নীললোহিতের অন্তরঙ্গ – ১১

১১

এলা নাম্নী কোন মেয়েকে আমি চিনিনা। কখনো এই নামের কোন জীবিত মেয়ের কথাও শুনিনি। কিন্তু প্রত্যেকটা নামের সঙ্গেই কল্পনার একটি মুখ থাকে। সুতরাং এলা যদি কোন মেয়ের নাম হয়, তবে তার মুখখানি কেমন দেখতে হবে—সে সম্পর্কে আমার কল্পনায় একটি স্পষ্ট ছবি ছিল।

শ্যামলী নামের যত মেয়ের সঙ্গেই আমার দেখা হোক—ঐ নাম শুনলেই আমার ছোটো পিসিমার কথা মনে পড়ে। সাধারণত একটু কালো মেয়েদেরই নাম রাখা হয় শ্যামলী—কিন্তু আমার শ্যামলী পিসিমা ছিলেন ধপধপে ফর্শা। বড় বেশি ফর্শা। একটু লম্বাটে, ডিম ছাঁদের মুখ, নাকে একটা মুক্তোর নাকছাবি—কথায়—কথায় লুটোপুটি হতেন। শ্যামলী পিসিমা মারা গেছেন অনেকদিন আগে, কিন্তু এখনও কোন সপ্রতিভ, আধুনিকা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলে যদি শুনি তার নাম শ্যামলী, তবুও আমার সেই হাস্যমুখী ফর্শা পিসিমার মুখখানাই প্রথমে মনে পড়ে। অল্পক্ষণের জন্যই যদিও পরক্ষণে সেই মুখ ভুলে সম্মুখবর্তিনীর প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়ি। মৃতদের বেশি মনে রাখতে নেই।

এমনকী ইন্দিরা নামটি শুনলেও আমার ইন্দিরা গান্ধীর মুখ মনে পড়েনা। ভবানীপুরে থাকার সময় আমাদের পাশের বাড়িতে একটি ইন্দিরা নামের মেয়ে থাকত—তেরো-চোদ্দবছর বয়েস, খানিকটা কালোর দিকে—বৃষ্টিভেজা মাটির মতন গায়ের রং, ঢলঢলে চোখদুটি একটু বোকা-বোকা—কিন্তু গলার আওয়াজটা ছিল শুভলক্ষ্মীর চেয়েও সুরেলা। ইন্দিরাও বেঁচে নেই, টাইফয়েডে হঠাৎ মারা গিয়েছিল। এখনকার মেয়েদের মধ্যে ইন্দিরা নামটা শোনা যায়না তেমন, তবু, কোথাও টাইফয়েড অসুখটার কথা শুনলেই ইন্দিরার মুখটা মনে পড়ে একপলক। মৃতদের মুখচ্ছবি স্মৃতিতে সহজে মরেনা।

একটা পার্টিতে একটি মেয়ের অপূর্ব নাম শুনেছিলাম। খুব কায়দার পার্টি, বিলিতি বাজনার সঙ্গে নাচেরও ব্যবস্থা ছিল, ছিল চার প্রকার পশুপাখির মাংস, ছিল তিন প্রকার লঘু ও কড়া মদ। আমার যে-কোন আনন্দ উৎসবই ভালো লাগে, দিশি-বিলিতি যে-কোন সঙ্গীত-নৃত্যই ভালো লাগে, মদ-মাংস সম্পর্কে তো কথাই নেই। শুধু ভালো লাগছিলনা, উপস্থিত কিছু ছেলেমেয়েদের। আজকাল একদল বোকা ছেলেমেয়ে তৈরি হয়েছে, বাঙালি হয়েও যারা নিজেদের মধ্যে পিজিন ইংরেজিতে কথা বলতে ভালোবাসে—পার্টিতে সেইরকম বোকা ছেলেমেয়ের দলই ছিল বেশি। তাদেরই মধ্যে একটি মেয়ে, শাড়ি পরেছে স্কার্টের ধরনে আঁটভাবে পেঁচিয়ে, শিঙ্গল করা চুল, মুখখানা ঝকঝকেভাবে মাজা, নিশ্চিত লরেটো হাউস বা কোন মিশনারি কলেজে পড়া মেয়ে, মুখ দিয়ে ধাতব ইংরেজির খ‍ই ফুটছে। মেয়েটিকে দেখতে ভালো, অর্থাৎ তার শরীরখানি সমানুপাতিক—সুতরাং তার সাজসজ্জা যাই হোক—তাতে কিছু যায়-আসেনা—আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিলাম একদৃষ্টে। মিশনারি স্কুল-কলেজে পড়া ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে একটা উদ্ভট ব্যাপার আমার মনে পড়ছিল। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা—যে—শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালায়—যারা নিজের দেশ-সংসার-প্রতিষ্ঠা ছেড়ে এসে এদেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কাজে আত্মনিয়োগ করেছে—তাদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েও এইসব ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই এমন উৎকট রকমের বোকা আর চালিয়াৎ হয় কী করে? কী এর সামাজিক ব্যাখ্যা? হঠাৎ আমার ইচ্ছে হল ও মেয়েটির নাম জানতে হবে। নাম না-জানলে কোন মেয়ের ছবি সম্পূর্ণ হয়না। ভিড় ঠেলে আমি আস্তে-আস্তে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালে আলাপ হবেই। হলও তাই, আর-একটি ছেলে আমার সঙ্গে মেয়েটির আলাপ করিয়ে দিল। মেয়েটির নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম। কিছুই বুঝতে পারলামনা। মেয়েটির নাম জাটাবেড়া। জাটাবেড়া বটআচারিয়া।

এ আবার কী অদ্ভুত নাম? মেয়েটি স্পষ্টতই বাঙালি, ঠোঁটের ভঙ্গি দেখলেই বাঙালি চেনা যায়—যতই ইংরেজি কায়দা দেখাক। একবার মনে হল, মেয়েটির মা বাঙালি, বাবা হয়তো অন্যদেশের অন্যজাতের লোক। কিন্তু কোন জাতের মেয়েদের এমন বিদঘুটে নাম হয়? আমার অস্বস্তি কাটলনা। একফাঁকে মেয়েটিকে একটু একলা পেয়ে আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, মুখের ভাব বেশ কঠোর করে—আপনি-টাপনি নয়, সরাসরি তুমি সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নামটা কী? ঠিক বুঝতে পারিনি তখন।

মেয়েটি চমকে আমার দিকে তাকাল, এক অনুপল আমার চোখে চোখ রাখল, কী জানি ভয় পেল কিনা—কিন্তু শরীরের সজাগ ভঙ্গি সাবলীল করে পরিষ্কার কৃষ্ণনগরের ভাষায় বলল, আমার নামে জাতবেদা ভট্টাচার্য। আমার দাদামশাই এই নাম রেখেছিলেন—

আমি জিজ্ঞেস করলাম, জাতবেদা মানে কী?

মেয়েটি এবার রহস্যময়ীর মতন হেসে বলল, আপনি বলুন-না? আপনি জানেননা? খুব আনয়ুজুয়াল নেম, তাই না?

আমি ভুরু কুঁচকোলাম। সত্যিই জাতবেদা কথাটার মানে আমি জানিনা, আগে কখনো শুনিনি। আন্দাজে মানে তৈরি করা যায়। সংস্কৃত শব্দ, মাঝখানে বা শেষে বোধহয় একটা বিসর্গ থাকার কথা। যে বেদ নিয়ে জন্মেছে? জন্ম থেকেই যে জ্ঞানী? এইরকমই কিছু একটা হবে।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার দাদামশাই এই নাম রেখেছিলেন?

মেয়েটি আবার ইংরেজিতে ফিরে গেছে। বলল, ইয়েস, দ্যাটস হোয়াট মাই মাদার টোল্ড মী। আই হার্ডলি রিমেম্বার হিজ ‘ফেস দো—

হঠাৎ আমার হাসি পেল। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে, ভট্টাচার্য যখন—পূজারী, পুরোহিতের বংশ হওয়াও বিচিত্র নয়, দাদামশা‍ই ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ ও ঐতিহ্যবাদী। তারপর পৃথিবীতে কত ওলোপালোট হয়ে গেছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কত সংসারের ভাগ্য বদলে দিয়েছে, পুরুত বংশের মেয়ে এখন প্রাণপণে মেম হবার চেষ্টা করছে—কিন্তু দায় হয়েছে দাদামশাইয়ের চাপিয়ে দেওয়া ঐ নামটা। এমনই নাম যে, সংক্ষেপে জাটা কিংবা বেডা করলেও শ্রুতিমধুর হয়না। আহা-বেচারা! এফিডেবিট করে নামটা বদলে নিতে পারেনা? এই তো কিছুদিন আগে রত্নাকর নামে এক ভদ্রলোক এফিডেফিট করে বাল্মীকি হয়ে গেলেন।

সেই থেকে কোন অদ্ভুত উদ্ভট বিষম উল্টোপাল্টা ব্যাপার দেখলেই আমার ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়ে। বিহারের একটি গ্রাম্য রাস্তায় একটি গামছা-পরা লোকের হাতে হাতঘড়ি দেখেও আমার জাতবেদার কথা মনে পড়েছিল।

কিন্তু এলার কথা আলাদা। এলা নাম্নী কোন মেয়েকে আমি এপর্যন্ত দেখিনি, তবু ঐ নামের মুখখানি আমার কল্পনায় স্পষ্ট আঁকা আছে। একদিন সেই মুখ আমি বাস্তবে দেখতে পেলাম। দেখে আকস্মিক খুশির ছোঁয়ায় অভিভূত হবার বদলে অকারণ ভয়ে আমার বুক দুরদুর করছিল।

অনেকদিন বাদে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কলেজ স্টিট কফিহাউসে দুপুরবেলা আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম। এমনসময় পাশের টেবিলে এলা এসে বসল। এলা তার সত্যিকারের নাম কিনা জানিনা—কিন্তু অবিকল আমার কল্পনায় রাখা সেই মুখ। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ এককালে আমার অত্যন্ত প্রিয় বই ছিল, সেই চার অধ্যায়ের নায়িকা এলা, সেই কোমল তেজস্বিনী প্রণয়িনী, অন্তু অর্থাৎ অতীন যাকে দেখে বলেছিল।

‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম
আমার সর্বনাশ।’

এই সেই এলা, আজ সশরীরে, দুপুরবেলা কফিহাউসে। চায়ের দোকানে এলার হঠাৎ চলে আসার বর্ণনা আছে চার অধ্যায় উপন্যাসে। কিন্তু এ যে বাস্তব কফিহাউস। একটা অজানা ভয়ে আমার বুক দুরদুর করতে লাগল।

একটা টেবিলে একজন যুবক একা বসেছিল, আর দুটি মেয়ের সঙ্গে সেই এলা এসে বসল সেই টেবিলে। আমার ঠিক সামনে। কল্পনায় যেরকম ছিল, অবিকল সেই রূপ। অন্য মেয়েদের তুলনায় একটু বেশি লম্বা, রোগাও নয় স্থূলও নয়, ধপধপে ফর্শা রং, শাদা রঙের শাড়ি, কোথাও প্রসাধনের কোন চিহ্ন নেই—কিন্তু একটা চিক্কণ শ্রী ছড়িয়ে আছে সর্বাঙ্গে। ধারালো নাক, ধারালো চোখ—তবু মুখে কোন কঠোরতা নেই। পাতলা ঠোঁট দুখানি, সুষ্ঠু চিবুক। টেবিলের ওপর হাত রেখে তার ওপর চিবুক, হাসিমুখে কথা বলবে। ঠিক তাই।

ভূত দেখলে যেরকম ভয় করে, কল্পনার মূর্তিকে বাস্তবে দেখলে সেইরকম ভয় হয়। ভয়-ভয় চোখে মেয়েটির দিকে আমি চেয়ে রইলাম। দুরন্ত ইচ্ছে হল, উঠে গিয়ে ঐ টেবিলে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি, আপনার নাম কি এলা? যদি না-ও হয়, তবু আপনি এলা–আপনি আমাদের টেবিলে এসে একটু বসুন! কিন্তু পরক্ষণে মনে হল, একথা বলার কী অধিকার আছে আমার! আমি তো অন্তু নই! আমি একটা এলেবেলে লোক। আমি আগে থেকেই ওর ঐ রূপ কল্পনা করে রেখেছিলাম, তাতে ওর কী যায় আসে! বিশ্বাসই বা করবে কেন?

বন্ধুদের সঙ্গে কথা আর জমছেনা, অন্যমনস্কভাবে হুঁ-হাঁ করে আমি ঘনঘন চেয়ে দেখছি মেয়েটিকে। ক্রমশ আমার ভয় বেড়ে যাচ্ছে। ভয়ে প্রায় কাঁপছি তখন। আমি এত ভয় পাচ্ছি কেন? বারবার নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তরটা খুঁজে পেলাম। যদি আমার কল্পনার ছবিটা হঠাৎ রূঢ়ভাবে ভেঙে যায়—সেই ভয়। যদি দেখি মেয়েটি গোপনে নাক খুটছে কিংবা ওর হাসির আওয়াজ বিশ্রী কিংবা ঐ ছেলেটির সঙ্গে ও কোন বদ রসিকতা করে তাহলে আমি জীবনে চরম আঘাত পাব! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে যদি আমার চোখে পড়ে ওর ঘাড়ে ময়লা কিংবা কনুই-এর কাছে শুকনো চামড়া—তাও আমি সহ্য করতে পারবনা। ঐটুকু ত্রুটিও আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।

অকস্মাৎ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের বললাম, চলি রে! সঙ্গে-সঙ্গেই মেয়েটির দিকে আর একবারও না তাকিয়ে-কফি হাউস থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার কল্পনায় এলা চির রূপসী থাক। তাকে আমি নষ্ট হতে দিতে পারিনা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *