গ্লানির্ভবতি ভারত – ১৫

১৫

শিবনাথের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর প্রায় দশদিন কেটে গিয়েছে। রুদ্র তদন্তে একচুলও এগোতে পারেনি। প্রতিদিন নিয়ম মাফিক এস পি স্যারকে প্রোগ্রেস রিপোর্ট পাঠাচ্ছে বটে, কিন্তু ও বেশ বুঝতে পারছে, কিচ্ছু এগোচ্ছে না। বরং যতদিন যাচ্ছে, একটা হতাশা এসে গ্রাস করছে ওকে।

এ কী হল। যখন ব্যাঙ্কে চাকরি করত, হঠাৎ করেই জড়িয়ে পড়ত নানারকম সমস্যায়। প্রথমবার বাবাকে খুঁজতে ভুটানে গিয়ে এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল।১ দ্বিতীয়বার প্রিয়মের কাছে লন্ডনে ছুটি কাটাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছিল নাৎসী জার্মানির এক লুপ্ত পরিকল্পনার ওপর গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক এক ষড়যন্ত্রে।২ আর আগ্রায় পোস্টেড থাকার সময় তো সাম্প্রদায়িক বীজবপনের আঙ্গিকে এক ভয়ঙ্কর নাশকতা হামলার প্রস্তুতির খোঁজ পেয়েছিল।৩

এই প্রতিটা ঘটনাতেই ও পুলিশকে যতটুকু সাহায্য করতে পেরেছিল, তা একজন সাধারণ যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। এই তিনটি ঘটনা হয়তো ওকে ভেতরে ভেতরে অনেক সাহসী ও আত্মবিশ্বাসীও করে তুলেছিল। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বের ইন্টারভিউ প্যানেলে এই কাজ নিয়ে ও অনেক প্রশংসাও কুড়িয়েছিল।

কিন্তু আজ যখন ও নিজেই পুলিশ দপ্তরের একজন? পরোক্ষভাবে নয়, প্রত্যক্ষভাবে এক সিরিয়াল কিলিং তদন্তের জাল গুটিয়ে আনার ভার যখন তুলে দেওয়া হয়েছে ওর ওপর? কী করতে পারছে ও?

রুদ্র চুপচাপ খোলা ব্যালকনিতে বসে ভাবছিল। সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ।

অন্যদিন এইসময় ক্ষমা বাগানে খেলে। কিন্তু কাল থেকে কী হয়েছে মেয়েটার, কিছুতেই ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। জ্যোৎস্নাদি, পাঁচু এমনকী প্রিয়মও চকোলেটের লোভ দেখিয়ে ওকে বাইরে বের করতে পারেনি। ওর মা মল্লিকাদি একটু আগে চায়ের কাপ নিয়ে এসেছিল রুদ্রর কাছে। মুখে কেমন ভয়ের ছাপ।

“কী হয়েছে ক্ষমার?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানতে চেয়েছিল রুদ্র।

মল্লিকাদি বলেছিল, “জানিনা দিদিমণি। কেমন খিঁচিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে।”

“জ্বর আছে গায়ে?”

“হ্যাঁ। অল্প।”

রুদ্র বলেছিল, “গরম দুধ খাওয়াও বারবার। বিকেলের মধ্যে না ঠিক হলে ডাক্তারকে কল দেব।”

মল্লিকাদি মৃদু ঘাড় নেড়ে চলে গিয়েছিল। রুদ্র আবার ডুবে গিয়েছিল নিজের ভাবনায়।

সত্যি বলতে কী, নিজের প্রতি ওর এখন খুব লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে, যে বাহবা ও ইন্টারভিউ বোর্ডে কুড়িয়েছিল, অতীতের যে কার্যকলাপ হয়তো ওর ইন্টারভিউয়ের নম্বরকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল, তা প্রতারণা মাত্র। ও আসলে এইসব কাজের যোগ্যই নয়।

এই ইনভেস্টিগেশন চলাকালীন সপ্তাহ দু’বার জেলাশাসক ফোন করছেন। আশাভরা কণ্ঠে বলছেন, রুদ্রাণী সিংহরায় পারবে এ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।

ওদিকে এস পি রাধানাথ স্যার প্রতিদিনের মতো ওকে অফিস যেতে বারণ করেছেন। বলেছেন, বাংলোর অফিস থেকেই কাজ চালাতে।

কিন্তু কী কাজ চালাচ্ছে ও? বিক্ষিপ্তভাবে একেকটা হত্যার একেকরকম দিক খুঁজে পাচ্ছে। যেন প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা ধাঁধাঁ। কিন্তু এভাবে প্রতিটা ধাঁধাঁর উত্তর খোঁজা তো ওর কাজ নয়, ওর কাজ হল, প্রতিটা ধাঁধাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা শক্ত সুতোটা খুঁজে বের করা। তারপর সেটাকে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলা।

কিন্তু আদৌ কি তেমন কোন সুতো আছে? নাকি, প্রতিটা খুনই বিচ্ছিন্ন, এই বুধবার আর কৃষ্ণপক্ষের ব্যাপারটা নেহাতই কাকতালীয়! ফরেনসিকের রিপোর্টগুলো থেকেও কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

এমন সময় গেট দিয়ে ঢুকল একটা গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে সোজা গটগট করে ঢুকে এলেন বীরেন শিকদার। সামনে এসে স্যালুট ঠুকে বললেন, “গুডমর্নিং ম্যাডাম!”

“মর্নিং। বসুন।” রুদ্র বলল, “বলুন। কী আপডেট?”

“আপনি আমাকে স্বপন সরকার আর সুনীল ধাড়ার কেসটা প্রথম থেকে শুরু করতে বলেছিলেন। স্বপন সরকার প্রথমে সাধারণ ঠিকাদারির কাজ করত, তারপর বছরকয়েকের মধ্যেই বেশ পয়সা করে ফেলে। লোকাল পলিটিক্সে বেশ দ্রুত উঠতে থাকে। তাছাড়া, ও বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিল।”

“এটা ফাইলেও লেখা ছিল। কী ধরনের ধর্মীয় সংগঠন?”

“এমনি গ্রামগঞ্জের দিকে যে ছোটখাটো আশ্রম থাকে না, সেইরকম বেশ কিছু জায়গায় নিয়মিত অনুদান দিত। তো আমি ওসিসায়েবের সঙ্গে বাড়ি গিয়ে আরও একবার ভালো করে সার্চ করলাম। আর তখনই এই ছবিটা পেলাম।” বীরেন শিকদার একটা ফোটোগ্রাফ বাড়িয়ে দিলেন।

রুদ্র হাতে নিয়ে দেখল, একটা অনুষ্ঠানমঞ্চের ছবি। মঞ্চে বসে আছেন চারপাঁচজন মানুষ। একজনের পেছনে ঝুঁকে পড়ে কিছু বলছে একটা রোগা চেহারার ছেলে। পাশের ভদ্রলোকও তা বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুনছেন। একটি বাচ্চা মেয়ে শাড়ি পরে স্টেজে উঠছে হাতে ফুলের স্তবক নিয়ে।

সবার পেছনে নীল শামিয়ানার ওপর থার্মোকোল কেটে লেখা:

শ্রী শ্রী গোপালকৃষ্ণ মহারাজের ৯৯ তম জন্মবার্ষিকী

উদযাপন

বাগডাঙা সরলাশ্রম, বাগডাঙা।

রুদ্র বলল, “এই বসে থাকা দুজন ভদ্রলোক স্বপন সরকার আর হৃষীকেশ জয়সোয়াল না?”

“একদম ঠিক বলেছেন ম্যাডাম। কেস ফাইলের ছবির সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে। আর আমি এই ছবি স্বপন সরকারের কাছের লোকদেরও দেখিয়েছি।” বীরেন শিকদার বললেন, “আর ওই ঝুঁকে কিছু বলা ছেলেটা কে বলুন তো?”

রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বিস্ফারিত চোখে বলল, “গোবিন্দ?”

“একদম ঠিক ধরেছেন। হৃষীকেশ জয়সোয়াল আর স্বপন সরকার এই আশ্রমে নিয়মিত যেতেন। দুজনের মধ্যে পরিচয়ও ছিল।”

“এক্সেলেন্ট! বীরেন বাবু, আপনি জিনিয়াস!” রুদ্র প্রায় লাফিয়ে উঠল, “এই বাগডাঙা জায়গাটা কোথায়?”

“চন্দননগর সাবডিভিশনে, ম্যাডাম।” বীরেনবাবু বললেন, “খুবই প্রত্যন্ত একটা গ্রাম।”

“চলুন, এখুনি যেতে হবে আমাদের।”

_____

১ রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ঈশ্বর যখন বন্দি’ দ্রষ্টব্য।

২ রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নরক সংকেত’ দ্রষ্টব্য।

৩ রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস ‘অঘোরে ঘুমিয়ে শিব’ দ্রষ্টব্য।

১৬

বাগডাঙা গ্রামটা নামেই চন্দননগর মহকুমায়, আসলে একটা গণ্ডগ্রাম। চন্দননগর থেকে গঙ্গার উলটোদিকে প্রায় একঘণ্টা গাড়ি ছুটিয়ে তবে পৌঁছনো যায়। সবুজ খেত আর গাছগাছালিতে ভরা এলাকা, সরলাশ্রম জিজ্ঞেস করতেই একজন দেখিয়ে দিল দূরে।

রুদ্র আজ ইচ্ছে করেই অফিসের গাড়ি নেয়নি। সাধারণ গাড়িতে এসেছে। সঙ্গে রয়েছেন বীরেনবাবু।

আশ্রমটা অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলা খেত, তার মাঝখানে। রাস্তা থেকে পায়ে চলা সরু পথ চলে গেছে আলের ওপর দিয়ে। রুদ্র আর বীরেনবাবু সেই আলপথের ওপর দিয়ে হেঁটে পৌঁছলেন।

ছিমছাম আশ্রম। তরিতরকারির চাষ হচ্ছে একপাশে। অন্যদিকে চার-পাঁচটা একতলা বাড়ি। বাড়িগুলোর ছাদ টালির, সেই টালির ওপর বিছিয়ে রয়েছে কুমড়োলতা। সামনে অনেকটা করে খোলা জায়গা। সেখানে ফুটে আছে কিছু মরশুমি ফুল।

ওদের দেখে একজন বেরিয়ে এলেন। পরনে সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা, ঊর্ধ্বাঙ্গে ফতুয়া। লম্বা দাড়ি প্রায় বুক ছুঁয়েছে।

“হরে কৃষ্ণ। কী চাই আপনাদের?” দুই হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকে ঠেকিয়ে তিনি স্মিতমুখে জিজ্ঞেস করলেন।

রুদ্রও হাতজোড় করল, “নমস্কার। আপনার পরিচয়?”

“আমি ভর্তৃহরি মহারাজ। এই আশ্রমের দেখাশোনা করি। বলুন মা, কী প্রয়োজন?”

“আমি রুদ্রাণী সিংহরায়, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছি। একটা খুনের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার ছিল। এই আশ্রমের প্রধান কে?”

“খুন?” ভর্তৃহরি মহারাজের ভ্রূ দুটো কিছুটা ওপরে উঠেই আবার ঠিক হয়ে গেল, “প্রধান হলেন শ্রী বিষ্ণুপদ মহারাজ। কিন্তু তিনি তো নেই, হিমালয়ে তীর্থে গিয়েছেন। তার পরিবর্তে আপাতত আমিই সব দেখাশোনা করছি। আপনি আমাকে বলতে পারেন। আসুন। ভেতরে আসুন।”

ছবিটা দেখে ভর্তৃহরি মহারাজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “হ্যাঁ, এটা আমাদের আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী গোপালমহারাজের জন্মবার্ষিকীতে তোলা। স্বপন সরকার আমাদের আশ্রমের নিয়মিত অনুগামী ছিলেন।”

“আর পাশের ভদ্রলোক?”

ভর্তৃহরি কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে বললেন, “সম্ভবত ওঁকে স্বপন সরকারের কথায় আমরা আমন্ত্রণ করে এনেছিলাম। ওঁর একটি বড় অঙ্কের টাকা আমাদের তহবিলে দান করার কথা ছিল। কিন্তু তারপর উনি আর আসেননি।”

“আচ্ছা,” রুদ্র ঝুঁকে পড়ল, “এই যে ছেলেটি স্বপন সরকারকে কিছু বলছে, এ তো মনে হচ্ছে আপনাদের আশ্রমের কেউ, কারণ বুকে ব্যাজ রয়েছে।”

“নানা।” ভর্তৃহরি মহারাজ দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন, “আমাদের আশ্রমে এমন কেউ নেই মা। উনি স্বপন সরকার মহাশয়ের সঙ্গেই আসতেন। সম্ভবত সহকারী। আমাদের আশ্রমে মূলত আট থেকে চোদ্দো বছরের অনাথ বালকদের শিক্ষা ও ভরণপোষণের ভার নেওয়া হয়। এখানে আমি ছাড়া আমারই বয়সি চারজন মহারাজ আছেন।”

রুদ্রর মুখটা নিভে গেল। অনেক আশা করে ও এসেছিল। ভেবেছিল, গোবিন্দকে এবার ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু এখন দেখছে গোবিন্দর সঙ্গে এই আশ্রমের কোনো সম্পর্কই নেই। স্বপন সরকারের সঙ্গে ও এসেছিল, এই যা।

হতাশ চোখে ও চারদিকে তাকাল। এটা একটা সাধারণ উপাসনাকক্ষ। মাটিতে নরম শতরঞ্জি পাতা। চারপাশের দেওয়ালে ঠাসা বই। যতদূর দেখতে পাচ্ছে, বেশিরভাগই সাধনা ও অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কিত বই। এত বই থাকার জন্য গোটা ঘরে কেমন একটা পুরোনো খবরের কাগজের মতো গন্ধ।

চারপাশ বড় শান্ত, নিঝুম।

সামনের বেদিতে একটি সাদাকালো পুরোনো ফটোফ্রেম। ছবিতে একজন বৃদ্ধ সাধক বসে আছেন ধ্যানের ভঙ্গিতে। একটি মেঝের চাতালে। পেছনে জানলা। জানলার ওপাশে গাছ ডালপালা মেলেছে।

ছবির সামনে জ্বলছে ধূপ।

গোটা আশ্রমে বিরাজ করছে কী অদ্ভুত শান্তি। বাইরের চাতাল দিয়ে মাঝে মাঝে নতমস্তকে হেঁটে যাচ্ছে কিছু কিশোর। তাদের এদিকে কোনো কৌতূহলই নেই।

“ইনি কে?” প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে রুদ্র ছবির দিকে নির্দেশ করল।

ভর্তৃহরি মহারাজ কপালে দু-হাত তুলে নমস্কার করলেন, “আমাদের পরম পূজনীয় গুরুদেব। শ্রী শ্রী গোপালকৃষ্ণ মহারাজ। উনিই এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন।”

রুদ্র চোখ সরু করে দেখছিল। ছবিটির নীচে লেখা রয়েছে :

শ্রী শ্রী গোপালকৃষ্ণ মহারাজ

আবির্ভাব : গোকুলাষ্টমী তিথি, ১৩২৭ বঙ্গাব্দ।

১৩২৭ বঙ্গাব্দ মানে … রুদ্র মনে মনে হিসেব করল। প্রায় একশো বছর আগের কথা।

“ইনি কি এখনো জীবিত?”

“জীবিত শব্দের অর্থ যদি এই নশ্বর তুচ্ছ দেহধারণকে বলেন, তবে আপনার প্রশ্নের উত্তর হবে ‘না’। কিন্তু আমাদের কাছে আত্মা অবিনশ্বর। আত্মার মৃত্যু নেই। তাই দৈহিক তিরোভাব হলেও আমাদের কাছে তিনি জীবিত। তাই তিরোধানের তারিখ লেখা নেই। আমরা কারুরই তিরোধানে বিশ্বাস করি না, তাই সেই তিথি পালনও করিনা।” ভর্তৃহরি মহারাজ চোখ বন্ধ করে হাসিমুখে একটানা বলে গেলেন।

রুদ্র হাতজোড় করে প্রণাম করল। দেখাদেখি বীরেন শিকদারও।

“অনেক ধন্যবাদ মহারাজ।” রুদ্র উঠে দাঁড়াল, “আপনি হয়তো জানেন না, স্বপন সরকার ও তাঁর পরিচিত এই হৃষীকেশ জয়সোয়াল দুজনেই খুন হয়েছেন।”

“অ্যাঁ!” ভর্তৃহরি মহারাজ মুহূর্তে বিস্মিত, “সেকি!”

“হ্যাঁ। আমরা সেই হত্যার তদন্ত করছি। এই ছেলেটি যদি আশ্রমে আসে, অবশ্যই আমাদের জানাবেন। এই আমার কার্ড। এতে নম্বর লেখা রয়েছে।” রুদ্র বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

“নিশ্চয়ই। হরে কৃষ্ণ। পরমগুরু আপনাদের মঙ্গল করুন।”

রুদ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সত্যি, ওরা সাধারণ মানুষরা নিজেদের সুখ দুঃখ নিয়েই মগ্ন, চাওয়া-পাওয়ার হিসেবনিকেশে ব্যস্ত। অথচ এই সন্ন্যাসীরা কেমন নিঃস্বার্থভাবে প্রচারের অন্তরালে সমাজের কল্যাণ করে চলেছেন। রুদ্রর মাথা শ্রদ্ধায় নুয়ে এল।

আবারও করজোড়ে নমস্কার করে ও বেরিয়ে এল।

১৭

 

“যদা যদা হি ধর্মস্য

গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য

তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।

পরিত্রাণায় সাধুনাং

বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।।

ধর্মসংস্থাপনার্থায়

সম্ভবামি যুগে যুগে।।”

পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ শ্লোকপাঠ শেষ করে মৃদু হাসলেন, “শ্রীমদ্ভগবদগীতা। চতুর্থ অধ্যায়। সপ্তম ও অষ্টম শ্লোক। শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বলছেন অর্জুনকে।”

উইলিয়াম জোন্স বাইরের চাতালের একপাশে হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন। ভ্রূ কিছুটা কুঞ্চিত করে তিনি বললেন, “এখানে ভারত অর্থে কি ভারতবর্ষ, পণ্ডিত?”

“না। অর্জুন ভরতবংশীয়, তাই তাঁকেই ভারত বলে সম্বোধন করেছেন শ্রীকৃষ্ণ।”

“গোটা শ্লোকটির অর্থ, পণ্ডিত?”

জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বললেন, “অর্থাৎ, ধর্ম যখনই গ্লানিযুক্ত হয়, অধর্মের যখন অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি দেহধারণ করি। দুষ্কৃতিদের বিনাশ করে সাধুদের রক্ষা করার জন্য এবং অধর্মকে উচ্ছেদ করে আবার ধর্মকে সংস্থাপন করতে আমি যুগে যুগে মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হই।”

জোন্স হেসে ফেললেন। ভাঙা বাংলায় বললেন, “কিন্তু ইহা তো আমাদের আইনের উলটোপথে হাঁটে, পণ্ডিত!”

“কেন?”

“এই শ্লোক মানতে হলে কোনো দুষ্ট লোককে যদি হত্যা করা হয়, তবে হত্যাকারীকে কোনো শাস্তি প্রদান করা যাইবে না।” উইলিয়াম জোন্স স্মিতমুখে বললেন, “তা তো হয়না। আমাদের কোম্পানি কোনো বাছবিচার করে না, পণ্ডিত। কোনো লোক যদি খুব খারাপ কাউকে হত্যা করে, তবুও তার শাস্তি হইবে। কারণ, আইন নিজের হস্তে কেউ লইতে পারেনা। শাস্তি দেবে আদালত, মানুষ নিজে নয়। তাই তুমি ইহা তোমার বইতে লিখো না।”

জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন হাসলেন। দীর্ঘ ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে বললেন, “তুমি এতদিন আমার কাছে পড়ে সাধুচলিত মেশানো ভয়ঙ্কর গুরুচণ্ডালী দোষসমৃদ্ধ বাংলা বলতে শিখেছ, সাহেব। সংস্কৃতভাষার আক্ষরিক অর্থও উদ্ধার করতে শিখেছ। কিন্তু অন্তর্নিহিত মর্মার্থ উদ্ধার করার বিদ্যা এখনো আয়ত্ত করতে পারোনি। এই শ্লোক কোনো সাধারণ মানুষ বলছেন না। বলছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুনকে। হিন্দুশাস্ত্রমতে যে চারটি যুগ, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই প্রতিটি যুগের একেবারে অন্তে এসে অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। অশুভশক্তিকে পরাস্ত করে পুনরায় শুভশক্তিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এই মর্ত্যলোকে। অবতাররূপে। কখনো তিনি মৎস্য, কখনো তিনি কূর্ম, কখনো তিনি নৃসিংহ, আবার কখনো বামন অবতাররূপে। একমাত্র তাঁরই অধিকার, অশুভের বিনাশসাধন করা। সাধারণ মানুষের এই কর্ম নয়, সাহেব!”

“এবার বুঝিলাম।” জোন্স বললেন, “আচ্ছা, এই যে তোমাদের চারটি যুগ। এগুলোর ব্যাপ্তি কতদিনের?”

তর্কপঞ্চানন চিন্তা করে বললেন, “পুরাণ অনুযায়ী একেকটি যুগের সময়কাল তার আগের যুগের চেয়ে এক গুণ কম। যেমন সত্যযুগ ছিল ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার বছর ধরে। বর্তমান কলিযুগের প্রায় চারগুণ। ত্রেতাযুগ ছিল কলি যুগের তিন গুণ, ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর ধরে। দ্বাপর যুগ কলিযুগের মাত্র দ্বিগুণ ছিল, তার সময়কাল ছিল ৮ লক্ষ ৬৪ হাজার বছর। কলিযুগের একেবারে অন্তে আবির্ভূত হবেন দশম অবতার কল্কি। তিনিই বিনাশ করবেন সবকিছু।”

“কলিকাল কতদিনের?”

“দ্বাপরের ঠিক অর্ধেক। অর্থাৎ ৪ লক্ষ ৩২ হাজার বছর।” তর্কপঞ্চানন বললেন।

“তো সেই কলিকালের কতদিন ইতিমধ্যে অতিবাহিত হইয়াছে, পণ্ডিত?” জোন্স ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করলেন।

জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন হাসলেন, “কলিযুগের শেষ প্রায় আসন্ন, সাহেব!”

“সেকী! তবে আমাদের এত পরিশ্রম?” উইলিয়াম জোন্স ভীত হওয়ার ভান করে বললেন, “সবকিছুরই যদি বিনাশ ঘটে যায়, কী হবে দেশীয় লোকেদের জন্য আইনের বই লিখে? তুমিই বা তোমার ‘দশানন বধ’ করে কী করবে?”

জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন হাসলেন। বললেন, ‘দশানন বধ’ আমার মনের তাগিদ। দশানন অর্থে রাবণ। তাঁর দশটি মুখ হলেও আমার লক্ষ্য আটটি অসুরবধ। চারপাশে প্রচুর স্মার্ত পণ্ডিত। তাঁরা আদি বেদকে না মেনে নিজেদের মতো করে অপভ্রংশে ভরিয়ে দিচ্ছেন আমাদের শাস্ত্রকে। প্রতি কৃষ্ণপক্ষে আমি যে এই দশাননবধের সংকল্প নিয়েছি, এতে একে একে আটটি সভায় এই জাতীয় পণ্ডিতদের আমি তর্কযুদ্ধে পরাজিত করব। এতে সাধারণ মানুষের কাছেও সত্যটা ছড়িয়ে পড়বে। সাতটি ইতিমধ্যেই সমাপ্ত করেছি।”

“তোমার এই সংকল্পের মধ্যেই যদি কল্কি অবতার চলিয়া আসেন?” জোন্স কৃত্রিম ভয়ের ভাব ফুটিয়ে তুললেন মুখের অভিব্যক্তিতে।

জগন্নাথ সহাস্যে বললেন, “মহাজাগতিক হিসেব অনেক প্রসারিত, সাহেব। আমাদের একসহস্র সৌরবর্ষ হয়তো প্রজাপতি ব্রহ্মার এক নিশ্বাসের সমতুল। কাজেই অত দুশ্চিন্তা কোর না।”

জগন্নাথ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় রঙ্গালাপে ছেদ পড়ল।

চাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে চতুষ্পাঠীর এক উঁচু শ্রেণীর ছাত্র। নীরবে এসে গুরুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল সে।

“জয়তু।” তর্কপঞ্চানন আশীর্বাদ করলেন, “নদীয়া থেকে কখন এলে, কৃষ্ণদাস?”

“কয়েক দণ্ড পূর্বে, গুরুদেব।”

“উত্তম। যাও, গিয়ে বিশ্রাম নাও। আহারাদি হয়েছে?”

কৃষ্ণদাস মাথা হেলাল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সুবিশাল চতুষ্পাঠীর সে আবাসিক ছাত্র। এখানে প্রায় আটশো ছাত্র থেকে পড়াশুনো করে। সব মিলিয়ে একখানা বৃহৎপল্লি প্রায়।

সে কিছু সংকোচে বলল, “অভয় দিলে একখানা কথা জানাই, গুরুদেব।”

“কী, বলো?”

“শুনে এলাম, নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র এক বিশাল বাজপেয় যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। সমগ্র বঙ্গের খ্যাতনামা পণ্ডিতবর্গ তো বটেই, সুদূর কাশী, মিথিলা, কান্যকুব্জ এমনকি দ্রাবিড় থেকেও বিখ্যাত পণ্ডিতরা নিমন্ত্রিত হয়েছেন সেই যজ্ঞে।”*

“বেশ।” তর্কপঞ্চানন বললেন, “তো?”

কৃষ্ণদাস কিছুক্ষণ মৌন থেকে উষ্মাভরা কণ্ঠে বলল, “আপনি ত্রিবেণীর সূর্য, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। আপনাকে নিমন্ত্রণ না করাটা কি ভয়ংকর অপমান হল না, গুরুদেব?”

তর্কপঞ্চানন মৃদু হাসলেন। তারপর উইলিয়াম জোন্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বুঝছ, সাহেব?”

উইলিয়াম জোন্স বললেন, “রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর দেখি তোমার ওপর রাগ কিছুতেই যাইতেছে না। তুমি গত একবছরে বড় বড় সব পণ্ডিতকে পরাস্ত করেছ বাকযুদ্ধে। তারপরেও তোমাকে এমন গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ কী, পণ্ডিত?”

তর্কপঞ্চানন বললেন, “ক্রোধ বিষয়টি এক্ষেত্রে একমুখী নয়, সাহেব, দ্বিমুখী।”

“অর্থাৎ শুধু রাজার তোমার প্রতি নয়, তোমারও রাজার প্রতি রাগ। কিন্তু কেন?”

“কারণ অতি জটিল, সাহেব। বলতে গেলে আজকের সন্ধ্যা নিঃশেষ হয়ে যাবে, তোমার অধ্যয়ন হবে না।”

“রোজই তো অধ্যয়ন করছি পণ্ডিত। কিন্তু আজ যে বড় জানতে ইচ্ছা যাচ্ছে, কী কারণে আপনার প্রতি তিনি এত অসন্তুষ্ট। যেখানে তাঁর বিদ্যোৎসাহের কথা সর্বজনবিদিত। অগণিত পণ্ডিতকে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া থাকেন। সেখানে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের প্রতি তাঁর এই রোষ কেন?”

তর্কপঞ্চানন তিক্তস্বরে বললেন, “তোমরা সাহেবরা তো এই প্রশ্ন করবেই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যে তোমাদের বড় সুহৃদ মনে করেন। কিন্তু নবকৃষ্ণ মুন্সী আর ওই কৃষ্ণচন্দ্র রায় যতই তোমাদের পা চাটুক, আমার চোখে তারা বিশ্বাসঘাতক। প্রবঞ্চক।”

“বিশ্বাসঘাতক?” উইলিয়াম জোন্স শব্দটির মর্মার্থ কিছু সময় নিয়ে উদ্ধার করলেন এবং হতবাক হয়ে গেলেন, কিন্তু এ’কথা তোমার কেন মনে হচ্ছে পণ্ডিত?”

_____

* নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুবর্ষ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলেন ১৭৮২, কেউ ১৭৮৩। উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় আসেন ১৭৮৩ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সঙ্গে তাঁর দিনের পর দিন নানা বিষয়ে আলোচনা চললেও তাতে ‘জীবিত’ কৃষ্ণচন্দ্র না আসাটাই তাই স্বাভাবিক। উপন্যাসের স্বার্থে তাই এখানে লেখকের সজ্ঞান Anacronism অধিকার প্রয়োগ করে তর্কপঞ্চানন—জোন্স প্রসঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রকে বর্তমান রাখা হল।। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ও উইলিয়াম জোন্স সম্পর্কিত বাকি ঘটনাবলি অবশ্যই ইতিহাস আধারিত।

১৮

জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন অনেকক্ষণ মৌন রইলেন। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে প্রায়। চতুষ্পাঠী সংলগ্ন তাঁর বসতবাটী থেকে সন্ধ্যাবেলার শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাঁকে এবার উঠতে হবে।

“বলো না পণ্ডিত! আজ যে বড় জানতে ইচ্ছে করছে, তোমাদের দুজনের এই শীতলযুদ্ধের কারণ কী!” উইলিয়াম জোন্স অনুনয় করলেন। তাঁরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। গার্ডেনরিচের বাড়িতে একাকী রয়েছেন স্ত্রী অ্যানা মারিয়া শিপলি। আগামীকাল প্রত্যুষের মধ্যে পৌঁছতেই হবে।

জোন্স যখন আটত্রিশ বছরের তরুণ, বিবাহের মাত্র কুড়িদিনের মধ্যে নবপরিণীতা অ্যানাকে নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে চেপে বসেছিলেন ভারতগামী জাহাজে। প্রাচ্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ আশৈশব, অ্যানা হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন স্বামীর এই ইচ্ছাকে।

তারপর থেকে জোন্স ক্রমশই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির দায়িত্ব সামলে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন বেদ, সংস্কৃতশিক্ষায়। উপলব্ধি করেছেন, ভারতবর্ষকে চিনতে গেলে জানতেই হবে আদিভাষা। তাই তো তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে ঘুরে বেড়ান কখনো নদীয়া, কখনো ত্রিবেণী, কখনো মুর্শিদাবাদে। পেতে চান তর্কপঞ্চাননের মতো পণ্ডিতদের সাহচর্য। ওদিকে অ্যানা এই বিদেশবিভুঁইয়ে ক্রমশই বোধ হয় আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন।

“এইসব বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে সাহেব।” তর্কপঞ্চানন চোখ বন্ধ করলেন, “তা তোমার ভালো নাও লাগতে পারে। তোমরা ভাবো আমি পণ্ডিত মানুষ, লেখাপড়া নিয়ে থাকি, দেশের খবর রাখিনা। জগন্নাথ পণ্ডিতকে তোমরা অন্ধ পাওনি সাহেব। প্রথমে বর্গীরা এসে দেশটা ছারখার করল, এখন ফিরিঙ্গিরা। আলিবর্দি খা’র নাতি সিরাজকে তোমরা যেভাবে অন্যায়ভাবে সিংহাসন থেকে সরালে, তা তোমাদের উপযুক্ত আচরণ নয়। সিরাজ ছোকরার চরিত্রের দোষ যতই থাক, সে কিন্তু এতগুলো পাকা মাথার ষড়যন্ত্রেও মাথা না নুইয়ে শেষ অবধি লড়ে প্রাণ দিয়েছে। নবকৃষ্ণ মুন্সী আর কৃষ্ণচন্দ্র রায় ক্লাইভের সঙ্গে যোগ দিয়ে দল ভাঙিয়ে সিরাজকে হারানোটা যতই ‘হিন্দুর জয়’ বলে গৌরবান্বিত করুক, দেশ কিন্তু বিদেশিদের হাতে গেল ওদের জন্যই। তবে হ্যাঁ, ওদের ওই বিশ্বাসঘাতকতার উপহারমূল্য তোমাদের ক্লাইভ দিয়েছে। মীর জাফর, রামচাঁদ রায়ের সঙ্গে মিলে সিরাজের কোষাগার লুঠ করে নবকৃষ্ণ এখন রাতারাতি রাজার ধন পেয়ে গিয়েছে। আর কৃষ্ণচন্দ্র তো আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে।”

“মিরজাফরকে সরিয়ে তারপর তো নবাব হয়েছিল তাঁর জামাতা মিরকাশিম।”

“সরিয়ে বলো না।” তর্কপঞ্চানন তিক্তমুখে বললেন, “বলো সরানো হয়েছিল। তোমাদের ক্লাইভের খিদে আর কত মেটাত মিরজাফর? কোষাগার তলানিতে, এদিকে ক্লাইভের হুকুম, প্রজাদের মেরেধরে যাহোক করে খাজনা দিতেই হবে। এত দিয়েও মিরজাফর খিদে মেটাতে পারল না, মসনদে তাই বসানো হল মিরকাশিমকে। মীর কাশিম যদিও শ্বশুরের মতো অমেরুদণ্ডী প্রবঞ্চক ছিল না, কিন্তু সে তো ছিল পরিস্থিতির শিকার, ফিরিঙ্গিদের ক্রীড়নক মাত্র। তার হাতে ক্ষমতা কিছুই ছিলনা, এদিকে খাজনা আদায়ের পাহাড়প্রমাণ চাপ। কী-বা করত সে!”

উইলিয়াম জোন্স অনেকক্ষণ নির্বাক রইলেন। তারপর বললেন, “আমাদের ওপর তোমার এত রাগ, পণ্ডিত? আগে তো কখনো বুঝিনি!”

“আগে তো কখনো এ’সব নিয়ে কথা বলোনি সাহেব!” তর্কপঞ্চানন হাসলেন, “লেখাপড়ার দিকে তুমি অবশ্যই আমার বন্ধু। আছে এবং থাকবেও। কিন্তু তাই বলে সত্যটা মিথ্যা হয়ে যায়না। নদীয়াধীশ্বরের ওপর আমার আরও একটি কারণে রাগ। তুমি ঢাকার রাজবল্লভ সেনের নাম শুনেছ তো? প্রথমে মুর্শিদাবাদের জগত শেঠদের কর্মচারী হয়ে জীবন শুরু করলেও লোকে তাঁকে রাজা বলেই চিনত ও মানত।”

“শুনেছি। কিন্তু তিনিও তো শুনেছিলাম সিরাজকে তাড়াতে ষড়যন্ত্র করেছিলেন।”

“ভুল কিছু শোননি। সে আমার কোনো প্রিয়পাত্রও ছিল না। কিন্তু এই ঘটনাটি ভিন্ন। বেশ কয়েকবছর আগের কথা। রাজবল্লভের কন্যা মাত্র আটবছর বয়সে বিধবা হয়েছিল। কন্যার অকালদুর্দশায় শোকে কাতর হয়ে সে ঠিক করল কন্যার বিধবা বিবাহ দেবে। তাঁর রাজ্যের সব পণ্ডিতদের বিধান জানতে চাইল। তা তাঁরা তো ভয়েই অস্থির। কেউ ঠিক করে কিছু বলতে পারল না। অবশেষে সে লোক পাঠিয়েছিল আমার কাছে।”

“বিধবা বিবাহ! হিন্দু নারীদের! সে তো কল্পনার বাইরে! পণ্ডিত, তুমি নিশ্চয়ই অমত করলে?”

তর্কপঞ্চানন খরচোখে তাকালেন, “অমত করতে যাব কেন সাহেব? তোমাকে যে দিনরাত অবসরে সংহিতা ও উপনিষদগুলো পড়তে বলছি, তা একেবারেই অগ্রাহ্য করছ?”

উইলিয়াম জোন্স অপ্রতিভ হলেন। বললেন, “পড়ছি তো। বেদের চারটি ভাগ। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, ও উপনিষদ। জানি তো!”

“তো জানো যখন, পরাশর সংহিতার সেই শ্লোকটা কি আমি তোমাকে বলিনি?” তর্কপঞ্চানন আদর্শ শিক্ষকের ভঙ্গিতে তিরস্কার করে উঠলেন।

“কোন শ্লোক?”

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।” তর্কপঞ্চানন বললেন, “পতি নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক বা পতিত হলে স্ত্রী আবার বিবাহ করতে পারে।”

“সেকি!” উইলিয়াম জোন্স চমকে উঠলেন, “পরাশর সংহিতায় রয়েছে এই শ্লোক?”

“হ্যাঁ। পরাশর মুনি স্বয়ং নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। আমি বলার কে! আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্মতি রাজবল্লভের দূতকে জানিয়ে দিলাম। জগন্নাথ পণ্ডিতের নিদান বলে কথা, কাশী থেকে বৃন্দাবন, কনৌজ থেকে বাংলা, দেশের সব পণ্ডিত অমনি বলতে শুরু করল, ঠিক ঠিক! আমরাও রাজি!”

“তারপর?”

“বিবাহের আয়োজন যখন প্রায় সম্পূর্ণ, সেইসময় রুখে দাঁড়ালেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র। তোমরা ওঁকে যতই বিদ্যানুরাগী হিসেবে চেনো, ওঁর মতো রক্ষণশীল, ধর্মের অনুশাসনের নামে অন্ধ শাসক খুব কম রয়েছে। তিনি তাঁর নবদ্বীপের সব পণ্ডিতকে এককাট্টা করলেন। বললেন, এই বিবাহ ভয়ঙ্কর পাপের সমতুল্য। রাজবল্লভ তার দূতকে দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে বলে পাঠাল, পরাশর সংহিতা অনুযায়ী এই বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ। তখন কৃষ্ণচন্দ্র কী করলেন জানো?”

“কী?”

“দূতকে দিয়ে তিনি নানা সৌজন্যমূলক উপহারের সঙ্গে পাঠালেন একটি গো শাবক। বললেন, বিধবাবিবাহের পর যেন রাজবল্লভ সেই গো শাবকটির মাংস ভক্ষণ করেন। বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ হলেও তা নাকি লোকাচারবিরুদ্ধ, দেশাচারের পরিপন্থী, তাই তা মহা পাপ।”

“তারপর?”

“রাজবল্লভ এমনিতে মহা সাহসী হলেও এইসব বিষয়ে ছিল ভীষণ ভিতু।” তর্কপঞ্চানন তিক্ত কণ্ঠে বললেন, “গোটা নবদ্বীপের চক্ষুশূল হতে সে চাইল না। বিবাহের আয়োজন বন্ধ হয়ে গেল।”

উইলিয়াম জোন্স অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। বললেন, “সত্যি পণ্ডিত! তোমার এক নতুন রূপ আজ আমি দেখতে পাচ্ছি। হিন্দু পণ্ডিত হয়েও তুমি যে এত যুক্তিবাদী, এত মুক্তমনা, আমি জানতাম না।”

“মন তো মুক্ত রাখতেই হবে সাহেব!” তর্কপঞ্চানন বললেন, “মন বন্ধ রাখলে আমি শিক্ষা আহরণ করব কী করে?”

“ঠিকই।” উইলিয়াম জোন্স বললেন, “তবে আমার প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর এখনো পেলাম না। তুমি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতি অপ্রসন্ন তা তো বুঝলাম। কিন্তু তিনি তোমার ওপর এত কূপিত কেন?”

তর্কপঞ্চানন বললেন, “ওহ! সে আবার অন্য এক প্রসঙ্গ। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারকে একবার বলেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাবের কবিতা রচনা করতে পারলে একশো বিঘা নিষ্কর ভূমি ও একশো রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার দেবেন। কিন্তু বাণেশ্বর যাই রচনা করতে যান, তারই প্রতিচ্ছবি ইতিহাস বা পুরাণে পান। অবশেষে অন্তিম দিনে তিনি একটি কবিতা রাজদরবারে পাঠ করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন অন্যান্য সমস্ত পণ্ডিতকে বাণেশ্বরের কবিতার অনুরূপ কোনো ভাব ইতিমধ্যেই আছে কিনা, তা সন্ধান করতে বলেন। পুরস্কারের লোভে একমাস ধরে অত্যুৎসাহে পণ্ডিতরা প্রচুর অনুসন্ধান করলেও বাণেশ্বরের সঙ্গে পুরোনো কোনো কাব্যের মিল পেলেন না।”

“তারপর?”

তর্কপঞ্চানন বলতে যাচ্ছিলেন, কৃষ্ণদাস সোৎসাহে বলল, “আমি বলব, গুরুদেব?”

গুরুর গর্বে গর্বিত শিষ্যের উৎসাহ তর্কপঞ্চানন স্তিমিত করতে চাইলেন না। বললেন, “বেশ। বলো।”

কৃষ্ণদাস বলতে লাগল, “রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন কবি বাণেশ্বরকে পুরস্কৃত করতে যাবেন, ঠিক তখনই বিশেষ কাজে আমাদের পূজনীয় গুরুদেব কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে উপস্থিত হলেন। রাজা তখন গুরুদেবকে অনুরোধ করলেন, কবিতাটি একবার শুনতে। গুরুদেব শোনামাত্র স্মিতহাস্যে বললেন, এই কবিতার অনুরূপ সংস্কৃতে না থাকলেও তুলসীদাসের একটি দোঁহার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায়।

জগ্মে তোম যব আয়া, সব হাঁসা, তোম্ রোয়।

এয়সা কাম করো পিছে হাঁসি না হোয়।।

গুরুদেব দোঁহা আবৃত্তি শেষ করলে বাণেশ্বর লজ্জিতমুখে নিজের দোষ স্বীকার করলেন। তিনি সম্ভবত কল্পনাও করতে পারেননি, সংস্কৃত বা প্রাকৃত কাব্য ছেড়ে কেউ দোঁহাতেও খোঁজ করতে পারেন।”

“গ্রেট পণ্ডিত!” উইলিয়াম জোন্স বললেন, “অসাধারণ তোমার স্মরণশক্তি। যত শুনি, যত দেখি, ততই অবাক হইয়া যাই। কিন্তু এতে রাজা তোমার ওপর রেগে গেলেন কেন?”

“বলছি।” তর্কপঞ্চানন বললেন, “নদীয়াধিপতি তখন খুশি হয়ে আমায় তাঁর রাজ্যে বসতি স্থাপনে আহ্বান করেন। কিন্তু আমি বলি, বর্ধমানরাজ ও আঞ্চলিক শূদ্রমণি জমিদারদের কৃপায় আমি ত্রিবেণীতেই ভালো আছি, আমি কোথাও যাব না।”

“সেকি! বর্ধমানের রাজা তো শুনেছি কৃষ্ণচন্দ্রের পরম শত্রু!”

“ঠিকই শুনেছ। আমি বর্ধমানরাজের প্রশংসা করায় তিনি কুপিত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিদ্যোৎসাহী, কাব্যানুরাগী, মহান দাতা ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে অতি অহংকারী ও দাম্ভিক। এরপর থেকেই তিনি নানা উপায়ে আমাকে হেনস্থা করতে শুরু করেন, কিন্তু প্রতিবারই নিজেই অপমানিত হন।”

“যেমন?”

“একবার তিনি আমাকে বললেন, আপনি তো বহুল শাস্ত্রদর্শী, বলুন তো, কার প্রতারণায় উন্মার্গগামী মূর্খেরা দু-হাত তুলে ভ্রমণ করে?

আমি জানতাম, রাজা শক্তির উপাসক। শ্রীচৈতন্যের ঘোর বিরোধী। বৈষ্ণবদের তিনি দু’চক্ষে দেখতে পারেননা। আমি হেসে বললাম, আজ বিশ্বাস হল, শ্রীচৈতন্যদেব প্রকৃতই অবতার ছিলেন।

রাজা বললেন, কীভাবে?

আমি বললাম, “ভগবান বিষ্ণুর প্রত্যেক অবতারকালেই অসুরসম এক দুরন্ত রাজা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যেমন, হিরণ্যাক্ষ, হিরণ্যকশিপু, বলি, রাবণ, কংস। আমাদের শ্রীচৈতন্য অবতারের প্রায় সমসাময়িক অসুর রাজাটিকে আজ চাক্ষুষ করলুম।

ভরা রাজসভায় এই অপমানে কৃষ্ণচন্দ্র আরও রেগে গেলেন। এরপরও নানা ছোটখাটো শাস্ত্রানুসারী আচারবিচারে প্রথমে আমার বিরুদ্ধাচরণ করেও পরে অজ্ঞতার কারণে পরাস্ত হয়েছেন। এইজন্যই তিনি আমার ওপর সন্তুষ্ট নন।”

অনেকক্ষণ বলার পর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন থামলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, “তবে হ্যাঁ। নিমন্ত্রিত হই না হই, ওই বাজপেয় যজ্ঞে আমি আমার ছাত্রসহযোগে উপস্থিত হব।”

“সেকী? বিনা নিমন্ত্রণে?”

“উপায় নেই, সাহেব।” জগন্নাথ স্বভাবসিদ্ধভঙ্গিতে মৃদু হাসলেন, “আমি না গেলে ওই মিথিলা, কান্যকুব্জের পণ্ডিতরা যে বঙ্গের পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে ধরাশায়ী করে চলে যাবেন। সে যে বড় লজ্জার বিষয় হবে, সাহেব! তাঁরাও ভাববেন, জগন্নাথ পণ্ডিত বুঝি তর্কের ভয়ে আসেননি। কৃষ্ণদাস, তুমি আমার সহকারীকে প্রেরণ করো, দ্রুত নদীয়া যাত্রার আয়োজন করতে হবে। আমার দশানন বধের অন্তিম পর্বে বধিত হবেন স্বয়ং এই যুগের রাজা হিরণ্যকশিপু।”

১৯

গুরুদেব ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, “এ’সব কী হচ্ছে কৃষ্ণকান্ত, বংশীধর, গোপাল? সমাজের এতবছরের ইতিহাসে খুব কম জনই এভাবে বিনা অনুমতিতে বাইরে বেরোতে পেরেছে। আর যারা পেরেছে, তারা কেউ বেশিদিন বেঁচে থাকেনি। আর সেখানে এতগুলো মাস কেটে গেল, থাকো গোপালের বৌ-মেয়ের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না?”

কৃষ্ণকান্ত লাহিড়ী ও গোপাল ব্যানার্জি নির্বাক হয়ে হুঁকা টানছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র বংশীধর, গোবর্ধন ও মধুসূদন নতমস্তকে বসে রয়েছেন অদূরে। প্রতি বুধবারের মতো আজও গোধূলিলগ্নে গুরুদেবের বাসকুটিরের অদূরে উপাসনামন্দিরে চলছে আলোচনা। অতি গোপন এই আলোচনাসভা, তাই বাইরে দণ্ডায়মান দুই অতন্দ্র প্রহরী।

উপাসনামন্দিরের পাশ দিয়েই শুরু হয়েছে বিস্তৃত অরণ্য। সেদিক এতই ঘন, যে বাইরের আলোও তেমন ঢোকেনা। অল্প আলোয় সবার মুখই কেমন ছমছমে লাগছে।

বংশীধর অনুদাত্ত স্বরে বললেন, “সন্ধান পাওয়া গিয়েছে গুরুদেব। কিছুটা আকস্মিকভাবেই। যে নারী হরিসাধনের সন্ধানে আশ্রমে গিয়েছিলেন, তাঁর গৃহেই রয়েছে মা-মেয়ে।”

“হরিসাধনের সন্ধানে বলতে?”

“কনেনগরের স্বপন সরকারের বিষয়টি যে সামলেছিল, সেই হরিসাধন। তার একটা যান্ত্রিক ছবি নিয়ে ওই নারী গিয়েছিলেন সরলাশ্রমে।”

“তো? একজন ব্যক্তি বিশেষত এক তুচ্ছ নারীর কাছ থেকে কেড়ে আনতে এত ভয়?” গুরুদেব তিরস্কারের সুরে বললেন, “তবে তো যে যুদ্ধের আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাতে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখাটাই বাতুলতা।”

“আমাদের ছেলেরা চেষ্টা করছে গুরুদেব। বেশিদিন লাগবে না।” গোপাল ব্যানার্জি হুঁকা নামিয়ে বললেন, “এই সামান্য বিষয় নিয়ে মনে হয় এত উতলা না হওয়াই ভালো। মা ও কন্যা দুজনেই অতি নিরীহ। জানাজানি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই গুরুদেব। এখন এমনিতেই অতি অনুসন্ধানে অন্য আশঙ্কা রয়েছে। বংশীধর, মধুসূদন বা গোবর্ধন, ওরা প্রত্যেকেই গিয়েছে। ধরা পড়ে যেতে পারে।”

“আচ্ছা, মা-মেয়ের বিষয়টা আমি দেখছি।” গুরুদেব অন্যদিকে মুখ ঘোরালেন, “ওদিকের কী অবস্থা, মধুসূদন?”

মধুসূদন বললেন, “সব কুশল গুরুদেব। ভর্তৃহরি অতি কৌশলে গোটা বিষয়টি সামলাচ্ছে। প্রতিটি সপ্তাহে দশজন করে গোপনে চলে যাচ্ছে ওখানে। কিছুজন গোশালায় নিযুক্ত হচ্ছে। কিছুজন অন্যান্য কাজে।”

“হুম।” গুরুদেব বললেন, “বহুপ্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্র মহোৎসবের আর বেশি বিলম্ব নেই। তার আগে সমস্ত কন্টক আমাদের উৎকীর্ণ করতেই হবে। আগে যে দু’বার ব্যর্থতা এসেছে, তার পুনরাবৃত্তি আর কিছুতেই হতে দেওয়া যাবেনা। বারবার তিনবার।”

গোবর্ধন বললেন, “ গুরুদেব, যদি অভয় দেন তো একটি কথা বলি।”

“বলো গোবর্ধন।”

“যে অবাধ্য বালকটিকে আপনি কয়েকদিন আগে শাস্তি দিয়েছিলেন, তাকে কিন্তু পাওয়া যায়নি।”

“কী!” প্রচণ্ড বিস্ময়ে চমকে উঠলেন গুরুদেব, “পাওয়া যায়নি মানে? আমি তো বলেছিলাম পরের দিন প্রত্যুষেই যেন তাকে উদ্ধার করা হয়। অতি বুদ্ধিদীপ্ত হলেও সে জেদী। জেত কমানোর জন্য সারারাত্রি ব্যাপী ওই আতঙ্কই তার শাস্তি।”

“উদ্ধার করতে গিয়েছিল কৈবর্তরা।” গোবর্ধন আড়ষ্টভাবে বললেন, “কিন্তু জরা নদীর চরে তাকে পাওয়া যায়নি। ভয়ে এই কথা আপনাকে কালু বলতে সাহস পায়নি গুরুদেব!”

“একী সাংঘাতিক কথা। তোমরা কী জানো ওর ইতিহাস? ওর পিতার নাম ছিল দীনবন্ধু। সে ভয়ংকর অপরাধ করেছিল প্রায় দুইযুগ আগে। এক কৈবর্তকন্যাকে বিবাহ করেছিল সে। তখনও প্রথম গুরু জীবিত। সেইসময়ে সমাজের সবচেয়ে শ্রুতিধর ও মেধাবী ছাত্র ছিল দীনবন্ধু। অস্পৃশ্য বিবাহের মতো ঘোরতর অপরাধেও প্রথম গুরু ওকে তেমন শাস্তি দেননি। বিবাহের পর এক পুত্র জন্মায়। সেই পুত্র শুদ্রগর্ভে জন্মালেও ব্রাহ্মণপল্লিতেই বড় করার নিদান দেন তিনি।”

মধুসূদন অস্ফুটে বললেন, “মনে আছে। আর অচ্যুত নামের এই ছেলেটি দীনবন্ধুখুড়োর দ্বিতীয় পুত্র। দীনবন্ধু মারা যাওয়ার পর শ্মশানঘাট থেকে প্রথম পুত্রটি পালায়। সে আমার বাল্যবন্ধু ছিল। আর তাকেই আমি…।”

“নির্ভুল বলেছ, মধুসূদন!”

মধুসূদন বললেন, “মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে ও আমাকে কিন্তু শনাক্ত করতে পারছিল, জানেন গুরুদেব! বাল্যবন্ধুর সঙ্গে পরিণত বয়সের নতুন বন্ধুর অদ্ভুত সাদৃশ্য ওকে সন্দিগ্ধ করে তুলছিল। তাই মৃত্যুর সময়ে ও খুব একটা বিস্মিত বোধ হয় হয়নি। শুধু বলেছিল, তুমি এত রাতে এখানে?”

গুরুদেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বললেন, “তুমি কি নরম হয়ে পড়ছ, মধুসূদন?”

“না গুরুদেব!” সচকিত হয়ে উঠলেন মধুসূদন।

“হ্যাঁ, নরম না হওয়াই উচিত। এই বিষয়ে মনকে একেবারেই প্রশ্রয় দেবে না।” গুরুদেব বললেন, “প্রথম গুরুর নরম মনোভাবের অপব্যবহার করেছে অনেকে। তাই গত কয়েকমাসে আগে এই বিনাশ অভিযান চালিয়েছি আমি। সমস্ত কন্টক নির্মূল হলেই আমাদের মহা অভিযান শুরু করার মনোবল পাব আমরা। কিন্তু আগে এই ছেলেটির সন্ধান করো। ছেলেটির অবাধ্যতা তার রক্তেই রয়েছে।”

“হ্যাঁ গুরুদেব।” মধুসূদন বললেন।

“ওপারে গিয়েছে কিনা খোঁজ নিয়েছ?” গুরুদেব চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

“না। আজই লোক পাঠাব।”

গুরুদেব উঠে দাঁড়ানো মাত্র দ্বারিকা মাথা নীচু করে বসে পড়ল।

ওর বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। মনে হচ্ছে, উত্তেজনায় হৃদপিণ্ডটা মুখ দিয়ে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে।

অচ্যুতকে পাওয়া যায়নি?

তার মানে … তার মানে অচ্যুত পালিয়েছে!

গুরুদেবের কুটিরের পেছনেই অনেকটা বনবাদাড়। সামনের দিকে প্রহরী থাকলেও এদিকে সাপখোপের উৎপাতে কেউ থাকেনা।

দ্বারিকা সেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছিল। ওপরে বিশাল বিশাল গাছের ছায়া ঢেকে রেখেছিল ওকে। সেই ছায়ার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে ওর গায়ে পড়ছিল সূর্যের আলো।

মাহেন্দ্র মহোৎসব কী? মহোৎসব তো বার্ষিক অনুষ্ঠান, ওদের এই বৈদিক সমাজের পবিত্রতম দিবস। অষ্টম অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে পালিত হয় সেই মহোৎসব। কিন্তু এবারে তার আগে ‘মাহেন্দ্র’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে কেন?

অচ্যুতের পিতার নাম নাকি ছিল দীনবন্ধু। তিনি ছিলেন প্রতিভাবান। বোঝাই যাচ্ছে, অচ্যুত পিতার গুণ পেয়েছে। কিন্তু অচ্যুতের মা? তিনি কোথায়? তিনি কি স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হয়েছিলেন? তাই যদি হয়, অচ্যুতের দাদা পালিয়েছিল কেন? মায়ের পরিণতিতে তীব্র আক্রোশেই কি?

তরুণ শিক্ষক মধুসূদনের কথাটা আবার মনে পড়ে গেল ওর।

“সে আমার বাল্যবন্ধু ছিল। মৃত্যুর আগে আমাকে শনাক্ত করতে পেরেছিল।”

অচ্যুতের দাদাকেও কি ব্রজেন্দ্রদাদার মতো হত্যা করা হয়েছে?

দ্বারিকা দরদর করে ঘামছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে ও বসে পড়ল। ছোট থেকে ওদের তিন গুরুর কথা বলা হয়েছে। শেখানো হয়েছে, বৈদিক সমাজের দিশারী তাঁরাই।

প্রথমজন সাক্ষাৎ ঈশ্বর, শ্রীকৃষ্ণের নবরূপ। স্বয়ং পরম গুরু। যার পার্থিব নাম ওরা মাত্র কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছে। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।

পরের জন ঈশ্বর নন, তবে অবতার। যিনি ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সেতুর কাজ করেন, তিনিই অবতার। প্রথম গুরু। যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই সমাজ।

কিন্তু দ্বিতীয় গুরু অর্থাৎ বর্তমান গুরুদেব? যিনি কোনো অজানা অভীষ্টপূরণের লক্ষ্যে কিছু মানুষকে বিনাশ করার অভিযান চালাচ্ছেন?

যিনি ব্রজেন্দ্রদাদা থেকে শুরু করে অচ্যুতকে এমন অমানুষিক শাস্তির মুখে ফেলছেন?

যিনি ক্ষমার মতো একটি শিশুকে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত হচ্ছেন?

তিনি কে? কী তাঁর পরিচয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *