি নজর ফিরিয়ে নিলাম আকাশের দিকে। চেয়ে থাকলাম সেই রক্তিম আর উজ্জ্বল অরাগল নক্ষত্রের দিকে। একটি তারার দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে আমি ডাকলাম, আনিস আনিস! আমার ঘুম পাচ্ছে না কেন?
সেই তারাটা ক্রমে লাল হতে হতে একটি রক্ত বিন্দুর মতো হয়ে গেলো। সেই রক্ত বিন্দুটা আমার চেতনায় জেগে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর আমি এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
বেনু আজকাল কম আসে। যখন আসে, তখন দু’ পাঁচ টাকা দিয়ে যায় মা’র হাতে। সে টাকা খরচ হয় মা’র জন্যে ওষুধ-পত্তর কিনতে। মম পুতুলের দুধ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বেনুকে সে কথা মা জানালো। বেনুৱ সে কি রাগ। বললো, আমি যে তোমাদের টাকা দেবো, তাতে আমার কী লাভ?
মা কাতরাতে কাতরাতে বললো, বেনুরে তুই আজ এ কথা বলছিস।
হ্যাঁ আমিই এ কথা বলছি। আজ প্রায় একটা বছর ধরে তোমাদের সংসার দেখাশোনা করছি, তাতে কী লাভ হয়েছে আমার। একটা ভাঙা দোকান কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিলে, সেই বোঝা টানতে টানতে প্রাণান্ত হয়ে গেলাম।
তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই বাবা! মা’র অস্ফুট কাতর স্বর শোনা যায়।
আমি ছাড়া কেউ নেই। বেনু বিদ্রূপ করে বাঁকা মুখে। বলে, কেন তোমার ছেলে রয়েছে তো! যার সঙ্গে তোমার মেয়ে পীরিত জমিয়েছে।
মা চুপ করে গেলো। আমি শুনলাম। একটু পর বেনু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমি বুঝতে পারি না কেন বেনু আমার সঙ্গে আজকাল খুব ভালো ব্যবহার করে। ওর অমন সুন্দর আচরণ দেখে মাঝে মাঝে মনেও থাকে না যে ও এক সময় আমার দিকে লোভী হাত বাড়িয়েছিলো। ওর জন্যে একেক সময় আমার কষ্ট হয়। সত্যি তো, ওর দোষ তো কিছু নেই। স্বাভাবিক মানুষের মতোই ও লোভী হয়েছিলো। মাঝে মাঝে আমার কেমন যেন মনে হয়, ওর একটা সচেতন মন রয়েছে আমারই কাছে পড়ে। এ জন্যে নিজেকে সময় সময় এত অপরাধী মনে হয়।
ও কখনোও বলে মাথা নিছু করে, তোর রাগ আজো পড়লো না। আমার এই এক দুঃখ থেকে গেলো চিরকালের জন্যে।
কখনোও বলে, মানুষ কি চিরকালই এক রকম থাকে? যদি জানতাম, আনিসের সঙ্গে তোর কোনো রকম সম্পর্ক হয়েছে, তাহলে কি আমি তোর কথা এমন করে ভাবতাম! ভাবতাম না, ভাবলেও তোকে অন্ততঃ টের পেতে দিতাম না। আমিও বুঝি মঞ্জু, ভালোবাসা কাকে বলে?
আমি শুনেছি ওর কথা। আর দেখেছি, কেমন মাথা নিচু করে আসে, কেমন চুপচাপ চলে যায়। কখনোও সহজ স্বরে বলে, মঞ্জু লক্ষ্মী বোনটি, যদি এককাপ চা খাওয়াতে পারিস।
আমি অবাক হয়ে যেতাম। ভালো লাগত আমার। কিন্তু তবু সংশয় কেন যেন জেগে থাকতো। আর তার কারণ ছিলো ওর চোখ দু’টো। কি বিষণ্ণ অথচ তীব্র সে চাহনি। যেন কোনো পশুর চোখ। দেখি আর মাঝে মাঝে চমকে উঠি আমি। তারপর আবার নিজেরই মনে ভেবেছি, এ হয়ত আমারই মনের ভুল। ওর সম্বন্ধে আমার পুরনো ধারণাগুলো মরে যায় নি বলেই আমি ওকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারছি না। যা দেখছি, ভুল দেখছি।
কিন্তু মনের সেই সংশয়টাকেও যে স্থির বিশ্বাসে দাঁড় করাতে পারি না। আর সে জন্যেই হয়তো বেনু যখন আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে, আমি ওর সঙ্গে কথা না বলে পারি না। আবার ও চলে গেলে তখন ভাবতে বসি, কেন এমন ভাবে কথা বললাম।
আর যদি বা এড়িয়ে যাই ওকে, তখন ও চলে গেলে ভাবতে বসি, কেন ওকে এড়িয়ে গেলাম। ওর সঙ্গে কথা বললে ক্ষতিটা ছিলো কোথায়? আমি এতো দুর্বল কেন?
আমি সহজ হতে চাইলাম এবার। শেষবারের মতো।
মা’র রোগার্ড দীর্ঘশ্বাস শুনি। মা বলে, আমি আর বাঁচব না রে মঞ্জু, তুই মম আর পুতুলকে দেখিস।
তাজিনা আসে মাঝে মাঝে। গল্প করে। ওর সেই পুরনো গল্প। ওর দুলু ভাবীকে নিয়ে এসেছিলো একদিন। মহিলার একটু বয়স হয়েছে। কিন্তু মোটে বোঝা যায় না। ভারী সুন্দর করে সাজতে পারে মহিলা।
মার সঙ্গে অনেক গল্প করলো মহিলা। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমাবার চেষ্টা করলো। যাবার সময় বলল, চলো একদিন পিকনিক করে আসা যাক।
মা শুনে শুধু সপ্রশ্ন চোখ তুলে চাইলো। আর দুলু ভাবী হেসে বললো, না, না, ভাববেন না কিছু। দিনে দিনেই ফিরে আসবো। আপনাদের বেনুও যাবে সঙ্গে, তাছাড়া তাজিনা ত’ আছেই।
.
আমি জানি না, আজ আমার মতো অবস্থায় অন্য কোনো মেয়ে কী করতো। এ ডায়েরী লিখছি মোটে কটা মাস ধরে। কিন্তু কতো অদল-বদল ঘটলো আমার ধারণার। কতো পরিবর্তন দেখলাম আমার দু’পাশে। দেখলাম আর ভাবলাম, এই বোধ হয় চরম ঘটনা ঘটে গেলো আমার জীবনে। কিন্তু দেখেছি, ঘটনার পরও ঘটনা আছে। জীবনের শেষ কথা বলে কিছু নেই। কোনো এক সময় ভেবেছি, আমি কী করবো এরপর? কোনো পথ খুঁজে পাই নি। ভেবেছিলাম আমার জীবনের আশ্রয় শেষ হয়ে গেলো, বাঁচবার আর পথ খোলা নেই। কিন্তু তবু দেখছি, আমি ঠিক বেঁচে রয়েছি। আর দশজনের মতো ঠিকই চলে ফিরে বেড়াতে পারছি, আমার মনও ঠিকই কাজ করে চলেছে। দাদুর মৃত্যুর পর ভেবেছিলাম, এই শেষ হলো আমার জীবনের সব চাইতে চরম ঘটনাটি। পরে দেখলাম, না, তারও পরে ঘটনা আছে। আনিস যখন আমাকে জাগিয়েছে, তখন সেই জাগার লগ্নে ভেবেছি, এটাই তো আমার জীবনের সবচাইতে বড় ঘটনা। আমি সুখী হতে চেয়েছি সেই জেগে ওঠার পর থেকে। তারপর আকরাম আর মার সম্পর্ক, বাবার মৃত্যু—একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটলো। দেখলাম চৌধুরী বাড়ি ভেঙে পড়লো আমার চোখের সামনে। তবু আমি বেঁচে গেলাম। বাবা মরলো, মা থেকেও সেই কবেই মরে গিয়েছে। মম্ পুতুল মরে যাবে—শুধু বাঁচল আনিস, বাঁচলাম আমি আর বাঁচলো রাহুল। আনিস রাহুল হয়তো অনেক আগেই এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিলো বলেই বাঁচতে পারল। কিন্তু আমি? আমি এই বাড়ির প্রতিটি তুচ্ছ মুহূর্তেও জড়িয়ে ছিলাম। সব ঘটনা ঘটে গিয়েছে আমারই চোখের সম্মুখে। সব দেখেও, সব জেনেও, আমি বেঁচে গেলাম। আমার মনে হয়, এই ধ্বংসের স্রোত থেকে কোথায় যেন আমি কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে। সেই জন্যেই ওদের আর সবার থেকে সরে থাকতে পেরেছি। কিন্তু এখন? সেই ধ্বংসের স্রোত থেকে গা বাঁচিয়েও তো নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না।
আমার জোর ছিলো একটাই। জীবনকে আমি সুন্দর করে গড়ে তুলতে চেয়েছি। বারবার আমি প্রার্থনা করেছি—আমি শুভ্র হবো, আমি সুন্দর হবো।
জীবনের কাছে আমি বরাবর হাত পেতেছি। বেঁচে থাকবার জন্যে। সব সুখ সব সাধ নিয়ে সফল হয়ে ওঠার জন্যে আমি বারবার ছুটে গিয়েছি আনিসের কাছে। কেন না জানি, আনিসই আমাকে বাঁচতে বলবে। ওরই কাছে রয়েছে আমার সেই সাহস।
আমার কতো সাধ ছিলো আনিসকে পাবার। আনিস ফিরে আসছে আমার কাছে। কিন্তু আমি কি আর পারবো ওর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতে মনেৱ সেই জোর নিয়ে। যে আমাকে বাঁচতে বলেছে, যার কাছ থেকে আমি মনের সেই জোর পেয়েছি—তাকে হারিয়ে আমি বাঁচবো কেমন করে।
আমার সব গেলো। যে শক্তি নিয়ে, যে সাহস নিয়ে আমি বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি এতকাল সেই শক্তি নিয়ে আমি ওদের রুখতে পারলাম না। নিজে রইলাম স্থির আর একাগ্র হয়ে কিন্তু তাতে ওদের তো কোনো অসুবিধা হলো না। আমাকে আমারই ভেতরকার আর কোনো একটা সত্ত্বা দুর্বল করে রেখেছিলো। অনেক আগেই সেটা আমাকে হারিয়ে দিয়ে বসে আছে। অথচ আমি তা জানতাম না। সেই সত্ত্বাটা লোভী, সেই সত্ত্বাটা হিংসুটে। সেটাই আমাকে বারবার করে বাইরের লোভ দেখিয়েছে।
আমি ওদের ওপর প্রতিহিংসা নিতে পারি। কিন্তু তাতে আমার লাভ কি? আনিসকে তো আর ফিরে পাবো না। আনিসও তো মানুষ, তারও তো ঘৃণা আছে। তারও তো ঈর্যা আছে। আর সেই ঘৃণা আর ঈর্ষা যদি কোনোদিন জেগে ওঠে— তাহলে আমি দাঁড়াবো কোথায়?
আজ ক’দিন হলো আমি ভাবছি। কিন্তু কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কেন না আমি জানি, আমার শত্রু রয়েছে আমারই ভিতরে, আমারই বাইরে। আমার নিজেরই অনুভূতির কতো আঁকাবাঁকা গতিপথ। যেসব অনুভূতিকে চিনতাম না, সেইসব অনুভূতি আমাকে শক্তিহীন করে ফেলেছে অনেক মুহূর্তে। আমার সেই রিক্ততার কথা, নরক যাত্রার বর্ণনা, আমার সেই নিহত হওয়ার কাহিনী কাউকে জানাতে পারলাম না। যদি কেউ জানতো! হায়রে!
এখন আমাকে মরতে হবে। মৃত্যু ছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ দেখি না। ছোট আপার মতো অবস্থা আমার তো নয়। ছোট আপা শুধু ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো, খুঁজে বেড়িয়েছিলো সেই সব মানুষকে। ও ঘৃণার পাথার পেরিয়েও হয়তো পেয়ে যাবে কোনো ডাঙা। আবার হয়তো ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু আমি? আমার যে ঘৃণার অবধি নেই। নিজেরই ওপর ঘৃণা হচ্ছে আমার। আমি এখন এই ঘৃণার সাগরে ডুবে মরবো। এখন এছাড়া অন্য গতি দেখি না।
নিজেকে সুন্দর বলতে পারবো না। কোনোদিন না। যদি আমি নিজেকে নিষ্কলুষ ভাবতে পারতাম, হায়রে!
না, মানুষের দেহ কলুষিত হতে পারে—এমন গোঁড়ামি আমার নেই। কোনো শ্বাপদ যদি মানুষের ক্ষতি করে, তাহলে আমি সেই মানুষকে দোষী করবো কোন যুক্তিতে? আমার যতো ঘৃণা সব যে এখন নিজেরই দুর্বলতার জন্যে। আমার প্রতিরোধের সব ক্ষমতা কেমন করে সেদিন হারিয়ে গেলো সেই সময়? সেই ভয়ঙ্কর নগ্নতার কথা মনে পড়লে আমি এখন আর্তনাদ করে উঠি। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে যদি কাসেম খানের মুখটা দেখি কোনো রাতে, তাহলে চিৎকার করে উঠি।
সেদিন সেই সময় আমার অনুভূতিগুলোই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমার মনের চাইতেও শরীরটা হঠাৎ যেন বড় হয়ে উঠলো। আমি কেন হেরে গেলাম? এ শুধু বাইরে বাইরে হেরে যাওয়া নয়। মনের ভেতরেও যে আমি হেরে বসেছিলাম একটা পশুর কাছে। যে পশুটা ছিলো আমারই ভেতরে লুকিয়ে। অথচ আমি কিছুই জানতাম না। এখন জেনেছি আর এই হার আমাকে এনে ফেলেছে ঘৃণার কূলহীন পাথারে। যা আমি কোনোদিনই অতিক্রম করতে পারবো না।
.
কোনোদিন আমি আর বলতে পারবো না, আমি সুন্দর হতে চাই, আমি শুভ্র হতে চাই। কোনোদিন আমি আর আনিসকে ছুঁতে পারবো না। এতোকাল ধরে ভেতরে বাইরে এতো বাধার পাহাড় পার হয়ে এসে শেষ মূহূর্তে আমি আনিসকে হারিয়ে ফেললাম।
আমি জানি, কেউ জানবে না ব্যাপারটা। হয়তো আমি আনিসকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারি। ও আমাকে হয়তো সারাজীবন বিশ্বাসও করবে। কিন্তু আমার এই একবারের নিহত হওয়ার কথা কেমন করে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখবো? লুকিয়ে রাখলেও, সেই নিয়ত আত্মগোপনের প্রতিটি মুহূর্তে কি আমার বিন্দুমাত্র সুখ-সাধকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো? আমার সুখ-সাধ সব যে মরে যাবে। সেই পরাজয় দিনে দিনে আমাকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলবে। বার বার আমি হাত বাড়িয়েছি, অন্ধকার একটা ঘরের দরজা খুলে আলোকিত পথে বের হয়ে আসার জন্যে, আর বার বার কেউ যেন আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে সেই অন্ধকারেই। ফেলে দিয়েছে আর সশব্দে নিষ্ঠুর হাতে দরজা বন্ধ করেছে।
এই শক্তিকে নিয়তি বলবো না। ভাগ্য বলে মেনে নিতেও আমার বাধে। এ শক্তি আছে মানুষেরই ভেতরে। সেই লোভ, সেই ঈর্ষা আর ঘৃণা মানুষকে ফাঁদ তৈরি করতে শিখিয়েছে। বাইরের জগতটাকে সাজিয়ে তুলছে ইচ্ছে মতো। তারপর সেই বাইরের জগতটাকে দেখেই মানুষ নিজে নিজে তৈরি হচ্ছে। নিজে তৈরি হয়ে সেই মানুষই আবার তৈরি করছে বাইরের পৃথিবীকে। আর সেই পৃথিবী আবার তাকে দুর্বল পেয়ে হত্যার দিকে, অন্ধকারের দিকে বার বার ঠেলে দিচ্ছে।
আমাকে বাঁচতে দেবে না ওরা। আমি বারবার চেষ্টা করলাম, আর ওরা বারবার ফিরিয়ে দিলো।
মা, মম, পুতুল, আনিস, রাহুল—এরা একে একে মরে যাবে সবাই।
আমি জানি, মা এবার মরবে। যে সন্তান এসেছে তার পেটে তাকেও মরতে হবে। মম পুতুল মরবে। আর মরবে আনিস। সুন্দর হয়ে বাঁচতে পারবে না ও। ও আবার ঘৃণার লোভের আর ঈর্ষার কাদায় গড়াগড়ি খাবে।
আমি সেই কুটিল ক্লেদাক্ত দিনের কথা মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ভুলতে পারবো না। মা বাবাকে হত্যা করেছে আর আমাকে হত্যা করলো এরা সবাই মিলে।
আমার এই যন্ত্রণার জীবনে নীল পাহাড়ের পাখির মতো এসেছিলো সুন্দর সাধের কটা দিন। সেই সাধের দিন কটাকে আমি বুকে করে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেউ দিল না তা রাখতে। কার কাছে আমি প্রতিবাদ করবো? কে শুনবে আমার কথা?
আইন শাসনের কথা জানি না। কাসেম খানের বিরুদ্ধে লড়ে আমি কিছু করতে পারবো না। আর কী নিয়ে আমি দাঁড়াবো ওদের বিরুদ্ধে। জন্ম থেকেই তো আমি একটা অস্থির পাহাড়ের চুড়োয় পা রেখেছি। টলমল করছি নিজেকেই দাঁড় করিয়ে রাখতে।
না, আমি কাঁদছি না। যা কাঁদবার সেদিনই আমি কেঁদে নিয়েছি।
আনিসকে এখন আমি কেমন করে মুখ দেখাব? আমারই ভেতরে এখন কেউ বার বার করে বলবে, মঞ্জু তুই মিথ্যুক! সারাজীবন মিথ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তুই নিজেই মিথ্যুক হলি। আর যখন জানবে আনিস, তখন ওর সুন্দর শুভ্র মুখের ওপর ঘৃণা কেমন করে সহ্য করবো আমি। বিপদে পড়ে আমি আকুল হয়ে খোদাকে ডেকেছি। আমার সেই বিপদ, সেই সঙ্কট খোদাকে ডেকেও কাটে নি। আজকের এই বিপদের দিনে কোনো বিধাতা আমার পাশে এসে দাঁড়াবে!
এ বিপদকে তো বিপদ বলে মনে হয় না আজকাল। বিপদ বুঝবো তখনই যখন তার একটা সমাধানের পথ থাকে। যে বিপদের পর সেই তাকে অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। আমার এই সময়ের চারপাশে তো এখন অতিক্রান্তির কোনো সম্ভাবনা নেই, সমাধানের কোনো পথ নেই। যে লোক চিরকালের জন্যে অন্ধকারের ভেতরে চলে গিয়েছে, সে অন্ধকারকে আর অন্ধকার বলবে কেমন, করে।
এর চাইতে বড় বিপদ আমার জীবনে আর কিছু হতে পারে না। এর চাইতে বড় কোনো বিপদ মানুষের জীবনে আসতে পারে না। এখন কী নিয়ে বাঁচবো, নিজেরই বিশ্বাসকে যে আমি হারিয়ে ফেলেছি।
পরকালের জন্যে আমি বাঁচতে চাই না। কী লাভ? নিজের বিশ্বাস হারিয়ে প্রেতাত্মার মতো বেঁচে থেকে কী লাভ!
মাঝে মাঝে একাকী ঘরে আমি চিৎকার করে উঠি। বার বার বলি, তোমরা আমাকে বাঁচতে দিলে না।
গতকাল আনিসের চিঠি এসেছে। আমি খুলি নি। সেই চিঠি হাত দিয়ে ছুঁতে এখোন আমার সাহস হয় না। মনে হয় না, আমার কোনো অধিকার আছে।
হারালাম আমি। আমার সব কিছু হারালাম। আমার সাহস, আমার সাধ, আমার অধিকার—সব কিছু নিঃশেষে হারালাম।
নদী পার হবার সময় ব্রীজটা কেন জীপসুদ্ধ ভেঙে পড়লো না সেদিন।
.