নীললোহিতের অন্তরঙ্গ – ১৭

১৭

কীরকমভাবে তালা খুলতে হয়? তালা খোলার মাত্র দুরকম স্বাভাবিক উপায় আছে। বন্ধ তালার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে নির্দিষ্ট চাবি বার করে টুক করে খুলে ফেলা। অথবা যদি চাবি হারিয়ে যায়, তবে ছোটো তালা হলে, ডানহাতের মুঠোয় তালাটাকে চেপে ধরে—কব্জিতে সমস্ত জোর এনে কট্ করে ভেঙে ফেলা উচিত। আর, তালাটা যদি বেশ বড়ো হয়, একটা লোহার রড ‘তালাটার মধ্যে ঢুকিয়ে মটাং করে ভেঙে ফেলা যায়। তালা খোলার এই দুই রীতি।

কিন্তু অনেক মানুষ দেখেছি যারা এরকম সহজ পথে যেতে চায়না। ঘন-ঘন তালার চাবি হারিয়ে ফেলে বড় বেশি ব্যস্ত আর উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তালাটাকে ভাঙার কথা মনেও পড়েনা। আশেপাশের বাড়ির সকলের কাছ থেকে চাবির থোকা নিয়ে আসে। হয়তো, জড়ো হল পঞ্চাশটা চাবি, প্রত্যেকটা পরের চাবি এক-এক করে চেষ্টা করা হচ্ছে নিজের তালায়। এতে কখনো তালা খোলে, আমার বিশ্বাস হয়না। তবে শুনেছি, কারুর-কারুর ক্ষেত্রে খুলে যায়। কেউ-কেউ আরও উৎকট কাণ্ড শুরু করে দেয়। তালার ছোটো গর্তের মধ্যে একটা ছোটো পেরেক কিংবা লোহার তার ঢুকিয়ে খুব কায়দায় নাড়াচাড়া শুরু করে। এতেও নাকি তালা খোলা সম্ভব।

ছেলেবেলা বিশ্বনাথ নামে একটি ছেলের কথা শুনতাম যে নাকি চাবি হারানো তালায় পেরেক ঢুকিয়ে অনায়াসে খুলতে পারত। সে ছিল পরোপকারী ছেলে, কারুর বাড়িতে এরকম তালাসংকট হলে ডাক পড়ত বিশ্বনাথের।

একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সত্যিই তুমি পেরেক ঢুকিয়ে তালা খুলতে পার?

—হুঁ! লাজুক হেসে বিশ্বনাথ বলেছিল।

-যে-কোন তালা?

—হুঁ।

তখন আমি ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করি, সে-তালাগুলো পরে আবার লাগানো যায়? ঠিক-ঠাক থাকে?

—নাঃ! তা আর যায় না। খারাপ হয়ে যায়।

— আশ্চর্য! যদি খারাপই হয়ে যায় তবে তুমি অত কষ্ট করে খুলতে যাও কেন? ভেঙে ফেললেই তো হয়। সেটাই তো সোজা!

—কী করব, সবাই যে খোলাতেই চায়। কেউ ভাঙতে চায় না। দেখবেন, সকলের বাড়িতে দু-চারটে তালা থাকে—যেগুলো দেখতে ঠিকই আছে, কিন্তু ভেতরের কলকব্জা খারাপ! তাছাড়া, আমারও প্রত্যেকবারই মনে হয়, এবার বোধহয় না-খারাপ করেই খুলতে পারব।

এ-জীবনে কার না দু-একবার তালার চাবি হারিয়েছে? চাবির মতো সামান্য জিনিশ কখনো-কখনো হারাতে বাধ্য। চেনাশুনোদের মধ্যে, যারা ব্রাহ্মণ—তাদের দেখেছি, পৈতের সঙ্গে চাবি বেঁধে রাখে সযত্নে। তাদেরও চাবি হারায়। অতিসাবধানীদের বারবার হারায়।

আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে, যখন কোন নতুন নারীপুরুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, মনে-মনে আমি যখন তাদের চরিত্র ও স্বভাবের পরিমাপ করি, তখন প্রথমেই ভাবি, এঁর যদি কখনো চাবি হারিয়ে যায়, কী উপায়ে খোলার চেষ্টা করবেন? ভেঙে ফেলা, পাশের বাড়ি থেকে চাবির থোকা চেয়ে আনা, না বিশ্বনাথের মতো কারুকে ডেকে পেরেক নাড়াচাড়ার কৌশল—জানতে আমার খুবই ইচ্ছে হয়। অথচ, মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারিনা। প্রথম পরিচয়ে অনেককিছু জিজ্ঞেস করা যায়—কোথায় চাকরি, অমুকের সঙ্গে চেনা আছে কিনা! বাড়ির সামনের রাস্তায় জল দাঁড়ায় কিনা, প্রেসিডেন্ট জনসনের বুদ্ধি সম্পর্কে তাঁর কী মত, সর্ষের তেল পাওয়া গেলেও আর বাদাম তেলের অভ্যেস ছাড়া উচিত না অনুচিত—এসবই জিজ্ঞেস করতে পারি—কিন্তু সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটা কিছুতে জিজ্ঞেস করতে পারিনা-চাবি হারিয়ে গেলে আপনি কী করেন? অথচ এ প্রশ্নের উত্তর জানা নাহলে, একটা লোকের চরিত্র সম্পর্কে আমার কিছুই জানা হয়না, সবসময় আমি বিষম অস্বস্তি বোধ করি।

চাবি খোলার চরিত্র দেখে মানুষ চিনতে আমার ভুল হয়না। বিশ্বনাথের ছোটবেলা থেকেই আমার দুশ্চিন্তা ছিল। ওর পরোপকারী সরল মুখ দেখে আমার ভয় হতো, বুঝতে পারতাম বিশ্বনাথ ভুল করছে। আর আমার ছোটোমাসি? আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তিনিই প্রথম এম-এ পাস মেয়ে। যেমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তেমন খুশির হৈ-হল্লা করতে ভালোবাসতেন ছেলেবেলায়, অর্থাৎ আমার ছেলেবেলায়,—উনি তখন কলেজে পড়েন। ছোটোমাসির একটা চামড়ার সুটকেস ছিল—তার মধ্যে যে কী অমূল্য সম্পদ থাকত জানিনা। কিন্তু প্রায়ই সে সুটকেসের তালার চাবি হারাত। আমি দাদামশাইয়ের বাড়িতে যেতাম মাঝে-মাঝে—গিয়েই শুনতাম, ছোটোমাসি চাবি হারিয়ে বাড়ি মাথায় করেছেন। জামাকাপড় ছড়িয়ে বইপত্র এলোমেলো করে ছোটোমাসি চাবি খুঁজছেন। সে চাবি যে পাওয়া যাবেনা সকলেই জানে–কোনদিন পাওয়া যায়নি। আমাকে দেখলেই বলতেন ছোটোমাসি, এই নীলু, চট করে তালাটা ভেঙে দে তো!—ছোটো টিপ-তালা, ভাঙতে এমন কিছু শারীরিক শক্তি লাগেনা। এমন অনেকবার ভেঙেছি। প্রায়ই ছোটোমাসি বাড়ি ফেরার পথে নতুন তালাচাবি কিনে আনতেন। একদিন আমি ঐরকম সময়ে ‘উপস্থিত হয়েছি। ছোটোমাসি সাজগোজ করে কোথায় বেরুবেন, হঠাৎ চাবি খুঁজে পাচ্ছেননা। যথারীতি, আমার ওপর ভাঙার হুকুম হল। আমি তালাটা হাতে নিয়ে, ছোটোমাসির মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, প্রায়ই যখন হারায়, তখন তুমি তালা লাগাও কেন?

ছোটোমাসি মুখ ভেংচে বললেন, ইস, বাক্স খোলা রাখি আর কী!

সেই মুহূর্তে ছোটোমাসির মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল, ছোটোমাসি জীবনে সুখী হবেননা। কেন মনে হয়েছিল জানিনা, কিন্তু ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভয় হয়েছিল। তালা ভাঙার পর বাক্স খুলে ভেতরে কী আছে কোনদিন আমাকে দেখতে দেননি। কিন্তু, তখন আমি প্যান্ডোরার বাক্সের গল্প নতুন পড়েছি। আমার মনে হয়েছিল, বাক্স বন্ধ করে যা উনি আটকে রাখতে চাইছেন, তার নাম প্যান্ডোরার সেই ‘আশা’। দুঃখদুর্দশা-কষ্ট-হতাশা আগেই বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে ওঁকে ঘিরে ধরেছে। তখন ওঁর মুখ কিন্তু বিষম হাসিখুশি থাকত।

ছোটোমাসির জীবন সুখের হয়নি। ওঁর স্বামী স্বনামধন্য পুরুষ, নিউ আলিপুরে প্রাসাদোপম বাড়ি, দেবশিশুর মতো দুটি ছেলেমেয়ে, নতুন মোটরগাড়ি। তবু ছোটোমাসিকে দেখলে না-ভেবে পারিনা—উনি জীবনে সুখ পাননি।

ছোটোমাসির এক ছেলেকে দেখতাম, প্রায়ই গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তারপর জিজ্ঞেস করতাম, কীরে পরেশ, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পরেশ বলত, চাবিওলা খুঁজছি।

ঝনঝন শব্দে পুরোনো চাবিওলা কলকাতার রাস্তা দিয়ে যেত—বাবা প্রায়ই চাবি হারিয়ে ফেলতেন, আশেপাশের সব বাড়ির চাবি লাগিয়ে চেষ্টা করার পরও না-খুললে, পরেশ দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তায়। ডুপ্লিকেট চাবি বানাবে চাবিওলা ডেকে। অসীম ধৈর্য ছিল পরেশের—দাঁড়িয়েই থাকত। আমরা তখন হয়তো ক্যারাম খেলছি কিংবা টেনিসবলের গলি-ক্রিকেট, পরেশ তবু দাঁড়িয়ে। বলতাম, যা না, তালাটা ভেঙে ফেল! পরেশ যেতোনা। চাবিওলা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরত।

জানতাম পরেশ জীবনে উন্নতি করবে। করেছে। ওর বাবার অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসায়ে পরেশ আজ মেরুদণ্ড। লক্ষ-লক্ষ টাকার খেলা করে। পাড়ার দুর্গাপুজোয় চাঁদা দেয় পাঁচশো টাকা, ঠাকুমার নামে হাসপাতালে দান করেছে একলক্ষ। ব্যাঙ্কের লকারের চাবি পরেশ নিশ্চিত হারায়না।

আর, পেরেকের কৌশল জানা বিশ্বনাথ, একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। হঠাৎ বেরিবেরিতে ওর একটা চোখ অন্ধ হয়ে গেছে, অন্যচোখেও কম দেখে। হাতে চাবি থাকলেও বিশ্বনাথ আজকাল তালা খুলতে পারেনা চোখে দেখে না বলে, চাবিটা গর্তে ঢোকাতে পারেনা।

কিন্তু এ-পর্যন্ত লিখে মনে হয় আমার ভুল হচ্ছে। হয়তো, এসব যোগাযোগ কার্যকারণহীন। মনে পড়ল, অনেকের চাবির রিঙে অনেকগুলো চাবি থাকে—কিন্তু সব চাবির তালা থাকেনা। মেয়েদের আঁচলে যতগুলো চাবি বাঁধা থাকে—সবই তালা খোলার জন্য নয়। অনেক মেয়ের নাকি তালা খোলার দরকারই নেই— এমনিই আঁচলে বা কোমরে চাবির থোকা ঝোলানো নতুন কায়দা। অনেক ছেলেও যে হাতে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে যায়—সেসব কিসের চাবি? আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি।

কিন্তু, আর-একটি ছেলের কথা না-বললে চলবেইনা। তার তালা খোলার স্বভাব দেখে আমি শিউরে উঠেছি। ঘরের দরজায় তালা বন্ধ, সে চাবি হারিয়েছে। ‘সে তালা ভাঙালনা, পাশের বাড়ি থেকে চাবির গোছা চাইলনা, পেরেক ঘোরালনা। বারান্দায় একটা স্ক্রুড্রাইভার ছিল, সে তাই দিয়ে দরজার যে কড়া দুটোর সঙ্গে তালা লাগানো—সেটাই খুলতে লাগল। আমি বললাম, এ কী করছ, এ তো তালা খোলা নয়, ঘর ভাঙা!

সে বলল, কিছুই ভাঙছিনা। শুধু ঘরে ঢুকছি। দরজার কড়া-দুটো পরে আবার লাগিয়ে দিলেই হবে।

আমি বললাম, তালাটা তো তখনও লেগেই থাকবে। পরে তো ভাঙতেই হবে।

–সে পরে দেখা যাবে। এখন তো ঘরে ঢোকা যাক।

তালা না-ভেঙেও বন্ধঘরে ঢোকার যে এরকম উপায় তার মনে এল, তা দেখে আমি হতবুদ্ধি হয়ে যাই। ছেলেটির চরিত্র বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *