গীতা কেন – ৯

নয়

কৃষ্ণকে ভক্ত পূজা করবে কেন? তিনিই ব্রহ্মভক্তকে মুক্তি পর্যন্ত দিতে পারেন। অবশ্য অন্য সব দেবতাই দেবমণ্ডলীতে উচ্চ আসনে পৌঁছেছেন। এই মুক্তি দেবার ক্ষমতার বলেই। এবং তাঁদের ভক্তরা তাঁদের ব্রহ্মরূপ বলেই স্তব করেছেন। কিন্তু গীতায় কৃষ্ণ যেমন বারেবারে নিজের ব্রহ্মত্ব প্রতিপাদন করেছেন, এঁরা তা করেননি। পূর্বে কৃষ্ণপূজার কোনও ইতিহাস ছিল না বলে গীতা নানা ভাবে তা নির্মাণ করল। এবং এমন ভাবে করল যা সহজে সকলেই গ্রহণ করে পালন করতে পারে। কৃষ্ণ দাবি করেন, ‘মৃত্যুকালে যে ব্যক্তি আমাকে স্মরণ করে দেহত্যাগ করে, সে আমার ভাবে প্রলীন হয়, এতে কোনও সংশয় নেই।’ (৮:৫) এ সম্বন্ধে খানিকটা যেন অলৌকিক ও কুসংস্কারধর্মী কথাই বলা আছে: ‘মৃত্যুকালে অচলা ভক্তি ও যোগবলে যে ব্যক্তি দুই ভ্রূর মধ্যে প্রাণকে স্থাপন করে [প্রাণত্যাগ করে], সে সম্যক দিব্য পরম পুরুষকে প্রাপ্ত হয়।’ (৮:১০) এমন কথাও আছে, যে, যে ভাবে ভাবিত হয়ে ভক্তি এবং যোগবলে যুক্ত হয়ে দেহত্যাগ করে, সে সেই-সেই দিব্যধামে আশ্রয় পাবে। এই ধরনের কথা যোগশাস্ত্রে, হঠযোগেও বলা আছে। কৃষ্ণ সেগুলি ব্যবহার করে নিজের পূজা প্রতিষ্ঠা করছেন। ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভুবনে মানুষ পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু আমার শরণাগত যে মানুষ তার আর পুনর্জন্ম হয় না।’ (৮:১৬) ‘পুনর্জন্ম দুঃখের ব্যাপার এবং অশাশ্বত। আমার শরণাগত যে মানুষ, তার আর এই পুনর্জন্ম হয় না। কারণ, সে পরম সংসিদ্ধি লাভ করে।’ (৮:১৫) এই পরম সংসিদ্ধি হল, অব্যক্ত এবং অক্ষয় যা লাভ করলে আর ফিরে আসতে হয় না। সেই আমার পরমধাম।

সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় মিলে একটি কল্প। কৃষ্ণ বলছেন, ‘সমস্ত জীবই আমার প্রকৃতি প্রাপ্ত হয় আবার কল্পের শুরুতে আমি তাদের সৃষ্টি করি।’ (৯:১৭) কল্পের শেষে, এই অর্থে তিনি স্রষ্টা। মহাভারত ও পুরাণে শিব ও ব্রহ্মাণ্ড স্রষ্টা, ব্রহ্মার নির্দেশে কখনও শিব, কখনও বিষ্ণু সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করেন, কিন্তু গীতায় কৃষ্ণই স্বয়ং স্রষ্টা। স্বয়ং প্রণোদিত হয়ে— কারও নির্দেশে নয়— তিনি সৃষ্টি করেন। এটা কৃষ্ণের উৎকর্ষ ও ক্ষমতা প্রতিপাদন করবার জন্যই। এই শক্তিমান স্বয়ংস্রষ্টা কৃষ্ণকে জানে ক’জন? কৃষ্ণ বলছেন, ‘মূর্খরা এই মানুষরূপী আমাকে অবজ্ঞা করে; ভূতমহেশ্বরত্বই যে পরম রূপ তা তারা জানে না।’ (৯:১৩) এই কৃষ্ণ তাই বলেন, ‘আমি সমস্ত দেবতাদের ও মহর্ষিদের আদি।’ (১০:২) এ ধরনের বহু শ্লোকে কৃষ্ণ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বদেবতাদেরও ঊর্ধ্বে এক অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করেন। এমন কথাও বলেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছুতে ঐশ্বর্য বা বিভূতি আছে, শ্রী আছে, বীর্য আছে— জেনো তা সবই আমার অংশ থেকে উদ্ভূত।’ (১০:৪) অর্থাৎ কৃষ্ণের বাইরে ভাল কিছুই নেই।

এই কৃষ্ণকে পাবার উপায় কী? তিনটি মার্গ চালিত ছিল: জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি। তিনটিই কৃষ্ণ গ্রহণ করেন। মূর্খরা মানুষের রূপে দেখে কৃষ্ণকেই তাঁর স্বরূপে চেনে না, তাই অবজ্ঞা করে। কৃষ্ণের উপাসনা যেমন পাতা, ফুল, ফল, জল দিয়েও হয় তেমনি শুদ্ধ ভক্তি দিয়ে, জ্ঞানচর্চা দিয়ে যজ্ঞ, পূজা ইত্যাদি কর্ম দিয়েও সাধিত হয়। কিন্তু কৃষ্ণের সবচেয়ে প্রিয় হল আত্মসমর্পণের দ্বারা উপাসনা। তার মধ্যে ভক্তের অহং একেবারে কৃষ্ণে সমর্পিত হবে, তার জীবনের যা কিছু তাৎপর্যপূর্ণ, মূল্যবান তা সবই কৃষ্ণে সমর্পিত হবে এবং এই সর্বাত্মক আত্মসমর্পণই কৃষ্ণের পূজা। এই পূজা প্রবর্তন করাই গীতার প্রধানতম উদ্দেশ্য। ‘আমিই তোমার মন জুড়ে থাকব। আমার ভক্ত হও, আমারই যজনা করো, নমস্কার করো আমাকে। এ ভাবে একান্ত ভাবে আমারই উপাসনা করে তোমার আপন আত্মা আমাতে যুক্ত করলে আমাতেই তুমি লীন হবে।’ (৯:৩৪) কৃষ্ণে লীন হওয়াই গীতার কৃষ্ণ আরাধনার শ্রেষ্ঠ লক্ষ্য। পরে অন্যান্য দেবতার উপসনাতেও এই একান্ত আত্মবিলুপ্তি অনুসৃত হয়, গীতাই এ পথ দেখায়।

যজ্ঞে আত্মসমর্পণের ব্যাপারই ছিল না; ছিল স্তব এবং বিধিসম্মত ক্রিয়াকাণ্ড। জৈনধর্মে প্রথম মহাবীরের ধ্যান এবং বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধের ধ্যান ধর্মোপসনার প্রধান অঙ্গ। এ সবের অনেক পরে গীতা, অর্থাৎ এ সব যখন দেশের সমস্ত প্রস্থানের মধ্যে অঙ্গাঙ্গী ভাবে ঢুকে গেছে তখন গীতা এ সবকে নিজের পদ্ধতির মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করে নিয়েছে। ততদিনে দেশে কোথাও কিছু কিছু যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বটে, কিন্তু উপাসনার পদ্ধতি হিসেবে যজ্ঞ প্রায় বিলীন। যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে পূজা তখনও ব্যাপক ভাবে ব্রাহ্মণ্য সমাজে প্রচলিত হয়নি। যদিও প্রাগার্য সমাজে নানা রূপে পূজা চলিত ছিল এবং সমাজে তার প্রভাবও পড়েছিল। তবুও পূজা তখনও সমাজে আরাধনার প্রধান রূপ হিসাবে গৃহীত হয়নি। তাই কৃষ্ণের বিধানে পূজার কথা নেই, আছে সর্বান্তঃকরণে কৃষ্ণভক্তি ও কৃষ্ণে আত্মসমর্পণ। এটা সহজ হয়েছিল দর্শন প্রস্থানগুলির প্রবল প্রভাবে; এগুলিতে তো অনুষ্ঠানের কিছু নেই, বিমূর্ত চিন্তার আলোচনা। তাই কৃষ্ণ আরাধনার মধ্যে আচার অনুষ্ঠান কম। আছে নামজপ, ধ্যান, আত্মসমর্পণ। অবশ্য পরে আঞ্চলিক ভাবে কৃষ্ণের নানা অবতারের উপাসনার সঙ্গে নানা ‘মিথ’ (কল্পকথা) যুক্ত হয়ে উপাসনাকে বহু-অঙ্গবিশিষ্ট জটিল পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করে। সমাজে প্রবল ভাবে আছে ছ’টি দর্শনপ্রস্থান। এ ছাড়া বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক এবং অন্যান্য প্রাগার্য পূজাপদ্ধতি অনুসারে নানা বিচিত্র দেবতার উপাসনা হচ্ছে এবং দর্শনের চর্চা হচ্ছে যেগুলির অধিকাংশের মধ্যেই দেবতা অনুপস্থিত। এই বিচিত্র মত ও পথের কোলাহলের মধ্যে— লোকে বলে— গীতা একটা সংহতি আনার চেষ্টা করেছে এবং অনেকে বলেন, এটা সার্থক হয়েছে।

আমাদের বিবেচ্য হল, গীতা এ চেষ্টায় কতটা সার্থক হয়েছে। গীতা রচনার অনেক আগে থেকে সমাজের কোনও কোনও অংশে পূজা প্রচলিত ছিল, গীতার যুগের পরে সে পূজাই নানা রূপ নানা উপচারে প্রায় একমাত্র আরাধনা পদ্ধতি হয়ে উঠল। কিন্তু এই সবের অনেক ওপরে স্থান হল কৃষ্ণের, যে কৃষ্ণ ব্রহ্মস্বরূপ, অতএব যাঁর ওপরে আর কেউ নেই, তাঁর কোনও পূজার পদ্ধতি নির্মাণ হয়নি। কিন্তু আভিজাত্যে ও উৎকর্ষে এই কৃষ্ণ অনন্য হয়ে উঠলেন। এই প্রতিষ্ঠা পাবার পর ব্রহ্মস্বরূপ এই কৃষ্ণের সব নির্দেশ অমোঘ, অলঙ্ঘনীয় হয়ে উঠল।

তখনও কিন্তু অর্জুন এই কৃষ্ণের আজ্ঞা পালন করতে রাজি হলেন না। সাংখ্য, যোগ, বেদান্ত এ সব শাস্ত্র থেকে যুক্তি সংকলন করে কৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝালেন, যুদ্ধ করা তাঁর অবশ্য কর্তব্য। এখানে কৃষ্ণ বর্ণধর্মের প্রবক্তা: ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করে যুদ্ধে প্রতিপক্ষের নিধন সাধন করা তাঁর অবশ্য কর্তব্য, এর অন্যথা ঘটানো পাপ। কিন্তু সেই যে দ্বিতীয় অধ্যায়ে অর্জুন বলে রেখেছেন, স্বজনহত্যা বর্ণধর্মপালনের জন্যও তিনি করতে পারবেন না, সেখান থেকে কৃষ্ণের কোনও যুক্তিই তাঁকে সরাতে পারেনি।

অর্জুনের এই মনোভাবের জোরটা এসেছে দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে অহিংসার নীতি থেকে এবং অহিংসা প্রাধান্য পেলে যুদ্ধ হয় না। এই সব দর্শন প্রস্থানের থেকে সংকলন করে কৃষ্ণ অর্জুনকে ভাল ভাল তত্ত্ব শোনালেন, যাতে তিনি তাঁর বর্ণধর্মের কর্তব্যে প্রবৃত্ত হন, রাজ্যলাভের জন্য যুদ্ধ করেন। কিন্তু আঠারো অধ্যায়ের গীতার দশ অধ্যায় ধরে এই চেষ্টা চলার পরেও অর্জুন যেমন নিজের অবস্থানে অটল রইলেন, তখন গত্যন্তর না দেখে কৃষ্ণ অর্জুনের অনুরোধে তার সামনে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। একাদশ সর্গের এই বিখ্যাত বিশ্বরূপ-দর্শনের সূচনা হল। কিন্তু কৃষ্ণের স্বরূপ চর্মচক্ষে তো দেখা যাবে না। ব্যাপারটা আধ্যাত্মিক, তাই অধ্যাত্মদৃষ্টি চাই। তার জন্যও ব্যবস্থা হল, কৃষ্ণ অর্জুনকে দিব্যদৃষ্টি দিলেন, একমাত্র সেই দৃষ্টিতেই কৃষ্ণকে তাঁর যথার্থরূপে দেখা যাবে।

কী সেই যথার্থরূপ? এই অধ্যায়ের নাম বিভূতিদর্শন-যোগ, অর্থাৎ কৃষ্ণের মহিমা ও ঐশ্বর্য প্রদর্শনের অধ্যায়। মনে পড়ে, যিশুখ্রিস্টও শিষ্যদের সামনে তাঁর অলৌকিক ঐশ্বর্যমণ্ডিত স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং শিষ্যরা যথারীতি অভিভূত হন। কিন্তু এখানে বিশ্বরূপদর্শন ব্যাপারটাই বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অর্জুনের যুদ্ধে আপত্তি খণ্ডন করে কৃষ্ণের অনুগত করার জন্যই এর প্রবর্তন। ব্যাপারটার ভূমিকা হিসেবে কৃষ্ণ অর্জুনকে মোহগ্রস্ত করবার জন্য একটা ভূমিকা করেন: দেখো, আদিত্য, বসু, রুদ্র, অশ্বিনরা, মরুৎত্রা (অর্থাৎ সব গণদেবতারা) এখানে একত্র হয়ে সর্বচরাচর-সহ সর্বজগৎ আমার দেহে সন্নিবিষ্ট। তোমাকে যে দিব্যদৃষ্টি দিচ্ছি, তার দ্বারা তুমি এটা দেখতে পাবে।

এর পরই অর্জুন দেখেন, ‘মহাকাশে সহস্র সূর্য উদিত হলে তার যা প্রবল দীপ্তি তা যদি একত্র হয়ে যায় সেই অত্যুজ্জ্বল দিব্য দীপ্তি …তোমার উজ্জ্বল খোলা মুখে বহুবর্ণ, বিশাল নেত্র দেখে ভয়ে আত্মা ব্যথিত হয়ে ওঠে। তোমার করালদন্তশোভিত মুখমণ্ডলে সে যেন কালাগ্নির সমান— দেখে দিকভ্রান্ত হয়েছি, মনে স্বস্তি পাচ্ছি না। হে দেবশ্রেষ্ঠ প্রসন্ন হও। ওই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সঙ্গে নানা দেশের রাজারা সেনাপতিরা ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ সঙ্গে আমাদের পক্ষেরও নানা বীর— তোমার করালদন্তযুক্ত মুখে প্রবেশ করছে। কেউ বা দাঁতের ফাঁকে আটকে আছে। …যেমন নদীসমূহের জল সমুদ্র অভিমুখে সর্বদা যায়, যেমন পতঙ্গরা জ্বলন্ত অগ্নি অভিমুখে ছুটে যায় বিনষ্টির জন্য তেমনই লোকেরা তোমার মুখে প্রবেশ করছে অন্তিম বিনাশের জন্য। তুমি আমাকে বলো, তুমি প্রকৃতরূপে কে?’

কৃষ্ণ বললেন, আমি লোকক্ষয়ের জন্য উদ্যত সেই মহাকাল, ত্রিলোকের সংহারের জন্য এখানে উদ্যত। তোমার কর্ম ছাড়াও এরা কেউ থাকবে না— এই যে এরা যুদ্ধে প্রবৃত্ত, এরা সকলেই বিনষ্ট হবে। অতএব তুমি ওঠো, যশ লাভ করো, শত্রু জয় করে সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ করো। আমি পূর্বেই এদের নিহত করেছি। সব্যসাচী তুমি নিমিত্তমাত্র হও। …তুমি যুদ্ধ না করলেও এরা কেউই থাকবে না। …আমি যাদের পূর্বেই বধ করেছি তাদের প্রকাশ্যে হত্যা করার জন্য তুমি ব্যথিত হয়ো না।’

কৃষ্ণ এবারে বললেন, এতকাল যা ছিল ধর্মাচরণ যেমন বেদপাঠ, যজ্ঞ, দান, তপস্যা, সেগুলি আর প্রয়োজনীয় নয়। তপস্যা ধ্যান এ সব দুঃসাধ্য। তাই তুমি সর্বান্তঃকরণে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করো। তা হলে কৃষ্ণের মধ্যেই তুমি অবস্থান করবে। অভ্যাসের চেয়ে জ্ঞান শ্রেয়, জ্ঞানের চেয়ে ধ্যান, ধ্যান অপেক্ষা শ্রেয় কর্মফলত্যাগ। এই ত্যাগ থেকে আসে শান্তি, মৈত্রী, করুণা, মমতা ও অহংকার ত্যাগ। দুঃখ-সুখে নির্বিকার চিত্ত— এ তো স্পষ্টতই বৌদ্ধ প্রভাবে রচিত।[১৯]

[১৯. অক্সফোর্ডের অধ্যাপক R C Zachner কথা প্রসঙ্গে আমাকে গীতায় বুদ্ধোত্তরতার কথা বলেছিলেন, ১৯৬৭ সালে।]

কৃষ্ণের কথা শুনে ভীত অর্জুন কৃতাঞ্জলিপুটে, গদগদ ভাবে বারবার কৃষ্ণকে প্রণাম করে বললেন: ‘হৃষীকেশ, এটা খুবই ন্যায্য যে তোমার কীর্তিতে জগৎ হৃষ্ট ও অনুরক্ত, সকলে তোমাকে নমস্কার করে। আর করবে নাই বা কেন? তুমি ব্রহ্মারও অধিক প্রাচীন। তুমি সৎ, অসৎ এবং তার পরেও যা থাকে তাই। বারংবার তোমাকে নমস্কার করি, সম্মুখে, পশ্চাতে সব দিক থেকে এই অনন্ত বীর্যবান, অনন্তবিক্রমী, সর্বব্যাপী তোমাকে প্রণাম করি।’

কৃষ্ণ বললেন, ‘বেদোক্ত যজ্ঞ, ক্রিয়া, তপস্যা দ্বারা এরূপ দেখা যায় না। তুমি ছাড়া আর কেউ এরূপ দেখতে পাবে না। তুমি ভয় পেয়ো না, দুঃখ পেয়ো না। এই রূপ একা তোমাকেই দেখিয়েছি। দেবতারা আমার রূপ দেখেননি। যে আমাতে নিবেদিত প্রাণ সে আমার এইরূপ দেখতে পায়।’ অর্জুনকে মনে রাখতে হবে, মৃত্যুতে জীবন শেষ হয় না, পরজন্মে তিনি পুরস্কৃত হবেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলেন ‘গীতার প্রথম তত্ত্ব আত্মার অবিনাশিতা। …দ্বিতীয় জন্মান্তরবার।…বাস্তবিক আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে যেমন কোনও প্রমাণ নাই, জন্মান্তর সম্বন্ধেও তদ্রূপ কোন প্রমাণ নাই।’ আত্মা অবিনাশী, এ কথা গীতায় বহুবার বহু ভাবে বলা হয়েছে, এ সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বলেন, ‘যাহা জানি না, যাহার প্রমাণাভাব তাহা মানিব না।’[২০] এই প্রবন্ধেই তিনি বলেন, ‘গীতাগ্রন্থখানি ভগবৎপ্রণীত নহে, কোনও ব্যক্তিই ইহার প্রণেতা।’ অথচ কৃষ্ণ অর্জুনের উক্তিপ্রত্যুক্তিতে প্রাধান্য কৃষ্ণের, ফলে পাঠকের মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, গীতার প্রণেতা কৃষ্ণই, ‘গীতা কৃষ্ণের ধর্মমতের সংকলন ইহাই আমার বিশ্বাস।[২১]

[২০. ‘শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা

২১. প্রাগুক্ত]

আগেই উল্লেখ করেছি, আজও কিছু মনীষী গীতার তত্ত্ব বিচার করে বলেছেন, গীতার তত্ত্ব হল সমাজে তৎকালে চলিত, ধর্ম ও দর্শন প্রস্থানগুলির সংক্ষিপ্ত সমাহার। এর মধ্যে দু’টি তত্ত্বই মুখ্য: প্রথমত যজ্ঞক্রিয়া, জপতপ, ধ্যান, পূজা এগুলি দ্বারা পুনর্জন্ম বোধ করা যায় না; যায় কেবল অচলা কৃষ্ণভক্তি দ্বারা। দেবতাদের পূজা তখনও স্পষ্ট ভাবে প্রবর্তিত হয়নি, প্রচলিত তো নয়ই। কিন্তু কৃষ্ণকে ব্রহ্মস্বরূপ শ্রেষ্ঠ দেবতা রূপে মেনে নেওয়ার মধ্যে এর লক্ষণীয় সূচনা।

মনে পড়ে, কোরানের ৭:১১ আয়াতে বিশ্বরূপদর্শনের অনুরূপ একটি অংশ আছে। বাইবেলে transfiguration বা যিশুর রূপান্তরে এর কাছাকাছি একটি বর্ণনা আছে।

এই বিশ্বরূপ দর্শনে কৃষ্ণ কী পেলেন, অর্জুনই বা কী পেলেন? দশটি সর্গ ধরে কৃষ্ণ নানা যুক্তি, অযুক্তি, কুযুক্তি দিয়েও অর্জুনকে বোঝাতে পারেননি যে, যুদ্ধ তাঁর করা উচিত। দ্বিতীয় সর্গে সেই যে অর্জুন অত্যন্ত মানবিক যুক্তিতে যুদ্ধের নামে অকারণ নরহত্যা, বিশেষত আত্মীয়সংহারে অসম্মত হলেন, তা অক্ষুণ্ণ ছিল দশম সর্গ পর্যন্ত। একাদশ সর্গের পরও তা ক্ষীণ ভাবে বিদ্যমান ছিল।

পণ্ডিত জে এল ব্রকিংটন অধ্যাপক রুডলফ অটোর উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, ভগবদ্‌গীতা নিশ্চয়ই অনেক পরবর্তী কালের রচনা, খুব সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের রচনা… রচনাশৈলী থেকে মনে হয়, এই বিশ্বরূপদর্শন অংশটি পরবর্তী মহাকাব্যশৈলীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, যে শৈলী কাব্যিক ভঙ্গিতে রচিত। এতে অর্জুনের সংশয়ের এবং কৃষ্ণের উত্তরের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। এটি নিশ্চয়ই একটি স্বতন্ত্র রচনা হিসেবে উদ্দিষ্ট ছিল, যেটি মূল মহাকাব্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল, মহাকাব্যের অন্য একটি স্তবরূপে নয়।[২২]

[২২. ‘The Bhagavadgita must be considerably later, more like the first century CE. The structure of the text seems almost more consistent with the later epic part of the text, since it contains a brief statement of Arjunas dilemma and not just Krisnas answer to it, if must have been intended as a separate composition and not another layer added to the epic part.’]

বিশ্বরূপদর্শন অংশটি নানা কারণেই একটি স্বতন্ত্র রচনা বলে মনে হয়। প্রথমত, সমগ্ৰ গীতার যে গতিধারা তার সঙ্গে এটি এক সুরে বাঁধা নয়। বাকি গীতা প্রশ্নোত্তর প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা বা উপদেশ। এর মধ্যে প্রশ্নোত্তরপর্ব হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের অযৌক্তি জাদুক্রিয়ার প্রবর্তন করলেন কৃষ্ণ। এবং অবাক কাণ্ড, যে-অর্জুন যুক্তির কাছে নতিস্বীকার করেননি, তিনি এই জাদুতে অভিভূত হয়ে স্বজনহত্যায় সম্মত হয়ে গেলেন। তা হলে দাঁড়াল এই যে, যুক্তি কৃষ্ণের অস্ত্র নয়, বা ব্যর্থ অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত অর্জুন কৃষ্ণের তথাকথিত যুক্তি পরম্পরাকে বস্তুত অগ্রাহ্য করে বা তাতে যথার্থ ভাবে কর্ণপাত না করে যে আপত্তির প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন, জাদুবিদ্যার আঘাতে সে প্রাচীর শতধা চূর্ণ হয়ে গেল। এমনও হওয়া খুবই সম্ভব যে, কৃষ্ণ ও অর্জুনের অবস্থান ও যুক্তি বা বক্তব্য তখনকার সমাজের মানুষের দু’টি অংশের প্রকৃত মনোভাব। বর্ণাশ্রমধর্মে একান্ত বিশ্বাসী অধিকাংশ মানুষ কৃষ্ণকে সমর্থন হয়তো করছিলেন। আর তার পূর্ব যুগের জৈন-বৌদ্ধ মতের অহিংসা, করুণা, মৈত্রী এগুলি অন্য এক অংশের মনোভাব। গীতায় তার দ্বন্দ্ব প্রতীকী ভাবে রূপায়িত হয়েছে। এবং যেমন প্রায়ই হয়— যুক্তি হার মেনেছে অলৌকিকতার কাছে। মানুষের গৌরবজনক মননসত্তা বিহ্বল হয়ে মাথা হেঁট করেছে জাদুবিদ্যার কাছে। অর্জুন বর্ণধর্মপালনের নামে স্বজনহত্যায় অসম্মত হলেন। তার পরের ছয় সর্গে সাংখ্য, বেদান্ত, ন্যায় ইত্যাদির নজির দেখিয়ে অর্জুন যে ‘না’ বলেছিলেন, কৃষ্ণ বহু চেষ্টাতেও সেটাকে ‘হাঁ’র সম্মতিতে পরিবর্তিত করতে পারেননি। অর্জুন নানা বিষয়ে জানতে চেয়েছেন: কৃষ্ণ শাস্ত্র এবং আপাত যুক্তি দিয়েও অর্জুনকে টলাতে পারেননি। এইবারে কৃষ্ণ যুক্তিতর্কের পরিসরের বাইরে এসে শেষ অমোঘ অস্ত্রটি প্রয়োগ করলেন: জাদুবিদ্যার দ্বারা অর্জুনের মনন ও চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে, মায়াজালে তাঁকে আবদ্ধ করে, তাঁর অভিভূত জাদুতে বিহ্বল মোহাচ্ছন্ন চেতনার সম্মতি অপকৌশলে আদায় করে নিলেন।

কৃষ্ণ পেলেন অর্জুনের সর্বান্তঃকরণে আত্মসমর্পণ। কিন্তু ওই বিশ্বরূপদর্শনে কবিত্ব নেই, অতিশয়োক্তি আছে। সব কিছুকেই অতিশয়িত করে দেখানো। জীবজন্তু, মানুষ, দেবতা এ সব কিছুই বৃহদাকার সকলেই কৃষ্ণের মুখগহ্বরে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে আতঙ্ক আছে, কিছু বা বীভৎসাও। আর আছে মানুষ কৃষ্ণের দেবত্ব, আলৌকিকত্ব। রক্তমাংসের মানুষ এই অলৌকিক প্রকাশে অভিভূত। যে কৃষ্ণ এমন অলৌকিক, অসামান্য শক্তিধর তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়া মানুষ অর্জুনের পক্ষে আর সম্ভব হল না। ছয় সর্গের নানা যুক্তিতর্কেও অর্জুন নিজের অবস্থান থেকে সরেননি। এ বার বিশুদ্ধ অলৌকিক দৃশ্যে অর্জুন কেমন যেন বিহ্বল, অভিভূত হয়ে পড়লেন। যুক্তি মননের বাইরে এই জাদু-দর্শন তাঁকে জানাল, কৃষ্ণ ঠিক তাঁর (অর্জুনের) মতো মানুষ নন, তিনি অন্য, ঊর্ধ্বতর লোকের এক মানবাকার; দেবতাদের ঊর্ধ্বে স্বয়ং ব্রহ্মসদৃশ অতিদেবতা। এঁর কাছে আনুগত্য ও প্রণিপাত এবং সর্বাত্মক আত্মসমর্পণ ছাড়া অর্জুন আর কোনও অবস্থান নিতে পারেন না।

এতে অর্জুনের সংশয়ের উক্তিও সংক্ষেপে বলা আছে, শুধুই কৃষ্ণের উত্তর নেই। এটি নিশ্চয়ই একটি স্বতন্ত্র রচনা হিসেবে সংকলিত হয়েছিল, মহাকাব্যের একটি স্তর হিসেবে সংযোজিত হয়নি। বিশ্বরূপদর্শন ছাড়াও বহু অংশে গীতা ঠিক দার্শনিক প্রবন্ধ বা আলোচনা নয়, বরং স্থানে স্থানে গীতিধর্মী এবং কতকাংশে কাব্যধর্মী রচনা। দার্শনিক রচনা হিসেবে এর তেমন কোনও সংহতি নেই, যেমনটা দর্শনপ্রস্থানগুলির মূল গ্রন্থে পাওয়া যায়। বিশ্বরূপ-দর্শনের মধ্যে প্রকৃত দর্শন প্রায় অনুপস্থিত, এতে বিস্ময় ও শ্রদ্ধা পাবার উপাদানই মুখ্য। এবং এ চেষ্টা সম্পূর্ণ সার্থক হয়েছে। জাদু প্রদর্শনীর যা অভিপ্রেত সেটি পুরোপুরি সফল হয়েছে। যুদ্ধে অনিচ্ছুক অর্জুন কৃষ্ণের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য দেখিয়ে যুদ্ধ করতে উদ্যত হলেন। কারণ, সুদীর্ঘ যুক্তিমালায় অর্জুন একেবারেই নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেননি, কিন্তু যে জাদু যুক্তিবহির্ভূত তার সামনে অর্জুনের কোনও প্রতিরোধের অস্ত্র নেই, তাই সম্পূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণ করলেন। এর পর কৃষ্ণ পূজ্যদেবতা, অর্জুন ভক্ত পূজারি।

বিশ্বরূপদর্শন দার্শনিকতা স্পষ্টতই নেই। দার্শনিকতায় যুক্তিগুলির একটা পারম্পর্য থাকে, প্রথমটি থেকে দ্বিতীয়টি আসে। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়। তা ছাড়া যুক্তিগুলির মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে। গীতা যে অংশগুলি সরাসরি দর্শনসূত্র থেকে নিয়েছে, সেখানে পারম্পর্য ও কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। বিবক্ষিতকে প্রসঙ্গের অনুগত করবার জন্য যেখানে ব্যাখ্যার চেষ্টা আছে সেখানে পারম্পর্য বা কার্যকারণযোগ সর্বত্র নেই। ধর্মের অন্যান্য দিক— ভক্তি, আরাধনা ইত্যাদিও মুখ্যত উপস্থিত নেই। যা আছে তা হল, কৃষ্ণকে সর্বশ্রেষ্ঠ দেবাদিদেবের মর্যাদা দেওয়া। এর উপায় হল, সমস্ত বর্ণনাটিকে বহুগণিত করে তোলা— সমস্ত দেবতা, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ ও অন্যান্য প্রাণিকুল তাঁর মুখগহ্বরে প্রবেশ করছে এবং কৃষ্ণ তাদের ধ্বংস করছেন। অর্থাৎ এ পর্যন্ত যত দেবতা ও উপদেবতা সমাজমানসে উপাসিত হতেন, তাঁদের সকলেরই বিনাশসাধন করেন কৃষ্ণ। এ যেন পূর্বের তাবৎ পূজ্যদেব ও উপদেবতাকে কৃষ্ণ আত্মসাৎ করেছেন। তাই বাকি রইলেন একা কৃষ্ণ, যিনি ব্রহ্মস্বরূপ, অতএব একমাত্র পূজনীয়। তাঁর আজ্ঞা অমান্য করা যায় না, তাই অর্জুন যুদ্ধে আপত্তি বা তাঁর বর্ণধর্মপালনে অসম্মতি প্রত্যাহার করে নিলেন। যথার্থ অর্থে গীতার পরিসমাপ্তি এখানেই যদি গীতার এই গঠন মনে রাখি, তা হলে মহাভারতে গীতার স্থান নিয়ে একই অসঙ্গতির কথা ওঠে। মহাভারতে যুদ্ধে উদ্যত দু’পক্ষ— কৌরব-পাণ্ডব যখন যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত, রণসজ্জায় সজ্জিত, শুধু শঙ্খধ্বনিটি হলেই হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, ঠিক তখনই অষ্টাদশ সর্গ গীতার তিন ঘণ্টাব্যাপী কথোপকথন অস্থানপ্রযুক্ত। এই গীতার স্থান এখানে হতে পারে না। গীতার অভিধানগত অর্থে, যদি সুরে গাওয়া হয়, তা হলে তো সাত আট ঘণ্টার ব্যাপার আর সি জেহনারের গীতা অনুবাদের শেষের দিকে পড়ি, ‘আমাকে মনে রাখবে, ভালবাসবে এবং উপাসনা করবে। যজ্ঞ করো। আমার সামনে প্রণত হও। তবে তুমি আমার কাছে আসবে, এ আমার প্রতিশ্রুতি। সত্যই, কারণ তুমি আমার প্রিয়।’ (১৮:৬৪-৬৫)[২৩]

[২৩. ‘Bear me in mind, love me and worship me / Sacrifice, prostrate thyself to me / So shall thou come to me. I promise thee / Truly, for thou art dear to me. ‘ -R C Zancer Introduction to the translation of the Bhagabadgita, p. xx.]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *