গীতা কেন – ১১

এগারো

প্রশ্ন হল, এর কী প্রয়োজন ছিল?

পণ্ডিতেরা মনে করেন, গীতার রচনাকাল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে। উত্তর ভারতে ওই সময়ে নানা দিক থেকে বহু বিদেশি আক্রমণ শুরু হয়— কুষাণ, শক, হুন, পারদ, মুরুণ্ড, আরও অনেকে। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস ও অনুষ্ঠান এবং সামাজিক আচরণ ছিল। এই নবাগতদের সমাজে স্থান দেওয়াটা একটা সমস্যার ব্যাপার ছিল।

এক দিকে রাজশক্তি অন্য দিকে পুরোহিতকূল মিলে এর যে সমাধান করেছিল, তারই অল্প বিস্তর পরিবর্তন করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল একটা নতুন সমাজনীতি যা সমাজে এক ধরনের সংহতি দিল। এর প্রতিবন্ধকও যেমন ছিল তেমনই প্রয়োজন ছিল। শক, হুন, পারদ, মুরুণ্ড, কুষাণ— এরা যখন উত্তর ভারতে দলে দলে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে প্রবেশ করল, তখন এদের নিয়ে নানা রকমের সমস্যা দেখা দিল। এরা ভারতীয় চার বর্ণের অন্তর্গত নয়, ফলে বর্ণবিভক্ত সমাজ এদের কোথায় স্থান দেবে তা ভেবে দেখতে হল। শক্তি, যোগ্যতা ও প্রবণতা দেখে এদের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের অন্তর্গত করে নেওয়া হল। মুশকিল হল, এদের কারও কারও সামাজিক আচরণ ছিল আর্যদের থেকে পৃথক। ১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বার্ডেসানেস (Bardesanes) রচিত গ্রন্থে উল্লেখ করা আছে, কুষাণদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে কোনও স্থির আনুগত্যের প্রশ্নই ছিল না। সেটা ছিল ক্ষণস্থায়ী অতএব পরিবর্তনশীল। কুষাণ-উচ্চপদস্থ রমণীরা ইচ্ছেমতো দাস বা ক্রীতদাসের সঙ্গেও মিলিত হতেন। পুরুষরাও।[২৫] অবশ্য পুরুষের এ স্বাধীনতা ভারতবর্ষের সব সমাজে ছিল। এখন ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন সমাজের রমণীরা যখন কুষাণ নারীদের এ স্বাধীনতা লক্ষ করলেন এবং দেখলেন এ আচরণের জন্য ওই নারীরা তাঁদের স্বামী বা সমাজ কারও কাছেই তিরস্কৃত হচ্ছেন না, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে তাঁরাও ওই আচরণের অনুসরণ করতে লাগলেন। বলা বাহুল্য, সমাজ এটা ভাল চোখে দেখল না, দোষবহ মনে করে তিরস্কার করতে লাগল।

[২৫. ‘Bardesanes, Book of the Land and Countries]

এই তিরস্কার গীতার প্রথম অধ্যায়েই কৃষ্ণের প্রতি অর্জুনের উক্তিতে শুনি; ‘স্ত্রীষু দুষ্টাসু বায়ে জায়তে বর্ণসঙ্করঃ। সঙ্করে নরকায়ৈর কুলঘ্রানাং কুলস্য চ। পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ।’(১:৪০-৪১) সমাজ কিন্তু নারীকেই দূষিতা মনে করে, পুরুষকে নয়। এ ছাড়া অন্যত্রও কৃষ্ণ বলেন, ‘মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য য্যেপি স্যুঃ পাপথোযয়ঃ। স্ক্রিনো, বৈশ্যাস্তথা শূদ্রায়স্তহপি যান্তি পরাং গতিম্।’ (৯:৩২) যারা পাপযোনি অর্থাৎ জন্মতেই পাপিষ্ঠ; যেমন নারী, বৈশ্য, শূদ্র— তারাও যদি আমাকে আশ্রয় করে তবে তারাও পরম অর্থাৎ শুভগতি প্রাপ্ত হয়। এখানে একেবারে নিশ্চিত ভাবে নারীকে জন্ম থেকেই পাপযোনি বলে উল্লেখ করা হল। বার্ডেসানেসের বইতে যেমন স্বাধীনচারিণী নারীর কথা আছে, তাদের প্রভাবে ভারতীয় নারীরা পতিব্রতা ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পরপুরুষগামী হলে বর্ণসঙ্কর হয় এবং তার থেকে যেন এক নিশ্চিত পরম্পরাক্রমে কুলনাশ, পিতৃপুরুষের পিণ্ডনাশ, অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও সে অমঙ্গল সঞ্চারিত হতে থাকে। কোথাও একবারও উল্লেখ নেই যে, একটি পুরুষকেও এর সূত্রপাতে সম্পৃক্ত থাকতে হয়েছে। অর্থাৎ নারী জন্ম থেকে এবং নারী বলেই স্বাভাবিক ভাবে পাপিষ্ঠ। আর আছে শূদ্র; গীতায় বারবার এ শ্রেণিটির হীনতা সমাজে অধম অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। শুধু গীতায় নয়, বেদের শেষাংশ থেকে রামায়ণ মহাভারত ও পরবর্তী কালে পুরাণগুলিতে বারবার শূদ্রের অশুচিতা প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

চারটি বর্ণের মধ্যে সবচেয়ে নীচে শূদ্র, যার একমাত্র কর্তব্য ওপরের তিন বর্ণের— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের সেবা করা। অবশ্য বৈশ্যও তার সামান্য মান্যতা হারিয়েছিল এই সময়ে; পাপযোনিদের তালিকায় তার স্থান হয়েছে। তবে সাধারণ ভাবে শূদ্র হল দাসবর্ণ। অতএব সমাজে তার কোনও স্থান নেই, সে থাকবে সবার নীচে, সবার পিছে। ছিলও তাই, সম্ভবত নিষ্প্রতিবাদেই, তবে এ কথা নিশ্চিত ভাবে জানা যায় না, কারণ, যা বাস্তবের অনেক বেশি স্পষ্ট প্রতিবিম্ব— সেখানে অনেকবার শূদ্রের অসন্তোষ, প্রতিবাদী মনোভাব দেখা গেছে। তবু শূদ্র তিন বর্ণের পদসেবা করার জন্য নির্দেশিত।

অথচ এই শূদ্র ছিল সংখ্যাগত ভাবে সমাজের প্রকাণ্ড এক অংশ, বহুবিধ বৃত্তিতে নিযুক্ত। কৃষি থেকে নানা কর্মকুশলতা, কুম্ভকার, কর্মকার, নাপিত, ধোপা, ইত্যাদি অসংখ্য কাজ যা ছিল সমাজের নিত্যপ্রয়োজনীয়, তা নির্বাহ করত শূদ্র। অর্থাৎ শূদ্র ছাড়া বাকি সমাজের একদিনও চলত না। শূদ্র অবশ্য দু’রকমের— জল-চল ও জল-অচল। দুইয়ে মিলে এই বৃহৎ কর্মসংস্থা সমাজের পক্ষে অপরিহার্য। অথচ সমাজের পায়ের তলায় তার স্থান হল। আরও সমস্যা হল, বিদেশ থেকে আগত জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে আসা তাদের শ্রমিকদের নিয়ে তাদের স্থান হত শূদ্রের সঙ্গে।

ঠিক তেমনই অন্যান্য জাতির পুরোহিত সম্প্রদায়কে কোনও রকমে গ্রহণ করল এখানকার সমাজ। এ নিয়ে যে কত সমস্যা হয়েছিল তার বিবরণ পাই পুরাণে। ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পথে যুদ্ধে যারা জয়ী হত, তারা সহজেই ক্ষত্রিয় পর্যায়ে স্থান পেত, যেমন বিধর্মী পুরোহিত ধীরে ধীরে ভারতীয় ধর্ম-সংস্কার আচার-আচরণ স্বীকার করে ও প্রয়োগ করে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠত। প্রণালীটা শুনতে যত সহজ মনে হয়, আসলে তেমন ছিল না; বহু বিরুদ্ধতা, খণ্ডযুদ্ধ, সংঘাত পেরিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যেত। বিদেশ থেকে আগত মানুষদের ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে শেষ পর্যন্ত প্রয়োজন হত রাজার সমর্থনের। কাজেই ইতিহাসের এই পর্যায়ে রাজার প্রতাপ অপ্রতিহত হয়ে উঠল। যে একটা সংহতি গড়ে উঠল তা দীর্ঘদিন ধরে নানা সংঘাতের মধ্যে দিয়ে নির্মিত হল। এর জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একজনের সমর্থন ও সিদ্ধান্ত যার ওপরে আর কেউ নেই এবং যার কথা শেষ পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য হবে। সেই পুরুষকে ওই ভাবে নির্মাণ করল গীতা, সেখানে তিনি পুরুষোত্তম কৃষ্ণ, যাঁর ফতোয়া অলঙ্ঘনীয়। এটার একান্ত প্রয়োজন ছিল সমাজে অত্যাবশ্যক সংহতির জন্য।

এর জন্য দু’টি জিনিসের প্রয়োজন ছিল: একটি মতাদর্শ, অপরটি একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি মতাদর্শের প্রবক্তা বা প্রতীক। গীতায় কৃষ্ণের উক্তির মধ্যে মাঝে মাঝেই নারীর অবদমন বৈশ্য, শূদ্র ও নারীর পাপযোনিত্ব অর্থাৎ কলুষিত উৎপত্তি উল্লেখ করা হয়েছে। নারীর পরে পাপযোনি বৈশ্য ও শূদ্র। ততদিনে বৈশ্য কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্যে নিযুক্ত; এগুলি সমাজের জীবনের পক্ষে অত্যাবশ্যক। এবং নতুন বিধানে এরাই হয়ে গেল পাপযোনি। মতটি সম্পর্ণ বেদবিরুদ্ধ, অন্তত বৈশ্যের ক্ষেত্রে, কারণ বেদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য ছিল আর্যবর্ণ অর্থাৎ উপনয়নের অধিকার এদের ছিল এবং এরা যজ্ঞে অংশ নিত। সেই বৈশ্য এখন হয়ে গেল পাপযোনি— দূষিত। অথচ অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য দুয়েতেই এরা সক্রিয় কর্মী। তা ছাড়া যে কৃষির উপরে সমাজ খাদ্যের জন্য নির্ভরশীল সেই কৃষিতেও এরা নিযুক্ত। অর্থাৎ কৃষি ও বাণিজ্য যা সমাজকে বাঁচিয়ে রাখে, সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায় তারা এখন গীতায় কৃষ্ণের ফতোয়ায় পাপযোনি হয়ে গেল। আর একটি সামাজিক প্রথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন: সতীপ্রথা। মহাভারতে স্বামীর মৃত্যুতে কেউ সতী হয়নি, শুধু কৃষ্ণের আটটি বৈধ পত্নী সহমরণে যান। কুষাণদের মধ্যে এ প্রথা প্রচলিত ছিল, এবার উত্তর ভারতের সমাজে ধীরে ধীরে সে প্রথা অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। কৃষ্ণের দৃষ্টান্তেই সম্ভবত এবং কুষাণ আচরণের প্রভাবে।

এ মনোভাবের পেছনে এক ধরনের ঈর্ষা স্পষ্ট। সমৃদ্ধির মান মর্যাদা সর্বত্রই স্বীকৃত। ব্রাহ্মণ রাজ-অনুগ্রহে, পৌরোহিত্যে নিযুক্ত যজমানের কাছে দানদক্ষিণা যা পেত তার পরিমাণ কম নয়। কিন্তু অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যে বৈশ্যের হাতে প্রচুর ধন সঞ্চিত হচ্ছে দেখে, ব্রাহ্মণ্যের প্রবক্তা কৃষ্ণ তার মর্যাদা ক্ষয় করে তাকে পাপযোনি বললেন। অবশ্য এও বললেন যে, কৃষ্ণ অনুগ্রহ করে তাকে উদ্ধার করবেন। এ কথায় যেমন কৃষ্ণের মহত্ত্ব প্রকাশ হল, তেমনই বৈশ্যের ক্রমহীয়মান অবস্থানও প্রকাশ হল। নারী ও শূদ্র বেদের আমল থেকেই হীন এই ‘পাপযোনি’ শ্রেণির পরিশ্রমের ওপরেই তখনকার সমাজ খেয়ে পরে বেঁচে আছে। এমনটা কেন হল? বড় বড় যুদ্ধ করে আসার পরে ক্ষত্রিয় আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ রইল না। এবং সমাজে তাদের সংখ্যাও কমে আসছিল। ব্রাহ্মণ চিরদিনের মতো সমাজে ‘স্বে মহিন্নি প্রতিষ্ঠাত্র’, ক্ষত্রিয় ক্ষীয়মাণ, বৈশ্য ও শূদ্র পাপযোনি। বেশ চমৎকার একটি বিভাজন, যাতে কারও কোনও ক্ষতি হল না, বৈশ্য ছাড়া। মনে রাখতে হবে, এর কয়েকশো বছর আগে বৌদ্ধ, জৈন আজীবিক ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায় বৈদিক সমাজের ভিতটা নাড়িয়ে দুর্বল করে দিয়েছে। যজ্ঞ কমে গেছে, তার সাহায্য ও গুরুত্বও কমে গেছে। এই নতুন পর্যায়ে আগন্তুক আক্রমণকারী এবং প্রত্যেক আক্রমণকারীই সমাজে নানা নিয়মে ও পর্যায়ে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। এই যে মিশ্র সমাজ নির্মিত হল, তাকে পরিচালনা করবার জন্যে নির্দিষ্ট কোনও ছক বা নিয়মাবলি তৈরি ছিল না। ফলে নতুন একটা বিন্যাসের জন্য নতুন নির্দেশ প্রয়োজন হল। এটা সম্ভব করলেন গীতার কৃষ্ণ।

লক্ষ করলে বোঝা যাবে, এতে যজ্ঞকে প্রায় অচল বলে বিন্যাসের জন্য নতুন নির্দেশ প্রয়োজন হয়েছে। ইতোমধ্যে জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক মতগুলিও এসেছে, অনুগামী দলও নির্মিত হয়েছে, বেড়েছে কমেছে, কেউ বা লুপ্তও হয়েছে। এরই মধ্যে দলে দলে বিদেশি আক্রমণকারী তাদের বিভিন্ন মত, পথ, সমাজ বিন্যাস নিয়ে এসে হাজির হল। তখন হল সমস্যা। এরা বিজয়ী, কাজেই ফেলা যায় না, নীচে ঠেলে ফেলাও যায় না। সমাজপতিরা বহু বুদ্ধি করে, সাপও না মরে লাঠিও না ভাঙে এমন বিস্তর সমাধান বের করলেন— সমাজে বিন্যাসের, ধর্মবিশ্বাসের ধর্মাচরণের অনুপূর্বিক নীতি নির্মিত হল। একদিনে বা এক বছরে নয়, ধীরে ধীরে বহু ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে। শেষ পর্যন্ত একটি ছক তৈরি হল যার প্রয়োগে সমাজে এক ধরনের সংহতি এল। প্রায় হাজার বছর ধরে এইগুলি সমাজের নিয়ন্তা হিসেবে চলিত ছিল। এই সংহতির সূত্রগুলির প্রবক্তা কৃষ্ণ, প্রযোক্তা পুরোহিতকুল।

নারীর অবনমন আরও কঠিন ভাবে স্পষ্ট হল, রাজার সার্বভৌমতা অনমনীয় ও অমোঘ হয়ে উঠল এবং শূদ্রের অবস্থান আরও গভীর অতলে নেমে গেল।

বেদের যুগ থেকেই সে প্রথম ত্রিবর্ণের সর্ববিধ সেবায় নিযুক্ত এবং সমাজের যে সব বৃত্তিহীন বলে প্রতিপন্ন ছিল, অথচ সমাজের পক্ষে একান্ত অপরিহার্য ছিল, সে ছিল সেই সব কাজের জন্য। বলাই বাহুল্য, সে খাটত পেটভাতায়। প্রায় সমকালীন মনুসংহিতায় পড়ি, গৃহস্বামী অব্যবহার্য জীর্ণ জুতো, ছাতা, জামাকাপড় শূদ্রকে দেবে। এতে তার কী কাজ হবে তা কে জানে! কিন্তু সাধারণ জামাকাপড় পরা অন্য ত্রিবর্ণের থেকে সে যে হীন তা এক পলকেই বোঝা যাবে। অতএব বলাই বাহুল্য, এ শূদ্র পাপযোনি। যদিও পরম করুণাময় কৃষ্ণ তারও গতি করে দেবেন বলেছেন, যেমন দেবেন নারীর ও বৈশ্যের।

সমাজের এই যে বিন্যাস— সর্বো েরাজা যিনি সার্বভৌম, তার পরে ত্রিবর্ণের পুরুষ, তার পরে অনেক নীচে, উচ্চ ত্রিবর্ণের নারী— এটিকে প্রতিষ্ঠিত করা তখন উত্তর ভারতের সমাজের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যে নীতিতে সে কাজ সাধিত হবে তা হল গীতা এবং ভার্গব রচয়িতাদের রচিত মহাভারতের শেষ প্রক্ষেপ। মনুসংহিতা, কিছু কিছু ধর্মসূত্র এবং সম্ভবত আদি একটিমাত্র মূল পুরাণ যা লুপ্ত হয়ে ক্রমে আঠারোটি পুরাণে গ্রথিত হয়েছে। অবশ্য এটা হতে বেশ কয়েক শতাব্দী লেগেছিল। কিন্তু এর সূত্রপাত হয়েছিল গীতায়। এবং যেহেতু গীতার আগে এমন কিছুই ছিল না, তাই গীতা এক ধরনের বিস্মিত মুগ্ধতা দিয়ে আচ্ছন্ন করেছিল তৎকালীন পণ্ডিত ও পাঠককে।

বর্ণাশ্রম ধর্ম, নারীর সতীত্ব, রাজার সার্বভৌম আধিপত্য এবং শূদ্রের প্রশ্নাতীত হীনত্ব ও একনিষ্ঠ সেবা— এইগুলির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল গীতা-নির্দেশিত সমাজ। কিছু বিবর্তন ও পরিবর্তনের পরে এই ছকটিই চলে আসে গুপ্ত সাম্রাজ্য পর্যন্ত প্রায় একই চেহারায়। মৌর্য থেকে গুপ্ত যুগে রচিত সাহিত্যে, ভাস্কর্যে, শিল্পে এই চিত্রটিই উন্মোচিত রয়েছে। তার কিছু পরে বর্ধন সাম্রাজ্যেও ছবিটা মূলত এ রকমই ছিল।

মহাভারত রচিত হবার পরে যখন তা জনপ্রিয় ও মুখে মুখে আবর্তিত হচ্ছিল— তখন সাহিত্য ছিল মূলত আস্য, অর্থাৎ মুখেমুখে রচিত। আবৃত্ত ও প্রচারিত এবং প্রসারিত। শাস্ত্রে ও বাস্তবে প্রত্যেক অংশেই অনেক ফাঁকফোকর— অর্থাৎ স্বাধীন নিয়ম-ভাঙা সঞ্চরণের রেশ অবকাশ ছিল। সমাজের দশ রকম বৈধ বিবাহের প্রচলন ছিল, অসবর্ণ বিয়ের রাস্তাও খোলা ছিল। তেমনই শাস্ত্রও অনেকটা পরিবর্তনশীল ছিল। অনেক পরের মৌর্য গুপ্তবংশের রাজাদের মতো বংশানুক্রমিক ছিল না। আগন্তুক প্রভাবশালী ব্যক্তির অনুচর। সহযোদ্ধা চর সবাই মিলে তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করত। শূদ্র অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন পেশা থেকে আসা মানবের একটি বহুল রূপযুক্ত গোত্র বা বর্ণে মিশ্রিত হল। গৃহ্যসূত্রে শূদ্ররা ব্রাহ্মণের পাকশালায় রান্নাও করতে পারে কিন্তু পরিবেশন করতে পারত না, এমনকী খাবার রাখা হয়েছে, খেতে আসুন’, এমন কথা উচ্চারণও করতে পারত না। স্পষ্ট বোঝা যায়, শূদ্রের শ্রমটা উচ্চ ত্রিবর্ণের পক্ষে অপরিহার্য ছিল, কিন্তু সেটা থাকবে গোপন অনুচ্চারিত, অশ্রুত। অর্থাৎ সমাজবিন্যাস এমন একটা ধাক্কা খেয়েছিল যে, উচ্চত্রিবর্ণের মনে এই নিয়ে একটা দোলাচল ছিল।

এর থেকেই সমাজ বিন্যাস ধীরে ধীরে বহুধা বিভক্ত হয় এবং না বেদ না কৃষ্ণ কারও কথাই শেষ পর্যন্ত একান্ত বা একমাত্র হয়ে রইল না। সেকালের শাস্ত্রে পড়ি, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, অনুচর, সহচর, যোদ্ধা, গুপ্তচর মিলে সিংহাসনে এক রাজার দাবি উচ্ছিন্ন করে তাবৎ বংশের রাজাকে বসাতে পারত। পারত না শুধু বেদ পাঠ করতে বা বেদপাঠ শুনতে। উচ্চারণ করলে উচ্চবর্ণের প্রতিহিংসা তার জিভ কেটে নিত আর বেদপাঠ শুনলে কানে গলন্ত সিসা ঢেলে দিত। সর্বদাই যে দিতে পারত বা দিয়েছে এর কোনও নজির নেই। শাস্ত্রে শুধু এই নিষ্ঠুর রীতির উল্লেখ পাই। সেই শাস্ত্রবাক্যের অমোঘত্ব প্রতিপন্ন করার জন্য কতটা বাস্তবে সংঘটিত হত আর কতটা নারকীয় এই শাস্তির মহিমা কীর্তন করার জন্য তা স্পষ্ট নয়। একটা কথা মনে রাখা ভাল: এই সমাজব্যবস্থা যতটা শাস্ত্রে ও আদর্শে, বাস্তবের চিত্র নিশ্চয়ই অনেকটা শিথিল ও ভিন্ন। সমাজে সব পেশা, কাজ সামাজিক রীতিনীতিরই প্রাধান্য ছিল।

তবে মুশকিলটা কোথায়? উত্তরাখণ্ডের চারিদিক থেকে ভিন্নজাতির মানুষ দলে দলে ভারতে প্রবেশ করছিল। এর অনেকাংশই অস্ত্রধারী যোদ্ধা। এদের নানা ধর্মবিশ্বাস, ধর্মাচরণের নানা প্রথা, সামাজিক আইনে অধিকাংশ স্থলেই এরা আর্যাবর্তের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে দলে দলে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরস্পরের মধ্যে যেমন এরা বিভিন্ন, স্থানীয় অধিবাসীদের রীতিনীতি থেকেও ভিন্ন ছিল। কাজেই সেই ভারতবর্ষ তখন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত একে অন্যকে দোষ দিত, কিন্তু কোনও একটি আদর্শগত ঐকিক ধর্ম বা আচরণ তখনও দেখা দেয়নি। এই সময়ে ভৃগুবংশীয় কিছু ঋষির মনে হল, এইটেকেই সমাজপতিদের অনুকূলে এনে সমাজে রক্ষণপন্থীদের নির্দেশিত রূপ দেওয়া হলে প্রতিরোধ বা বিদ্রোহী প্রভাব থেকে রক্ষা করা যাবে। নিত্যকালের এক দৃঢ় ব্রাহ্মণ্যসমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কাজেই রাজা, নারী, বৈশ্য, শূদ্র এদের নির্দিষ্ট অবস্থানকে চিরদিনের মতো কায়েম করা যাবে। চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। নিয়মলঙ্ঘনকারী শূদ্রের নারকীয় নিষ্ঠুর শাস্তি, সতীত্ব থেকে বিচ্যুত বা সামান্য মাত্ৰ বিচলিত নারীর শাস্তিও ছিল মর্মান্তিক নিষ্ঠুর। আর রাজদ্রোহীর সহজ এবং একমাত্র দণ্ড ছিল মৃত্যুদণ্ড। চারিদিকে নিয়ম শাসনের কারাগারে নিয়মনিষ্ঠরা হয়তো মোটামুটি সুখেই থাকত, যদিও বহু ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে বিদ্রোহীরা পালাত। কিন্তু এই ছকটাই ছিল সুপরিকল্পিত এবং সুবিধাজনক।

এই ভাবে সমাজে একটা সংহতি হয়তো সৃষ্ট হয়েছিল। তবে এ সংহতি বেশ খানিকটা নড়বড়েও ছিল। তাই কুড়িজন ধর্মশাস্ত্রকারী (মনু, অত্রি, বিষ্ণু, হারীত ইত্যাদি)— এঁদের মধ্যে বহু নীতি ও আচরণের বৈষম্য ছিল। মহাভারত সম্পূর্ণ হবার পরে ভৃগুবংশীয় ধর্মসংস্থাপকরা এ মহাকাব্যে যে সমস্ত নতুন বিষয় বা পুরাতনের নবতর ব্যাখ্যা ও নির্দেশ দিলেন। সেই ভার্গব প্রক্ষেপগুলিকে ভাল করে বুঝতে হলে তৎকালীন আর্যাবর্তের পূর্বতন সমাজে আগন্তুক বহু জনগোষ্ঠীর একত্র সমাবেশে যে সব নানাস্তরের সমস্যা দেখা দিল— বর্ণাশ্রমধর্মে, জাতিভেদে নারীপুরুষের সামাজিক অবস্থানের— যে নানাবিধ বিভিন্ন সমাধান পাওয়া যায় সেগুলিকে দেখতে হবে। অল্প পরের থেকে রচিত পুরাণগুলির নানা উপাখ্যানে এ কথা বোঝা যায়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পাঠান-মোগল বা ইউরোপীয় শক্তিগুলির আগমনে ততটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার উদ্রেকও হয়নি। সমাধানও হয়নি।

আগেই বলেছি, কৃষ্ণ এই সংহতি চেষ্টার প্রবক্তা এবং গীতা বহুলাংশে এই সংহতির শাস্ত্র। এর একটানা প্রমাণ গীতায় দার্শনিকতা যা আছে তার তুলনায় বহুগুণ দার্শনিক সমস্যা ও সমাধান অন্য রচনায় থাকা সত্ত্বেও গীতাই সেই অসাধারণ ধর্মগ্রন্থের স্থানে উপনীত হয়েছে যা ভারতবর্ষের আর কোনও শাস্ত্রই পায়নি।

আগন্তুক জনগোষ্ঠী চতুর্বর্ণে বিভক্ত ছিল না, তাই আর্যাবর্তের বর্ণ বিভক্ত সমাজে আগন্তুকদের স্থান নির্ণয় করা যাথষ্ট দুরূহ ছিল। বৃত্তি, প্রবণতা এবং কীর্তি অনুসারে তারা আর্য সমাজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ভিনগোষ্ঠীর নারীপুরুষের আচরণ, যা আর্যদের আচরণের সঙ্গে মিলত না, তাদের তিনটি বিকল্প ছিল; পূর্বতন স্থানে থেকে যাওয়া। নির্ধারিত স্থানে জায়গা করে নেওয়া অথবা এ দুয়ের মাঝামাঝি একটা অবস্থিতি নির্মাণ করে তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া। আগন্তুকদের উপাসনা ও উপাস্য সহজে একই ব্যবস্থা হয়েছিল। রাজার স্থান ক্রমান্বয়ে উচ্চতায় দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধবৃত্তি এক সময়ে ক্ষীণ ও প্রায় অপ্রয়োজনীয় হওয়াতে ক্ষত্রিয়রা ক্রমে ক্রমে লুপ্ত অর্থাৎ অন্য বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। নারী ও শূদ্রের এবং কিছু পরে বৈশ্যের স্থানে কিছু পরিবর্তন দেখা গেল। বৈশ্যরা শূদ্রের কিছু বৃত্তি ও নিজস্ব কৃষি, পশুপালন ইত্যাদি থেকে সরে এসে বহির্বাণিজ্য ও অন্তর্বাণিজ্যে বিত্তবান হয়ে উঠল। এদের জন্যে সমাজে পুনর্বিন্যাস করতে হল।

আর্যদের নিজেদের দেবমণ্ডলী আঞ্চলিক দেবকুলের সঙ্গে সংমিশ্রণে স্ফীত হয়ে উঠল। পূর্বতন যজ্ঞকর্মে নবতম পূজা প্রাধান্য লাভ করল— নানা বিভঙ্গে, নানা আয়োজনে। এ বার বহিরাগতদের উপাস্য ও উপাসনার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আঞ্চলিক পূজা, প্রকরণ ও নৈবেদ্যের সংমিশ্রণে নূতন আকার ও প্রকার লাভ করল।

এই গুরুতর নৈরাজ্যের মধ্যে কৃষ্ণ একটি দেবতা ও একপ্রকার উপাসনার প্রবর্তন করলেন। এর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সংঘর্ষকে প্রশমিত করে একটি ছত্রের তলে তাকে সংহত করা ছিল কৃষ্ণের একটি করণীয়। এ সবই গীতার প্রচ্ছদপট। গীতামাহাত্ম্য থেকে বোঝা যায়, কৃষ্ণের চেষ্টা বহুলাংশে সার্থক হয়েছিল। বহুধা বিচিত্র ধর্মীয়, সামাজিক সমস্যাকে যতটা সম্ভব সংহতি দিয়ে সৃষ্টি করলেন গীতা এবং প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের প্রাথম্য। গীতা তাই অসামান্য এক ধর্মগ্রন্থ যার কেন্দ্রে এক পুরুষ, অসামান্য বুদ্ধিমান কৃষ্ণ।

নির্বাচিত গ্রন্থ

1. Roy R N: The Bhagavadgita (text and commentary in English ), Allahabad, 1981

2. The Bhagavadgita (with text translators commentary by Sri Aurobindo), Sri Aurobindo Trust, Rajasthan, 1992

3. The Bhagavadgita for Changing Times, Bharatiya Vidya Bhavan, Bombay, 1995

4. Rajagopalachari C: Bhagavadgita, Bharatiya Vidya Bhavan, Bombay, 1967

5. Kaji G Chhaganlal: Philosophy of the Bhagavadgita, Rajkot, 1909–11

6. Srimadbhagavadgita (with glossary of Shridhara Swami), Mylapore Ramkrishna Math.

।7. Besant Annie: Bhagavadgita, London, 1905

8. Sankaracharya Jnaneshar: Commentary on the Bhagavadgita, Kolhapur, 1912

9. Srimadbhagavadgita (text and Bengali translation by Panchanan Tarkratia), Calcutta,

10. Bhagavadgita (ed by Ashutosh Bhattachary), Calcutta, 1936

11. Belvalka SK: Srimadbhagavadgita, Varanasi, 1959

12. Tilak Balgangadhar: Bhagavadgita Rahasya, Poona, 1935

13. Rajagopalachari C: Bhagavadgita, New Delhi, 1949

14. Zachner R C: The Bhagavadgita, Kolhapur, OUP, 1969

15. Gandhi M K: Discourses on the Gita, Ahmedabad, 1960

16. Desai Morarji: A view of the Gita, Ahmedabad, 1974

17. Radhakrishnan S: The Bhagavadgita, London, 1949

18. Tilak Balgangadhar: Srimadbhagavadgita, Calcutta, 1924

19. Chattopadhyay Bankimchandra: Srimadbhagavadgita, Calcutta, 1941

নির্বাচিত তর্জমা

1. August Sehlegal Latin 1861

2. I. C. Wilkins 1785

3. Sir Edwin Amold (The Song Celistal) 1865

4. Anni Besant 1912

5. Aurobindo 1922

6. ANBP Hill 1928

7. Swami Nikhilananda 1974

8. GM Sanyal 1984

9. SC Ray 1942

10. Guru Nanda Charan Sen 1987

11. Jitendra Nath Banerji 1982

12. DR Barnett 1938

13. Franklin Edgeston 1938

14. Jnan Mascars 1962

15. Juan Maspero

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *