পিঙ্গল আকাশ – ৪

আজ আমার কেমন দিন কাটলো, কাকে বোঝাই সে কথা। যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। মানুষের মনে যে কী করে এতো যন্ত্রণার জন্ম হতে পারে। আমি যেন নিজেরই শত্রু হয়ে পড়েছি। নিজেকেই হত্যা করছি তিল তিল করে।

তখন সকাল, এক রকম ভোরই বলা যেতে পারে। এ-বাড়ির কেউই ওঠে নি তখনও। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। সারারাত গেছে গুমসানো গরম। ঠাণ্ডা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে শরীর জুড়িয়ে গেলো আমার। বাইরের ঘরের দরজা খোলা। বাইরের বারান্দায় রোজ সকালে দাঁড়াই আমি। ঘরের ডানদিক দিয়ে বারান্দায় যেতে হয়। জানালার পাশ দিয়ে যাবার সময় চমকে উঠলাম। ঘরে এ কে শুয়ে। দেখলাম আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো আমাকে। আনিস ভাই শুয়ে রয়েছে শক্ত তক্তপোষের ওপর। নোঙরা জামা-কাপড়, না-কামানো মুখ। ক্লান্তিতে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। নিঃশ্বাসের মৃদু মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে আমার মন ভরে উঠলো। নড়লাম না, স্থির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলাম। আনিস ভাই সুন্দর, কিন্তু এত সুন্দর ওকে কোনোদিন মনে হয় নি। ক্লান্তিতে কি সুন্দর ছবির মতো ঘুমিয়ে রয়েছে। নিমীলিত দু’টি চোখের ভেতরে যেন মধুর স্বপ্ন মিশে রয়েছে, আর সেই সঙ্গে নির্ভরতা। বহুদিন পর যেন ভারি শান্তিতে ঘুমাচ্ছে ও।

কোথায় ছিলো এতোদিন কে জানে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ওর শুকনো চুলে হাত রাখতে ইচ্ছে করলো আমার। সত্যি, ভারি সুন্দর চুল ছিলো ওর। সেই চুলে কতকাল তেল পড়ে নি, কতদিন আঁচড়ানো হয় নি। নরম শুকনো চুলে আমার হাত ডুবে গেলো। তখন আমি ওর পাশে চৌকির ওপর এক হাত ভর করে দাঁড়িয়ে। একটু পর ও চোখ খুললো। আমাকে দেখে হাসলো। হাত ধরলো আমার। আমি কাঁপছিলাম তখন। কেন যে, নিজেই জানি না। মনে হচ্ছিলো, আনন্দে যেন ভেঙ্গে পড়বো। পাশে বসতে বললো। তারপর বললো, ফিরে এলাম, ভালো ছিলে তোমরা?

এ যেন আনিস নয়, অন্য কেউ, কিন্তু তবু যেন একে আমি চিনি, বহুকাল ধরে চিনি। ওর কথার পর আর কোনো কথা খুঁজে পেলাম না যে বলবো। সেই নিঃশব্দ সকালের আলোয় ভরে দেয়া ঘরের মাঝখানে ওর মৃদু, ভরাট গলায় কুশল প্রশ্ন, কেমন ছিলে, এ-কথার উত্তরে কি আর কিছু বলা যায়! বললেই কি আমার সব কথা বলা হবে? অতো সুন্দর হবে।

আমি চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। এক সময় ও বালিশ থেকে মাথা তুলে আমার কোলের ওপর মাথা রেখে চোখ বুজলো। আর আমি ওর মাথার চুলে হাত রাখলাম। বুকের ভেতরে তখন একটা অসহ্য কান্না মাথা কুটে মরছে। কান্নার ভারে যেন ভেঙ্গে পড়বো। ও তখন চোখ বুজে বলছে, আর পারি না আমি। আমি যে কী করবো।

আমার সারা বুকের কান্না ঐ সময় দু’চোখে জমে উঠেছে। চোখ দিয়ে হু হু করে পানি এসে গেলো। ওর মাথা নামিয়ে রেখে ছুটে এলাম। কেন না বলবার মতো যে আমার কথা ছিলো না।

তারপর সারাদিন, সারাদিন শুধু ভাবলাম। আমি এ কী করছি। কিন্তু ভাবনার সূতো বারবার ছিড়লো। শুধু মনে হতে লাগলো, আনিস ফিরে এসেছে।

এই এক আশ্চর্য বোধ। আমি যেন আর একাকী নই। আমার যন্ত্রণা হলো দ্বিগুণতর। এমন যন্ত্রণা কোনোদিন ছিলো না আমার। একদিকে শুধুই নিজেকে বলছি, এবার তোর মরা ভালো। আর অন্যদিকে মনের ভেতরে আমার সব সুখ সব সাধ ফুলের মতো ফুটে উঠছে, বাঁচার সাধে বার বার হাত বাড়াচ্ছি সম্মুখের দিকে। আমি ওর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতে পারলাম না সারাদিন। তবু মনে হলো, কে যেন আমার পাশাপাশি রয়েছে সর্বক্ষণ। আর কেবলি ওকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। জানি না, এরই নাম ভালোবাসা কি না। মনের ভেতরে কেউ যেন বারবার ধমকে উঠছে। বারবার ক্রুদ্ধস্বরে বলছে, এটা অন্যায়, পাপ হচ্ছে তোমার। কিন্তু মনের সে কথা শুনব যে, সে ধৈর্য কোথায়! শুধু অনুভবের তীব্র তারে বাজতে লাগলাম, সারাদিন, সারাদিন। একবার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললাম, আর অমন ভাবে চলে যেও না তুমি, বাড়ির সবাই ভাবছিলো। কী আশ্চর্য, কত সহজে মুখ দিয়ে তুমি বেৱিয়ে এলো। ওকে কোনোদিন তুমি বলি নি। কথাটা উচ্চারণ করেও আমার কোনো রকম সঙ্কোচ হলো না। নিজেকে অদ্ভুত সহজ আর স্বাভাবিক আর মুক্ত মনে হলো। ও কী উত্তর দিল শুনতে পেলাম না। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।

এখন ও নিজের ঘরে পড়াশোনা করছে। কতোরাত এখন কে জানে। বাড়ির ঘড়িটা অনেকক্ষণ আগে বারোটার ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।

আমার ঘুম পাচ্ছে না। গত রাতে যে স্বপ্নটা দেখেছিলাম, সেই স্বপ্নের কথা মনে ছিলো আমার।

আমি যেন নির্জন এক সমুদ্রের তীরে বালির ওপর বসে রয়েছি। সমুদ্রের ঢেউ আমার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে। হাওয়ায় আমার শাড়ির আঁচল উড়ছে, পায়ের কাছে অসংখ্য ঝিনুক—সাদা, ধূসর, কোনোটা বা রামধনু রঙের। মাথার ওপরে কয়েকটা সমুদ্র-ঈগল বিশাল ডানা ছড়িয়ে উড়ছে আর চিৎকার করছে। দৃষ্টির সম্মুখে অতিকায় একটা মাছ ভেসে উঠলো। মাছটার সাদা ধবধবে বিশাল বুক দেখলাম। আর সেই হাওয়া, সমুদ্র গর্জন, সেই ঈগলের চিৎকার আমাকে ডেকে নিতে চাইলো সমুদ্রের অনেক গভীরে। আমার সব ভালোলাগা, আমার সব সাধ, সব সুখ তখন আমাকে নিঃশেষ করে মিশে যেতে বললো সেই সমুদ্র-উপকূলে। আর আমি হারিয়ে গেলাম। অণু অণু হয়ে নিবিড় আর গভীর শান্তির ভেতরে আমি যেন মিশে গেলাম।

কেউ ছিলো না আমার সঙ্গে। কেউ না। কি আশ্চর্য, ওই স্বপ্নের মধ্যে একাকী শুধু আমিই।

আনিস ভাই এলো আজ। আমার জীবনের সব সুখ, সব সাধ যেন ভরে উঠলো। কিন্তু তবু যে ভয় আমার, কী যেন ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে রয়েছে। আমি জানলাম, আনিস জানলো, কিন্তু তবু যে ভয়ে আমার বুক কাঁপে। কী করবো এখন? মা জানতে পারবে, আজ না হোক, কাল। জানবে রাহুল, আব্বা। এখন আমি এ মুখ কোথায় লুকোবো। আমার বরং মরণ ভালো এখন।

তার চেয়ে, তার চেয়ে বরং আমি চলে যাই এখান থেকে। থেকে কী লাভ। আনিস কষ্ট পাবে। কষ্ট পাবো আমি নিজে—দু’জনে কোনোদিন সুখী হতে পারবো না। কোনোদিন না। তার চেয়ে এই ভালো। নাহলে আনিস ভাইকে মা ছেড়ে কথা বলবে না। পাড়া-প্রতিবেশীর কানে উঠবে কথাটা, মা-ই হয়তো তুলবে। হায়রে! আমার নিজের মা-ই যে সব চাইতে বড় শত্রু।

শুধু কি মা, বাবা যখন জানবে? যখন জানবে আনিসের বন্ধুরা? বাবা হয়তো আনিসকে ঘৃণা করবেন। বাবার স্নেহ থেকে চিরকালের জন্যে আনিস বঞ্চিত হয়ে যাবে। তার চেয়ে, তার চেয়ে আমার চলে যাওয়াই ভালো।

.

আজকাল এ বাড়িটা বেশ সুখী। বাবা নিয়মিত দোকানে বসছেন, মা’র শাড়ি জামা আসছে নতুন নতুন। মম্ পুতুল ওদের কাপড় জামা হচ্ছে। আমিও নতুন কাপড় পেয়েছি। বাবা সরিষা কিনে রেখেছিলেন সিজনের সময়, বেশি দাম পেয়ে এখন বাজারে ছেড়েছেন। লাভ এসেছে প্রচুর। একেকদিন সিনেমা দেখতে যাই সবাই মিলে। বেনুদা নিয়ে যায়। আর আসে আকরাম চাচা। ওদের বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও খুব বন্ধুত্ব। মা’র সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে সময় সময় আকরাম চাচা। আমি শুনি দরজার আড়াল থেকে আর লজ্জায় দু’কান লাল হয়ে ওঠে। কি বিশ্রী নোংরা কথা ওসব। আরও অবাক কাণ্ড বেন্দার সামনেই মা এসব কথা বলে, অমন ধরনের কথা শুনে সময় সময় ওরা দু’জনেই হেসে ওঠে। কখনও বা মা হেসে ওঠে কোনো তুচ্ছ কথাতেই। খিলখিল সে হাসি যেন থামতেই চায় না। হাসির চমকে আঁচল খসে পড়ে মেঝেতে। সমস্ত শরীর দুলতে থাকে, তবু হাসে মা।

আজকাল মা স্নো পাউডার ব্যবহার করছে। নানা রঙের জামা উঠছে গায়ে, শাড়ির রঙ বদলাচ্ছে দৈনিক। আর কি অবাক কাও, এতো ধরনের অন্তর্বাস পরতে পারে আজকাল মা! আমার নিজেরই লজ্জা করে মা’র দিকে চোখ তুলে তাকাতে।

আর সে জন্যে, হ্যাঁ সে জন্যেই, ছাড়লাম সবকিছু। সাদা ছাড়া আর কিছু পরি না। পরতে পারি না আজকাল। অস্বস্তি লাগে। স্নো পাউডার ব্যবহার করি না। করতাম না এমনিতেই, তবু বাইরে বেরুবার সময় একটু আধটু ইচ্ছে করতো। এখন সেসব হাত দিয়ে ছুঁতে আমার গা বিজবিজ করে ওঠে। আমার কেবলি বিস্ময়, কেন করছে মা এসব।

বাবা দেখছেন আর হাসছেন। মাকে এখনও ছেলেমানুষ মনে করেন। পঁয়ত্রিশের ওপর বয়স হলো মা’র। তবু বাবার কাছে মা ছেলেমানুষের মতো।। বাবা হাসেন দূর থেকে। সস্নেহে প্রশ্রয়ের চোখে তাকান।

মাঝে মাঝে আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে। কেন বাবা ধমকে উঠছেন না মাকে। কেন ঐ সাজ-পোষাক আর স্নো-পাউডারগুলো পাঁচিলের ওপারে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন না। ভয়ঙ্কর রকমের সর্বনাশা স্রোতের মুখে ভাসতে যাচ্ছে মা। কেন বাবা বাধা দিচ্ছেন না?

আমি বুঝতে পারি। মা’র মন আর সংসারে নেই এখন। কেবলি মা বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছে। থেকে থেকে বাইরে বেরুবার জন্যে ছটফট করে উঠছে। শুধু আমি কেন, রাহুল, আনিস ওরাও দেখলো। আর সে জন্যেই কি না, কে জানে, রাহুল আজকাল মা’র সঙ্গে কথা বলে না। আনিস কথা বললেও মা’র মুখের দিকে তাকায় না।

জানি আমি, বুঝতে পারি, ওদের মনের ভেতরে ঘৃণা জমে উঠছে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে চায় না ওরা। আর চাইলেও তা পারে না।

এটা এখন একটা সুখী বাড়ি। কোনো ঝগড়া নেই, কোনো অসুবিধা নেই কারো। বাইরে থেকে দেখলে যে কারো ভালো লাগবে। মনে হবে সুন্দর একটি সুখী পরিবার। মালিকের হাতে অনেক টাকা, ছেলেমেয়েরা সবাই হাসিখুশি—একটা পরিবারের জন্যে আর কি দরকার!

কিন্তু এ সবই বাইরের মুখোস। মনে হয় তীব্র দুটো স্রোত বয়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। এমন স্রোত যেন কোনোবার আসে নি। বাইরে সবাই নিয়ম বাঁধা গতানুগতিক কাজ করে যাচ্ছে, কিন্তু সেই অন্তঃস্রোতে ওরা আলাদা। মা একাই একদিকে আর অন্যদিকে আনিস, রাহুল, আর, আর হয়তো আমিও।

একটা ভয়ঙ্কর সর্বনাশ যেন ঘনিয়ে আসছে। স্রোতের প্রবল টানে কী যে ধ্বংস হবে বলা যায় না।

চৌধুরী বাড়ির ভিতে গোনা লেগেছে। এবার ভাঙবে, ভেঙে পড়বে বিরাট বাড়িটা। আর সেই ধ্বংসস্তূপে কে যে চাপা পড়বে কিছু বলা যায় না।

আনিসের মুখোমুখি হতে পারি না, কিন্তু মন ভরে আছে ওর উপস্থিতিতে। একই বাড়িতে আছি, একই বাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি আমরা। ওর ঘরের ভেতরে কতবার যেতে হচ্ছে, কতোবার ও আমার পাশ দিয়ে হাঁটছে, হয়তো দরকারী দুটো একটা কথাও বলছে, কিন্তু শুধু কথাই, আর কিছু না।

আমি মন ভরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারি না। ওর হাত ধরতে পারি না। বলতে পারি না অনেক রাতে ওর ঘরে গিয়ে, আর রাত জেগো না, এখন ঘুমোও। আমার মনের কোনো ইচ্ছেই পূরণ করতে পারি না। কিন্তু তবুও আমি মনে মনে সুখী। প্রার্থনা করছি, অন্তত যেন এমনি থাকতে পারি পাশাপাশি চিরদিন। শুধু এটুকুর জন্যেই আমি সব করতে পারি। হ্যাঁ, সব।

হায়রে। আমার এই সুখটুকু যেন স্রোতের ঘোলা জলে ভেসে যাওয়া পদ্মপাতার ওপর একফোঁটা টলমল পানি। আমার চারপাশে এমনি ঘৃণা, লোভ, হিংসা আর ক্রোধ উদ্যত রয়েছে তবু আমি এরই মধ্যে শান্তি পাচ্ছি একটুখানি। যদি আনিস ও বাড়িতে না থাকতো, তাহলে আমি বোধহয় বাঁচতে পারতাম না।

কেবলই মনে হয়, আছে, আছে। আমার আর যেন কোনো কামনা নেই, ইচ্ছে নেই। মনে মনে আমি সুন্দর হয়েছি, শুভ্র হয়েছি। আমার শরীরে গয়না নেই, কতোদিন চুল বাঁধি না, প্রসাধন করি না— তবু যেন মগ্ন রয়েছি আশ্চর্য কোনো স্বপ্নের ভেতরে।

মাঝে মাঝে মা লুকিয়ে দেখে আমাকে। যখন আমি স্নানের পর বাথরুম থেকে বেরিয়েছি, কিংবা যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছি, তখন। হ্যাঁ, তখনই যেন মা তীক্ষ্ণ চোখে খোঁজে কিছু।

কিছু যেন রয়েছে আমারই শরীরে। আতিপাতি সেই দৃষ্টি অনুভব করি শরীরময়। আর সমস্ত শরীর আমার শিউরে শিউরে ওঠে। আমি একাকী অনেক সময় নিজেও কৌতূহলী হয়েছি, কী খোঁজে মা অমন করে। নিজেকে দেখেছি খুঁজে, আর বিস্ময়ে, মোহে অবাক হয়ে গিয়েছি। শরীরও যে এতো সুন্দর হতে পারে কে জানতো। আর সেই শরীরটা আমারই। দেখছি আমার শরীরময় যেন সুন্দর একটা আলোর আভা জড়ানো। আমার বুক সুন্দর, আমার কোমর সুন্দর, আমার গ্রীবা সুন্দর। আমার দু’চোখের ভেতরেও যেন এখন পুরনো আমিকে খুঁজে পাই না। যাকে আমি আজন্ম দেখতে চেয়েছি গোপনে গোপনে, সে-ই যেন এসে দাঁড়িয়েছে আমার রক্তমাংসের ভেতরে।

বুঝলাম সুন্দর হয়েছি আমি। বুঝলাম আমি আরও শুভ্র হয়েছি।

খালাআম্মা এসেছিলো সেদিন। আমাকে বারান্দায় দেখে, বেশ কিছুক্ষণ নজর ফেরালো না। তার সঙ্গে এসেছিলো ওর ভাসুরের মেয়ে তাজিনা। এখন কলেজে পড়ছে। দূরে দূরে একটু জানাশোনা ছিলো। আর অনেকদিন পর আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। বললো, তোমার সঙ্গে গল্প করতে এলাম।

ওকে নিজের ঘরে নিয়ে এলাম। বললাম, বলুন, কী বলবো?

অল্প হাসল তাজিনা, অমনভাবে বুঝি গল্প হয়?

জোর করে হাসতে হলো আমাকেও। বললাম, কীভাবে গল্প করে তা হলে?

তুমি ভয়ানক গম্ভীর।

আমি গম্ভীর। এবার হেসে ফেলতে হলো আমাকে।

না ঠিক গম্ভীর না, তবু যেন কী। তুমি যেন আলাদা। আর ক’মাসে এতো সুন্দর হয়েছে- তুমি, যে চেনাই যায় না।

আমি সুন্দর হয়েছি? আমি ওর কথাটা তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিতে চাইলাম।

বাহ্ বিশ্বাস হলো না। একবার বাইরে বেরিও। যে দেখবে তারই মুণ্ডু ঘুরে যায় কি না দেখো।

আমি খুশি হচ্ছিলাম মনে মনে। তবু সংযত থাকতে হচ্ছিলো।

আচ্ছা এমনভাবে থাকো কেনো তুমি? তাজিনা একটু পর জিজ্ঞেস করল।

কী রকম?

এই বিধবার বেশ কেন? সাদা জামা, সাদা শাড়ি, চুল বাঁধা নেই। দেখে মনে হচ্ছে, একটা বিরাট কিছু যেন ঘটে গিয়েছে।

বাহ্ বাড়িতেও কি সেজেগুজে থাকতে হবে?

সাজবার কথা কে বলেছে? একটু রং নেই পোশাকে, হাতে একটা গয়না নেই—এরকম কোনো মেয়ে থাকে না।

আমিও থাকি না, নিজেকে লুকোতে হলো তখন। বললাম, আজ ক’দিন ধরে শরীর খারাপ যাচ্ছে। তাই…

তাজিনা যাওয়ার আগে কানে কানে বলে গেল, খবরদার বাইরে বেরুবে না। যে তোমাকে দেখবে, তারই মাথা খারাপ হবে।

খালাআম্মাও একই মন্তব্য করলেন। মাকে ডেকে বললেন, তোর মেয়েতো দিনকে দিন সুন্দর হচ্ছে। ওকে বিদায় করবার ব্যবস্থা কর।

দেখো তোমরাও। মা জবাব দিলো, আমি একা কি আর পারবো।

তবু একাই করতে হবে তোকে। আমার নিজেরই গলায় বিষ-কাঁটা লেগে আছে। ওটার ব্যবস্থা করতে পারবো কি না সেই চিন্তায় মরছি আমি।

আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছি। তারপর শুনলাম সেই কথাটা। মেজো খালাই বললো, এক কাজ করলেও তো পারিস, হাস্না বুবুর ছেলে বেনু তো হাতেই রয়েছে। ওকে ধরলেই তো হয়।

বেনুর কথা আমিও ভেবে রেখেছি। কিন্তু ভালো একটা চাকরি-বাকরি না হলে…

আরও ভালো চাকরির কথা তুলে লাভ কি, মা খালার কথা শেষ হবার অনেক আগেই বলে ওঠে – যা দিনকাল। কনট্রাক্টরীর চাকরি করছে, তাই বা মন্দ কি! সপ্তাহে ষাট সত্তর টাকা নিশ্চয়ই পায়। এদিকে মেয়ের মুখ দেখে তো বিয়ে হবে না, টাকাপয়সা লেখাপড়া এসবও তো খোঁজে ছেলেরা।

আমি জানতাম, একথাটা উঠবে একদিন না একদিন। হয়তো হাস্না খালাই পাঠিয়েছে কথাটা পাড়বার জন্যে। কিংবা হয়তো মেজো খালা এমনিই বললো। তবে এরকম ধারণা প্রায় সবারই। বেনুদাও হয়তো সেই কথাই ভেবে রেখেছে।

এ নিয়ে আমি ভাবলাম না। ভাববার কী আছে এতে? এরকম কথা তো বলবেই ওরা। আমার মন ঘিরে সেই একটি কথা বারবার বেজে উঠল গানের মতো, আমি সুন্দর!

হ্যাঁ, আমি সুন্দর। আর সুন্দর হয়েছি যে তোমারই জন্যে। তোমারই জন্যে আমি শুভ্র হবো, পবিত্র হবো।

.

আনিস কি দেখে নি আমাকে? ও কি দেখে নি আমি কতো সুন্দর হয়েছি? জানি না, আমি কিছুই জানি না ওর মনের কথা।

আনিস অনেক বেলাতে ঘুম থেকে ওঠে। অনেক রাত জাগতে হয় ওকে। যখন ঘুম থেকে ওঠে, আমার তখন সকাল বেলাকার স্নান হয়ে গেছে, রান্নাঘর আর বারান্দাগুলো ঝাঁট দিয়ে ফেলেছি, চা-নাস্তা তৈরি করে, মম-পুতুল ওদের মুখ ধুইয়ে নাস্তা খেতে দিয়েছি। আর তখন ওঠে ও।

ঘুম থেকে ভোর সকালেই উঠে যখন আমি রোজকার মতো বাইরের ঘরের বারান্দায় আসি, তখনও আনিস গভীর ঘুমে অচেতন থাকে। আমি মশারির বাইরে থেকে দেখি ওকে। দেখি দু’টি চোখের পল্লব কী শান্ত, দু’টি ঠোঁটে যেন স্বপ্নের হাসি। এলোমেলো চুলে গভীর স্বস্তি। আর শিথিল হাতে পরম নির্ভরতা।

আমার মনে তখন যেন কেউ অস্ফুট কণ্ঠে ডেকে ওঠে, আনিস। আনিস। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি চলে আসি।

সেদিন জানালার পাশ দিয়ে যেতেই চমকে গেলাম। বাইরের দিকার দরজা খোলা। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত দরজার মাঝখানে আনিস দাঁড়িয়ে। পায়ের শব্দে সেই মুহূর্তে পেছনে তাকিয়েছে।

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। যাবো কি যাবো না। আর তখন আনিস দু’পা এগিয়ে ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়েছে। ও ডাকলো মৃদু কণ্ঠে, তাও শুনতে পেলাম কি পেলাম না, এসো।

আমি দাঁড়িয়ে। যাবো কি যাবো না। তখনও রাস্তা নির্জন। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। শুকতারা দপ্ দপ্ করে জ্বলছে পূবের আকাশে। বাড়িতে কেউ জেগে ওঠে নি।

আমি এক পা দু’পা করে এগোলাম। পায়ে পায়ে যেন লজ্জা জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে আবেগে আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না।

ওর মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ও হেসে বললো, এতো সকালে যে?

বাহ্ রোজ ভোরেই তো ঘুম ভাঙে আমার।

তোমাকে দেখে আমার হিংসা হয়, কি সুন্দর ঘুমোতে পারো তুমি?

কেন, ঘুম হয় নি রাতে?

না, কিছুতেই রাতে ঘুম এলো না।

সেকি! আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। না ঘুমানো লাল চোখ, সারা মুখে ক্লান্তি।

কেন জানি না, আমার তখন কান্না পেলো। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কী ভাবো তুমি এতো! এত কষ্ট পাও কেন?

ও আমার কাছে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখলো। বললো, জানি না কেন? তবু ভাবনা আসে, কষ্ট পাই।

তারপর কাছে টানলো আমাকে। আমি ওর কাঁধে মাথা রাখলাম। আর সেই ভোরে, সেই আশ্চর্য ভোরে, যখন সকালের আলো ফুটছে, আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম সারা জীবনের ব্যগ্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। আর অস্ফুটে কেঁদে উঠলাম, না, ভেবো না তুমি। এমন করে নিজেকে কষ্ট দিও না।

আবেগের সেই মুহূর্তে কিছুই মনে নেই আমার। শুধু এটুকু অনুভব করছিলাম, যেন মস্ত বড় আশ্রয় পেয়ে গিয়েছি। ও এখন দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে। আমার বুকের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো, তবু যেন তীব্র সুখ ছিলো সেই রুদ্ধশ্বাস আলিঙ্গনে ওর মুখ নেমে এলো এক সময়। তারপর, আমার সব সাধ, সব কামনা, সব দুঃখ, সব আনন্দ পরিপূর্ণ হয়ে নামলো আমার দু’টি ঠোঁটের ওপর।

ভয়ে না আনন্দে, লজ্জায় না যন্ত্রণায়, জানি না, আমি ওর দু’হাতের মধ্যে বাঁধা ছিলাম এক সময় বললাম, আমি যাই।

ও ছেড়ে দিল আমাকে।

কিন্তু মুখে বললে কি হবে, আমি ওকে ছাড়তে পারছিলাম না। বুকের কোথায় যেন কান্না জমে উঠছিলো। আবার ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম। আবার কান্নায় ভেঙে পড়লাম।

এবার ওর দুটি হাতে অনেক কালের সান্ত্বনা আর আশ্রয় নেমে এলো। আমার চুলে, আমার পিঠে, আমার গলায় হাত বুলিয়ে দিলো ও। বললো, ছি! সাত সকালে উঠে নাকি কেউ কাঁদে, কি হয়েছে?

জানি না, বলে আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম।

সত্যিই যে জানতাম না। ও পাশে দাঁড় করালো আমাকে, বাঁ হাতে জড়িয়ে। তারপর কাঁধের কাছে মুখ নামিয়ে বললো, পারলাম না আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে। তোমার হয়তো ঘৃণা হবে।

না, না, আমি মাথা নেড়েছি তখন, কি বাজে কথা বলছো, আমিও তো পারলাম না।

ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এতো সুন্দর হলে কেন তুমি?

আমি সরে এলাম তারপর। সেই ভোর, সেই আশ্চর্য ভোর। অমন তৃপ্তি জীবনে কোনোদিন পাই নি। আমার সমস্ত মনে দেহে তখন আনন্দের ঝঙ্কার বাজছে। আমার গান গাইতে ইচ্ছে করল সারা সকাল।

কিছুক্ষণ পর ওর ঘরে গেলাম নাস্তা দিতে। গিয়ে দেখি ও আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর দু’ঠোঁটে তেমনি মৃদু হাসি, দুটি নিমীলিত চোখে তেমনি অপার স্নিগ্ধতা। আমার লোভ হলো। ওর শুকনো নরম চুলে আঙ্গুল ডোবালাম একবার। তারপর ঝুকে পড়ে, ওর চোখে আস্তে, প্রায় স্বপ্নের মত, চুমু খেলাম।

হায়রে, এই যদি সুখ হতো। এই যদি তৃপ্তি হতো!

মানুষ যদি জানতো সাধের সীমানা। যদি জানতো শরীরের ভেতরকার জানোয়ারটার লোভের সীমানা।

জানি না বলেই যে অতৃপ্তি। জানি না বলেই যে যন্ত্রণা।

এরই নাম কি ভালোবাসা! এমনি ভরে থাকা, এমনি নিজের মনের ভেতরে বিভোর হয়ে যাওয়া। এমনি একাকী সুখী হওয়া। এই কি চায় না মানুষ সমস্ত জীবন ধরে!

এরই জন্যে আমি সারাজীবন ধরে কষ্ট করতে পারি, এরই জন্যে আমি যুগযুগান্ত বেঁচে থাকতে পারি। এরই জন্যে আমি পবিত্র হতে পারি, শুভ্র হতে পারি।

আমি সুন্দর, আমি সুন্দর। আর কিছু চাওয়ার নেই, আর কিছু পাওয়ার নেই। এখন আমার চারপাশে যত ঘৃণা বয়ে যাক, যতো গ্লানি বয়ে যাক, যতো সন্দেহ আর সংশয় ঘনিয়ে উঠুক, আমার কোনো ক্ষতি হবে না।

.

আমি এই সেদিনও চলে যেতে চেয়েছিলাম। আনিসের কাছাকাছি যেতে যে ভয় ছিলো, সেই ভয়কে তুচ্ছ করে কেউ যেন আমাকে ঠেলে দিলো সম্মুখে। এখন পেছনে পা রাখার কথা আমি ভাবতেও পারি না। নিশ্চিত জানি, একদিন না একদিন এ ব্যাপারটা মায়ের চোখে পড়বে। মা হৈ চৈ করবে এ নিয়ে। জানবে রাহুল, ছোট আপা, আনিসের বন্ধুরা। আনিসের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক চিরকালের জন্যে আলাদা হয়ে যাবে। তখন আমি কোথায় দাঁড়াবো? এই ভাবনাতে ভয়ে আমার বুক কেঁপে ওঠে। ভাবতে গেলে শিউরে উঠি। কিন্তু আর যে পথ নেই। এখন এ বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার শরীর আর মনের পরতে পরতে কান্না বাজে।

আমি কি চিরকালই কাঁদবো! জন্ম হওয়া অবধি তো শুধু কাঁদছিই।

আমার সম্মুখে যেতে কান্না। পেছনে যেতে কান্না। এখন আমি কী করবো?

এদিকে ঘটনাগুলো নিজের নিয়মে ঘটে যাচ্ছে। অসম্ভব রকমের দ্রুত। সব ঘটনার মাঝখানে রয়েছি আমি। তবু লক্ষ্য রাখতে পারছি না, কোন ঘটনা কী ভাবে এগিয়ে আসছে। কোন ঘটনা আমাকে শুভ্রতার দিকে নিয়ে যাবে আর কোন ঘটনা ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে ঘৃণার পঙ্ককুণ্ডে। মানুষগুলোও আসছে নানান রূপ ধরে। বুঝতে পারি, কিছু একটা ঘটে যাবে। আর তা ঘটবে খুব শীগগীরই। হয় আমি বাঁচবো, নইলে মরবো।

বাবা আজকাল দোকানেই থাকছেন। ইনসিওরেন্সের টাকাটা পেয়ে যাওয়াতে দেনা শোধ হয়েছে। এখন দোকানটা দাঁড়া করবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছেন। কোনোদিন দুপুরে খেতে আসেন না। আজকাল আসেন অনেক রাতে। কোনোদিন তাও আসেন না। শরীর খুব ক্লান্ত থাকে। কোনো হোটেলে খেয়ে দোকানেই ঘুমিয়ে পড়েন। আনিস রংপুরে সরকারি চাকরি পেয়ে গেছে। শিগগীরই যাবে। ছোট আপা নার্সিং ছেড়ে দিয়েছে। এখন চাকরি নিয়েছে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার-এ। কে জানে হয়তো দূরে কোনো মফঃস্বলে পাঠিয়ে দেবে। আমি জানি, ছোট আপা আর এ বাড়িতে ফিরবে না।

রাহুল পড়াশোনা একদম বন্ধ করে দিয়েছে। সারাদিন ওকে বাড়িতে দেখা যায় না। কোনো সময়েই বাড়িতে থাকতে পারে না। ওর সারা মনে ঘৃণা ছেয়ে আছে। একেক সময় নিজেকেও ঘৃণা করে। কিন্তু কেউ জানে না। ওর মনের কথা কেউ জানে না। কাউকে ও কোনোদিন বলবে না। বাবাকে না, আমাকে না, আনিসকে না।

হয়তো বলতো, যদি বাবা বাড়িতে থাকতেন, যদি নিজের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে মা’র ওপর কথা বলতে পারতেন, তাহলে হয়তো বলতো। কিন্তু বাড়ির ভেতরকার ব্যাপারে তো মা-ই সব। আর মা যা করে তাইতো বাড়িতে হয়। মা’র ওপর কারো কথা এ বাড়িতে চলে না। বেনুদা আসে, আকরাম চাচা আসে। রাহুল ওদের সহ্য করতে পারে না। কিন্তু কিছু করারও পথ খুঁজে পায় না। আর সেজন্যেই হয়তো ও বাড়িতে থাকতে পারে না।

আমি সেদিন ওকে ধরেছিলাম। ও ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়েই চলে যাচ্ছিলো। বাড়ির আর কেউ তখনও ঘুম থেকে ওঠে নি। ওকে দরজার কাছে ধরে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাস তুই রোজ।

বাইরে, গম্ভীর হলো ও।

পরীক্ষা না তোর সামনে। কেমন করে পরীক্ষা দিবি?

আমি পরীক্ষা দেবো না মঞ্জু, কী হবে পাস করে। তখন ছোটলোক হয়ে যেতে পারলেই বেঁচে যাবো। বড়লোক হওয়ার শখ আমার নেই।

রাহুল আমার থেকেও বয়সে ছোট। কিন্তু গম্ভীরভাবে কথা বলছে। ওর কোনো বিশ্বাস নেই এখন কারো ওপর। নিজের ওপর থেকেও বিশ্বাস হারিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে কষ্ট হলো আমার।

বললাম, তুই আকরাম আর বেনুকে সহ্য করতে পারিস না, তাই না?

ও কিছু বললো না, আমার দিকে তাকিয়ে দেখলো। আমি তখন বললাম, আমার কথা ভেবে দ্যাখ তো, আমার চোখের সামনে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, আমাকে কতো অপমান সহ্য করতে হয়, আমারও একেক সময় অসহ্য মনে হয়। কিন্তু আমি তো আর পালিয়ে যেতে পারি না। তুই পালিয়ে বাঁচিস, কিন্তু আমি কী করবো! আমিও কি মরবো ওদের সঙ্গে থেকে থেকে?

রাহুল আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। বললো, আমি কিছু জানি না মঞ্জু। আমি কিছু করতে পারি না। তুই বরং তোর দাদুর কাছে চলে যা। এ বাড়িটা থাকবে না। আমি বলছি তোকে, কিচ্ছু থাকবে না এ বাড়ির।

আমারও মনের ভেতরে কেউ যেন সায় দিয়ে উঠলো, না কিচ্ছু থাকবে না এ বাড়ির।

তাহলে আমি? আমি কোথায় যাবো? আমার কী হবে?

কী হবে, কী হবে এই আশঙ্কা আমার মনের ভেতরে যেন ছেয়ে গেলো। বুঝলাম অস্পষ্টভাবে, আমাকে পালাতে হবে এ-বাড়ি থেকে। পালানো ছাড়া আর কোনো বাঁচবার পথ নেই।

জানি পালাতে হবে, কিন্তু তবু যে পারি না। আনিসকে দেখবার সাধটাকে বাদ দেব কেমন করে! আমার এই যন্ত্রণার আর মধুর দিন ক’টা একেবারে হারিয়ে যাবে? মনে মনে ঠিক করলাম, আনিসকে বলবো আমার ভাবনার কথা।

আনিস হঠাৎ রংপুর চলে গেলো আজই। ওর যাওয়ার সময় বাড়িতে আকরাম ছিলো (ওকে চাচা বলতে ঘেন্না হয় এখন)। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে খেতে চাইলো আনিস। মা বললো, রান্নাঘরে ভাত ঢাকা আছে, নিয়ে খাও।

আনিস কিছু বললো না। আমি গেলাম রান্নাঘরে, ভাত বেড়ে দিলাম, গ্লাসে পানি ঢেলে দিলাম। এক সময় জিজ্ঞেসও করলাম, কী ভাবছো এতো?

মাথা ঝাঁকালো আনিস, না কিছু ভাবছি না।

আবার চুপ। আমি একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করলাম। কবে ফিরবে?

দু’দিন পর। স্বল্প জবাব ওর।

তারপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশের ঘরে তখন মা আর আকরাম কি একটা কথায় হেসে উঠেছে। আমি বারান্দা দিয়ে হাঁটবার সময় মা’র চাপা গলা শুনলাম। আঃ ছাড়ো, মঞ্জু আসছে।

আমার কানে তখন জ্বালা ধরেছে। কেউ যেন চরম অপমান করলো সেই মুহূর্তে। যেন কোনো বিষাক্ত সাপ আমার শরীরে ছোবল মারলো! আমি ইচ্ছে করে পায়ের শব্দ তুলে সরে এলাম বারান্দা থেকে।

আমার নিজের ঘরে মম আর পুতুল খেলছিলো। ওরা আমাকে খেলতে ডাকলো। ওদের কথায় কান দিতে পারলাম না। এক সময় শুনলাম আনিসের গলা।

বলল, চললাম আমি।

কেউ সাড়া দিল না ওর কথায়। আমিও না। আমার ইচ্ছে করছিলো যাওয়ার আগে ওর কাছে গিয়ে দাড়াই। এগিয়ে দিই গোট পর্যন্ত। কিন্তু পারলাম না। বসে রইলাম সেই

ঘরে। মম, পুতুল আর আমি। বারবার মা’র সেই চাপা হাসি আর সেই কথাটা কানের কাছে শুনলাম। সব মিলিয়ে বিশ্রী লাগলো।

মম আর পুতুল কি জন্যে যেন চিৎকার করছিলো, ওদের বললাম, তোরা মায়ের কাছে যা।

না, পুতুল জবাব দিলো।

কেন?

ঘরে আকরাম চাচা আর মা গল্প করছে। মা এ ঘরে খেলতে বললো।

আমার অনেক দিনের পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়লো। হ্যাঁ আমিও পুতুলের মতো ছিলাম তখন। পুতুল যেমন কথা বলছে, তেমনি আমিও এক সময় বলেছি।

তখন মা নানার কাছ থেকে দাদুর ওখানে যেতো। থাকত দু’ এক মাস। সেই সময় আসতো কবির চাচা। ঢাকায় লেখাপড়া করতো, ছুটিতে আসতো বাড়িতে। আর সারাটা ছুটি ও মা’র সঙ্গে রোজ দুপুরবেলা গল্প করতো। নিঝুম দুপুর তখন, গোটা বাড়িটা নিঃশব্দ। এমন সময় কবির চাচা মা’র ঘরে যেতো।

সেই অস্পষ্ট ঘটনাগুলো আজ স্পষ্টতর হলো। একবার দু’জনে ঘরের মধ্যে পাঞ্জা লড়ছিলো, কার গায়ে জোর বেশি। কবির চাচা লিকলিকে হাল্কা মানুষ। মা ওকে হারিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু মা নিজেই বারবার হেরে যাচ্ছিলো। আমি দেখছিলাম দু’জনের কাণ্ড। খুব মজার ব্যাপার মনে হয়েছিলো। লিলিকে মানুষ কবির চাচা জিততে পারছিলো দেখে হাসি পাচ্ছিলো আমার।

তারপর, হ্যাঁ, ঐ ঘটনাও মনে আছে।

চাপা হাসিতে দু’জনে এক সময় হুমড়ি খেয়ে পড়লো, একে অন্যের ওপর। আর তখন মা কবির চাচাকে কাতুকুতু দিতে আরম্ভ করলো। কবির চাচাও ছাড়ে নি। দু’জনে মেঝেতে গড়াগড়ি করতে করতে হেসে হেসে সারা হচ্ছিল, আর ঠিক তখনই ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে পিছিয়ে গিয়েছিলো রাহেলা ফুফু। ঘরের ভেতরে ওরা টের পায় নি। আমি লক্ষ্য করেছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরের এসে দেখি রাহেলা ফুফু দৌড়ে যেন পালিয়ে যাচ্ছে।

অমনি আমিও পালিয়ে এসেছি। রাহেলা ফুফু সেদিন কিছু দেখে নি, শুধু হাসির শব্দ শুনেছিলো, আর তাই শুনে পালিয়ে এসেছিলো। আমাকেও পালিয়ে আসতে হলো, কিছুই দেখি নি, তবু।

সেই ঘটনার পরই মাকে দাদু নানার ওখানে রেখে যান। মা তারপর আর কোনোদিন যেতে পারে নি দাদুর বাড়িতে। তখন বুঝতে পারি নি, মা যেতে চাইলেও কেন দাদু বারবার নিয়ে যেতে অস্বীকার করেছেন। এখন বুঝতে পারি সব কিছু। কিন্তু বাবা এখন কোথায় রেখে আসবেন মাকে! নানা বেঁচে নেই, মামারা সবাই ফৌৎ হয়ে গেছেন। মা’র যাবার জায়গা নেই কোথাও। আর থাকলেই কি পারতেন বাবা।

পারতেন না, আমি জানি। আহা, যদি পারতেন।

.

দুটো দিন কী অস্বস্তিতে যে কাটলো!

উঃ সেইদিন, কী ভয়ঙ্কর দিন।

তখন অনেক রাত। আমি তখনও জেগে রয়েছি ঘরে। আমার কাছে মম পুতুল শুয়ে। মা সন্ধে হতেই বাবার জন্যে ভাত তুলে রেখে, ঘরের দরজা বন্ধ করলো। আমাকে ডেকে বললো, যা তুই শুয়ে পড়গে, মম পুতুলকে নিয়ে যা তোর কাছে। আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।

মা’র অমন মাথা ধরে মাঝে মাঝে।

তখন দু’ একদিন খুব কষ্ট পায়।

আমার ঘুম আসে নি তখনও। আনিসের কথা ভাবছিলাম। সেদিনই আনিসের আসবার কথা ছিলো। তখন কতো রাত কে জানে। রাহুল সিনেমায় গিয়েছে, তখনও ফেরে নি। সমস্তটা বাড়ি চুপ।

এমন সময় বাবার গলা শুনতে পেলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন। তারপর আবার নেমে এলেন বাইরের ঘরটা পেরিয়ে। উঠোন থেকেই পুতুলের নাম ধরে ডাকলেন, তারপর আমার নাম ধরে। কেউ সাড়া দিলো না।

তারপরই আমি বেরুলাম। আর ঐ সময়ই বাবার ক্রুদ্ধ স্বর শোনা গেল। মা’র নাম ধরে ডাকছেন, এই সালেহা, দরজা খোল। মা দরজা খুলছে না তখনও। আমিও ডাকলাম। বাবা হঠাৎ আমাকে ঘরে যেতে বললেন।

বুঝলাম। ভয়ঙ্কর কিছু যেন একটা হতে যাচ্ছে। মা দরজা খুলছে না কেন?

আমি ঘরে গেলাম না। বাবা আমাকেই বললেন, যা তো বন্দুকটা নিয়ে আয়।

অতো রাতে বন্দুক কোথায় পাবো। বন্দুকটা থাকে আনিস ভাইয়ের ঘরে। আর সে ঘর তো বন্ধ।

আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। বাবার দিকে তাকালাম একবার। কী ভয়ঙ্কর চেহারা হয়েছে তাঁর! চোখ দুটোতে আগুন জ্বলছে।

বাবা এগিয়ে প্রবল জোরে লাথি মারলেন দরজার ওপর। বিশাল শরীরের সজোরে লাথি খেয়ে দরজাটা ভেঙে পড়লো। এবং দেখলাম, মা সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর মা’র আড়ালে আকরাম। মা যেন আড়াল করে ধরেছে আকরামকে।

আমিও তখন ফুঁসে উঠেছি। বলছি, মারুন ওটাকে। মেরে ফেলুন।

আকরাম ভয় পেয়েছে তখন। কিছু বলছে না।

মা বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলছে, যদি মারতে হয়, আমাকে মারো আগে, তারপর ওর গায়ে হাত দিও। বাবা স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছেন তখন মার দিকে তাকিয়ে। তাঁর চোখে ঘৃণা, ক্ষোভ, আর যন্ত্রণা এক সঙ্গে ফুটে উঠলো। কিছু বলতে গিয়েও যেন পারছেন না। আর সেই স্তব্ধ বিমূঢ় মুহূর্তে ঝড়ের বেগে আকরাম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

বাবা তারপরও কিছু বলছেন না। বাবার ওপর আমার রাগ হতে লাগলো। কেন কিছু বলছেন না!

অবশেষে বললেন। হ্যাঁ বললেন, থেমে থেমে, চরম ঘৃণায় যেন কথা বেরুচ্ছে না তাঁর। বললেন, তুমি পশুরও অধম সালেহা, তোমাকে আমি ঘৃপা করি। তোমার মুখ দেখিও না আমার কাছে।

বাবা না খেয়ে সে রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বাবা গেলেন আর আমার মনে হলো, তিনি চিরকালের জন্যে গেলেন আর আসবেন না কোনোদিন।

সেই রাতে, সেই ভয়ঙ্কর রাতে আমি বুঝলাম, চৌধুরী বাড়ির সব চাইতে শত জায়গাটার ভিত ভেঙেছে এবার। আর বেশি দেরি নেই।

এই ঘটনা আমি কাউকে বলি নি। কাকে বলবো। নিজের মার অমন ব্যভিচারের কথা কাকে বলা যায়? মা’র মুখোমুখি হতে আমারও শরীরে কোথায় যেন ঘৃণা ঘুলিয়ে উঠতো।

উঃ সেইদিন কি ভয়ঙ্কর দিন। কেউ নেই বাড়িতে। কেউ কথা বলছে না। রাহুল কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলো বোধ হয়। এক সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে মঞ্জু

আমি ওর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললাম, না তো, কিছু হয় নি তো।

ও মৃধু হাসলো, ঠিক আনিসের মতো হাসে ও। স্বচ্ছ আর সুন্দর। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুই বলতে পারলাম না তখন। কেমন করে উচ্চারণ করবো সেই অশ্লীল ঘটনাটা।

রাহুল আমাকে চুপ দেখে বললো, নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে, তুই হয়তো জানিস না। তোর মা একদম চুপ, বেনুদাকে আসতে দেখি না। আকরামকে দেখলাম রাস্তায়, মনে হলো তাড়া খাওয়া চোরের মত।

আমি জোর করে হাসলাম, তোর আবার দেখা, কি দেখতে কী দেখেছিস, তার ঠিক কি?

রাহুল জানে না তখনো। হে খোদা, ও যেন জানতে না পারে। কি বিশ্রী, কি বিশ্রী। যতবার মনে পড়লো, ততোবার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। গলার নিচ থেকে একটা বমির ভাব ঠেলে ঠেলে আসতে লাগলো উপরের দিকে

অতোবড় বাড়িটা এখন অথৈ নিঃশব্দতায় ডুবতে লাগলো। আমি রান্না করলাম, পুতুলকে খাওয়ালাম, মম’কে খাওয়ালাম। দুপুরে ওদের শুইয়ে রেখে নিজে বসলাম ঘরে। কোনো অনুভূতি নেই এখন। কিচ্ছু ভাবছি না। প্রবল একটা ঝড়ের পর যেমন সমস্ত প্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে যায়, আমার মন ছেয়ে তেমনি একটা স্তব্ধতা। মা ঘর থেকে বেরুলো এক সময়, তারপর স্নান করলো, ভাত খেলো, বারান্দা থেকে আমাকে ডেকে খেয়ে নিতে বললো। সব কাজ বয়ে চললো পুরনো নিয়মে। কিন্তু সেই অগাধ অস্বস্তি আর নিঃশব্দ আতঙ্ক থেকে বাড়িটা যেন মাথা তুলতে পারছে না।

আমি কী করি এখন। কী করি!

রাহুলের টেবিল ঘেঁটে একটা পোস্ট কার্ড পেলাম। তাতে চিঠি লিখলাম দাদুকে। এখানে থাকতে পারছি না, আমাকে তোমরা নিয়ে যাও।

চিঠিটা পোস্ট করতে যাবো। এমন সময় দেখি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে দোকানের কর্মচারী আবুল। ও রাহুলকে ডাকতে এসেছে। বাবা ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি ওকে বাড়ির ভেতর ডেকে আনলাম। টিফিন ক্যারিয়ার-এ করে খাবার সাজিয়ে দিলাম। ক্যারিয়ারটা ওর হাতে দিয়ে বললোাম, বলবি মঞ্জু পাঠিয়েছে। বলবি, মঞ্জুই রান্না করেছে।

আবুল চলে গেলো, আর ওর পেছন পেছন রাস্তায় নামলাম। মোড়ের কাছে পোস্ট বাক্স। চিঠি পোস্ট করে আসছি, এমন সময় পেছনে ডাক শুনলাম। শুনলাম আর চিনলাম। বেনু ডাকছে আমাকে। থামলাম না, ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। বাড়ির গেটের কাছাকাছি এসে আবার জিজ্ঞেস করলো, কি রে কথার জবাব দিস না যে বড়।

কী জবাব দেবো?

কাকে চিঠি লিখলি?

বলতে হবে নাকি? আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকে পাল্টা প্রশ্ন বেরিয়ে এলো।

না, না, আমার প্রশ্নে অপ্রস্তুত হলো যেন। বললো, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম। ও হাসল কৃতার্থ হয়ে।

আমি পা বাড়িয়েছি, গোট খুলে ভেতরে ঢুকব। আবার সেই প্রশ্ন ওর। বলবি না, কাকে লিখলি।

আমার হাসি পেলো তখন। বললাম, প্রেমপত্রের কথা কেউ কাউকে বলে নাকি?

বেনু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমার সময় ছিলো না যে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি।

বিকেলে মা খালার বাড়ি যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগলো। অন্যান্য বারের মতো আমাকেও যেতে হবে হয়তো।

এক সঙ্গে রিক্সায় উঠতে হবে, বসতে হবে পাশাপাশি, ভাবতেই বিশ্রী লাগলো। কিন্তু উপায় তো নেই। মম্ পুতুলকে সামলাবার লোক চাই। তাছাড়া কেমন করে একাকী থাকবো এতো বড় বাড়িটাতে। বেনুদা আসতে পারে খারাপ মতলব নিয়ে।

কিন্তু কি অবাক, মা আমাকে সঙ্গে নিলো না আজ। অবশ্যি স্বস্তি পেলাম তাতে। কিন্তু মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে হলো, আজ কী হয়েছে যে মা সঙ্গে নিলো না আমাকে। দেখলাম মা’র মুখ রাগে কালো হয়ে আছে। আমি যেন বিরাট কিছু অপরাধ করে ফেলেছি। বুঝলাম, আমার মা মরে গেছে। শুধু আমার মা নয়। পুতুল মম ওরাও যেন হারিয়েছে ওদের মা’কে।

এ বাড়িটা কি বিচিত্র এখন। ভাবা যায় না কতো দ্রুত বদলে যাচ্ছে সব কিছু। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। কেউ কাউকে বুঝতে চেষ্টা করছে না। কয়েকটা অদৃশ্য ফাটল বড় হতে হতে এখন প্রত্যেককে আলাদা করে দিয়েছে।

ছোট আপা গেলো, আনিস গেলো, রাহুল গিয়েছে। আমি, আমিও তো নেই কারো সঙ্গে। আমরা সবাই একাকী I

কোথায় যেন অদৃশ্য সূক্ষ্ম বাঁধন ছিলো। যা অনুভব করতাম সবাই। এখন আর তা কেউ অনুভব করি না। যদি করতাম, তাহলে সবাই এমন করে দূরে দূরে চলে যেতে পারতাম না।

এই কি প্রেম! মা’র জীবনে এই কি প্রেম এসেছে। কবির চাচাকে মা ভালোবেসেছে, বাবাকে ভালোবেসেছে, আবার আকরামকেও ভালোবেসেছে।

এরই নাম যদি প্রেম হয়, তাহলে জানি না, আমি কাউকে ভালোবেসেছি কিনা।

মেয়ের মন নিয়ে আমি বুঝতে পারি, কেন মা কবিরের সঙ্গে অমন হাসাহাসি করতো, কেন আকরাম এসে মা’র শরীরে হাত রাখতে পারে। বুঝি এসব শরীরের বিচিত্র উল্লাস। মন যেন তখন আর নিজের বশে থাকে না। সেই ভয়ঙ্কর উল্লাসের রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়, অথবা সেই উল্লাসের তালে তাল দিতে থাকে।

এ যদি প্রেম না হয়, তাহলে এর নাম কী? আর কেন ভালো লাগে এসব? মা’র তো কতো আছে সাধের আশ্রয়। স্বামী আছে, সন্তান আছে, সংসার আছে, তবু কেন মা এই বিচিত্র উল্লাসে গা ভাসিয়ে দিতে চায়! কেন মা’র ভালো লাগে এসব?

আমি আর পারি না এমন ভাবনা নিয়ে।

বিকেলের দিকে বেনু আসে নি। বিকেলটা কাটল বেশ একাকী।

আমাকে যেতে হবে। এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই এখোন আর। যদি চাচা আসে কাল অথবা পরশু অথবা পরের সপ্তাহে কোনোদিন, তাহলে বাঁচি। একেকটা দিন যাচ্ছে, আর মনে হচ্ছে, একেকটা দীর্ঘ আর ক্লান্ত বছর কাটছে। এ বাড়ি থেকে চলে গেলেও কি বাঁচবো আমি? মনের মধ্যে প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হয় আমাকে।

দাদুর বাড়িতে গিয়ে উঠবো। তারপর কয়েক দিন পর আমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমার বাধা দেবার শক্তি থাকবে না। আর কোনোদিন আমি সেই সুখের স্পর্শ পাবো না, যে সুখে আমার সারা মন বিভোর হয়ে রয়েছে। আমি যে সমুদ্রের মতো বিপুল শুক্তি পেয়েছি সারা মনে, তা আর কোনোদিন অনুভব করবো না। সেই সুখ, সেই মুক্তি ধরে থাকতে হলে আমাকে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে।

কিন্তু দাঁড়াব কোথায়? আমার পায়ের নিচের জমিই যে টলোমলো। আমি কার আশ্রয়ে থাকবো এখানে? বাবা নেই, আনিস নেই, মা নিজেই থাকবার অধিকার হারিয়েছে। এখন কোন আশ্রয়ের নিচে আমি মাথা গুঁজবো

আজকের সন্ধ্যা একাকী। উঠোনে একাকী হেঁটে বেড়ালাম, মনের ভেতরে এলোমেলো ভাবনা নিয়ে। হাওয়া বইলো, তারা দেখা গেল আকাশে, তারপর আবার হয়তো হাওয়া চুপ করে গেলো, মেঘ ভেসে এলো। আবার হয়তো হাওয়া দিলো, বইলো অন্য কোথাও, তারা ফুটলো অন্য কোনো আকাশে। আমার হাতে একটা সন্ধ্যা হঠাৎ এসে গিয়েছে। যে সন্ধ্যায় আমার কিছুই করবার নেই। যদি আমার বন্ধুরা কেউ আসতো, রঞ্জু কিংবা নাসিমা, তাহলে ওদের সঙ্গে গল্প করা যেতো। যদি রাহুলও থাকতো। আর যদি, যদি থাকতো……..। আমার মন এই নিঃসঙ্গ একাকী সন্ধ্যায় ওর কথা স্মরণ করতেই থমকে উঠলো।

ও যদি থাকত, তাহলে কী হতো বলা যায় না। ইশ, কী ভয়ঙ্কর সুন্দর আর লোভের সন্ধ্যা হতো এটা।

বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছিলো, এখন সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত্রি। আর সেই প্রথম রাতেই নিঃসঙ্গ মস্ত বাড়িটার দরজার কড়া নড়ে উঠলো।

কে! সাড়া দিলাম আমি।

আমি, মোহনপুর থেকে আসছি।

মোহনপুর! আমার দাদুর ওখান থেকে! আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম।

চৌধুরী সাহেব আছেন? এক অপরিচিত ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

না, মাথা নাড়ালাম আমি? ভদ্রলোককে চিনতে চেষ্টা করলাম।

ওঁকে একটা কথা জানাবেন?

বলুন।

বলবেন, মোহনপুরের হাফিজ খান মারা গেছেন।

মারা গেছেন! অস্ফুট স্বর বেরুল আমার গলা দিয়ে। ঠিক বুঝতে পারলাম না কী হলো আমার। মুহূর্তের মধ্যে আমার সমস্ত চেতনা যেন অসাড় হয়ে গেলো। ভদ্রলোককে আমি দেখতে পর্যন্ত পেলাম না।

না কান্না, না যন্ত্রণা, না দুঃখ কিচ্ছু না। শুধু একটা প্রকাণ্ড শূন্যতায় ভরে গেল সমস্ত মন।

দাদু নেই। শুধু এই শব্দ দুটো যেন চারপাশ থেকে মৃদু স্বরে আমার কানের কাছে বলছে কেউ বারবার। আমাকে শুনতে হচ্ছে সেই কথা। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না, তবু শুনতে হচ্ছে।

কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছি জানি না। যখন সম্বিৎ ফিরলো, দেখলাম ভদ্রলোক অনেকক্ষণ আগে চলে গিয়েছেন। দরজার কপাট ধরে আমি একা।

আমি একা। এই প্রকাণ্ড প্রাচীন বাড়ির উঠোন, দূরের বারান্দা, দোতলার ঘরগুলো, সব জায়গায় যেন একটা প্রকাণ্ড শূন্যতা আর তার মাঝে আমি একা।

দাদু নেই। এই সেদিনও ছিলেন। মুখে প্রসন্ন হাসি আর স্নিগ্ধতা দেখেছি। পাতলা ধবধবে ফর্শা মানুষ, মুখে সাদা দাড়ি আর সেই দাড়ির আড়ালে স্নিগ্ধ হাসিটি। কাছে দাঁড়ালে মাথা নিচু হয়ে আসতো। এই সেদিন এলেন, এসে বলে গেলেন, চল তুই এবার, তোর জন্যে ভালো বর জুটিয়েছি। যাবার সময় হাতে ক’টা টাকা দিয়ে গেলেন, আর সেই সঙ্গে হাতে ক’গাছি চুড়ি। বললেন, হাত খালি রাখিস কেন?

শুধু কি সেদিনই। আমাকে অনেক জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন দাদু। আমি তাঁর বড় ছেলের সন্তান। আমার আদর ছিলো সব চাইতে বেশি।

তাঁর সঙ্গে ঢাকা গিয়েছি, পাবনা গিয়েছি, কলকাতা গিয়েছি। মাঝে মাঝে শুধু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকতো। আমি দেখতাম, তাঁর দু’চোখ পানিতে টলমল আর ঝাল্লা হয়ে উঠতো।

দাদু নেই। আর আসবেন না কোনোদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে। কখনও তাঁর শক্ত আর বিশাল হাতখানা আমার মাথা আর কাঁধ ছুঁয়ে আশির্বাদ করবে না।

সেই সন্ধ্যায় আমি একাকী থাকলাম। নিজের ঘরের বিছানার ওপর উপুর হয়ে শুয়ে। না, কাঁদছিলাম না, ভাবছিলাম। এবং একটু পর বাবার গলা শুনলাম। বাড়িতে ঢুকেই রাহুলকে ডাকলেন। তার পর এঘর-ওঘর খুঁজে এসে দাঁড়ালেন আমার ঘরে। আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, আজই কি যাবি তোর দাদুর ওখানে?

না, মাথা নেড়ে বললাম আমি।

কাল সকালে রওয়ানা দে তাহলে।

না, আমি যাবো না। আমি আরেক বার বললাম।

বাবা দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। আমার মনে হলো, বাবা যেন কিছু দেবার জন্যে এসেছেন। বাবার কাছে যেন কিছু আছে, যা আমি না পেলে চিরকালের জন্য আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। মনোময় ছাওয়া সেই শূন্যতার ওপার থেকে আমার ডাকতে ইচ্ছে করল বাবাকে। ডাকলাম, বাবা!

বাবা কাছে এলেন। আর সেই মুহূর্তে কেঁদে ফেললাম। বাবার সস্নেহ সান্ত্বনার হাত আমাকে শান্ত করলো। বললেন, কাঁদিস না মা, কেউ তো চিরদিন বাঁচে না।

একটু পর আবার বলেছিলেন বাবা, কাল যাবি?

না, কি হবে গিয়ে।

তা’ বটে, বাবাই বলছেন এখন, ওখানে গিয়ে আরও কষ্ট পাবি।

মা সেদিন কখন ফিরেছিল জানি না। বাবা কখন দোকানে ফিরে গিয়েছিলেন তাও জানি না। আমি সেদিন সারাটা রাত জেগে ছিলাম।

এই দুঃখের মধ্যেও বাবার সস্নেহ সান্ত্বনা মনের ভেতরে কী যেন পরম প্রাপ্তির স্বাদ এনে দিয়েছিলো। এই স্বাদ আমি মনে মনে অনুভব করছিলাম। না, আর অন্য কোনো কথা ভাবতে পারি না, পরশু আর কালকের দু’টো দিন। না তাকিয়েছি মার দিকে, না রাহুলের দিকে। লক্ষ্য করি নি, কখন এসেছে বেনু, কখন ফিরে গেছে আকরাম। একবার শুধু মনে হয়েছে, রাহুল যেন আড়াল থেকে দেখে গিয়েছে আমাকে। কিন্তু মুখোমুখি দাঁড়ায় নি। কেননা কান্নাকে বড় ভয় ওর। সহানুভূতির কথা খোলাখুলি ও কাউকে বলতে পারে না। আমার এই দুঃখের দিনে জানি, রাহুলই আমার ভাই, আমার বন্ধু।

সেদিন ভোর রাতে আমি আনিসের কথা ভাবছিলাম। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, হে বিধাতা, আনিস যেন না আসে। আমার কষ্টের দিনে ও আমার কথা নিয়ে চিন্তা করবে, তারপর যখন দেখবে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তখন ও ভেঙে পড়বে। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে হয়তো নিজেরই ওপর থেকে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *