গ্লানির্ভবতি ভারত – ৫০

৫০

জনাপনেরোর দলটা গোটা ক্যাম্পাসটা পাক দিচ্ছিল। দু-হাত ওপরে তুলে মাঝেমাঝেই ‘হরেকৃষ্ণ’ বলছিল, তারপর আবার হাঁটছিল। তাদের কারুর কারুর হাতে খঞ্জনি। সেগুলোর মিলিত শব্দে বেশ লাগছিল শুনতে।

দলের পেছনে অনেক সাধারণ ভক্তও হাঁটছিলেন, যারা জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে এসেছেন এই পুণ্যধামে। উচ্চৈঃস্বরে হরেনাম না করলেও তাঁরা গলা মেলাচ্ছিলেন।

প্রিয়াঙ্কা ঢিমেতালে হাঁটছিল। সঙ্গে লোকেশবাবুর স্ত্রী। লোকেশবাবুর স্ত্রীর নাম কাকলি। তিনি বেশ সাধাসিধে মহিলা। হাঁটতে হাঁটতে মায়াপুরে প্রতিবছর আসার নানা টুকরোটাকরা অভিজ্ঞতার গল্প করছিলেন প্রিয়াঙ্কার কাছে।

“এখন কী ভিড় দেখছ, রাতের বেলা যখন মহাপ্রসাদ বিতরণ হবে, তখন ভিড় উপচে পড়বে। আমি তো সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবার হাত ধরে আসতাম। এখন লোকেশ প্রতিবছর আসতে পারুক না পারুক, আমি ঠিক কাউকে না কাউকে সঙ্গে করে চলে আসি। বছরে দোলপূর্ণিমা আর জন্মাষ্টমী, এই দুটো তিথিতে এখানে না এলে মনটা বড় খারাপ লাগে, জানো!”

স্বামীর সহকর্মীর সঙ্গে কাকলি নিজের মনে বকে চলেছিলেন। প্রিয়াঙ্কাও হু—হা করছিল। ইচ্ছে করেই ও লোকেশবাবুর স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটছে, এতে কেউ লক্ষ্য করলেও সন্দেহ করবে না।

ওর ভেতরটা আফশোসে পুড়ে যাচ্ছে।

ছেলেটা কোথায় গেল? কিছুদূর গিয়ে যেন উবে গেল ভিড়ের মধ্যে। আসলে চারপাশে একই পোশাক, একই ধরনের কিশোর স্বেচ্ছাসেবকের ছড়াছড়ি। প্রিয়াঙ্কা গুলিয়ে ফেলেছে।

ছেলেটা কি ওকে চেনে? ওরা এত কড়া নিরাপত্তায় গোটা ক্যাম্পাস মুড়ে রেখেছে, তবু কি সেই আমীশ সমাজের লোকেরা এখানে সাধারণ লোকদের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে?

একদিকে জনা চার পাঁচ শাড়ি পরিহিতা বিদেশিনী কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ‘হরেকৃষ্ণ’ গাইছিলেন। তাদের ঘিরে রয়েছে কিছু স্থানীয় ভক্তের জটলা।

কাকলি সেদিকে এগিয়েও হঠাৎ থেমে গেলেন। বললেন, “আমি একটু বাথরুম যাব। তুমি যাবে?”

“না।” প্রিয়াঙ্কা বলল, “আপনি ঘুরে আসুন। আমি এখানেই থাকব।”

কাকলি মাথা নেড়ে প্রস্থান করতেই প্রিয়াঙ্কা ছেলেটাকে আবার দেখতে পেল। বিদেশিনীদের সেই নাচের দলের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে সেই ধুতি-ফতুয়া। মুখটা ঢলোঢলো, চোখদুটোয় বুদ্ধি ঝকঝক করছে। অন্যদের মতো এর মাথা চকচকে করে কামানো নয়। অল্প অল্প চুল রয়েছে।

ছেলেটার হাতে একটা পেতলের থালা। তার ওপর যে ফুলগুলো রাখা রয়েছে, সেগুলো সম্ভবত প্রসাদী। প্রত্যেক ভক্তের কাছে ধীর মন্দ্র পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। প্রত্যেক ভক্ত সেই থালা থেকে একটু বা দুটি ফুল তুলে নিলে সে আবার চলেছে পরের জনের কাছে।

এদিকটা অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। প্রিয়াঙ্কা চুপিসারে গিয়ে একেবারে পেছনদিকে দাঁড়াল, যাতে ছেলেটা একেবারে শেষে ওর কাছে আসে। ওর আশেপাশে ওই পোশাকের আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

ছেলেটা ওর কাছে আসতেই ও মিষ্টি করে হাসল। চাপা গলায় আন্দাজে একটা ফাঁকা প্রশ্ন ছুঁড়ল, “আমায় চিনতে পারছ তুমি?”

“হ্যাঁ।” লম্বা করে মাথা হেলালো ছেলেটা, “কানুখুড়োর মন্দিরে এসেছিলে না তুমি? তোমার সঙ্গে আরেকজন ছিল। দুজনেই ছেলেদের মতো জামা পরেছিলে। আমি জানলা দিয়ে দেখেছিলাম।”

“ঠিক বলেছ তুমি।” প্রিয়াঙ্কা বলল, “তুমি কানুখুড়োর ওখান থেকে কবে এলে?”

ছেলেটার মুখটা কালো হয়ে গেল। চারপাশ একবার দেখে নিয়ে বলল, “কালই। নিজে থেকে আসিনি গো। জোর করে ধরে এনেছে।”

“জোর করে ধরে এনেছে? কেন?”

ছেলেটা চোখ নামাল। বলল, “গুরুদেবের আদেশ। কানুখুড়োকে খুব মেরেছে গো।”

৫১

রুদ্রর গাড়ি ঝড়ের গতিতে ছুটছিল দিল্লি রোড ধরে। গাড়ি চালাচ্ছে জয়ন্ত। সামনের আসনে বসে রুদ্র টেনশনে বারবার নখ কাটছে। পেছনে রয়েছে রাধানাথ রায়ের দেহরক্ষী অর্জুন ও তিনজন কনস্টেবল।

সঙ্গে আসছে একটা পুলিশ জিপ। তাতে দশজন কনস্টেবল। বাকিদের নিয়ে কমিশনার সুনীত বসু নিজে আসছেন একটু পেছনে।

জয়ন্ত বলল, “কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আমাদের এই আমীশ সমাজ খুঁজতে যাওয়ার থেকে কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মায়াপুরে থাকা ছিল না? আপনি নেই, ওরা যদি বাই চান্স সিচুয়েশন কন্ট্রোল করতে না পারে, পুরো রেসপন্সিবিলিটি আপনার ঘাড়ে পড়ে যাবে। লোকেশবাবু কি সব সামলাতে পারবেন?”

রুদ্র বলল, “কথাটা তুমি ঠিকই বলছ, জয়ন্ত। কিন্তু কিছু কিছু সময় এমন আসে, যে কিছু করার থাকে না। এটা তো বুঝতে পারছ, মায়াপুরের সঙ্গে ওই সমাজের সবসময় যোগাযোগ রয়েছে। যতই ওরা নতুন টেকনোলজিকে ঘৃণা করুক, নিজের লোকদের এইসব ব্রেইন ওয়াশ করুক, এস পি স্যার নিজে দরকারে যে মোবাইল ব্যবহার করেন, তা আমরা সবাই জানি। আমরা সবাই একই জায়গায় থাকলে এইদিকটায় ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। সেটাও তো ভুললে চলবে না।”

জয়ন্ত চুপ করে রইল।

“আর লোকেশবাবু সিনিয়র বলে তাঁকে বলে এসেছি, কিন্তু আসল কাজ তো করবে প্রিয়াঙ্কা। প্রিয়াঙ্কা কমপিটেন্ট অফিসার। ওর ওপর আমার ভরসা রয়েছে।” রুদ্র আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ফোন বাজতে শুরু করল। কমিশনার সুনিত বসু আবার ফোন করছেন।

“হ্যাঁ স্যার, বলুন। আমরা অন দ্য ওয়ে রয়েছি।”

“রুদ্রাণী, কয়েকটা কথা মন দিয়ে শোনো। রাধানাথ রায়ের দাদা শেখর চৌধুরী গত কয়েক বছর ধরে একটা মোটা টাকা মায়াপুরে ডোনেট করেন। যদিও দাদার নামে, আমি শিওর, এর পেছনে রাধানাথ রায়ই রয়েছেন।”

“হ্যাঁ স্যার।” রুদ্র বলল, “লোকেশবাবুও বলছিলেন, উনি আগে দু’একবার স্যারকে ওখানে দেখেছেন। আপনি কি একবার লোকেশবাবুর সঙ্গে কথা বলবেন?”

“রুদ্রাণী, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। এইবছর গোটা মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে যে মহাপ্রসাদ ভক্তদের খাওয়ানো হবে, সেই ভোগ রান্নার কন্ট্রাক্ট পেয়েছে চন্দননগরের বাগডাঙা সরলাশ্রম। এই কন্ট্রাক্টে গ্যারান্টর হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন শেখর চৌধুরী।”

তীব্র এক ঝাঁকুনি। রুদ্রর নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল।

“রুদ্রাণী, ক্যান ইউ হিয়ার মি? তুমি তো ওই আশ্রমে গিয়েছিলে, রিপোর্টে দেখলাম।”

রুদ্রর মাথা কাজ করছিল না। তার মধ্যেই ওর মনে হল, এই মুহূর্তে মায়াপুর মন্দিরে কত সংখ্যক ভক্ত রয়েছেন?

দশ হাজার? পনেরো হাজার?

ভোগের প্রসাদে বিষ মিশিয়ে যেভাবে একসঙ্গে এতজনকে হত্যা করা যায়, তেমন কোনো সুযোগ আর কোন পন্থায় আছে কি? এতক্ষণ কেন একবারও এই সম্ভাবনাটা মাথায় আসেনি?

ও উদ্ভ্রান্তের মতো বলল, “স্যার, উইথ ডিউ রেসপেক্ট, আমি আপনাকে একটু পরে ফোন করছি।”

ফোনটা কেটে দিয়ে ও ফোন করল প্রিয়াঙ্কাকে। ওর বুকের মধ্যে জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে।

প্রিয়াঙ্কার ফোন বেজে বেজে কেটে গেল। কেউ তুলছে না। রুদ্র ঘড়ি দেখল। রাত সাড়ে দশটা।

ক’টায় বিতরণ হয় মহাপ্রসাদ?

রুদ্র আবার ডায়াল করল। এবার লোকেশ বাবুর নম্বরে। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করলেন ভদ্রলোক, “ইয়েস ম্যাডাম!”

“প্রিয়াঙ্কা কোথায়?”

লোকেশবাবু কী বলছেন, ভালো করে শোনাই যাচ্ছে না। পাশেই প্রচণ্ড জোরে চলছে হরিনাম সংকীর্তন। খোল কর্তালের আওয়াজে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

রুদ্র চেঁচিয়ে বলল, “হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন? প্রিয়াঙ্কা কোথায়?”

“কে? প্রিয়াঙ্কা ম্যাডাম? উনি আর আমার স্ত্রী একটু প্রধান মন্দিরের দিকে গিয়েছেন। কিছু বলতে হবে, ম্যাডাম?”

রুদ্র বলল, “আপনি ইমিডিয়েটলি ওকে বলুন, রাত বারোটায় যে ভোগ বিতরণ হবে, সেই খাবারের রান্নাঘর যেন সিজ করে। এনশিওর করুন, একজন লোকও, অ্যাই রিপিট একজন লোকও যাতে সেই ভোগ না খায়।”

“কী বলছেন ম্যাডাম?” খোল কর্তালের আওয়াজ ছাপিয়ে লোকেশবাবু প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করছেন, “ওহ এখানে এত আওয়াজ, কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না! কী বলছেন, রোগ নির্ধারণ? না, এখানে তো কেউ অসুস্থ নেই!”

রুদ্র বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিল। ঘড়িতে রাত এগারোটা। যত দ্রুত সম্ভব মায়াপুর মন্দিরের রান্নাঘর সিল করতে হবে। কমিশনার স্যারকে ফোন করে নদীয়ার টাস্ক ফোর্স যারা এই মুহূর্তে ওখানে ডিউটি করছে, তাদের বলাটাই ঠিকঠাক হবে।

যথাসম্ভব সংক্ষেপে গোটা বক্তব্য বুঝিয়ে ফোন রাখল ও। ঘড়িতে রাত এগারোটা পনেরো। দিল্লি রোড দিয়ে সাঁই সাঁই করে লরি ছুটে চলেছে। উলটোদিক থেকে আসা গাড়ির সার্চলাইট চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

রুদ্রর বুকের ভেতরটা কেমন করছে। কী অপেক্ষা করছে আজ সেই অজানা ফার্মহাউজের অন্তরালে?

চাকরিতে যোগদানের পর থেকে যে মানুষটিকে দেখে এসেছে কর্মক্ষেত্রে নিজের আদর্শ হিসেবে, সেই মানুষটিই কিনা শেষে অপরাধের মূল নায়ক সাব্যস্ত হয়েছেন?

কিন্তু কেন?

কমিশনার সাহেবের কথায় ‘কেন এতগুলো খুন করাবেন তিনি?’

প্রিয়মের কথায়, ‘মোটিভ কী?’

ভাবতে ভাবতে রুদ্র যেন কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন থেকে ক্ষমা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র থেকে সরলাশ্রমের ভর্তৃহরি মহারাজ, কানু চক্রবর্তী থেকে আমেরিকার শুভাশিসবাবু, সবাই যেন ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নের মতো আসছিল ওর ভাবনার মধ্যে।

যেন একটা প্রকাণ্ড দরজা। সেই দরজার পাল্লায় লাগানো রয়েছে অসংখ্য ছোটবড় তালা। ওর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা চাবির গোছা। কাজ শুধু সঠিক তালায় সঠিক চাবি লাগানো।

সময় খুব কম। সব তালা ঠিকমতো না খুলতে পারলে খোলা যাবে না দরজা। ঘটে যাবে ভয়ংকর বিপদ।

৫২

হঠাৎ পেছন থেকে জয়ন্তের কথায় রুদ্রর চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। চলন্ত গাড়িতে চমকে তাকায় ও, “কী হয়েছে?”

“ম্যাডাম, অনেকক্ষণ থেকে আপনার ফোন বাজছে!”

সত্যিই তো! ফোন বেজে চলেছে, ও খেয়ালই করেনি। অজানা নম্বর দেখে তড়িঘড়ি রিসিভ করে ও, “হ্যালো!”

“কাজটা ভালো করলে না রুদ্রাণী। তোমার প্রোবেশন পিরিয়ডের মধ্যেই কেরিয়ারটাকে শেষ করে ফেললে!”

এস পি রাধানাথ স্যারের হিমশীতল কণ্ঠে বলা কথাগুলো কানে প্রবেশ করা মাত্র রুদ্র স্থির হয়ে গেল।

রাধানাথ স্যার নিজে ফোন করেছেন ওকে। এটা কোন নম্বর?

ও কিছু বলার আগেই স্যার বললেন, “কী ভাবছ, আমাকে জেলে পুরবে? কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে? কোর্টে গিয়ে কি তোমার ইতিহাসের গালগল্প শোনাবে? না অন্য কোনো ছেঁদো গল্প জুড়বে?”

রুদ্র স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। যে স্যারকে ও এতদিন দেখে এসেছে, তার সঙ্গে ফোনের ওপারের কণ্ঠস্বরকে যেন মেলাতে পারছিল না কিছুতেই।

শ্রদ্ধার আগলটা যখন ভেঙে যায়, তখন আর মানুষটি শ্রদ্ধেয় থাকেন না। নেমে আসেন নিজেরই স্তরে। কিংবা নিজের থেকেও নীচে।

রুদ্র হেসে বলল, “কেন স্যার? আপনার ফার্ম হাউজের নাম শম্ভল, দেবদত্ত আপনার ঘোড়ার নাম, আপনি তো সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণের অবতার!”

বিপরীত প্রান্তে রাধানাথ রায় একটু থমকে গেলেন। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, “মানে?”

“মানে তো স্পষ্ট স্যার।” রুদ্র মিহিস্বরে বলল, “আপনি নিজেকে অন্তিম অবতার কল্কি মনে করেন। কল্কির গ্রামের নাম শম্ভল, ঘোড়ার নাম দেবদত্ত। সেইজন্যই তো আপনি এই নামকরণগুলো করেছেন। আপনার হাতেই তো কলিযুগের বিনাশ! আপনিই তো ত্রাতা।”

ওপাশে রাধানাথ স্যার সম্পূর্ণ চুপ। কোনো শব্দ নেই।

রুদ্র বলল, “কিন্তু এই নিরপরাধ লোকগুলোকে মেরে কীভাবে আপনি সত্যযুগ প্রতিষ্ঠা করবেন, স্যার?”

“নিরপরাধ? কারা নিরপরাধ?” রাধানাথ রায় এবার চিৎকার করে উঠলেন, “তোমার ওই স্বপন সরকার? যে নিজে শূদ্র হয়ে ব্রাহ্মণ চাকর রাখার দুঃসাহস করে? না ওই শিবনাথ? যে এই পবিত্র বৈদিক সমাজ ছেড়ে পালিয়ে যায় পাপের জগতে? নাকি ওই ডাক্তার সুবল ভট্টাচার্য, যার আসল রোজগার অ্যাবরশন করে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই শিশু খুন করা?”

“এতই যদি পাপের জগৎ হয়, তবে আপনিই বা কেন এখানে থাকেন?” রুদ্রর রাগ ক্রমেই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

“আমি কেন থাকি? শুনতে চাও?” ফোনের পর্দা ছাপিয়ে রাধানাথ অট্টহাস্য করে উঠলেন, “চতুর্থ অবতার কে ছিলেন জানো নিশ্চয়ই? নৃসিংহ। পাপী রাজা হিরণ্যকশিপুর অত্যাচারে পৃথিবী তখন জর্জরিত। হিরণ্যকশিপু কৌশলে ব্রহ্মার থেকে বর আদায় করে নিয়েছিলেন। দিনে বা রাতে তাঁকে হত্যা করা যাবেনা, পশু, মানুষ বা দেবতা কেউই তাকে হত্যা করতে পারবে না, এমনকি ভূমিতে বা আকাশেও হিরণ্যকশিপু ছিলেন অবধ্য। তাই সুপুত্র প্রহ্লাদ যখন দুরাচারী পিতার প্রশ্নে বললেন, বিষ্ণু বিরাজমান সবজায়গায়, এমনকি রাজসভার ওই থামেতেও, হিরণ্যকশিপু তখন প্রচন্ড দম্ভে লাথি মেরে ভেঙে চাইলেন সেই থাম। আর সেই থাম ভেঙে আবির্ভূত হলেন নৃসিংহ অবতার। তিনি পশু, মানুষ, দেবতা কোনোটাই নন, মধ্যবর্তী অর্ধ-মনুষ্য অর্ধ-সিংহাকার। তিনি হিরণ্যকশিপুকে বধ করলেন দিন ও রাত্রির সন্ধিস্থল গোধূলি লগ্নে, হিরণ্যকশিপু ভূমি বা আকাশ, কোথাওই বধ্য নন, তাই নৃসিংহ তাঁকে নিজের জঙ্ঘার ওপর স্থাপন করে নখরাঘাতে বধ করেন।”

রুদ্র শুনছিল। ইচ্ছে করেই ও আরও বেশি দীর্ঘায়িত করতে চাইছিল এই কথোপকথন। নিজের বক্তব্য মিউট করে রেকর্ডার অন করে নিঃশব্দে শুনে চলেছিল ও। রাধানাথ স্যার যে উদ্দীপ্ত স্বরে টানা বলে চলেছিলেন, সেই রাধানাথ রায়কে চেনে না ও। এ যেন সম্পূর্ণ এক অন্য মানুষ!

গাড়ি রুদ্রর নির্দেশমতো দিল্লিরোড দিয়ে সোজা ছুটছিল, এমনসময় পেছন থেকে অর্জুন চেঁচিয়ে উঠল, “বাঁদিক নিন, বাঁ দিক নিন, খোশলাপুরের রাস্তা এইটাই!”

ড্রাইভার বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেও রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে সামাল দিল, “না। সোজা চলো। দোগাছিয়ার রাস্তা দিয়ে ঢুকবে। বদনপুর হয়ে যাব আমরা।”

জয়ন্ত বলল, “বদনপুর! সে তো ওই ফার্ম হাউজের উলটোদিকে। এই রাতদুপুরে নদী পেরোবেন কী করে ম্যাডাম?”

“কমিশনার স্যার সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। লোকাল থানাও থাকবে। বদনপুরের চণ্ডীমন্দিরের ঘাট পেরিয়ে ওপারে যাব আমরা। নাহলে ফার্ম হাউজ দিয়ে সোজা ঢুকতে গেলে এই রাত্রিবেলা ওই দুর্ভেদ্য জঙ্গল পেরোতে হবে। যা রিস্কি।” কোনমতে কথাগুলো বলে রুদ্র আবার টেলিফোনে মনোযোগ দিল।

রাধানাথ স্যার এখনো বলে চলেছেন, “তাহলে বুঝতে পারছ? যে কারণে নৃসিংহ অবতারকে পাপিষ্ঠ হিরণ্যকশিপুর রাজসভায় উপস্থিত থাকতে হয়েছিল, আমাকেও সেই কারণেই তোমাদের ওই পাঁকে নিমজ্জিত জগতে থাকতে হয়। বৃহত্তর প্রয়োজনে শত্রুর বন্ধু হতে হয়।”

রুদ্র বলল, “কী চান আপনি?”

রাধানাথ স্যার বললেন, “এখনো বুঝতে পারছ না? সব কিছু ধ্বংস করে নতুন করে সত্যযুগ প্রতিষ্ঠা করতে। আর এই কল রেকর্ড করে কোনো লাভ নেই। ক্রিপ্টেড সার্ভার থেকে স্পুফ করা এই কল কোথাও ট্র্যাক করা যাবে না।”

“যাক! দরকারে আপনি তাহলে প্রযুক্তি ঠিকই ইউজ করেন! আর ট্র্যাক না করা যাক, মিথ্যে বলাটা বন্ধ করুন, স্যার!” রুদ্র ফিসফিস করে বলল, “ওসব আপনার আমীশ সমাজের ওই ব্রেইন ওয়াশ করা লোকজনকে বোঝাবেন। আপনি তো চান মায়াপুর মন্দিরটা দখল করতে।”

“মানে?” একটু যেন থমকে গেলেন রাধানাথ রায়।

“মানেটা তো খুব সোজা। আজ রাতে মন্দিরের মহাভোগ খেয়ে যে হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হবে কিংবা মারা যাবে, তার দায়টা গিয়ে পড়বে বাগডাঙা সরলাশ্রমের ওপর। যার গ্যারান্টর হিসেবে সই করিয়েছেন দাদা শেখর চৌধুরীকে। যে দাদা ভাইয়ের সব অন্যায়ে সাধ দিয়েছেন শুধুমাত্র স্নেহের বশে। সেই দাদাকেই ফাঁসিয়ে জেলে ঢোকাতে আপনার হাত কাঁপবে না। যে আশ্রমের গোটা প্রপার্টিটা জয়েন্টলি কেনার পরই আপনি খুন করেছেন স্বপন সরকার আর হৃষীকেশ জয়সোয়ালকে। যিনি উইটনেস ছিলেন, সেই ড. সুবল ভট্টাচার্যকেও সরিয়ে দিয়েছেন। আপনার দাদা এমনিতেই এখন মায়াপুর মন্দিরের গভর্নিং বডিতে একজন হোমড়াচোমড়া। এত বড় কাণ্ডের পর বর্তমান প্রেসিডেন্টকে সমস্ত দায়ভার মাথায় নিয়ে সরে যেতে হবে। সরতে হবে আপনার দাদাকেও। সেই পদে ঢুকবেন আপনি। বেশ সুন্দর প্ল্যান। বন্ধু কানু চক্রবর্তী আপনাকে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে তাঁকে বাধ্য করেছেন মুখ বন্ধ রাখতে, দাদা শেখর চৌধুরীকেও তাই। অথচ কাজ মিটে গেলে এদের সর্বনাশ করতে আপনার বিবেকে একফোঁটাও বাধবে না। আসলে কল্কি টল্কি কিস্যু না, আপনি একজন প্রচণ্ড স্বার্থপর মানুষ।”

 রুদ্র ধীরে ধীরে সত্যি মিথ্যে মেশানো, জানা অজানায় মেলানো কথাগুলো বলছিল।

রাধানাথ স্যার এখনো নবদ্বীপে আছেন না ওই শম্ভল ফার্ম হাউজে, তা ও জানেনা। কিন্তু যেখানেই থাকুন, কথোপকথন দীর্ঘায়িত করে তাঁকে ব্যস্ত রাখলে ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশি।

এদিকে গাড়ি এসে পৌঁছেছে বদনপুরের চণ্ডীমন্দিরে। নিস্তব্ধ রাত। দূরে কোথাও শিয়ালের আওয়াজ যেন খানখান করে দিচ্ছে সেই নৈঃশব্দ্য। তবু চণ্ডীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন থানার ওসি আশুতোষ তরফদার। সঙ্গে বেশ কয়েকজন কনস্টেবল।

রাধানাথ গর্জন করে রুদ্রর কথার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, রুদ্র ফোনটা কেটে দিল।

গাড়ি থেকে নেমে ওসিকে বলল, “নৌকো?”

“সব রেডি আছে ম্যাডাম।” ওসি আশুতোষ তরফদার স্যালুট করলেন।

রুদ্রর ইনফরমার মিন্টুও এসে হাজির হয়েছে। সে চাপা গলায় বলল, “কানু চক্রবর্তীর সঙ্গে যে ছেলেটা থাকত, তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল, ম্যাডাম?”

“না।” রুদ্র সংক্ষেপে বলল, “এই ঘাট কি চৌধুরীরাই বানিয়েছিল?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম। নীলকন্ঠ চৌধুরীর ঠাকুরদার আমলে বানানো।”

ওসি এগিয়ে এলেন, “ম্যাডাম, আপনার কথামতো তিনটে নৌকোর অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছি। আমাদের বাকি ফোর্স ফার্ম হাউজের সামনে দিয়ে ঢুকবে। এদিকে আসুন।”

৫৩

প্রিয়ম ফোনে সব শুনে বলল, “একজন সিনিয়র আই পি এস অফিসার হয়ে শেষে কল্কি হওয়ার মতো পাগলামি?”

রুদ্র বলল, “পাগলামি বলছ কেন?”

“কারণ মাঝেমাঝেই এরকম একেকজন নিজেকে কল্কি বলে দাবি করে। বিশেষত উত্তরভারতের স্বঘোষিত ধর্মগুরুরা। তবে হ্যাঁ, সেই পাগলামি থেকে এতগুলো মার্ডার, আস্ত একখানা অলটারনেট ইকোনমি গড়ে তুলে অতগুলো লোককে নিয়ে দল গড়ে তোলা, এমন নজির নেই। তবে এমনিতে কল্কি অবতার নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে।”

রুদ্র ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে নিকষ কালো অন্ধকার। মনে হচ্ছে নির্জন এই চরাচর যেন পৃথিবীর বাইরের কোনো জায়গা। নৌকোর মাঝিরা কাজ করছে চুপচাপ।

ও ফিসফিস করে বলল, “কী বিতর্ক? হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী কল্কি অবতার তো এখনো জন্মায়ইনি! রাধানাথ স্যার নিজেকে কল্কি ভেবে সবকিছু ধ্বংস করতে চাইছেন। হয়তো মায়াপুর মন্দিরে পুরো জাঁকিয়ে বসার পরে তাঁর আরও কোন প্ল্যান রয়েছে।”

“বললাম তো, তোমার ওই এস পি স্যারই প্রথম নন, যিনি নিজেকে কল্কি ভাবেন। এটা কি জানো, অনেকে মনে করেন হজরত মহম্মদ আসলে কল্কি অবতার ছিলেন?”

“হজরত মহম্মদ?” রুদ্র অবাক গলায় বলল, “তিনি মুসলিম ধর্মের প্রবর্তক। তিনি হিন্দু অবতার হবেন কেন?”

“কেন’র উত্তর যদি সবসময় থাকত, তবে তো কোনো বিতর্কই কখনো মাথাচাড়া দিত না। একটু দাঁড়াও, এই ব্যাপারে লাইব্রেরিতে একটা বই আছে। কী যেন ভদ্রলোকের নাম, খুব হইহই হয়েছিল বইটা নিয়ে। একবার এয়ারপোর্ট থেকে কিনেছিলাম।” প্রিয়মের কথার মাঝেই রুদ্র সিঁড়ি দিয়ে নামার আওয়াজ শুনল।

প্রিয়ম একতলায় লাইব্রেরি ঘরে যাচ্ছে।

ও ফোনটা কানে চেপে ধরে ঘাটের দিকে এগিয়ে এল। ঘাট অবশ্য নামেই, কোনোকালে বাঁধানো শান ছিল, এখন ভেঙে সব জলে মিশে গেছে। বদনপুর থানার ওসি বেশ কাজের, জোরালো সাত-আটটা টর্চ জ্বেলে রেখেছে তাঁর স্টাফেরা। নাহলে এই অন্ধকারে পিচ্ছিল কাদায় যে কেউ হড়কে পড়ত।

উত্তেজনায় রুদ্র নখ ছিঁড়ছিল। রাধানাথ স্যারের এই কর্মকাণ্ডের পেছনে বৈষয়িক কোনো উদ্দেশ্য নেই বলেই মনে হয়। তবে এইভাবে স্যার যদি মায়াপুর মন্দির দখলও করেন, তারপর কীভাবে তাঁর লক্ষ্যপূরণ করবেন? মায়াপুর মন্দির ক্যাম্পাসের সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি সবই কি ধীরে ধীরে পালটে যাবে? মুক্তমনা উদারতার বদলে জায়গা দখল করবে মধ্যযুগীয় আমীশ সম্প্রদায়?

কিন্তু দেশে আইন শৃঙ্খলা আছে, গণতান্ত্রিক শাসন আছে, সেসব সামলে কীভাবে স্যার এগোবেন?

পরক্ষণে ওর মনে পড়ে গেল শুভাশিসবাবুর কথাগুলো। আমেরিকার মতো প্রথম বিশ্বের দেশে যদি তারা বহাল তবিয়তে বাস করতে পারে, সরকার যদি তাদের প্রতি নরম মনোভাব নিয়ে চলে, এখানে তা অসম্ভব কেন? এখনো রুদ্র এটাই জানতে পারেনি যে, স্যারের এই বাংলা আমীশ সমাজে কতজন রয়েছে? তবু সেই সংখ্যাটা একলাফে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে মায়াপুর দখলের পর। এখনই সমূলে বিনষ্ট করতে না পারলে হয়তো বাংলায় আবার ফিরে আসবে সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসন, কুসংস্কার। সরকার তখন চাইলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য সেভাবে দমন করতে পারবে না। সুর নরম করতেই হবে।

প্রায় সাত-আটমিনিট পর প্রিয়মের গলা শোনা গেল, “হ্যাঁ পেয়েছি। ভদ্রলোকের নাম ড. বেদপ্রকাশ উপাধ্যায়। তিনি মনে করেন, হিন্দুরা কলিযুগে যে কল্কি অবতার জন্মানোর অপেক্ষায় রয়েছে, হজরত মহম্মদই সেই অবতার। কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন কল্কি অবতারের বাবা-মা, ঘোড়া, গ্রাম, আরও অনেক কিছুই মহম্মদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।”

“কীরকম?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল। একটা নৌকো কাদায় আটকে গেছে, মাঝিরা টানাটানি করছে। এখনো কিছুটা সময় লাগবে। তার মধ্যে শুনে নেওয়াই যায়। তাতে টেনশনও কম হবে।

“আমি বই থেকে পড়ছি শোনো। হিন্দুধর্মের পরিভাষায় রসুলকে অবতার বলা হয়। ঈশ্বরের পক্ষ থেকে যাকে অবতীর্ণ করা হয় তিনিই অবতার। সে হিসেবে যিনি সর্ব শেষে আসবেন তিনি অন্তিম অবতার। অন্তিম অর্থ শেষ এবং অবতার অর্থ রসূল অর্থাৎ শেষ রসুল। হিন্দুধর্মে যুগ চারটি। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি।”

“আরে এসব জানি। মহম্মদ কেন কল্কি, সেই ব্যাপারে কী লেখা আছে?” রুদ্র বাধা দিয়ে বলল।

“পড়ছি একে একে। শোনো।

১। ঋগ্বেদে লেখা আছে অন্তিম অবতার বা শেষ রসুলের নাম হবে ‘নরাশংস’।

নরাশংসং সৃধৃষ্টমমপশ্যং সপ্রথস্তমং দিবো ন সদ্মম খস।।১

‘নরাশংস’ —এর অর্থ ‘প্রশংসিত ব্যক্তি’। যার আরবী অর্থ হল ‘মুহাম্মদ’।

২। অন্তিম অবতারের পিতার নাম হবে ‘বিষ্ণুযশা’।

সুমত্যাং বিষ্ণুযশা গর্ভমাধত্ত বৈষ্ণবম২

‘বিষ্ণুযশা’ অর্থ ‘মালিকের দাস’। যার আরবী অনুবাদ হল ‘আবদুল্লাহ’। আর হজরত মুহাম্মদের পিতার নাম ছিল আবদুল্লাহ।

৩। কল্কিপুরাণে লেখা আছে যে, কল্কি অবতারের মাতার নাম ‘সুমতি’।

সুমত্যাং মাতরি বিভো। কন্যায়াংত্বন্নিদেশতঃ।।

‘সুমতি’-র অর্থ ‘সুবুদ্ধিসম্পন্না’। যার আরবী অনুবাদ ‘আমেনা’। আর হজরত মুহাম্মদের মায়ের নাম ছিল আমেনা।

৪। অন্তিম অবতারের জন্মস্থান সম্পর্কে কল্কি পুরাণে লেখা আছে, তিনি জন্ম গ্রহণ করবেন, ‘শম্ভল’ নামক স্থানে।

শম্ভলে বিষ্ণুযশসো গৃহে প্রদুর্ভবাম্যহম।

‘শম্ভল’ শব্দের অর্থ ‘শান্তির স্থান’। যার আরবী অনুবাদ ‘বালাদুল আমিন’। আর মক্কার আরেক নাম হলো, বালাদুল আমিন। আর হজরত মহম্মদ মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছেন।

৫। অন্তিম অবতার ‘মাধব মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশ তারিখে জন্মগ্রহণ করবেন।

দ্বাদশ্যাং শুক্লপক্ষস্য মাধবে মাসি মাধবঃ।

মাধব অর্থ বৈশাখ মাস, বিক্রমী ক্যালেন্ডার মতে বৈশাখকে বসন্তের মাস বলা হয় যার আরবী অর্থ ‘রবি’।

শুক্ল পক্ষ, অর্থাৎ ‘প্রথম অংশ’ যার আরবী অনুবাদ ‘আউওয়াল’। একত্রে হল ‘রবিউল আউওয়াল’ দ্বাদশ তারিখ অর্থাৎ ১২ তারিখ।

হজরত মহম্মদ ‘রবিউল আউওয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন।

এরকম আরো ব্যাখ্যা আছে। আবার আরেকটা বইও পড়েছিলাম, যেখানে যিশুখ্রিস্টকে কল্কি অবতার বলা হয়েছে। আসলে হিন্দু ধর্ম হল সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম, তাই পরবর্তীকালে নানা ধর্ম থেকেই তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন বুদ্ধকেও অনেকে নবম অবতার বলেন।”

প্রিয়ম একটানা বলে একটু দম নিল। তারপর বলল, “তবে নিজেদের যারা এইরকম অবতার টাইপ ভেবে অবসেশানে ভোগে, তারা একরকমের মানসিক রোগগ্রস্থ। তাই তোমাদের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাধানাথ রায়কে আটকানো। এই জাতীয় লোকেরা যখন তখন ভয়ংকর কিছু করে ফেলতে পারে।”

রুদ্র এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল। বিষ্ণুযশা, সুমতী, শম্ভল, সবকিছু মাথায় গেঁথে নিচ্ছিল। বহুকাল আগে ও কল্কি অবতার সম্পর্কে পড়েছিল, এখন আর অত বিশদ মনে নেই।

“আমার মনে হয়, স্যারের মামা ওই গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্যই ছোট থেকে স্যারের এই মগজ ধোলাইটা করেছিলেন। আর এই কারণেই কানু চক্রবর্তী মাঝপথে ফিরে এসেছিল বদনপুরে।” রুদ্র ফোনটা বন্ধ করে এগিয়ে গেল।

সকলে নৌকোয় একে একে উঠছে।

নৌকোয় উঠে মাঝি দাঁড় টানা শুরু করতে করতে আরও পাঁচ মিনিট চলে গেল। এই নিস্তব্ধ রাতে কেউ কোন কথা বলছে না, নিশ্চল প্রেতমূর্তির মতো বসে রয়েছে নৌকোর ওপর।

রুদ্র ছটফট করছিল অজানা এক অস্থিরতায়। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, কল্কি, আমীশ, লক্ষ লক্ষ ভাবনার জাল যেন কিলবিল করছিল, জটলা পাকাচ্ছিল ওর মনের মধ্যে। মনে হচ্ছিল, এত বছর ধরে যে ভয়ংকর উদ্দেশ্যে রাধানাথ রায় গড়ে তুলেছেন ওই আমীশ সমাজ, তা কি এত সহজে বন্ধ করা যাবে?

যদি না করা যায়? যদি এর মধ্যেই মায়াপুর মন্দিরের হাজার হাজার ভক্ত খেয়ে থাকেন ওই মহাভোগ?

রুদ্র ঘড়িতে সময় দেখল। বারোটা বাজতে ঠিক পনেরো মিনিট বাকি। পাক্কা বারোটায় পরিবেশিত হবে মহাভোগ।

কী হচ্ছে ওদিকে?

_____

১ (ঋগ্বেদ ১/১৮/৯)

২ কল্কিপুরাণ, ১১/২/১

৫৪

প্রিয়াঙ্কা পাগলের মতো ছুটছিল। ও এতক্ষণ ছিল প্রধান মন্দিরের দিকে।

সেখানে জন্মাষ্টমীর অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান মহা অভিষেক চলছিল। মন্দিরের প্রধান সন্ন্যাসীরা সকলে মিলে নিষ্ঠাভরে আরতি করছিলেন রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিকে। হাজার হাজার অনুরাগী সেই পবিত্র দৃশ্য দেখতে ভিড় করে ছিল সেখানে। হরেকৃষ্ণ-র উচ্চৈঃস্বরে গান আর কলরোলে ওর ফোন বেজে বেজে কেটে যাচ্ছিল, ও টেরই পায়নি।

সেই ভিড়ের মধ্যে সুষ্ঠু পরিচালনা করতে করতে যখন ক্লান্ত, তখন প্রিয়াঙ্কা হঠাৎই দেখতে পেয়েছিল, লোকেশবাবু ভিড় ঠেলে ওর কাছে আসার চেষ্টা করছেন আপ্রাণ। কিন্তু সাধারণ পোশাকের লোকেশবাবুকে কিছুতেই আসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ভিড়ের মধ্যে তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত।

প্রিয়াঙ্কা নিজেই তখন বেরিয়ে এসেছিল। আর তারপর লোকেশবাবুর মুখে সব শোনামাত্র এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এসেছিল সেখান থেকে।

ঘড়িতে এখন রাত বারোটা বাজতে ঠিক দশ মিনিট বাকি। প্রিয়াঙ্কার বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। আর আফশোসে নিজের ওপর রাগে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছে।

একঘণ্টা আগেও যখন সেই অচ্যুত বলে এগারো বারো বছরের বাচ্চা ছেলেটা ওকে নিয়ে যাচ্ছিল রন্ধনশালার দিকে, ও ধারণাও করতে পারেনি ছেলেটা আসলে কী বলতে চেয়েছিল! অথচ একটু চিন্তা করলেই ও বুঝতে পারত।

ছেলেটা তখন হাসিমুখে ধীরপায়ে হাঁটছিল। প্রিয়াংকাও একটু তফাত রেখে পেছন পেছন চলেছিল। ছেলেটা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বলল, “আজ রাতটার পর এই গ্রামটা পুরো পালটে যাবে, জানো!”

“পালটে যাবে মানে?” প্রিয়াঙ্কা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল। ছেলেটা এই মন্দির ক্যাম্পাসটাকে গ্রাম বলছে কেন? এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এই ছেলেটা বাংলার ওই আমীশ সমাজের একজন। তার মানে এর মতো আরো অনেক আমীশ সমাজের মানুষ এই ভিড়ের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে সকলের অলক্ষ্যে।

ছেলেটা আর কিছু বলেনি, খুব সন্তর্পণে হেঁটে চলেছিল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ঘাড় ঘুরিয়ে বলেছিল, “আমি যাই। কেমন?”

“কোথায় যাবে তুমি?” প্রিয়াঙ্কা দেখেছিল, ওরা উপস্থিত হয়েছে মন্দিরের ভাঁড়ারঘরের পেছনদিকে। ভোগ রান্নার বিশাল আয়োজন চলছে ভেতরে।

ভেসে আসছে সুগন্ধ। রান্নাঘরের পেছনদিকের এই দরজার বাইরে এদিক ওদিক ফেলে রাখা হয়েছে প্রকাণ্ড আকারের সব কড়াই, হাতা, খুন্তি।

ছেলেটা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওই দরজা দিয়ে একটা লোককে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখেই ও ফ্যাকাশে মুখে দ্রুত পায়ে ঢুকে গিয়েছিল ভেতরে।

ওহ, প্রিয়াঙ্কা যদি তখন একবারও আন্দাজ করতে পারত যে আসল ব্যাপার লুকিয়ে রয়েছে ওই রান্নাঘরেই!

একদিকে মহা অভিষেক, অন্যদিকে মহাভোগ বিতরণ, এই দুই কারণে মন্দির চত্বর এখন প্রায় ফাঁকা।

প্রিয়াঙ্কা মোবাইলে নদীয়া টাস্ক ফোর্সের একজন অফিসারকে সংক্ষেপে পুরোটা জানাতে জানাতে পৌঁছল ভোজনশালায়।

একজন তরুণ সাধক বাইরে দাঁড়িয়ে তদারক করছিলেন। ও বলল, “ব্যাচ কি শুরু হয়ে গিয়েছে?”

সাধক মিষ্টি হাসলেন। দু’হাত জড়ো করে বললেন, “দুঃখিত, প্রথম ব্যাচে আর একটিও আসন নেই। আপনাকে দ্বিতীয় ব্যাচের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। হরেকৃষ্ণ।”

সাধক সরে যাওয়া মাত্র প্রিয়াঙ্কা দেখতে পেল, বিশাল বড় একটা হলঘর। একটা ছোটোখাট ফুটবল খেলার মাঠ ঢুকে যেতে পারে তার মধ্যে। সেই ঘরে সার সার দিয়ে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা। লম্বা শতরঞ্জি পেতে সেখানে বসানো হয়েছে মানুষদের।

কতজন হবে? প্রিয়াঙ্কা চোখ সরু করে দেখতে লাগল। অন্তত এক হাজার জন তো হবেই। সকলে বসে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছেন আর প্রতীক্ষা করছেন মহাভোগের।

এই তরুণ সাধকের মতো আরও অনেক সন্ন্যাসী ঘুরে বেড়াচ্ছেন গোটা ঘরে। এরা সবাই মন্দিরের নিজস্ব স্বয়ংসেবক। ভক্তরা তো দূর, এঁরাও কল্পনা করতে পারছেন না, এই ভোগবিতরণের পর কী হতে চলেছে।

ইতিমধ্যে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে নদীয়া টাস্ক ফোর্সের বেশ কিছু পুলিশ। প্রত্যেকে সিভিল পোশাকে। প্রিয়াঙ্কা বলল, “এই খাবার পরিবেশন বন্ধ করতে হবে। এখুনি।”

“কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?” একজন বললেন, “মায়াপুর মন্দিরের মহাপ্রসাদ বলে কথা। আমরা এমন দুমদাম বন্ধ করতে পারি না। অর্ডার লাগবে।”

প্রিয়াঙ্কা চিনতে পারল। ভদ্রলোক নদীয়া পুলিশের একজন অফিসার। ও বলল, “আমাদের কমিশনার কথা বলছেন আপনাদের হায়ার অথরিটির সঙ্গে। অর্ডার চলে আসবে। কিন্তু সেইজন্য দেরি করা যায় না। খাবারে বিষ আছে।”

“অ্যাঁ! সেকি!” ভদ্রলোকের মুখের অভিব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল।

“হ্যাঁ। আমাদের যেভাবে হোক, খাবার পরিবেশন আটকাতেই হবে।”

“আমি এখুনি আমাদের স্যারকে এই মন্দিরের প্রধানকে ফোন করতে বলছি।” ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন।

প্রিয়াঙ্কা ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে ঠিক আর তিন মিনিট বাকি।

খাবারে যদি বিষ সত্যিই থেকে থাকে, সেটা কোন খাবারে? বিষক্রিয়া শুরু হতে কতক্ষণ সময় লাগবে? দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যাচ যখন খাবে, তখনই যদি প্রথম ব্যাচের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে? সেই ঝুঁকি কি ওই বাগডাঙা সরলাশ্রমের লোকেরা নেবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *