নীললোহিতের অন্তরঙ্গ – ৫

দুপুরবেলা অনিমেষের অফিসে দেখা করতে গিয়েছিলাম। খানিকটা পরে মনে হল, না-এলেই ভালো হতো।

অনিমেষ একটা ছোটো অফিসে চাকরি করে। এক মারোয়াড়ি কম্পানির আমদানী-রপ্তানীর শাখা অফিস। স্ট্র্যান্ড রোডে তিন-চারখানা ঘর নিয়ে অফিস, দশ-বারোজন কর্মচারী, একজন মারোয়াড়ি বড়োবাবু, অনিমেষের কাজ ইংরেজিতে চিঠিপত্র লেখা। ধুতি ও হাফশার্ট, শীত, গ্রীষ্ম বারোমাস অনিমেষের পায় কেড্‌স জুতো—কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ, শান্ত লাজুক প্রকৃতির। ভেবেছিলাম অনিমেষের অফিসটা নিরিবিলি হবে—এই শীতের মনোরম দুপুরে কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে। আমি দুপুরবেলা একাকীত্ব একেবারে সইতে পারিনা। আর অনিমেষও, ভিড়ের মধ্যে বা অনেক বন্ধুর মধ্যে একেবারেই কথা বলতে পারেনা—কিন্তু একা-একা দেখা হলে অনেক কথা বলে।

ও আমাকে দেখে উদ্ভাসিত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আয় একটু বোস —আমি ততক্ষণে হাতের কাজটা সেরে নিই। তারপর—। চা খাবি তো?

চা আনতে পাঠিয়ে অনিমেষ কী একটা চিঠি শেষ করতে লাগল। মাস দু-এক ওকে দেখিনি, আজ লক্ষ করলাম, ওর মুখ চোখ যেন কিছুটা শুকিয়ে গেছে। ক্রমশই শুকিয়ে যাচ্ছে—গত সাত-আটবছর ধরে দেখছি। আমারই সমান বয়েস —তবু ওর মুখের চেহারা আমার চেয়ে অনেক রুক্ষ, রেখাময় — সারা মুখের মধ্যে নাকটাই এখন বেশি প্রকট।

অনিমেষ নিজের জীবনে একজন খাঁটি ব্যর্থ মানুষ। আমি আমার নিজের ব্যর্থতার কথা জানিনা, ক্বচিৎ দৈবাৎ যদি নিজের দিকে তাকিয়ে আমি বুকের মধ্যে একটা পরিত্যক্ত পুকুরের ঘাট দেখতে পাই—সেই ভয়ে আমি একা থাকতে পারিনা —ছুটে-ছুটে যাই অন্য মানুষের দিকে—আমি তাদের ব্যর্থতা দেখার চেষ্টা করি। আমি অনিমেষের অনেকগুলি ব্যর্থতার কথা জানি।

ছেলেবেলায় অনিমেষ ছিল আমাদের মধ্যে পড়াশুনোয় সবচেয়ে ধারালো ছেলে, ইংরেজি পরীক্ষায় প্রতিবার ফার্স্ট হতো। আমরা ভাবতাম, অনিমেষ একসময়ে নামকরা ইংরেজির অধ্যাপক হবে। কিন্তু, কী কারণে যেন বি. এ. পরীক্ষায় ইংরেজি অনার্সে ফেল করে গেল অনিমেষ, আর ওর পড়াশুনো করাই হলনা। মানিকতলার দিকে বেশ চমৎকার তিনতলা বাড়ি ছিল ওদের, ওর বাবা মারা যাবার কয়েকদিন পরই জানাতে পারলাম, সে-বাড়ি নাকি অনেকদিন আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। অনিমেষরা এখন আছে বরানগরের এক নড়বড়ে ভাঙা বাড়িতে। সংসারে ছোটো ভাই-বোন, মা-ও বিধবা পিসি—সকলেই পাখির ছানার মতো হাঁ করে আছে, অনিমেষ সারামাস খেটে ওদের মুখে খাবার এনে দেবে। অনিমেষ রত্না নামে একটা মেয়েকে ভালোবাসত কলেজজীবনে। তখন আমরা ভাবতাম, এ অত্যন্ত বিসদৃশ জোড়-অনিমেষের মতো বুদ্ধিমান ছেলের পাশে ওরকম একটা বোকা অহংকারী মেয়েকে মানায়না। রত্নার ধারণা ছিল সে সুন্দরী, কিন্তু আসলে একটা পুষি বেড়ালের মতো চেহারা। দেখা হলেই গড়গড় করে যত কথা বলত তার একটি কথাও না-শুনলে—পৃথিবীর কিছুই যায় আসেনা। অথচ অনিমেষ ছিল রত্নারই জন্য গোপন উন্মাদ। কোনদিন রত্নাকে কিছু বলতে ভরসা পায়নি, যেদিন মুখ ফুটে বলল, সেইদিনই প্রত্যাখ্যান–তখনও অনিমেষ বাবা ও তিনতলা বাড়ি হারায়নি। রত্না ওরই সমান আর-একটি বোকা—পরাশরকে বিয়ে করেছে। এবং ওরাই জীবনে সাকসেসফুল। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরে চাকরি নিয়ে রত্না আর পরাশর এখন আছে সুইটসারল্যাণ্ডে! অনিমেষ আর কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।

কিন্তু এ সবই তো বাইরের ব্যর্থতা। অনিমেষ তার চেয়েও বেশি হেরে গেছে। অনিমেষের চেহারায় কোন খুঁত ছিলনা—দীর্ঘ চেহারায় সুপুরুষই বলা যায়, কিন্তু ক্রমশ ও ভিড়ের যে-কোন লোক হয়ে গেল। কোনদিন ও রুখে দাঁড়ালনা। পৃথিবীতে ও একটি দাবিও আদায় করে নিতে চেষ্টা করলনা। কোন গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে পথ দিয়ে যাবার সময় আমি যদি দূরে অনিমেষকে দেখি, আমিও হয়তো ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করব। ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকেই হয়তো অনিমেষ একদিন অগোচরে অদৃশ্য হয়ে যেতে চায়

অনিমেষ বলল, আর-একটু বোস, হয়ে গেছে, আমি চিঠিটা টাইপে দিয়ে আসি। ওর জামার হাতা ঢল-ঢল করছে, মনে পড়ল, একসময় সৌখিন অনিমেষ সোনার বোতাম ব্যবহার করত।… ওর অফিসঘরটা ছোটো, আরও দুটো চেয়ার আছে—একটি চেয়ারে কোট রাখা, অন্যটি খালি। যাক, কিছুক্ষণ নিরিবিলিতে গল্প করা যাবে।

ফিরে এসে ও বলল, টাইপিস্ট আসেনি আজ। চিঠিটা জরুরি ছিল—তা আর কী করব!

জিজ্ঞেস করলাম, তোর বাড়ির সব কেমন আছে।

ও স্মিত হেসে বলল, ভালোই।

বুঝতে পারলাম, এই যে ভালো কথাটির সঙ্গে একটা ‘ই’ যোগ করে দেওয়া এবং স্মিত হাসি-এর পিছনে অন্তত আছে মায়ের বাতের ব্যথা, ছোটো বোনটার জ্বর, পিসিমার চোখ অপারেশন করাতে হবে—ইত্যাদি। এগুলিরই সংক্ষিপ্ত রূপ, ভালোই! আমি জানি অনিমেষ যখন মরে যাবে তখন মরার ঠিক আগের মুহূর্তে যদি ওকে জিজ্ঞেস করা হয়, কেমন আছিস, ওর যদি উত্তর দেবার ক্ষমতা থাকে তখন, তবে অনিমেষ নিশ্চিত তখনও বলবে স্মিত হাসি হেসে, এই একটু মরে যাচ্ছি আর কী!

গেছে।

—আবেশ, উত্তেজনা অনিমেষের জীবন থেকে একেবারে অন্তর্হিত হয়ে

সুতরাং কী কথা শুরু করব? আমি তাই আলগাভাবে বললাম, তোদের অফিস থেকে গঙ্গা দেখা যায় দেখছি!

–হ্যাঁ, মাঝে-মাঝে জাহাজের বাঁশিও শোনা যায়। এ-বাড়ির ছাদে উঠলে দেখা যায় অনেকদূর পর্যন্ত। শীতকালের রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে গঙ্গা দেখতে ভালো লাগে।

—চল-না, ছাদেই যাই। নাকি, অসুবিধে হবে তোর অফিসে?

—নাঃ অসুবিধে কী! চল—

এইসময়ে ঘরে একটি লোক ঢুকল। বলে দিতে হয়না, এই লোকটিই এ-অফিসের মারোয়াড়ি বড়োবাবু। সার্জের সুট, হাতে সোনার ব্যান্ডের ঘড়ি। কিন্তু বিশাল ভুঁড়ি ও মুখে পানের দাগ—দর্পিত পদশব্দ—বড়োবাবুর এই চিহ্নগুলিও আছে। লোকটির বাংলা জ্ঞান নিখুঁত। আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অনিমেষকে জিজ্ঞেস করল, চ্যাটরজি নন ফেরাস মেটালের সেই চিঠিটা হয়েছে?

অনিমেষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ।

—এখুনি পাঠিয়ে দাও!

—সেটা তো গতকালই পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনি সই করে দিলেন—

—আমাকে এজেন্টরা ফোন করেছিল—আমি বলতে পারলামনা, আমার প্যাডে লিখে দিয়ে আসবে তো!

-আপনিই সই করলেন কিনা—

–আমার মাথায় বৃহৎ কাম ঘোরে। একটা চিঠির কথা মাথায় ভরে রাখলে চলেনা। প্যাড আছে কী জন্যে? ডেপুটি কন্ট্রোলারের চিঠিটাও হয়ে গেছে কাল?

-না, ওটা আজ লিখেছি। কিন্তু টাইপিস্ট আসেনি।

এবার কি কারবারটা ডকে তুলব? কেন আসেনি কেন?

—আপনার কাছ থেকেই ছুটি নিয়েছে শুনলাম—

-টাইপিস্ট ছুটি নিয়েছে বলে চিঠি যাবেনা? ডেপুটি কন্ট্রোলার সে-কথা বুঝবে?

—হাতে লিখে পাঠাব?

—আমাদের কারবারের কি প্রেস্টিজ নেই যে হাতে লিখে চিঠি যাবে? চিঠঠিটা আজই যাওয়া দরকার।

—আমি তো টাইপ জানিনা।

—টাইপ আবার জানা আর না-জানা কী! একটু সময় বেশি লাগবে। বাজে গপ্পোসপ্প না-করে চিঠিটা টাইপ করে ফেলুন। যদি দেরি হয়ে যায়, ওভারটাইম নিয়ে লেবেন! যান!

লোকটা আবার পায়ের শব্দ করে চলে গেল। লোকটার অসম্ভব রূঢ়তায় এবং অভদ্রতায় আমি খুবই রেগে উঠেছিলাম—কিন্তু দুনিয়ার এত মানুষের বিরুদ্ধে রেগে ওঠার আছে যে বন্ধুর অফিসের বড়োবাবুর বিরুদ্ধে আর রাগ দেখিয়ে লাভ কী—এই ভেবে চুপ করে বসেছিলাম। ঐরকম বাক্যালাপের পরই আমি চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি-অনিমেষ এসব সহ্য করেও এখানে হাসিমুখে চাকরি করবে —কিন্তু আমার এসব সহ্য করার দরকারটা কী! কিন্তু অনিমেষ আমার হাতটা চেপে ধরে বলল, আর-একটু বোস।

নিজেই পাশের ঘর থেকে টাইপরাইটারটা নিয়ে এল ঘাড়ে করে। সেটাতে কাগজ পরিয়ে টকাটক্ শুরু করল। আমি এই দুপুরবেলা টকাটক্ শোনার জন্য আসিনি। একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, তুই কাজ কর, আমি চলি রে!

–বোস, আর-এককাপ চা খেয়ে যা।

আমার সত্যিই অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। অনিমেষদের অফিসে হয়তো এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আমার সামনেই অপমানিত হয়ে অনিমেষ নিশ্চয়ই বেশি লজ্জিত হয়েছে। এখানে আমার না-আসাই উচিত ছিল। অনিমেষের মুখ কিন্তু আগের মতোই প্রশান্ত, নির্বিকার। থাকতে না-পেরে বললাম, তুই জীবনে আর কত সহ্য করবি? মানুষের কাছে এত ছোটো হতে-হতে তোর আর মনুষ্যত্ব কী থাকবে?

—কার কাছে ছোটো হলাম? ঐ বাজোরিয়ার কাছে? ওর কাছে আর অপমান হবার কী আছে? ও তো আর বেঁচেই নেই!

—কী বলছিস….

অনিমেষ টাইপরাইটার থেকে মুখ তুলে সেইরকম স্মিত হেসে বলল, সত্যি ও-লোকটা আমার সামনে আর বেঁচে নেই। অনেকদিন আগেই আমি ওর মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। তারপর আমিই ফাঁসি দিয়েছি ওর। ওর চরম নির্বুদ্ধিতা এবং বুনো শুয়োরের মতো গোঁয়ার্তুমি দেখে আমি ঠিক করেছিলাম, ওর আর বাঁচার অধিকার নেই। অনেকদিন আগে, ও যখন আরও বাচালের মতো কথা বলছিল—আমি এই চেয়ারেই বসে থেকে বিচারকের আসনে বসেছিলাম, ওর ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলাম শান্তভাবে। তারপর, নিজেই উঠে এসে—আমিই তখন জল্লাদ সেজে ওর গলায় দড়ি পরিয়ে ওকে ঝুলিয়ে দিয়েছি। ও তখনও কথা বলে যাচ্ছিল-কিন্তু জানলনা, সেই মুহূর্তে ওর ফাঁসি হয়ে গেল। তারপর থেকে ওর কোন কথাই আমার গায় · লাগেনা। ও তো একটা মড়া—ওর আবার কথার মূল্য কী!

আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে ও আবার বলল, তোর অবাক লাগছে? শাস্ত্রে আছে, অতি মূর্খ এবং স্মৃতিভ্রষ্ট মৃতের সমান। দেখছিস-না—আমি ওকে মেরে ফেলেছি বলে যে-চিঠি ও নিজে সই করেছে—তার কথাও ওর মনে থাকেনা! টাইপিস্টকে ছুটি দিয়ে নিজেই ভুলে গেছে—একি জীবিত মানুষের লক্ষণ? ওর কথায় আবার রাগ করব কী?

–কিন্তু, তুই ওর কথা অমান্য করতেও পারিসনা।

–কারণ, ওর কাছ থেকে আমি অর্থ পাই। অর্থ মৃতের হাত দিয়ে আসুক আর জীবিতের হাত দিয়ে আসুক—তার মূল্য একই। তার সঙ্গে মানসম্মানের প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন সেখানে—যদি আমি ওকে ভয় করতাম। কিন্তু আমি ওকে ভয় করিনা—কারণ, আমি ওকে চরম শাস্তি দিয়েছি!

-তুই এইভাবে সব মানুষকে দেখিস্!

—হ্যাঁ। সেদিন ট্রামে একটা পুলিশ ভারী জুতো দিয়ে আমার পা মাড়িয়ে দিল। আমি ভেবেছিলাম, সে দুঃখিত বা লজ্জিত হবে! পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিলাম। কিছুই হলনা—ভ্রূক্ষেপও করল না। তখন আমি ওর একটা পা কেটে ফেলার হুকুম দিলাম। তারপর নিজের করাত দিয়ে পুচিয়ে-পুচিয়ে সেই ট্রামের মধ্যেই ওর একটা পা কেটে বাদ দিলাম। ও জানেনা। এখনও ওকে দেখি মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে সদর্পে, কিন্তু ও জানেনা—আমার কাছে ওর একটা পা চিরকালের মতো খোঁড়া—কোনদিন আর আমাকে আঘাত করতে পারবেনা। কলেজে পড়ার সময় রত্না আমাকে অন্যায়ভাবে অপমান করেছিল। আমি ওকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছি। কী কঠিন সেই দণ্ড।…এই তো সেদিন, আমার বাড়িওয়ালা বিষম পাজী ছিল—কোন কথায় কান দিতনা। আমি তার কানদুটো কেটে নিয়েছি। লোকটা জানেনা—এখনও মনের সুখে কাগজ পাকিয়ে কান চুলকোয়, কিন্তু জানেনা, আি ওর কানদুটোই কেটে নিয়েছি—সেখানে দুটো রক্তাক্ত গর্ত আমি স্পষ্ট দেখে পাই।….

আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, অনিমেষের এসব পাগলামির লক্ষণ কিনা। টাইপ মেসিনের ওপাশে—ময়লা হাফশার্ট গায় অনিমেষ একবার জোব্বা-পরচুল পরে কঠিন বিচারক হয়ে যাচ্ছে—আবার সে পরমুহূর্তে কালো কাপড় পরে খড়গ হাতে নিয়ে হয়ে যাচ্ছে নৃশংস জল্লাদ। কে জানে এসব পাগলামি কিনা—কিন্তু এই খেলা নিয়ে অনিমেষ সুখেই আছে মনে হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *