পিঙ্গল আকাশ – ৩

বাবার ওপর মামলা হয়েছে। ফৌজদারী মামলা! দশ হাজার টাকা দিতে হবে একজনকে।

কী জন্যে যে মামলা, কী জন্যে যে বাবার মতো শান্ত আর নিরীহ মানুষকে এই মামলায় জড়িয়ে পড়তে হলো, কে জানে। কিছুই বুঝি না, কেউ কিছু বলে না। আর কাউকে কিছু আমি জিজ্ঞেসও করতে পারি না। শুধু দেখি, বাবা আজকাল বাড়িতে থাকছেন। আর দিনরাত ভাবছেন। শুধু ভাবছেন। দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মহাজনের দেনা শোধ কতে পারেন নি। সেই দেনা শোধ না করায় মহাজন দোকানে তালাচাবি লাগিয়ে রেখেছে।

নিজের দোকান থেকেও নেই। বাবা এঘর-ওঘর পায়চরি করেন। কারো সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা বলেন না। কেমন যেন উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে গেলেন মোটে ক’টা দিনে। মনে হলো বাবা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছেন। মনে হলো, আজ, হ্যাঁ আজই, আমার প্রথম মনে হলো, এ সংসার আর থাকবে না। চোরা স্রোতের উপরকার বালির ওপর যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়িটা। এই স্রোতের জন্ম অনেক পেছনে। কেমন করে যে, আর ঠিক কোন সময়ে যে এর জন্ম হয়েছে, আমি বলতে পারবো না। শুধু আমি কেন, অনেকেই জানতাম না। একাকী বাবাই বোধ হয় এই চোরা স্রোতের কথা জানতেন।

যে ভয় ছিলো লুকিয়ে, সেই ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাবার তখন আর শক্ত পায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। ভয় পেয়েছেন বাবা। হেরে যাওয়ার ভয়।

ছোট আপার অমন ভাবে চলে যাওয়া, রাহুলের অমন যন্ত্রণা, আনিস ভাইয়ের নিজেকে অমন করে তিলে তিলে ক্ষয় করা—সব যেন, হ্যাঁ, সব যেন এক সূত্রে বাঁধা। এমন কি মাও যে বাবাকে দেখতে পারে না—এও যেন সে সব ব্যাপারের একটা দিক। আমি বলতে পারি না, কিন্তু বুঝতে পারি, অস্ফুট অস্পষ্ট হলেও, বুঝতে পারি, কী যেন রয়েছে ভেতরে ভেতরে অন্তঃস্রোতের মত।

এ বাড়ি ভেঙে যাচ্ছে, অথচ এ ব্যাপারের জন্যে কে দায়ী তা কেউ বলতে পারে না। আমি বুঝতে পারি, রাহুলের অমন মন খারাপের জন্যে এ বাড়ির কাউকে দায়ী করা যায় না। ছোট আপার বেরিয়ে যাওয়ার জন্যেই বা কাকে দায়ী করবো! আর আনিস ভাই-এর যে যন্ত্রণা, আর নিজেকে তিলে তিলে হত্যা—যা আমার বুকের ভেতরে তীব্র ভাবে বাজে—তারও জন্যে এ বাড়ির কাউকে দায়ী করা যায় না।

ক’দিন আগে মনে হয়েছিলো দোষ বাবার, দোষ আমার, দোষ আনিসের। এখন বুঝি, সে সব আমার আবেগের মুহূর্তের ভাবনা। শত্রু রয়েছে অগোচরে, আমারও, তারও। এ বাড়িকে যে ধ্বংস করছে, সে রয়েছে সব রকম স্পষ্টতার ওপারে। দূর থেকে নানান ছলে সে এগিয়ে এসে একে একে ভিত্তির ইট খসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ কেউ টের পাচ্ছে না। চারদিক থেকে কী একটা শক্তি ধীরে ধীরে তার প্রকাণ্ড থাবার মধ্যে চেপে ধরতে চাইছে। একদিন হয়তো দেখবো, এতোবড় বাড়িটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

শুনেছি বাবা জমিদারের ছেলে। তাঁর বাবা বিলাস করে জমিদারী ফুঁকে দিয়েছেন। বাবা নেমেছিলেন ব্যবসায়ে। জমির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে এখন বাবারও আর দাঁড়াবার জায়গা নেই।

আমাকে যে আরও কত দেখতে হবে কে জানে। বুক ভরে শুধু আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে। এতোবড় একটা বাড়ি ক’দিন পর ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে, কিন্তু কেউ তাকিয়ে দেখবে না, কারুর কোনো কষ্ট হবে না। এ যে কী কষ্টের, কী যন্ত্রণার, কাকে বলি আমি সে কথা।

বাবার জন্য আমার এতো কষ্ট হয় সময় সময়। এতো কান্না পায়।

হয়তো পেতো না কান্না। কিন্তু বাবাকে চিনতাম না। কিন্তু সেদিন চিনলাম। আর কষ্ট হলো আমার।

বাবা টাকা নিয়েছিলেন বরকত এলাহীর কাছ থেকে। লোকটাকে আমি দেখেছি আমাদের বাড়িতে লোকটা আসতো। সব সময় হাসি হাসি মুখ। সুন্দর দাড়ি রাখে ভদ্রলোক। দাড়ির আড়ালে দুটো ধূর্ত চোখ সর্বক্ষণ জ্বলছে। আর কী চোখ সে দুটো। মনে হয়, মানুষের মনের ভেতরটা পর্যন্ত বোধহয় লোকটা দেখতে পায়।

বরকত সাহেব এলে চা খাওয়াতে হয়। আমিই চা দিয়ে এসেছি নিজের হাতে। পান সেজে দিয়েছি।

দোকান ক্রোকের আগে, হ্যাঁ ঠিক দু’দিন কি তিন দিন আগে লোকটা এসেছিলো এ বাড়িতে। বাবাকে কী যেন অনেকক্ষণ ধরে বোঝাতে চাইছিলো। বাবা কেবলি গর্জে উঠছিলেন ঘরের ভেতরে। একটু পর আমি চা নিয়ে যাচ্ছিলাম ভদ্রলোকের জন্যে। দরজার কাছে গিয়েছি—এমন সময় বাবা ঘর থেকে বেরুলেন। দু’চোখের রঙ লাল। বাবার এমনিতে ব্লাডপ্রেসার। তার ওপর ভয়ানক রেগে উঠেছেন। আমার ভয় হলো, কি জানি কী হয়। বাবা আমাকে দেখেই ধমকে উঠলেন, কী চাস তুই?

বললাম, চা নিয়ে যাচ্ছি।

তুই কেন, বাবা আরেকবার গর্জে উঠলেন, আর কেউ নেই বাড়িতে?

বাবার কথায় আমাকে ফিরে যেতে হলো। বাবা আমার নিজের বাবা নয়। কিন্তু তবু আমাকে কোনোদিন বকেন নি। বিরক্ত হলেও কোনোদিন মুখ ফুটে কোনো কথা বলেন নি। অথচ আজ আমাকেই এমন করে ধমকে উঠেছেন। বরকত সাহেবকে চা দিয়ে আসতে পারলাম না। ওকে চা দিতে আমার একটুও ইচ্ছে করতো না। কিন্তু তবুও দিতে যেতে হতো। মা জোর করে পাঠাতো।

লোকটাকে আমি প্রথম থেকেই পছন্দ করতে পারি নি। টাকা-পয়সাওয়ালা লোককে আমার কেন জানি না ভালো লাগে না। কিন্তু আমার ভালো লাগা মন্দ লাগায় কার কি এসে যায়। বাবা ওর সাহায্যে এতোবড় ব্যবসা চালাচ্ছেন। সে জন্যে সংসার চলছে। অমন লোকের সমাদর না করলে চলবে কেন! তা যেমনই লোক হোক না সে। এ কথা আমাকে কেউ বলে দেয় নি। আমার নিজের থেকেই মনে হয়েছে এ কথা। আর আমি সে-জন্যেই অমন সমাদরের চেষ্টা করেছি। কিন্তু……….

কিন্তু সামান্য সাধারণ ঘটনাও যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, একথা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। সেদিন বাবা কোথাও বেরোননি। সারা সন্ধা মাথায় পানি ঢেলে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আর অনেক রাত পর্যন্ত আমি পাশের ঘরে বসে বাবার নিঃশ্বাসের শব্দ স্থির হয়ে শুনছিলাম। তারপর জানলার ওপারে দিয়ে ঠাণ্ডা আকাশের বুকে তারার ঝাঁক দেখতে ইচ্ছে করছিলো। কতো কথা মনে পড়ছিলো। আমার ছেলেবেলা, আর সেই সময়ের বন্ধুদের। আর সেই সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার সব কথা ভাবছিলাম এলোমেলো। এমন সময় মার গলা শুনলাম। বলছে, বেশ তো, বরকত এলাহীর কী আর এমন বয়স হয়েছে।

না, না। বাবা গজরাচ্ছেন তখনও। ওসব কথা তুমি এনো না। যায় যাবে আমার ব্যবসা, কিন্তু একটা জীবন নষ্ট করতে পারবো না আমি।

মা বোঝাতে চেষ্টা করছেন, আহা জীবনটা যে নষ্ট হয়ে যাবে, সেকথা কে বলেছে তোমাকে! এমনও হতে পারে সেখানেই ওর জীবনের সব সুখ আছে।

না, না, ওসব বাজে কথা বন্ধ করো তুমি।

মা রেগে উঠলো যেন। বললো, তার মানে তুমি চাও তোমার ব্যবসা চলে যাক, আর আমার নাবালক ছেলেমেয়ে দু’টো না খেয়ে মরুক? একটু পর আবার বললো, তুমি না রাজি থাকো, আমি রাজি হচ্ছি।

না, ওসব হয় না। বাবার স্থির জবাব, তুমি নিজের মেয়ের এমন সর্বনাশ করতে চাও কেমন করে?

কিন্তু বরকতকে সামলাবে কেমন করে?

সামলাবো কেমন করে। এখন দুটো পথ খোলা। হয় ওকে সন্তুষ্ট করা, না হলে দোকান সম্পত্তি ওর হাতে তুলে দেওয়া। এখন দশ হাজার টাকা আমি কোথাও পাবো না যে ওর দেনা শোধ করবো। তবে একটা ষোল বছরের বাচ্চা মেয়েকে ওর হাতে তুলে দিতে পারবো না, এটাও ঠিক।

ষোল নয়, সতেরো। মা সংশোধন করে দিল। এমন তো কত হচ্ছে। আমি যে তোমার বয়সী একটা লোককে বিয়ে করে সুখী হয়েছি—এটাও তো হওয়া উচিত ছিলো না।

বাবার স্বর শুনলাম না একথার উত্তরে। আমি আরও সজাগ হয়ে কান পাতলাম। বাবা কী বলেন শোনার জন্যে। একটু পর বাবার গলা শুনেছি। বাবা ধীরে ধীরে বলছেন, ম আমার মেয়ে হয়তো নয়, কিন্তু ওকে আমি স্নেহ করি। ওকে সুখী করার দায়িত্ব আমারও।

কিন্তু অন্যায়টা কোথায়, ভদ্রলোক তো আর কুৎসিত কোনো প্রস্তাব করে নি। মেয়েটাকে বিয়ে করতে চায়, আর আগের পক্ষের স্ত্রীও তো বেঁচে নেই। মা বাবাকে তখনও বোঝাচ্ছে, কী আর এমন অন্যায় করেছে।

একটু পর আবার মার গলা শুনলাম। বলছে, কোনোমতেই আমি পুতুল আর মম-এর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দিতে পারি না। তুমি আর ক’দিন বাঁচবে, তোমার বয়স হয়েছে একথা ভুলে যাও কেন? তোমার বড় ছেলে যে আমার ছেলেমেয়ে মানুষ করবে –এ ভরসা করি না আমি

আর আমার শোনার প্রয়োজন ছিলো না। গোটা কাহিনী বুঝে নিলাম। বরকত ইলাহী আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে চায় তার সংসারে। আর বাবার পাওনার জন্যে যে ডিক্রী হয়েছে, সেটা সে তুলে নেবে। পরে সময় মতো বাবা ওকে টাকাটা শোধ করে দেবেন।

টাকা পয়সার হিসেবটা কি সূক্ষ্ম। একেবারে মাপ করে খাপে খাপে বসিয়ে ডিক্রী করা হয়েছে। বরকত ইলাহীর দ্বিতীয় সংসার জাঁকিয়ে তুলতে হবে আমাকেই, আমার ছোট ভাই আর বোনের মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে। এমন জায়গায় আঘাত করেছে ওরা, যেখানে বাবা একেবারে নিরুপায়।

কিন্তু তবু বাবার সম্মান-জ্ঞান রয়েছে। মাথা নিচু কখনও করতে পারবেন না, তা আমি বুঝে নিয়েছি। জমিদারী গিয়েছে কিন্তু জমিদারীর রক্ত এখনও তাঁর দেহে। মা যতোই বলুক না কেন, শুধু মা কেন, আমি এখানে থাকলে দাদু চাচা ওরাও এ-বিয়েতে রাজি হয়ে কিছু করতে পারবে না।

কিন্তু মা। আমারই মায়ের মন এমন কেন? আমার জীবন তার কাছে কি কিছুই না। পুতুল আর মম-এর কথা মা ভাবছে, কিন্তু আমার কথা মা ভাবছে না কেন? মার জীবনের সুখ বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই কি আমার জন্ম হয়েছে।

আমার কেউ নেই। কেউ নেই আমার। না বাবা, না মা, না বোন—কেউ না। কার জন্যে তবে আমি বাঁচবো। কার জন্যে?

শুনেছি নিজের বিয়ের কথা শুনে মেয়েরা অবাক হয়ে যায়। আনন্দ আৰু পুলক, সাফল্য আর মাধুর্য বুকের ভেতরে সব অনুভূতি নাকি একসঙ্গে জেগে ওঠে। কিন্তু আমার যে শুধু ঘৃণা জাগছে। শুধুই ঘৃণা।

অথচ আমার জীবন তো আর সবার জীবনের মতোই হতে পারতো। কোনোদিন হয়তো কাউকে আমার ভালো লাগতো। আমার জন্যে সে হয়তো ভাবতো। সারাদিনের কাজ সেরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যেতো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুক ভরে উঠতো। ওকে আমি ভালোবাসতাম। তারপর একদিন সবাইকে জানিয়ে আমি ওর কাছে চলে যেতাম। কোনো উৎসব হতো না। কোনো আয়োজন থাকতো না। মনে থাকতো আয়োজন আর আনন্দে থাকতো উৎসবের সমারোহ।

হায়রে! মরণই তাহলে আমার একমাত্র গতি। অথচ আমার বেঁচে থাকতে কতো ইচ্ছে করে।

ঘুম আসে নি আমার চোখে। কাঁদবো যে মন ভরে, সে অবস্থাও ছিলো না মনের। আর কাঁদবোই বা কেন? দুঃখ কোথায় আমার। শুধু যে ঘৃণা। নিজেরই ওপর ঘৃণা। নিজের দুর্ভাগ্যের ওপর, নিজেরই সব ভালো লাগা মন্দ লাগার ওপর তীব্র ঘৃণা। ঘরের ভেতরটা তখন অসহ্য লাগছিলো। বাইরে বেরিয়ে এলাম। তখোন কৃষ্ণপক্ষের পাণ্ডুর চাঁদের জ্যোৎস্না ছেয়ে আছে সমস্তটা বাড়ি। বারান্দায় বসে বসে হাঁটুর ওপর দু’হাত জড়িয়ে তার ওপর মাথা রেখে চুপ করে বসে ছিলাম। চাঁপা গাছের পাতায় পাতায় কাটা ঝিরিঝিরি জ্যোৎস্নার রেখা আমার শরীরের ওপর পড়ছিলো। আমার ভাবনা ছিলো না, না দুঃখ, না কান্না, না ক্ষোভ, না ঘৃণা—কোনো অনুভূতি ছিলো না। শুধু একাকী আর শূন্য একটা নিঃসঙ্গতা নিয়ে বসে ছিলাম। কতক্ষণ যে, কে জানে।

এমন সময় মাথার ওপরে যেন কেউ হাত রাখলো।

চমকে উঠলাম। কিন্তু মাথা তুললাম না। ভাবতে চেষ্টা করলাম, কে এলো এ সময়ে। মা, না বাবা না রাহুল না, পাণ্ডুর জ্যোৎস্নায় পথ চিনে আনিস ভাই ফিরে এলো। অপেক্ষা করলাম, তার ডাক শোনবার জন্যে। কিন্তু অনেকক্ষণ কথা বললো না সে।

মঞ্জু মা, থেমে থেমে বাবার কণ্ঠস্বর ডাকল আমাকে।

যে নামে কোনোদিন আমাকে ডাকেন নি বাবা, সেই নামে আজ ডাকলেন। মাথা তুললাম আমি। দেখলাম, বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মহানুভূতি আর স্নেহ, করুণা আর বেদনা যেন শরীর ধরে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ঘুম আসছিলো না, তাই-

তুই সব কথা শুনেছিস, না? বাবা আমার কথা শেষ না হতেই জিজ্ঞেস করলেন। হ্যাঁ, মাথা নাড়লাম আমি।

সে জন্যে ভাবিস না, হঠাৎ বাবা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, আমি যতোক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ তোর সব দায়িত্ব আমার। তোর যা ভালো লাগবে না, তা আমি কক্ষনো হতে দেবো না।

আমি চুপ। আমার বলবার মতো কোনো কথা নেই। বাবাকে কেমন করে বলবো যে আমার জীবনের কষ্টের কথা ভাবছি না। ভাবছি আমার মা কেন আমার মা থাকল না। ভাবছি, আমার বেঁচে থেকে লাভ কী, কার জন্যে বাঁচবো আমি। কিন্তু কেমন করে সে কথা বারাকে বলি। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তখন। অনেকক্ষণ। তারপর আবার বললেন, তুই বরং এখান থেকে কিছুদিনের জন্যে চলে যা। থেকে আয় তোর দাদুর ওখানে। এসব কষ্ট থেকে কিছুদিনের জন্যে রেহাই পাবি।

কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ পাণ্ডুর হয়ে সরে গিয়েছে অনেক পশ্চিমে। আমার বলবার সব কথা ফুরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তবু বললাম, আমি ওসব কথা আর ভাববো না বাবা। আমার ভাগ্যে যা আছে, তাইতো হবে।

খানিক পর বাবা বললেন, যা শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে। বাবার কণ্ঠে অপরিসীম স্নেহ।

বাবার পাশাপাশি হেঁটে আমার ঘরের বারান্দায় এলাম। আমার পিঠের ওপর বিশাল স্নেহের আশ্রয়ের মতো বাবার হাত। ঘরে এসে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর আমার মনের কান্না হারিয়ে গেলো সেই মুহূর্তে। পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করলো।

ইচ্ছে করলেই তো আর সব পারা যায় না। ইচ্ছে আর মন যে আলাদা। শুয়ে পড়েও ঘুম এলো না আমার। এখনও ভাবনা। আর বিস্ময়। মানুষকে বাইরে থেকে কে চিনতে পারে। বাবা আমার বিয়ের দায়িত্ব নিতে হবে বলে আমাকে এ বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন—আমার এই ধারণা ছিলো। কিন্তু কতো ভুল ধারণা আমার। আর যদি সে ধারণা ভুল না-ও ছিলো, তবু সেই লোক কত বদলে গেছেন। যে কোনোদিন আমাকে নিজের করে নিতে পারবে না বলে আমার মনে হয়েছিলো—তারই কাছে আমি সব চাইতে আপন হয়েছি। আনিস ভাই আর ছোট আপা, আমি আর রাহুল। পুতুল আর মম, আমরা সবাই যেন সমান তাঁর কাছে। আর সেই মুহূর্তে মনে হলো, সব কিছুর গভীরে, অত্যন্ত নিগূঢ় গভীরে, আমরা সবাই যেন এক হয়ে রয়েছি, অন্ততঃ বাবার মনে।

বাবাকে ভুল বুঝেছে সবাই। আমি যেমন ভুল বুঝেছিলাম, তেমনি ভুল বুঝেছে ছোট আপা, তেমনি ভুল রাহুলের, হয়তো আনিস ভাইয়েরও। আমার সব চাইতে দুঃখ, মা বাবাকে চিনতে পারে নি। পারলে মা সুখী হতো।

সব চিন্তার শেষেও চিন্তা থাকে আমার। তাহলে বাবা এরপর কী করবেন? অন্ধকারের ভেতরে চোখ মেলে আমি নিজেকেই যেন প্রশ্ন করি। তবে কি বাবা ধ্বংস হয়ে যাবেন! না ব্যবসা ফেলে গ্রামে ফিরে চাষ-বাসে মন দেবেন। না কোথাও চাকরির চেষ্টা দেখবেন।

জীবিকাই যে জীবনের সব নয়, তা তো বাবাকে দেখেই আমি বুঝতে পারি। তবু বাবাকে কিছু করতে হবে। অন্ততঃ তাঁর মনের জন্যে হলেও। নইলে তাঁকে হারাবো আমরা। জমিদারের ছেলে ছিলেন। দু-হাতে টাকা খরচ করে ব্যবসায়ে নেমেছিলেন। আর ক্রমাগত ক্ষতিই হয়েছে তাঁর। কিন্তু কোথাও কোনোদিন দমেন নি। পেছনের দিকে পা রাখেন নি। একমাত্র ভরসা তাঁর ইন্সিওরেন্সের টাকাটা। যেটা কোম্পানীর কাছে ধার চেয়েছেন। যদি না পান, তাহলে কী যে হবে কে জানে। হে খোদা, বাবা যেন হেরে না যান। আমি প্রার্থনা করলাম মনে মনে। তারপর এক সময় আমি নিজের মনের ভেতরেও চুপ হয়ে যাই। সব নিঃশব্দতা যেন হঠাৎ হারিয়ে যায় একেবারে। আমার ঘুম পেতে থাকে। ওদিকে তখন পাণ্ডুর জ্যোৎস্না বাইরের উঠোন থেকে মিলিয়ে গিয়েছে।

.

বাবা ক’দিন বাইরে বাইরে ঘুরলেন। খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই। সকালে বেরিয়ে একেবারে সন্ধ্যার দিকে আসেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, বাবা গ্রামের সম্পত্তি বিক্রি করে দেবেন। সেজন্যে ঘোরাঘুরি করছেন। বাবার মামাতো ভাই আৰুরাম চাচা ক’দিন ধরে আসা যাওয়া করছে। আসেন বাবার খোঁজে। বাবা থাকেন না, মা’র সঙ্গে ঘরে বসে গল্প করেন। চল্লিশের মতো বয়স ভদ্রলোকের। শক্ত সমর্থ চেহারা। জাহাজে চাকরি করতেন। কি একটা মামলায় জড়িয়ে পড়ে চাকরি গিয়েছে। অংশীদার হিসেবে রাবার সঙ্গে ব্যবসা করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। বাবা রাজি হন নি। বলেছিলেন, আগে ব্যবসা বুঝতে শেখো, তারপরে ব্যবসায়ে নামবে।

বাবার এখনকার অসুবিধা দেখে আকরাম চাচা তাঁর নিজের আলাদা ব্যবসা খুলে ফেলতে চাইছেন। বাবাকে বলেছেন, বরং আপনি দোকানটা বিক্রি করে দিন। ঐ অবস্থাতেই কিনে নিই আমি। তারপর পাওনাদারদের দেখে নেবো। বাবা কোনো কথা বলেন নি। বাবা যে ওর কথার খুব বেশি গুরুত্ব দেন না, এটা আমি লক্ষ্য করেছি। ওর কথায় কান না দিয়ে বাবা সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টাই করতে লাগলেন।

এতো কাজ করতে হয় বাবাকে, কিন্তু মা’কে দেখলাম না বাবার জন্যে এতোটুকু চিন্তা করে। লোকটা এলো কি এলো না, তার খাওয়া হলো কি হলো না, সেদিকে যেন কোনো খেয়াল নেই। হয় সাকিনা খালার সঙ্গে গল্প করছে। নাহলে আকরাম চাচার সঙ্গে আলাপ করছে।

এদিকে বাবা বাসায় এসে গোসল সেরে খেয়ে নিয়ে, কোনো বিশ্রাম না করেই বেরিয়ে যান। আর এজন্যেই আমাকে সজাগ থাকতে হয়। বাবার গোসলের পানি তুলে রাখা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা। খাওয়ার পর হাতে মশলাটি পর্যন্ত দিতে হয়। এবং যদি সিমেট হাতে নিয়ে দেশলাইটা খুঁজে না পান, তাহলে দেশলাইটা পর্যন্ত হাতের কাছে এগিয়ে দিতে হয়।

বাবার বয়স হয়েছে, কিন্তু তিনি এই বয়সটাকে অগ্রাহ্য করতে চান। শুধুমাত্র মনের জোরে। নইলে এরকম বয়সে বাবার মতো লোকের পক্ষে অতো খাটুনি সম্ভব ছিলো না। মনের এই দৃঢ়তা আমি দেখতে পাই। কিন্তু তবু ব্যাপারটা তো দেহের। আর সেই দেহে বয়স ক্লান্তি ছড়িয়ে রাখে আজকাল। আমি বুঝতে পারি, কাজের পর বাবা একটু বিশ্রাম আর শান্তি চান। আর সে জন্যেই আমি বাবার কাছাকাছি না থেকে পারি না।

মাঝে মাঝে উনি আজকাল তাঁর নিজের কথা বলেন। খেতে খেতে অথবা কাজের পর বাসায় ফিরে ঈজিচেয়ারে এসে বসেন যখন, তখন। আমি বাবাকে বাতাস করি আর শুনি।

আর বুঝতে পারি, বাবার এখন আর কোনো পথ নেই। জমিজমা বিক্রি করায় অসুবিধা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অংশীদার বেরিয়েছে সম্পত্তির। বিক্রি করলে আবার মামলায় জড়িয়ে পড়তে হবে। যদি ইন্‌সিওরেন্সের টাকাটা ধার না পান, তাহলে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনো পথ নেই।

এই সময় বড় খোকা যদি কাছে থাকতো! বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সত্যি, আনিস ভাই যদি থাকত এ সময়ে, তাহলে বাবার কতো সাহায্য হতো। বাবা একা আর কত পারেন।

সব চাইতে আশ্চর্য লাগে মা’র কাণ্ড দেখে। এদিকে এতো ভয়ঙ্কর দাঁড়িয়ে গিয়েছে বাড়িটার অবস্থা কিন্তু মা’র যেন ভ্রূক্ষেপ নেই সেদিকে। দিব্যি গল্প জমিয়ে আগের মতো দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। আর রাতের অনেকক্ষণ পর্যন্ত বাবার ওপর রাগারাগি করছে।

ঘটনা আর ঘটনা। এত ঘটনা ঘটতে পারে আমাদের চারপাশে। আমাদের বাড়ির আর চারপাশে ঘটনার যেন শেষ নেই। ক’দিন আগে ছোট খালা মা’র কাছে তার মেয়ে মীনার সঙ্গে আনিস ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাব আনেন, ব্যাপারটা জানতাম না কেউ। আজই জানা গেলো। সকালে ছোট খালা এসে কেঁদে ফেললো মা’র কাছে। কী ব্যাপার। না কাল রাত থেকে মীনা বাড়িতে নেই।

মীনা মেয়েটা অমনই। বাইরে ও কথাবার্তা কম বলে। অন্ততঃ আমার তো তাই মনে হয়েছে। খুব চাপা মনে হয় ওকে। কিন্তু ওর শোবার ঘরময় শুধু সিনেমার মেয়েদের ছবি। ওর চুল বাঁধা, শাড়ি পরা, চোখে কাজল দেয়া, গালে মুখে রঙ মাখা সব সিনেমার মেয়েদের অনুকরণ করে। এক একদিন কি বিচ্ছিরি পোষাক পরে এ বাড়িতে এসেছে। আমার এমন অস্তস্তি লাগতো ওর দিকে তাকিয়ে। আমারও মাথা লজ্জায় নিচু হয়ে এসেছে। ও নিজে কিন্তু নির্বিকার। বলে গ্ল্যামারই নাকি মেয়েদের সব। ছেলেরা গ্ল্যামার ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি ওর কথা শুনে মনে মনে সালাম জানিয়েছি থাক বাপু তুই গ্ল্যামার নিয়ে দূরে। আমাদের ওসবে দরকার নেই।

মীনা একবার, সেই দু’বছর আগে যখন ও ক্লাস নাইনে পড়তো, তখন সিনেমা হলের দুই দারোয়ানের সঙ্গে পালিয়েছিলো। ইচ্ছে ছিলো নাকি সিনেমা করবে। ধরা পড়ে পরে ফিরে এসেছে।

সেই মীনার বাড়ি থেকে পালানোর খবর শুনে চমকে উঠলাম। ছোটখালা তখন বলছেন, ও রাক্ষুসী আমাকে না খেয়ে স্থির হবে না। ভেবেছিলাম, তোর কাছে দিয়ে যাবো, কিন্তু ও কি না……. পাশের বাড়ির বখাটে ছোঁড়া আফজালের সঙ্গে……..।

আমার খুব হাসি পাচ্ছিলো তখন। আনিস ভাইকে খুব চিনেছে ছোট খালা। ও যেন এই মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে একেবারে।

আরেক ঘটনা, ছোট আপা চিঠি লিখেছে বাড়িতে। ওর বিয়ে মাসখানেক পরই। বিয়ের পর ও বাড়িতে আসবে। ঢাকায় ও নার্সিং এর ট্রেনিং নিচ্ছে।

আর সব চাইতে বড় ঘটনা, ভারি মজার। আমারই স্কুলের বন্ধু রঞ্জু আর নাসিমা কলেজে ঢুকেই নতুন করে প্রেমে পড়েছে। স্কুলে পড়তে পড়তেই ওরা যে কতোবার করে প্রেমে পড়লো খোদাই জানে। ওদের অমন ছ্যাবলামো আমার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু তবু ওরাই তো আমার বন্ধু। ওদেরই সঙ্গে আমি দু’একটা কথা বলতে পারি মন খুলে। আমি জানি, ওদের সম্বন্ধে অনেকে অনেক রকমের কথা বলে। কিন্তু ওরাই আসে আমার কাছে। আর কেউ তো আসে নি কোনোদিন। আমি ইস্কুল থেকেই দেখে আসছি।

ইস্কুল জীবন আমার মোটে কয়েকটা মাস। কয়েকটা মাস, তবু একেবারে কম সময় নয়। কিন্তু দেখলাম, স্কুলে আমার সমান বয়সী মেয়েরা আমাকে এড়িয়ে চলেছে। দূর থেকে লক্ষ্য করে দেখেছি, ওরা কয়েকজন মিলে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে আমার সম্বন্ধে আলোচনা করছে। আমাকে নিয়ে কয়েকজন ক’দিন বেশ হাসাহাসি করলো। ওদের সবার সঙ্গেই আমার আলাপ হয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখেছি, ওরা আমাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে। যেন আমি মস্ত একটা পাপ করেছি। আমাদের পারিবারিক জটিল সম্পর্কটা যেন অস্বাভাবিক একটা কিছু। আর সেই অস্বাভাবিকতা আমি নিজে।

সেই থেকে আমাকেও এড়িয়ে চলতে হয়েছে ওদের। এবং একাকী থাকতে চেষ্টা করেছি। সেই সময় কাছে এসেছে নাসিমা আর রঞ্জু। আর উঁচু ক্লাশের মেয়ে তাজিনা আসতো কাছাকাছি। আমি ইস্কুল ছাড়লাম। ওদের কারুর সঙ্গে আমার আর দেখা হয় না। শুধু আসে নাসিমা আর রঞ্জু। প্রায়ই আসে ওরা, আর চারপাশের গল্প শোনায়। সব চাইতে আশ্চর্য লাগলো দেখে যে, সত্যি সত্যি ওরা ভালোবেসেছে। এতোকাল ওরা প্রেমের গল্প করতো। চিঠি দেখালেখি করতো ছেলেদের সঙ্গে কিন্তু তখন যেন দেখতাম ওরা ভারি মজা পেত। চিঠি লেখা লেখা খেলা, প্রেম প্রেম খেলা বেশ জমে উঠতো যখন, তখন একদিন হঠাৎ খেলার পাট সাঙ্গ করে অন্য কিছুতে ঝুঁকতো। সেই রঞ্জু, সেই নাসিমাকে যখন দেখলাম প্রেমে পড়তে, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না।

রঞ্জু এক অদ্ভূত মেয়ে। ওদের দু’জনের মধ্যে ও বেশি সুন্দরী, পাড়ার মেয়েদের মধ্যে সব চাইতে বেশি বুদ্ধি রাখ, সবচেয়ে ওর গুণ বেশি, কিন্তু ও নিজে একথা কোনোদিন স্বীকার করে না। নিজের সম্বন্ধে ওর ধারণা সাধারণ। নিজে জানে ও সাধারণ কিন্তু একটি মাত্র দুর্বলতা আছে ওর। ওর ধারণা, ছেলেরা ওর সঙ্গে পরিচিত হলেই প্রেমে পড়ে যায়। আমার একেক সময় এতো হাসি পায় ওর প্রেমিকের সংখ্যা গুণতে গুণতে যে, ওকে এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে পারি না। অদ্ভুত মানসিকতা মেয়েটার।

আর নাসিমা। এও এক আশ্চর্য মেয়ে। ছেলেদের দু’চোখে দেখতে পারে না। বলে, ও জাতটাই শয়তান, একবার প্রশ্রয় দিয়েছিস কি মরেছিস। সব সময় ছেলেদের ঘেন্না করে। ইস্কুলে পড়বার সময় ছেলেদের লোভ দেখিয়ে কায়দায় ফেলে পাড়ার ছেলেদের দিয়ে মার দেয়াতো। আবার কি মজা, সেই মার খাওয়া ছেলেকেই আবার ও মাসের পর মাস ধরে চিঠি লিখতো। সেই মেয়ে নাসিমা প্রেম করছে, আশ্চর্য নয়।

ওদের কি বিচিত্র সব কথা। কী যে লাভ অমন কথা বলে, ওরাই জানে। আমার কত বার বিরক্তি লেগেছে, নিষেধ করেছি ওসব কথা বলতে। কিন্তু, ওছাড়া ওদের আর কোনো কথা নেই। আমাকে শুনতেই হবে অগত্যা।

আজ রঞ্জু আহসানের কথা তুললো। বললো, এবার আর ছেলেমানুষী নয়। বিয়ে তো এক সময় করতেই হবে। তুই তোর আনিস ভাইকে জানাস কথাটা। ওর আব্বা আনিস ভাইকে খুব ভালোবাসেন। মাথা নেড়ে জানালাম, আচ্ছা বলে দেবো।

নাসিমা সারাক্ষণ চুপ করে ছিলো। কিছু যেন ভাবছিলো। রঞ্জু এক সময় আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, ওকে জীবনে না পেলে আমি সুখী হতে পারবো না মঞ্জু।

সেদিন রঞ্জু আর নাসিমার সঙ্গে আমাদের পুকুর ঘাটে বসে অনেক গল্প করলাম। প্রজাপতি উড়ছিলো ঝাঁকে ঝাঁকে। সামনের দিকে বুনো ফুলের ক’টা গাছ। অজস্র ফুল ছিলো সে গাছগুলোতে। রোদ্দুরে ঝকঝক করছিলো দুপুরটা। প্রকাণ্ড আকাশ আর হাল্কা মেঘের ছায়া।

ও গল্প বললো, যখন প্রথম দেখে ও আহসানকে, তখন নাকি ওর খুব বিরক্তি লেগেছিলো। ঠিক বিরক্তি নয়। ও শুধরে বললো, আমার মনের ভেতরে কেমন যেন ভয় ভয় করছিলো।

অথচ আসলে ভয়ের কিছুই ছিলো না। বড়লোকের ছেলে, খুব ভদ্র। কোনোদিন দেখি নি বা শুনি নি ও কাউকে খারাপ কথা বলেছে, বা খারাপ ব্যবহার করেছে। কিন্তু যখন ও কথা বলে, মনে হয়।, সমস্ত ঘরময় অনেক লোক একসঙ্গে একই কথা বলছে। আর যখন ও হাসে, মনে হয়, ঘরের দেয়াল পর্যন্ত কাঁপছে। সেদিন মনে হয়েছিলো ও একটা ফ্রুট।

আরও মজা কি জানিস? আমাদের বাসায় একদিনও আসে নি। আসতো নাসিমাদের বাসায়। পরে জানলাম, ওদের সঙ্গে নাকি নাসিমাদের কি একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। একদিন নাসিমার খোঁজ করতে গিয়েছি, ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ ঘরে পায়চারি করে যখন ও বললো, আমি যাই এখন। আমাকে বলতে হলো, একটু বসুন, নাসিমা এখুনি আসবে। আমি জানতাম, নাসিমার ওপর ওর একটু দুর্বলতা আছে।

আমাকে অবাক করে ও বিস্মিত হলো, নাসিমা আসবে? নাসিমার সঙ্গে তো দেখা হলোই। একটু থেমে আমার চোখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললো, নাসিমার জন্য অপেক্ষা করব কেন? তুমি ভুল করছ বোধ হয়।

আমি ভুল করছি। কথাটা ভাবালো আমাকে। কেন তবে ও রোজ বিকেলে নাসিমাদের বাড়িতে আসে। কেন ও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে।

জানলাম পরে। এ জানা কথা দিয়ে জানা নয়। দিনে দিনে মুহূর্তে মুহূর্তে একটু একটু করে জানা। মাঝে মাঝে বেশ কিছুদিন ধরে দেখা হয় না, তবু মনে হয়, ও যেন সব সময় আমারই আশেপাশে রয়েছে। শান্ত ঘরের মধ্যে এইমাত্র যেন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো। কিংবা হয়তো এক্ষুণি প্রচণ্ড হেসে শান্ত ঘরের চুপচাপ নিঃশব্দতাকে ভেঙে খান-খান করে দেওয়ালগুলোকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেবে। শুধু অপেক্ষা করে থাকা। অপেক্ষা করে থাকা সারা মন নিয়ে। ওর জন্য কেবলি প্রার্থনা করা। আমার যে চাইবার কিছুই নেই ওর কাছে। দেবারও নেই কিছু। শুধু যন্ত্রণা। তারপর খালি মনে মনে দেখতে ইচ্ছে করেছে আমার। একেক সময় মনে হতো, ও যদি রোজ আসতো আমার কাছে।

কিন্তু মজা দেখ, কাউকে জানাতে পারি না, আমার মনের এই অবস্থাটা। এমন কি ওকেও না। ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনোদিন আমার সব কথা বলতে পারবো কি না সে-ই এখন আমার সব চাইতে বড় ভয়। আমার বড় বাড় ছেড়েছিলো মঞ্জু। ভেবেছিলাম, শুধু আমিই একাকী মেয়ে, আর ছেলেরা সবাই আমার কাছাকাছি এসে ভিড় জমাবে। আমারই শুধু দাম আছে। আর কারুর নেই। এখন সেই আমারই ওর পায়ে লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।

আমি আবেগ আর ভালোবাসার ছবি দেখছিলাম ওর মুখে। মেয়েটাকে তখন আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছিলো। এত সুন্দর কোনোদিন দেখি নি। ভালোবাসার আলো মুখের ওপর তখন আভার মতো ফুটে উঠেছে।

নাসিমা একমনে শুনছিলো। ওরও কথা নেই। একটু বোধ হয় অন্যমনস্কও ছিলো। রঞ্জুর কথা শেষ হতে বললো, খালা আম্মার কাছে না হয় আমিই কথাটা তুলবো।

থাম তুই! আমি ধমকে উঠলাম, তোর নিজেরটা সামলা আগে তুই, তার পরে অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে যাস।

নাসিমা জামিলকে দেখেছিলো পথে। ঢাকা থেকে রংপুরে ফেরার পথে। দু’একদিন দেখা হয়েছে তারপর। জামিল নাসিমাদের প্রতিবেশী করিম সাহেবের আত্মীয়। একদিন রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে দু’জনে। রাস্তার মোড়ে ছাড়াছাড়ি হবার সময় দুঃসাহসী জামিল হঠাৎ প্রশ্ন করে, কাল দেখা হবে?

নাসিমা প্রথমটা জবাব দিতে পারে নি। তারপর জামিলকে ওর কথার জবাবের জন্যে অপেক্ষা করতে দেখে মৃদু কণ্ঠে বলেছে, হ্যাঁ হবে। কাল সকালে, খুব ভোরে।

জামিল তক্ষুণি চলে যায় নি। আবার প্রশ্ন করেছে, আমি যদি চলে যাই, ভাববে তুমি?

হ্যাঁ, এবাৱ অনেক জড়তা কাটিয়ে মুখোমুখি তাকিয়ে জবাব দিয়েছে নাসিমা।

কেন? পাল্টা প্রশ্ন করেছে জামিল।

জানি না। নাসিমার তখন লজ্জা করছিলো।

জানো না? প্রশ্নের পর প্রশ্ন এসেছে তারপর, গানের সুরের মতো।

না আমার লজ্জা করে নি তখন, নাসিমা জানায়। বলে, ইচ্ছে করছিলো, নিজেকে ওর হাতে তুলে দিই। ও যা ইচ্ছে করুক।

এই। ওকে বাধা দিলাম, নোংরামি করবি না।

বাহ্, আমার জীবনের ভালো লাগার কথা নোংরা লাগছে তোর কাছে?

লাগবে না, ওর হাতে নিজেকে তুলে দেয়ার আর কী মানে হয়?

আমার কী মনে হচ্ছিলো বলব না? আর…….

আর কী? কৌতূহলী হলো রঞ্জু।

আর নিজেকে তুলে দেয়ার যে কী আনন্দ, কী শান্তি …….

এই নাসিমা, ফের?

বেশ বলবো না। নাসিমা গম্ভীর হলো। এটা লোকে দোষের ব্যাপার মনে করে। কিন্তু আমি তো জানি, যারা এসব ব্যাপারে বড় বড় কথা বলে, তাদের শেষ অবস্থায় কী হয়। অল্প বয়সে রাণী দিদিমনি কতজনকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। শেষটা শেষ বয়সে আমাদের বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে জ্যোৎস্নারাতে কতো দিন দেখেছি রাণী দিদিমনিকে পর পর বি-এ ফেল করা আশরাফের ঘরে যেতে। আর রাজিয়া খানকে তো তোরা দেখিস নি, অমন বিকৃত হওয়ার চেয়ে মেয়েদের মরে যাওয়া ভালো।

আমরা অবাক। ভয়ঙ্কর অথচ কৌতূহলের একটা দরজা খুলে যাচ্ছে যেন আমাদের চোখের সামনে। বুঝছি, এসব শোনা উচিত নয় আমার। কিন্তু ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে তখন। না শুনে পারছি না।

রাজিয়া খান কলেজে চাকরি করতো ঢাকায়। থাকতো একটা হোষ্টেলে ছাত্রীদের সুপার হয়ে। সেখানে একটা মেয়েকে নিয়ে কি কেলেঙ্কারিটাই না করতো। এদিকে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের মেলামেশা একদম দেখতে পারতো না।

অথচ মজা দেখ, দিনের পর দিন দেখেছি ওর চেহারা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। আর মেজাজও হয়ে উঠেছে তিরিক্ষি।

আবার রাণী দিদিমনি কেমন সুন্দর হয়েছিলো দেখতে। কেমন মিষ্টি ব্যবহার হয়েছিল তাঁর। সেই জন্যেই তো! গল্প শুনিয়ে নাসিমা মন্তব্য করলো।

সে জন্য কী?

সেই জন্যেই তো আমি-

ও আর বলতে পারলো না। বুঝলাম কোনো সিদ্ধান্তের কথা বলতে চায়। ওর কথা শুনে নিঃশব্দে পাথরের মতো বসে রইলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে সেই কখন। রঞ্জু মুখ নিচু করে বসে থাকল। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কেন একথা বললো নাসিমা, কেন বললো? কেন?

আমি জানি না, কী আছে এই রক্ত মাংসের গভীরতর ভেতরে। কোন ধ্বনি, আর কোন সুর নিয়ত মোহিনী গান শোনায়। জানি না, কোন নিষ্ঠুর শত্রু রয়েছে আমারই ভেতরে যে আমাকে বার বার আনিসের কাছে ঠেলে দিতে চেয়েছে। যাকে আমি চিনতে পারি নি তখনও স্পষ্ট করে। ওকে শাসন করি এখন। কিন্তু জানি না, কখন আমাকে সে অস্বীকার করে বসবে। ওর আনন্দে যে আমি উল্লসিত হবো এমন কথা তো কেউ বলে নি আমাকে। শুধু যে কান্না। এই শরীর শুধু যে কাঁদিয়েছে আমাকে, তা তো ভুলতে পারি না কখনও। যতো যন্ত্রণা, সব তো এই শরীরটা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। এই বুক, এই কাঁধ, মসৃণ চামড়ায় ঢাকা সুগোল বাহুমূল। কেন আমাকে সব সময় সন্ত্রস্ত থাকতে হবে। আমার শরীরটা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লোভ আর লোভ। আমার চারপাশে শুধু ক্লেদাক্ত, পিচ্ছিল, রোমশ লোভ থিক্‌থিক্ করছে। সেই লোভ লালসার ওপারে আমি একেক সময় কোনো মানুষের মুখই দেখতে পাই না।

তবে কি আমি একাকী থাকবো চিরকাল! চিরকাল ধরে একাকী।

কিন্তু আমি যে বাঁচতে চাই। আমারো যে প্রাণ ভরে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আর ভালো না বাসলে বাঁচব কেমন করে।

সব কিছুর অন্তরায় হয়ে রইলো আমার এই শরীর। হায়রে। কবিগুরুর চিত্রাঙ্গদার অবস্থা হলো আমার। এই শরীরই আমার ভালোবাসার শুভ্র স্রোতকে ঠেকিয়ে রাখবে, আবিল করে ফেলবে। ভয় হয়, কোনোদিন হয়তো আমি ভালোবাসার সেই উজ্জ্বল স্রোতকে ছুঁতে পারবো না। রঞ্জুই কি পারবে। কিংবা নাসিমা?

নিজেকে প্রশ্ন করি আর বুঝতে পারি, আমারই মন বলছে, পারবে, পারবে, সবাই পারে ভালোবাসার স্রোতকে ছুঁয়ে যেতে। ওদের কাছে যে সহজ হয়ে রয়েছে সব কিছু। সহজ ভাবে গেলেই যেন পাওয়া যাবে সেই স্রোতকে। রঞ্জু সহজ হবে, সহজ হবে নাসিমা আর এক সময় ওরা ভালোবাসতে পারবে।

সত্যি, কি আশ্চর্য! কত ঘটনা চারপাশে কীভাবে ঘটে যাচ্ছে। আর দেখছি, সবকিছুর অন্তরাল দিয়ে অণুতে পরমাণুতে পরিবর্তন আসছে। ধীর, অস্ফুট ভাবে, তবু আসছে। জানি না, আমিও বদলে যাচ্ছি কি না।

এ বাড়িতে আসার পর কতদিন হয়ে গেলো। কতো বদলেছি আমি। নাসিমা রঞ্জুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো, চিনলাম মীনাকে, তাজিনাকে। নিজের চোখে দেখলাম সবার মন কী ভাবে বদলে যাচ্ছে এক এক করে। শুধু আমার। আমারই মনের ভেতরে যন্ত্রণা। শুধু যন্ত্রণা।

রঞ্জু আর নাসিমা সেদিন গল্প করে সেই যে গেলো আর এলো না কয়েকদিন। ওদের সময় কোথায়। নিজেরই মন নিয়ে ওরা যে মগ্ন হয়ে রয়েছে। ওদের কথা মনে পড়লে ভাবি, রঞ্জুকে ছাড়লে আহসান তার সব মূল্য হারাবে, জামিলকে ছাড়া নাসিমা জীবনে সুন্দর হয়ে ফুটে উঠতে পারবে না। ওদের আলাপ হওয়াটাই যেন খুব স্বাভাবিক। পরস্পরকে ভালোবাসাটা যেন অবশ্যম্ভাবী ছিলো ওদের জন্যে। এর চাইতে ভালো কিছু আর হতে পারতো না। কিন্তু সন্দেহ আর সংশয় থেকে কে আর কবে মুক্তি পেয়েছে? আমি কেবলই বলতে চেয়েছি, ওরা নিশ্চয়ই সুখী হবে। সারা জীবন ধরে ওরা বেঁচে থাকতে পারবে পরস্পরকে ভালোবেসে!

কিন্তু সেই সন্দেহ, সেই সংশয় তবু থেকেই যায়। আমার সব বাসনার অন্তরাল থেকে যেন গম্ভীর আর প্রবল একটা স্বর শুনতে পাই। মনে হয়, একটা শূন্যলোকের ওপরে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ধ্বনি বেজে উঠছে। ধূমায়িত শূন্যতার গভীর থেকে সেই ধ্বনির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই আমি। মনে হয়, কেবলই যেন কেউ না কেউ বলছে। বুঝতে পারি, এসব আমার আজে বাজে কল্পনা। আমার নৈরাশ্যের ভেতর থেকে জন্য নিয়েছে। আর সে জন্যেই শাসন করি নিজেকে। কেন আমার মনে এ ধরনের হতাশা আসে? তবে কি এখানেও রয়েছে আমার ভেতরকার সেই শত্রু। যে আমার বন্ধুর সুখ দেখে ঈর্ষায় জ্বলছে। আর সে-ই টেনে নামাচ্ছে অন্ধকার অতল গহবরে। না, আর ভাববো না এসব। হে বিধাতা, রঞ্জু যেন সুখী হয়, নাসিমা যেন সুখী হয়।

.

বাবা ধাক্কাটা সামলে উঠলেন। ইনসিওরেন্সের টাকাটা পাওয়া গেলো। বাবার সে কি আনন্দ সেদিন! যখন শুনলাম, আমার মন আনন্দে ভরে উঠলো। এখন ভাগ্যকে জিতে নেবার আনন্দ। বাবার শুকনো মুখে হাসি দেখলাম আর নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচলাম।

দোকান খুললো আবার আমাদের। কিন্তু তবু মনে হয় কী যেন চৌধুরী বাড়ির ভেতরে ভেঙ্গে গিয়েছে, তা আর জোড়া লাগবে না। বেনুদা আসছেই। আকরাম চাচা আসছেই। আকরাম চাচাকে দেখি আর আমার গা জ্বালা করে ওঠে। কেউ বলে না আমাকে। তবু বুঝতে পারি, লোকটা কী যেন ধ্বংস নিয়ে আসছে।

বাবা দোকান নিয়ে ব্যস্ত। আগের গতানুগতিকতায় আবার ফিরে গিয়েছি। কিন্তু তবু যেন সেই স্বাভাবিকতা ফিরে পাচ্ছে না কেউ। রাহুল কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় কিছু বলে না। আর আমি শুধু দেখছি। কখনও আনন্দে, কখনও ভয়ে, একাকার হয়ে যাচ্ছি।

এখন সবাই স্বস্তি পেয়েছি। বাবা আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছেন, এই যেন এক গভীর স্বস্তি আমার। কিন্তু তবু যেন বাবা কিছু একটা দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পাচ্ছি না আমিও। তবু যেন বুঝছি, কিছু একটা ঘটবে।

এই সন্দেহ আর সংশয় কখনও নিশ্চিন্ত হ’তে দেয় না আমাকে। তবু আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছি এজন্যে বিধাতার কাছে বারবার মাথা নিচু করেছি আমি।

ছোট আপার চিঠি পাওয়া গেল আজ। খুব দুঃখ করে চিঠি লিখেছে। আর সে চিঠি আমাকেই লেখা। অনেক কথার শেষে লিখেছে, মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই মঞ্জু। বাড়িতে আমি ফিরতে পারবো কি না জানি না। ফিরলেও কোন মুখে ফিরব। তবু হয়তো আমাকে ফিরেই যেতে হবে। রাহুল, মম, পুতুল ওদের জন্যে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায়। যদি এ মাসের মধ্যে ফিরতে না পারি তাহলে বুঝবি, তোর ছোট আপা মরে গেছে। আমি এখনও মন ঠিক করতে পারছি না, কী করবো। আমার এ চিঠির কথা কাউকে বলবি না। বললেও আমার দুঃখের কথা জানাস না। আমার এতো একাকী লাগে একেক সময়।

আরও অনেক কথা ছিলো কিন্তু সে সব গতানুগতিক মনে হয়েছে আমার কাছে। খুব সাধারণ আর গতানুগতিক। শুধু ওই ক’টি লাইন পড়েছি বারবার। আর ছোট আপার চশমার কাঁচ আর শান্ত মুখ বারবার মনের মধ্যে ভেসে উঠেছে। ছোট আপার জীবনের কান্না জমে রয়েছে লাইন ক’টির ভেতর। না, কাউকে বলি নি। এক বলতে পারতাম বাবাকে। বাবা ছাড়া ছোট আপার কথা আর কেউ বুঝবে না। কিন্তু বাবাকেই বা কেমন করে জানাবো। কতো দুশ্চিন্তার পর এই তো সেদিন একটু স্বস্তি পেয়েছেন। এখন এই চিঠি পড়লে আবার চিন্তা করতে আরম্ভ করবেন। না, এ চিঠি বাবাকে দেখাতে পারবো না।

রাহুলকে পড়তে দিতে ইচ্ছে করছিলো—

কিন্তু ছোট আপার নিষেধের কথা মনে করে তাও পারি না।

আমাকে পিকনিকে যেতে হয়েছিলো সেদিন। বেনুদা ক’দিন ধরেই মাকে বলছিলো, বাবাকে বলছিলো, বাবা রাজি হন নি। বলেছেন, তোমরা যাও, আমার অনেক কাজ। মা রাজি ছিলো আগের থেকেই, কথা ছিলো বেন্দাদের বাসার সবাই যাবে।

বেনুদা, ভাবী, মা, ঝুনু আর মুন্না–এরা সবাই যাবে। আর সেই সঙ্গে আমরা যদি যাই তাহলে ভালো হয়। কথা ছিলো বাড়ি সুদ্ধ যাওয়ার। বাবা গেলো না। রাহুল রাজি হলো না যেতে। আমারও ইচ্ছে ছিলো না যাই। কিন্তু রাহুল যখন গেল না তখন আমার না গিয়ে উপায় রইলো না। রাহুল আর আমি না গিয়ে বাড়িতে থাকলে মা কুৎসার অন্ত রাখবে না। মা’র মুখকে বড় ভয় করি আমি। হ্যাঁ, বড় ভয় আমার। রাহুলকে এক সময় ডেকে বললাম, তুই যা রাহুল। আমি তাহলে না গিয়ে বাঁচি।

রাহুল হাসলো আমার কথায়। বললো, আমি গেলেও কি তোকে ছেড়ে দেবে? তোকে নিয়ে যাবেই।

গেলাম। সারাদিন মীর নগরের প্রাচীন পুকুরের পাড়ে বসে থাকলাম। বেনুদা রেকর্ড বাজালো। সব প্রেমের গান। আমি সারা দুপুর কথা বললাম না কারো সঙ্গে। বলতে ইচ্ছে করছিলো না।

বেনু একবার কাছে এসে বললো, এসো একটু বেড়িয়ে আসা যাক আমবাগানের দিক থেকে।

মাথা নাড়লাম আমি, না, আমার ভালো লাগছে না। বরং আর কাউকে নিয়ে যান।

ঐ পর্যন্ত। বেনুদা নিষ্প্রভ হয়ে গেলো আমার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। তারপর সারাক্ষণ ওর নিরুদ্যম হতাশ চেহারা দেখলাম। কিছু বললো না আমাকে। বুঝলাম, ও খুব হতাশ হয়েছে। কিন্তু আমি কী করতে পারি তার জন্যে?

মা এসে ধমকে উঠলো। কেন, একটু নড়ে-চড়ে বেড়াতে পারিস না? ছেলেমানুষ ছেলেমানুষের মতো থাকবে। ছেলেমানুষের বুড়োমি দেখলে আমার গা জ্বালা করে।

তখনও আমি উঠলাম না। সন্ধ্যার পর সবাই ফিরে এলাম। বাড়িতে এসে মা ডেকে বললো, বেনুর সঙ্গে তুই কথা বলিস না কেন? তোর নিজের খালাতো ভাই, অতো স্নেহ করে তোকে, তবু কেন যে রেগে আছিস ওর ওপর বুঝতে পারি না। একটু মেলামেশা করা ভালো, নইলে লোকে কী মনে করবে?

মা’র এই কথা আমাকে সারাদিনকার এই হৈ-চৈ ব্যাপারটার একটি পরিষ্কার অর্থ বার করে দিয়েছে। আমি বেনুদার সঙ্গে মেলামেশা করি মার একান্ত ইচ্ছা।

কিন্তু আমি পারি না যে। মার যেটা ভালো লাগে, আমার যে সেটা ভালো লাগে না। যদি এ-বাড়ি ছেড়ে যেতে পারতাম। গতকাল চিঠি পেয়েছি চাচার, ক’দিন পরই আসছেন আমাকে নিয়ে যেতে। চাচা এলে বেঁচে যাই আমি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *