নীললোহিতের অন্তরঙ্গ – ৬

আগে মস্তানি, পিছে পস্তানি!

কথাটা নতুন শুনলাম, ভালোই লাগল। যে-লোকটি বলল কথাটা, তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। খালি গা, কালো তেলচকচকে দেহ, ধুতির এক পাক কোমরে জড়িয়ে মোটা করে গিঁট বাঁধা। লোকটার হাতে একটা ছোটো লাঠি, রাগে দুলছে। কথাটা ও শত্রুর উদ্দেশ্যে বলছে বোঝা যায়, নিজেকে সাবধান করছেনা। শত্রু অবশ্য তখন অনুপস্থিত।

আর-একটা নতুন কথাও সেখানে শুনলাম। ‘লাল বল’। অনেকক্ষণ কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। দশ-বারোজন নারী-পুরুষের জটলা, উত্তেজিত চিৎকার, শাসানি, তার মাঝে-মাঝেই শোনা যাচ্ছে, ‘লাল বলটা এই তো এখানে ছিল’, ‘আমি নিজের চোখে দেখেছি লাল বলটা নিয়ে ভেগে গেল’ ইত্যাদি। এতগুলো বয়স্ক লোক সত্যি-সত্যিই একটা লাল বল নিয়ে বিচলিত—এটা বিশ্বাস করা যায়না। বাচ্চা ছেলের খেলার জিনিশ, চুরির ঝগড়া এ নয়।

আমি ইন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলাম, লাল বলটা কী? ইন্দ্রনাথও ঐ একই ব্যাপারে চিন্তা করছিল বোধহয়, হেসে বলল, কী জানি! বুঝতে পারছিনা!

মাটির দাওয়ায় চাটাইয়ের ওপর হেলান দিয়ে বসেছিলাম দুজনে। মালদা শহর থেকে আট-দশমাইল দূরে, জায়গাটার নাম পাণ্ডুয়া। সেই পাণ্ডুয়া—যেখানে রাজা গণেশের রাজধানী ছিল, রাজা গণেশের ছেলে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে শেখ জালালুদ্দীন নাম নিয়েছিল—তার সমাধিভবন আর রাজ দরবারের ধ্বংসস্তূপ দেখতে গিয়েছিলাম। ঠা ঠা করছে রোদ, প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, পিচের রাস্তা এমন চটচটে যে জুতো আটকে যায়—কোনরকমে চক্কর মেরে আমরা ফিরে এলাম বড়ো রাস্তায়, এখান থেকে ফের বালুরঘাট যাবার বাস বা ট্যাক্সি ধরতে হবে। কখন তা পাওয়া যাবে ঠিক নেই।

মোড়ের মাথায় একটা ছোটো চায়ের দোকান, সেখানে দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বাসের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম, চা তৈরি করছিল একজন স্ত্রীলোক, সে বলল, আহা ভাইয়েরা আপনারা রোদ্দুরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। আমার ঘরের দাওয়ায় এসে বসুন।

মাটির ঘর, তাই মেঝেটা একটু ঠাণ্ডা, সেখানে আধ-শোয়া হয়ে আমরা দুজনে ঘাম মুছতে-মুছতে ঝগড়া শুনতে লাগলাম। এখানে সেই লাল বল নিয়ে আন্দোলন চলছে। যাক, আমাদের পক্ষে ভালোই তো, সময় কেটে যাবে।

অবিলম্বে লাল বলের অর্থ আমরা নিজেরাই বুঝতে পারলাম। বলদকে এখানে বল বলে। কিন্তু লাল রং? লাল গরুর কথা শুনিনি। মেটে-মেটে রঙের গরু হয় বটে—। অর্থাৎ মামলাটা গরু চুরির।

ভিতর দিকে মুসলমানদের প্রাচীন বসতি—অদূরে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কলোনি, তার উল্টোদিকে সাঁওতালদের গ্রাম। সুতরাং এলাকাটা যে তপ্ত বিছানা হয়ে থাকবে—তা তো খুবই স্বাভাবিক। আজকের ঝগড়াটা সাঁওতাল আর উদ্বাস্তুদের মধ্যে। মারামারির নিশ্চয়ই অনেক কারণ থাকে—দুপক্ষেরই গরু চুরিটা নেহাত ছুতো।

উদ্বাস্তুরা এখানে বিদেশি, কিন্তু পনেরো-কুড়ি বছর কেটে গেছে, অনেকটা শিকড় গেড়েছে, এখন আর সেই আগেকার মতন ভীতু দয়াপ্রার্থী ভাব নেই। এখন তারাও এককাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়ায়, পুরো অধিকার দাবি করে। সুতরাং তিনপক্ষই এখন সমান-সমান—মুসলমান, উদ্বাস্তু, সাঁওতাল—এদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া-লড়াই বাধে, দুপক্ষ যখন লড়াই করে—বাকি একপক্ষ তখন চুপ করে থেকে মজা দেখে।

বেশ বুঝতে পারলাম, আজ সাঁওতাল বনাম উদ্বাস্তু একটা ঘোরতর লড়াই বাঁধতে আর দেরি নেই। উদ্বাস্তুদের মধ্যে একটা ছেলে, নাম তার লখা, সে শুধু চোর নয়, পুরোপুরি মস্তান। বাবলা গাছে বাঁধা ছিল সাঁওতালদের একটা গরু, সে সেটা শুধু খুলে নিয়ে যায়নি, যাবার সময় চেঁচিয়ে বলে গেছে—সাঁওতালরা আবার গরু পুষবে কী? ওরা কুকুর পুষুক! গরু আমাদের কাজে লাগবে!—কেউ একজন তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, লখা ও-গরুতে হাত দিসনি, ওটা দুখো মাঝির গরু, দুখো মাঝি তুলকালাম করবেনি! লখা নাকি তার উত্তরেও বলেছিল, যা যা! ওরকম দু-দশটা দুখো মাঝিকে হাপুর হাটে কিনে বেচতে পারি! বলিস তাকে বলদ ছাড়িয়ে আনতে—দেখব তার কত হেম্মৎ!

লখার চরিত্রটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। এ-নাটকে ভিলেন হিসেবে সে খুব জোরালো। কিন্তু মঞ্চে তাকে দেখা যাচ্ছেনা। দুখো মাঝিকে দেখলাম, ভিড়ের মধ্যে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে—এই ভরদুপুরেই কিছুটা নেশা করেছে মনে হয়।—চোখে রাগ কিন্তু ঠোটের কোণে ক্ষীণ হাসি—এইসব লোক সত্যিই বিপজ্জনক।

খানিকটা শরীর ঠাণ্ডা হয়েছে, হেলান দিয়ে বসে আমরা দুই বন্ধুতে উদ্‌গ্রীব হয়ে দেখছি। কখন মারামারি লাগবে! লাগলেই তো পারে—আমরা তাহলে দেখে যেতে পারতাম। আমরা দুজনেই মনে-মনে চাইছি— মারামারিটা তাড়াতাড়ি লাগুক! প্রায়ই মারামারি হয়, ভবিষ্যতেও হবে—এব্যাপারে আমাদের করণীয় কিছুই নেই—সুতরাং এই উত্তেজক দৃশ্যটা দেখার সুযোগ নষ্ট করার কোন মানে হয়না। সাইকেল আছে, ট্রানজিস্টার আছে, অনেকের হাতেই ঘড়ি, তবু আদিম সমাজ। জমি আর জাতিভেদ নিয়ে লড়াই অনবরত চলবে। সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদি ‘ যা-সব আমরা বলি—সে সবই শহুরে ফ্যাশান।

দুখো মাঝি পিছন ফিরে দুর্বোধ্য ভাষায় কী একটা চিৎকার করে উঠল। দূর থেকে তার উত্তর ভেসে এল। সেদিকে আমরা তাকিয়ে দেখলাম। হ্যাঁ, এবার জমবে মনে হচ্ছে। জন পনেরো সাঁওতাল, দ্রুত পায় এগিয়ে এল, কারুর হাতে ধনুক, কারুর কাঁধে টাঙ্গি—সঙ্গে কয়েকটা শিকারী কুকুর। না, সিনেমার দৃশ্যের মতন ঠিক নয়, এ সাঁওতালদের খুবই দৈন্য দৃশ্য—-অধিকাংশরই চেহারা ডিগডিগে, অস্ত্রগুলো প্রথমশ্রেণীর নয়—বহুদিন শান পড়েনি। তা হোক—রিফিউজিদেরই বা স্বাস্থ্য আর অস্ত্র কত ভালো হবে? এ-অঞ্চলে হাত বোমার কুটিরশিল্প চালু হয়েছে কিনা ঠিক জানিনা। দুপক্ষ প্রায় সমান-সমানই হবে মনে হয়।

আর-একটাও নতুন শব্দ শিখলাম। ‘খিটকেল।’ ‘একি খিটকেল দেখুন দিনি দাদারা!’ আমাদেরই বলছে। চায়ের দোকানের সেই স্ত্রীলোকটি। তিরিশের কাছাকাছি বয়েস, আঁটো স্বাস্থ্য, চোখদুটো বেশি উজ্জ্বল—স্ত্রীলোকটিকে দেখলেই বোঝা যায়— শুধু নিজের স্বামীকেই নয়—আশপাশের সকলকে হুকুম করার ক্ষমতা ওর আছে। একটু আগে চায়ের দোকানে ঐরকমই তার প্রতাপ দেখেছিলাম। কিন্তু এখন সে ভয় পেয়েছে। বারান্দার বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে আমাদের বলল, আমি কারুর সাতে নেই, পাঁচে নেই—আমারই দোকানের সামনে একি খিটকেল শুরু হল।

শুধু মারামারিতেই তো নাটক হয়না—মনস্তত্ত্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব, নারী চরিত্র—এসবও তো থাকবে। এবার সেদিকটা চোখে পড়ল। স্ত্রীলোকটি খুব সংক্ষিপ্তভাবে নিজের অবস্থাটা বুঝিয়ে বলল। ওদের পরিবারটিও উদ্বাস্তু। কিন্তু স্ত্রীলোকটি নিজের বুদ্ধিতে এই উন্নতি করেছে। কলোনিতে থেকে চাষবাস করার বদলে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এই চায়ের দোকান বানিয়েছে। পাণ্ডুয়াতে প্রায়ই ভ্রমণকারী আসে—সুতরাং এখানে চায়ের দোকানের উপযোগিতা সে নিজের বুদ্ধিতেই বুঝেছিল। আশেপাশে কোন চায়ের দোকান নেই—বেশ চালু হয়েছে তার দোকান, পাশে এই মাটির বাড়িটা বানিয়েছে, পিছনে ধান জমি কিনেছে তিন বিঘে। তার দোকানে সাঁওতাল, উদ্বাস্তু, মুসলমান—সবাই চা খেতে আসে। সে নিজের হাতে চা বানায়—সবাই তাকে সুরোদিদি বলে ডাকে।

আজ লাল বলদটা চুরি হয়েছে প্রায় দোকানের সামনে থেকে। সাঁওতালরা এসে তাকে জিজ্ঞেসবাদ করছে। সে এখন কী বলবে? একজনের দোষে সবার দোষ। ঐ হারামজাদা লখাটা চোর-গুণ্ডা, কিন্তু দোষ পড়বে সব রিফিউজিদের নামে। লখাকে মারতে গেলে অন্য রিফিউজিরা দল বেঁধে রুখে দাঁড়াবে। অর্থাৎ দাঙ্গা হবে সাঁওতাল আর রিফিউজিতে। আর-একবার দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলে— সাঁওতালরা কি তাকেও মারবেনা? সেও তো আসলে রিফিউজিই। এক হয়, এখনই যদি চুপি-চুপি পালিয়ে গিয়ে রিফিউজি কলোনির মধ্যে ঢুকে পড়া যায়—তাহলে হয়তো প্রাণে বাঁচবে। কিন্তু ব্যাপারটা টের পেলে সাঁওতালরা তো রাগের চোখে প্রথমেই তার দোকানবাড়ি ভাঙবে। এত সাধের, পরিশ্রমের, কষ্টের গড়া দোকান। সাঁওতালরা এখনো তার সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি।

আর নয়তো, দোকান—প্রাণ বাঁচাবার জন্য সে যদি সাঁওতালদের পক্ষ নেয়—চেঁচিয়ে লখার নামে, রিফিউজিদের নামে গালাগালি করে চেঁচিয়ে, যদি বলে ঐ রিফিউজিদের উচিতশিক্ষাই দেওয়া উচিত—তাহলে হয়তো সাঁওতালরা খুশি হবে। কিন্তু হাজার হোক, রিফিউজিরা তার জাতভাই—তাদের নামে ওরকম বলা যায়? আর রিফিউজিরাও কম শক্তিশালী নয়—ও-কথা শুনলে তারাও আজ না হোক কাল এসে ঝামেলা করবেনা? একি খিটকেল বলুন তো! সত্যি, ‘খিটকেল’ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নিয়ে ব্যাপারটা বুঝানো যেতনা!

বন্ধু ইন্দ্রনাথ বলল, থানা নেই এখানে? থানায় খবর দিননা!

সুরোদিদির বুদ্ধি কি কম, সে খেয়াল কি তার নেই? চুপি-চুপি একজনকে সাইকেল দিয়ে থানায় খবর পাঠিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু কারু দেখা নেই। দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু না হলে দু-একজন লোক খুন-জখম না হলে—আগে কি কখনো পুলিশ আসে? কেউ সেরকম দেখেছে কখনো?

সাঁওতালদের আলোচনা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। এবার তারা যুদ্ধে যাবেই বোঝা যাচ্ছে। একজন ডাকল, এ সুরোদিদি, ইদিকে শোন, তু তো দেখেছিস্ উঁ শালা লখাটো….

এইসময় পথের দিগন্ত কাঁপিয়ে আমাদের বাস এল। ইস, মারামারিটা দেখা হলনা! ইন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলাম, কী এই বাসটা ছেড়ে দেবে নাকি? ইন্দ্ৰনাথ বলল, তুমি বলো কী করব? আমরা দুজনে কেউই মনঃস্থির করতে পারছিনা। পরের বাস আবার দুঘণ্টা বাদে। এই গরমে আরও দুঘণ্টা কি অপেক্ষা করা ঠিক হবে? যদি শেষপর্যন্ত মারামারি না হয়? না, আর দেরি করবনা— আমরা দুজনে ছুটে গিয়ে বাসে উঠে পড়লাম।

বাস একটু দূর যেতেই দেখলাম পথের ওপর আর-একটা দঙ্গল! এখানেও কিছু লোকের হাতে লাঠি-সোঁটা। এটা রিফিউজিদের দল। পাজামার ওপর হাওয়াই শার্ট-পরা ওই লোকটাই কি লখা? ওপাশ থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসতেই এরাও ক্রুদ্ধ চিৎকার দিয়ে উঠল। আমরা নেমে পড়ার সুযোগ পেলামনা—বাস ঊর্ধ্বশাসে ছুটে পালাল।

এইসব মারামারিতে পরের দিন খবরের কাগজে পাঁচ-ছ লাইন খবর বেরোয় মাত্র। নিহতের সংখ্যা তিনের বেশি হলে পনেরো-কুড়ি লাইন। কিন্তু তাতে সুরোদিদির খিটকেলের কথা কিছুই থাকেনা। কোন শক্তিমান নাট্যকারের পক্ষেই শুধু ওর অন্তর্দ্বন্দ্ব ফোটানো সম্ভব। আমার সে-ক্ষমতা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *