৩০
জ্যোৎস্নাদি এসে খুব নীচুগলায় বলল, “দাদাবাবু, আজকের মাটনটা আমি রান্না করতে পারব না।”
প্রিয়ম বসার ঘরে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিল। রুদ্র বসে ছিল অদূরের বিশাল কাঠের টেবিল চেয়ারে। ওরও সামনে ল্যাপটপ। সেখানে খোলা পরপর খুনগুলোর বিবরণ। হাতে একটা ছোট নোটবুক আর পেন। সবে সকাল সাড়ে সাতটা। একটু পরেই দুজনে তৈরি হবে অফিসের জন্য।
জ্যোৎস্নাদি’র এত ম্রিয়মাণ গলায় ওরা অবাক হল না। মল্লিকাদি মারা যাওয়ার পর থেকেই জ্যোৎস্নাদি এমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। নীচে মল্লিকাদি আর ক্ষমার ঘরটা তারপর থেকে তালাবন্ধ রয়েছে। পুলিশি তরফে প্রথমে কিছুদিন সিল করা থাকলেও পরে খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তবু ওই ঘরে পারতপক্ষে কেউ যায় না।
মল্লিকাদি আর ক্ষমা যেন এই বাড়িতে একটা অসম্পূর্ণ অধ্যায়। যা শেষ হওয়ার আগেই টেনে হিঁচড়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
প্রিয়ম মুখ তুলে বলল, “রান্না করতে পারবে না? কেন?”
জ্যোৎস্নাদি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ওর চোখদুটো ছলছল করছিল। তারপর বলল, “মল্লিকাদি কী ভালো পাঁঠার মাংসটা রাঁধত, বলুন? আমাদের মতো ফাঁকিবাজি করে বাজার থেকে কেনা গুঁড়ো মশলা দিয়ে নয়। বসে বসে ধৈর্য ধরে ধনে, জিরে বাটত, আদা, রসুন, সব। কী ভালো খেতে হত! আবার ভক্তি করে বলত, মহাপ্রসাদ! কেন কে জানে। রাঁধতে গেলে ওর মুখটা বড্ড মনে পড়বে। আমাকে রাঁধতে বলবেন না দাদাবাবু।”
প্রিয়ম কী বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র বাধা দিয়ে বলল, “আচ্ছা বেশ। তোমাকে মাটন রান্না করতে হবে না। থাক, আমরা দুজনে মিলে করে নেব। ঠিক আছে? তুমি যাও, জ্যোৎস্নাদি।”
জ্যোৎস্নাদি যেতে উদ্যত হয়েও পেছন ফিরল। ধরা গলায় বলল, “কাল ওদের ঘরটা পরিষ্কার করতে ঢুকেছিলাম দিদিমণি। সেই জানলাটা, যেখান দিয়ে মল্লিকাদিকে … এত কষ্ট হচ্ছিল! বেরিয়ে এলাম। ক্ষমাটাই বা কোথায় গেল? মল্লিকাদির খুনের কি কোনো কিনারা হবেনা, দিদিমণি?”
রুদ্র চুপ করে রইল। জ্যোৎস্নাদি বেরিয়ে যেতে কপালের দু’পাশের রগদুটো টিপে ধরল ও। মাথায় যেন কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এতগুলো বিষয় বিষাক্ত সাপের মতো কিলবিল করছে, যে ও কোনো খেই পাচ্ছে না।
প্রিয়ম বলল, “সত্যিই। মল্লিকাদি কে, ক্ষমা কে, কোথা থেকেই বা এসেছিল, কেনই বা এসেছিল, কেন ক্ষমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল, কেন মল্লিকাদি’কে খুন করা হল, কোনো হদিশ নেই! এতগুলো দিন চলে এল, কোনো প্রোগ্রেসও নেই। কী করছে বলো তো তোমাদের ডিপার্টমেন্ট?”
“জানি না। এই কেসটা শ্রীরামপুর থানাকে দেওয়া হয়েছে।” ক্লান্তগলায় বলল রুদ্র।
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, “নাহ, হুগলীর পুলিশ সত্যিই কোনো কম্মের নয়। এখন তো মনে হচ্ছে, মল্লিকাদি আর ক্ষমাও ওই আমীশ সমাজ না কী, তার বাংলা সংস্করণ।”
”মানে?” খাতা থেকে মুখ তুলল রুদ্র।
“তুমি নিজেই দ্যাখো না। আমীশ সমাজ নাকি সবসময় মধ্যযুগে বাস করে। মল্লিকাদি বা ক্ষমাও কি তাই নয়? ক্ষমা কখনো আজকালকার মেয়েদের নাম হয়? যখন মানুষ কন্যাসন্তান চাইত না, তখন এইসব নাম রাখত। আমার মায়ের মাসতুতো বোনের নাম সমাপ্তি। কেন? না, আগে তিনটে মেয়ে আছে, আর চাইনা ঠাকুর, এবার সমাপ্ত করো। তেমনই ইতি, ক্ষমা এইগুলো। চায়না বলে যে নামটা, সেটাও চাই না থেকে এসেছে।” প্রিয়ম বলে যাচ্ছিল, “তার ওপর, পাঁঠার মাংসকে মহাপ্রসাদ! আগেকার দিনের লোকেরা বলত শুনেছি। মা চণ্ডীর প্রসাদ, তাই মহাপ্রসাদ। বহু পুরোনো গল্প উপন্যাসে পড়েছি। কিন্তু এখন কে বলে ভাই? তারপর ওইটুকু মেয়ে মালা গাঁথছে, পুজো করছে, মা অতবড় ঘোমটা টানছে। কেমন সেকেলে ব্যাপার না? পার্থক্য এটাই যে, আমেরিকার আমীশরা সেইযুগের ঘোড়ার গাড়ি চড়ে, গাউন পরে, আর এরা দুশো বছর আগেকার বাংলার মতো রীতিনীতি পালন করে।”
রুদ্র বিস্ফারিত চোখে শুনছিল। প্রিয়ম থামতেই বলল, “ব্রিলিয়ান্ট! প্রিয়ম, ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট! সত্যিই তো! আমার তো একেবারে মাথায় আসেনি। আমি এদিক ওদিক ঘুরে মরছি। আমার বাড়িতেই দুজন রয়েছে। আড়াইশো-তিনশো বছর আগে বাঙালি আলু কী, তা জানত না। মল্লিকাদিও প্রথমদিকে আলু দেখে অবাক হত, জ্যোৎস্নাদি বলত। মল্লিকাদি’কে তির ছুঁড়ে মারা হয়েছে। সেটাও তো প্রাচীন পদ্ধতি!”
প্রিয়ম এবার অবাক, “তুমি কি সিরিয়াসলি নিলে নাকি? আমি তো মজা করছিলাম। অতগুলো খুনের সঙ্গে মল্লিকাদি’র খুনের কী সম্পর্ক? মল্লিকাদি তো কোনো ব্যবসাদার নয়।”
“ব্যবসাদার নয় তো কি হয়েছে!” রুদ্র উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করল, “ওরা সারাক্ষণ খুব ভয়ে থাকত। বিশেষ করে ক্ষমা। মাঝেমাঝেই বলত, ওকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে। ওহ, কী করে এত বড় ক্ল্যু মিস করে গেলাম আমি! ক্ষমা যেদিন ভয় পেল? তারপরে পরেই আমায় বলেছিল, ও নাকি ওর ভাশুরপো’কে দেখে অত ভয় পেয়েছিল। ওকে নাকি ধরে নিয়ে যাবে। ইশ, আমি তখনো গুরুত্ব দিলাম না? আমার … আমার এক্ষুনি রিজাইন করা উচিত। আমি এই চাকরির যোগ্যই নই।”
“সে তো যোগ্য নও বুঝলাম।” প্রিয়ম বলল, “কিন্তু ভাশুরপো মানে? ভাশুরপো মানে তো বরের দাদার ছেলে। তাহলে ভাশুরপো থাকতে গেলে তো আগে একটা বর থাকতে হবে। ওইটুকু মেয়ের বর কি করে হবে? গাঁজাখুরির কোনো সীমা নেই। কথাটা কি মল্লিকাদি বলেছে?”
“না। ক্ষমা বলেছে।” রুদ্র বলল, “বাংলার আমীশরা যদি দু-আড়াইশো বছর পিছিয়ে থাকে, তবে ন’দশবছরের মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়াটা কি খুব অ্যাবনর্মাল, প্রিয়ম? তখন তো ওইরকমই হত।”
“তাই তো! কিন্তু এখন তো আঠেরো বছরের নীচে বিয়ে দেওয়া অপরাধ। যদিও গ্রামের দিকে লুকিয়ে চুরিয়ে আকছার চলে এসব।” প্রিয়ম বলল, “তবে কি অত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিল বলে ক্ষমা আর মল্লিকাদি পালিয়ে এসেছিল শহরে? ওদের গ্রাম কোথায়, আমরা তো এখনো জানি না!”
রুদ্র কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকেশ ব্যানার্জি ফোন করলেন।
“কী ব্যাপার, কেমন উৎসব করছেন মায়াপুরে?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
“ভালো। এখন তো প্রস্তুতি চলছে ম্যাডাম, এখনো শুরু হয়নি। ম্যাডাম, একটা কথা জানানোর জন্য ফোন করছি। গত দুদিন ধরে আপনার আদেশমতো আমাদের ইনফর্মার মিন্টু কানু চক্রবর্তীকে চোখে চোখে রাখছিল। ও কয়েকটা ইন্টারেস্টিং অবজারভেশন আমাকে ফোনে জানাল। আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে কানু চক্রবর্তীর সঙ্গে একটা ছেলে থাকছে। গ্রামের এক মহিলা দেখেছে, প্রথম দু’দিন ছেলেটা ধুতিফতুয়া পরেছিল। ন্যাড়া মাথা, পেছনে টিকি। তারপর থেকে সে গেঞ্জি প্যান্ট পরে থাকে। টিকি কেটে ফেলেছে। মাথায় অল্প চুল গজিয়েছে। চারদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা কানু চক্রবর্তীকে বদনপুর থেকে একটু দূরের এক বাজারে অল্পবয়সি ছেলের জামাপ্যান্ট কিনতে দেখা গেছে।”
“হুম।” রুদ্র বলল, “ছেলেটাকে কি মহিলা চিনতে পেরেছেন?”
“না।”
রুদ্র বলল, “ইমিডিয়েটলি ওই ছেলেটার সিকিউরিটির ব্যবস্থা করুন। ছেলেটার জীবন সংশয়ের মধ্যে রয়েছে।”
“আচ্ছা। তবে কানু চক্রবর্তী লোকটা ভালো, ম্যাডাম। লোকটার পাস্ট হিস্ট্রি বেশ ইন্টারেস্টিং।”
“কীরকম?”
লোকেশবাবু কিছু বলতে শুরু করলেন, কিন্তু পাশ থেকে বেশ জোরে খোলতাল সংকীর্তনের আওয়াজ ভেসে আসায় রুদ্র কিছু শুনতে পেল না। ও বলল, “একটু দূরে গিয়ে কথা বলুন, লোকেশবাবু। আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা।”
লোকেশবাবুর গলা আবার শোনা গেল মিনিট দুয়েক পর, “হ্যাঁ ম্যাডাম। বলছি, কানু চক্রবর্তী লোকটা একটু অদ্ভুত। ওর বাবা বদনপুর গ্রামের জমিদার চৌধুরীদের বাড়ি পুরোহিতের কাজ করত। চৌধুরীরা ছিল শক্তির উপাসক, মা চণ্ডীর সেবাইত। কিন্তু কানু ছোটবেলা থেকে ছিল কৃষ্ণভক্ত। এই নিয়ে বাড়িতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। বাবা অসুস্থ হয়ে কোনো একদিন মন্দিরে পুজো করতে যেতে না পারলেও কিছুতেই একমাত্র ছেলে কানুকে রাজি করানো যেত না। দেবীর নাম শুনলেই কানু ক্ষেপে উঠত। বলতো, চণ্ডী আবার কিসের ঠাকুর? আর এই ব্যাপারে ওর এক সঙ্গী ছিল। সে ওই চৌধুরীবাড়িরই এক শরিকের ছেলে। দু’জনেই কৃষ্ণঠাকুরের ভক্ত ছিল।”
রুদ্র বলল, “কিন্তু এখন তো কানু চক্রবর্তী চণ্ডী মন্দিরেই পুজো করে!”
“পুরোটা শুনুন আগে, ম্যাডাম।” লোকেশবাবু বললেন, “চোদ্দো পনেরো বছর বয়সে কানু আর ওর সেই বন্ধুটা গ্রাম ছেড়ে পালায়। তারপরের কয়েক বছর তাদের আর কোনো খোঁজ ছিল না। চৌধুরীবাড়ি থেকে অনেক খোঁজখবর করেও পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে সবাই হাল ছেড়ে দেয়।”
“তারপর?”
“কানু একা আবার গ্রামে ফিরে আসে আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে। ততদিনে তার বাবা মারা গিয়েছে। চৌধুরীরাও গ্রামের পাট চুকিয়ে চলে গিয়েছে শহরে। চণ্ডী মন্দিরটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ছিল। কানু চক্রবর্তী এসে আবার পুজো আচ্চা শুরু করে। অদ্ভুতভাবে তার কৃষ্ণভক্তি উবে গিয়ে সে চণ্ডীর উপাসক হয়ে যায়। তারপর থেকে ওভাবেই আছে। যদিও গ্রামের কারুর সঙ্গে সেভাবে মেশে না।”
“তা কানু চক্রবর্তী লোকটা যে ভালো, সেটা আপনি কী করে বুঝলেন?”
লোকেশবাবু এবার একটু হেঁহেঁ করে বললেন, “না মানে ইয়ে, এককালে কৃষ্ণের ভক্ত ছিল, সে কি কখনো খারাপ হতে পারে? গ্রামের একজন নাকি একবার আমাদের এই মায়াপুরের মন্দিরে কানু চক্রবর্তীকে দেখতেও পেয়েছিল। পরনে পুরোদস্তুর সন্ন্যাসীর পোশাক ছিল। যদিও কানু চক্রবর্তী চিনেও না চেনার ভান করেছিল। পরে গ্রামে আসতে ওই কথা জিজ্ঞেস করতে লোকটাকে দূরদূর করে তাড়িয়েও দিয়েছিল।”
“আর কানুর ওই বন্ধু?”
“তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, ম্যাডাম।”
রুদ্র কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে রইল। এতগুলো বিচ্ছিন্ন বিষয় এত দ্রুতগতিতে চলে আসছে, যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আর প্রতিটা বিষয়ই একে অন্যের চেয়ে এত আলাদা, দিশেহারা লাগছে।
ও বলল, “চৌধুরীরা কলকাতার কোথায় থাকে, তার বিশদ জোগাড় করুন।”
লোকেশবাবু একটু কাঁচুমাচু গলায় বললেন, “এখনই? ম্যাডাম, এখন তো এখানে আছি, চারদিন পরেই পুজো। ফিরে করলে হবেনা?”
“না।” কঠিন গলায় বলল রুদ্র, “আপনাকে তো চলে এসে করতে বলছি না। লোক মারফত ফোনে খবর জোগাড় করতে বলছি। সেটুকু করুন অ্যাটলিস্ট! আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসে পৌঁছচ্ছি। ওখানেই জানান।”
৩১
অচ্যুত চলে যাওয়ার পর থেকে দ্বারিকা কেমন যেন পালটে গিয়েছে। আগে ও মেধার পরিচয় ততটা না দিলেও চতুষ্পাঠীতে সবাই ওকে খুব শান্ত ও বাধ্য ছাত্র বলে চিনত। যে কারণে বনমালী বা রাখহরির মতো পড়ুয়ারা থাকতেও শিক্ষকরা দ্বারিকাকে আলাদা করে পছন্দ করতেন।
কিন্তু দ্বারিকা এখন আর তাঁদের সেই পছন্দের তালিকায় নেই। দ্বারিকা অবাধ্য বা দুর্বিনীত না হলেও নিয়মিত পাঠঘরে উপস্থিত থাকে না। প্রায়ই সে অনুপস্থিত থেকে অন্য কোথাও ঘুরে বেড়ায়।
প্রথম প্রথম বংশীধর বা মধুসূদনের মতো তরুণ শিক্ষকেরা খেয়াল করেননি। কিন্তু যেদিন ধরতে পারলেন, সেদিন সদগোপদের দুজনকে পাঠালেন দ্বারিকাকে খুঁজে আনতে।
দ্বারিকা তখন বসেছিল জরা নদীর পাড়ে। মাথার ওপরে তপ্ত আকাশ। বসে বসে ভাবছিল, ও যেমন এই আকাশের নীচে বসে রয়েছে, অচ্যুতও তেমনই এই আকাশেরই নীচে কোথাও একটা রয়েছে।
‘রয়েছে’ তো এখনো?
নিশ্চয়ই রয়েছে। মনকে সাহস জোগাল দ্বারিকা। অচ্যুত তার বন্ধু, ভাবলেই গর্বে বুক ফুলে ওঠে এখন ওর। কালু কৈবর্তের গ্রাস থেকে পালানো মুখের কথা নয়।
আচ্ছা, অচ্যুত একবার কী একটা খাবারের নাম বলেছিল। আলো চালের মতো শুনতে। বলেছিল, যে কোনো তরকারিতে সেই সবজীটা নাকি দিয়ে খায় আধুনিক সমাজের মানুষরা। তাতে নাকি স্বাদই পালটে যায়। সেই সবজির চাষ এই বৈদিক সমাজে করা হয় না কেন?
আর অচ্যুত কী করে জানল? অচ্যুত কি তাহলে আগেও গিয়েছিল বাইরে? না শুনেছিল কারুর কাছে!
অচ্যুত কি এখন দিনরাত তাহলে ওই খাবারটা খাচ্ছে?
যতদিন যাচ্ছে, দ্বারিকারও বড় খেতে ইচ্ছা করছে। সমস্ত শৃঙ্খল ভয় সংকোচকে উপেক্ষা করে চলে যেতে ইচ্ছা করছে আধুনিক পৃথিবীতে, যেখানে গুরুদেবের মতে চলছে অকল্পনীয় অনাচার।
আধুনিক পৃথিবীতে না হয় অনাচার চলছে, কিন্তু ওদের এই সমাজে? এখানে যা চলছে, তা কি অনাচার নয়?
ওর পাশের বাড়ির বোন পুতুর বিয়ে দেওয়া হল বুড়ো গোপাল ব্যানার্জির সঙ্গে। তিন সতীনের সঙ্গে পুতু একমাথা সিঁদুর নিয়ে শুরু করেছে সংসার।
দশ বছরের মেয়ের সঙ্গে সহবাস কি বিকৃতি নয়? শুধুমাত্র বর্ণের প্রেক্ষিতে কাজ ভাগ করে দেওয়াটাও কি অন্যায় নয়? কে বলতে পারে, কালু কৈবর্তের ঘরে এমন কোনো ছেলে নেই, যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অসম্ভব মেধা? নিজের জাতের জন্য যে কোনোদিনই জানতে পারবে না নিজের প্রতিভা?
শিক্ষা বা অন্যান্য অধিকার জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য হবে না কেন?
দ্বারিকা বেশ বুঝতে পারে, ও ধীরে ধীরে অচ্যুতের মতো হয়ে যাচ্ছে। আগে যেমন অন্ধভাবে সবকিছু মেনে নিত, বিনা প্রশ্নে পালন করত অনুশাসন, এখন যেন তা হচ্ছে না। জলের মধ্যে বড় মাছ যেমন ঘাই মারে, সেভাবেই মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে হাজারো প্রশ্ন।
যেমন সেদিন। যদুহরি ঘোষালের বিধবা স্ত্রী সেই ক্ষমা বলে মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল গ্রামে। গোটা গ্রাম বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদুহরি ঘোষালের ভাই কেষ্টহরি ঘোষালের ছেলেরা সেদিন সদর্পে বলছিল, ক্ষমার মা’কে নাকি হত্যা করা হয়েছে। মা হয়ে শ্মশানঘাট থেকে সতী হতে যাওয়া মেয়েকে নিয়ে পালানোর মতো জঘন্য পাপ যে করে, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ব্রজেন্দ্রদাদার মতোই।
ক্ষমা মেয়েটা পুরোপুরি পালটে গিয়েছে। এখন শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। সাদা থান পরে। একবেলা খায়। ওর অত সুন্দর মেঘের মতো চুল নাকি কেটে দেওয়া হয়েছে। দ্বারিকার মা একদিন ভারী মুখে বলছিলেন।
যদুহরি ঘোষালের ভাই কেষ্টহরি ঘোষালের ছেলেরা সম্পর্কে জ্যাঠাইমা ক্ষমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তারা নাকি উঠে বসতে লাঞ্ছনা গঞ্জনায় অতিষ্ঠ করে তুলছে বাচ্চা মেয়েটিকে। যে বিধবা স্বামীর সঙ্গে সহমরণে না গিয়ে পালায়, সে তো মহাপাপিষ্ঠা! তাকে ঘরে আশ্রয় দেওয়া মানে সংসারেরও অকল্যাণ। এমনকী ক্ষমার জন্মদাতা পিতা থাকোগোপালেরও তাই মত।
পরম গুরু জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন নাকি ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। তাঁর লেখা বইয়ের রীতিনীতিই নাকি অনুসরণ করা হয় বৈদিক সমাজে। অন্তত বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্ররা তাই বলেন।
কিন্তু দ্বারিকার বিশ্বাস হয় না। সত্যিই কি পরম গুরু ওইসব লিখে গিয়েছিলেন? সত্যিই কি তাঁর লেখা গ্রন্থে ছিল স্বামীর প্রয়াণে স্ত্রীর সহমৃতা হওয়ার নির্দেশ?
এইবছরের মহোৎসবের দিন এগিয়ে আসছে দ্রুত। আর যত এগিয়ে আসছে, ওদের সমাজের প্রতিটি লোক যেন কেমন পালটে যাচ্ছে, লক্ষ্য করেছে দ্বারিকা। ওদের গ্রামের পুরুষদের মধ্যে থেকে বেশ কিছুজন করে একসঙ্গে উধাও হয়ে যাচ্ছে। ঘোষালবাড়ির তিন ছেলে, বাগচি বাড়ির চার ছেলেকে প্রায় দুইসপ্তাহ হয়ে গেল দেখেনি ও।
কী চলছে এখানে?
হঠাৎ একটা কর্কশ ডাকে দ্বারিকা চমকে পেছনে তাকাল। দেখল, দুজন বল্লমধারী প্রহরী ডাকছে তাকে। যেতে বলছে নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে।
বিনাবাক্যবয়ে তাদের অনুসরণ করে নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে গেল দ্বারিকা। গিয়ে অবাক হয়ে গেল। ওদের শ্রেণীর সব ছাত্র তো বটেই, বাকি শ্রেণীরও সব ছাত্র সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে চাতালের সামনে। সব মিলিয়ে প্রায় সত্তরজন।
ওকে সেই সারিতে ঢুকিয়ে দিয়েই ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে গেল দুই প্রহরী। দ্বারিকা এগিয়ে গিয়ে বনমালীকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হচ্ছে ভায়া?”
বনমালী তার স্বভাবসুলভ দাম্ভিক স্বরে উত্তর দিল, “তুই অ্যাদ্দিন কোন গর্তে ঢুকে বসেছিলি দ্বারিকা? জানিস না, কাল বাদে পরশু মাহেন্দ্রমহোৎসব?”
“মহোৎসব জানি।” দ্বারিকা কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু শব্দটা যে ও আগে কোথাও শুনেছে সেটা মনে করতে পারল। বলল, “মাহেন্দ্রমহোৎসব কী?”
বনমালীর পাশ থেকে ব্যাঙ্গের সুরে হাসল রাখহরি, “কী ব্যাপার বল তো? তোর প্রাণসখার প্রাণবায়ু ফুরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দেখছি, তুই যাও বা বেগুন ছিলি, এখনো একেবারে কানা বেগুন হয়ে উঠেছিস দ্বারিকা! গত চার পাঁচদিন তো মুখও দেখাসনি চতুষ্পাঠীতে!”
রাখহরির কথায় বনমালী তো বটেই, আশপাশের আরও দু-তিনটে ছেলে হেসে উঠল।
রাগে দ্বারিকার নাকের পাটা ফুলে উঠল। এরা সবাই ভেবেছে অচ্যুত মরে গিয়েছে। কিন্তু ও একেবারে নিশ্চিত, অচ্যুত বেঁচে রয়েছে। বেঁচে রয়েছে গুরুদেবের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে। জানাজানি হলে তা গুরুদেবের অপমান তো বটেই। তাই প্রচার করে দেওয়া হয়েছে, অচ্যুত মরে গেছে।
উহ! কী নিষ্ঠুর এরা!
দ্বারিকা সারির একেবারে পিছনে চলে গেল। আপাত নিরীহ গোছের এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার রে? আমি তো ক’দিন আসতে পারিনি, তাই জানি না।”
ছাত্রটির নাম শ্রীহরি। চতুষ্পাঠীতে তার খ্যাতি মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী হিসেবে।
শ্রীহরি গড়গড় করে যান্ত্রিকভাবে বলে গেল, “আমাদের বৈদিক সমাজের সবচেয়ে বড় কর্মকাণ্ডের দিন এই মাহেন্দ্রমহোৎসব। ওই দিনেই গুরুদেব আবির্ভূত হবেন কল্কি অবতার রূপে। গুরুদেবের মধ্যে সেদিন প্রকট হবেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, পরম গুরু ও প্রথম গুরু তিনজনেই। আর আমরা সবাই তাঁর হয়ে লড়াই করবো যুদ্ধক্ষেত্রে।”
শ্রীকৃষ্ণ (ভগবান বিষ্ণু�)
।
পরম গুরু (জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন)
।
প্রথম গুরু
।
বর্তমান গুরুদেব (কল্কি অবতার)
“যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই? মানে?” দ্বারিকা কিছু বুঝতে পারল না। কল্কি অবতার? অর্থাৎ যে অবতারের এখনো মর্ত্যে আগমন হয়নি?
দ্বারিকা দ্রুত রোমন্থন করতে চেষ্টা করছিল কিছুদিন আগে চতুষ্পাঠীতে বলা গুরুদেবের কথাগুলো।
“সত্যযুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন চারজন অবতার। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ। ভালো করে লক্ষ করো, কীভাবে পৃথিবীর বিবর্তনের ক্রমবিকাশ মূর্ত করে তুলেছেন অবতাররা। প্রথম যখন পৃথিবী সৃষ্টি হয়, তার তিনভাগ জল ও একভাগ স্থলে প্রথম আবির্ভাব ঘটে জলচর প্রাণী মৎস্যের। তারপর জল ও স্থল, দুই স্থানেই প্রাণীর বসবাস শুরু হয়। তাই পরবর্তী অবতার কূর্ম অর্থাৎ কচ্ছপ। উভচর প্রাণী। তৃতীয় অবতার বরাহ, অর্থাৎ শূকর। তার মতোই জগতের প্রাণীরাও প্রধানত স্থলেই বসবাস করতে শেখে। সত্য যুগের চতুর্থ ও শেষ অবতার ছিলেন নৃসিংহ। পশু ও মানুষের সংমিশ্রণ। মানবজাতির পূর্বতন অবস্থাও ছিল পশুসুলভই। তখনো মানবদেহ পুরোপুরি পূর্ণতা পায়নি।”
“ত্রেতাযুগে প্রথমেই এলেন বামন। অর্থাৎ মানুষের ক্ষুদ্র বিকাশ। এরপর পরশুরাম। মানুষের আদিম পর্যায়। অরণ্যচারী মানুষ। এরপর রাম। সমাজ বিকাশের প্রথম উন্নত পর্যায়। সমাজ, গোষ্ঠী, রাজা, প্রজা ইত্যাদি। এরপর দ্বাপর যুগে অষ্টম অবতার কৃষ্ণ নিজরূপে অবতীর্ণ হয়ে নিয়ে এলেন রাজনীতি। নবম অবতার বলরাম জ্ঞানী মানুষের প্রতীক। অবশেষে কলি যুগের একেবারে অন্তিমে আগমন ঘটবে কল্কি অবতারের। যার মধ্যে আধারিত থাকবে এমন এক প্রচণ্ড শক্তি যা হবে একইসঙ্গে ধ্বংস ও সৃষ্টির ধারক ও বাহক। শেষ হবে কলিযুগ। শুরু হবে আবার সত্যযুগ।”
দ্বারিকার স্পষ্ট মনে পড়ছে গুরুদেবের সেদিনের বলা কথাগুলো। মনে পড়ছে, এরপরই বনমালী উঠে প্রশ্ন করেছিল, “কিন্তু আমরা তাঁকে কীভাবে চিনতে পারব, গুরুদেব?”
গুরুদেব তখন স্মিতমুখে বলেছিলেন, “ভাগবত পুরাণে স্পষ্ট লেখা রয়েছে। কলিযুগের অন্তিম ও সত্যযুগের প্রারম্ভের সন্ধিক্ষণে জন্ম নেবেন শ্রীকৃষ্ণের শেষ অবতার কল্কি। ওইসময় পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শাসক আসক্ত হবে অসততায়, শাসকরাই অধঃপতিত হয়ে নেমে আসবে সাধারণ ডাকাতের পর্যায়ে।
“গোটা পৃথিবী জুড়ে চলবে হত্যালীলা, দরিদ্র, নারী ও শিশুর প্রতি অকল্পনীয় অত্যাচার। সাধারণ মানুষের দুঃখ শোক ও ক্লেশের কোনো সীমা থাকবে না। দুষ্টরা হয়ে উঠবে দেশের রাজা, সৎরা হবে নির্যাতিত।
“কল্কি অবতার তখন আসবেন তাঁর বাহন পক্ষীরাজ দেবদত্তয় উড্ডীন হয়ে। তিনি সবাইকে বিনাশ করবেন। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে ধ্বংস হবে সবকিছু। সত্যযুগের পুনরারম্ভে বেঁচে থাকবে খুব কম সংখ্যক লোক, যারা সৎ ও ধার্মিক।”
দ্বারিকার মাথা ঝিমঝিম করছিল। ওদের এই বৈদিক সমাজের মুখ্য ব্যক্তি গুরুদেব নিজেই কল্কি অবতার? তিনি নিজে বিনাশ করবেন পৃথিবীর সব খারাপ মানুষদের? কলিযুগের অবসান ঘটিয়ে শুরু হবে সত্যযুগ?
তাহলে ওরা কে? কেনই বা এইভাবে জমায়েত হয়েছে সবাই ক্রীড়াঙ্গনে?
ও ফিসফিস করে শ্রীহরিকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন কোথায় যাব রে?”
শ্রীহরি চোখ বন্ধ করে বলল, “সেই অভিশপ্ত পুণ্যধামে, যেখানে চলে যথেচ্ছ পাপলীলা। যেখানে কৃষ্ণের উপাসনা হলেও নিরন্তর চলে আধুনিক সভ্যতার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।”
৩২
জ্যোৎস্নাদি নিভে যাওয়া মুখে বলল, “এমা! আমি এত তরিবৎ করে বানালাম, দিদিমণি খাবে না?”
“না।” প্রিয়ম আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়িতে রাত পৌনে বারোটা। অফিস থেকে এসে রুদ্র একতলায় লাইব্রেরি ঘরে ঢুকেছে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। তারপর থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
জয়ন্ত আর ড্রাইভার পাঁচু এসেছিল চাবি রাখতে। বলছিল, আজ সারাদিন নাকি রুদ্র ত্রিবেণী থেকে বৈদ্যবাটী, চন্দননগর থেকে আদিসপ্তগ্রাম ছুটে বেরিয়েছে। এই থানা থেকে অমুক স্টাফকে তুলেছে, ওই থানা থেকে তমুক স্টাফকে। নানা জায়গায় ঘুরেছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়াই করেনি। শুকনো কিছু ফল খেয়ে কাটিয়েছে।
প্রিয়ম তাই তারপর থেকে আর বিরক্ত করেনি। ও বুঝতে পারছিল, এই কেসটা সলভ করা রুদ্রর কেরিয়ারের জন্য কতটা প্রয়োজন। এখন মিডিয়াগুলো রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। প্রতি মাসে যদি এই অদ্ভুত হত্যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে, সেটা রুদ্রর জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের।
আর গোটা বিষয়টা এত জটিল হয়ে উঠেছে যে রুদ্রকে একা থেকে নিজের মতো ভাবতে দেওয়াটা খুবই দরকার।
প্রিয়ম একটা পুরোনো ইংরেজি সিনেমা দেখছিল। ষাটের দশকের এই অ্যাকশনধর্মী ছবির প্রেক্ষাপট অবশ্য অষ্টাদশ শতকের ব্রিটেন। ওর প্রিয় অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো রয়েছেন মুখ্য ভূমিকায়। ওদের দুজনেরই একটা শখ হল পুরোনো ছবি দেখা। বিশেষত ঐতিহাসিক ঘরানায়। পুরোনো দিনের পটভূমিকায় সিনেমা দেখতে দেখতে তখনকার মানুষদের চালচলন সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা যায়। টাইম ট্রাভেল করছে ভেবে রোমাঞ্চ জাগে বেশ।
আজ অবশ্যি সিনেমাটা দেখতে দেখতে প্রিয়মের বারবার মনে পড়ছিল গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমীশ সম্প্রদায়ের কথা।
কী অদ্ভুত! এই সিনেমায় ও যেরকম পোশাক পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রা দেখছে, তা যে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বেও কেউ বা কারা একইরকম রেখেছে, ভাবলেই অবাক লাগে।
জ্যোৎস্নাদি বলল, “তাহলে আপনি খেয়ে নিন এবার?”
প্রিয়ম ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে বলল, “আমিও খাব না। তুমি খেয়ে নাও। খেয়ে শুয়ে পড়ো।”
জ্যোৎস্নাদি ছাড়ার পাত্রী নয়। সে বকে যেতে লাগল, “কোনো মানে হয়? এত ভালো করে রাঁধলুম, আর দুজনেই খাবে না? আবার বলে কিনা, তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো। আরে আপনারা খেলেন না, আর আমি খেয়ে শুয়ে পড়ব? জ্যোৎস্না সরখেল কি অমানুষ নাকি?”
জ্যোৎস্নাদি বহুবছর হল এই এ এস পি বাংলোয় কাজ করছে। অনেক এ এস পি গেছেন এসেছেন, কিন্তু রুদ্রর মতো আন্তরিকভাবে কেউ মেশেনি বলেই বোধ হয় ও-ও নিজের বাড়ির মতোই এতদিনে ভাবতে শুরু করেছে এই বাংলোটাকে।
প্রিয়ম একটু বিরক্ত হয়ে কী বলতে যাচ্ছিল, ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকল রুদ্র। মুখচোখ বিধ্বস্ত, চুল উসকোখুসকো।
ঘরে ঢুকে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল, “তোমার ডিনার হয়ে গেছে?”
“না।” প্রিয়ম বলল, “আমি ভাবছিলাম, তুমি কখন বেরোবে, তাই …।”
“তাহলে জ্যোৎস্নাদি, জলদি খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে। রাতও হয়েছে অনেক।”
জ্যোৎস্নাদি’র মুখটা এবার ঝলমল করে উঠল। সে দ্রুত পায়ে ছুট লাগাল রান্নাঘরের দিকে।
রুদ্র একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সোফায় বসতেই প্রিয়ম বলল, “কি? কিছু ক্লিয়ার হল?”
“অনেককিছু ভাবার অবকাশ পেলাম। এস পি স্যারকে ফোন করছি বারবার বলব বলে, কিন্তু স্যারের ফোন বন্ধ।” রুদ্র ওর হাউজকোটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। তারপর বলল, “তুমি শুনবে?”
“বলো। ক্ষতি কী?”
“পয়েন্ট ওয়াইজ পড়ছি শোনো।
“একনম্বর। প্রথম খুন হয়েছিল ত্রিবেণীর সাইবার ক্যাফের মালিক শিবনাথ বিশ্বাস (৩৮)। লোকাল থানা প্রথমে স্ত্রী আরতি ও পাড়ার এক ছেলে রাজুকে প্রেমঘটিত কারণে সন্দেহ করলেও কোনো প্রুফ নেই। আজ রাজুকে ত্রিবেণী গিয়ে আমি নিজে ইন্টারোগেট করে এসেছি। সে জানিয়েছে, সম্প্রতি শিবনাথের এক নতুন বন্ধু হয়েছিল। নাম শ্যামসুন্দর। শিবনাথেরই বয়সি। কোথায় থাকত বা কী করত, রাজু কিছুই জানেনা। কিন্তু মাঝে দু’বার ওদিক দিয়ে যেতে গিয়ে শিবনাথের দোকানে দেখা করেছিল, দু’বারই দেখেছিল, শ্যামসুন্দর বসে আছে। শিবনাথই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। লোকটা নাকি বাইরে কাজ করে, ছুটিতে ত্রিবেণী এসেছে। যদিও কী কাজ, রাজু জানে না।”
“হুম!” প্রিয়ম বলল, “তার মানে এখানেও উটকো একটা লোকের সন্ধান পাওয়া গেল অ্যাট লাস্ট!”
“তার থেকেও বড় আরেকটা তথ্য জানতে পেরেছি প্রিয়ম।” রুদ্র বলল, “রাজুর কাছ থেকে ফেরার সময় আমি আবার গিয়েছিলাম শিবনাথের বাড়ি। আমার আগেরবার একটা সামান্য খটকা লেগেছিল, যখন শিবনাথ বিশ্বাসের টেবিলে ওর বাবা-মায়ের ছবি দেখেছিলাম।”
“কী খটকা?”
“শিবনাথের ছবি দেখেছি, গায়ের রং খুবই ফর্সা। কিন্তু ওর বাবা-মা খুব কালো।”
“তো?” প্রিয়ম ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তাতে কী হয়েছে? হয়তো শিবনাথ ওর দাদু বা ঠাকুমা-দিদিমার গায়ের রং পেয়েছে। মেন্ডেলের বংশগতির সেই প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য তো পড়েছিলে নাকি!”
রুদ্র বলল, “পড়লেও এক্ষেত্রে আমার খটকাটাই সত্যি হয়েছে, প্রিয়ম। শিবনাথের স্ত্রী আরতি জিজ্ঞাসাবাদে আমায় জানিয়েছে, শিবনাথকে ছোট বেলায় গঙ্গার ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন ওর বাবা। তাঁদের নিজেদের কোনো সন্তান ছিল না, তাই শিবনাথকেই মানুষ করেছিলেন ছেলের মতো। তখন শিবনাথের দশ-বারো বছর বয়স।
“দু’নম্বর, চন্দননগরের মহম্মদ তারেক। তার আসল পরিচয় কেউ জানে না। বদনপুর গ্রামের পল্টু এবং কানু চক্রবর্তীর কথা অনুযায়ী সে এসেছিল কোনো অন্য জায়গা থেকে। মন্দিরে পুজো করত, অর্থাৎ সে ছিল হিন্দু। কিছুদিন থেকে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। নতুন জীবন শুরু করে চন্দননগর রেলস্টেশনের গায়ে। নতুন নাম নেয়, মহম্মদ তারেক। অর্থাৎ মুসলমান। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন? কেন তাঁকে এইভাবে নিজের পরিচয় পুরোপুরি পালটে ফেলতে হল?”
প্রিয়ম বলল, “নিশ্চয়ই সে কারুর থেকে লুকনোর চেষ্টা করছিল।”
রুদ্র বলল, “হ্যাঁ। এটা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না। আরেকটা ব্যাপার, ঠিক তারেকেরই মতো আরেকজন ছেলে এখন কানু চক্রবর্তীর কাছে রয়েছে, যার সম্বন্ধেও গ্রামের মানুষ পুরো অন্ধকারে। এখানে তাহলে আরেকটা প্রশ্ন হল, কানু চক্রবর্তীর কাছেই এরা আসে কেন? আর কানু চক্রবর্তী বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ছিল কৃষ্ণভক্ত, ফিরে এসে শৈব হয়ে গেল কি করে? মাঝের কয়েকটা বছরই বা সে কোথায় ছিল? সে যখন বদনপুর গ্রামে ফিরে এল, তার সঙ্গী বন্ধুটি কোথায় গেল?”
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, “কানু চক্রবর্তীর ব্যাপারটার সঙ্গে কি এই সিরিয়াল কিলিং এর আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে? লোকটা হয়তো এমনিই ক্ষ্যাপা প্রকৃতির। তুমিই তো বললে!”
রুদ্র উত্তর দিল না। বলল, “তিন নম্বর খুনের ঘটনায় আসি। পরের কৃষ্ণপক্ষে খুন হল বৈদ্যবাটির চশমাব্যবসায়ী সুনীল ধাড়া। বছরখানেক আগে তার দোকানে কয়েকদিনের জন্য কর্মচারী ছিল বলরাম। তাকে কাজে ঢুকিয়েছিল কে, কিছুতেই জানা যায়নি।
“পাঁচ নম্বর খুন স্বপন সরকার, তার খুন হওয়ার আগে নতুন ঢুকেছিল গোবিন্দ। ছ’নম্বর খুন ব্রিজেশ তিওয়ারি, তার কাছে কিছুদিনের জন্য কাজ করেছিল কানাই। আমি আজ এই প্রত্যেকের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে গিয়ে নিজে কথা বলেছি। সুনীল ধাড়ার বাড়ির লোক বা স্বপন সরকারের অন্যান্য সাঙ্গোপাঙ্গোরা প্রত্যেকেই জানিয়েছে, বলরাম আর গোবিন্দ দেখতে আলাদা হলেও দুজনেই ছিল পরিশ্রমী। কারেন্ট বা ওই জাতীয় জিনিসকে খুব ভয় পেত। পুজোআচ্চা করত। মানে ব্রিজেশ তিওয়ারির কাছে কিছুদিন কাজ করা কানাইয়ের ব্যাপারে ভট্টাচার্য বাড়ির মধুময়বাবু যা বলেছিলেন, সব মিলে যায়।”
৩৩
প্রিয়ম বলল, “চার নম্বর খুনটা বাদ দিয়ে গেলে তো!”
রুদ্র বলল, “বাদ দিইনি। চার নম্বর হৃষীকেশ জয়সোয়ালকে নিয়ে স্বপন সরকার গিয়েছিল বাগডাঙার সরলাশ্রমে। সেখানে দুজনের সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় কানাইয়ের ছবি আছে।”
প্রিয়ম গভীরভাবে চিন্তা করছিল, “অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, এই কানাই, বলরাম, গোবিন্দ, এরা একই গ্রুপের লোক। এবং এরা কোনো না কোনোভাবে তর্কপঞ্চাননের বংশের সেই দত্তক নেওয়া লোকটার সঙ্গে যুক্ত।”
রুদ্র বলল, “শুধু তাই নয়। শুভাশিসবাবু বলেছিলেন, তাঁদের সেই নকলদাদু আমেরিকায় আমীশদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর নাম গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। তিনি ভারতে ফিরে এসেছিলেন, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমেরিকায় যে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন, তেমনও কোনো হদিশ নেই। উনি আমেরিকার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করতেন, আমি সেখানেও খোঁজ নিয়েছি। কোর্স কমপ্লিট করার পর আর কোনো আপডেট ইউনিভার্সিটির কাছে নেই। কলকাতার ইউ এস এমব্যাসির কাছে পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে ট্র্যাক করতেও পাঠিয়েছি। এটা খুবই সম্ভব যে, এই বাংলারই কোথাও সেই আমীশ সম্প্রদায় এখনো রয়েছে, যেখান থেকে আধুনিক পৃথিবীতে পালিয়ে আসার অপরাধে মল্লিকাদি’কে খুন হতে হয়েছে।”
“খুন হতে হয়েছে কেন?” প্রিয়ম ভ্রূ কুঁচকল।
রুদ্র বলল, “যদি তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায়, তবে সেখান থেকে যারা পালাবে, তাদের তারা মুখ বন্ধ করতে খুন করতেই পারে। মল্লিকাদিকে বিষ মাখানো তির ছোঁড়াটাও আমীশদের দিকেই ইঙ্গিত করছে। এইদিক দিয়ে চিন্তা করলে একইভাবে জাস্টিফাই করা যায় ছোটবেলায় পালিয়ে আসা শিবনাথ বা কয়েকবছর আগে পালিয়ে আসা আইডেন্টিটি পুরো বদলে ফেলা মহম্মদ তারেকের খুনকেও।”
“তাহলে ক্ষমাকেও ওরকম কিছু না করে ধরে নিয়ে যাওয়া হল কেন?”
রুদ্র এবার চুপ করে রইল। তারপর বিড়বিড় করতে লাগল, “ক্ষমা ভয় পেত ওর ভাশুরপো নাকি ওকে ধরে নিয়ে যাবে। ভাশুরপো ধরে নিয়ে যাবে কেন? তার মানে ক্ষমা শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছে। কিন্তু কেন পালিয়েছে?”
প্রিয়ম বলল, “ক্ষমা যদি বিবাহিতই হয়ে থাকে, তাহলে ওর মাথায় সিঁদুর বা হাতে শাঁখাপলা কিছু ছিল না কেন? পুরনো দিনের মতো জীবনযাপন করলে সেগুলো থাকা উচিত ছিল।”
“হয়তো সেগুলো আগেই মুছে ফেলেছিল।” রুদ্র একটু ভেবে বলল, “তুমি আর আমি ভোরবেলা বাংলোর বাইরে যখন ওদের রেসকিউ করি, তখন বেশ ঠান্ডা ছিল। দুজনেই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল।”
প্রিয়ম বলল, “তোমার যুক্তি যদি মেনেও নিই, সেখানেও অনেকগুলো কোয়েশ্চেন অ্যারাইজ করছে। শিবনাথ আর তারেক ছাড়া বাকিরা অন্য কোথাও থেকে আসেনি। সবাই নিজেদের বাড়িতেই জন্মেছে, বড় হয়েছে। রাইট? তবে তাদের মারা হল কেন?”
রুদ্র বলল, “এমনিতে তো এরা সবাই এমন এমন পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যেগুলো ওই আমীশ সম্প্রদায়ের চোখে পাপ। শিবনাথ আর তারেক ওখান থেকে এসে হয়ত কাকতালীয়ভাবেই সাইবার ক্যাফে আর মোবাইল রিচার্জের ব্যবসা শুরু করে। তাতে তারা আমীশ সমাজের কাছে আরও বেশি করে অপরাধী হয়ে ওঠে। তাই ওদের দোকানও ভাঙচুর করা হয়েছে। আর সুনীল ধাড়ার চশমার দোকান। যার যা স্বাভাবিক আয়ু বা কোনো রোগজনিত যন্ত্রণাভোগ, সেটাকে চশমা বা কৃত্রিম কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে লঙ্ঘন করাটা আমীশ সমাজের কাছে অপরাধ।”
“সে তো হাজার হাজার চশমার দোকান আছে, গুচ্ছের নার্সিং হোম আছে। ওই আমীশ ব্যাটারা সুনীল ধাড়া আর ড. সুবল ভট্টাচার্যকেই টার্গেট করল কেন?” প্রিয়ম বুলেটের মত পরপর প্রশ্ন ছুঁড়ে যাচ্ছিল।
রুদ্র বিব্রত মুখে বলল, “সেটার উত্তর আমি এখনো পাইনি প্রিয়ম। আমীশ সমাজ বাংলায় কোথাও লুকিয়ে থাকলেও তাদের প্রতিনিধি নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে আধুনিক জগতে আসে। তারা হয়তো কোনোভাবে এইসব লোকগুলোর সঙ্গেই মিশেছে। সুনীল ধাড়ার দোকানের স্থায়ী কর্মচারী দানু জানিয়েছে, সে একবার লম্বা ছুটি নিয়েছিল, তখনই বলরামকে দোকানে রাখা হয়।”
প্রিয়ম না মানার ভঙ্গিতে দু’পাশে মাথা নাড়াল, “তোমার মোটিভ একদমই কনভিন্সিং লাগছে না। যাইহোক, তারপর বলো।”
রুদ্রর মুখটা নিভে গেল। ম্লান গলায় ও বলল, “নেক্সট হল বাগডাঙ্গার সরলাশ্রম। ওই আশ্রমের সঙ্গে আমীশ সমাজের ডেফিনিটলি কোন সরাসরি যোগাযোগ আছে। হয়ত ওই আশ্রমের মধ্যে দিয়েই বাংলার ওই আমীশ সম্প্রদায় আধুনিক জগতের সঙ্গে কানেকশন রাখে।”
প্রিয়ম বলল, “এটা আবার কোথা থেকে ইনফার করলে? শুধু ওই আশ্রমে তর্কপঞ্চাননের বই দেখে?”
“না।” রুদ্র বলল, “বাগডাঙা সরলাশ্রমে যে মহারাজের ছবি রয়েছে, তাঁর নামও গোপালকৃষ্ণ মহারাজ। এটাও তো হতে পারে, শুভাশিসবাবুর নকলদাদুই ওখানে ওই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর পাঁচনম্বর যিনি খুন হয়েছেন, সেই স্বপন সরকার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন ওই সরলাশ্রমের সঙ্গে। হৃষীকেশ আগরওয়ালকেও তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন। গোবিন্দ বলে ছেলেটা ছিল তাঁর সহকারী। হতেই পারে যে স্বপন সরকারকে মারার জন্যই জড়ানো হয়েছিল সরলাশ্রমের সঙ্গে। যেহেতু তিনিও আধুনিক সভ্যতার অনিবার্য অঙ্গ গাড়ির ব্যবসা করেন। হৃষীকেশ আগরওয়ালও তাই। প্রোমোটারি।”
প্রিয়ম অদ্ভুত মুখব্যাদান করে বলল, “মারুতি, টাটা এইসব কোম্পানিকে ছেড়ে তোমার এই বাঙালী আমীশদের এত ছেঁদো দিকে নজর কেন সেটাই বুঝতে পারছিনা। যাইহোক, বাকি দুজন?”
রুদ্র অপ্রতিভ মুখে বলল, “ব্রিজেশ তেওয়ারি তো খোদ তর্কপঞ্চাননের বাড়িতেই ইনভার্টারের দোকান করেছিল। ওকে মারবে না? আর সুবল ভট্টাচার্য ডাক্তার, মানে রুগিকে বাঁচিয়ে …।”
“বুঝেছি বুঝেছি।” প্রিয়ম হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিল। জোর গলায় বলল, “ভাবো ভাবো। এগুলো একটাও আমার ঠিকঠাক লাগছে না। হয়তো তুমি ঠিক দিকেই এগোচ্ছ, নাহলে এতগুলো ঘটনা সেইম ডিরেকশনে ওভারল্যাপ করত না। কিন্তু আরও জোরালো মোটিভ আছে পেছনে। আগে বুঝতে হবে আমীশ সমাজের উদ্দেশ্যটা কী। কীভাবেই বা তুমি ধরে নিচ্ছ, বাগডাঙার ওই আশ্রম দিয়ে ওরা কানেকশন রাখে এদিকের সঙ্গে?”
রুদ্র বলল, “সেটা বুঝলাম আশ্রমটার ভৌগোলিক অবস্থান দেখে। অফিস থেকে হুগলীর ডিটেইলড ম্যাপ চেয়ে আনলাম পাঁচুকে দিয়ে। আশ্রমের একেবারে সামনে দিয়ে যে সরু নদীটা বয়ে গিয়েছে, সেটা আসলে খাল। খালের অন্যদিকে কিছুদিন উজানে গেলেই বদনপুর। আর সেই খাল গিয়ে মিশেছে মৃতপ্রায় সরস্বতী নদীতে। আর সেই সরস্বতী নদী অনেকটা এঁকেবেঁকে গিয়ে পড়েছে গঙ্গায়, ত্রিবেণীর যাত্রাশুদি বলে একটা জায়গায়।”
“মানে?” প্রিয়মের ভ্রূ এবার কুঞ্চিত।
“মানেটা পরিষ্কার।” রুদ্র হাতে রোল করে পাকানো ম্যাপটা এবার বড় করে মেলে ধরল, “আমরা ভেবে মরছিলাম, শিবনাথের দোকানে যাওয়ার রাস্তায় সিসিটিভি ফুটেজে কাউকে দেখা যায়নি কেন। কারণটা আর কিছুই নয়, আততায়ী এসেছিল গঙ্গা দিয়ে, নৌকো করে। শিবনাথের দোকান গঙ্গার ধারেই। শুধু শিবনাথ নয়, প্রতিটা খুনই এমনভাবে হয়েছে, যেখান থেকে নদীপথে পালানো খুব সহজ। হুগলীর এই পুরো অঞ্চলটার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে গঙ্গা। বা আরো নির্ভুল বলতে গেলে আমাদের হুগলী নদী। আমরা গঙ্গা বলি তাই, আসল নাম তো হুগলী।”
“তার মানে তুমি বলছ ওই বাংলা আমীশ সমাজ এই গঙ্গার ওপরেই কোথাও না কোথাও রয়েছে?” প্রিয়ম হুমড়ি খেয়ে পড়ে হুগলী জেলার ম্যাপটা দেখছিল।
“হতে পারে।” রুদ্র ম্যাপটার ওপর পেনসিল বোলাচ্ছিল, “আবার লক্ষ্য করে দ্যাখো, গঙ্গা থেকে মাঝে মাঝেই অনেক সরু সরু খাল বেরিয়েছে, যেগুলো অনেকদূর প্রবাহিত হয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়েছে। যেমন এই সরস্বতী নদীটা। কিংবা আরও একটু উত্তরে গেলে গঙ্গা নদীতে মুর্শিদাবাদ থেকে এসে মিশেছে জলঙ্গী নদী। কোথাও আবার গঙ্গা থেকে একটা সরু শাখা বেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে আবার গঙ্গাতেই মিশে গেছে। আমীশ সমাজ যেখানেই বাস করুক, নদীপথেই তারা যাতায়াত করে বাগডাঙা আশ্রম বা অন্য জায়গাগুলোয়। আর বদনপুর গ্রামটায় তারেক বা নতুন ছেলেটি পালিয়ে এসেছে কারণ নিশ্চয়ই সেটা জলপথে আমীশ সমাজ থেকে কাছে।”
“হুম।” প্রিয়ম বলল, “এইটা এতক্ষণে একটা সলিড পয়েন্ট বলেছ। এটা যদি হয়, তবে বেশ জটিল ব্যাপার। এবার কী করবে ভাবছ?”
রুদ্র বলল, “আপাতত বদনপুর গ্রামে একজন ইনফর্মার লাগিয়েছি। যে কানু চক্রবর্তী আর নদীর দিকটাকে ভালো করে অবজার্ভ করবে। একই জিনিস করেছি বাগডাঙা সরলাশ্রমে। আমি যখন গিয়েছিলাম আশ্রম ছিল ফাঁকা। নিশ্চয়ই তারা আবার আসবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে খবর পাব।”
প্রিয়ম বলল, “এত জটিলতার কী আছে? ওই কানু চক্রবর্তী আর ওই কী মহারাজ, তাদের থানায় তুলে এনে একটু কড়কালেই অনেক কিছু জানা যাবে।”
রুদ্র এবার জিভ দিয়ে আফশোসের আওয়াজ করে বলল, “সেটা করতে পারলে তো হয়েই যেত। কিন্তু এস পি রাধানাথ স্যারের স্ট্রিক্ট অর্ডার, শিবনাথ বিশ্বাসের কেসে ওই রাজুকে থানায় বারবার ডাকার জন্য লোকাল পার্টি থেকে অনেক ঝামেলা হয়েছে। কোনো প্রমাণ ছাড়া কাউকে যেন না কড়কানো হয়। তাই আপাতত এভিডেন্স জোগাড় করার জন্য ইনফর্মার ছাড়া আমার গতি নেই।”
“কিন্তু এইসব গ্রামগুলোয় তো একেবারেই কম লোকজন থাকে। বাইরের লোক দেখে যদি অ্যালার্ট হয়ে যায়?”
রুদ্র বলল, “প্রতিটা গ্রামেই পুলিশের কিছু নিজেদের লোক থাকে। আমরা তাদের বলি খোচর। এরা নিজেরা ছিঁচকে চুরি-টুরি করে। উপরি বকশিশের আশায় লোকাল থানায় ইনফর্মারের কাজও করে।”
“তাই বলো! সাধে কি লোকে বলে চোর আর পুলিশ একই গোত্রের?”
রুদ্র প্রিয়মের রসিকতায় অল্প হেসে বলল, “কিন্তু যতক্ষণ না আমি আমীশ সমাজের লোকেশনটা ট্র্যাক করতে পারছি, কিছুতেই বুঝতে পারছি না, ওদের পরবর্তী টার্গেট কে। আর এর শেষ কোথায়!”
৩৪
উপবীতধারী অতিথি একটি ছাত্রের পিছু পিছু এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, “আহ, আজ আমার চক্ষু সার্থক হল। দেশের জীবন্ত কিংবদন্তীকে নিজচোখে দেখার সৌভাগ্য হল। প্রণাম নেবেন, পণ্ডিতমশায়!”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন গড়গড়ায় তামাক সেবন করছিলেন। পাশে বসেছিলেন তাঁর বৈকালিক সঙ্গী বাসুদেব বাচস্পতি। অদূরেই তর্কপঞ্চাননের চতুষ্পাঠী সমাপনান্তে ছাত্ররা ফিরে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ছাত্রাবাসে। সম্প্রতি তাঁর চতুষ্পাঠীতে ছাত্রসংখ্যা এক হাজার অতিক্রম করেছে। তাঁর উঁচুশ্রেণীর ছাত্ররাই মূলত শিক্ষাদান করেন। তর্কপঞ্চানন নিজে পড়ান একেবারে বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রেণীকে। তবে চতুষ্পাঠীর ভাণ্ডারঘর থেকে রন্ধনশালা, ছাত্রাবাস থেকে অতিথিশালা, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ সংবাদ থাকে তাঁর নখদর্পণে। বয়স হয়েছে অনেক, কিন্তু তাঁর শরীরে বা মনে কোথাওই বার্ধক্যের কোনো চিহ্ন এখনো নেই।
“শুভমস্তু। আসন গ্রহণ করতে আজ্ঞা হোক।” জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন দক্ষিণ হস্ত তুলে আশীর্বাদ করলেন। তারপর পাশে দণ্ডায়মান ছাত্রটিকে কিছু মিষ্টান্ন নিয়ে আসার ইঙ্গিত করে বললেন, “আপনার পরিচয়?”
ব্রাহ্মণ তর্কপঞ্চাননের বিপরীতের চাটাইয়ে বসে পড়ে বললেন, “আমি এক সাধারণ ব্রাহ্মণ। আবাস বর্ধমানের কাটোয়া। শিক্ষা ও পেশা দুইয়েরই প্রয়োজনে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেছি। সঙ্গে আরবি, ফারসিও শিখেছি কর্মে অগ্রাধিকার পাওয়ার জন্য।”
“বাহ, অতি উত্তম।” তর্কপঞ্চানন বললেন, “তা আমার কাছে কী অভিপ্রায়ে আগমন?”
“আজ্ঞে আমি হিন্দু ধর্মে অতিশয় শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে একটি সংশয়ের ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হচ্ছি। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের আশায় ছুটে গিয়েছি নবদ্বীপেও। কিন্তু খ্যাতনামা বা অখ্যাত কোনো পণ্ডিতই আমার কৌতূহল নিরসন করতে পারেননি। তাঁরা কেউ কেউ দুরূহ সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছেন। আজ তাই ছুটে এসেছি ত্রিবেণীতে, সাক্ষাৎ জগন্নাথের কাছে। যদি তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর প্রাঞ্জলভাবে ব্যখ্যা করেন।” ব্রাহ্মণ করজোড়ে বলে চলেছিলেন।
বাসুদেব বাচস্পতি এবার তাঁর দীর্ঘ ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে বললেন, “অ্যাদ্দিনে ঠিক লোকের কাছে এসেছেন।”
জগন্নাথ জিজ্ঞাসা করলেন, “কী প্রশ্ন?”
“ঈশ্বর কী? ব্রহ্ম কী? তিনি কি এক না অনেক?”
এমন আকস্মিক প্রশ্নে বাসুদেব বাচস্পতি বিব্রত চোখে তাকালেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের দিকে। এই প্রকার স্পর্শকাতর বিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর অধিকাংশ পণ্ডিতই এড়িয়ে যান।
কিন্তু তর্কপঞ্চানন একটুও না ইতস্তত করে বললেন, “ঈশ্বর এক।”
ব্রাহ্মণ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তবে শিব কে? বিষ্ণুকে? গণেশ কে? শক্তি কে?”
“এঁরা সকলেই ঈশ্বরের প্রকারভেদ। নামহীন কায়াহীন ঈশ্বরের উপাসনা সহজ নয়। তাই কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। বস্তুত শিব, বিষ্ণু, গণেশ, কার্তিক সব একই।”
বাসুদেব বাচস্পতি অস্ফুটে বললেন, “এসব কী বলছ ভায়া! প্রকাশ্যে এ’সব বোলো না, তীব্র নিন্দার শিকার হবে।”
তর্কপঞ্চাননের কর্ণকুহরে কথাটা প্রবেশ করল বলে মনে হল না। তিনি নির্বিকার চিত্তে গড়গড়া টানতে লাগলেন।
ব্রাহ্মণ জিজ্ঞেস করলেন, “সকলে যদি অভিন্ন হন, তবে প্রত্যেকের পূজার ধরণ পৃথক কেন, পণ্ডিতমশাই? শিবঠাকুরকে পুজো করতে লাগে বেলপাতা, বিষ্ণুর জন্য তুলসীপাতা, আবার মা শক্তির জন্য রক্তজবা। কেন? যদি সকলেই এক হন, তবে এই ভিন্ন উপাচারের কারণ কী?”
তর্কপঞ্চানন এবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “একনটী যাত্রাপালা দেখেছেন কখনো?”
“হ্যাঁ।” ব্রাহ্মণ উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, “আমাদের গ্রামে গতবছরই এসেছিল। একটিই লোক প্রথমে মা যশোদা সেজে গান গাইল। তারপর কেষ্টঠাকুর সেজে দুটো পালা গাইল। সবশেষে সাজল নারদ। আহা! খাসা করেছিল।”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বললেন, “সেই লোকটি আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য কখনো বাউটি, মল, চেলি পরে যশোদা সাজল, কখনো পাকা দাড়ি লাগিয়ে নারদ কিংবা বাঁশি হাতে কৃষ্ণ হল। ঈশ্বরও তাই। আমরা মানুষরা নিজেদের সন্তোষের জন্য ঈশ্বরকে নানা বেশ ধারণ করাই। কখনো জবা-মাংসে কালী আরাধনা করি, কখনো বেল ধুতরোয় ভোলানাথকে। আর কিছু নয়। সব আসলে একই জায়গায় যায়।”
ব্রাহ্মণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বোধ হয় নিজের যুক্তির যন্ত্রে যাচাই করে নিতে চাইলেন পণ্ডিতশ্রেষ্ঠর মতবাদ। সংকোচের সঙ্গে বললেন, “আর মোছলমানদের আল্লা বা ফিরিঙ্গিদের খ্রিস্টান?”
বাসুদেব বাচস্পতি শিহরিত চোখে তাকালেন, কিন্তু তর্কপঞ্চানন নির্বিকার। গড়গড়া টানতে টানতে সহাস্যে বললেন, “বললাম তো, সব আসলে একই জায়গায় যায়। কেষ্ট আর খ্রিস্ট, আল্লা আর কমলা একই। সব আমাদের মনের সন্তুষ্টির জন্য। আমরাই গড়েছি এদের।”
“তবে এই পুজো আচ্চা, যজ্ঞ, উপাচার?”
তর্কপঞ্চানন বললেন, “বেদে যেমন স্থূল দ্রব্যযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে, আলোচিত হয়েছে প্রতীকী যজ্ঞও। যজ্ঞ না পুজো যেমন বাইরের উপাচার দিয়ে হয়, তেমনই হয় অন্তরের ভাব দিয়েও। কৌষিতকী আরণ্যক স্মরণ করুন।
”শ্রদ্ধা পয়ো বাক্ সমিৎ।
সত্যম্ আহুতিঃ প্রজ্ঞাত্মা স রসোঃ।
শ্রদ্ধাই দুগ্ধ, বাক্যই সমিৎ, সত্যই আহুতি, প্রজ্ঞাই আত্মা। এগুলো থাকলে আর কিচ্ছু লাগে না যে!”
ব্রাহ্মণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। বললেন, “সাধু! সাধু! ধন্য জগন্নাথ পণ্ডিত! এইজন্যই বলে, ত্রিবেণীতে সাক্ষাৎ মা সরস্বতীর বাস! এমন সহজভাবে কেউ তো বুঝিয়ে দেয়নি!”
তর্কপঞ্চানন এবার অট্টহাস্য করে বললেন, “তা ত্রিবেণীতে সরস্বতীর বাস তো বটেই, সরস্বতী নদী তো ত্রিবেণী দিয়েই বয়ে গিয়েছে!”
“সরস্বতী তো এখন মৃতপ্রায় পণ্ডিতমশাই।” ব্রাহ্মণ বললেন, “সপ্তগ্রাম বন্দর তো ওইজন্যই বন্ধ হল। এখন আসল নদী হল গিয়ে আমাদের গঙ্গা। উত্তরে আপনাদের এই ত্রিবেণী, গুপ্তিপাড়া, অগ্রদ্বীপ, নবদ্বীপ, খাগড়াঘাট, মুর্শিদাবাদ হয়ে পাটনা, কাশী। আর দক্ষিণে তো ফিরিঙ্গিদের নতুন বন্দর কলকাতা। কত হাজার হাজার মণের বাণিজ্য চলে এই পথে! দিবারাত্রি মহাজনী নৌকোর সারি।”
তর্কপঞ্চানন বললেন, “মৃতপ্রায় আপাতদৃষ্টিতে। সরস্বতী অনন্তসলিলা। ঋগ্বেদেও এই নদীর উল্লেখ রয়েছে। যদিও তা অন্য নদী। যাইহোক, পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। আবার আসবেন।”
ইতিমধ্যেই এক ছাত্র কিছু মিষ্টান্ন এনে দিয়েছে। ব্রাহ্মণ সেগুলো সেবন করে আরও অনেক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রস্থান করলেন।