নীললোহিতের অন্তরঙ্গ – ৮

এই সময়টায় ওদের দেখলেই চেনা যায়, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ এই চারমাসে বাংলাদেশে যে হাজার-হাজার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, এখন এই শরৎকালে তাদের দেখলেই বোঝা যাবে—তারা অন্যসব মেয়ের চেয়ে আলাদা। তারা আর কুমারী নয়, তারা এখনও গিন্নী নয়, তারা নতুন বউ। তাদের পা এখন পৃথিবীর মাটি ছোঁয় কী ছোঁয়না।

তাদের মাথায় সিঁথির সিঁদুর বড় বেশি গাঢ়, অনভ্যস্ত হাতে সিঁথি ছড়িয়ে চুলের মধ্যেও ছড়ানো সিঁদুরের গুঁড়ো—সেইসঙ্গে মুখেও একটা অরুণ আভা সবসময়। হাতের সোনার গয়না অন্যদের চেয়ে বেশি ঝকঝকে, এখন প্রত্যেকদিন তারা এক-একটা নতুন শাড়ি পরে রাস্তায় বেরোয়, পায়ের চটিজোড়াও নতুন, ব্লাউজ নতুন। অর্থাৎ নতুন বউদের সবই নতুন। গায়ের চামড়াও নতুন রং ধরেছে মনে হয়, ঠোটে নতুন রকমের হাসি, পাশের নতুন লোকটির দিকে মাঝে-মাঝে চোরা চাহনি—এইসব মিলিয়ে ওদের আলাদা করে চেনা যায়।

এই লগনশা’য় আমার চেনা পাঁচটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। দুজন নেমন্তন্ন করেছিল, আর তিনজন ভুলে মেরে দিয়েছিল। তা নেমন্তন্ন করুক আর না-করুক, প্রত্যেকের বিয়ের দিনই আমি বিষণ্ন বোধ করেছি। সত্যিকথা বলতে কী, পৃথিবীর যাবতীয় কুমারী মেয়ের বিবাহ সংবাদেই আমি ব্যক্তিগত ক্ষতি অনুভব করি। যেমন, পৃথিবীতে তো প্রতিদিন অসংখ্য শিশু থেকে বৃদ্ধ ব্যক্তির মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু কোন কুমারী মেয়ের মৃত্যুর কথা শুনলে আমি আমার বুকে দারুণ শেলের আঘাত পাই। মনে হয়, পৃথিবীর পক্ষে এ-ক্ষতি অপূরণীয়।

যাইহোক, যে-পাঁচজনের বিয়ে হয়ে গেল, তাদের মধ্যে দুজন বিয়ের পরই চলে গেল কলকাতার বাইরে, একজন শিলং আর অন্যজন মাদ্রাজ—সুতরাং আমার চোখে তাদের কুমারী জীবনের ছবিই জেগে রইল। বাকি তিনজনের মধ্যে রত্নার বিয়ে হয়েছে এক বনেদী পরিবারে—তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা কম। দেখা করার জন্য আমি যে খুব উদ্‌গ্রীব—তাও তো নয়, আমি তো আর একসঙ্গেই সব কুমারীর ব্যর্থ প্রেমিক হতে পারিনা। ওরা কেউ আমার প্রেমিকা ছিলনা, কিংবা আমাকে প্রেমিক হবার সুযোগ দেয়নি, তবু ওদের বিবাহজনিত আমার যে বিষণ্ণতা, সেটা একটা অন্যরকম ব্যাপার—আমি তার ব্যাখ্যা করতে পারবনা।

স্নিগ্ধার সঙ্গে দুবার দেখা হল এরমধ্যে। স্নিগ্ধার বরটি বেশ নাদুসনুদুস, মুখে একটা বিগলিত হাসি, তার পাশে স্নিগ্ধা যেন হাওয়ায় উড়ছে। চাঁপারঙের বেনারসীর আঁচল হাওয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে আনতে স্নিগ্ধা হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে অযাচিতভাবে উচ্ছল হয়ে বলল, আরে আপনি? কী খবর? বিয়েতে আসেননি কেন?

স্নিগ্ধা ভুলে গেছে যে ও আমাকে নেমন্তন্নই করেনি, কিন্তু সেকথা তো মনে করিয়ে দিতে পারিনা এখন। তাই আমাকে লাজুক মুখে বলতে হল, না, ইয়ে, খুব দুঃখিত, খুব যাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু একটা বিশেষ কাজ

স্নিগ্ধা তার বরের দিকে ফিরে বলল, ঐ যে টুটু মাসি, টুটু মাসিকে মনে আছে তো? যিনি সেই বউভাতের দিনে একটা কইমাছ পাড় শান্তিপুরী শাড়ি পরে এসেছিলেন, সেই যে আসানসোলে ওঁর বাড়িতে যাবার জন্য আমাদের নেমন্তন্ন করেছেন—তার দেওরের ছেলে নীলুদা, আমাদের সঙ্গে একবার থিয়েটার করেছিলেন। নীলুদা, আসবেন একদিন আমাদের বাড়িতে, নিউ আলিপুরের ও ব্লক, এ-সপ্তাহে না, সামনের মাসে একদিন—আমরা হায়দারাবাদে হনিমুনে যাচ্ছি (এইসময় একটু মুচকি হাসি)—ফিরে এলে তারপর—

স্নিগ্ধার কী বদল হয়েছে এই ক’দিনে! আগে স্নিগ্ধা ছিল খুব শান্ত ধরনের মেয়ে, বেশি কথা বলতনা, কখনো জোরে শব্দ করে হাসেনি—বিয়ের একমাসের মধ্যেই স্নিগ্ধা অজস্র কথায় উচ্ছ্বসিত। একাই সবকিছু বলে যাচ্ছে, হায়দারাবাদে হনিমুনের কথা, নিউ আলিপুরে ওদের ফ্ল্যাট কত সুন্দর, ‘ওর’ অফিস থেকে শিগগিরই গাড়ি দিচ্ছে—স্নিগ্ধা যেন তার গয়নার ঐশ্বর্য এবং শাড়ির জৌলুষের সঙ্গে-সঙ্গে কায়দা আমাকে দেখিয়ে, দ্যাখো, আমার স্বামীও কত ভালো লোক–তোমার মতন একটা রোগা আর কালো চেহারার বাউণ্ডুলের তুলনায় আমার স্বামী কীরকম রূপবান দেবতা।

আশ্চর্য মেয়েদের মনস্তত্ত্ব। আমি কি কোনদিন স্নিগ্ধার পাণিপ্রার্থী ছিলাম? কক্ষনোনা! তাহলে আমার কাছে ওর এত স্বামীগর্ব করে কী লাভ? ও বুঝি হিংসে আমার বুক ফাটিয়ে আনন্দ পেতে চায়? কিন্তু এই ফাটা বুক আর কত ফাটবে?

পূরবী আবার অন্যরকম। পূরবীর একটু-একটু দুর্বলতা ছিল আমার সম্বন্ধে আমিও তাতে খানিকটা প্রশ্রয় দিয়েছি। কোন-কোন নম্র গোধূলিতে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পূরবী আর আমি মৃদুস্বরে কথা বলেছি। শুধু কথাই, তার বেশি আর এগোয়নি। যেসব স্থান পূরবীর ভালো লাগত, সেগুলো আমার প্রিয়। হাজারীবাগের ক্যানারি হিল থেকে দেখা সূর্যাস্ত আমার ভালো লেগেছিল, পূরবীর সঙ্গে তো মিলে গেল। কোথাও ভিড়ের মধ্যে আমাকে দেখলে পূরবী এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বলত, কখনো-বা হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত ভিড় থেকে আড়ালে। তবে শুধু ঐটুকুই, তার বেশিনা।

সেইরকমই এক নম্র গোধূলিতে পূরবীর সঙ্গে আমার দেখা হল রাসবিহারীর মোড়ে। বিয়ের পর পূরবীকে এই প্রথম দেখলাম। সিঁদুরের আভায় তার মুখখানি আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। পূরবীর স্বামী ছিল না, পাশে যে মেয়েটি—সে বোধহয় তার ননদ বা ঐরকম কিছু, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল পূরবীর-সঙ্গে-সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিল—একটা কথাও বললনা, না-চেনার ভঙ্গিতে চলে গেল। আমি আমার ঠোটের উদ্যত কথা ফিরিয়ে নিলাম। আমি পূবরীকে অভিনন্দন জানাতে যাচ্ছিলাম—কী ক্ষতি হতো পূরবীর—একটা কথা বললে! পূরবী কোনদিনই তো এমন আড়ষ্ট সংস্কারগ্রস্ত ছিলনা। কিন্তু একটি মেয়ে, কুমারী অবস্থায় যার সঙ্গে আমি কোনদিন একটা কথাও বলিনি, নতুন বিবাহিতা হিসেবে তাকে যেদিন দেখলাম, সেদিন আমি একমুখ হেসে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, বললাম, আরে, বাঃ কবে হল? মেয়েটি উত্তর না দিয়ে লাজুকভাবে হাসল।

মেয়েটির সঙ্গে আমার কোনদিন আলাপই হয়নি, আমি তার নামও জানিনা। মেয়েটিও আমার নাম জানেনা। দীর্ঘ তিনবছর মৌলালির মোড়ে একটা অফিসে আমি চাকরি করতাম—প্রতিদিন ঠিক দশটা বেজে দশে বাসে উঠতাম শ্যামবাজার থেকে। রামমোহন লাইব্রেরির সামনে থেকে মেয়েটি। প্রত্যেকদিন ওকে দেখেছি, প্রত্যেকদিন রামমোহন লাইব্রেরির স্টপ এলে আমি মেয়েটির জন্য উঁকি মেরে দেখতাম। একটু কালো, ছিপছিপে চেহারা লাবণ্যমাখা মুখে মেয়েটিকে প্রত্যেকদিন দেখা এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল যে, এক-আধদিন ওকে না-দেখলে চিন্তিত হয়ে পড়তাম। মেয়েটিও দেখত নিশ্চয়ই আমাকে—আমি দরজার সামনে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে মেয়েটির জন্য জায়গা করে দিতাম। এক-একদিন কণ্ডাকটরকে চেঁচিয়ে বলেছি, রোককে, রোককে, জেনানা হ্যায়! যেন আমারই কোন আত্মীয়া। কিন্তু কোনদিন একটাও কথা হয়নি।

আজ মেয়েটিকে নতুন সিঁদুর-পরা ও নতুন বেনারসী-পরা চেহারায় সিনেমা হলের সামনে দেখে আচমকা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আরে! বাঃ! কবে হল? মেয়েটি লাজুকভাবে মুখ নিচু করল—তারপর আবার মুখ তুলে বলল, গতমাসের সাত তারিখে। মেয়েটি আবার হাসল, আমিও হাসলাম। জীবনে আর আমাদের কোন কথা হবেনা—শুধু একঝলক অনাবিল খুশির বিনিময় হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *