২
আমি ভাবছিলাম আমি কোন দলে? কোলিয়ারির অফিসঘরে বসে আছি। সকালবেলা ভারী ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে। চৌধুরি সাহেব খুব অতিথিবৎসল, তাঁর বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার এলাহি বন্দোবস্ত। সকালেই চায়ের সঙ্গে টোস্ট, বেকন, মার্মালেড আর খাঁটি ক্ষীর খাওয়ালেন, তারপর বললেন, চলুন আমার সঙ্গে। খনির মধ্যে নামবেন তো!
খনিতে নামার ব্যাপারে আমার খুব উৎসাহ। খনি অঞ্চলে বেড়াতে এসে একবার অন্তত ভূগর্ভের অন্ধকার না-দেখার কোন মানে হয়না। মৃত্যুর পর তো নরকে যাবই, সুতরাং তার আগেই একবার পাতালের কাছাকাছি ঘুরে আসা যাক।
চৌধুরি সাহেব এখানকার চারটে খনির এজেন্ট অর্থাৎ এই বিস্তীর্ণ এলাকার দণ্ডমুণ্ডের বকলম অধিকর্তা। মালিকের অনুপস্থিতিতে প্রতিনিধি হিসেবে তিনিই এখানকার সব। একদিন আমার এক বন্ধুকে কথায়-কথায় বলছিলাম, আমার কিছুদিন খনি অঞ্চলে গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে খুব। বন্ধুটি সঙ্গে-সঙ্গে বলেছিলেন, চলে যা না। আমার এক মাসতুতো দাদার আণ্ডারে চারটে খনি আছে, চিঠি লিখে দিচ্ছি, চলে যা।
সেই চিঠি নিয়েই এখানে আসা। চৌধুরি সাহেব ব্যস্ত মানুষ, কোলিয়ারি ছেড়ে বাইরে প্রায় যাওয়াই হয়না—অনেকদিন পর শহরের লোক পেয়ে তিনি খুশি হয়ে ওঠেন। অমায়িক, হাসিখুশি মানুষ—সাহিত্য-শিল্পেও উৎসাহ আছে, শরীরটাও মজবুত।
খাদে নামব সব ঠিকঠাক মাথায় সাদা রঙের হেলমেট পরে নিয়েছি, কোমরেও চওড়া বেল্ট লাগানো, ব্যাটারি—হাতে জোরালো টর্চ—চৌধুরি সাহেব নিজে আমার সঙ্গে নামবেন, এমন সময় একটা পাল্লার টেলিফোন এলো। চৌধুরি সাহেব বললেন, তাহলে আর-একটু বসুন, আর-এককাপ চা খেয়ে নিন বরং, আমি টেলিফোনটা সেরে নিচ্ছি।
সেই থেকে আরও দেরি হয়ে গেল। টেলিফোন শেষ হয়েছে, এমন সময় আর্দালি এসে খবর দিল, সেই চারজন লোক আবার দেখা করতে এসেছে। ‘সেই চারজন’ শুনেই বিরক্তিতে চৌধুরি সাহেবের মুখ কুঁচকে গেল, বিড়বিড় করে কী যেন বললেন, আর্দালিকে কিন্তু বললেন, যাও ডেকে নিয়ে এসো! আমার দিকে চোখের এমন একটা হতাশ ইঙ্গিত করলেন, যার অর্থ, আরও খানিকক্ষণ বসতেই হবে।
ভেবেছিলাম, হোমরাচোমরা কেউ হবে, কিন্তু সেই চারজনকে দেখে আমি হতাশ হলাম। চারজন অতি সাধারণ গেঁয়ো লোক—একজন ছোকরা আর তিনজন বুড়ো, বুড়োদের মধ্যে একজনের গায়ে ফতুয়া আর চোখে গোল চশমা—নিকেলের ফ্রেম, বাংলা নাটক এবং সিনেমায় গ্রাম্য কুচক্রী বদমাইশদের চেহারা যেমন থাকে —সেইরকম। তারা এসে বলল, স্যার সেই জমির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে এলাম।
চৌধুরি সাহেবের মুখের বিরক্ত ভঙ্গি তখন সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে গেছে, হেসে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বসুন বসুন, এই রঘুয়া, বাবুদের চেয়ার দে। চা খাবেন তো? গোল-চশমা-বুড়োটি বিগলিতভাবে বলল, না স্যার। আপনি ব্যস্ত লোক, বেশি সময় নষ্ট করবনা—আমাদের সেই জমিতে জল ঢোকার ব্যাপারে….
চৌধুরি সাহেব বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেসব কথা হবে। আগে চা খান। চা খেতে আপত্তি কী! এই রঘুয়া——
আমি একপাশে চুপ করে বসে সিগারেট ধরালাম। লক্ষ করলাম দিনকাল সত্যিই অনেক বদলে গেছে। চৌধুরি সাহেব তিন হাজার টাকার মতন মাইনে পান, ফুলবাগান সমেত বিশাল কম্পাউণ্ড নিয়ে তাঁর বাড়ি, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য দুখানি মোটর গাড়ি। তাঁকে কেউ চৌধুরিবাবু বলবেনা, বলবে চৌধুরি সাহেব। এইসব সাহেবরা তো চিরকালই ঐধরনের গেঁয়ো লোকদের তুইতুকারি বলে কথা বলেছেন, হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা—এইসব আদরের সম্বোধন করেছেন। চেয়ারে বসানো? চা খাওয়ানো? স্বপ্ন বলে মনে হয়। শুধু যে চৌধুরি সাহেবই ওদের চেয়ারে বসিয়ে চা খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত, তাই নয়, ঐ হেঁজিপেঁজি গেঁয়ো লোকগুলোও কিন্তু চেয়ারে বসতে একটুও আড়ষ্ট বোধ করলনা, অবলীলাক্রমে চুমুক দিল চায়ের কাপে—একজন আবার আর্দালির দিকে চেয়ে বলল, আর-একটু চিনি দাও হে! ঠিক মিঠা হয়নি।
ধীরেসুস্থে চা শেষ করে তারা বক্তব্য শুরু করল। গাঁয়ের অশিক্ষিত অর্ধনগ্ন লোক হলেও তেমনটি আর হাবাগোবা নেই, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানে —এমনকী দু-চারটে ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করে।
বৃত্তান্তটি এই। ওরা কোলিয়ারি সংলগ্ন গ্রামের চাষা। কোলিয়ারির বয়লার থেকে বিষাক্ত গরমজল ওদের জমির ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেছে, তাতে জমির ফসলই শুধু নষ্ট হয়নি। জমি একেবারে চাষের অযোগ্য ঊষর হয়ে গেছে। সেইজন্য ওরাঁ কমপেনসেশন চায়। সেই জল পুকুরে পড়ায় পুকুরের মাছও মরে গেছে। সুতরাং ওদের মহাসর্বনাশ, ওরা খাবে কী? ওরা ক্ষতিপূরণ চায়— তার অঙ্কও নেহাৎ কম নয়।
চৌধুরি সাহেবের বক্তব্য, গরমজল গড়িয়ে গেছে ঠিকই, সেই জল ফসলের গোড়ায় লাগলে ফসলও মরে যেতে পারে—কিন্তু ঐ জল মোটেই বিষাক্ত নয়, জল শিশিতে ভরে ডিস্টিল্ড ওয়াটার হিসেবে বেচা যায় পর্যন্ত। সুতরাং জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথাটা বাজে, পুকুরে মাছ মরে যাবার কথাটা গুজব—এখন ক্যানাল কেটে দেওয়া হয়েছে—এখন সমস্ত জমির ওপর জল ছড়ায়না—এবং পুকুর পর্যন্ত পৌঁছুতে -পৌঁছুতে জল ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ঐ জলকে বিষাক্ত বলার কোন মানে হয়না। নিকেল-চশমা-বুড়ো বলল, না স্যার, জমির ঘাসগুলো পর্যন্ত একেবারে হলদে হয়ে গেছে। সেই ঘাস মুখে দিয়ে একটা গরু…
চৌধুরি সাহেব ওর বাক্যের মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বললেন, মরে গেছে তো? গরুটা ঘাস মুখে দিল আর ধপাস্ করে মরে পড়ে গেল। তাই না? শুনেছি আমি সে-গল্প। কিন্তু সেই মরা গরুটা কে দেখেছেন আপনাদের মধ্যে? কেউ দেখেছে?
— আজ্ঞা স্যার, গদাই—
গদাই বলেছে তো? জানি, তাও জানি। গদাইয়ের নিজের কি কোন গরু আছে? আপনাদের সারা গাঁয়ে একমাসের মধ্যে একটাও গরু মরেনি—আমি খবর নিয়েছি। গদাই তো বলবেই! সে অমুক পার্টির লোক—সে তো চায়ই সবসময় একটা হাঙ্গামা বাধাতে—সে আবার আজকাল লিডার হচ্ছে?
—তাহলে আমাদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটার এবার একটা ফয়সালা করেন।
মুখ থেকে পাইপটা সরিয়ে চৌধুরি সাহেব এবার উঠে দাঁড়ালেন। বেশ আবেগের সঙ্গে বলতে লাগলেন, আপনাদের যদি চাষের ক্ষতি হয়ে থাকে—তবে তার ক্ষতিপূরণ কম্পানি নিশ্চয়ই দেবে। স্থানীয় লোকের অসুবিধে করে কম্পানি ব্যবসা চালাবেনা। কিন্তু, আমি একটা কথা বলছি শুনুন। এই যে জমি নষ্ট হয়ে গেছে—এ-গুজব ছড়াবেননা। ঐ জমি আবার চাষ করুন। আমাদের দেশে এখন আরও খাদ্যের দরকার। আমি নিজের পকেট থেকে আপনাদের বীজ ধানের খরচা দিচ্ছি। বয়লারের জল আমি অনায়াসেই অন্যদিকে ঘুরিয়ে নদীতে ফেলে দিতে পারি। কিন্তু আপনাদেরই চাষের সুবিধের জন্য ঘণ্টায় চারশো গ্যালন করে জল বিনাপয়সায় পাচ্ছেন—সেই জল পুকুরে জমিয়ে যদি সেচের কাজে লাগান—
—ও-জল কেউ ছোঁবেনা। সবাই জানে, ওতে বিষ আছে।
—বিষ আছে? চলুন আপনাদের সঙ্গে আমি যাচ্ছি—আমি নিজে আপনাদের সামনে সেই জল খেয়ে দেখাব কেউ মরে কিনা—আমারও তো প্রাণের দাম আছে? নাকি নেই?
—গাঁয়ের লোকে আমাদের পাঠিয়েছে, আপনি ক্ষতিপূরণের টাকাটার কথা বলুন স্যার। ও-জমিতে আর ফসল হবেনা—মেহনত করে রক্ত সব ঘাম করে ফেললেও কিছু হবেনা—
ব্যাপারটা অত্যন্ত ঘোরালো। আমি বাইরের লোক, আমার কোন কথা বলা উচিত নয় বলেই আমি চুপ করে রইলাম। মনে-মনে ভাবতে লাগলাম, আমি কোন্ দলে? কোন্ পক্ষ আমি সমর্থন করব? চৌধুরি সাহেব যে যুক্তি দেখাচ্ছেন, তা কি পুরো সত্যি? কমপেনসেশনের কথাটা এড়িয়ে গিয়ে তিনি ভাব দেখাচ্ছেন যেন তিনি ওদের উপকার করার জন্যই ব্যগ্র। কিন্তু কোথাও একটা গোলমাল আছে। কমপেনসেশনের টাকা একবার দিলে কি বার বার দিতে হবে? জল সরাবার সত্যিই কি অন্য উপায় আছে? এ-কথা ঠিক, চৌধুরি সাহেব কোম্পানির স্বার্থ টেনেই কথা বলবেন। কোম্পানি তাঁকে তিন হাজার টাকা মাইনে দিচ্ছে কি এমনি—এমনি? লোকগুলোকে আপনি বলা, চা খাওয়ানো—এ সবই হয়তো কৌশল, সহজে কাজ হাসিল করার চেষ্টা। একটা জটিল সমস্যার সহজ মীমাংসা করতে পারলে তিনি মালিকের কাছ থেকে বাহবা পাবেন—সেইজন্যই কি দেশের খাদ্যসমস্যার উল্লেখ করে তাঁর গলায় ওরকম আবেগ ফুটেছে?
আমি চৌধুরি সাহেবের পক্ষে নই। চৌধুরি সাহেব দেখছেন মালিকের স্বার্থ। যে-মালিক নিষ্কর্মাভাবে রাজস্থান বা গুজরাটে বসে থেকে মোটা মুনাফা ভোগ করছে। আমি কেন তার পক্ষে যাব? চৌধুরি সাহেবের আত্মীয় আমার বন্ধু, তার চিঠি আমি নিয়ে এসেছি—এবং আমি লিখিটিখি শুনে তিনি আমাকে খাতির করছেন। কিন্তু বিনা সুপারিশে যদি আসতাম, উনি আমাকে নিশ্চিত পাত্তাই দিতেননা। আমি একজন সাধারণ লোক—আমি কেন ঐ বুর্জোয়াদের পক্ষে যাব?
আমি কি ঐ গ্রাম্যলোকগুলোর পক্ষে? তাতেও আমার মন সায় দিচ্ছে না। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, বয়লারের জলকে বিষাক্ত বলা ওদের ইচ্ছাকৃত গুজবরটনা। গরু মরার খবরটা মিথ্যে। লোকগুলোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়—ওরা অলস আর ধূর্ত। খেটে খাব শ্রমের যথার্থ মূল্য চাইব—এরকম কোন মনোভাব ওদের নেই। এখানকার জমিতে কঠিন পরিশ্রম করে ফসল ফলাতে হয়—সেই পরিশ্রম এড়াতে চাইছে। গ্রামের সরল, নির্যাতিত চাষা এদের কিছুতেই বলা যাবেনা। আবার জমি চাষ করলেই যদি প্রমাণ হয়—জমি নষ্ট হয়নি—সেইজন্য চাষের কথা তুলতেই চাইছেনা। ভাবখানা এই, এজেণ্ট সাহেবকে এবার খুব প্যাঁচে পাওয়া গেছে—ওঁর কাছ থেকে যতটা পারা যায় টাকা খিঁচে নিয়ে তারপর পায়ের ওপর পা দিয়ে খাওয়া যাবে! যদি রাজি না হয় তাহলে আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘটের ভয় দেখালেই হবে। না, ঐ নিষ্কর্মা মতলববাজগুলোর পক্ষ সমর্থন করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি কোন দলেই যেতে পারবনা। আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত, মাঝখানে ঝুলে থাকাই আমার নিয়তি। আমার বুকের মধ্যে একটা অপ্রয়োজনীয় বিবেক আর গুচ্ছের যুক্তি ঠাসা। সুযোগ পেলে, ঐ দুজনই আমাকে লাথি মারবে
ধুত্তোর! এর চেয়ে খনিতে নেমে অন্ধকারে ঘুরলে অনেক বেশি ভালো লাগত!