গ্লানির্ভবতি ভারত – ১

১৫ই জানুয়ারি, ত্রিবেণী

ঘড়ির বড় কাঁটাটা সবেমাত্র নয়ের ঘর পেরিয়েছে। তবু এরই মধ্যে গঙ্গার ধার দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সরু পাকা রাস্তাটা আজ শুনশান। শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে বলেই বোধ হয় বেশ কিছুক্ষণ অন্তর দু-একটা বাইক ছাড়া আর তেমন কারুর দেখা নেই।

গঙ্গার ধারে বেশ কিছু পানবিড়িসিগারেটের দোকান। সেগুলোরও ঝাঁপ বন্ধ। অন্যদিন ঘাটের সিঁড়িগুলোতে বসে গুলতানি করে কিছু ফচকে ছেলে। আজ কেন কে জানে, তারাও অনুপস্থিত।

খুব নিস্তব্ধতার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকলে নিজেরও শব্দ করে কিছু করার ইচ্ছেটা চলে যায়। শিবনাথ তাই বেশ সাবধানে বলতে গেলে একেবারে নিঃশব্দে কম্পিউটার সেটগুলোর ওপর তোয়ালে ঢাকা দিচ্ছিল। তারগুলো খুলে ভালভাবে মুছে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখে অফ করছিল সুইচ।

এই সবকিছু ওর তিলতিল কষ্ট দিয়ে গড়া, যত্ন তো থাকবেই।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার। লক্ষ্মীবার বলে দোকান বন্ধ থাকবে। অন্যান্য বুধবার শিবনাথের মেজাজ বেশ প্রসন্ন থাকে। তার মেয়ের বয়স সবে সাড়ে চারমাস, সপ্তাহে এই একটা দিনই মেয়েকে সে সারাদিন ধরে দেখতে পায়। যখন হাসপাতাল থেকে ন্যাকড়া জড়িয়ে নিয়ে এসেছিল, তখন সে অ্যাত্তটুকুন, যেন চোখ বোজা একটা নরম বিড়ালছানা।

তাকে প্রথম দেখে শিবনাথ কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কাটছিল বারবার। পরখ করে নিতে চাইছিল, স্বপ্ন দেখছে কিনা। ওর বউ আরতি কাণ্ড দেখে যতই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসুক, শিবনাথের ঘোর কাটছিল না কিছুতেই।

ওর ভাগ্যে এত সুখও লেখা ছিল? যে প্রচণ্ড টালমাটালের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল ওর জীবনটা, যে ভীষণ প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুঝতে হয়েছে শৈশবে, সেইসব দিনগুলোর পর যে এমন সোনালি মুহূর্ত অপেক্ষা করছে, তা কি ও কখনো ভাবতে পেরেছিল? তখন তো প্রতি মুহূর্ত কাটত ভয়ে, অস্থির আশঙ্কায়। এই বুঝি কেউ চিনে ফেলল ওকে। এই বুঝি কেউ আবার টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে যেতে লাগল সেই নরক কুণ্ডে।

শিবনাথের নরম বিড়ালছানার মতো সেই মেয়ে এখন দিব্যি এদিক ওদিক তাকায়, ফোকলা দাঁতে লাল টুকটুকে মাড়ি বের করে হেসে দেয়। আর সেই হাসি দেখে শিবনাথের মন খারাপ হয়ে যায়।

মনে হয়, মেয়ের একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠাটা ও দেখতেই পাচ্ছে না।

তাই বৃহস্পতিবারটা মেয়ের বিছানার সঙ্গে প্রায় লেপটে বসে থাকে ও। হিসি করে ভিজিয়ে দেওয়া কাঁথা পালটানো থেকে শুরু করে দুধ গুলে বোতলে করে খাওয়ানো, শীতের বেলায় সর্ষের তেল দলাইমলাই করে গায়ে মাখানো, কিচ্ছু বাদ দেয় না। কখনো কখনো আরতি বিরক্ত হয়ে যায়। কিন্তু শিবনাথ পাত্তা দেয়না। ছয়দিনের না পাওয়াটাকে সে একদিনে উশুল করে নিতে চায়।

কিন্তু আজ বুধবার হওয়া সত্ত্বেও শিবনাথের মনটা খিঁচিয়ে রয়েছে। সারাদিন রোজগার প্রায় হয়নি বললেই চলে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা চলছে, যে গুটিকয় বাচ্চা আসত, তারাও গেম খেলতে আসছেনা। কিন্তু কলেজের যে দু-একটা ছেলেমেয়ে সন্ধের দিকে আসত, তারা তো আসতে পারত!

লাইট পাখা অফ করে দরজায় তালা মেরে শাটার নামাতে নামাতে নিজের মনেই শিবনাথ গজগজ করে। সব দোষ ওই ফোরজি প্ল্যানওয়ালাদের। যবে থেকে সস্তায় ইন্টারনেটের প্ল্যান বিক্রি শুরু হয়েছে, তবে থেকে তার সাইবার ক্যাফের ব্যবসায় ভাঁটা পড়েছে।

বারো বছর হতে চলল, ধারদেনা করে এই গঙ্গার ধারের রাস্তায় ও এই দোকানটা খুলেছিল। তখন সবাই বারণ করেছিল। বলেছিল, পয়সা যখন ঢালছেই, আরেকটু বেশি ইনভেস্ট করে বাজারের দিকে খুলতে। কম্পিউটারের দোকান, একটু জমজমাট এলাকায় না থাকলে হয়? এই দিকটায় কে আসবে?

শিবনাথের সেই যুক্তি মনে ধরলেও কিছু করার ছিল না। থাকার বলতে তখন ওর ছিল শুধুমাত্র একটা এস টি ডি বুথ। বাবা মারা যাওয়ার আগে খুলেছিলেন। বাবা ওর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এমন কিছু নেই যে করেননি। ট্রেনে হকারি থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি সাবান বিক্রি। বলতে গেলে মুখে রক্ত তুলে সংসার চালিয়েছেন। এক মুহূর্তের জন্য শিবনাথকে বুঝতে দেননি যে ও বাবা-মায়ের নিজের সন্তান নয়। নিঃসন্তান দম্পতির স্নেহবুভুক্ষ হৃদয় যেন শিবনাথকে ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছিল প্রতিটা দিন।

অনেক রকম ব্যবসা করে একেবারে শেষদিকে সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে বাবা শুরু করেছিলেন ওই এস টি ডি বুথ। সেই বুথ বেশ ভালো চলত। তরুণ শিবনাথ বসত। কখনো কখনো বাবাও।

কিন্তু, কয়েকবছর পর মোবাইল ফোন আসার পর ব্যবসা ধুঁকতে শুরু করল। সারাদিনে একটা টাকাও রোজগার হয় না। পেটটা তো চালাতে হবে। ততদিনে বাবা চলে গিয়েছেন।

শিবনাথ তখন অনেক ভেবেচিন্তে সেই বুথ বিক্রি করে দিয়েছিল। সেই টাকাটুকুই তখন ওর পুঁজি।

ত্রিবেণী স্টেশন রোড বা বাজার এলাকায় আগুন দাম, ওখানে দোকানঘর ভাড়া নেওয়ার ক্ষমতা ওর ছিল না। শুধু যে দোকানঘর ভাড়ার মোটা সেলামি, তা তো নয়, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল সবই কিনতে হয়েছিল।

 তা হরির কৃপায় ওর সেই পরিশ্রম তখন বিফলে যায়নি। মাসছয়েকের মধ্যেই ওর এই ‘শ্রীহরি সাইবার ক্যাফে’ রমরমিয়ে চলতে শুরু করেছিল। গঙ্গার ধারেই ত্রিবেণীর তিনটে সরকারি স্কুল, এছাড়া অনেকগুলো ছোটবড় কোচিং ক্লাস। সেখানকার ছেলেপুলে হুড়মুড়িয়ে ভিড় জমাতে আরম্ভ করেছিল। বাজারের দিকে তখন দুটো সাইবার ক্যাফে ছিল, শিবনাথ ইচ্ছে করেই সেই দুটোর থেকে ঘণ্টাপিছু গেম বা ইন্টারনেট সার্ফিং এর খরচ কিছুটা কম রেখেছিল। আর তাতেই বাজিমাত। বছরদুয়েকের মধ্যেই শিবনাথের ক্যাফেতে তিনটে থেকে বেড়ে হয়েছিল দশটা কম্পিউটার। রাখতে হয়েছিল একটা পাড়ার ছেলেকেও। শিবনাথ তখন শুধু ক্যাশে বসে থাকত। কম্পিউটার খুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সময় পেরিয়ে গেলেই জোর করে খেলায় তন্ময় হয়ে দেওয়া ছেলেটাকে উঠিয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো ওই ছেলেটাই করত। এই দোকান থেকেই বাড়ি মেরামত, বিয়ে সব ধীরে ধীরে সেরে ফেলেছিল শিবনাথ।

কিন্তু ব্যবসায় মন্দা এসেছে বছরদুই হল। চারদিকে ফোরজি প্ল্যানের বাড়বাড়ন্তে এখন আর ছেলেমেয়েদের ক্যাফেতে গেম খেলতে আসার বিশেষ দরকার হয়না। নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে ফোনেই তা দিব্যি খেলা যায়। ইন্টারনেট সার্ফিং থেকে শুরু করে বইপত্র, সোশ্যাল মিডিয়া সব চাহিদাই মেটায় ফোন। দৈবাৎ চাকরির পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ করা কোনো ছাত্র বা ছাত্রী শিবনাথের সাইবার ক্যাফেতে আসে প্রিন্ট আউট নেওয়ার জন্য। কিংবা এখনকার প্রযুক্তিতে একেবারেই অস্বচ্ছন্দ কোনো বয়স্ক ব্যক্তি ট্রেন বা প্লেনের টিকিট কাটতে আসেন।

বাজারের সাইবার ক্যাফেদুটো উঠে সেখানে এখন গেম পার্লার হয়েছে। কিন্তু ভারী ভারী গেম খেলার জন্য শিবনাথকে নিজের কম্পিউটারের অনেক কিছু পালটাতে হবে। কিনতে হবে প্লে-স্টেশন। এখন অত পয়সা তার নেই।

শিবনাথ ছেলেটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেই এখন পুরো ক্যাফেটা দেখে।

আজকের দিনটা একেবারেই মড়া। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ন’টা। একটা খদ্দেরও আসেনি শিবনাথের সাইবার ক্যাফেতে। গোমড়া মুখে দোকানের একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা স্কুটিতে চাবি ঘোরায় শিবনাথ।

এভাবে আর কদ্দিন চলবে? বাচ্চা হওয়ার পর একলাফে সংসারখরচ যেন একশো গুণ বেড়ে গিয়েছে। আরতির সঙ্গেও সারাক্ষণ খিটিমিটি।

শালা একটার পর একটা ব্যবসা কষ্ট করে দাঁড় করাচ্ছে, কয়েকবছর পরই সেগুলোয় লাল বাতি জ্বলে যাচ্ছে। এইভাবে কাঁহাতক চলা যায়?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দোকানের চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে স্কুটিতে চেপে বসল শিবনাথ। দোকানের গায়েই গঙ্গার এক পুরোনো ঘাট। সেখান থেকে হু হু করে হাওয়া আসছে।

ত্রিবেণী বহু প্রাচীন জনপদ। এক কালে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী, এই তিন নদী এখানে চুলের বেণীর মতো মিলেমিশে গিয়েছিল। তাই ত্রিবেণী। এখন অবশ্য সেই যমুনাও নেই, সরস্বতী শুকিয়ে খালের চেয়েও সরু। শুধু মা গঙ্গাই নিরবচ্ছিন্ন গতিতে বয়ে চলেছেন।

 স্কুটিতে স্টার্ট দিয়ে বেরোতে যাবে, হঠাৎ পাশে যেন ভূতের মতোই উদয় হল একটা মানুষ। পরনে কী, তা বোঝা যাচ্ছে না। মাথা থেকে পেট অবধি চাদর জড়ানো।

কাছেপিঠে আর কোনো দোকান নেই। শিবনাথ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। লোকটা কি ক্যাফেতে কোনো প্রিন্ট আউট নিতে এসেছে? দেরি হলেও তাহলে ও আবার দোকানের ঝাঁপ খুলবে। অন্তত বউনিটা তো হবে।

কাছাকাছি আসতে শিবনাথ বলল, “তুমি! এত রাতে? কী ব্যাপার?”

শিবনাথ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলতে পারল না। কারণ সে বিস্ফারিত চোখে দেখল, লোকটার চাদরের তলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা ধাতব লম্বা কিছু।

শিবনাথ আত্মরক্ষার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ‘আঁক’ করে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে।

তার স্কুটিটার ইঞ্জিন তখনো চালু। স্কুটির পেছনের চাকার ঠিক পাশে পড়ে থাকা তার পা দুটো কাটামাছের মতো লটপট করতে লাগল।

লোকটা কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা বুঝতে। নিঃসন্দেহ হয়ে চারপাশ দেখল। মিনিটদুয়েক পর নীচে পড়ে থাকা শিবনাথের পকেট থেকে হাতড়ে হাতড়ে বের করল একটা চাবি। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ‘শ্রীহরি সাইবার ক্যাফে’-র দিকে।

লোকটা বেরিয়ে এল প্রায় দশমিনিট পরে। ধীরেসুস্থে শাটার নামাল। তারপর মার্জারপদে চলে গেল গঙ্গার জনহীন ঘাটের দিকে।

ঘাটে একখানা ছোট নৌকো নোঙর করা ছিল। বাতাসে সেটা কাঁপছিল তিরতির করে। লোকটা সন্তর্পণে নৌকোটায় উঠে বসে দাঁড় বইতে শুরু করল।

কালো জলে শব্দ হতে লাগল, ছপছপ।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নৌকোটাকে আর দেখা গেল না। শুধু ঘাট লাগোয়া নদীর জলের মৃদু কম্পন বোঝা যেতে লাগল।

সারা রাতের ঘুম যতই গভীর হোক, ভোরবেলা ঘণ্টাখানেকের যে ঘুমটা হয়, তার কোনো তুলনা হয় না। পাশেই নদী। ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসে। সেই আমেজে এই গরমেও একটা আলগা চাদর আলতো করে গায়ে জড়িয়ে নিতে হয়।

ও বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমের মধ্যে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখছিল। দেখছিল, ও আর ক্ষমা বেড়াতে গিয়েছে দূরের এক পাহাড়ে।

পাহাড়টা কোথাকার, তা ঠিক বুঝতে পারছে না, তবে উঁচু নিচু টিলা দেখে মনে হচ্ছে ছোটনাগপুর মালভূমির দিকে কোথাও। লাল রঙের পথ, এদিক ওদিক কিছু গাছ ছড়ানো ছিটানো।

ক্ষমা আর চলতে পারছে না। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে, “আর পারব না গো মাসি, খুব কষ্ট হচ্ছে! ওই দ্যাখো, আমার মা বসে পড়েছে।”

ও তাড়া দিচ্ছে, “এইটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলি? তোদের বয়সে আমরা কত ছোটাছুটি করতাম! আরেকটু চল। ওই যে, ওই দূরের লম্বা গাছটা …!”

ক্ষমা চোখ বড়ো বড়ো করে বলছে, ‘এখনো অতদূর?’

ও বলছে, “কোথায় অতদূর? আয় না, গল্প করতে করতে হাঁটি। আচ্ছা, তোর ওই কবিতাটা মনে আছে? আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা?’

‘হ্যাঁ’ ক্ষমা হাঁটতে হাঁটতে বলতে আরম্ভ করল।

‘আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা,

দেবদারুর কুঞ্জে ধেনু চরায় রাখালেরা।

কোথা হতে চৈত্রমাসে হাঁসের শ্রেণি উড়ে আসে,

অঘ্রাণেতে আকাশপথে যায় যে তারা কোথা

আমরা কিছুই জানিনে কো সেই সুদুরের কথা।’

‘বাহ!’ ও বলল, ‘দেখলি, কবিতা বলতে বলতে কেমন গাছটার কাছে চলে এলাম।’

ক্ষমা দাঁত বের করে বলল, ‘তাই তো!’

একটানা একটা কর্কশ শব্দে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল।

স্বপ্নটা বুদ্বুদের মত মিলিয়ে গেল কোথায়। ঘুমের ঘোরটা কাটতেই ও ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর খাটের লাগোয়া টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করল।

—হ্যালো?

—হ্যালো, আপনি কি শ্রীরামপুরের অ্যাডিশনাল এস পি রুদ্রাণী সিংহরায় বলছেন?

রুদ্র একটা হাই তুলল। জড়ানো কণ্ঠে বলল, “বলছি।”

—গুড মর্নিং ম্যাডাম। আমি চন্দন বলছি। চন্দন শাসমল। হুগলী ডি এম অফিসের এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট।

—বলুন।

—ডি এম আপনার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাইছেন। একটু কনফিডেনসিয়াল। আপনি কি আজ একবার ডি এম অফিসে আসতে পারবেন? আপনার বাংলোয় অফিসরুমে ফোন করছি, বেজে বেজে কেটে গেল। তাই এখানেই করলাম।”

রুদ্রর ঘুমের রেশটা কেটে গেল। জেলাশাসক ওর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, গোটা জেলার প্রশাসনিক প্রধান। ডেকে পাঠাতেই পারেন। কিন্তু এইভাবে টেলিফোনে কেন? অফিশিয়াল চিঠি কই?

চন্দন শাসমল বোধ হয় ওর মনের কথা বুঝে ফেলল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আপনার স্যার মানে শ্রীরামপুরের এস পি সাহেবও থাকবেন মিটিং এ। চাইলে আপনি একবার কথা বলে নিতে পারেন।”

রুদ্র বলল, “না ঠিক আছে। কখন যাব?”

“ঠিক দশটা।”

চন্দন শাসমল ফোন কেটে দেওয়ার পর রুদ্র ঘড়ি দেখল। সবে পৌনে সাতটা। আরও আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়াই যায়।

ও আবার শুয়ে পড়ার তোড়জোড় করছিল, কিন্তু মোবাইলটা আবার বেজে উঠল।

ফোন অন করতেই প্রিয়মের গলা শুনতে পেল।

“বেরিয়ে পড়েছি।”

“ওমা!” রুদ্র অবাক, “এত তাড়াতাড়ি?”

প্রিয়ম বলল, “মা তোমার জন্য অনেক মিষ্টি ভরে দিয়েছে। যা গরম পড়েছে, যদি নষ্ট হয়ে যায়? সকাল সকাল চলে যাওয়াই ভালো।”

“সে ভালোই করেছ। রাস্তাও ফাঁকা থাকবে।”

প্রিয়ম বলল, “না আজ আর গাড়ি নিয়ে বেরোইনি। ভাবলাম একটু অন্যভাবে ফিরি। বাড়ি থেকে পেরিয়ে জেটিতে চলে এলাম। কল্যাণী থেকে গঙ্গার ওপারে বাঁশবেড়িয়া যাওয়ার স্টিমার ছাড়ছে। উঠে পড়লাম। আহ! নদীতে কি সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে!”

“তারপর? ওখান থেকে কী করবে?”

“কেন, বাঁশবেড়িয়া থেকে একটা অটো করে ব্যান্ডেল স্টেশন। আর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে আমার বউয়ের কাছে। যাওয়ার সময় মাটন নিয়ে যাব। মল্লিকাদি’কে জমিয়ে পাঁঠার ঝোল করতে বলব।” প্রিয়ম হাসল।

রুদ্র আবার একটা হাইতুলে বলল, “বাবা! লোকে ঘুরিয়ে নাক দেখায় শুনেছিলাম, এই প্রথম সেটা কাউকে করতে দেখলাম। যাইহোক, মাটন আনবে আনো, কিন্তু আমাকে বেরোতে হবে।”

“কেন? আজ তো ছুটি।”

“কিসের ছুটি?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকল।

“আজ তো শনিবার।”

রুদ্র হাসল, “এসেনশিয়াল সার্ভিসে আবার শনিবার! এ কি তোমাদের মতো ডেস্কজব নাকি? ডি এম ডেকেছেন, যেতে হবে।”

“ধুর!” প্রিয়মের বিরক্তি ফোনের তার বেয়ে এদিকে এসে উপচে পড়ল, “কী করতে যে তুমি ব্যাঙ্কের চাকরিটা দুম করে ছাড়লে! যত যাইহোক, ঠিকঠাক ছুটিছাটা ছিল। একটা ভদ্র সময়ে আসা যাওয়া ছিল। আর ছাড়লে তো ছাড়লে, রাতদিন পড়ে পরীক্ষা দিয়ে ঢুকলে পুলিশ সার্ভিসে। কেন, আর কোনো ক্যাডার ছিল না?”

রুদ্র হাসল, “এই প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে এই তিনবছরে অন্তত একশোবার দিয়েছি প্রিয়ম। ব্যাঙ্কের চাকরিতে আমার সম্মান একটু হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। আমার কাছে আত্মসম্মান সবার ওপরে। আর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাডার পেলে কি নিতাম না? জানোই তো, অপশনাল পেপারটা ঝুলে গেল বলে র‍্যাঙ্কটা পিছিয়ে গেল। বারবার মনে করাও কেন?”

“মনে করাই কারণ আমার ভালো লাগেনা তুমি বাইরে বাইরে থাকো।” প্রিয়ম উষ্মাভরা কণ্ঠে বলল।

“ওমা!” রুদ্র অবাক স্বরে বলল, “বাইরে বাইরে কোথায়? শ্রীরামপুরের মতো জায়গায় পোস্টিং আমাদের ব্যাচের ক’জন পেয়েছে বলো তো? দিব্যি একসঙ্গে রয়েছি দুজন, তুমি এখান থেকে অফিসও করতে পারছ। এটাকে প্রাইজ পোস্টিং বলে, তা জানো?”

“আরে সে তো মেরেকেটে তিনবছর। একবছর তো হায়দ্রাবাদের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে কাটিয়ে এলে, কিছুদিন পরেই আবার কোন বনবাদাড়ে পাঠিয়ে দেবে।” প্রিয়ম বিরক্ত স্বরে বলল, “যাকগে। আমি ঘাটে নামছি। এখন রাখছি।”

ফোনটা রেখে দিয়ে রুদ্র বাথরুম থেকে ঘুরে এসে বাইরে এল। সকাল সাড়ে সাতটা, রোদ এখনো নরম রয়েছে।

ওর বাংলোর সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে এখন মল্লিকাদি’র নয় বছরের মেয়ে ক্ষমা খেলে বেড়াচ্ছে।

একটা প্রজাপতি উড়ছে, ক্ষমা ছুটে ছুটে সেটাকে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাছাকাছি গেলেই প্রজাপতিটা আবার উড়ে যাচ্ছে।

“কীরে, তোর মা কোথায়?” রুদ্র অলসভাবে এসে বসল লম্বা বারান্দায়।

ওর এই সরকারি বাংলোটা ব্রিটিশ আমলের, ভিক্টোরিয়া ধাঁচের স্থাপত্যে তৈরি। দোতলা হলেও এখনকার আধুনিক বাড়ির উচ্চতায় চারতলারও বেশি। বিশাল বিশাল ঘর, ভারী ভারী মেহগনি কাঠের আসবাবপত্র। বাংলোর চারপাশে বাগান। সেই বাগানের পরিচর্যায় রয়েছে মালি সনাতন। সে অবশ্য এই ক্যাম্পাসে থাকে না। একটু দূরে তার নিজের বাড়ি। সেখান থেকে আসা যাওয়া করে।

বাংলোয় থাকে রাঁধুনি জ্যোৎস্নাদি আর আর্দালি কাম ড্রাইভার পাঁচু। পাঁচু বউকে নিয়ে থাকলেও জ্যোৎস্নাদি বিধবা। সে একাই থাকে। ক্যাম্পাসের মধ্যেই বাংলোর আউটহাউজে ওদের থাকার ব্যবস্থা।

গঙ্গার পাশ দিয়ে সরু পিচের রাস্তা, তার ওপরেই এই বাংলো। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে নদী দেখা যায় স্পষ্ট। ওপারে ব্যারাকপুর, কখনো কখনো ক্যান্টনমেন্টের গুলির মহড়ার শব্দও কানে আসে।

গত তিনবছরে রুদ্রর জীবনটা অদ্ভুতভাবে বদলে গিয়েছে। প্রথম জীবনে বাবার মতো ইতিহাসের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থাকলেও স্বপ্ন ছিল আই এ এস অফিসার হওয়ার। প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকলে সমাজের নীচুস্তরের মানুষদের জন্য অনেক কিছু করা যায়। মূলত এই তাগিদেই চেয়েছিল আই এ এস হতে।

কিন্তু প্রথম জীবনের সেই স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছিল চটজলদি কেরিয়ার গড়ার জাঁতাকলে। তাই আগ্রায় তাজমহলের সেই ভয়ংকর ঘটনায় ব্যাঙ্ক থেকে শো-কজের পর* যখন দুম করে রিজাইন করেছিল, তখন মনের মধ্যে প্রথম ভাবনা এসেছিল, এখনো তো বয়স রয়েছে। আরেকবার চেষ্টা করতে দোষ কী? না হলে না হবে।

সেই ভাবনা থেকে প্রিয়ম যখন নিজের কাজে লন্ডনে ফেরত চলে গেল, বাবা-মা ফিরে এলেন কলকাতায়, রুদ্র তখন দিনরাত এক করে পড়াশুনো করতে শুরু করেছিল। ইচ্ছে করেই কলকাতায় আসেনি। বাবা-মা’র কাছে বা নিজের ফ্ল্যাটে থেকে পড়ার চেয়ে দিল্লিতে গিয়ে কোন পেশাদার কোচিং সেন্টারে ভরতি হয়ে প্রস্তুতি নেওয়াটা ওর কাছে অনেক বেশি ফলপ্রসূ মনে হয়েছিল। বয়স পেরনোর আগেই ওকে যেভাবে হোক আই এ এস পেতে হবে, কলেজ জীবনের সেই স্বপ্নটা ওর মাথায় তখন গেঁড়ে বসেছিল।

ফলস্বরূপ দেড়বছরের মধ্যে এসেছিল সাফল্য।

না। ওর স্বপ্নের আই এ এস হয়নি। র‍্যাঙ্ক একটু পিছনে থাকায় আই পি এস ক্যাডার পেয়েছিল ও। তাতে কী? আবার পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ওর আর হয়নি। ততদিনে প্রিয়ম ফিরে এসেছে লন্ডন থেকে। কিন্তু রুদ্র কলকাতায় যেতে পারেনি। পরবর্তী একবছর কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে ওর ট্রেনিং চলেছে হায়দ্রাবাদের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে, তারপর কিছুক্ষণ মুসৌরিতে।

সব মেটার পর প্রথম পোস্টিং হয়েছে হুগলীর শ্রীরামপুরে। অ্যাডিশনাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ। প্রিয়ম তখন ঠিকই বলছিল। এটা প্রোবেশন পিরিয়ডের পোস্টিং। তিনবছরের মধ্যেই ওকে আবার অন্য কোথাও চলে যেতে হবে এস পি হয়ে।

তা হোক। পরিযায়ী জীবনে এই সময়টুকু তো দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারছে। পারছে ছুটিছাটায় কলকাতায় বাবা-মা’র কাছে বা কল্যাণীতে শ্বশুরবাড়িতে যেতেও। এই বা মন্দ কি!

“এই নাও গো।” ক্ষমার কথায় ওর চিন্তার জাল হঠাৎ ছিঁড়ে গেল।

ক্ষমার হাতে একটা খবরের কাগজের ছেঁড়া পাতার ওপর রাখা অনেক ক’টা লাল রঙের তরতাজা ফুল।

রুদ্র কপট চোখ পাকাল, “তুই আবার ফুল ছিঁড়েছিস? সনাতনকাকার চোখে পড়লে তোকে আর আস্ত রাখবে?”

ক্ষমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফ্রকের কোঁচড় থেকে বের করল আরও পনেরো-কুড়িটা ফুল, “বকলে বকবে। আমার বুঝি কেষ্টঠাকুরের জন্য মালা গাঁথতে সাধ যায়না?”

রুদ্র বিস্মিত হল না। ন’বছরের একটা শিশু হয়েও ক্ষমার মুখে একটু বয়সছাড়া কথা। নামের মতোই তার কথাগুলোও একটু সেকেলে।

আর মা যেমন, মেয়েও তো তেমনই হবে।

ক্ষমার মা মল্লিকাদি অন্যদের মতো বাংলোর সরকারি কর্মচারী নয়। রুদ্র এখানে পোস্টেড হয়ে এসেছে সাড়ে তিন মাস হল। আসার ঠিক একমাসের মাথায় ভোরবেলা গঙ্গার ধারে মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছিল ও আর প্রিয়ম। তখনই বাংলোর বাইরে গুটিসুটি মেরে ঘুমতে দেখেছিল মল্লিকাদি আর কোলের কাছে শুয়ে থাকা ক্ষমাকে। ক্ষমার তখন গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। রুদ্রর নির্দেশে পাঁচু আর জ্যোৎস্নাদি ধরে ধরে ওদের নিয়ে গিয়েছিল ভেতরে।

দিনদুয়েকের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছিল ক্ষমা। মল্লিকাদির বাড়ি হুগলীরই কোন এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে আর নিজের কেউ নেই। পেটের দায়ে শ্রীরামপুরে কাজ খুঁজতে এসেছিল। ক্ষমার ভাসা ভাসা আয়ত চোখদুটোর ওপর ভারী মায়া পড়ে গিয়েছিল রুদ্রর। অন্যদের সঙ্গে ওদেরও থাকতে বলে দিয়েছিল আউটহাউজের একটা ঘরে।

তারপর থেকে মা-মেয়ে ভালোই আছে। মল্লিকাদি’র হাতের রান্না খুব ভালো, সে এমনিতে টুকিটাকি কাজ করলেও প্রায়ই প্রিয়মের আবদারে এটা সেটা বানায়। এই নিয়ে স্থায়ী রাঁধুনি জ্যোৎস্নাদি’র সঙ্গে মাঝেমাঝেই তার খটাখটি লেগে যায়।

রুদ্র শুধু দেখে আর উপভোগ করে। মাঝেমাঝে ভাবে, মল্লিকাদি না এলে ও জানতেও পারত না, এখনো গ্রামের মানুষরা কত সেকেলে। কত ধরনের ব্রত, উপবাস, পুজো।

ও এখন গম্ভীরমুখে ক্ষমাকে বলল, “যা সাধ মেটানোর মিটিয়ে নাও। আর মাসখানেকের মধ্যেই তোমায় স্কুল যেতে হবে। তখন আর দিনরাত খেলে বেড়ানো চলবে না। ছি ছি, এত বড় মেয়ে, পড়তে পারেনা। লোকে বলবে কী?”

ক্ষমা ফিক করে হেসে একছুটে চলে গেল বাগানের দিকে। রুদ্র ওকে আর ডাকল না। শিক্ষিতের হার যতই বাড়ুক দেশে, এমন কত শিশু যে নিরক্ষর রয়ে গিয়েছে এখনো, তার কোনো হিসেব নেই। সরকারের চেষ্টা, বিভিন্ন প্রকল্পই তো সব নয়, এর জন্য দায়ী পরিবারের মানসিকতাও। এই ক্ষমাই প্রথমদিকে বলতো, মেয়েদের লেখাপড়া শিখে কী হবে? তাই শিখিনি।

এখন আর বলেনা।

ফুলসমেত খবরের কাগজটা পড়ে রইল টেবিলে। সেখানেই ফুল পেরিয়ে খবরের কাগজের একটা খুচরো খবরে চোখ আটকে গেল রুদ্রর। খবরটার শিরোনাম ‘কোন্নগরে ব্যবসায়ী খুন’।

কোন্নগর শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত একটা ছোট মফঃস্বল এলাকা। সেখানে কোন ব্যবসায়ী খুন হল?

রুদ্র ফুলগুলো সরিয়ে কাগজটা তুলে নিয়ে আগ্রহের সঙ্গে পড়তে শুরু করল:

নিজস্ব সংবাদদাতা, কোন্নগর : গতকাল গভীর রাতে নিজের বাড়িতেই নৃশংসভাবে খুন হলেন গাড়ি ব্যবসায়ী স্বপন সরকার (৪৫)। তিনি একটি গাড়ি প্রস্তুত সংস্থার ডিলার ছিলেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দিল্লিরোডে নিজের শো-রুম থেকে ফিরে বুধবার তিনি তাঁর ক্রাইপার রোডের বাড়িতে একাই ছিলেন। আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ এক প্রতিবেশী এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় পাড়ার লোকেরা দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।

 রুদ্র একটু অবাক হল। কোন্নগর বেশ শান্তিপূর্ণ এলাকা। সেখানে এইভাবে খুন? আর খুন হয়েছে লেখা রয়েছে, কিন্তু কীভাবে খুন করা হয়েছে, সেই ব্যাপারে কোনো বিশদ নেই। সংবাদপত্রের খবরের মান দিনদিন নেমে যাচ্ছে। কবেকার কাগজ এটা? বোঝার উপায় নেই। ক্ষমা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে এনেছে।

রুদ্র আর কিছু ভাবার অবকাশ পেল না। জ্যোৎস্নাদি এসে বলল, “আজ অফিসে কী খেয়ে যাবেন দিদিমণি? রুটি?”

রুদ্র হাসল। এখানে আসার পর অনেক কষ্টে ‘ম্যাডাম’ ছাড়াতে পেরেছিল ও, বলেছিল ‘দিদি’ বলতে। দিনরাত যাদের সঙ্গে থাকতে হবে, তাদের মুখ থেকে ‘ম্যাডাম’ শুনলে যেন কেমন হোটেলে থাকার মতো মনে হয়।

কিন্তু এদের এতবছরের অভ্যেস! মাঝে মাঝেই তাই ম্যাডাম, দিদিমণি এইসব বেরিয়ে আসে।

ও বলল, “নাহ। আজ বরং স্যান্ডউইচ করে দাও। সঙ্গে একটা ওমলেট। একটু তাড়াতাড়ি বেরবো আজ।” জ্যোৎস্নাদি চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই ও পিছু ডাকল, “ও হ্যাঁ, তোমার দাদা বোধ হয় মাটন আনছে। মল্লিকাদি’কে করতে বোলো দুপুরের জন্য। আমি রাতে ফিরে খাব।”

জ্যোৎস্নাদি’র মুখটা নিভে গেল। স্বাভাবিক। বাড়ির রান্নার দায়িত্ব যার কাঁধে, মাটনের ভার যদি তাকে ছাড়িয়ে অন্য কাউকে দেওয়া হয়, তা তো অপমানই।

রুদ্র বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে হাসল, “না মানে তুমি তো দারুণ করো। কিন্তু তোমার দিনরাত যা খাটনি যাচ্ছে। মল্লিকাদি তো বলে যে ও খুব ভালো রান্না জানে, তাই প্রিয়ম বলল …!”

“বলতে তো সবাই পারে। বলতে তো আর টাকা লাগেনা।” জ্যোৎস্নাদি মুখ বেঁকাল, “রান্নার যা ছিরি। চোদ্দোবার খালি মশলা বাটে। গুঁড়ো মশলার প্যাকেট দেখলে যেন আঁতকে ওঠে। আলু দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন জন্মে দেখেনি। আধমিনিট অন্তর ঘোমটা টানে। আর গ্যাস জ্বালাতে জানত নাকি? আমিই তো শেখালাম! কাজেকম্মে নেই, কথার ফুলঝুরি!”

“তা তিনি কোথায়? সকাল থেকে একবারও দেখতে পাইনি।” রুদ্র আলগা ছলে কথা বলতে বলতে প্রস্তুত হতে লাগল স্নানে যাওয়ার জন্য।

বলতে বলতেই এসে উপস্থিত হল মল্লিকাদি। পরনে ডুরে ছাপা শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। অনেক বলেও সেই ঘোমটা সরাতে পারেনি রুদ্র। ঘোমটা সরালে তার নাকি ভীষণ লজ্জা করে।

মল্লিকাদি প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না, “মটর? মানে কড়াইশুঁটি?”

“আহা মটর নয়, মাটন। মানে পাঁঠার মাংস। রাঁধতে পারো?” রুদ্র নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার আগে বলল।

“মহাপ্রসাদ!” মল্লিকাদি বলল, “হ্যাঁ মা, পারি।”

জ্যোৎস্নাদি অবাকচোখে তাকাল। বলল, “আ মরণ! প্রসাদ রাঁধতে তোমায় কে বলেছে? পাঁঠার মাংস রাঁধতে বলছে। পারো কি? না পারলে বলো, আমি করে নেব।”

“পারব।”

রুদ্র বাথরুমে ঢুকল। ওর মনটা কেমন খচখচ করছে। ও হুগলী জেলায় এসেছে সবে কয়েকমাস হল। সেভাবে কাজ কিছু শুরু হয়নি। তাছাড়া জেলার আরও তিনটে মহকুমায় ওর মতো দু’জন করে অ্যাডিশনাল এস পি আছেন।

কী এমন হল যে ছুটির দিনে জেলাশাসক গোপনে ওকেই ডেকে পাঠালেন?

_____

* রুদ্রপ্রিয়ম সিরিজের ৩য় উপন্যাস ‘অঘোরে ঘুমিয়ে শিব’ দ্রষ্টব্য।

হুগলীর ডি এম অফিসটা চুঁচুড়ায়। শ্রীরামপুরে আসা ইস্তক রুদ্রর কখনো এর আগে ডি এম অফিস আসার প্রয়োজন পড়েনি। ড্রাইভার পাঁচু দিল্লি রোড দিয়ে এসে ডানদিকে বেঁকে বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। রুদ্র বেশ আগ্রহের সঙ্গে দু’পাশ দেখছিল। সঙ্গে রয়েছে ওর দেহরক্ষী জয়ন্ত।

জয়ন্ত পদমর্যাদায় অনেক নীচে হলেও ওর বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতা যে কোনো অফিসারকে টেক্কা দিতে পারে। সে ত্রিবেণীর ছেলে। নিম্নবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে, কোনোমতে গ্র্যাজুয়েশন করেই এই চাকরিতে ঢুকেছে। পড়াশুনোতেও ভালো ছিল। রোজকার ডিউটি সামলে সে এখনো বড় চাকরির প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। রুদ্রও ওকে পড়াশুনোয় সাধ্যমতো সাহায্য করে।

রুদ্র একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল। কোন জায়গা, তা সে যতই কাছাকাছি বা অকিঞ্চিৎকর হোক, সেখানকার ইতিহাস জেনে নেওয়া ওর বহুদিনের অভ্যাস। জয়েন করার পর হুগলী জেলার সম্পর্কে একটা মোটা বই দেখতে পেয়েছিল অফিসের কেবিনে। বাড়িতে নিয়ে এসে সেখান থেকে কখনো শ্রীরামপুর, কখনো চন্দননগর সম্পর্কে পড়ত।

আজও গাড়িতে সেই বইটাই পড়তে পড়তে যাচ্ছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে পাশাপাশি চন্দননগর আর চুঁচুড়া— এই দুটো জনপদ কখনোই ইংরেজ বশ্যতা স্বীকার করেনি। চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ আর চুঁচুড়া ওলন্দাজ। ওদিকে হুগলী আবার ছিল পর্তুগিজদের দখলে। চুঁচুড়াতে বসেই নাকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন বন্দেমাতরম গান।

প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই চুঁচুড়া শহর। আগে এর নাম ছিল ওলন্দাজনগর।

ড্রাইভার পাঁচু নতুন এ এস পি’কে এই ক’দিনেই বেশ চিনে গিয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে সে বলেছিল, “এদিকে অনেক কিছু দেখবার আছে ম্যাডাম। ফেরার পথে যাবেন?”

“কী কী দেখার আছে চুঁচুড়ায়?” জানতে চেয়েছিল রুদ্র।

“নদীর ধারে ষণ্ডেশ্বর শিবমন্দির আছে। বড়া ইমামবড়া আছে।” পাঁচু বলেছিল।

“হ্যাঁ, ইমামবড়ার কথা পড়েছিলাম। হাজি মহম্মদ মহসীন বানিয়েছিলেন। এইট্টিন্থ সেঞ্চুরির খুব বড় একজন সমাজসেবী। হুগলী মহসীন কলেজও ওঁরই তৈরি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ও অনেক দানধ্যান করেছিলেন। আর কী কী আছে?”

তখন জয়ন্ত মুখ খুলেছিল, “বাঁশবেড়িয়ার দিকে এগোলে রয়েছে হংসেশ্বরী মন্দির। রাজা নৃসিংহ দেব রায় বানানো শুরু করেছিলেন, শেষ করেন তাঁর ছোটরানী শঙ্করী দেবী। দেখতে যাবেন ম্যাডাম? আমার বাড়ির কাছেই।”

রুদ্র তখন হাসি চেপে বলেছিল, “নাহ, আপাতত ডি এম অফিসটাই দেখি চলো। সেটাও তো হেরিটেজ বিল্ডিং। পরে বাকিগুলো দেখা যাবে।”

হুগলীর জেলাশাসক এখন একজন তরুণী। বয়সে রুদ্রর চেয়ে বছরদশেকের বড় হবেন। পাঞ্জাবের মেয়ে। নাম গুরশরণ কৌর। কিন্তু প্রথম থেকেই বেঙ্গল ক্যাডার বলে বাংলাটা খারাপ বলেন না। প্রকাণ্ড ঘরের একেবারে মাঝখানে বিশাল টেবিলের ওই প্রান্তে বসে কথা বলছিলেন তিনি।

রুদ্রর বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠছিল।

ইশ! কেন ও আর একটু ভালো করে পড়ল না? তাহলে আই এ এস টা পেয়ে যেত! এইভাবেই একটা গোটা জেলার দায় ভার থাকত ওর ওপরে।

পরক্ষণে নিজের মনেই ও নিজেকে সান্ত্বনা দিল। চাহিদার কোন শেষ নেই। যখন ব্যাঙ্কে চাকরি করতে, কখনো ভেবেছিলে যে আই পি এস হবে? হয়েছ তো? যা হয়েছ, তাতেই খুশি থাকো। দুটোই দেশের সেবা। জনগণের সেবা। সেই কাজে মনোযোগ দাও।

ডি এম ম্যাডাম ভাঙা বাংলায় বললেন, “মিসেস সিংহরায়, আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি? এটা ভীষণ ডেলিকেট একটা সিচুয়েশন।”

মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে এল রুদ্র, “ইয়েস ম্যাডাম।”

রুদ্রর বস শ্রীরামপুরের এস পি রাধানাথ রায় এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার বললেন, “রুদ্রাণী, তুমি যদি ভালো করে অ্যানালাইজ করো, দেখবে, এই পাঁচটা খুনই কিন্তু হয়েছে হুগলীতে।”

রুদ্র আবার ঝুঁকে পড়ল সামনে রাখা কাগজটার ওপর।

 রুদ্রর আজ সকালেই সেই পুরোনো খবরের কাগজে পড়া খবরটা মনে পড়ে গেল। তার মানে সেই কাগজটা ছিল ১৩ই মে’র দু’দিন পরের। ও মুখ তুলল, “কিন্তু এই পাঁচটা মার্ডার যে একই সুতোয় বাঁধা, তা আপনি ধরে নিচ্ছেন কী করে?”

“মিঃ রায়, রুদ্রাণীকে প্লিজ এক্সপ্লেইন করুন।” জেলাশাসক ম্যাডাম এস পি রাধানাথ রায়ের দিকে তাকালেন।

রাধানাথ রায় বললেন, “দ্যাখো রুদ্রাণী। এমন কোনো ক্লিয়ার এভিডেন্স আমরা এখনো পাইনি যা থেকে বলা যেতে পারে যে এই সবকটা খুনের মধ্যে কোনো যোগসূত্র রয়েছে। খুনের ধরনও একরকম নয়। কাউকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করা হয়েছে তো কাউকে ছুরি মেরে। কিন্তু ডি এম ম্যাডামের মতে, লিঙ্ক এটাই, যে প্রত্যেকে ব্যবসায়ী। আর এই পাঁচটা খুনের ক্ষেত্রেই লোকাল পুলিশ সেভাবে কোনো প্রোগ্রেস করে উঠতে পারছেনা। তাই আমরা খুব চিন্তিত। চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেট থেকেও চাপ আসছে। আমরা তাই চাইছি লোকাল থানা যেমন তদন্ত করছে করুক, কিন্তু একটা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশান টিম তৈরি করা হোক যেটা বিশেষভাবে এই খুনগুলোর তদন্ত করবে। তুমি নতুন এসেছ, সেভাবে কোন ডিপার্টমেন্ট তোমার এখনো অ্যালোকেটেড নেই। তাই আমরা চাই, তুমিই এই টিমটা লিড করো। হুগলী জেলার সবকটা থানা তোমায় সহযোগিতা করবে।”

জেলাশাসক শুনছিলেন। এস পি থামতেই বললেন, “মিসেস সিংহ রায়, এমনিতেও আপনার পুলিশ সার্ভিস জয়েনের আগের কিছু অ্যাচিভমেন্টের রিপোর্ট আছে আমাদের কাছে। ভেরি কমেন্ডেবল। আমার মনে হয়, এই কেসের জন্য আপনি আইডিয়াল হবেন।”

রুদ্র বলল, “অ্যাজ ইউ অর্ডার ম্যাডাম। আমার টিমে কে কে থাকবেন?”

এস পি রাধানাথ রায় বললেন, “আমরা তিনজনকে নমিনেট করেছি। প্রত্যেকেই ইয়ং এবং এফিশিয়েন্ট। তবে তুমি চাইলে নিজের মতো কাউকে বেছে নিতে পারো।”

“আমি আর ক’জনকে চিনি?” রুদ্র কাঁধ নাচাল, “এই ক’মাস তো শুধু অফিসেই বসে রয়েছি। আপনারা যাদের সিলেক্ট করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই স্যুটেবল হবেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

“ভেরি গুড।” রাধানাথ রায় বললেন, “উত্তরপাড়া থানার এস আই বীরেন শিকদার, শেওড়াফুলি থানার ওসি লোকেশ ব্যানার্জি আর শ্রীরামপুর সাব ডিভিশনের সেকেন্ড অফিসার প্রিয়াঙ্কা চন্দ। এঁরাই তোমার টিম মেম্বার।”

রুদ্র মাথা নাড়ল। এদের মধ্যে ও শুধু প্রিয়াঙ্কাকেই চেনে। বেশ করিৎকর্মা মেয়ে। ও বলল, “অল রাইট স্যার। শুধু সঙ্গে আমার গার্ড জয়ন্তকেও ইনক্ল্যুড করলে ভালো হয়। হোমগার্ড হলেও ও খুব কমপিটেন্ট।”

“বেশ। কোনো অসুবিধা নেই। বীরেন শিকদার বাইরে অপেক্ষা করছেন।” এস পি বললেন, “ওঁর কাছে সব ক’টা মার্ডারের ফাইল রয়েছে। তুমি দেখে নিয়ে কাজ শুরু করে দাও।”

“ওকে স্যার!” রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকল।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে জেলাশাসক ডাকলেন, “মিসেস সিংহরায়!”

রুদ্র চমকে তাকাল।

জেলাশাসক বললেন, “যদিও এটা পুলিশ ম্যাটার, প্রশাসনিক পদে থেকে আমার এতটা সরাসরি ইনভলভ হওয়াটা হয়তো একটু আনইউজুয়াল লাগছে। কিন্তু আমার জেলায় এইভাবে বিজনেসম্যান মার্ডার হওয়া নিয়ে আমাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গতকাল হোম সেক্রেটারি নিজে ফোন করে ইনভেস্টিগেশনের প্রোগ্রেস জানতে চেয়েছেন। আসলে একদম শেষে যিনি খুন হয়েছেন, ওই কোন্নগরের ব্যবসায়ী বেশ ইনফ্লুয়েনশিয়াল। আপনি এখনো প্রোবেশনে আছেন। পুলিশ কমিশনার চাইছিলেন অভিজ্ঞ কাউকে এই দায়িত্ব দিতে। কিন্তু আমি এবং এস পি মিঃ রায় একটু ঝুঁকি নিয়েই আপনাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন।”

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নাড়ল।

জেলাশাসক হাসলেন। বললেন, “অল দ্য বেষ্ট!”

বীরেন শিকদার, লোকেশ ব্যানার্জি, প্রিয়াঙ্কা চন্দ এবং জয়ন্ত সমাদ্দার। এদের মধ্যে লোকেশ ব্যানার্জিকে বাদ দিলে সকলেরই বয়স ত্রিশ বত্রিশের নীচে। লোকেশবাবুর বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু পেটাই চেহারা। ভদ্রলোক বৈষ্ণব, পুলিশ উর্দিতেও দু’চোখের ঠিক মাঝখানে রসকলি আঁকা।

জয়ন্ত আর প্রিয়াঙ্কা একেবারেই অল্পবয়সি। তারুণ্যের নিয়ম মেনে উৎসাহে ভরপুর। জয়ন্ত কাল থেকে বারকয়েক রুদ্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেলেছে। নিজের পদমর্যাদার চেয়ে অনেক ওপরের এক টিমে ওকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ও রীতিমতো উত্তেজিত। এই কাজ ওর সার্ভিস রিপোর্টে একটা উজ্জ্বল পালক যোগ করবে।

আজ ওরা সবাই এসেছে রুদ্রর বাংলোর অফিসে। নিজের বাংলোতেই ছোট একটা অফিসঘর আছে ওর, জরুরি প্রয়োজনে সেই অফিসঘর ব্যবহার করা হয়।

রুদ্র খুঁটিয়ে সবকটা কেস পড়ছিল। বলল, “প্রথমেই বলি, এই পাঁচটা মার্ডার হয়েছে পাঁচটা আলাদা জায়গায়। লোকাল থানা তার তদন্ত করছে। আমাদের সেটা কাজ নয়। আমাদের এই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের কাজ হল এই পাঁচটা কেসের মধ্যে কী লিঙ্ক আছে বা আদৌ কোনো লিঙ্ক আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করা। যাতে পুনরাবৃত্তি আটকানো যায়। তাই তো?”

“ইয়েস ম্যাডাম!” বীরেনবাবু বললেন।

“আপনারা আমার আগেই প্রতিটা কেস স্টাডি করেছেন। বীরেনবাবু তো সরাসরি যুক্ত রয়েছেন কোন্নগরের মার্ডারের তদন্তে। তা এই পাঁচটা কেসে কী কী কমন বিষয় খেয়াল করেছেন আপনারা?”

প্রিয়াঙ্কার সবেতে একটু বেশি উৎসাহ। বলল, “ম্যাডাম! পাঁচজনই বিজনেসম্যান!”

“কারেক্ট! আর?”

“পাঁচজনই পুরুষ।”

“এত তুচ্ছ মিলগুলোই চোখে পড়ছে? আর কিছু নজরে আসছেনা?”

প্রিয়াঙ্কা এবার চুপ করে গিয়ে ভাবতে লাগল।

জয়ন্ত বলল, “প্রত্যেকটা খুনই হয়েছে রাতের বেলায়।”

“এটা একটা ভালো অজারভেশন।” রুদ্র গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আমি যতটুকু নোটিশ করেছি তা থেকে তিনটে পয়েন্ট পেয়েছি। সেগুলো আগে বলি। ত্রিবেণীর শিবনাথ বিশ্বাস খুন হয় শীতকালে। তার ছিল সাইবার ক্যাফের ব্যবসা। পোস্ট মর্টেম বলছে, কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পেটে একাধিকবার কোপ দেওয়া হয়। সম্ভবত ছুরি। মার্ডার ওয়েপন স্পটে পাওয়া যায়নি। পাশেই গঙ্গা, নদীতে ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

“লোকাল থানা তদন্ত করতে গিয়ে দেখে, তার দোকানে পাড়ারই একটি ছেলে কয়েক মাস আগে অবধি কাজ করত। নাম রাজু। কিন্তু তাকে শিবনাথ ছাড়িয়ে দেয়। পুলিশ খুনের আগের দশদিনের কলরেকর্ড ঘেঁটে দেখেছে, তার সঙ্গে শিবনাথের স্ত্রী আরতির নিয়মিত কথা হত। রাজু আরতির সম্ভাব্য প্রেমিক, এবং দুজনে মিলে শিবনাথকে খুন করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু রাজুর একটি স্ট্রং অ্যালিবাই রয়েছে। খুনের দু’দিন আগে থেকে পরের পাঁচদিন সে ত্রিবেণীতে ছিল না। একটা ট্যুর এজেন্সির হয়ে লোক নিয়ে গিয়েছিল পুরীতে। প্রপার এভিডেন্সের অভাবে এখনো অবধি তাই আরতি ও রাজুকে গ্রেফতার করা যায়নি।

“চন্দননগরের মহম্মদ তারেক মোবাইল ফোনে রিচার্জ করত, সে খুন হয় তার গুমটি দোকানেই। পোস্টমর্টেম অনুযায়ী রাত বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে। তার স্ত্রী আমিনা বিবি জানিয়েছে, তার মদ, গাঁজা আরও নানারকম নেশা ছিল। এই নিয়ে বাড়িতে ঝামেলা হত। সেইজন্যই প্রায়দিনই সে রাতেরবেলা গুমটিতেই কাটাত। এক্ষেত্রে কিন্তু খুনের ধাঁচ আলাদা। কোনো সরু দড়ির ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করা হয়। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। মহম্মদ তারেকের যাদের সঙ্গে চেনাজানা ছিল, বা পুলিশি রেকর্ড, কারুর সঙ্গেই সেই দড়ির ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলেনি।

“এরপর খুন হল বৈদ্যবাটির সুনীল ধাড়া। তার অবস্থা ভালো। বৈদ্যবাটি স্টেশন রোডে চশমার দোকান। ছোট হলেও বেশ চালু। দু-তিনজন ডাক্তারও বসেন। একজন কর্মচারীও রয়েছে। সুনীল যেদিন খুন হয়, সেদিন অবশ্য ওর কর্মচারী দানু দোকানে ছিল না। তার একদিন আগেই দোল গিয়েছে, সেই উপলক্ষ্যে সে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে গিয়েছিল। সুনীল ধাড়া দোকান বন্ধ করে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। সেইসময়েই একটা অন্ধকার গলির মধ্যে কেউ তাকে পেছন থেকে চেপে ধরে। তারপর পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। সুনীল ধাড়া সাঁতার জানত না। পরেরদিন সকালে তার লাশ পুকুরের জলে ভেসে ওঠে। তার মুখে গামছা বাঁধা ছিল, যাতে চেঁচাতে না পারে।

“চুঁচুড়ার হৃষীকেশ জয়সোয়ালের বাড়ি ঘড়ি মোড়ের পেছনে। তিনি প্রোমোটার। বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট বানিয়েছেন। খুন হওয়ার আগে তিনি বানাচ্ছিলেন গঙ্গার ধারে একটা বেশ অভিজাত আবাসন। অনেক টাকা লগ্নি করেছিলেন তাতে। প্রোমোটারদের শত্রু থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জয়সোয়ালেরও নিশ্চয়ই ছিল। যাইহোক সেদিন রাতে তিনি হঠাৎই বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। তাঁর গাড়ির ড্রাইভার বাড়ি চলে গিয়েছিল, তাই তিনি একটা অটোরিকশা করে পৌঁছন গঙ্গাপাড়ের সেই নির্মীয়মাণ আবাসনে। অটোরিকশা তাঁকে ফেরত চলে যায়। আবাসনটির তখন সবে একতলার গাঁথনি তৈরি হয়েছে। সেই ভিতের মধ্যেই একটা বিমে তাঁকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখা যায়।”

“তবে তো ম্যাডাম, সুইসাইডও হতে পারে!” কথার মাঝখানে বলে উঠলেন লোকেশবাবু।

রুদ্র বলল, “সুইসাইড করার হলে ভদ্রলোক বাড়িতেই করতে পারতেন। বাড়ি থেকে অতদূরে গিয়ে করবেন কেন? আর তাছাড়া আপনি কি রিপোর্টটা ভালো করে পড়েননি? হৃষীকেশ জয়সোয়ালের হাতদুটো বাঁধা ছিল। বাঁ হাতের পাঞ্জার সঙ্গেও দড়ি বাঁধা ছিল। ডান হাত ছিল দেহের সঙ্গে সমান্তরালে। আত্মহত্যা করলে বাঁধা থাকবে কি করে? আর ফরেনসিক রিপোর্টেও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, শ্বাসরোধ করে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাওয়া যায়নি জয়সোয়ালের মোবাইলটিও। পুলিশ ট্র্যাক করেছিল, তাঁর কাছে আসা শেষ ফোনটা করা হয়েছিল চুঁচুড়া স্টেশনের একটা টেলিফোন বুথ থেকে।”

রুদ্র একটানা কথা বলে একটা লম্বা নিশ্বাস নিল। তারপর চেয়ারে হেলান দিল, “আর কোন্নগরে স্বপন সরকার ছিলেন গাড়ির শোরুমের মালিক। যথেষ্ট ধনী ব্যক্তি। গঙ্গার ধারে বিশাল বাড়ি। তাঁকেও একলা বাড়িতে গলার নলি কেটে খুন করা হয়। এক্ষেত্রেও মার্ডার ওয়েপন পাওয়া যায়নি।”

গোটা ঘরটায় বিরাজ করছে থমথমে নিস্তব্ধতা। সবাই চুপ করে শুনছে ঊর্ধ্বতন কর্তীর কথা।

রুদ্র বলল, “এবার এই কেস স্টাডি থেকে আমি কী কী নোটিশ করেছি বলি।’

“এক, প্রথম দুজনের কাজের জায়গা ভাঙচুর করা হয়েছে। কেস ডিটেইলে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, শিবনাথ বিশ্বাসের সাইবার ক্যাফের একটা কম্পিউটারও আস্ত ছিল না। সাইবার ক্যাফেতে কোনো সিসিটিভি ছিল না। কিন্তু, এটা পরিষ্কার যে, শিবনাথকে খুন করে তার থেকে চাবি নিয়েই দোকানটা খোলা হয়।”

“কেন ম্যাডাম?” এতক্ষণে মুখ খুলল জয়ন্ত, “এমনও তো হতে পারে, শিবনাথ দোকানে বসে কাজ করছিল। হয়তো কোনো টাকাপয়সা সংক্রান্ত ঝামেলা ছিল কারুর সঙ্গে, সে এসে দোকানের মধ্যেই খুন করে।”

রুদ্র সপ্রশংস চোখে জয়ন্তর দিকে তাকাল। বলল, “হ্যাঁ তা হতেই পারত। কিন্তু হল না ফাইলে লেখা একটা সেন্টেন্সের জন্য। দ্যাখো। এখানে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, ডেডবডি যখন পাড়ার লোকে আইডেন্টিফাই করে, তখনও স্কুটির ইঞ্জিন গরম। এবং কম্পিউটারগুলো ভাঙলেও দোকানের শাটার কিন্তু ভাঙা ছিল না। বন্ধ করা ছিল। এক্ষেত্রে একটাই সম্ভাবনা যে, শিবনাথ বেরিয়েছিল, কিন্তু স্কুটিতে স্টার্ট দেওয়ার সময়েই ওকে আক্রমণ করা হয়। আর তারপর চাবিটা নিয়ে দোকান খোলা হয়।”

জয়ন্ত মাথা নাড়ল।

“নেক্সট দ্যাখো। মহম্মদ তারেকের রিচার্জের গুমটিতে বিক্রি হওয়া মোবাইল চার্জার, হেডফোন সেট সব কিছু ছেঁড়া ভাঙা ছিল। এমনকি, গুমটির দেওয়ালের দরমায় আটকানো রিচার্জ প্ল্যানের অফারগুলো পর্যন্ত কুটিকুটি করা ছিল। এর মানে কী? কেউ বা কারা এদের ব্যবসার ক্ষতি করতে চাইছে।”

“কিন্তু আমরা যদি ধরে নিই, যে পাঁচটা খুন একই লিঙ্কে যুক্ত, তাহলে সুনীল ধাড়ার চশমার দোকান ভাঙচুর করা হল না কেন? স্বপন সরকার-র গাড়ির শো-রুমই বা বাদ গেল কেন?”

রুদ্র গভীরভাবে ভাবছিল। এমন সময় ঘরে ঢুকল মল্লিকাদি। মাথায় একহাত ঘোমটা। হাতে ট্রে। ট্রে’র ওপর কফি, বিস্কুট। সবাই একে একে কাপ তুলে নিতে মল্লিকাদি চলে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলল, “দাদাবাবু কাজে বেরোনোর আগে আমায় বলে গেলেন, আজ যেন রাতের রান্নাটা আমিই করি। আপনি একটু জ্যোৎস্নাদি’কে বলে দেবেন দিদিমণি?”

রুদ্র হাসি চেপে বলল, “জ্যোৎস্নাদি কোথায়?”

“ক্ষমার খাতা শেষ হয়ে গেছে। কিনে আনতে গেছে।” মল্লিকাদি আড়ষ্ট গলায় ঘোমটার ফাঁক দিয়ে বলল।

ক্ষমাকে অনেক কষ্টে অ থেকে ঔ পর্যন্ত শিখিয়েছে প্রিয়ম। এবার সেটার বারবার মহড়া চলছে। খাতা কিনতে যাওয়ার সংবাদে রুদ্র মনে মনে খুশি হল। মেয়েটার মধ্যে পড়াশুনোর প্রতি আগ্রহ গড়ে তোলা খুবই জরুরি।

“আচ্ছা, এলে পাঠিয়ে দিও, বলে দেব। তুমি যাও এখন।” রুদ্র এদিকে ফিরল, “জয়ন্ত, তুমি জিজ্ঞেস করলে, পেছনে একই ক্রিমিনাল থাকলে সুনীল ধাড়া বা স্বপন সরকারের ব্যবসার ক্ষতি করা হয়নি কেন? যে কোনো চশমার দোকানে সিসিটিভি থাকে আজকাল। আর স্বপন সরকার-র গাড়ির শো-রুমে তো থাকবেই। এটাও তো হতে পারে, সেজন্যই খুনি ঝুঁকি নেয়নি। এদের ক্ষেত্রে টার্গেট করছে অন্য জায়গা। তারেক বা শিবনাথের মামুলি দোকান, তাদেরটাই শুধু ভেঙেছে। একই কথা প্রযোজ্য জয়সোয়ালের ক্ষেত্রেও। তাঁর প্রোমোটারির অফিসেও নিশ্চয়ই গার্ড বা ক্যামেরা আছে। তাই তাঁকে কোনোভাবে ওই ইনকমপ্লিট আবাসনে নিয়ে যেতে হয়েছে।”

জয়ন্ত বলল, “প্রত্যেকে ব্যবসায়ী হলেও এই পাঁচজন সমাজের নানাস্তরের মানুষ। যেমন, শিবনাথ আর মহম্মদ তারেক বেশ অভাবী। সুনীল ধাড়া মোটামুটি স্বচ্ছল। অন্যদিকে হৃষীকেশ জয়সোয়াল আর স্বপন সরকার সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ। স্বপন সরকার’র তো এইবারের পুরসভা ভোটে দাঁড়ানোরও কথা ছিল। শাসক দলের হয়ে। তাছাড়া উনি বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠনেরও হর্তাকর্তা ছিলেন।”

বলল, “স্বপন সরকার বা হৃষীকেশ জয়সোয়ালের শত্রু যে বা যারা হবে, তারা কেন খুচরো ব্যবসায়ী মহম্মদ তারেক বা নির্বিবাদী ওষুধ ব্যবসায়ী সুনীল ধাড়ার শত্রু হবে? এই মোটিভটা খুঁজে বের করাই হবে আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি।”

রুদ্র আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ওর টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। ফোনে কয়েক সেকেন্ড মাত্র কথা বলে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াল, “মাই গড। বলতে বলতেই ছ’নম্বর খুন। আবার ত্রিবেণী। ভট্টাচার্য পাড়ার ব্রিজেশ তিওয়ারি।”

“অ্যাঁ! আমার বাড়ির পাশের গলিতেই তো।” চোখ বড় বড় করে বলল জয়ন্ত, “লোকটার ইনভার্টারের দোকান। আমি ওর দোকান থেকেই কিনেছিলাম আমার বাড়িরটা।”

রুদ্র বলল, “হ্যাঁ। আজ সকাল থেকে দোকান খুলছিল না। একটু আগে আশপাশের দোকানদাররা এসে দেখে, শাটার নামানো থাকলেও খোলা। তোলার পর দেখা যায়, ঘরের মধ্যেই পড়ে আছে। সেই একই মোডাস অপারেন্ডি। গলার নলি কাটা। আর আশপাশের তিন-চারটে ইনভার্টারের ব্যাটারি ভাঙা। গতকাল রাতেই মার্ডার হয়েছে। চলুন, আমাদের এখুনি স্পটে যেতে হবে!”

সবাই উঠে বেরোতে যাচ্ছিল, শুধু রুদ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই টেবিলে লেটারপ্যাডে কী যেন কাটাকুটি করছিল। মুহূর্তের মধ্যে পিছু ডাকল ও, “এক সেকেন্ড শুনুন সবাই। আমার তিন নম্বর পয়েন্টটা বলা হয়নি এখনো। ছ’টা খুনের তারিখগুলো দেখুন। ১৫ই জানুয়ারি, ১২ই ফেব্রুয়ারি, ১১ই মার্চ, ১৫ই এপ্রিল, ১৩ই মে এবং গতকাল ১০ই জুন। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকান। তারিখগুলো দেখে কিছু বুঝতে পারছেন?”

সবাই দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল।

কেউ কিছু বলার আগে প্রথম মুখ খুললেন লোকেশ ব্যানার্জি। সবার আগে তিনি আঙুল উঁচিয়ে অস্ফুটে বললেন, “প্রতিটা দিনই বুধবার!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *