৯
বললাম, তোমার কপালের টিপটা ব্যাঁকা।
মেয়েটি বলল, যাঃ, মোটেইনা।
বলার সময় মেয়েটি হাসেনি। বরং যখন ‘যাঃ’ বলল, সেটা শোনাল ছোট্ট ধমকের মতো। আমি তখনও খরচোখে ওর ভ্রূসন্ধিতে তাকিয়ে আছি, সম্মোহনকারীর ভঙ্গিতে। চোখ না সরিয়েই মৃদুস্বরে টেনে-টেনে ঘরের অন্যান্য লোকেরা যাতে ঠিক শুনতে না-পায় এমনভাবে বললাম, আমি এ-পর্যন্ত যত সুন্দরী মেয়ে দেখেছি, সকলেরই কপালের টিপ ব্যাঁকা হয়। কখনোই ঠিক মাঝখানে বসেনা।
মেয়েটি মুখ নিচু করল। আমার এই স্তুতি একটু অপ্রত্যক্ষ বলে মুখ নিচু করতেই হয় এসময়ে। কোন উত্তর দেওয়া যায়না। আমি তখনও দ্বিধায় দুলছি। আর-একটু কী বলব? ঠিক আমার যা মনের কথা? কিন্তু বলার বিপদও আছে —এক-একসময় প্রতিফল এত খারাপ হয়! তবু আমিও মুখ নিচু করে বললাম, কেন ঠিক হয়না জানো? কেন? এবার মেয়েটি স্পষ্টই হাসল। উত্তর শোনার প্রতীক্ষায় যেরকম হাসতে হয়।
বললাম, কারণ, সুন্দরী মেয়েরা যখন আয়নার সামনে টিপ পরতে যায়, তখন তারা নিজের মুখ সবচেয়ে নিবিড়ভাবে দেখে। স্নো-পাউডার মাখা কিংবা চুল আঁচড়ানোর সময় আয়নায় দাঁড়ানোর সঙ্গে এর তুলনাই হয়না। অন্যসবসময়ই তারা আলগাভাবে দেখে, কিংবা দেখে সারা শরীর— অথবা ব্লাউজের হাতাটা কুঁচকে গেছে কিনা, কানের পাশে পাউডারের দাগ—এইসব। কিন্তু শুধু মুখখানা—সম্পূর্ণ মুখও নয়, দুই চোখ, নাকের সামান্য অংশ, ঈশ্বরের কবিতার খাতার মতো নির্মল কপাল (এইটা বলার সময় আমি টুক করে একটু হেসে নিলাম)—মুখের যেটুকু সবচেয়ে সুন্দর অংশ, মেয়েরা সেটা দেখতে পায়। দেখে অবাক হয়ে যায়, হাত কেঁপে যায়, ঠিক জায়গায় টিপ বসেনা। পৃথিবীর কোন সুন্দরী মেয়ের এপর্যন্ত বসেনি, আমি জানি। টিপ পরতে গিয়ে প্রত্যেক মেয়েই একবার করে নার্সিসাস হয়ে যায়। অবশ্য খুব গভীর দুঃখ পেলেও শুনেছি কোন-কোন মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এরকম নিবিড়ভাবে নিজেকে দেখে। কিন্তু তাদের কথা আমি ঠিক জানিনা।
এবার মেয়েটি কাচের গ্লাস ভাঙার মতন বেশ জোরে হেসে উঠল। বলল, ইস, বাকি সব সুন্দরীদের কথাই যেন জেনে বসে আছেন। খুব চালিয়াতি, না?
আমিও বেশ জোরে হাসলাম। আমার বিপদ কেটে গেল। মনের ভেতরটা খুব পরিষ্কার এবং ভালো লাগতে লাগল।
না, এইভাবে কোন গল্প শুরু করতে যাচ্ছিনা। এ-গল্পের এখানেই শেষ এবং কোন ক্রমশ নেই। আমি আমার একটি ছোট্ট বিপদমুক্তির ইতিহাস জানালাম। আমার জীবনটাই বিপদে ভরা, প্রত্যেক পায়েপায়ে আমাকে বিপদের হাত থেকে সাবধান হয়ে চলতে হয়। তার মধ্যে একটা বিপদ, কোন নারী বা বালিকার রূপের প্রশংসা করার পর তার মুখের কথা শুনে আমার কী অবস্থা হবে। আমি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি। এ-ভয় শারীরিক নয়। মেয়েটি আমাকে চপেটাঘাত করবে, না তার ব্যায়ামবীর দাদা এসে আমার হাত মুচড়ে দেবে, বা তার স্বামী বা হবু স্বামী এসে আমার সামনে রাগে নাকঝাড়ার আওয়াজ করবে, এরকম কোন আশঙ্কার কারণ আমার নেই! আমার স্তুতি নির্লোভ— আমার আশঙ্কা মেয়েটির উত্তর যদি আমার মনঃপূত না হয়। আসলে রূপের চেয়েও রূপসীর মুখের ভাষারই বোধহয় আমি বেশি ভক্ত। যাকে আগে সুন্দর মনে হয়েছিল, অনেকসময় তার মুখের উত্তর শুনে আমার তাকে কুৎসিত মনে হয়েছে।
অথচ, রূপ দেখলে প্রশংসা বা স্তুতি না-করেও পারিনা। প্রশংসার ভাষা এমন কিছু কঠিন নয়—আমি যদিও একটু কাঁচা—তবে অনেকেই খুব সুন্দর সুরুচি—সম্মতভাবে প্রশংসা করতে জানে। কিন্তু সবচেয়ে শক্ত প্রশংসার উত্তরে কী বলা হবে—সেই ভাষা। প্রশংসার উত্তরে চুপ করে থাকা উচিত নয়, সেটা দৃষ্টিকটু, তাহলে মনে হবে, অহংকারে কথাটা গ্রাহ্যই করা হয় না। আবার প্রশংসায় বিগলিত হয়ে পান্তুয়া-মুখে-পোরা গলায় উত্তর শুনলেও গা জ্বলে যায়।
আমি প্রায়ই ভাবি, কোন নবীন লেখককে যখন কোন প্রবীণ লেখক প্ৰশংসা করে, তখন নবীনটি কী করবে? চুপ করে বসেও থাকতে পারেনা, হেঁ-হেঁ ধরনের হাসতেও পারে না—তাহলে সেই সময়টি নিশ্চয়ই তার খুবই অস্বস্তি বা সংকটের সময়। অবশ্য আমার এ-ভাবনা নেই—কাজ তো খই ভাজার মতন, কারণ এরকম সৌভাগ্য আমার এ-পর্যন্ত হয়নি, অদূর-ভবিষ্যতে এমন সম্ভাবনাও নেই যে, আগে থেকে রিহার্সাল দিয়ে নেব।
তবে প্রশংসার সময় সবচেয়ে অরুচিকর জিনিশ, প্রশংসার উত্তরে প্রতিপ্রশংসা। আমি যদি কারুকে বলি আপনার অমুক ব্যাপারটা খুব সুন্দর তার উত্তরে যদি শুনি, আপনারও তো অমুকটা আ-হা-হা—তাহলেই আমার গা রি-রি করে। নেমন্তন্নবাড়িতে কোন একটা রান্নার প্রশংসা করলেই তার পাতায় সেই পদ আরও খানিকটা এনে ঢেলে দেওয়া হয়—এই নিয়মটি যেমন কুৎসিত। একমাত্র মেয়েরাই, অধিকাংশ মেয়েরাই ন্যায্যভাবে প্রশংসা গ্রহণ করতে জানে। কারণ, মেয়েদের ক্ষেত্রে ঐ প্রতিপ্রশংসা করার ব্যাপার নেই। একটি পুরুষ যদি একটি নারীর রূপের প্রশংসা করে উন্মুক্ত গলায় তার উত্তরে কোন নারীই পুরুষের রূপের প্রশংসা করবেনা। কারণ মেয়েরা জানে রূপের প্রশংসা তাদের সবসময়ই প্রাপ্য, তাদের দাবি—কিন্তু প্রশংসা পাবার জন্য কোন পুরুষকে অনেক যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তাছাড়া মেয়েদের প্রশংসা হয় নিন্দাচ্ছলে—অর্থাৎ ব্যাজস্তুতি। অন্নপূর্ণা যেমন তাঁর স্বামী সম্পর্কে বলেছিলেন, কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন। এখনও সব মেয়েরাই এরকম ভাষা ব্যবহার করে। কোন মেয়ে যদি কোন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে দাড়ি না-কামানোই বুঝি স্টাইল হয়েছে আজকাল? কী বিশ্রী খোঁচা-খোঁচা দাড়ি—ঠিক কয়েদীর মতো চেহারা হয়েছে।—তাহলেই বুঝতে হবে মেয়েটি আসলে ছেলেটির মুখের প্রশংসা করছে। ব্যাজস্তুতি ছেলেরা সহ্য করেও বোঝে, মেয়েরা সহ্যই করতে পারেনা। আবার সোজাসুজি স্তুতিতে ছেলেরা একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়, নাকচোখ পর্যন্ত গোল হয়ে সারা মুখ গোল হয়ে যায়, কোন কথাই বলতে পারেনা। কিন্তু মেয়েরা গ্রহণ করতে পারে, রূপের এশংসা শুনে মেয়েরা আরও রূপসী হয়ে ওঠে সেইমুহূর্তে।
মনে করা যাক, একটি সাহেবী কায়দার নেমন্তন্ন বাড়িতে এক মহিলার সঙ্গে আমার দেখা হল। তিনি একটি কোঁকড়ানো ফুলকাটা জামা পরেছেন। মহিলার কপালের দুপাশে চূর্ণ চুল জংলী ফুলের মতো স্তবক বেঁধে আছে। ঘুরতে-ঘুরতে তাঁর সামনে এসে আমি দাঁড়ালাম হয়তো। আমি অনেককথা বলতে পারতাম, কেমন আছেন, অমুকের সঙ্গে কি দেখা হয়, অমুক ফিল্ম দেখেছেন কিনা, অমুক লেখকের লেখা—ইত্যাদি অনেক বাজে কথা। কিন্তু যে কথাটা আমার প্রথমেই মনে এল, এক মিনিট দ্বিধা করে আমি সেই কথাই বললাম, আপনার জামার সঙ্গে আপনার সুন্দর চুল—অথবা আপনার সুন্দর চুলের সঙ্গে আপনার জামা—চমৎকার মানিয়েছে। মনে হচ্ছে, ভিড়ের মধ্যেও আপনি আলাদা। মহিলা মুখ টিপে হেসে বললেন, আপনাকে কি আমি ধন্যবাদ দেব?
আমি আঁতকে উঠলাম। মেয়েদের মুখ থেকে ধন্যবাদ শুনলে আমার মনে হয়, কেউ যেন আমার শরীরে গরম লোহার শিক্ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর এই সাহেবী কায়দার নেমন্তন্নে ধন্যবাদের তো ছড়াছড়ি।
মহিলা বললেন, এসব জায়গায় ধন্যবাদ দেওয়াই রেওয়াজ। কিন্তু আপনাকে আমি কিন্তু ধন্যবাদ জানাবনা।
এই বলে তিনি মুখের চাপা হাসিটুকুই রেখে দিলেন কিছুক্ষণ। আমার বিপদ কেটে গেল।
আমার নিতান্ত ভাগ্যদোষে এবং ঘটনাপরম্পরায় প্রায়ই কিছু কিছু সাহেব—মেমের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। সাহেব-মেমদের সঙ্গে কথাবার্তায় কমা ফুলস্টপের মতো প্রায়ই ‘ধন্যবাদ’ বসিয়ে যেতে হয়, আমি সবসময় সজাগ থাকি। কিন্তু পারতপক্ষে আমি মেমসাহেবদের এড়িয়ে যাই, কথাবার্তা বিশেষ বলিনা। যদি-বা কখনো পাকে-চক্রে কথা বলতেই হয়, কিছুতেই কোন মেমের রূপের প্রশংসা করিনা কখনো। কারণ জানি রূপের প্রশংসা শুনলে কোন মেমের মুখে লজ্জার আভা আসবেনা, অর্ধস্ফুট হাসি দেখা দেবে না, মুখের একটি রেখাও না—কাঁপিয়ে তিনি বলবেন, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। তারপরই আবার অন্যকথা। আমার কাছে এ-জিনিশ ভয়ংকর। সুতরাং মেমসাহেবদের রূপের প্রশংসা আমার মুখ দিয়ে বেরয়না। আর সত্যিকারের রূপসী মেমসাহেবদের মধ্যে ক’জন আছে কে জানে -আমার তো একটিও চোখে পড়েনি। এ-কথাটাও আমি সুযোগ পেলেই কোন রাঙালি মেয়েকে জানিয়ে দিই!