৪০
সুগন্ধা থানাটা ছোট হলেও ভেতরে যে একটামাত্র লক-আপ সেটা বেশ বড়। কোর্টে চালান দেওয়ার আগে পর্যন্ত স্থানীয় অপরাধীদের এখানেই রাখা হয়। কম ব্যবহৃত হয় বলেই বোধ হয় অন্যান্য থানার লক-আপের মতো অতটা নোংরা নয়।
রুদ্র আর প্রিয়াঙ্কা যখন ঢুকল, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা।
ফোনে সব কথাবার্তা হয়েই ছিল, থানার ওসি আশুতোষ তরফদার বেশ খানিকক্ষণ রুদ্রকে এলাকার সুস্বাদু শিঙাড়া খাওয়ানোর জন্য পীড়াপীড়ি করে বিফলমনোরথ হয়ে অবশেষে ওকে নিয়ে গেলেন লক-আপের কাছে।
লক-আপের ভেতরে কানু চক্রবর্তী চুপ করে মাটিতে বসেছিল। নিজের ঘর থেকে যখন তাকে তুলে আনা হয়, তখন সে নাকি কোনো প্রশ্ন বা আপত্তি করেনি। মিন্টুও ছিল সেইসময় পুলিশের সঙ্গে। ছেলেটাকে সেও কোথাও দেখতে পায়নি।
ওসি লক আপের এপারে দাঁড়িয়ে রুদ্রর দিকে সামান্য ঝুঁকে ফিসফিস করলেন, “ম্যাডাম, এসে থেকে কোনো কথা বলছে না। আমরা অনেকরকম ভাবে জেরা করেছি।”
রুদ্র লক আপের ওপারে বসে থাকা কানু চক্রবর্তীকে দেখছিল ভালো করে। কপালের ওপর দিয়ে খয়েরি মতো কিছু একটা দাগ দেখা যাচ্ছে। সেটা কী?
আশুতোষ তরফদারকে জিজ্ঞেস করতে তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, “দেখেছি ম্যাডাম। কপালে একটা ইনজুরি আছে। কোথায় লেগেছে জানতে চাইলে কিছুতেই বলছে না। আজকের দিনটা দেখবো, কাল থেকে কড়া ডোজ দেব।”
রুদ্র আবারও তাকাল লক-আপের ভেতরে। কানু চক্রবর্তী হাঁটুদুটো বুকের কাছে জড়ো করে শক্ত হয়ে বসে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কাঁচাপাকা চুলগুলো এলোমেলো।
চোখ দিয়ে ওটা কী নেমেছে? জলের ধারা?
আলো-আঁধারিতে রুদ্র ভাল করে বুঝতে পারল না।
ওরা যে এতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কানু চক্রবর্তীর দৃষ্টি একবারের জন্যও মেঝে থেকে উত্থিত হয়নি। কে আসছে, কে যাচ্ছে তা নিয়েই যেন তার কোনো মাথাব্যথা নেই।
রুদ্র ওসি আশুতোষ তরফদারের দিকে তাকাল, “আমি একটু ভেতরে গিয়ে একা কথা বলব। প্রিয়াঙ্কা থাকুক আমার সঙ্গে।”
“নো প্রবলেম ম্যাডাম।” ওসি ও তাঁর কনস্টেবল লক-আপের দরজাটা টেনে রুদ্র আর প্রিয়াঙ্কাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
দরজার বাইরে শুধু দাঁড়িয়ে রইল একজন গার্ড।
রুদ্র দ্রুত চারপাশে চোখ বোলাল। অদূরে সামান্য আড়াল করা শৌচব্যবস্থা। সেখান থেকে খুব মৃদু হলেও প্রস্রাবের ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। অন্যদিকে একটা তক্তা। তক্তার পাশে ছোট টুল।
একটা হলদে বাল্ব জ্বলছে ঘরের মাঝখানে। কানু চক্রবর্তী একইরকম পাথরের মতো মুখ করে বসে রয়েছে।
রুদ্র বলল, “আপনার সঙ্গের ছেলেটি কে, কানুবাবু? সে কোথায়?”
কানু চক্রবর্তীর চোখের পাতাগুলো সামান্য কেঁপেই আবার স্থির হয়ে গেল।
রুদ্র আবার জিজ্ঞেস করল, “আমি জানি আপনি অনেক কিছু জানেন। আপনি যদি মুখ খোলেন, আমাদের তদন্তে অনেক সুবিধা হবে।”
এবারেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
রুদ্র এবার টুলটা টেনে নিয়ে এসে কানু চক্রবর্তীর মুখোমুখি বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “শঙ্কর চৌধুরী কোথায়, কানুবাবু? আপনারা তো একইসঙ্গে বদনপুর ছেড়েছিলেন। আপনি একা ফিরে এলেন কেন?”
কানু চক্রবর্তী এবার সামান্য চমকাল। তারপর দাঁড়িগোঁফের ফাঁক দিয়ে সামান্য কিছু বিড়বিড় করল। তারপর আবার চুপ করে গেল।
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দেখুন কানুবাবু, আপনি যতই লুকনোর চেষ্টা করুন, আমরা কিন্তু সব জেনে গিয়েছি। শঙ্কর চৌধুরীর সঙ্গে ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের পারিবারিক যোগ বা আপনার সঙ্গের ওই ছেলেটি যেখান থেকে পালিয়ে এসেছে, তারা যে আধুনিক সভ্যতাকে কতটা ঘৃণা করে, তাও জানতে পেরেছি আমরা। ওখান থেকে যারাই পালিয়ে এসেছে, তাদেরকেই তারা খুন করেছে। আপনি এইভাবে নিরপরাধ মানুষদের হত্যাকে সমর্থন করেন?”
এবার কানু চক্রবর্তীর ডানদিকের চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
রুদ্র বলে যেতে লাগল, “এবং এর পরের খুনটাও হবে খুব শীগগিরই। এই কৃষ্ণপক্ষেই। এরপরেও আপনি যদি পুলিশকে কিছু খুলে না বলেন, আমি কিন্তু ওসির মার থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারব না।”
কানু চক্রবর্তী একভাবে বসে রইল।
রুদ্র এবার সুর কিছুটা নরম করল। বলল, “বলুন কানুবাবু। কী চায় তারা? কেন এভাবে একের পর এক মানুষ মারছে? এরপর তাদের পরিকল্পনা কী?”
কানু চক্রবর্তী এবারেও কোনো উত্তর দিল না। প্রিয়াঙ্কা একটু কড়া গলায় বলে উঠল, “কী ব্যাপার, কথা কি কানে যাচ্ছে না, নাকি? ম্যাডাম কী জিজ্ঞেস করছেন, বলতে পারছেন না?”
আরো তিন-চারবার পীড়াপীড়ির পর রুদ্র হতাশ মুখে উঠে দাঁড়াল। বোঝাই যাচ্ছে কানু চক্রবর্তীর কাছ থেকে কোনো কথা আদায় করা যাবে না। তবু ও শেষ চেষ্টা করল।
“বলুন প্লিজ। কানুবাবু। ওরা কী চাইছে? আপনি কেন এভাবে মানুষ খুনে মদত দিচ্ছেন?”
মিনিট তিনেক পর রুদ্র আর প্রিয়াঙ্কা যখন সেল থেকে বেরিয়ে আসছে, গার্ড সেলে চাবি লাগাচ্ছে, পেছন থেকে কানু চক্রবর্তীর জড়ানো কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
“আ-আমি মদত দিইনি!”
রুদ্র উদগ্রীব হয়ে পেছন ফিরল। বলল, “তবে? তবে কেন আপনি কিছু বলছেন না কানুবাবু?
“ছেলেটাকে ওরা জোর করে … আমি বাধা দিয়েছিলাম! প্রতিবারই দিই। কিন্তু কেউ শোনেনা আমার কথা!”
“কারা শোনেনা?” রুদ্র এগিয়ে এল কানু চক্রবর্তীর দিকে, “কারা জোর করে ছেলেটাকে নিয়ে গেল কানুবাবু? বলুন। আপনি যা জানেন, বলুন প্লিজ!”
“রাধা … আমার রাধা সব জানে!” হঠাৎ ঘোলাটে চোখে বিড়বিড় করে উঠল কানু চক্রবর্তী।
“রাধা? রাধা কে?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
কানু চক্রবর্তী কেমন অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসল। ফিসফিস করে বলল, “আমি তো কানু। আর কানুর রাধাকে চেনেন না?”
প্রিয়াঙ্কা এবার ধমকে উঠল, “ইয়ার্কি হচ্ছে ম্যাডামের সঙ্গে? জুতিয়ে মুখ লাল করে দেব!”
কানু চক্রবর্তীর চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেল। কিন্তু কালো ঠোঁটদুটো বিড়বিড় করতে লাগল, “বললাম তো। আ-আমার রাধা জানে!”
রুদ্র আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। কানু চক্রবর্তীর চোখ এবার সম্পূর্ণ বুজে গিয়েছে। ঘাড় কাত হয়ে হেলে পড়েছে একদিকে।
মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে সাদা ফেনা।
৪১
প্রিয়ম অকাতরে ঘুমোচ্ছিল। সারাদিন অফিসে একটানা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, টানা দশ-বারো ঘণ্টার মাথার পরিশ্রমের পর রাতের ঘুমের সময় কোন হুঁশ থাকেনা। যে কোনো পছন্দের একটা বই নিয়ে শোয়, দু-তিন পাতা পড়ার পরই চোখ ভারী হয়ে আসে।
কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ওর ঘুম ভেঙে গেল। দেখল, রুদ্র উদগ্রীব হয়ে ওর মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে ডাকছে।
“ওঠো, ওঠো! শীগগিরই ওঠো!”
“কী হল?” প্রিয়ম ধড়মড় করে উঠে বসল। ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা। বিছানা লাগোয়া পড়ার টেবিলে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। রুদ্র তার মানে এতক্ষণ পড়াশুনো করছিল।
রুদ্রর চোখমুখ উত্তেজিত। বলল, “আট নম্বর খুনটা হবে নবদ্বীপে!”
প্রিয়ম বলল, “মানে? নবদ্বীপ কোথা থেকে এল? নবদ্বীপ তো হুগলীতে নয়!”
“হুগলী টুগলী কোনো ফ্যাক্টর নয়। ওটা আমাদের একটা ভাঁওতা দেওয়ার চেষ্টা। দ্যাখো!” রুদ্র ল্যাপটপে একটা ডকুমেন্ট খুলল। বলল, “এটা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের প্রামাণ্য জীবনীচরিত। প্রায় দেড়শোবছর আগের লেখা, এখন আর পাওয়া যায় না। আজ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে আমাকে ইমেল করেছে। এই বইতে কীভাবে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন কিংবদন্তী হয়ে উঠলেন, লেখা রয়েছে।”
প্রিয়ম ঝুঁকে পড়ে দেখল, “এটা তো সংস্কৃত?”
“হ্যাঁ।” রুদ্র বলল, “নীচের ট্রান্সলেশনটা দ্যাখো। এশিয়াটিক সোসাইটির সমরবাবু খুব কাজের মানুষ। এক রাতের মধ্যেই সবকিছু আমাদের কথ্য বাংলায় ট্রান্সলেট করিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
“জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ‘দশানন বধ’ নামক একটা সংকল্প নিয়েছিলেন। বাংলার আটটি স্থানে আটজন পণ্ডিতকে বাকযুদ্ধে বধ করার সংকল্প। প্রথমে তিনি এক পৌষ সংক্রান্তিতে ত্রিবেণীতে আয়োজিত এক বিখ্যাত তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন রামকান্ত তর্কবাগীশ নামক খ্যাতনামা পণ্ডিতকে। সেই শুরু হয় তাঁর জয়যাত্রা। পরের মাসে তিনি একাই ধরাশায়ী করে দেন ফরাসডাঙার পণ্ডিতদের। তার পরের মাসে বৈদ্যবাটি। তার পরের মাসে ওলন্দাজনগর। তার পরের মাসে কনেনগর। তারপর আবার নিজের ত্রিবেণীতে। তারপরের মাসে বংশবাটি রাজবাড়ির বেদান্তযুদ্ধ। গোঁড়া পণ্ডিতরা সকলে মিলেও জগন্নাথের অদ্বৈতবাদকে অসার প্রমাণ করতে পারেননি।
“এরপর সবশেষে নবদ্বীপে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেই বিখ্যাত বাজপেয় যজ্ঞ। ততদিনে ত্রিবেণীর জগন্নাথ পণ্ডিত একাই ম্লান করে দিয়েছেন নবদ্বীপের দর্প। নবদ্বীপের পণ্ডিতরা নিজেদের পাণ্ডিত্য ও কৌলীন্যের অহংকারে ডগমগ হলেও বাজপেয় যজ্ঞের নানা আলোচনায় কেউ দাঁড়াতে পারেননি তর্কপঞ্চাননের সামনে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজেও জগন্নাথ পণ্ডিতের ওপর বিরূপ ছিলেন। তাঁর সামনেই নবদ্বীপের এক পণ্ডিত কথা কথায় দম্ভভরে বলছিলেন, “মা সরস্বতী সারাদিনে অন্তত একবার নবদ্বীপে অধিষ্ঠিত হতে বাধ্য হন, কোনো না কোনো পণ্ডিতের ভদ্রাসনে …।
“ইঙ্গিতটি পরিষ্কার। নবদ্বীপে অসংখ্য পণ্ডিত, কিন্তু ত্রিবেণীতে একজনই। অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নবদ্বীপ শ্রেষ্ঠ।
“জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, “ওখানেই নবদ্বীপের সঙ্গে ত্রিবেণীর পার্থক্য। নবদ্বীপে দিনে একবার, কিন্তু ত্রিবেণীতে দেবী সরস্বতী দিবারাত্র অধিষ্ঠান করেন।”
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রসহ সভার সকলেই চমকে উঠলেন জগন্নাথের আত্মপ্রশংসায়।
তখন সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথ হেসে বললেন, “কী আশ্চর্য! বুঝতে পারলেন না। ত্রিবেণীতে তো সরস্বতী দিবারাত্র বয়ে চলেছেন। নবদ্বীপে সেই নদী কোথায়?”
রুদ্র থামল। টেবল ল্যাম্পের হলদে আলোয় ওর মুখটা জ্বলজ্বল করছিল। বলল, “তুমি যদি দ্যাখো, জগন্নাথের বিভিন্ন স্থানের বাকযুদ্ধের সঙ্গে আমাদের খুনের ভেন্যুগুলো পুরো মিলে যায়। এমনকি তিথিও। আমরা ভাবছিলাম হুগলী জেলার মধ্যে খুন। কিন্তু আসলে তা নয়। খুনগুলো হচ্ছে তর্কপঞ্চাননের ফুটস্টেপস অনুযায়ী। এই আটটা জায়গাতে তিনি বড় বড় তর্কযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবং একদম শেষে কৃষ্ণচন্দ্রের বাজপেয় যজ্ঞের পরই তিনি অদ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে দেশবিখ্যাত হন।”
প্রিয়ম ভ্রূ কুঁচকে দেখছিল। রুদ্র একটা তালিকা বানিয়েছে।
জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ‘দশানন বধ’ :
ত্রিবেনী
↓
ফরাসডাঙা
↓
বৈদ্যবাটী
↓
ওলন্দাজনগর
↓
কনেনগর
↓
ত্রিবেনী
↓
বংশবাটী
↓
নবদ্বীপ
প্রিয়ম বলল, “এটা কো-ইনসিডেন্স নয়তো?”
“এত বড় কো-ইন্সিডেন্স কি একটু অস্বাভাবিক নয়?” রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছ, প্রিয়ম? যে সাতজন খুন হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিল কৃষ্ণভক্ত? শিবনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে বড় করে টাঙানো ছিল শ্রীকৃষ্ণের ছবি। ওর সাইবার ক্যাফে’র নামও ছিল শ্রীহরি সাইবার ক্যাফে। শুধু তাই নয়, ওর ল্যাপটপেও আমি দেখেছি শ্রীকৃষ্ণ ওয়ালপেপার। আমি আজ সন্ধ্যাবেলায় ওর স্ত্রী আরতিকে ফোন করেছিলাম। আরতি আমাকে জানিয়েছে, শ্যামসুন্দর নামে যে নতুন বন্ধুটি ইদানীং শিবনাথের সঙ্গে খুব মিশছিল, মেয়ে হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে তার সঙ্গে শিবনাথ একবার মায়াপুরে ইসকনের মন্দিরে যায়। কিন্তু ফেরার পর থেকেই শিবনাথ নাকি বেশ চিন্তিত থাকতো। এবং শ্যামসুন্দরের সঙ্গে ও দূরত্বও বাড়াতে শুরু করেছিল। আমরা যতজন উটকো লোকের সন্ধান পেয়েছি, কানাই, গোবিন্দ, বলরাম, শ্যামসুন্দর। প্রতিটাই কৃষ্ণের একেকটা নাম। এমনকি ক্ষমাও আমাকে বলেছিল, ও কেষ্টঠাকুরের জন্য মালা গাঁথবে।”
রুদ্র থামল। বলল, “গঙ্গা বরাবর উত্তরদিকে সোজা গেলে তো নবদ্বীপ পৌঁছনো যায়। সেখানে গঙ্গার সঙ্গে এসে মিশেছে জলঙ্গী নদী। নদীপথে যাওয়াও কোন সমস্যার নয়। নবদ্বীপ অধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সঙ্গে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের ছিল বহুবছরের বিরোধ। রাজা ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল, শক্তির উপাসক, জগন্নাথ বৈষ্ণব, উদারমনস্ক। নানাকারণে মতানৈক্য হতে হতে দুজনের বিরোধ এতদূর পৌঁছেছিল যে তর্কপঞ্চানন নবাবি দপ্তরে নিজের ইনফ্লুয়েন্স ইউজ করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে জেলও খাটিয়েছিলেন। পরে যদিও কৃষ্ণচন্দ্র নিজের সভাকবি ভারতচন্দ্রকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন যে দেবী চণ্ডীর প্রসাদেই তিনি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। কিন্তু আসল ঘটনা হল, তিনি জগন্নাথের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করে তবেই ছাড়া পেয়েছিলেন।”
প্রিয়ম এবার একটা হাই তুলল। তারপর একটু বিরক্ত গলায় বলল, “আমি বুঝতে পারছি না, তুমি বর্তমান সময়ের খুনের কিনারা করতে গিয়ে বারবার অতীতে চলে যাচ্ছ কেন! জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের লিঙ্ক তবু বুঝলাম, কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে তর্কপঞ্চাননের কী ঝামেলা হয়েছিল, তার সঙ্গে এই মিস্ট্রিকেসের সংযোগ কী?”
রুদ্র বলল, “বদনপুর চৌধুরী পরিবার।”
প্রিয়ম বলল, “বদনপুরের চৌধুরী মানে ওই শেখর চৌধুরী। উনি আবার কী করে এর মধ্যে আসছেন?”
রুদ্র বলল, “রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশের একটি শাখা প্রায় দেড়শোবছর আগে নদীয়া থেকে হুগলী চলে আসেন। বদনপুর গ্রামের পূর্বে কিছুদূর জলপথে গেলে বাঁশবেড়িয়ার গঙ্গা। অন্যদিকে সরু সরস্বতীও মিশেছে। সেই বদনপুর গ্রামে এসে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক বংশধর বসতি স্থাপন করেন। তাঁর নাম ছিল রামরাম রায়। তিনি স্থানীয় জমিদার হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে বেশ সুসম্পর্ক তৈরি করেন। তাঁরা বংশপরম্পরায় শক্তির উপাসক, দুর্গাপুজোর জাঁকজমকে তাক লাগিয়ে দেন হুগলীর বাকি জমিদারদের। রামরাম রায় ছোটলাটের তরফে পান ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু কালের নিয়মে বদনপুরের জমিদাররা হয়ে ওঠেন শুধুই চৌধুরী।”
কথা শেষ করে রুদ্র প্রিয়মের দিকে একটা মোটা বই বাড়িয়ে দিল।
বইটির নাম হুগলী জেলার প্রাচীন ইতিহাস। বিবর্ণ, অতি পুরোনো। প্রিয়ম হাত বাড়িয়ে বইটা নিল। প্রথম পৃষ্ঠায় উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরীর স্ট্যাম্প।
রুদ্র বলে চলল, “সেই বংশের একজন হলেন নীলকণ্ঠ চৌধুরী। তিনি বিবাহ করলেন ত্রিবেণীর জগন্নাথ পণ্ডিতের বাড়ির মেয়ে মৃন্ময়ীকে। কলকাতায় শুরু করলেন ‘মৃন্ময়ী টেক্সটাইলস’ ব্যবসা। তাঁদের দুই পুত্র হল। শেখর ও শঙ্কর। বাড়িতে চণ্ডীমন্দির। এদিকে শঙ্কর ছোট থেকেই কৃষ্ণভক্ত। এই ব্যাপারে তার দোসর বাড়ির পুরোহিতের ছেলে কানু। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সে তারা বাড়ি থেকে পালাল। গ্রামের একজন বাসিন্দা কানুকে একবার মায়াপুরের মন্দিরেও দেখতে পেল। একেবারে বৈষ্ণবদের ধাঁচে রসকলি আঁকা মুখে।
“কানু একা গ্রামে ফিরে এল কুড়ি বছর পর। সম্পূর্ণ ভোল পালটে। কৃষ্ণভক্ত কানু তখন ঘোর শাক্ত। নিষ্ঠাভরে মন্দিরে দেবীর পূজা করে। অথচ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘রাধা জানে।’ কেন?”
প্রিয়ম আবার একটা লম্বা হাই তুলল। বলল, “কানু চক্রবর্তীর ছবি নিয়ে মায়াপুরে গিয়ে খোঁজ করলেই হয়। তোমার ওই লোকেশ ব্যানার্জিও তো এখনো মায়াপুরে আছেন। আর তাছাড়া তুমি যে বলছ, আট নম্বর খুন হবে নবদ্বীপে, তা নবদ্বীপ একটা বড় শহর। সেখানে কাকে খুন করার পরিকল্পনা চলছে, তুমি কী করে জানবে? আমার মনে হয় তোমার এখুনি এস পি স্যারকে ফোন করে সবকিছু জানানো উচিত।”
রুদ্র অন্যমনস্কভাবে বলল, “অনেকবার ফোন করেছি। স্যারের ফোন সুইচড অফ। লিভ থেকে এখনো ফেরেননি।”
প্রিয়ম বলল, “ওঁর গার্ডকে করে দ্যাখো।”
“জানোই তো স্যার কেমন। সবসময় গার্ড নিয়ে ঘোরা পছন্দ করেন না। আর তাছাড়া এইসব হিস্টোরিকাল রেফারেন্স শুনলেই উনি রেগে যাবেন।” রুদ্র ল্যাপটপের পাশ থেকে একটা ছোট নোটবুক তুলে নিল। সেখানে গুচ্ছের কাটাকুটি হিজিবিজি কাটা।
ও বিড়বিড় করে বলল, “শেখর আর শঙ্কর, এই দুই ভাইয়ের শরীরে বইছে একদিকে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, অন্যদিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রক্তধারা। একদিকে কৃষ্ণ, অন্যদিকে শক্তি। জগন্নাথ ও কৃষ্ণচন্দ্র, দুই শত্রু এসে মিলেমিশে গিয়েছে। কিন্তু শঙ্কর চৌধুরী কোথায়? শেখর চৌধুরী কেন ভাইয়ের অস্তিত্ব চেপে গেলেন আমার কাছে?”
“আট। এই আট সংখ্যাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণ-উপাসকদের কাছে পবিত্রতমও। সামনে যে খুনটা হবে, সেটা আটনম্বর। ওদিকে বাগডাঙা সরলাশ্রমে যে গোপালকৃষ্ণ মহারাজের ছবি দেখেছিলাম, তিনিও জন্মেছিলেন ১৩২৭ বঙ্গাব্দের জন্মাষ্টমী তিথিতে। ঠিক একশো বছর আগে। আগামীকাল জন্মাষ্টমী। কৃষ্ণপক্ষও বটে।”
প্রিয়ম অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল স্ত্রীর দিকে।
রুদ্র বিড়বিড় করেই যাচ্ছিল, “কালই কি কিছু ঘটবে? নবদ্বীপে কি এমন কেউ রয়েছে, যে পালিয়ে এসেছে ওই আমীশ সমাজ থেকে?”
“কানু চক্রবর্তীর ‘রাধা’ টা কে? তার কোন প্রেমিকা? আমি কি খুব সহজ কিছু মিস করে যাচ্ছি? আমার চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে, অথচ আমি কি বুঝতে পারছিনা? কোথায় ওই শঙ্কর চৌধুরী?”
৪২
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া। অপরাহ্ন। দুর্গাপুজো সদ্যই সমাপ্ত হয়েছে, কোজাগরী পূর্ণিমা অন্তে বাতাসে হেমন্তের আগমনের আভাষ। আকাশ নির্মেঘ, শ্বেতশুভ্র মেঘ ভেসে চলেছে রাজহংসের মত।
ত্রিবেণীর গঙ্গাতীরে গত কয়েকদিন ধরেই এক স্থানে জটলা। এই পড়ন্ত বেলাতেও দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে, বেশ কিছু মানুষ একসঙ্গে ভিড় করে রয়েছে। বাজছে খোল কর্তাল। খুব অস্ফুটে ভেসে আসছে মন্ত্রোচ্চারণ।
মাঝেমধ্যেই ঘাটে উপস্থিত হচ্ছে কিছু মানুষজন, তারা ইতস্ততপদে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ভিড়ের দিকে, কিছুক্ষণ দণ্ডায়মান থেকে প্রণামান্তে আবার ফিরে আসছে। বেশ কিছুজন আবার দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখান থেকেই প্রণাম সারছে তারা।
সুসজ্জিত এক বজরা থেকে গঙ্গার ঘাটে নামলেন দু’জন ব্যক্তি। বজরাটি কলকাতা থেকে এসেছে। ব্যক্তি দুইজনের প্রথম জন গৌরবর্ণ ইংরেজ, পরনে পুরোদস্তুর বিদেশী পোশাক। অপরজন মুণ্ডিত মস্তক ব্রাহ্মণ। বেশভূষা অভিজাত।
তাঁরা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। সম্ভবত প্রস্তুত করে নিলেন নিজেদের।
দূরের ভিড় থেকে বেরিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি পাশ দিয়েই আসছিলেন, বজরায় আগত ব্রাহ্মণ তাকে সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন, “কীসের ভিড় ওদিকে?”
মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি কপালে দুই হাত জোড় করে উত্তর দিলেন, “জগন্নাথ পণ্ডিত অন্তর্জলি যাত্রায় এসেছেন যে ঠাকুরমশাই! দিনসাত-আট হয়ে গেল, ওখানেই রয়েছেন তিনি। তাই দূরদূরান্ত থেকে শেষ দেখা দেখতে আসছে সবাই। আমিও সেখানেই গিয়েছিলাম। এও তো এক বড় পুণ্যি!”
ইংরেজ লোকটি ভাঙা বাংলায় সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলে ওঠেন, “জগন্নাথ পণ্ডিত মানে সেই সেঞ্চুরি ওল্ড লেজেন্ডারি জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন তো?”
মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি লম্বা ঘাড় নাড়লেন, “আজ্ঞে। দশমীর দিন অপরাহ্নে নিজের পুত্র-পৌত্র-দৌহিত্র-প্রপৌত্র সহযোগে নিজের বাড়ির দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনে এসেছিলেন। সেখান থেকেই মনস্থির করেছিলেন, আর বাড়ি ফিরবেন না। এখান থেকেই গঙ্গাযাত্রা করবেন। সেইমত সব ব্যবস্থা হয়েছে। কীর্তন হচ্ছে। পুজোআচ্চা চলছে। আজ আটদিনে পড়েছে।”
ইংরেজ লোকটি অকৃত্রিম বিস্ময়ে বললেন, “একশো বারো বছর বয়সেও তিনি সশরীরে প্রতিমা বিসর্জন করতে নদীতে এসেছিলেন?”
“আজ্ঞে, উনি যে সাক্ষাৎ ঈশ্বর সাহেব, এত বয়সেও শক্তিহ্রাস তো দূর, স্মৃতিবৈকল্য পর্যন্ত হয়নি। আজ আটদিন একভাবে নদীতে পা স্পর্শ করে শুয়ে রয়েছেন। প্রথম তিনদিন একটু করে দুধ মুখে দিয়েছিলেন। আজ পাঁচদিন হয়ে গেল, কয়েক ফেঁটা গঙ্গাজল ছাড়া মুখে কিছুই দিচ্ছেন না। কত লোক দেখতে আসছে, আপনার মত সাহেবসুবোরাও আসছে।”
ইংরেজটি এবার সঙ্গের ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধচোখে বললেন, “সত্যিই আনবিলিভেবল কৃষ্ণদাস! খবর পেয়ে তোমার সঙ্গে এসে দেখছি ভুল করিনি।”
কৃষ্ণদাস এতক্ষণ নির্বাক ছিলেন, এবার হাসলেন। বললেন, “গুরুদেবের শিষ্য বলে বলছি না, ওঁর মত মুক্তমনা হিন্দু পণ্ডিত খুব কম রয়েছেন, অ্যালবার্ট। জোন্স সাহেব ছিলেন তোমারই মত সংস্কৃতপাগল। প্রাচ্যের সবকিছুই বড় আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। গুরুদেবের সঙ্গে তাঁর ছিল গাঢ় বন্ধুত্ব। দিনের পর দিন তাঁদের দুজনের কথোপকথনগুলো আজও যেন কানে বাজে। জোন্স সাহেব বেঁচে থাকলে পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই হোক, ছুটে আসতেন। চলো অ্যালবার্ট, যাওয়া যাক!”
অ্যালবার্ট আর কৃষ্ণদাস এগোতে থাকেন ভিড়ের দিকে। ত্রিবেণীর জগন্নাথ পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীর একসময়ের ছাত্র কৃষ্ণদাস এখন কলকাতার আদালতের জজ পণ্ডিত। পণ্ডিতমহাশয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অবশ্য বরাবরই অক্ষুণ। বার্ষিক এক থেকে দুইবার গুরুদর্শনে আসেন তিনি।
কৃষ্ণদাস স্বভাবগতভাবে রাশভারী, কিন্তু আজ যেন কেমন আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছেন। অতি প্রত্যুষে কলকাতা ছেড়ে বেরিয়েছেন শুধুমাত্র গুরুদেবকে শেষ দেখার জন্য।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন তাঁরা।
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন একভাবে শুয়ে ছিলেন। চোখ অর্ধ-উন্মীলিত, সম্মুখে গঙ্গার দিকে দৃষ্টি। কৃষ্ণদাস কিছু না বলে নিশ্চুপে গিয়ে বসলেন পায়ের কাছে। কম্পিত হস্তে স্পর্শ করলেন শিক্ষকের পা। অনুদাত্তে বললেন, “স্বেচ্ছামৃত্যুর কি খুব প্রয়োজন ছিল গুরুদেব?”
তর্কপঞ্চানন বিস্মিত হলেন না। তিনি যেন প্রতীক্ষায় ছিলেন কৃষ্ণদাসের। বললেন,
“কেচিৎ ব্রহ্ম নিরাকারং নরাকারঞ্চ কেচনঃ।
বয়ন্তু দীর্ঘ যোগেন নীরাকার মুপাস্মহে।।
আবারও বলছি, ব্রহ্ম নিরাকার। কর্মার্থে তিনি কখনো নররূপ ধারণ করেন, কখনো অন্য। সেই কর্মার্থ আমার ক্ষেত্রে ফুরিয়েছে কৃষ্ণদাস। আর কেন? বৃথা এই জীবন। মানবকল্যাণার্থে কতটুকু নিয়োজিত করতে পারলাম নিজেকে? মেয়াদ যে এবার শেষ!”
কৃষ্ণদাস বললেন, “আপনি যদি এই কথা বলেন গুরুদেব, তবে আমরা কোথায় মুখ লুকোই? আপনার দশানন বধের পর অনেক পণ্ডিতই আদি বেদ পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন। ইতিমধ্যেই বেদোত্তর সাহিত্যের অপভ্রংশকে অতিক্রম করার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি অনেকের মধ্যে। এ কি আপনারই জয় নয়?”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন তিক্তস্বরে বললেন, “কীসের জয় কৃষ্ণদাস? এই দুর্গাপুজোর মধ্যেও ত্রিবেণীর একটি বাচ্চা মেয়ে স্বামীর চিতায় সহমৃতা হয়েছে। আমার দেখা একাধিক শিশুকন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বৈধব্যযন্ত্রণা সহ্য করে চলেছে। নমঃশূদ্র কারুর ছায়া মাড়ালে স্নান করতে ছুটছে ব্রাহ্মণের দল। অথচ আমি কীভাবে বোঝাব, সহমরণ বেদসিদ্ধ নয়? কীভাবে সেই নিষ্পাপ শিশুগুলোর বাপদের লোকলজ্জা এড়িয়ে সম্মত করাব পুনর্বিবাহে? কী করে বলব, যজুর্বেদে লেখা রয়েছে, তপসে শুদ্রম?১ জন্মাধিকারে নয়, বহুপরিশ্রমী, কঠিন কার্যকারী পুরুষমাত্রেই শুদ্র? আমি… আমি একজন ব্যর্থ মানুষ, কৃষ্ণদাস! শ্রী চৈতন্যের মত মানসিক শক্তি আমার নেই, ক্ষমতা নেই সমাজের বিষস্ফোটকগুলো সারিয়ে তাকে পাল্টে দেওয়ার!”
কৃষ্ণদাস চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “সতী নিশ্চয়ই একদিন বন্ধ হবে গুরুদেব। পরাশর মুনির সেই নষ্টে মৃতে প্রবজ্রিতে শ্লোকও কেউ একদিন ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে নিয়ে আসবে মুক্তির আলোকে। শুদ্ররাও শিক্ষিত হবে।”
“সেই আশাতেই তো এই জীবন সম্পূর্ণ করছি কৃষ্ণদাস!” ফিসফিস করে বললেন তর্কপঞ্চানন। তাঁর চোখ বুজে গিয়েছে, একদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, “যে যাই বলুক, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান … ঈশ্বর এক। ঈশ্বর অভিন্ন। সেই ঈশ্বর শুধুমাত্র মানবপ্রেমের মন্ত্রে তুষ্ট হন। ভেদাভেদ, শোষণে নয়। একদিন এমন কেউ আসবেন যিনি এই বৈষম্য শোষণ নিগ্রহ বন্ধ করে আবার সমাজকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন সত্যযুগের সাম্যবাদে। তিনিই হবেন প্রকৃত কল্কি! তেমন কাউকে ঈশ্বর একদিন নিশ্চয়ই মর্ত্যে পাঠাবেন, বলো!”
কৃষ্ণদাস চেপে ধরলেন শতায়ু বৃদ্ধের শীর্ণ হাত। কম্পিত স্বরে বললেন, “নিশ্চয়ই গুরুদেব! সেদিনের আর বেশি দেরি নেই!”
দূরে দণ্ডায়মান প্রাচ্যভক্ত তরুণ ইংরেজ অ্যালবার্ট সাহেবের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে ত্রিবেণীর সূর্য জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রিয় শিষ্যের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, “আ নো ভদ্রাঃ ক্রতবো যন্তু বিশ্বতঃ। রুচং শুভ্রেষু।”২
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন চোখ বুজলেন। দেহ এলিয়ে দিলেন শেষশয্যায়। কেউ একজন ঠোঁটে ঠেকালেন গঙ্গাজলে পূর্ণ তাম্রপাত্রটি। সেই জল মুখগহ্বরে প্রবিষ্ট হল না। গড়িয়ে পড়ল পাশে।
শায়িত অবস্থায় প্রণাম অনুচিত জেনেও কৃষ্ণদাস যখন গুরুর চরণে মস্তক স্পর্শ করলেন, ততক্ষণে ত্রিবেণীসূর্য বিলীন হয়ে গিয়েছেন। অন্তর্জলী যাত্রান্তে হচ্ছে শঙ্খধ্বনি। বাড়ছে কীর্তনের কলরোল।
এই অপরাহ্নে অস্তায়মান সূর্যের মতই প্রাকনবজাগরণপর্বের প্রথম আলোকপুরুষ চলে গিয়েছেন অস্তাচলে। দায়ভার অর্পণ করে দিয়ে গিয়েছেন উত্তরসূরীদের স্কন্ধে।*
_____
১ যজুর্বেদ, ৩০/৫
২ শুভচিন্তার উদয় হোক। ব্রাহ্মণ হোক বা ক্ষত্রিয়, বৈশ্য হোক বা শুদ্র, পুরুষ হোক বা নারী, সকলকে সমভাবে সম্মান কোরো। – যজুর্বেদ, ১৮/৪৮
* জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের তিরোভাব হয় ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে। ততদিনে জন্মে গিয়েছেন রামমোহন, নিরলস পরিশ্রম করে তিনি খুঁড়ে বের করছেন প্রকৃত বৈদিক শাস্ত্রগুলি। আর তার তেরোবছর পরই ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও। সতীদাহ আইন পাশ হবে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে, বিধবা বিবাহ ১৮৫৬। আরো পরে আসবে ভারত সরকারের অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন। ত্রিবেণীর ‘রোমশ পন্ডিত’এর শেষ ইচ্ছা সত্যিই ঈশ্বর পূরণ করেছিলেন।
৪৩
ভোর যখন চারটে, আবার এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে প্রিয়মের ঘুম ভেঙে গেল।
“কী হল’টা কি! তুমি কি একটু ঘুমোতেও দেবে না?” প্রিয়ম অতিকষ্টে চোখ খুলল। বাইরে এখনো অন্ধকার। বাগানের গাছগুলোর পাতায় রাত্রি এখনো জমাট বেঁধে রয়েছে।
প্রিয়ম দেখল, রুদ্রর পরনে পুরোদস্তুর পুলিশ উর্দি। একহাতে কোমরে বেল্ট আঁটছে, অন্যহাতে চিরুনি, কোনমতে এলোমেলো চুলগুলো টেনে বাঁধার চেষ্টা করছে।
“একি! তুমি কোথায় যাচ্ছ!”
রুদ্রর চোখদুটো লাল, বোঝাই যাচ্ছে সারারাত সে জেগে রয়েছে। শান্ত গলায় বলল, “বললাম তো, নবদ্বীপে।”
“কিন্তু নবদ্বীপে কে খুন হবে?”
রুদ্র মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি জানি না। আদৌ আমার এই গোটা অ্যানালিসিসটা ঠিক কিনা তাও আমি শিওর নই। কিন্তু এত বড় ঝুঁকি নিয়ে বসে থাকা যায় না। এবারেও কোনো মার্ডার হলে রাধানাথ স্যার আমায় কোনোভাবেই বাঁচাতে পারবেন না। আমেরিকায় এখন ক’টা বাজে?”
রুদ্রর শেষ বাক্যে প্রিয়ম হকচকিয়ে গেল। বলল, “অ্যাঁ?”
রুদ্র কাকে ফোন করছিল। একবার দু’বার। লাইন পাওয়া মাত্র ও চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যালো শুভাশিসবাবু, রমণীমোহন ভট্টাচার্য যাকে দত্তক নিয়েছিলেন, সেই নকলদাদুর নাম গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, রাইট?”
রুদ্র ফোনটাকে স্পীকারে করে চুল বাঁধছিল। প্রিয়ম পরিষ্কার শুনতে পেল, শুভাশিসদা বলল, “হ্যাঁ।”
“আপনি বলেছিলেন, দত্তক নিলেও গোপালকৃষ্ণবাবু আসলে আপনাদেরই এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলে ছিলেন। কিরকম আত্মীয় বলতে পারবেন?”
“এইরে! দাঁড়ান আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আপনার ভাগ্যটা ভালো। বাবা-মা আমার কাছে এসে রয়েছেন আজ মাসতিনেক হল।” শুভাশিসবাবু কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে গেলেন।
প্রায় মিনিট খানেক পর বললেন, “হ্যাঁ। নকলদাদু ছিলেন রমণীমোহনের শ্যালকের পুত্র। নিজের শ্যালক নয়। রমণীমোহনের স্ত্রীর কীরকম এক তুতো ভাই। তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে। ছোট ছেলে গোপালকৃষ্ণ।”
রুদ্র কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “আ-আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করুন তো, সেই বোনের নাম কি মৃন্ময়ী? বিয়ে হয়েছিল হুগলীর কোন জমিদারবাড়িতে?”
শুভাশিসবাবুও বোধহয় ফোনটা স্পীকারে করে দিয়েছিলেন। পাশ থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোকের ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
“হ্যাঁ। নকলজ্যাঠার বোনের বিয়ে হয়েছিল হুগলীর এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেই গ্রামের নাম বদনপুর। গ্রামটা প্রত্যন্ত হলেও সেখানকার ভূতপূর্ব জমিদার চৌধুরীদের বংশকৌলীন্যে বেশ নাম ছিল। আর তাছাড়া রমণীমোহন তাঁর একটা বিশাল সম্পত্তি নকলজ্যাঠার নামে লিখে দিয়েছিলেন, যেটা বদনপুর থেকে কাছেই। নকলজ্যাঠা যতদিন সংসারে ছিলেন, নিজের পরিবার ও আমাদের পরিবার দুই তরফেই সম্পর্করক্ষা করতেন।”
রুদ্র শুনতে শুনতে ঝড়ের বেগে একটা বংশের ডায়াগ্রাম আঁকছিল।
শুভাশিসবাবুর বাবা থামতেই উদগ্রীব হয়ে ও প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য কেন নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, জ্যেঠু?”
“নিরুদ্দেশ হননি তো!” রুদ্র আর প্রিয়মকে বিস্মিত করে বললেন শুভাশিসবাবুর বাবা, “আমেরিকায় পড়তে এসে উনি প্রথমে জড়িয়ে পড়েছিলেন হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের সঙ্গে।”
“হরেকৃষ্ণ আন্দোলন!”
“হ্যাঁ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের যে কৃষ্ণ আন্দোলন আমেরিকা থেকে শুরু করে নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। শ্রীল প্রভুপাদ তৈরি করেছিলেন ইসকন। নকলজ্যাঠা একেবারে প্রথম থেকে ইসকনের সঙ্গে ছিলেন। প্রভুপাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। অনেক দেশও ঘুরেছিলেন ইসকনের প্রচারে। তবে পরে শুনেছিলাম মতানৈক্য হচ্ছিল। তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই।”
“মাই গড!” রুদ্র ফোনটা রেখে অস্ফুটে বলল।
“কী!” প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল।
রুদ্র বলল, “আমি একটা হাঁদা। মস্ত বড় হাঁদা।”
“মানে?” প্রিয়ম বলল, “কেন, এরকম বলছ কেন?”
রুদ্র বলল, “শোনো! নবদ্বীপ নয়, আট নম্বর খুনটা হবে মায়াপুরে। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সময়ে মায়াপুরটাও নবদ্বীপেই ছিল। আমি প্রিয়াঙ্কা, জয়ন্ত আর বীরেনবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছি। সবাই এখুনি আসছে। নবদ্বীপ নয়, আমাদের এখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে মায়াপুরের উদ্দেশ্যে। কাছাকাছিই অবশ্য।”
“মায়াপুর?” প্রিয়ম অবাক, “সেটা কী করে বুঝতে পারলে?”
রুদ্র উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল, “মাথায় যার সামান্যতম গ্রে ম্যাটার থাকবে, সে-ই বুঝতে পারবে। মায়াপুরে ইসকন মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত রয়েছে। সারা পৃথিবী থেকে সেখানে কৃষ্ণ অনুরাগীরা আসেন। তারা সকলেই কৃষ্ণভক্ত, অথচ ইসকন আধুনিক সভ্যতার সবকিছুই ব্যবহার করে। বিশাল বড় ইমারৎ থেকে শুরু করে কম্পিউটার, ইলেক্ট্রিসিটি, হাসপাতাল সব! তাই, মায়াপুরের ওপর তো আমীশ সমাজের সবচেয়ে বেশি রাগ হওয়া উচিত! তাই না? আর সেই রাগ মেটানোর জন্য যদি তারা আজকের দিনটাকে টার্গেট করে? আজ জন্মাষ্টমী। সেখানে প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়েছে। অনেক বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে প্রিয়ম! আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে!”
“তুমি শিওর?”
“শিওর কিনা জানি না, ঝুঁকি নিতে পারব না। এক-একটা মিনিটও এখানে ক্রুশিয়াল। এস পি স্যারকে ফোনে পাইনি, আমি কমিশনার স্যারকে এখুনি ফোন করে সব জানাচ্ছি। এত ক্রুশিয়াল ব্যাপার, সুনীত বসু নিশ্চয়ই পারমিশন দেবেন। মায়াপুরে ঢোকার পর থেকেই যদি নদীয়া পুলিশের একটা স্পেশাল টাস্ক ফোর্স আমাদের সঙ্গে থাকে, অনেক ইজি হয়ে যাবে ব্যাপারটা!”
৪৪
আজ কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী। চন্দ্রদেব প্রায় অস্পষ্ট হয়ে অবস্থান করছেন মহাকাশে। তাঁর ক্ষীণ আলোয় চারপাশ এক অদ্ভুত আবছা মেদুরতায় ভরে উঠেছে। কেমন এক অপার্থিব পরিবেশে নিস্তব্ধ গঙ্গা দিয়ে বয়ে চলেছে কয়েকটি নৌকো। ঠিকমতো গুণে দেখলে দেখা যাবে, তাদের সংখ্যা আট। ভটভটি নৌকো নয়, দাঁড় টানা নৌকোর ছলাত ছলাত শব্দে মধ্যরাত্রির নৈঃশব্দ্য যেন থেকে থেকেই চমকে উঠছে।
সারিবদ্ধ পিঁপড়ের মতো নৌকোগুলো বয়ে চলেছে গঙ্গা দিয়ে। অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছে তারা। সামনেই জলঙ্গী নদীর সঙ্গে গঙ্গার মিলন।
শ্রীহরি বলে মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী ছাত্রটা শক্তমুখে বসেছিল। ওদের নৌকোয় নারায়ণী চতুষ্পাঠীর অনেকজন ছাত্র একসঙ্গে চলেছে। সবাইকে সার দিয়ে প্রধান পুষ্করিণী কৈবর্ত ও বাগদিদের পাড়ার পাশ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল শ্মশানে। তারপর একে একে সকলকে শ্মশানঘাট থেকে তোলা হয়েছিল নৌকোয়।
বনমালী শ্রেষ্ঠ ছাত্র, তাকেই দেওয়া হয়েছে দল নেতৃত্বের দায়ভার।
বনমালী বলছিল, “ওখানে পৌঁছে আমাদের মিশে যেতে হবে সকলের সঙ্গে। ভর্তৃহরি মহারাজ ও তাঁর ছাত্ররা সেখানে থাকবেন। তাঁরাই নির্দেশ দেবেন আমাদের কী করতে হবে। আজ সারারাত জুড়ে চলবে কর্মকাণ্ড। আমরা আবার বৈদিক সমাজে ফিরব আগামীকাল ভোরে। যুদ্ধজয় শেষে।”
ছাত্ররা সকলে একসঙ্গে থাকায় সবাই নীচুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল। কিন্তু শ্রীহরি কোনো কথা বলছিল না। ওর ভাবনাচিন্তা খুব একটা পরিণত নয়। চিন্তা করতে পারেনা বলেই সবকিছুকে নিজের মুখস্থবিদ্যা দিয়ে অতিক্রম করতে চায় ও।
কিন্তু আজ ওর মন যেন ভীষণ এক কু ডাকছে। দ্বারিকা যা বলল, তা কি সত্যি? ও তো আজ পর্যন্ত এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি!
কল্কি অবতারের সৈনিক হয়ে ওরা যা করতে যাচ্ছে, তা কি আদৌ শুভকাজ?
ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিল শ্রীহরি, হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল পিঠে একটা খোঁচায়।
পেছন ফিরে দেখে, ওর একেবারে পেছনে বসে রয়েছে রাখহরি। মুখ গম্ভীর, চোখে এই স্বল্প আলোতেও স্পষ্ট বিদ্যমান সংশয়।
“দ্বারিকা কোথায়?”
শ্রীহরির মুখচোখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তার উপস্থিত বুদ্ধি বা বানিয়ে বলার ক্ষমতা দুটোই প্রায় শূন্য। পুঁথিগত স্মৃতিশক্তিই তার একমাত্র সম্বল। সেখানে এই প্রশ্নটা যে কোথাও নেই, সেই বিষয়ে ও নিঃসংশয়।
“কীরে? মুখে কুলুপ আঁটলি কেন?” রাখহরি গর্জে ওঠে, “শ্মশানে আসার সময়েও তো দেখলাম দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে গুজগুজ করছিলি। সে গেল কোথায়?”
শ্রীহরি প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে উত্তর দেওয়ার। দ্বারিকা যে শ্মশানঘাট থেকে কৌশলে ঢুকে পড়েছে বাগদিদের পাড়ায়, তা বলা যাবে না কোনমতেই।
বুদ্ধিটা দ্বারিকাই দিয়েছিল।
বলেছিল, “আমি যাব না শ্রীহরি।”
“যাবি না মানে!” শ্রীহরি ভিতুচোখে তাকিয়েছিল বন্ধুর দিকে, “সকলে যাচ্ছে, আর তুই যাবি না, এ’কেমন কথা হল?”
দ্বারিকা কণ্ঠস্বর আরও খাদে নামিয়ে বলেছিল, “অনেকেই যাচ্ছে না। আমার একটা কাজ পড়ে গেছে শ্রীহরি।”
“কী কাজ?”
“তোর ব্রজেন্দ্রদাদাকে মনে আছে?”
শ্রীহরির মুখ সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত হয়ে গিয়েছিল, “একি। ব্রজেন্দ্রদাদাকে মনে থাকবে না? সেই কালোপুকুরের মাঝখানে … ওইরকম দৃশ্য কেউ ভুলতে পারে?”
“ঠিক বলেছিস।” দ্বারিকা প্রায় শুনতে না পাওয়ার মতো করে বলেছিল, “ব্রজেন্দ্রদাদার অপূর্ণ রেখে যাওয়া কাজটা আমাকেই সম্পূর্ণ করতে হবে, শ্রীহরি!”
“তোকে!”
“হ্যাঁ। আমি ঠিক সুযোগ বুঝে সরে পড়ব। কেউ জিজ্ঞেস করলে যাহোক কিছু বলে দিস।”
“কিরে, তুই কি কানে কালা হয়ে গেলি নাকি?” রাখহরির পর এখন ঝুঁকে এসেছে বনমালীও।
আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে শ্রীহরির মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায়, “ওই যে দেখছিস পেছনের নৌকোটা, তাতে করে আসছে।”
সবাই কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে যায়। রাখহরি, বনমালীরা বসে আছে নদীর দিকে পেছন ফিরে, গলুইয়ের মধ্যে আড়াআড়ি। আর শ্রীহরি বসে আছে নদীর মুখোমুখি।
নৌকো সত্যিই আসছে। একটা নয়, তিনটে। সবচেয়ে সামনের নৌকোটার মাঝি বোধ হয় এই নৌকোর চেয়ে বেশি বলশালী, দ্রুত দাঁড় টানায় নৌকোটা এগিয়ে আসছে তাড়াতাড়ি। দাঁড় টানার শব্দ হচ্ছে ছপছপ।
বনমালী বলে, “অ। আমি ভাবলুম তোর বিজ্ঞ বন্ধুটি বোধ হয় ভয়ে পালিয়েছে, হা হা!”
সবাই যোগ দেয় হাসিতে। কিন্তু শ্রীহরি হাসতে পারে না।
কারণ ততক্ষণে পেছনের নৌকোটার গলুইয়ের ওপর পড়া চাঁদের আলোয় স্বল্প উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা দৃশ্যটা ওর অন্তরাত্মা ভয়ে হিম করে তুলেছে।
চাঁদের আলোয় নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় শ্রীহরি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, নৌকোর গলুইয়ে শুয়ে রয়েছে অচ্যুত।
চোখ সম্ভবত বোজা।
আর তার দুদিকে হাতদুটো শক্ত করে চেপে বসে রয়েছে গোপাল ব্যানার্জির দুই শাকরেদ!
অচ্যুত তার মানে বেঁচে রয়েছে?