গীতা কেন – ৫

পাঁচ

কৃষ্ণ ও অর্জুন দু’জনেই মহাভারতের দুই মুখ্য চরিত্র। কৃষ্ণ মহাভারত ছাড়াও হরিবংশে, নানা পুরাণে ও বৈষ্ণবগ্রন্থে চিত্রিত এবং এ সব চিত্রের কোনও সংহত রূপ নেই। একই ব্যক্তি বৃন্দাবনের রাজকুমার, গোপালদের সখা, পাণ্ডবদের বন্ধু, রাধার প্রণয়ী, গোপীদের প্রেমিক এটা কল্পনা করা দুষ্কর হলেও শাস্ত্র সমবেত ভাবে তাই করেছে। কিন্তু এই জটিল কৃষ্ণকে আমাদের প্রয়োজন নেই; আমাদের কাছে এটা যখন থেকে কৃষ্ণ অর্জুনের যুক্তি মত খণ্ডন করতে প্রয়াসী হন তখন থেকে ক্রমশই ব্যাপারটা একতরফা উপদেশের সংকলন হয়ে ওঠে। অর্জুনের আপত্তি ক্রমশই ক্ষীণ ও হ্রস্ব হতে থাকে। যেন বক্তা হচ্ছে কৃষ্ণ, অর্জুন নন। তিনি পরাজিত শ্রোতামাত্র। এইটেই গীতার গঠন ও রচনাপ্রণালী।

গীতার গঠনে শ্লোকছন্দ, যা সারা মহাভারতেরই। তা ছাড়া এখানে সংলাপের একটা ক্ষীণ বহিরাবরণ আছে কিন্তু প্লেটোর যে সংলাপ, উপনিষদে যে সংলাপ গীতায় তা একেবারেই অনুপস্থিত। এখানে প্রশ্ন বিরল, মৃদু, ক্ষীণ; উত্তর দীর্ঘায়িত এবং বলতে গেলে এই উত্তরগুলির সমাহারই গীতা। এই অংশে সাংখ্য, যোগ ও বেদান্ত এবং খানিকটা ন্যায় উপস্থিত— যে কারণে গীতার নিজের কোনও দর্শন নেই, হয়তো, খানিকটা বেদান্ত ছাড়া।

এ কথা ভুললে চলবে না যে, সাধারণ মানুষ দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, সদযুক্তি পরম্পরার দ্বারা কোনও দর্শন প্রস্থানকে গ্রহণ করতে পারে না তার অন্তর্নিহিত দুরূহতার জন্য। এর চেয়ে অনেক সহজে সে গ্রহণ করতে পারে নানা মতের সমাহারে নির্মিত একটি মতকে। এটাই গীতার জনপ্রিয়তার একটা কারণ। যে সমাজে বহুবিধ প্রায় পরস্পরবিরোধী নানা মতের সমাহার, কিন্তু সমন্বয় সমাস্থিত হলে একটি প্রবল শক্তিশালী কেন্দ্ৰীয় মত পাওয়া যেত এবং নানা প্রস্থানের মানুষ সেই কেন্দ্র ছত্রতলে আশ্রয় পেত; তা না হওয়ায় গীতায় তৎকালীন উত্তর ভারতের প্রাচীন ও অর্বাচীন নানা আঞ্চলিক মতের যুক্তি পরম্পরাহীন একত্র সমাবেশ ঘটেছে। এতে সব মতের লোকই নিজের বিশ্বাস ও আকর্ষণের নির্দেশ খুঁজে পায়। এতে সব প্রস্থানের মানুষ তার বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিও খুঁজে পায়। এই প্রশস্ত বহুধা-বিস্তৃত ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় গীতা কৃষ্ণের মধ্যে প্রধান ব্রহ্মৈকত্ব প্রচার করে। ফলে সামগ্রিক দৃষ্টিতে গীতা একটি বহু-মত-মিশ্র প্রস্থান হয়ে উঠেছে।

গীতায় ব্রহ্মসূত্রের স্পষ্ট প্রভাব আছে বেদান্তের মধ্যে দিয়ে— যে বেদান্ত এখানে অন্য দর্শন প্রস্থানগুলির তুলনায় যথার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। ব্রহ্মসূত্র বহু পূর্বতন দার্শনিক প্রস্থান থেকেই ধীরে ধীরে সংহত একটি রূপ পেয়েছে। বেদান্তের পরেই যোগ, ন্যায়, সাংখ্য মত গীতায় যথেষ্ট প্রাধান্য পেয়েছে। সাংখ্য বেদান্তের মধ্যে বটে এবং বাইরেও বটে। সে তুলনায় পূর্বমীমাংসা ও বৈশিষিকও গীতায় অনেকটাই অবজ্ঞাত; গৌণ ভাবেও এগুলি গীতার সঙ্গে যেন সম্পৃক্ত নয়। তেমনই নয় বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক ও বাহস্পত্য বা চার্বাক। অর্থাৎ তৎকালীন সমাজে যে প্রস্তাবগুলি বিশেষ ভাবে আলোচিত ও অনুসৃত হত, গীতা সেগুলিরই উল্লেখ ও আলোচনা করেছে। কোনও যুক্তিপরম্পরা বা দার্শনিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে ততটা নয়, যতটা সে এক পাঁচমিশেলি দর্শন হয়ে উঠেছে, যার মধ্যে তৎকালীন সমাজে পরিব্যাপ্ত বহু দর্শন প্রস্থানের দেখা পাওয়া যায়। এতে কিন্তু নিঃশেষ, পরিণত, একমাত্র গ্রহণীয় কোনও মতের প্রতিষ্ঠা হতে পারেনি।

এর লাভের দিকটা হল প্রায় প্রত্যেক প্রস্থানবাদীরা এর মধ্যে নিজেদের মত খুঁজে পান। কিন্তু একমাত্র বা অবিসংবাদী মত হিসেবে কোনওটিই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ফাঁকটার মধ্যে সব মতই নিজেকে খুঁজে পায়— কিন্তু একমাত্র গ্রহণযোগ্য বলে কোনও কিছু প্রতিষ্ঠিত হয় না। বেদান্তকেই গীতা শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছে, সম্ভবত কৃষ্ণকে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম বলে দেখাবার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে। প্রসঙ্গভেদে কৃষ্ণের বাগভঙ্গি যুক্তিনির্ভর থেকে, অনুনয়ের থেকে সহসা আদেশের ও নিযুক্তি ফতোয়া দেওয়ার সুরে পর্যবসিত হয়। এতৎসত্ত্বেও গীতায় নাটকীয়তা নেই, কারণ চরিত্র দু’টি সেই অর্থে পরস্পরবিরোধী হয়ে ওঠেনি। সমস্ত গীতার মধ্যে অর্জুন মাত্র দু’বার স্পষ্ট ও স্বতপ্রভাবে মত প্রকাশ করেছেন— দ্বিতীয় অধ্যায়ে যুদ্ধে যোগ দিতে আপত্তি করায় এবং একাদশ থেকে কয়েক অধ্যায়ে সম্পূর্ণ বংশবদ, অভিভূত ও দাসানুদাসের ভঙ্গিতে কথা বলে। এই সুরেই গীতা শেষ হয়। কৃষ্ণের স্বর প্রথম থেকেই গুরু-র— যে গুরু ভ্রান্ত বিপথগামী শিষ্যকে যুক্তির দ্বারা স্বমতে ও সত্য পথে আনবার জন্য চেষ্টা করছেন। সদগুরুর ভূমিকায় যে কৃষ্ণ, তাঁর ওপরে কোনও কথা অর্জুন বলতে সাহস পাননি, কারণ, কৃষ্ণ জ্ঞানীতম এবং তাঁর দাবি অনুসারে তিনি ব্রহ্মস্বরূপ। তুচ্ছ মানুষ অর্জুন কী সুবাদে এঁর সঙ্গে তর্ক করবেন? তাই গীতার শুরু থেকেই এ রকম বোঝা যায় যে, কৃষ্ণ যা বলবেন তাই গ্রহণীয়, যুক্তিগ্রাহ্য। এবং সত্য।

সখা ও সারথি মহাভারতে এই অংশে অর্থাৎ গীতায়, প্রাসঙ্গিক। মনে রাখতে হবে যে, শাস্ত্রে সারথিকে রথীর উপদেশ দিয়ে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করবার অধিকার দিয়েছে। তাই গীতার শুরুতেই কৃষ্ণ সারথিধর্ম অনুসারে অর্জুনকে তাঁর বর্ণধর্ম অনুসারে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেন। যুদ্ধটা ছিল হস্তিনাপুরের সিংহাসনের অধিকার নিয়ে কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে অধিকারের দ্বন্দ্ব। ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠ হলেও, অন্ধ বলে সিংহাসনে অধিকার নেই; তাঁর পুত্র দুর্যোধনের এক ধরনের অধিকার ছিল সিংহাসনে; কিন্তু অন্ধ অর্থাৎ বিকলাঙ্গ রাজার পুত্র হিসেবে তা নাকচ হয়ে যায়। অতএব তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা পাণ্ডুর পুত্রদের অধিকার আসে। এ অধিকার দুর্যোধন স্বীকার করতে নারাজ। কৃষ্ণ অর্জুন ও তাঁর ভাইদের অধিকার মানেন বলেই তাঁর কাছে এটা ধর্মযুদ্ধ; কৌরবদের দাবি ধর্মসম্মত নয়, পাণ্ডবরাই ধর্মত সিংহাসনের অধিকারী। ক্ষত্ৰিয় হিসাবে অর্জুনের ধর্ম হল নিজের এবং ধর্মত অন্য অধিকারীর ন্যায্য প্রাপ্য পেতে সাহায্য করা, প্রয়োজন হলে তার জন্যে যুদ্ধ করা এমনকী প্রাণ দেওয়াও। এই ধর্মনির্দেশ অনুসারে কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে প্রেরণা দেন।

অর্জুন কৃষ্ণের বর্ণ ধর্মনির্দেশ মানতে সম্মত নন, কারণ তাঁর কাছে বর্ণধর্মের ওপরে আর একটি ধর্ম আছে— মানবধর্ম। আত্মীয়বন্ধুদের হত্যা করে যে সিংহাসন ধর্মত লাভ করা যায় তা বর্ণধর্ম অনুসারে সঙ্গত হলেও মানবধর্মের বিরোধী। এতেই প্রায় প্রমাণ রয়েছে যে, গীতায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব আছে— মৈত্রী, করুণা ও অহিংসার প্রভাব ব্যাপক ভাবে উত্তর ভারতে প্রচারিত ও প্রসারিত হচ্ছিল। উৎকর্ষে কিছুকাল ধরে অন্যান্য ধর্মমতের ঊর্ধ্বে শ্রেষ্ঠ একক ধর্ম বলে উচ্চ আসন পেয়ে আসছিল। অর্জুনের আপত্তিতে এই বৌদ্ধ প্রভাবের নিগূঢ় ধ্বনি শোনা যায়।

গীতার রচনাকালের বহু পূর্বে বুদ্ধ ভারতীয় সমাজে অন্য একটি ধর্ম বা বর্ণধর্মের ঊর্ধ্বে সেই মানবধর্মকে ব্যাখ্যায়, শ্রেষ্ঠ বলে উপস্থাপিত করে গেছেন। এই মানবধর্মেরই সেই যুক্তিগুলিই অর্জুন নানা ভাবে কৃষ্ণের বর্ণধর্মের এবং তার দ্বারা লভ্য ধন, মান, যশ, বিজয় ও সিংহাসনের অনেক ঊর্ধ্বে স্থাপিত করছেন। বৌদ্ধধর্ম সমাজে তখন পূর্বের চেয়ে বিরল হয়ে এলেও কোথাও কোথাও বর্তমান আছে এবং বর্ণধর্মের ঊর্ধ্বে এক উচ্চকোটির লক্ষ্য বলে গণ্য হত। অধিকাংশের ধর্ম তখন ব্রাহ্মণ্য বর্ণধর্মের ধর্ম এবং কৃষ্ণের যুক্তির জোর অনেকটা এইখানেই। কিন্তু সব মানুষই অবচেতনে হলেও জানে যে মানবধর্ম, যার প্রতিষ্ঠা অহিংসা মৈত্রীর ওপরে, তাই তা শ্রেষ্ঠ। কাজেই খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রভাব আটশো বছরে কতকটা ক্ষীণ হয়ে এলেও সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়নি। তাই কৃষ্ণ-অর্জুনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা সমাজে দৃশ্যমান দু’টি মতাদর্শের দ্বন্দ্ব। কৃষ্ণ যা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন তা অনেকগুণে তরল হয়ে এলেও তখনও জাজ্জ্বল্যমান একটি মত। এবং অর্জুন যা বলছেন তা তৎকালীন উদীয়মান একটি ধর্মপ্রস্থান। যাদের সুখে রাখবার জন্য যুদ্ধ করে সিংহাসন লাভ করার প্রশ্ন উঠছে, যুদ্ধে তো সেই সব আত্মীয়বন্ধুদের প্রাণনাশ হবে; তা হলে কোন সুখের জন্য, কার সুখের জন্য অর্জুন যুদ্ধ করবেন? তাঁর কাছে এটা আর ধর্মযুদ্ধ রইল না, অধর্ম যুদ্ধ হয়ে উঠল, এবং তিনি তাতে অসম্মত হলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী-সহ কৌরবপক্ষ এবং বিপরীতে পাণ্ডবপক্ষ সুসজ্জিত, শুধু শঙ্খধ্বনিটি হলেই যুদ্ধ শুরু হয় সেই বিশেষক্ষণে এই অষ্টাদশ অধ্যায়ের গীতা শুধু কৃষ্ণ অর্জুনের বিতণ্ডা। বলা উচিত অর্জুনের আপত্তি প্রথমে স্পষ্ট ও অবিচল থাকলেও কৃষ্ণ ক্রমশই একে একে দর্শন প্রস্থানগুলির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইছেন। অর্জুনের যুক্তি আপাত ভাবে ক্ষীণতর হলেও তার পশ্চাতে সর্বজনীন অহিংসা ও মৈত্রী থাকায় সেগুলি আপাত ভাবে খণ্ডনীয় হলেও দৃঢ় সর্বকালীন মহত্তর বিশ্বাসের মহিমা তার মধ্যে লিপ্ত আছে। হায়, সেই কারণে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ যুক্তিমার্গ ছেড়ে অলৌকিকতার আশ্রয় নিলেন। এ নয় যে, কৃষ্ণ সব সময় যুক্তিগ্রাহ্য বা সত্য কথা বলেন। তিনি যে বলেন, চারটি বর্ণ তাঁরই সৃষ্ট এবং তা গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে নির্মিত, তা তো শাস্ত্রই খণ্ডন করে। ঋগ্বেদে চতুবর্ণের ধারণা এল অনেক পরে, দশম মণ্ডলে। এবং তাও সম্পূর্ণ নয়। ইতিহাস জানে, বিজয়ী ও বিজিতের সংমিশ্রণে যে সব জনগোষ্ঠী তৈরি হয় তা আসে অনেক পরে। ঋগ্বেদের প্রথম দিকে গুণকর্ম নির্বিশেষে বর্ণ সৃষ্ট হয় এবং অনেক পরেও, ঋগ্বেদেই বর্ণগুলি কতকটা সঞ্চরণশীল ছিল। অর্থাৎ একই গোষ্ঠী স্থির নিষ্ঠিত ছিল না। কাজেই কৃষ্ণের দাবি ধোপে টেকে না।

তেমনই, কৃষ্ণ বলেন, বৈশ্য শূদ্র, নারী এরা স্বভাবতই অশুচি এবং এরা তাঁর শরণাপন্ন হলে শুচিতা লাভ করে। বলা বাহুল্য, নারীমাত্রই অশুচি এ কথা বেদের ধর্মসূত্রে থাকলেও স্বীকার করা যায়। যেমন বৈশ্য তো শাস্ত্রমতেই দ্বিজ, অতএব আর্যবর্ণ যজ্ঞেও তার অধিকার আছে। কৃষ্ণ এদের প্রথমে অশুচি বললেন, যেটা তখনই অশাস্ত্রীয় এবং তার পরে বললেন যে, বৈশ্যও তাঁর শরণাগত হলে শুচিতা পাবে। স্পষ্টতই এর প্রতিপাদ্য বিষয়টি শাস্ত্রের সঙ্গে মেলে না, কারণ বৈশ্য আর্যবর্ণ এবং স্বভাবতই শুচি— কৃষ্ণের সাহায্য ছাড়াই!

একটা বিশেষ কথা নানা ভাবেই কৃষ্ণ বলেন: কর্মফলত্যাগ একটি বিশেষ পূণ্য। দ্বাদশ অধ্যায়ে (ভক্তিযোগ) এক জায়গায় বলা আছে ‘অভ্যাসের চেয়ে জ্ঞান শ্রেয়, জ্ঞানের চেয়ে ধ্যান এবং কর্মফলত্যাগ ধ্যানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ অভ্যাস, জ্ঞান, ধ্যান যে ভাল তা সবাই জানত, যে নতুন কথাটি কৃষ্ণ এখানে যোগ করলেন তা হল, এ সবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হল কর্মফলত্যাগ। অবশ্য, ত্যাগ ও দান এ দু’টি কর্ম করেও কর্মফলত্যাগ, বস্তুত সর্বফলত্যাগ হল শ্রেষ্ঠ ধর্মাচরণ। কার্ল পটার বলেন, ‘ত্যাগ সম্বন্ধে সমস্ত ভারতীয় শাস্ত্রের মধ্যে গীতাই উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। নানা ধরনের ত্যাগের কথাই গীতায় আছে: যোগ্য অযোগ্য পাত্রকে দান, দুঃখী প্রার্থীকে দান, ত্যাগের দ্বারা দানকে মহিমান্বিত করা ও দেবতার উদ্দেশে দ্রব্যত্যাগ— এ সবই ধর্মবিধানে দান— মূল্যবান দান। সর্বোৎকৃষ্ট দান হল কর্মফল ত্যাগ অর্থাৎ কর্মফল দান। অতএব যজ্ঞের কাল থেকে দ্রব্যত্যাগ (নৈবেদ্য বা দান), একটি বিশেষ দানই; গীতার পূর্বেই একটি পুণ্যজয়ী দানের মহিমা বর্ণিত ছিল। গীতায় কয়েকটি নতুন দানের প্রবর্তন হয়। এর পরের যুগে আসবে (কৃষ্ণের) পূজা— ক্রমবর্ধমান নৈবেদ্যের সমাহারে যা নিষ্পন্ন হবে। এখন পর্যন্ত পত্রপুষ্প, জল, ফল (পূজাতে, এ সবই আছে, আরও অনেক কিছুই আছে) গীতা মানসিক ভাবে তার পূর্বপ্রস্তুতি করলেন।

অন্যত্রও শুনি, কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কখনওই তোমার অধিকার নেই। এখন সমাজে কৃষিজীবী হোক, নানা উৎপাদনে ও উচ্চ বর্ণত্রয়ীর সেবা শ্রমিকই হোক, এরা কর্মী এবং এদের কর্ম হল উৎপাদন: কৃষিতে ফসল এবং অন্যত্র কামার, কুমোর, ছুতোর, জেলে, গোয়ালা দ্রব্য উৎপাদন করে যা তাদের শ্রমের ফল। কৃষ্ণ বলছেন, ওই কর্মটাতেই এদের অধিকার, ফল যা উৎপন্ন হল তা এদের নাগালের বাইরে, তাতে এদের কখনও কোনও অধিকার নেই— এই হল কর্মফলত্যাগ। তা হলে সমাজের বহুল ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা, দুঃসাধ্য কষ্টকর শ্রমে যাদের দিন কাটে তারা তাদের শ্রমের ফলে— ফসলে বা নির্মিত বস্তুতে অনধিকারী অর্থাৎ একদিকে তার মূল্যে অধিকারী নয়। প্রশ্ন আসে, তা হলে অধিকারী কে? সমাজ তখনই শ্রেণিবিভক্ত— অর্থাৎ একদিকে অসংখ্য হতদরিদ্র চাষি ও মজুর এবং অন্য দিকে মুষ্টিমেয় ধনী। এদের মধ্যে বণিকও ছিল। এই শেষোক্ত সম্প্রদায়ের হাতে অর্থ, অর্থাৎ প্রচুর বিত্তের সঞ্চয় ছিল এবং কৃষক শ্রমিকের শ্রমফলের অধিকারী তারাই। যদি না আগেই এরা অপর কাউকে কর্মফল ত্যাগ বা দান করে থাকে। তাই এত জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষ শ্রম করবে, কারণ, শুধু শ্রমেই (‘কর্মনি এব’) তাদের অধিকার। কিন্তু সে কর্মের ফলে তার অধিকার নেই— কখনওই নেই (‘কদাচ ন’)। এই কঠোর ভাষাতেই প্রমাণ যে, এখানে স্বার্থের সংঘাত ছিল, অনুমানে মনে হয়, হয়তো বা নীচের তলায় কিছু প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদও ছিল। যদিও গীতা কোথাও স্পষ্ট উচ্চারণে বলেননি শ্রমফলের অধিকারী কে, তথাপি সমাজে কর্মী (‘কর্মাণি’) ও উৎপাদক শ্রেণির যখন কখনওই (‘কদাচ ন’) শ্রমফলে অধিকার নেই, তখন প্রশ্ন আসবেই, তা হলে কার সেই অধিকার? অবশ্যই মুষ্টিমেয় ধনীর, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্যের বণিকের এবং ধনিকের। রোমিলা থাপার বলেন, ভোগী স্বাধীন ব্যক্তি সর্বদাই (অর্থাৎ তারা অন্যের কর্মের ফল ভোগই করে); কখনও তার উৎপাদক নয়।[১৩] ধন তখন পুঞ্জিত হচ্ছিল এদের হাতে। সেটাকে সুরক্ষিত করার জন্য এত কড়া হুকুমনামা। বৌদ্ধ সমাজেও ওপরতলায় যখন বাণিজ্যের রমরমা, কাজেই বৌদ্ধদের কাছেও এ কথা অত্যন্ত স্বাগত। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ধনিকের স্বার্থ সংরক্ষণে এ সব কথা যে কত মূল্যবান ছিল, কাজেই কত যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তা বোঝাই যায়। আজও গীতার মধ্যে এই শ্লোকটিই সবচেয়ে বেশি মুখে মুখে ঘোরে ও হয়তো সবচেয়ে জনপ্রিয়।

[১৩. From Lineage to State OUP, New Delhi 1985, p. 75]

কৃষ্ণের আর একটি প্রিয় বক্তব্য হচ্ছে, সমস্ত বিপরীত বিষয়ে ও সেগুলির সমাহারে সমান অবিচলিত থাকা। তাঁর উক্তি: পণ্ডিতরা জীবিত বা মৃত কারও জন্য শোক করেন না। জীবিত, রোগী না হলে লোকে তার জন্য শোক করবেই বা কেন? কিন্তু মৃত? আর সে মৃত যদি আত্মীয় বা প্রিয়জন হয়, তা হলে তার জন্য শোক না করাই তো অস্বাভাবিক। এই ধরনের আচরণে দীক্ষা দেন কৃষ্ণ। সমস্ত অবস্থায়— সদর্থক ও নঞর্থক— মানুষ যেন একই রকম অবিচলিত ভাব পোষণ করে; কৃষ্ণের তাই উপদেশ। মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও উৎকর্ষ কিন্তু ঠিক এর বিপরীতে। ছোট থেকে শেখানো হয়— শিশু, বালক, কিশোর, যুবককে— কোনটা ভাল, কেন ভাল, কোনটা খারাপ, কেন খারাপ। তারই সঙ্গে সে বিবেচনা করতে শেখে আরও ভাল আর আরও মন্দকে। সে জায়গায় কৃষ্ণের শিক্ষা হল ভাল-মন্দ, উৎকৃষ্ট-অপকৃষ্টকে সমান জ্ঞান করা। এ শিক্ষা হল মনুষ্যত্বের উন্নতির একান্ত বিরোধী। মানুষ মন্দকে মন্দ জেনে পরিহার করবে, ভালকে ভাল জেনে অনুসরণ করবে— এই পথেই তার চরিত্রের ক্রমবিকাশ ঘটবে। কিন্তু কৃষ্ণ বলেন: ‘সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু। সাধুম্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধিবিশিষ্যতে।’ (৬:৯) অর্থাৎ প্রিয়বন্ধু (সুহৃদ), বন্ধু, শত্রু, উদাসীন, (নিরপেক্ষ), দ্বেষের পাত্র, সাধু এবং পাপিষ্ঠের প্রতি যে সমদর্শী সেই বিশিষ্ট। এখানে সাধু ও পাপিষ্ঠকে সমদৃষ্টিতে দেখতে বলা হয়েছে। তা হলে বিশিষ্ট বক্তার কাছে পাপী ও পুণ্যবানের প্রভেদ নেই? থাকলেও উভয়কে এক বলে মনে করতে হবে? তা হলে শিশুকাল থেকে মানুষ যে ভাল-মন্দর, উৎকর্ষ-অপকর্ষের শিক্ষা পায় সেটা নিরর্থক? সকলকে সমান জ্ঞান করা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়। সকলের প্রতি অবিচলিত অথবা সমান আচরণ করাও বাঞ্ছনীয় নয়। অথচ এই হল গীতায় কৃষ্ণের উপদেশ।

মনে হয় দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রবল জোয়ারে ভেসে যাবার পর আদর্শ শ্রমণ ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের যে ভাবমূর্তি সৃষ্ট হয়েছিল সেইটি অনুপ্রাণিত করেছিল এই নিস্তরঙ্গ চিত্তবৃত্তির মানুষের, যে সুখেদুঃখে বিচলিত হয় না, পাপী পুণ্যবান যার কাছে সমান, শত্রুমিত্রের প্রতি যার সমান মনোভাব। এই আদর্শের অল্প কিছু মাত্র মানা যায়— সুখে দুঃখে অধীর হয়ে পড়াটা পরিশীলিত চিত্তবৃত্তির মানুষের পক্ষে লজ্জাকর। কিন্তু তাই বলে পাপী ও পুণ্যবানকে একদৃষ্টিতে দেখতে হবে? পুণ্যবানকে অপমান করা হয় না তাতে? এ ধরনের কোনও প্রশ্নই তোলা হয়নি একেবারে। কাজেই এ ভাবে দেখা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়। পাপ-পুণ্য, বিদ্বান-মুখ, শত্রু-মিত্র সব কিছুকেই সমদৃষ্টিতে দেখলে শত্রু-মিত্র, বিদ্বান, মূর্খ পুণ্যবানের মধ্যে কোনও প্রভেদ থাকে না এবং সেটা যথার্থ মানসিক শিক্ষা ও উৎকর্ষষের বিপরীতে। যথার্থ শিক্ষা তো জ্ঞান ও গুণের উৎকর্ষ-উপকর্ষ বিচার শেখায়, সব কিছুকে সমদৃষ্টিতে দেখলে দোষগুণ ও সেগুলির মাত্রা ও মান বিলুপ্ত হয়ে যায়। বেদে দেবরাজ ইন্দ্রের আচরণ একেবারেই সৎ নয়, সব সময়েই ইন্দ্ৰ কৌশলী— যেখানে মন্দ স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে।

বেদ থেকে মহাভারত পর্যন্ত এর বিরুদ্ধ শিক্ষাই দেয়। সেখানে নীতিজ্ঞানসম্পন্ন বিবেকবান মানুষ নির্মাণ করবার জন্যই সব উপদেশ। নানা উপাখ্যানের মাধ্যমে উৎকর্ষ-অপকর্ষের পরস্পর বিরুদ্ধতা দেখিয়ে সৎ ও বিবেকবান পুরুষের বিবর্তন দেখানো হয়েছে। এই নৈতিকতার নানা উৎকর্ষ-অপকর্ষ সম্বন্ধে বিশেষ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ব্যত্যয় দেখা গেছে পুরাণে এসে। যেখানে বহু উপাখ্যানে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য অন্যায় পথ ও অসৎ ভাবে অনুপ্রাণিত কর্মের সিদ্ধি দেখানো হয়েছে বারেবারেই। কিন্তু পুরাণে কোথাও ভাল-মন্দের প্রতি সমদর্শী হতে বলা হয়নি। বরং মহৎকে মহৎ দেখিয়ে মন্দ কাজে তাকে নিযুক্ত দেখানো হয়েছে। এই গীতাতেই শুধু কৃষ্ণের নৈতিকতার সংজ্ঞায় ভাল-মন্দ, সুনীতি-দুর্নীতি আচরণ করে যারা, তাদের প্রতি পণ্ডিতকে সমদর্শী হতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে যুদ্ধজয়ের পটভূমিকায় পাপ-পুণ্য সৎ-অসৎ সকলকেই একই দৃষ্টিতে দেখেই কৃষ্ণের পণ্ডিতদের কাছে একান্ত কাম্য বলা হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *