গ্লানির্ভবতি ভারত – ৫

অরণ্যপ্রান্তে এক চতুষ্পাঠী। চতুষ্পাঠী বলতে একটি মৃৎকুটির। বাঁশ-দড়ি -খড় দিয়ে বানানো। মাটির দেওয়াল। সযত্নে নিকনো মেঝে। বাইরে একটি বড় কাপড়ের ওপর জ্বলজ্বল করছে রক্তরঞ্জিত হস্তাক্ষর, “নারায়ণী চতুষ্পাঠী।’

সেই কুটিরের একেবারে বাইরে দণ্ডায়মান প্রহরীসম দুই আমগাছ।

কুটিরের সামনের অনেকটা জায়গা জুড়ে লম্বা চাটাই বিছনো। সেখানে বসে এখন পাঠ অধ্যয়ন করছে বেশ কয়েকজন ছাত্র। তরুণ শিক্ষক মহাশয় বসে আছেন কুটিরের বাইরে একটি বেদিতে। তিনি এই চতুষ্পাঠীরই বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র। তাঁর কাজ কনিষ্ঠদের বেদ অধ্যয়নপ্রস্তুতির বিদ্যাদান করা। তিনি মৃদুভাষ্যে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। একপাশে পড়ে রয়েছে বেত্রদণ্ড।

শিক্ষক থেকে ছাত্র, প্রত্যেকের মস্তক মুণ্ডিত। মাথার পেছনে ঝুলছে দীর্ঘ ব্রহ্মশিখা। সকলেরই পরনে ধুতি ও ফতুয়া।

চতুষ্পাঠী অর্থাৎ যেখানে চার বেদের পাঠ দেওয়া হয়। শুধুই চতুর্বেদ নয়, সঙ্গে পড়ানো হয় ষড়ঙ্গ। অর্থাৎ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। পড়ানো হয় ষড়দর্শন। অর্থাৎ, সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক, যোগ, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা। বিভিন্ন উপনিষদ ও সংহিতা। চারটি শ্রেণীতে প্রায় সত্তরটি ছাত্র পড়াশুনো করে।

কুটিরের একবারেই পাশে পূজামণ্ডপ। আটচালা ঘর। সেই ঘরের ভেতরে চলে উঁচু শ্রেণীর ছাত্রদের শিক্ষা। এই চতুষ্পাঠীর গুরুমহাশয় স্বয়ং সেখানে পড়ান নব্যন্যায়, বেদান্তের মতো পাঠ। পাঠান্তে ছাত্রদের বসতে হয় ন্যায়, তর্ক বা স্মৃতিশাস্ত্রের পরীক্ষায়। অতি পারদর্শিতার প্রমাণ মিললে তখন তারা কেউ ভূষিত হয় ‘ন্যায়রত্ন’ আখ্যায়, কেউ ‘তর্কবাগীশ’, আবার কেউ বা ‘কাব্যতীর্থ’তে।

আজ অবশ্য একটি ব্যতিক্রমী দিন। তরুণ শিক্ষক বললেন, “আজকের মতো পাঠ এখানেই সমাধা হল বাবা সকল। মধ্যাহ্নভোজ দ্রুত সেরে নাও। আজ গুরুদেব পদধূলি দিয়েছেন এখানে। তিনি স্বয়ং তোমাদের জ্ঞানের পরীক্ষা নেবেন।”

ছাত্ররা সকলেই তেরো-চোদ্দো বছর বা তার নীচের বালক। শিক্ষকের কথা শুনে তাদের মুখে ভয়ের ছাপ পড়ল। নিজেদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন করতে করতে তারা আসন গুটিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর সারিবদ্ধভাবে চলল অদূরে অবস্থিত ভোজনশালার দিকে।

ঘন অরণ্য কেটে প্রসারিত করা হয়েছে এই বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। চতুষ্পাঠীর পাশেই রন্ধনশালা, ভাণ্ডারঘর। পাচকেরা সেখানে ইতিমধ্যেই সার দিয়ে বিছিয়ে দিচ্ছে কলাপাতা।

আয়োজন সামান্য কিন্তু পুষ্টিকর। ভাত, চালকুমড়োর বড়া, আমড়া-মুকুলের মটর ডাল, লাউসেদ্ধ, জলপাইয়ের মাখা চাটনি। শেষপাতে সামান্য ক্ষীর।

সবই পার্শ্ববর্তী খেতের উৎপন্ন হওয়া ফসল। এছাড়া ভাণ্ডারঘরের পাশেই রয়েছে গোশালা।

আহার প্রারম্ভের আগে সবাই করজোড়ে একসঙ্গে বলতে লাগল, “ওঁ শ্রী জনার্দনায় নমঃ। ওঁ শ্রী জনার্দনায় নমঃ। ওঁ শ্রী জনার্দনায় নমঃ।”

সারিতে একেবারে প্রথমে বসা দ্বাদশবর্ষীয় বালকটি তার সহপাঠীকে অস্ফুটে বলল, “একিরে দ্বারিকা, আজ নিরামিষ ব্যঞ্জন? ধুর!”

দ্বারিকা নামক বালকটি প্রত্যুত্তর করল, “এই অচ্যুত! এসব কী বলছিস? আজ না একাদশী? তার ওপর ভরণী নক্ষত্রে অতিগন্ড যোগ। আমিষ খাওয়া যে মহাপাপ রে! উপনয়ন হয়েছে পাঁচমাসও পুরেনি।”

“আমিষ না থাক, একটু আলু দিলেও তো পারে বল!” অচ্যুত ঠোঁট উল্টে বলল।

“আলু?” দ্বারিকা ভ্রূ কুঞ্চিত করল, “মানে আলো? আতপ চাল?”

“ধুস! আলু এক ধরনের সবজি। তরিতরকারিতে দেওয়া হয়।” অচ্যুত সামান্য গলা নামিয়ে বলল, “দারুণ খেতে শুনেছি। বাইরে সবাই খায়।”

ভয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে উঠল দ্বারিকার মুখ, “বাইরে! সেটা তুই … তুই জানলি কী করে?”

“না জানার কি আছে? মধুসূদনদা’রা গিয়ে মাঝে মাঝেই বাইরের জল বাতাস খেয়ে আসছে, আর আমরা জানলেই দোষ?” অচ্যুত রহস্যময় হাসি হেসে কথাটা গিলে ফেলল, “ভালো লাগেনা। খেয়েদেয়ে কোথায় একটু শীতলপাটি বিছিয়ে ঘুম দেব, তা না। আবার ওই রোদের মধ্যে গিয়ে বসে থাকো।”

দ্বারিকা এবার ভয়ার্তমুখে এদিক ওদিক তাকাল। চতুষ্পাঠীতে নিয়ম শৃঙ্খলা অতি কঠোর। তার ওপর আজ বুধবার। প্রতি বুধবার গুরুদেব স্বয়ং অধিষ্ঠান করেন এখানে। বয়োজ্যেষ্ঠ শিষ্যরা চারদিকে তাই অতিসতর্ক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনোরকম বেচাল দেখলে তৎক্ষণাৎ অভিযোগ যাবে গুরুদেবের কাছে।

আর তারপর? দ্বারিকা সেই ভয়ঙ্কর শাস্তিগুলোর কথা ভেবে ভীত হয়ে উঠল। কথা না বাড়িয়ে সে আহারে মনোনিবেশ করল।

অচ্যুত ওইরকমই, কোনো ভয়ডর নেই। কিন্তু ওর আছে।

ভোজন সারা হলে ওরা গিয়ে আবার বসল কুটিরের সামনের চাতালে।

কিছু পরেই এলেন গুরুদেব। ওদের এই বৈদিক সমাজের প্রধান। যদিও তিনি সর্বক্ষণ এখানে থাকেন না। সমাজের কল্যাণার্থে তাঁকে নানাস্থানে পরিভ্রমণ করতে হয়। সমগ্র বৈদিক সমাজ এই বুধবারের পুণ্যদিবসে তাঁর সাক্ষাৎ পায়। মঙ্গলবার গভীর রাতে তিনি আসেন, আবার বুধবার গভীর রাতে চলে যান। আগে তাঁর আসা অনিয়মিত হলেও গত একবছর ধরে সাপ্তাহিক এই আগমন সুনির্দিষ্ট। তাঁর আগমন ও প্রস্থানলগ্নে উপাসনামন্দির থেকে সজোরে বেজে ওঠে শঙ্খ।

গুরুদেবের বয়স পঞ্চাশোর্ধ, কিন্তু চেহারা ঋজু। তিনি দীর্ঘাঙ্গী, পুরুষ্টু শ্মশ্রুগুম্ফে লেগেছে শুভ্রতার ছাপ, তবু বয়স এখনো তাঁকে একটুও ন্যুব্জ করতে পারেনি। একটি ধবধবে সাদা ঘোড়ায় তিনি টহল দেন গোটা গ্রাম। সেই ঘোড়ার নাম দেবদত্ত। দেবদত্তকে দেখলে মনে হয় যেন কোন তেজী পক্ষীরাজ স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে মর্ত্যে। দেবদত্ত যখন গুরুদেবকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে বিচরণ করে, তখন গ্রামের প্রতিটি কুটির থেকে মানুষজন বেরিয়ে আসে। দূর থেকে পরমভক্তিতে তারা প্রণাম করে এই সিদ্ধপুরুষকে।

নারায়ণী চতুষ্পাঠীর এই শ্রেণীর ছাত্ররা যখন ছোট ছিল, তখন গুরুদেবের অন্য একটা ঘোড়া ছিল। তার নামও ছিল দেবদত্ত। সে মারা যেতে সমস্ত লক্ষণ মিলিয়ে একে আনা হয়েছিল।

ঘোড়া পালটায়, নাম একই রয়ে যায়।

দেবদত্তর পৃষ্ঠদেশ থেকে লাফিয়ে নামলেন গুরুদেব। গম্ভীর মুখে উঠে এলেন নারায়ণী চতুষ্পাঠীর চাতালে।

ছাত্রদের যিনি নিয়মিত শিক্ষাদান করেন, সেই তরুণ শিক্ষক প্রণাম করলেন গুরুদেবকে। দেখাদেখি ওরাও। গোটা চাতাল নিঃশব্দ।

ওরা সকলে গুরুদেবকে প্রতি বুধবার প্রত্যুষের সূর্যপ্রণামের সময় দেখতে পায়। প্রধান পুষ্করিণীতে স্নান সেরে গুরুদেব পূর্বে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করেন। উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন,

 ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতি্

 ধ্বান্তারিং সর্ব্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।

 উষা উদ্ধন্তি সমিধানে অগ্না উদ্যনৎ সূর্য উর্বিয়া জ্যোতিরশ্রেৎ।

 দেবো নো অত্র সবিতা ন্বর্যং প্রাসাবীদ্বিপৎত্র চতুষ্পসদিত্যৈ।।

ওদের রোমকূপ শিহরিত হয়ে ওঠে। দূর থেকে সসম্ভ্রমে প্রণাম করে ওরা। শুধু ওরা নয়, ওদের বাবা মা-রাও। ওদের এই সমাজের সকলে দেবজ্ঞানে ভক্তি করে গুরুদেবকে।

সারাবছরে চলা নানা পুণ্য তিথির মধ্যে একমাত্র মহোৎসবেই উপস্থিত থাকেন গুরুদেব। সেইদিন ওরা সকলে তাঁর পবিত্র পদস্পর্শ করার অনুমতি পায়।

গুরুদেব আসনে বসলেন না। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে দেখলেন গোটা শ্রেণীকে। স্মিতমুখে বললেন, “জয় কৃষ্ণ! কেমন শাস্ত্র অধ্যয়ন হচ্ছে বাবাসকল? মধুসূদন কেমন পড়াচ্ছে তোমাদের?”

ওরা প্রত্যেকে ইতিবাচক মাথা নাড়ল। মধুসূদন নামক তরুণ শিক্ষক আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

গুরুদেব বললেন, “বেশ। প্রথমে সামান্য পরীক্ষা নিই। তুমি বলো তো বাবা, আগম ও নিগম কী?”

যাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নবাণ, সেই বালক উঠে দাঁড়াল। করজোড়ে প্রণাম করে বলল, “আগম ও নিগম বেদেরই অন্য দুই নাম, গুরুদেব।”

“হেতু? বেদের সঙ্গে কী এদের সম্পর্ক?”

“আগম অর্থাৎ যা ঐতিহ্যরূপে আমাদের কাছে এসেছে। আর যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে, তাই নিগম। বেদ কথাটির উৎপত্তি ‘বিদ’ ধাতু থেকে। অর্থাৎ জানা।” ছাত্রটি গড়গড় করে বলে গেল।

সে এই শ্রেণীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাত্র। নাম বনমালী।

“বেশ। আরণ্যক কী?”

বনমালী এবারও আলোকিতমুখে বলে গেল, “বেদ চারপ্রকার। ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। এই প্রতিটি বেদ আবার চার অংশে বিভক্ত। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। আরণ্যক অংশে রয়েছে বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা।”

“উত্তম। অতি উত্তম!” গুরুদেব একবার প্রশান্তির হাসি হাসলেন, “তুমি বসো বাবা। মহাপণ্ডিত হও। আচ্ছা, তুমি ওঠো তো।”

অকস্মাৎ আহ্বানে তিরবিদ্ধ পক্ষীর মতো উঠে দাঁড়াল দ্বারিকা। তার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছে। কোনোমতে সে করজোড়ে প্রণাম করল।

“বৃহদারণ্যক উপনিষদ কে প্রণয়ন করেন?”

দ্বারিকা প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে রইল। সে যেন থমকে গিয়েছে। উপনিষদ রয়েছে দুশোরও বেশি, বিভিন্ন সময়কালে রচনা করেছেন বিভিন্ন ঋষি। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বাইশটি হল প্রাচীনতম। বৃহদারণ্যক উপনিষদও সেই বাইশটির মধ্যে একটি।

ঈশোপনিষদ, কেনোপনিষদ, মান্ডুক্য উপনিষদ, ঐতরেয় উপনিষদ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ, প্রতিটির প্রণেতার নাম মনে পড়ছে দ্বারিকার, কিন্তু এই অতিসহজ প্রশ্নের উত্তরটা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। তার জিহ্বা জড়িয়ে যেতে লাগল, হাতের তালু ঘর্মাক্ত হতে শুরু করল।

“কী হল বাবা? বলো?”

“ঋষি … ঋষি বাল্মীকী?” মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল দ্বারিকার। আর বলামাত্র অনুভব করল, বড় ভুল হয়ে গেল।

গুরুদেব বিস্মিত, “রামায়ণের প্রণেতা মহাকবি বাল্মীকিকে দিয়ে তুমি উপনিষদ রচনা করাচ্ছ, বাবা?”

লজ্জায় অধোবদন হয়ে দ্বারিকা যুক্তকর গরুড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

 ”বোসো। আর তুমি?” ব্যথিত গুরুদেব এবার পাশে বসে থাকা অচ্যুতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন, “তুমি এর কী উত্তর দেবে? ব্যাসদেব?”

অচ্যুত উঠে দাঁড়াল। প্রণাম টণামের বালাই নেই। ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে সে বলল, “কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস কেন লিখতে যাবেন? বৃহদারণ্যক উপনিষদ তো রচনা করেছিলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। যাকে গার্গী জনকরাজার সভায় প্রায় হারিয়েই দিয়েছিলেন, নেহাত যাজ্ঞবল্ক্য কায়দা করে বেরিয়ে গেলেন তাই!”

“কায়দা করে?” গুরুদেব বিস্মিত হলেন। তাঁর চতুষ্পাঠীতে এইরকম শব্দ কেউ ব্যবহার করার স্পর্ধা দেখায় না।

“তা নয়তো কী?” অচ্যুত বলে যেতে লাগল, “যেই যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীর ব্রহ্ম কোথায় ওতপ্রোত রয়েছে-র উত্তর দিতে পারলেন না, অমনি বলে উঠলেন, “গার্গী! মা অতিপ্রাক্ষীঃ! অতিপ্রশ্ন করোনা গার্গী। তোমার মাথা খসে পড়বে। একজন নারীর কাছে পরাস্ত হতে আসলে তাঁর পুরুষ অহং বাধা দিচ্ছিল।”

গুরুদেব বিস্মিত হলেন। বালকের অর্বাচীন শব্দ ব্যবহার সত্ত্বেও অবাক হলেন শাস্ত্র অতিক্রম করে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও মতামতের প্রসার দেখে। এমন বালকই সম্পদ। জ্ঞানী অথচ তেজি।

কিন্তু সামান্য ভুলচালনায় বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। নিজস্ব চিন্তাভাবনাই বিপদের উৎস।

তিনি মুখে বললেন, “উত্তম। বোসো। আমি জানি, গোবর্ধন বা মধুসূদনরা তোমাদের উত্তম শিক্ষা দিচ্ছে। তবু আজ সময় এসেছে আরও বিশদ জানার। আজ থেকে আমাদের আরাধ্য পরমগুরু সম্পর্কে প্রতি বুধবার আমি তোমাদের কিছু কিছু বলব। কলিযুগের এক অত্যন্ত পুণ্যলগ্নে তিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ধন্য করেছিলেন মর্ত্যলোককে। এতদিন তোমরা শুধু তাঁকে উপাসনা করে এসেছ, বিষ্ণু মন্দিরের বাইরে স্থাপিত তাঁর মৃন্ময় মূর্তিকে আরাধনা করেছ। তিনি স্বয়ং ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।

“আজ তাঁর মানবরূপ সম্পর্কে বলব তোমাদের। বলব অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম সুপণ্ডিত সম্বন্ধে। বলব, তাঁর অসম্পূর্ণ ক্রিয়ার বিষয়ে। প্রথমেই বলব, পরম গুরুর জাগতিক নাম কী ছিল।”

অচ্যুত বলে উঠল, “আমি জানি। জগন্নাথ! জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।”

গুরুদেব প্রবল বিস্ময়ে পাশে দণ্ডায়মান তরুণ শিক্ষক মধুসূদনের দিকে তাকালেন, “একি! পরমগুরুর পার্থিব নাম কি তুমি আগেই বলে দিয়েছ? আমার কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও?”

মধুসূদন সভয়ে মাথা নাড়লেন। আশ্রমের নিয়ম, আশৈশব ছাত্রদের পরম গুরুকে আরাধনা করা শেখানো হবে, তারপর এক শুভতিথিতে গুরুদেব স্বয়ং সব জানাবেন। তার অন্যথা হওয়া যে গুরুতর অপরাধ!

তিনি বললেন, “না গুরুদেব। আমি একবারও ওই নাম উচ্চারণ করিনি এদের সামনে। প্রত্যয় না হলে আপনি প্রশ্ন করুন অন্য ছাত্রদের।”

মধুসূদনের কথা মিথ্যা নয়। অন্য কোনো ছাত্রই পরম গুরুর নাম আগে শোনেনি।

“তবে তুমি? তুমি কোথা থেকে জানলে?”

অচ্যুত চুপ করে রইল। তারপর বলল, “উপাসনাগৃহে একদিন আলোচনা হচ্ছিল। আমি পিছনের জানলা দিয়ে শুনেছি। অন্যায় হয়ে গিয়েছে গুরুদেব। আর হবে না।”

গুরুদেব এই কিশোরের স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন। পরক্ষণে তাঁর মনে হল, রাজমণ্ডপে আড়ি পাতার মতো অচিন্ত্যনীয় অপরাধ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে এই কিশোর, তাতে এখন সর্বসমক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখালে অন্য বালকদেরও সেই ইচ্ছা হতে পারে। বয়সটাই যে এই। নিষেধ যেদিকে, সেইদিকে পতঙ্গের মতো ছুটে যেতে চায় মন। তার থেকে ব্যবস্থা গোপনে নিতে হবে।

তিনি মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। বললেন, “আমি গল্পচ্ছলে পরম গুরুর কীর্তি তুলে ধরব তোমাদের কাছে। তবেই তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে তোমাদের সুবিধা হবে। শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের নবরত্নসভার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে,

তার ছিল নবরত্ন ইহার সে রূপ

সভাস্থের কিবা কার নিজ বিদ্যাকূপ।।

সাক্ষাৎ বরদাপুত্র নামে জগন্নাথ

তর্কপঞ্চাননরূপে ভুবনবিখ্যাত।।”

কথা শেষ করে কপালে দুই হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন গুরুদেব। চোখ বন্ধ করে বললেন, “তিনি জগন্নাথ। তিনিই শ্রীকৃষ্ণ। ঈশ্বর শ্রী শ্রী জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।”

ষষ্ঠ খুনটা হয়েছে ত্রিবেণীর ভট্টাচার্য পাড়ায়। জয়ন্তর চেনা, তাই সটান দোকানের সামনে সরাসরি উপস্থিত হতে অসুবিধা হল না। আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল, ত্রিবেণী থানার ওসি দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকলেন। বললেন, “কমিশনারেট থেকে ফোন এসেছিল ম্যাডাম। আমি ত্রিবেণী থানার অফিসার ইন চার্জ সুকেশ সান্যাল। এদিকে আসুন।”

ভট্টাচার্যপাড়াটা ছিমছাম একটি পাড়া। পরপর একতলা দোতলা বাড়ি। সামনে পেছনে সবুজ গাছগাছালি। পাতকুয়ো। বাগান। কোনো ফ্ল্যাটবাড়ি তেমন চোখে পড়ছে না। এই দোকানটাও একটা প্রকাণ্ড বাড়ির সামনের অংশে। দোকানের সামনে তিন-চারমিটার ব্যবধানে পুলিশ থেকে ব্যারিকেড দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যারিকেডের এপারে জটলা করেছে পনেরো-কুড়িজন মানুষ। তাঁদের মুখে আতঙ্ক।

জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে সেই জটলায় দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, অনুপমদা!”

অনুপম নামক ভদ্রলোক মুখ ফেরালেন। বললেন, “ওহ, জয়ন্ত। দ্যাখো না, সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি এই কাণ্ড। ব্রিজেশকে কারা খুন করে গেছে। পাড়ার মধ্যে একি সাংঘাতিক ব্যাপার বলো তো! ব্রিজেশ তো লোক ভালো ছিল বলেই জানতাম, কারুর সাতে পাঁচে থাকত না বলো!”

জয়ন্ত কথা বলতে লাগল। রুদ্র ওসি সুকেশ সান্যালের সঙ্গে এগিয়ে গেল দোকানের দিকে।

বডি এর মধ্যেই নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে ময়না তদন্তের জন্য। যেখানটা বডি পড়েছিল, সেখানটা সাদা চক দিয়ে মার্ক করা। কালচে হয়ে শুকিয়ে রয়েছে রক্ত। ছোট বর্গাকৃতি দোকানে যে’কটা ইনভার্টার এবং ব্যাটারি রয়েছে, সেগুলো তোবড়ানো। ধারালো কিছু দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়েছে তাদের ওপর।

রুদ্র এগিয়ে গেল। ব্যাটারির ওপর যে আঘাত, তাতে কালচে ছোপ। আশপাশেই কিছু কালচে ছোপ লেগে রয়েছে।

সন্দেহ নেই, আততায়ী যে অস্ত্র দিয়ে ব্রিজেশ তিওয়ারিকে খুন করেছে, সেই অস্ত্র দিয়েই খুনের পর এগুলোর ওপর আঘাত করেছে। ও বলল, “কোনো শার্প ওয়েপন দিয়ে গলাটা কাটা হয়েছে। এই ব্লাড স্যাম্পলগুলো ফরেনসিকে পাঠান।”

“ওকে ম্যাডাম।” ওসি সুকেশ সান্যাল বললেন, “মনে হচ্ছে কাল রাত বারোটা নাগাদ মার্ডারটা হয়েছে। আমরা যখন এলাম, রাইগর মর্টিস শুরু হয়ে গিয়েছিল।”

রুদ্র বলল, “এই বাড়িটা তো বিশাল আর বহু পুরোনো দেখছি। ব্রিজেশ তিওয়ারিরই?”

সুকেশ সান্যাল মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই এগিয়ে এল জয়ন্ত, “না না। এ তো ত্রিবেণীর বিখ্যাত বাড়ি ম্যাডাম। এখন বহু শরিক থাকে। ব্রিজেশ একটা শরিকের অংশে ভাড়া থাকত। ওর আদি বাড়ি বিহারে, সেখানেই পরিবার থাকে। দোকানের অংশটাও ভাড়া নেওয়া।”

রুদ্র বাড়িটার দিকে তাকাল। প্রকাণ্ড বড় ঠাকুরদালান, তার একদিকে তালাবন্ধ পারিবারিক মন্দির। ঠাকুরদালানকে মধ্যিখানে রেখে প্রায় চার-পাঁচ বিঘার ওপর দানবাকৃতি প্রাসাদ। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এদিক ওদিক মাথা উঁচু করে রয়েছে বট-অশ্বত্থ গাছ।

একেকটা মহলের মাঝখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে আম কিংবা কাঁঠাল গাছের উপরিভাগ। বিশাল এই বাড়ির এদিক ওদিক জানলায় ও বারান্দায় জামাকাপড়ের অস্তিত্ব দেখে এটা স্পষ্ট যে, গোটা বাড়িতেই এখনো লোকজন বসবাস করেন।

বাড়িটার মধ্যে দিয়ে ঢুকে গিয়েছে সরু সরু গলি। সেই গলির ভেতরেও প্রসারিত হয়েছে এই প্রাসাদের শাখাপ্রশাখা।

রুদ্র কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে চারদিকে বাড়িটা দেখল প্রকাণ্ড অট্টালিকা। ঠাকুরদালানের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে যেন গোটা বাড়িটা গিলে খেতে আসছে।

একসময় ও বলল, “বিখ্যাত বাড়ি কেন?”

জয়ন্ত বলল, “এটা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বসতবাড়ি ম্যাডাম। উনিই এই গোটা বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। এখন অবশ্য প্রচুর শরিক। ভেঙে ভেঙে পড়ছে।”

“জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কে তিনি?”

জয়ন্তের মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল।

“একি ম্যাডাম, জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের নাম শোনেননি?” পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল ও, “অবশ্য ত্রিবেণীর লোকেরাই তাঁকে ভুলতে বসেছে, আর আপনি বাইরের মানুষ হয়ে জানবেন কী করে! ওইদিকে তাকান।”

বাড়ির দক্ষিণদিকে জয়ন্তর আঙুল বরাবর তাকিয়ে রুদ্র একখানা শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু দেখতে পেল। একজন মুণ্ডিত মস্তক ব্যক্তির আবক্ষ স্ট্যাচু। গায়ে উড়নি, মাথায় দীর্ঘ টিকি। নীচে একখানা ফলক।

ও এগিয়ে গিয়ে দেখল,

অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সুপণ্ডিত ও অসামান্য শ্রুতিধর

জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন

জন্ম ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ

মৃত্যু ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ

রুদ্রর একটা স্থানে চোখ আলাদা করে আটকে গেল। জন্ম – ১৬৯৫ সাল। মৃত্যু — ১৮০৭ সাল? মানে এই পণ্ডিত ১১২ বছর বেঁচেছিলেন?

জয়ন্ত রুদ্রর মনের কথাটা বুঝতে পেরে গেল। বলল, “হ্যাঁ ম্যাডাম। উনি ১১২ বছর বেঁচেছিলেন। শেষেও নাকি মারা যাননি, গঙ্গার ঘাটে স্বেচ্ছায় অন্তর্জলি যাত্রা করেছিলেন। অসম্ভব শ্রুতিধর এবং মহাপণ্ডিত ছিলেন। তখন তো সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান ছিল নবদ্বীপ। কিন্তু ইনি একাই নবদ্বীপের সেই ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিয়েছিলেন। ত্রিবেণীর জগন্নাথ ঘাটও ওঁর নামে। সারা ভারতবর্ষ একডাকে চিনত। গায়ে প্রচুর লোম ছিল। তাই লোকে বলত ত্রিবেণীর লোমশ পণ্ডিত। এঁর সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত মিথ চালু আছে ম্যাডাম। অবিশ্বাস্য অনেক কিংবদন্তী ঘোরে লোকমুখে। জানিনা সেগুলো কতটা সত্যি।”

“কীরকম?” রুদ্র জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, তার আগে সুকেশ সান্যাল এগিয়ে এলেন, “ম্যাডাম, আপনি কি দোকানের ভেতরটা আর দেখবেন? নাহলে আমরা শাটার নামিয়ে সিজ করে দেব।”

“হ্যাঁ আরেকবার দেখব। চলুন।”

ব্রিজেশ তিওয়ারির দোকানের ভেতরটা ছিমছাম। একদিকে একটা টেবিল, তার ওপরে পুরনো খবরের কাগজ, টেবিলের ড্রয়ারে হিসেবের খাতা। অন্যদিকের দেরাজে কয়েকটা ফাইল, তাতে কোম্পানির ক্যাশমেমো। ইনভার্টার বা ব্যাটারিগুলোর হামলা চললেও খাতাপত্র ফাইলগুলো অবিকৃত রয়েছে।

রুদ্র দেখতে দেখতে বলল, “জয়ন্ত, দোকানটা কতদিনের পুরোনো?”

জয়ন্ত বলল, “তিন-চারবছর।”

“ব্রিজেশ তিওয়ারি পাড়ার মধ্যে দোকান করেছিল কেন? এইসব দোকান সাধারণত বাজার তল্লাটে থাকে।”

“হ্যাঁ। আসলে আমাদের এই এলাকাটায় অনেকটা বড় জায়গা জুড়ে কোন ইনভার্টারের দোকান নেই, তাই হয়তো। আর ও বা ওর কর্মচারী খুব হেল্পফুল ছিল। যারা যারা ওর কাছ থেকে কিনেছে, সবার বাড়ি বছরে তিন-চারবার গিয়ে ফ্রিতে সার্ভিসিং বা জল ভরে দিয়ে আসত। তাই অল্পদিনেই বেশ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।”

রুদ্র জিজ্ঞাসুচোখে বলল, “ওর কর্মচারী? কোথায় সে? তাকে তো দেখিনি এসে থেকে!”

“বাড়ির মধ্যেই আছে। অলোক। ব্রিজেশ এখানে দুটো ঘর নিয়ে একা থাকত। যখন যে ওর দোকানে কাজ করত, সে একটা ঘরে থাকত।” সুকেশ সান্যাল বললেন, “একটু আগেই আমি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আপনি চাইছেন, আমি আবার ডেকে পাঠাচ্ছি। এই সুজিত, ডেকে আনো তো।”

একজন কনস্টেবল ডাকতে যাচ্ছিল, রুদ্র বাধা দিল, “না, আমরাই যাচ্ছি। ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরটাও দেখব।”

দোকানের পাশ দিয়েই দু’হাত চওড়া গলি। সেই গলি দিয়ে যেতে যেতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “যে শরিকের অংশে ব্রিজেশ ভাড়া থাকত, তার নাম কী?”

“সোমনাথ। সোমনাথ ভট্টাচার্য।” জয়ন্ত বলল, “জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের আসল পদবি ছিল ভট্টাচার্য। সোমনাথবাবু থাকেন মালদায়, সেখানে চাকরি করেন। তাই তাঁর অংশটা বরাবরই ভাড়া দেওয়া।”

ব্রিজেশের সহকারীর নাম অলোক। তার বয়স উনিশ-কুড়ি। ঘরের মধ্যে বসেছিল, পুলিশ আসামাত্র পাংশুমুখে এসে দাঁড়াল।

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

“অলোক যাদব।”

“বাড়ি কোথায়?”

“আসানসোলের কাছে, বার্নপুর।”

“এদিকে কবে এসেছ?”

“ব্রিজেশভাইয়া ডাকার পর, পাঁচ-ছ’মাস হল।”

“ব্রিজেশ তিওয়ারি তোমার আত্মীয় ছিল?”

“হ্যাঁ। আমার মায়ের এক চাচার ছেলে।”

“ব্রিজেশভাইয়া ডাকলেই তুমি চলে এলে কেন? কত টাকা মাইনে দিত তোমায়?”

“আমি বারোক্লাস পাশ করে এদিক ওদিক ধান্দা করছিলাম। ভালো কিছু পাচ্ছিলাম না। এদিকে ব্রিজেশ ভাইয়ের এখানে যে কাম করত, সে হঠাৎ কিছু না বলে চলে গিয়েছিল। তাই ব্রিজেশভাইয়া ডাকতেই চলে এসেছিলাম। থাকা ফ্রি, সঙ্গে মাসে ছ’হাজার।”

“কাল রাতে কী হয়েছিল? যতটুকু জানো, ডিটেইলে বলো।”

অলোকের মুখটা এবার কালো হয়ে গেল। বলল, “কাল রাতে আমি আর ব্রিজেশভাই একসাথে রাতের খাওয়া সারলাম। আমরা রান্নাবাড়া একসাথেই করতাম। রাতে রোটি পাকাতাম আমি, সবজি বানাত ব্রিজেশভাই। কাল রাতে খাওয়াদাওয়া মিটতে মিটতে সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছিল। নিজের ঘরে ফিরে আসি সাড়ে এগারোটা নাগাদ। তারপর আর আমি কিছু জানি না।”

“সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা, এই এক ঘণ্টা কী করছিলে?”

“ব্রিজেশভাইয়ার ঘরে বসে দুজনে টিভিতে গানা খাজানা দেখছিলাম। রোজই দেখি। দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা দেড় ঘণ্টা হয়।”

 ”ব্রিজেশ কখন দোকানে গেল, তুমি টের পাওনি?”

“না। আমাদের দুজনের ঘরের সামনেই তো বারান্দা। ব্রিজেশ ভাইয়া ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে গিয়েছে। চাবি ওর কাছেই থাকত। আমি সকালে উঠে ডাকতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। তখন দোকানের দিকে যাই। দেখি, শাটার অর্ধেক নামানো। আর …।” অলোকের গলা ধরে এল।

“তুমি রাতে কোন শব্দ পাওনি?” রুদ্র কথা বলতে বলতে অলোকের ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। আট বাই আটের খুবই বাহুল্যহীন ঘর। একপাশে একটা বড় ট্রাঙ্ক। দেওয়ালে গণেশের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার।

“না।” অলোক বলল, “আমি ঘুমিয়েছি বারোটার সময়। কোনো শব্দ পাইনি তখনও অবধি।”

রুদ্র ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে ওসিকে বলল, “ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরে চলুন। আর এই ছেলেটি যেন এখন স্টেশন লিভ না করে। জয়ন্ত, অলোকের আগে ব্রিজেশ তিওয়ারির কাছে কে কাজ করত?”

জয়ন্ত বলল, “এটা আমি ঠিক বলতে পারব না, কয়েকমাস এদিকে আসা হয়নি। এক মিনিট।”

মিনিট দুয়েকের মধ্যে আর এক বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন।

“ইনি আরেকজন শরিক। মধুময় ভট্টাচার্য। পাশেই থাকেন।”

মধুময়বাবু বললেন, “ব্রিজেশের দোকানে অলোকের আগে কাজ করত কানাই। বেশিদিন করেনি। ওই মাসচারেক। কোন এক গ্রাম থেকে দুম করে এসেছিল, আবার দুম করে উধাও হয়ে গেল।”

“দুম করে এসেছিল মানে?”

মধুময়বাবু বললেন, “আমি একদিন ব্রিজেশের দোকানে বসেছিলাম। দেখি একটা ছেলে সারাদিন সামনের ক্লাবের চাতালে জড়সড় হয়ে বসে আছে। বিকেলের দিকে ব্রিজেশ ডাকল। চা-বিস্কুট খাওয়াল। নাম বলল কানাই, অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে, বাড়িতে ঝগড়া করে চলে এসেছে। ব্রিজেশ এমনিতেও একটা কাজের ছেলে খুঁজছিল, কিন্তু বেশি পয়সা দিতে পারবে না বলে তেমন কাউকে পাচ্ছিল না। কানাইকে বলতে সে লুফে নিল প্রস্তাব।”

“তারপর?”

“তারপর কানাই কাজ করতে লাগল। এমনিতে খাটিয়ে ছেলে, ঘাড়ে করে ব্যাটারি বওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করত। কিন্তু একটু ক্যাবলা টাইপ। রোজ অন্তত তিনঘণ্টা ধরে পুজো-আচ্চা করত। আজকালকার জোয়ান ছেলে হয়ে ভাবাই যায়না। তারপর কারুর বাড়িতে ইনভার্টার সেট আপ করতে গেলেই গণ্ডগোল পাকাত। ইলেকট্রিকের কাজ করতে পারত না। হাত কাঁপত। বলতো, জন্মে অবধি ওদের গ্রামে এখনো কারেন্ট পৌঁছয়নি। তাই খুব ভয় পায়। এমনকি মোবাইলও ব্যবহার করতে পারত না। বাধ্য হয়ে ব্রিজেশ ওকে দোকানে রাখত, নিজে যেত লোকের বাড়িতে। এরকম করে চারমাস কাজ করল। তারপর একদিন ব্রিজেশ সকালে উঠে দেখে নেই। শেষ মাসের মাইনেটাও নিয়ে যায়নি। খ্যাপাটে হলে যা হয়।”

“কানাইয়ের কোন ছবি আছে? কিংবা ভোটার কার্ড জাতীয় পরিচয়পত্র?”

“আমার কাছে তো নেই। ব্রিজেশের কাছে ছিল কিনা জানিনা। তবে মনে হয় না আছে।”

রুদ্র জয়ন্তকে ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরটা আরও একবার ভালো করে সার্চ করার নির্দেশ দিয়ে এদিকে ফিরল, “ব্রিজেশ তিওয়ারির সঙ্গে আপনাদের বাড়ির কোনো শরিক বা ত্রিবেণীর কারুর কোনো শত্রুতা ছিল?”

“তেমন তো আমি কিছু জানিনা। এই বাড়িতে আর থাকে কজন। সবই তো প্রায় বাইরে। আমিই যা ভূতের মতো পড়ে রয়েছি! বাকি সব ঘরই প্রায় ভাড়া।”

রুদ্র মন দিয়ে শুনছিল। মধুময়বাবু থামতে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল, “আপনি জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কততম বংশধর?”

“আমি দশম প্রজন্ম।” মধুময়বাবু বললেন, “ওই যে দেখছেন ঠাকুরদালান, ওখানে এখনো দুর্গাপুজো হয়। শুরু করেছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন নিজে।”

“তাহলে তো অনেক পুরনো পুজো।”

“তিনশো বছর পুরেছে। শুনেছি, স্যার ওয়ারেন হেস্টিংস, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোন্সও এসেছিলেন এই দুর্গাপুজো দেখতে।”

“হুম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।” রুদ্র আর বাক্যবয় না করে নিহত ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরে ঢুকল। ঘরে টিভি, টেবিল-চেয়ার, আলমারি, মোটামুটি সবই রয়েছে। ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে রাতের এঁটো থালা-বাটি। চারদিক দেখতে দেখতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “ব্রিজেশ তিওয়ারির মোবাইলটা পেয়েছেন?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম।” ওসি বললেন, “ওটা সিজ করে নিয়েছি।”

“গুড। গতকাল রাতে কার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে, সারাদিন কতক্ষণ কার সঙ্গে কথা হয়েছে, সব ট্র্যাক করুন। কানাইয়ের আইডিটা খুঁজুন।” রুদ্র বিড়বিড় করল, “রাতের খাওয়ার পর ব্রিজেশ তিওয়ারিকে দোকানে যেতে হল কেন? কেউ কি তাকে ডেকেছিল?”

গুরুদেব বললেন, “মহাপুরুষের জন্ম যখন সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকে, তখন কোনোভাবেই তা আটকানো যায় না। এই প্রবাদ অক্ষরে অক্ষরে খাটে পরম গুরুর ক্ষেত্রে। কীভাবে তা বলি। ত্রিবেণীর পণ্ডিত রুদ্রদেব তর্কবাগীশ পাণ্ডিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করলেও মধ্যবয়সে অকস্মাৎ স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হতে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। তখন নিত্যানন্দপুরের অদ্বিতীয় জ্যোতিষাচার্য চন্দ্রশেখর বাচস্পতি বসবাস করতেন ত্রিবেণীরই পূর্বপল্লীর বান্দাপাড়ায়। সেখানেই তাঁর চতুষ্পাঠী। রুদ্রদেব তর্কবাগীশ তাঁকে গিয়ে বললেন, সংসারে থেকে অনেক কষ্ট পেলাম, শোকে আকুল হলাম, বংশও লোপ পেল। অধ্যাপনায় আর মনঃসংযোগ করতে পারছি না। কাশীধামে গিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই বাবা বিশ্বনাথের চরণে। আপনি কি বলতে পারেন, আমার অদৃষ্টে শীঘ্রই কাশীযোগ আছে কিনা? নাকি সেখানেও বাধা?”

চন্দ্রশেখর বাচস্পতি দীর্ঘক্ষণ হস্তগণনা করে বললেন, “কাশীবাস কী, পণ্ডিতমশাই! আপনার ভাগ্যে যে দিগ্বিজয়ী পুত্রলাভ রয়েছে! সেই পুত্র শুধু দেশজোড়া যশ ও প্রতিপত্তির অধিকারীই হবে না, আপনার বংশ দীর্ঘকাল ধরে বহমান হবে।”

গোটা নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে সূচিভেদ্য নিস্তব্ধতা। সকলে স্তব্ধ হয়ে শুনছে গুরুদেবের কথা। অদূরে দাঁড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে গুরুদেবের ঘোড়া। আরও দূর দিয়ে চার-পাঁচজন কৃষক গরু নিয়ে চলেছে শস্যক্ষেতের দিকে। আকাশে দেখা যাচ্ছে এক ঝাঁক পাখি যারা কোনও সীমানা মানে না।

“রুদ্রদেব তর্কবাগীশ এই কথা শুনে বললেন, “আমার মনে হয়, আপনার তীর্থযাত্রার সময়কাল উপস্থিত হয়েছে জ্যোতিষাচার্য! আপনি নাকি মুর্শিদাবাদে নবাবের নির্ভুল ভাগ্যগণনা করেছিলেন? তা সে-ও কি প্রতারণা করেই? আমার বয়স তেষট্টি বছর। আর আপনি বলছেন, আমি ভবিষ্যতে আবার পুত্রবান হব? রঙ্গরসিকতার একটা মাত্রা থাকা উচিত।”

“ক্রুদ্ধ হয়ে রুদ্রদেব চলে এলেন বটে, কিন্তু হলও তাই। নিকটস্থ গ্রাম রঘুনাথপুর নিবাসী ব্রাহ্মণ বাসুদেব বাচস্পতির কনিষ্ঠা কন্যাটি দশমবর্ষীয়া হয়ে গেলেও উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না, সেই বৈবাহিক প্রস্তাবই হঠাৎ এল রুদ্রদেবের কাছে। অকালবৈধব্যের আশঙ্কায় কন্যার মা অমত করলেও তা গ্রহণীয় হল না, রুদ্রদেবের সঙ্গে বিবাহ হল বাসুদেব কন্যা অম্বিকার।”

একটানা বলে গুরুদেব কিছুক্ষণের জন্য থামলেন। তারপর উজ্জ্বল মুখে বললেন, “তার একবছর পরেই আশ্বিনের মহাপঞ্চমীতে ভূমিষ্ঠ হল এক অসাধারণ শিশু। ইংরেজি সাল ১৬৯৫। আপ্লুত রুদ্রদেব তাঁর নাম রাখলেন রামরাম। কিন্তু আবার বিধির বিধান। অম্বিকার পিতা বাসুদেব ব্রহ্মচারী তখন সদ্য ফিরেছেন শ্রীক্ষেত্র পুরী থেকে। তাঁর অনুরোধে নাম পরিবর্তন হল। নতুন নাম হল জগন্নাথ। অর্থাৎ কিনা কৃষ্ণ। এ দৈবলীলা ছাড়া আর কী?”

গুরুদেবের গল্প বলায় আচমকা ছেদ পড়ল। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, অচ্যুত উঠে দাঁড়িয়েছে।

“কী ব্যাপার, বাবা? তুমি কিছু বলতে চাও?”

“হ্যাঁ, গুরুদেব।” অচ্যুত বলল, “আমরা জানি, কলিযুগে স্বর্ণকাল হল অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা।”

“ঠিক। পরম গুরুর আবির্ভাবের পুণ্যে সেইসময় উৎকর্ষতা শীর্ষে পৌঁছেছিল।” গুরুদেব প্রশান্ত মুখে মাথা দোলালেন।

অচ্যুত বলল, “কিন্তু ত্রেতা যুগের রামায়ণে বা দ্বাপর যুগের মহাভারতে তো এমন অসমবিবাহের উল্লেখ ছিল না গুরুদেব।”

 ”অসমবিবাহ মানে?” ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন গুরুদেব, “তুমি কী বলতে চাইছ?”

“চৌষট্টি বছরের প্রৌঢ় বিবাহ করছেন দশ বছরের বালিকাকে। কিন্তু, ত্রেতা বা দ্বাপর যুগে তো গৌরীদান ছিল না। পরিণত বয়সে স্বয়ম্বরা হয়ে পাত্রনির্বাচনের স্বাধীনতা নারীদের ছিল। তবে কলিযুগের স্বর্ণকালে এই অধঃপতন কেন?” অচ্যুত ব্যাখ্যা করল।

“অধঃপতন? তোমার দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি।” গুরুদেবের মুখ রক্তাভ হয়ে উঠল, “গৌরীদান শাস্ত্রসিদ্ধ। তাকে অধঃপতন বলার অর্থ তুমি শুধু বৈদিক শাস্ত্রকে নয়, আমাদের সমগ্র বৈদিক সমাজকে তুমি অপমান করছ!”

দ্বারিকা সভয়ে হাত ধরে টেনে নামাতে যাচ্ছিল, কিন্তু অচ্যুত গুরুত্ব না দিয়ে বলল, “কিন্তু গুরুদেব, প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যেও তো পরিণত বয়সে মেয়েদের বিবাহের কথা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় তাদের বিদ্যাশিক্ষার কথাও। এমনকি সহমরণের …।”

“চুপ করো, অর্বাচীন! গত সপ্তাহেও তোমার আচরণে আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম। তোমার স্পর্ধা দেখছি দিনদিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই মধুসূদন আমাকে একাধিকবার তোমার নানা নিয়মলঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে।” গুরুদেব থরথর করে কাঁপছেন। তাঁর দুই চোখ লাল হয়ে গিয়েছে, তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, “তোমার এই প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যের শাস্তি আজ তোমায় পেতে হবে!”

কয়েক মুহূর্ত কাটল।

তারপরই দ্বারিকা আড়ষ্ট হয়ে দেখল, চাতালের বাইরে উপস্থিত হয়েছে কালু কৈবর্ত আর তার দুই সাঙ্গোপাঙ্গ। নিরাবরণ ঊর্ধ্বাঙ্গ, হাঁটু পর্যন্ত মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, মাথায় লাল ফেটি। হাতে বর্শা।

ওরা সাধারণত এদিকে আসে না। রন্ধনশালার বাইরে এসে গোলাপদীঘি থেকে জাল ফেলে তোলা মাছ ফেলে দেয়। কখনো রুই-কাতলা, কখনো আবার মৌরলা, সরপুঁটি, চাঁদা।

পাচকরা সেই মাছ কৈবর্তদের স্পর্শ বাঁচিয়ে নিয়ে নেয়। পরিবর্তে দেয় জমির কপিটা-মুলোটা, কিংবা তিনদিনের চালের খোরাক। বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য সেরে খুশিমনে আবার চলে যায় ওরা পল্লির দিকে। পল্লিতেও উপুড় করে দেয় মাছের পসরা। বাড়ির বউরা আধহাত ঘোমটা টেনে কেনে সেই মাছ, বিনিময়ে দেয় ক্ষেতের চাল, সবজি কিংবা গোয়াল থেকে দুইয়ে আনা দুধ।

কিন্তু কালু কৈবর্ত যেদিন তার সীমানা ছাড়িয়ে এসে উপস্থিত হয় পূজামণ্ডপে কিংবা ভদ্রপল্লিতে, তার অর্থ ভয়ংকর। এই গোটা সমাজে গুরুদেবকে অসম্মান করা বা রীতিনীতি অমান্য করার শাস্তি হিসেবে কৈবর্তরা জানে অমানুষিক নির্মম কিছু দণ্ড।

দ্বারিকা ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছিল। ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল ব্রজেন্দ্রদাদার কথা। বেশিদিন নয়, কয়েক মাস আগের ঘটনা। ব্রজেন্দ্রদাদার সেই দুঃসাহসের কথা কেউই ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি তার সেই চরম শাস্তির কথাও। অরণ্যের পাশেই যে কালোপুকুর, তার একেবারে মাঝখানে, যেখানে থই পাওয়া যায় না জলের, সেখানেই বেঁধে রাখা হয়েছিল ওকে। শুধু মুখটুকু জলের বাইরে ছিল, ঠোঁটের ভেতর ছিল ন্যাকড়া গোঁজা। টানা নয়দিন ওভাবেই অর্ধেক জলে অর্ধেক বাতাসে ভেসে ছিল সে। সম্পূর্ণ নিরন্ন ও নিরম্বু হয়ে।

গোটা সমাজ কাজে যেতে আসতে বিস্ফারিত চোখে দেখত ন্যাকড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসা তার গোঙানির অমানুষিক আর্তনাদ। এও গুরুদেবের নির্দেশ। মানুষের মনে ভয় জিইয়ে রাখার জন্য।

ধীরে ধীরে চেতনাশূন্য হয়ে গিয়েছিল ব্রজেন্দ্রদাদা। শেষের দু’দিন আর কেউ শুনতে পায়নি তার গোঙানি। দশ দিনের দিন নিঃস্পন্দ কেশহীন মাথাটা একদিকে হেলে জলের ওপর ভাসছিল তিরতির করে।

ব্রজেন্দ্রদাদা গুরুতর অপরাধ করেছিল। লঙ্ঘন করেছিল সমাজের নিয়ম। কিন্তু অচ্যুত তো শুধু প্রশ্ন করেছে। তার শাস্তিও কি অতটাই ভয়ানক হবে? ভাবতে ভাবতে দ্বারিকা হিমচোখে দেখল, অচ্যুতের কোনো হেলদোল নেই।

সকলের ভয়ার্ত চাহনির সামনে দিয়ে অচ্যুত দিব্যি চলে গেল কৈবর্তদের সঙ্গে। একবারও পিছু ফিরে দেখল না।

গুরুদেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর একঝলক তাকিয়ে বললেন, “এটা বৈদিক সম্প্রদায়। আমাদের লক্ষ্য ঐতিহ্যের পথে হেঁটে এক পবিত্র পৃথিবী নির্মাণ। সেই লক্ষ্যে অবিচল থাকতে প্রয়োজন কঠোর তপস্যার। প্রখর সাধনার। নিরন্তর সংযমের। এখানে অতিরিক্ত কৌতূহল মানে মহাপাপ। এখানে নিয়ম লঙ্ঘন মানে কঠিন শাস্তি।”

কথা শেষ করে তিনি একটু থামলেন তারপর বললেন, “উপনিষদের সেই বাণী স্মরণ করো।

সহ না ববতু

সহ নৌ ভুনক্তু।

আমরা মিলেমিশে খাব। আমরা একসঙ্গে শক্তিশালী হয়ে উঠব। আমরা পরস্পরকে বিদ্বেষ করব না। তাই যে বা যারা আমাদের পবিত্র বৈদিক সমাজে ভাঙন ধরাতে চায়, তাদের একটাই শাস্তি। মৃত্যু।”

কথাটা শেষ করে তিনি আর অপেক্ষা করলেন না। নেমে চলে গেলেন দণ্ডায়মান দেবদত্তর দিকে। দৃপ্তভঙ্গিতে উড্ডীন হলেন অশ্বপৃষ্ঠে, তারপর দ্রুতগতিতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন গ্রামের ভেতরের দিকে।

দ্বারিকা এবং অন্য ছাত্ররা চাতাল ছেড়ে বেরিয়ে এল। সবাই হাঁটা দিল নিজেদের ঘরের দিকে। সবাই নির্বাক থাকলেও ভয়ে স্তব্ধ। গুরুদেবের ক্রোধ যে অতি সাংঘাতিক, তা কারুর অজানা নয়।

দ্বারিকার বাড়ি পূজামণ্ডপের চাতাল থেকে যেতে লাগে অর্ধেক দণ্ড। প্রধান মন্দিরের পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে হয়। পথে পড়ে শস্যক্ষেত, কীর্তনমঞ্চ এবং বিষ্ণুমন্দির। সেই মন্দিরে প্রত্যহ পুজোর সময় জমায়েত হয় তামাম বৈদিক সমাজ।

বাসভবন বলতে সকলেরই সমান আকার ও আয়তনের মৃৎকুটির। এই গোটা বৈদিক সমাজে সমস্ত কিছু সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠুভাবে বিন্যস্ত। সমাজের একেবারে উত্তরে যেমন অরণ্যপ্রান্তে রয়েছে পূজামণ্ডপ, উপাসনা মন্দির ও নারায়ণী চতুষ্পাঠী, সমাজের একেবারে দক্ষিণে সার দিয়ে দিয়ে মৃৎকুটির। প্রতিটি মৃৎকুটিরের সামনে একফালি উঠোন, তুলসী মঞ্চ ও পেছনদিকে গোয়ালঘর, অল্প বাগান। সেই বাগানে কিছু ঘরোয়া সবজি ও ফলমূল। বেশ কয়েকটি করে মৃৎকুটির নিয়ে এক একটি পাড়া।

 কোনটা ব্রাহ্মণপাড়া, কোনটা কায়স্থপাড়া, কোনটা আবার নবশায়কপাড়া। নবশায়ক অর্থে নয়টি সম্প্রদায়। তিলি, মালাকার, তাঁতি, সদগোপ, নাপিত, বারুই, কামার, কুম্ভকার ও ময়রা।

আরো দক্ষিণে গেলে শুরু হয়ে যাচ্ছে অরণ্য।

গ্রামের একেবারে উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে কৈবর্ত ও বাগদিদের পাড়া। তারা অচ্ছুৎ, তাই এই ব্যবস্থা। তাদের পাড়ার পাশেই বৈদিক সমাজের শ্মশান।

মৃৎকুটিরগুলোর একটু আগে রয়েছে গোলাপদিঘি। গোটা সমাজের জলের প্রয়োজন মেটানো হয় এই দীঘি থেকেই। সমাজের সব মেয়ে বউরা ভোর হতে না হতেই কলসি কাঁখে বেরিয়ে পড়ে গোলাপদিঘির দিকে।

সমাজের দণ্ডমুণ্ড গুরুদেব স্বয়ং ছাড়াও সমাজপতি আছেন দুইজন। একজন কৃষ্ণকান্ত লাহিড়ী, অন্যজন গোপাল ব্যানার্জি। তাঁরা গুরুদেবের মতো পরিযায়ী নন, সমাজেই থাকেন। গুরুদেবের অবর্তমানে তাঁরাই চালান সমাজকে। কোনো বাড়ির মেয়ের দশ পুরলেও বিবাহ হয়নি, কার বাড়ির সন্ধ্যাপ্রদীপ ঠিকসময়ে প্রজ্জ্বলিত হয়নি, কোনো বাড়ির বিধবা উঁচু স্বরে কথা বলছে, এই সব বিষয়ে তাঁদের কড়া নজর। স্বয়ং গুরুদেবও তাঁদের মতামতকে বেশ গুরুত্ব দেন। গোটা সমাজে কোনো লেনদেনের মুদ্রা নেই। পুরোটাই চলে বিনিময় প্রথায়।

সকলকে মেনে চলতে হয় কঠিন অনুশাসন। গোটা সমাজে মোট চল্লিশটি ব্রাহ্মণ পরিবার। সেই চল্লিশটি পরিবারকে কুড়ি কুড়ি করে দুইভাবে বিভক্ত করা আছে। এক ভাগের মাথা কৃষ্ণকান্ত, অন্যভাগের হর্তাকর্তা গোপাল ব্যানার্জি। বিবাহাদি সম্পন্ন হয় এক ভাগের সঙ্গে অন্য ভাগের।

এইরকমভাবেই দুই ভাগে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কায়স্থ, নবশায়ক, তিলিদের মধ্যে।

অসবর্ণ প্রথার কোন স্বীকৃতি নেই। নেই অবকাশও। বৈদিক সমাজে তা চরমতম অপরাধ।

অচ্যুতের বাবা-মা নেই। ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছে। ও থাকে ব্রাহ্মণ পল্লিরই এক দুঃসম্পর্কের কাকার পরিবারে। অনাথ বলেই বোধ হয় অচ্যুত কেমন একটু ছন্নছাড়া। এত মেধাবী, অথচ এত অবাধ্য, চঞ্চল। দ্বারিকা সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়েও অচ্যুতের চিন্তাভাবনার কোনো তল পায় না।

দ্বারিকা বাড়ি পৌঁছে দেখল ওর মা উনুনে ভাত চাপিয়েছেন। এই কুঁড়েঘরে মা আর দাদা’র সঙ্গে থাকে ও। ওদের বাবা থাকেন কিছুদূরে। সেখানে কিশোরী স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর নতুন সংসার।

“দাদা কোথায়, মা?”

মা বললেন, “পুতুর বিয়ে কাল, সেই জোগাড় করতে গিয়েছে।”

পুতুর বিয়ে? দ্বারিকা হাঁ হয়ে গেল। পুতু ওর পাড়াতুতো বোন। সবে আট পেরিয়ে নয়ে পড়েছে। পুতুর বাবা পশুপতিজ্যাঠার দশটা গরু আছে। সেই গরুর দুধ থেকেই সংসার চলে।

আর কিছুদিন পরেই মহোৎসব, পুতু সেইসময় কত আনন্দ করে!

ও বলল, “কার সঙ্গে বিয়ে?”

“বাঁড়ুজ্জেমশাইয়ের সঙ্গে।”

“মানে?” দ্বারিকার হাঁ মুখ বন্ধ হল না, “গোপাল ব্যানার্জি?”

“হ্যাঁ।”

“কী বলছ তুমি, মা!” দ্বারিকা বলল, “উনি তো এই ক’মাস আগে তৃতীয় পক্ষ করলেন!”

“তো কি!” মা বললেন, “সোনার আংটি আবার বেঁকা! পুতুর বাপের কত দেনা জানিস বাঁড়ুজ্জেমশাইয়ের কাছে? অন্তত পঞ্চাশ সের দুধ বকেয়া আছে। গুরুদেব তাই আদেশ করেছেন পুতুকে বিয়ে দিতে।”

“কিন্তু, বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের বয়স ষাট পুরেছে। ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে?”

মা চুপ করে যান। কিছুক্ষণ পর বলেন, “সে’সব হলে পুতুর মন্দকপাল। অন্তত একমাথা সিঁদুর নিয়ে শ্মশানযাত্রা তো করতে পারবে! বাপ-মা’কেও গালমন্দ খেতে হবেনা।”

দ্বারিকা চমকে উঠল। ওর মনে পড়ে গেল সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা। বাচ্চা মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিতার দিকে। সেই চিতায় শয়ান সেই মেয়েটির বৃদ্ধ পতি যদুহরি ঘোষাল। যদুহরি ঘোষাল নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর পাঁচটি পত্নীর মধ্যে যেন কনিষ্ঠাটি অবশ্যই সহমৃতা হয়।

চারদিকে তারস্বরে বাজছে কাঁসরঘণ্টা, ঢাকঢোল। আগুনের লেলিহান শিখা এসে গ্রাস করার আগেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দূরে ব্রজেন্দ্রদাদা পালাচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে! সঙ্গে রয়েছে মেয়েটার মা’ও। নিজের একমাত্র সন্তানটিকে বাঁচাতে সেই মা’ও বদ্ধপরিকর।

গ্রামের মেয়েবউরা স্তম্ভিত। অজানা অভিশাপের ভয়ে থরোথরো। কোনো মা এমন সৃষ্টিছাড়া কাজ করতে পারে? মেয়ে সতী হলে যে কত পুণ্য, তা কি তার জানা নেই?

এই সবের মধ্যেই সবাই লাঠিসোঁটা নিয়ে উন্মত্ত পশুর মতো ছুটছে তার পেছনে। এমনকি অনাচারের ভয়ে মেয়েকে আটকাতে ছুটছে মেয়েটির বাবাও। মেয়ে আর মা অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেও একজনের লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়ছে ব্রজেন্দ্রদাদা। তারপর সবাই মিলে নির্মম পেটাচ্ছে তাকে। তারপর আধমরা করে নিয়ে আসা হচ্ছে কালোপুকুরে।

উফ! দ্বারিকা চোখ বুজে ফেলল। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল, কে বলেছে অষ্টাদশ শতক সেরা সময়কাল? হোক পরমগুরুর আবির্ভাব! এইসব কুপ্রথা যে সময়ে থাকে, তাকে কি স্বর্ণকাল বলা যায়? অচ্যুতের প্রশ্ন কি খুব অযৌক্তিক? বাইরের পৃথিবী কি সত্যিই এরে চেয়েও ভয়ংকর?

কী যেন নাম ছিল সেই মেয়েটার? পুতুরই বয়সি হবে।

হ্যাঁ। মনে পড়েছে ওর।

ক্ষমা।

প্রিয়ম লাইব্রেরি রুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। ডান হাতে একটা বাটি, তাতে টক ঝাল আচার। অন্য হাতে বই। প্রিয়মের কল্যাণীর বাড়ির বিশাল বইভাণ্ডার সে এই বাংলোয় আসার পরই তুলে নিয়ে এসেছে। ছুটির দিনটা তার এই লাইব্রেরি রুমেই কাটে।

প্রিয়ম এক টুকরো আচার মুখে দিয়ে বলল, “একি! জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের নাম শুনব না? ত্রিবেণীর দেশবিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন!”

রুদ্র একটু অপ্রতিভ হল। ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়ে ওর চেয়ে প্রিয়মের জ্ঞানের প্রসার বেশি, এটা ও ধারণা করতে পারেনি।

ত্রিবেণী থেকে ফিরে উর্দি ছেড়ে স্নান করে ও ফ্রেশ হয়েছে। প্রিয়ম আজ বাড়ি থেকে কাজ করছে। তাই আজ অনেকদিন পর দুজনে দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে পেরেছে। ও বলল, “উনি নাকি একশো বারো বছর বেঁচেছিলেন!”

“হ্যাঁ। জানি তো।” প্রিয়ম বলল, “ইলেভেন টুয়েলভে কল্যাণী থেকে গঙ্গা পেরিয়ে ত্রিবেণীতে জয়েন্টের জন্য ফিজিক্স পড়তে যেতাম, ওই তর্কপঞ্চাননের দৈত্যের মতো বাড়িটার পাশেই। মধ্যযুগের সেরা বাঙালি। গোটা অষ্টাদশ শতকটা সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকের নবজাগরণের দাপটে মানুষ এখন ওঁকে একেবারে ভুলে গিয়েছে, এই যা দুঃখের!”

“কী জানো তুমি ওর সম্পর্কে?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “না মানে একজন বিদ্বান পণ্ডিত ছাড়া ওঁর আর কোনো পরিচয় ছিল কি?”

প্রিয়ম বলল, “অনেক রকম পরিচয় ছিল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ছিলেন অসম্ভব শ্রুতিধর। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে উনি ত্রিবেণীতে টোল খুলে বসেছিলেন। একটা ঘটনা শুনেছিলাম। একবার তিনি বর্ধমানের মহারাজা ত্রিলোকচন্দ্রের আমন্ত্রণে বর্ধমান গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে হারানোর পর রাজা বললেন, তর্কপঞ্চাননমহাশয়, ত্রিবেণী থেকে বর্ধমান আসার পথে কী কী দেখেছেন?

জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বললেন, “সংক্ষেপে বলব না বিস্তৃত বলব?”

“রাজা বিস্তারিত বলার অনুরোধ করতে তিনি নাকি পরের কয়েকঘণ্টা ধরে গোটা যাত্রাপথের প্রতিটি বাড়ি, বাগান, পুকুর, মন্দির, সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিলেন। রাজা পরে খোঁজ নিয়ে দেখেন, প্রতিটি তথ্য সত্যি।”

“এমনও হয়!” অস্ফুটে বলল রুদ্র, “আসার সময় জয়ন্তও এইরকমই একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা বলল। একদিন নাকি জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলেন স্নান করতে। সেইসময় দুজন ইংরেজ একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছে। পরে দুজনের মধ্যে সেই হাতাহাতি আদালত অবধি গড়ালে খবর পাওয়া গেল, সেইসময় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ঘাটে উপস্থিত ছিলেন। কোর্টে ওঁকে সাক্ষ্য দিতে ডেকে পাঠালে তিনি গিয়ে বললেন, দেখুন, আমি ইংরেজি জানিনা। তাই কী নিয়ে ঝগড়া আমি বলতে পারব না। তবে, তারা কী বলেছিল, আমি বলতে পারি। এই বলে উনি একঘণ্টা ধরে গোটা ইংরেজি কথোপকথনটি নাকি বলে গিয়েছিলেন!”

“রাইট!” প্রিয়ম বলল, “এটাও জানতাম। তোমার কাছে শুনে মনে পড়ল। আসলে তোমরা এদিককার লোক নও তাই জানোনা, এগুলো ত্রিবেণী, বাঁশবেড়িয়ার সবাই জানে। আর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ছিলেন আইনের দুঁদে লোক। তখন ইংরেজরা সবে ভারতে এসেছে, এখানকার ভাষাও জানেনা, এখানকার রীতিনীতি সবকিছুই অজানা। তাই তারা পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে। নবকৃষ্ণ দেব বা নকু ধরের মতো কিছু সুযোগসন্ধানী দেশীয় লোকদের হাত করে তখন তারা দেশ শাসন করছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী দেশীয় বিচারপদ্ধতি আর আইন প্রণয়নের একটা প্রামাণ্য বই তখন তাদের খুব দরকার ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে সেই বই লিখেছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। নামটা যেন কী ভুলে গিয়েছি।”

“বিবাদভঙ্গার্ণব।”

“ইয়েস! তখনকার সব দেওয়ানির মামলার বিচার ওই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ দিয়েই করা হত। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন দেশীয়মহলে তো বটেই, ইংরেজ মহলেও খুব প্রভাবশালী ছিলেন। রবার্ট ক্লাইভ তাঁর কাছে সংস্কৃত শিখেছিলেন। হেস্টিংস, হার্ডিঞ্জের মতো বড়কর্তারা তাঁর কাছ থেকে আইনি বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। উইলিয়াম জোন্সও আসতেন। এমনকি পরে যখন নবকৃষ্ণ খেতাব পেয়ে রাজা হলেন, তাঁর রাজসভাতেও জগন্নাথ পণ্ডিতের উচ্চ আসন ছিল। আর এই নবকৃষ্ণদেবই কিন্তু পলাশির যুদ্ধে সিরাজকে হারাতে ইংরাজদের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, জানো! নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িই হল আজকের শোভাবাজার রাজবাড়ি।”

রুদ্র বলল, “বাবা! তুমি তো অনেক কিছু জানো দেখছি!”

“জানব না?” প্রিয়ম বলল, “ত্রিবেণীর ওই জগন্নাথ পণ্ডিতের বাড়ির একজন বংশধর আমার সঙ্গে ওই টিউশনে পড়ত যে! শুভাশিস ভট্টাচার্য। আমার চেয়ে কিছুটা বড়, আমি যখন ইলেভেন, শুভাশিসদা তখন ফিজিক্সে এম এসসি করছে, ফাইনাল ইয়ার। স্যারের কাছে একটা স্পেশাল পেপার পড়তে আসত। এখন আমেরিকায় থাকে। এখনো যোগাযোগ আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ছবি-টবি দেখি। মাঝেমধ্যে কথাও হয়। তখন ওর সঙ্গে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বাবা ছিলেন খুব গরিব, কিন্তু জগন্নাথ নিজে প্রচুর ধনসম্পদ করেছিলেন। ওঁর বাড়ির একতলাটায় একটা ছোটখাটো কোর্টের কাছারি ছিল, যেখানে উনি স্থানীয় লোকদের মোকদ্দমার বিচার করতেন। একেবারে জীবন্ত কিংবদন্তী যাকে বলে!”

“হুম। সেই লিভিং লিজেন্ডের বাড়িতেই কিনা এমন একটা খুন হল?” রুদ্র বিড়বিড় করল, “খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। মোট ছ’টা খুন। প্রতিটাই কোনো না কোনো বুধবারে। প্রতিটাই কোনো না কোনো ব্যবসায়ীকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। কিন্তু, কী সেই যোগসূত্র?”

জ্যোৎস্নাদি ঢুকল ঘরে, “রাতে কী খাবেন দাদাবাবু? চিকেন আছে, করে দেব?”

প্রিয়ম তন্ময় হয়ে শুনছিল রুদ্রর কথা। হঠাৎ এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ, এই তো দুপুরে খেয়ে উঠলাম। এখনই রাতের খাওয়া কেন জ্যোৎস্নাদি? খাওয়ার চিন্তা ছাড়া দুনিয়ায় আরও কিছু আছে তো নাকি।”

জ্যোৎস্নাদি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “না, আজ গানা খাজানার ফাইনাল। সন্ধে থেকে দেখব তো, তাই ভাবছিলাম এখনই যদি রান্নাটা সেরে রাখি।”

প্রিয়ম বলল, “ঠিক আছে, তুমি না করতে পারো, মল্লিকাদি করবে। অসুবিধা কী আছে! মল্লিকাদি তো টিভি ফিভি দেখেনা।”

জ্যোৎস্নাদি সঙ্গে সঙ্গে মুখ বেঁকাল, “ভালো লোককে করতে বলছেন দাদাবাবু। তার তো রোজই কিছু না কিছু লেগেই রয়েছে। আজ কী না কী ষষ্ঠী, উনি পিঁয়াজ রসুন ছোঁবেন না। রান্নাটা হবে কী করে শুনি?”

“আজ ষষ্ঠী?” প্রিয়ম বলল।

“হ্যাঁ।” জ্যোৎস্নাদি ঘরের এক দেওয়ালে অবহেলায় ঝুলতে থাকা বাংলা ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই দেখুন না। আমরা বাপু চৈত্রমাসের অশোক ষষ্ঠী বুঝি, ভাদ্দর মাসের চাপড়া ষষ্ঠী বুঝি, চৈত্রমাসে নীল ষষ্ঠী বুঝি। প্রত্যেক মাসে দু’বার করে এমন ষষ্ঠী করতে কাউকে দেখিনি!”

রুদ্র কী যেন চিন্তা করছিল। বলল, “গানা খাজানা? পরশুদিন বললে সেমিফাইনাল ছিল? তাহলে গতকালই তো ফাইনাল হয়ে যাওয়ার কথা!”

“গতকাল তো বুধবার ছিল দিদিমণি।” জ্যোৎস্নাদি লম্বা বিনুনি দুলিয়ে বলল, “বুধবার দিন তো গানা খাজানা হয় না।”

 ”আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটু পরে বলছি। এখন তুমি যাও।” প্রিয়মের ধমকে জ্যোৎস্নাদি চলে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছু ডাকল রুদ্র, “তুমি শিওর জ্যোৎস্নাদি, বুধবার গানা খাজানা হয় না?”

“ওমা, একবচ্ছর ধরে দেখে আসছি, আর জানব না? সোম থেকে রবি হয়, শুধু ওই বুধবারটা বাদ দিয়ে।”

রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ফোন করল ত্রিবেণীর ওসি সুকেশ সান্যালকে, “হ্যাঁ শুনুন। ওই ব্রিজেশ তিওয়ারির যে কর্মচারী ছেলেটি, কী যেন নাম, হ্যাঁ, অলোক, ওকে ভালো করে জেরা করুন। ছেলেটা ফলস স্টেটমেন্ট দিয়েছে। ও সকালে আমাদের বলেছে, গতকাল রাত এগারোটা নাগাদ ও আর ব্রিজেশ তিওয়ারি একসঙ্গে গানা খাজানা দেখছিল। অথচ কাল ছিল বুধবার, ওই প্রোগ্রামটা হয়ই না। আপনি আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিপোর্ট করুন।”

ফোনটা রেখে রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকাল। বলল, “জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের তার মানে আসল পদবি ছিল ভট্টাচার্য?”

“হ্যাঁ। তর্কপঞ্চানন উপাধি পেয়েছিলেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের হারিয়ে টোল খুলেছিলেন। কলকাতায় যখন প্রথম সুপ্রিম কোর্ট খোলা হয়েছিল, প্রধান জজ পণ্ডিতের পোস্ট অফার করা হয়েছিল ওঁকেই। কিন্তু উনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, ওঁরই নাতি ঘনশ্যাম বাচস্পতি তখন প্রথম জজপণ্ডিত হন। মজার কথা হল, ওঁর নাতি নাকি ওঁর চেয়েও বেশি প্রতিভাধর ছিলেন। কিন্তু মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সেই সেই নাতি উন্মাদ হয়ে যান।” প্রিয়ম বলল, “তখন শুভাশিসদার কাছে গল্প শুনতাম এইসব। বেশ লাগত। এসব তো আমাদের পাঠ্য ইতিহাসে ছিল না। ত্রিবেণীর প্রথম দুর্গাপুজোও শুরু করেছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। এখনো গঙ্গার ঘাটে ওঁর একটা মূর্তি আছে।”

রুদ্র কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে পাঁচু এসে সেলাম করল, “ম্যাডাম, লোকেশ স্যার আর প্রিয়াঙ্কা ম্যাডাম এসেছেন। আপনার অফিসে বসতে বলেছি।”

 ”এখন এই অসময়ে?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকল।

অলোক ছেলেটা ভিতু ধরনের। দুটো রুলের বাড়ি খেয়েই ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে সব বলে দিল।

“বিশ্বাস করুন স্যার, মরা বাপ-মায়ের দিব্যি খেয়ে বলছি, আমি কিছু করিনি। হ্যাঁ, সেদিন রাতে খাওয়ার সময় ব্রিজেশদা’র সঙ্গে আমার একটু ঝামেলা হয়েছিল। ব্রিজেশদা দোকানের হিসেবের খাতায় কিছু গরমিল পাচ্ছিল ক’দিন ধরে। আমাকে সন্দেহ করছিল। মুখে কিছু না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বোঝাচ্ছিল। সেদিন রাতে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। দুজনেই মাথা গরম করে ফেলি। ব্রিজেশদা ওই রাতেই আমাকে দোকানঘরে নিয়ে যায়, খাতা খুলে গরমিল দেখানোর জন্য।”

“তারপর? কত টাকা চুরি করেছিলি তুই?”

“স্যার, আমি গরিব হতে পারি। চোর নই। ব্রিজেশদা একটা কোম্পানির অর্ডারের পেমেন্টে কিছু ভুল করছিল। আমি সকাল হলে বোঝাব বলে চলে আসি ঘরে। ব্রিজেশদা তখন দোকানঘরে রয়ে যায়। তখন রাত সোয়া এগারোটা হবে। বিশ্বাস করুন স্যার! এর বেশি আমি কিছু জানিনা। ব্রিজেশদা আমার মালিক, আমাকে থাকা খাওয়া সব দিয়েছে। আমি তাকে কেন খুন করতে যাব?”

“তবে প্রথমে মিথ্যে বললি কেন?”

অলোক মাথা নীচু করে বলল, “ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম স্যার। আমি ব্রিজেশদা’র সঙ্গে দোকানে গিয়েছিলাম জেনে যদি আপনারা আমাকেই খুনি ভাবেন।”

রুদ্র টেলিফোনে পুরো কথোপকথনটা শুনছিল। বলল, “ফরেনসিকের রিপোর্ট কি এসেছে?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম। অলোকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে দোকানে।”

রুদ্র বলল, “অলোক দোকানে কাজ করত। ওর ফিঙ্গার প্রিন্ট তো পাওয়া যাবেই। কোথায় কোথায় ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে?”

“খাতায়, দরজার হাতলে, বডির আঙুলে। কিন্তু ইনভার্টারে বা ব্যাটারিতে নেই ম্যাডাম। অলোক আর ব্রিজেশ তিওয়ারি ছাড়া আরও কিছু অন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে।” সুকেশ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে ফোনে বললেন।

“হুম। অলোককে আপাতত অ্যারেস্ট করুন। তারপর দেখছি। ত্রিবেণীতে জানুয়ারি মাসে যে আরেকটা খুন হয়েছিল, সেটাও কী আপনিই দেখছেন?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম। ওই সাইবার ক্যাফের শিবনাথ বিশ্বাস তো?” সুকেশ সান্যাল বললেন, “ওটা তো সিম্পল কেস।”

“কী রকম?”

 ”বউ আর বউয়ের প্রেমিক খুন করেছে। নেহাত অ্যালিবাইটা স্ট্রং বলে একটু দেরি হচ্ছে। আমরা সবদিক দেখে এগোচ্ছি।”

* * *

প্রিয়াঙ্কা উত্তেজনায় ফুটছিল। এ এস পি ম্যাডামকে ঘরে ঢুকতে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকে বলল, “ম্যাম, কয়েকটা ইন্টারেস্টিং অবজারভেশন আছে।”

“কী?”

‘বৈদ্যবাটীর সুনীল ধাড়ার দোকানের কর্মচারীকে ইন্টারোগেট করলাম। সে বলল, ঠিক ব্রিজেশেরই মতো সুনীল ধাড়ার দোকানেও বছরখানেক আগে একটা নতুন কর্মচারী ছেলে এসেছিল। কোথা থেকে তা জানে না। তবে একেবারে ক্যাবলা। নাম বলরাম। ঠিক ওই ব্রিজেশ তিওয়ারির দোকানের কানাইয়ের মতো বলরামও কাউকে কিছু না বলে একদিন ভ্যানিশ হয়ে যায়।”

রুদ্র মাথা নাড়ল, “এটা আমি প্রথম থেকেই গেস করেছিলাম। বেশিরভাগ খুনই হয়েছে ডেকে নিয়ে গিয়ে। সুনীল ধাড়া যখন খুন হয়, তখন ওর কর্মচারী দানু ছুটি নিয়েছিল। সেইসময় দোকানে ওকে কে হেল্প করত?”

“কেউ না ম্যাডাম। সুনীল ধাড়া একাই সামলাচ্ছিল। বলরাম বলে ছেলেটা এসেছিল প্রায় একবছর আগে। তখন দানু দু’মাসের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল কোন কাজে।” প্রিয়াঙ্কা বলল।

রুদ্র বলল, “বলরামকে সুনীল ধাড়ার দোকানে কে কাজে ঢুকিয়েছিল?”

প্রিয়াঙ্কা এবার একটু অপ্রতিভ গলায় বলল, “সেটা তো খোঁজ করিনি ম্যাডাম!”

রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বলেছি না, কখনো অর্ধেক ইন্টারোগেশন করবে না। এতে ফ্লো কেটে যায়, কনফিউশানও বাড়ে। খোঁজ নাও, দানুর অ্যাবসেন্সে বলরামকে কে কাজে ঢুকিয়েছিল।”

লোকেশ ব্যানার্জি এতক্ষণ পর মুখ খুললেন, “কোন্নগরের স্বপন সরকারের কেসটাও অনেকটা এইরকম। স্বপন সরকার এবার ভোটের টিকিট পেত। পলিটিক্সে ঢোকার পর থেকে তার পেছনে অনেক ফচকে ছেলে জুটেছিল। সেরকম একটা ছেলেরও কোন ট্রেস নেই দু’মাস ধরে। নাম গোবিন্দ।”

“কানাই। বলরাম। গোবিন্দ।” রুদ্র বিড়বিড় করতে লাগল, “এদের কারুর কোনো ছবি পাওয়া যাচ্ছে না? ভেরি স্ট্রেঞ্জ! কোনো আইডি প্রূফ ছাড়া কী করে এরা কাজে ঢুকল? মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ দিনদিন কমে যাচ্ছে।”

লোকেশ ব্যানার্জি বললেন, “গোবিন্দ স্বপন সরকারের সঙ্গে বেশ কিছু জায়গায় গিয়েছিল ম্যাডাম। কোথাও থেকে কোনো ফোটোগ্রাফ বা সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায় কিনা, সেই চেষ্টা করছি।”

“চেষ্টা করলেই শুধু হবেনা মি. ব্যানার্জি, আমাদের এই কেসটা যত দ্রুত সম্ভব সলভ করতে হবে।” রুদ্র বলল, “হায়ার অথরিটি থেকে কন্সট্যান্ট চাপ আসছে।”

ওর এবার বিরক্ত লাগছিল। ছ’খানা জলজ্যান্ত খুন। অথচ কোন ক্ল্যু পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতা থেকে দূরে বলে প্রথমদিকে মিডিয়া সেভাবে মনোযোগ দেয়নি। কিন্তু স্বপন সরকারের কেসটার পর থেকে এদিকে আগ্রহ বাড়ছে। যেহেতু রুদ্র এই তদন্তকমিটির প্রধান, দিনে একটা-দুটো করে ফোন আসছেই কোনো না কোনো নিউজ পোর্টাল থেকে।

আর ঠিকমতো ধরতে গেলে এটা ওর কেরিয়ারের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। প্রথমেই এমন জটিল কেস যদি ও সলভ করতে পারে, নিঃসন্দেহে সেটা ওর কেরিয়ারে অনেকগুলো পালক যোগ করবে। কিন্তু এগোতে পারছে কই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *