গীতা কেন – ১

এক

প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতমহলে প্রায় সকলেই স্বীকার করেন যে, গীতা কুষাণ যুগে রচিত। এই যুগে মধ্যপ্রাচ্য ও চীন থেকে বহু জাতির বণিক, সৈন্য ও সাধারণ মানুষ, কোনও বিজয়কামী সেনাপতির সঙ্গে দলে দলে ভারতে আসে। সঙ্গে আনে সেই সব গোষ্ঠীর নানা বিচিত্ৰ ধর্মবিশ্বাস, দর্শনপ্রস্থান, সংস্কার ও আচার-আচরণ। ভারতবর্ষের উত্তরার্ধে তখন নানা মতের প্রবল সংঘর্ষ চলছে; কোনও একটি মত প্রধান বা সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেনি। সম্ভবত ভগবদ্গীতায় এই সব মতের সমন্বয়ের চেষ্টা হয়েছে।

গীতা নানা কারণে অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থ। খ্রিস্টধর্মে যেমন বাইবেল, ইসলামে যেমন কোরান, হিন্দুধর্মে তেমনি গীতা প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এর একটা প্রমাণ অতীতে ও বর্তমানে— এবং হয়তো ভবিষ্যতেও— ভারতবর্ষে অসংখ্য মেয়ের নাম গীতা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে গীতা ছিল ধর্মগ্রন্থ। তাঁরা গীতা নিয়ে যেতেন ফাঁসির মঞ্চের কাছে; শেষ উপহার পাঠাতেন মা-বাবার কাছে। এ দেশে মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে পর্যন্ত এক খণ্ড গীতা মৃতদেহের বুকে রাখা থাকে। বিচারালয়ে বাদী-প্রতিবাদীকে সত্য কথা বলার জন্য শপথ করতে হত গীতা স্পর্শ করে। শ্রাদ্ধের সময়ে গীতা পাঠ করতে হত। অন্য শুভকার্যের অঙ্গ হিসেবেও গীতা পাঠ আবশ্যিক ছিল। গীতা আকারে ছোট হলেও গুরুত্বে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

কুষাণযুগে সমাজে বহু দার্শনিক, ধর্মীয় ও সামাজিক তোলপাড় চলছিল, যার মধ্যে দিয়ে সমাজ হয়তো একটা পথনির্দেশ খুঁজছিল। সেটা পায়নি, কিন্তু পাবার জন্যে একটা প্রায় সার্বিক আকুতি, একটা আপ্রাণ চেষ্টা চলছিল, যার নানা চিহ্ন গীতার মধ্যেই নিহিত। গীতা জনপ্রিয় হলেও কোসম্বী বলেন, ‘গীতা যতটা সম্মানিত হয়, ততটা পঠিত বা বুদ্ধি দ্বারা আত্মসাৎ করা হয় না, এবং যতবার আবৃত্তি করা হয় ততটা বুদ্ধিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না।[১]

[১. ‘The Gita is honoured more often than read and understood less than it is recited.’ The culture and civilization of Ancient Indian Civilization in Historical Outlines. London, 1965. p. 209]

দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মশায় বলেছেন, ‘গীতার অনেক আগেই ভারতবর্ষে একটি সুবৃহৎ পরিমাণ দর্শনচিন্তার সমাহার ছিল, যেটিকে বিভিন্ন প্রস্থানে বিভক্ত করার চেষ্টাই তখনও শুরুই হয়নি।[২]

[২. ‘A large mass of philosophical thought must have existed in India long before there was any attempt of dividing it into definite channels of systematic philosophies.’ Cārvāka, Purogami Prakashan, Calcutta. 1967, p. 15]

এটা সত্য যে, গীতার বহু ভাষ্য রচিত হয়েছে, কিন্তু রুক্মনি বলেন যে, ‘সব ভাষ্যকারই গীতাকে নিজের মতের অনুকূলে ও সমর্থনে ব্যাখ্যা করেছেন, তাই এ গ্রন্থটির স্পষ্ট উদ্দেশ্য হল, বিভিন্ন ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদকে একটি ছত্রের তলে নিয়ে আসা।’[৩] সে চেষ্টা বহুলাংশে সার্থকও হয়েছিল। নবাগত ও পূর্বেকার সমাজের বহু অন্তর্নিহিত সমস্যার সমাধান হয়েছিল; ফলে এক ধরনের একটা সংহতি সৃষ্ট হয়েছিল।

[৩. ‘The express purpose of bringing all the diverse religions and philosophical groups under one umbrella. ‘ Journal of Studies on Ancient India. Vol. 1, 1993]

সে আলোড়ন বোঝবার জন্য সে সময়কার সমস্যাগুলো খানিক বোঝা প্রয়োজন। কুষাণ যুগে বৈদিক যাগযজ্ঞ কিছু কিছু অনুষ্ঠিত হলেও মোটামুটি তার উপর থেকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস বেশ কমে গিয়েছিল। এর একটা কারণ হল যে, যে সামাজিক সংহতির মধ্যে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত তা বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রভাবে শিথিল হয়ে এসেছিল অথচ নতুন কোনও সর্বজনগ্রাহ্য বিকল্প নির্মিত হয়নি। মহাভারতের পঞ্চম অধ্যায়ে উদ্যোগপর্বে গীতাকে পাই। সেখানে কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষ যুদ্ধের জন্য তাঁদের অসংখ্য সহচর সঙ্গে নিয়ে দু’দিকে যুদ্ধের নিয়মে সজ্জিত— কেবল যুদ্ধসূচনার শঙ্খধ্বনিটি হলেই যুদ্ধ শুরু হবে। অর্থাৎ কয়েক মুহূর্তের প্রতীক্ষা মাত্র। এমন সময়ে, অষ্টাদশ অধ্যায়ে রচিত প্রায় স্বতন্ত্র একটি বৃহদায়তন প্রক্ষেপ সংযোজিত হল যার নাম গীতা। এর মূল প্রতিপাদ্য কৃষ্ণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং একটা সামাজিক বিন্যাসের প্রবর্তন— তাও দার্শনিক ও আপাত দার্শনিক যুক্তিতর্কের এক প্রলম্বিত পরিচ্ছেদে। এই বাগ্‌বিনিময়ের সময়ে দু’দিকে সজ্জিত সৈন্যদল কী করছিলেন? কৃষ্ণ ও অর্জুনের বিতণ্ডায় তাঁদের কী উৎসাহ থাকতে পারে? যুদ্ধে অনিচ্ছুক অর্জুনকে কৃষ্ণ স্বমতে আনবার জন্য যুক্তি, অযুক্তি, কুযুক্তি প্রয়োগ করেই চলেছেন। তিনিই মুখ্য বক্তা; অর্জুন শ্রোতা মাত্র। মাঝে মাঝে কেবল অর্জুন অল্প কিছু প্রতিবাদ বা প্রশ্ন করেছেন এবং কোনও বিষয় বিশদ ভাবে জানতে চেয়েছেন। কিন্তু ক্রমেই অর্জুনের স্বর যেন ক্ষীণতর হচ্ছে এবং বক্তা হিসেবে কৃষ্ণের প্রাধান্য বাড়ছে। তাঁর বক্তব্য অর্জুনের স্বীকৃতি অর্জন করতে না পারলেও দৈর্ঘ্যে এবং আপাত ভাবে বিধৃত হয়ে ক্রমে প্রধান হয়ে উঠছে।

সে যাই হোক, এমন কোনও যুদ্ধ কল্পনা করা যায় না যাতে যোদ্ধারা এমন আশ্চর্য ধৈর্যশীল এবং সুদীর্ঘ প্রতীক্ষায় সম্মত। মহাভারতে যুদ্ধটা এক অর্থে গ্রন্থের মূল অংশ, অতএব সেটার প্রাধান্য স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু তাকে বিলম্বিত করার প্রক্রিয়ার গীতা যখন দেখা দিল পুরো আঠারো অধ্যায় নিয়ে, তখন মহাকাব্যের গতি ব্যাহত করার দায় গীতার। এ বস্তু কোনও সুস্থ বুদ্ধিমান রচয়িতা হতে দেবেন তা কল্পনা করা যায় না। অতএব একমাত্র সিদ্ধান্ত হল, মহাভারতে গীতা হচ্ছে প্রক্ষিপ্ত। এর প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় মূলগ্রন্থের ভূমিকা রূপে থাকলেও থাকতে পারত, কিন্তু তার বেশি কখনওই নয়। যে সব দর্শন প্রস্থানের ওপর ভিত্তি করে কৃষ্ণ তাঁর বক্তব্য উপস্থাপিত করছেন সেগুলি তৎকালীন ভারতবর্ষের মানসে সঞ্চরমান ছিল দীর্ঘকাল ধরেই, এবং গীতায় কৃষ্ণ কখনওই সেগুলিকে যুক্তি সূত্রের বন্ধনে বেঁধে একটি সার্বভৌম যুক্তিতে পরিণত করতে পারেননি, চেষ্টাও করেননি।

ইরফান হবীব বলেন, ‘উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে জনপ্রিয় একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল তা শ্রমিক সমাজের সঞ্চরণশীলতা গ্রামে ও নগরে ব্যাপ্ত করে তুলছিল, যেমন গ্রামাঞ্চলে জাঠদেরও এতে তাদের কতকটা সম্মান বাড়িয়েছিল।’ এমন পরিস্থিতিতেই উচ্চবংশীয় বিত্তবান মুখপাত্র হয়ে কৃষ্ণ বলেন, ‘কর্মেই তোমাদের অধিকার, কখনোই ফলে নয়।’ কারণ এরা সকলেই কর্মী বা কোনও নির্দিষ্ট শ্রমের শ্রমিক— উচ্চ বিত্তশালীরাই ফলের অধিকারী। এ কথা আপনিই আসে যে, যে বহুমত ও পথ উত্তরাখণ্ডের ও বহিরাগতদের, তার একটা সমন্বয়ের চেষ্টা হয়তো আদি গীতাতে প্রচ্ছন্ন ছিল। গীতা কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসন্ধানের রীতিতে এ সমন্বয় সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়নি। বিভিন্ন দর্শন প্রস্থানের আলোচনাও এতে নেই। কিছু কিছু প্রসঙ্গে এর বিবরণ আছে মাত্র। কোনও কোনও দর্শনের উল্লেখ ও তার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে গীতার প্রসঙ্গে কোনও স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া উল্লিখিত হয়েছে। এতে গীতার বক্তব্য কোনও বিধিবদ্ধ আকৃতি পায়নি, এবং যুক্তি পরম্পরার দ্বারা যে সুগ্রথিত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপিত হতে পারত তাও হয়নি।

তা হলে গীতার মূল বক্তব্য কী? গ্রন্থের শুরুতেই কৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর বর্ণধর্মে প্রবৃত্ত করবার চেষ্টা করেন। উত্তরে অর্জুন বলেন, ‘যাঁদের জন্য মানুষ যুদ্ধজয় করে তাঁরাই শত্রু হিসেবে আমার সম্মুখে উপস্থিত। এঁদের হত্যা করে আমি বৈকুণ্ঠেও যেতে চাই না। বিপন্নকে, আত্মীয়কে, নারী ও শিশুকে রক্ষা করাই ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য, অতএব এ যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ নয়। এতে আমার সায় নেই।’ অর্থাৎ অর্জুন যা বলছেন তার মর্মার্থ হল, বর্ণধর্ম অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের কর্তব্যের ওপরেও একটি ধর্ম আছে— তা মানবধর্ম, যেখানে মানবিক মূল্যবোধেরই প্রাধান্য। এই মূল্যবোধে প্রণোদিত অর্জুনের পক্ষে হীনতর বর্ণধর্মের নির্দেশ মেনে আত্মীয়হনন করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। পরবর্তী বহু অধ্যায় জুড়ে কৃষ্ণ অর্জুনের আপত্তি খণ্ডন করবার চেষ্টা করলেন, প্রায় সকল দর্শনপ্রস্থান ও নীতিবাক্য দিয়ে। বলা বাহুল্য, অর্জুন যে মহনীয় মানবিকতার নীতির ছত্রতলে অধিষ্ঠান করছিলেন তার থেকে তাঁকে সরানো সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় কৃষ্ণ জাদুবিদ্যার আশ্রয় নিয়ে অর্জুনকে দেখালেন যে, সমগ্র চরাচর তাঁর মধ্যেই বিধৃত; তিনিই পরাৎপর ব্রহ্ম, তাঁর ওপরে আর কেউ নেই। তখন অর্জুন নতশিরে নিজেকে কৃষ্ণের আজ্ঞাবহ দাস বলে স্বীকার করলেন: সমস্ত বিরোধিতার অবসান ঘটল। দুই সখা এখন প্রভু ও অনুচরে সারথি ও আরোহীতে পরিণত হলেন। কৃষ্ণের ইষ্ট সিদ্ধ হল, অর্জুনের ব্যক্তিমর্যাদা কৃষ্ণের পায়ে ভূলুণ্ঠিত হল। গীতা যা চেয়েছিল তাই হল।

একটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, বিখ্যাত শ্লোক হল, ‘যাঁকে পেয়ে অন্য কোনো লাভকে অধিকতর [লাভ] বলে মনে হয় না, যাঁর মধ্যে অবস্থান করলে গুরু দুঃখেও [মানুষ] বিচলিত হয় না, তাঁকেই গ্রহণ কর।’ (৬:২২) এখানে সর্বনামেই রাখা হয়েছে সেই পরমপুরুষকে যিনি পরম লভ্য বস্তু, যাঁকে পেলে আর কোনও লাভ তাঁর চেয়ে বেশি, অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না এবং যাঁর মধ্যে অন্তরাত্মা বিরাজ করলে অতি তীব্র দুঃখও বিচলিত করতে পারে না। অর্থাৎ যাঁর মধ্যে বাস করলে বড় সুখ, বড় দুঃখ কোনওটাই মনকে বিচলিত করতে পারে না। এখানে সর্বনামে যাঁকে অভিহিত করা হচ্ছে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি কৃষ্ণ। যে কৃষ্ণকে অন্যত্র বারেবারেই বলা হয়েছে ব্রহ্মস্বরূপ। অর্থাৎ মানুষ এমন একটা মানসিক আশ্রয় চায় যেটা অনন্ত সুখের চরম বিকাশ, অতএব সকল দুঃখের চরম ও একান্ত অবসান। কাল্পনিক হলেও এ তো সব মানুষের চিরকালের কাম্য অবস্থা, তাই এর সুপরিচিত কোনও স্পষ্ট পরিচয় দেওয়া হয়নি। কিন্তু গীতায় এর পূর্বপর আশ্রয় থেকে যেন বোঝা যায়, সুখদুঃখের অতীত সেই মানসিক আশ্রয় মানুষ কৃষ্ণেরই মধ্যে খুঁজে পাবে এবং এ আশ্রয় পেলে তীব্র গুরুত্বপূর্ণ সুখ ও দুঃখকে মানুষ অনায়াসে অতিক্রম করতে পারে। এই ধরনের শ্লোকই গীতাকে যত অমরত্ব দিয়েছে, গীতার তত্ত্বকথাও বোধহয় ততটা দেয়নি।

এমনই আর একটি বিখ্যাত উক্তি হল: ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎদুর্গতিং তাত গচ্ছতি।’ (৬:৪০) মানুষের কল্যাণে নিযুক্ত যে মানুষ, তার কখনও দুর্গতি হয় না। শুনতে খুব ভাল। ভরসা পাওয়া যায় যে, মানুষের মঙ্গলে নিযুক্ত থাকলে তার পরিণামে মঙ্গলই হয়। কিন্তু বাস্তবে হয় কি? চারদিকে তাকিয়ে আমরা অসংখ্য উদাহরণ দেখি না কি, যাঁরা মানুষের মঙ্গলব্রতে একনিষ্ঠ তাঁরা জীবনে অসহ্য দুঃখে দিন কাটান?

গীতার অসাধারণ জনপ্রিয়তা ভারতবর্ষে এবং অন্যত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। এর একটা কারণ হল, খ্রিস্টানের যেমন বাইবেল, মুসলমানের যেমন কোরান হিন্দুর তেমনই গীতা— বেদ নয়, রামায়ণ, মহাভারত বা পুরাণগুলিও নয়— একমাত্র গীতা। আগেই বলেছি আদালতে হিন্দুকে শপথ করতে হয় গীতা ছুঁয়ে। মৃতদেহকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় বুকের ওপর একখণ্ড গীতা রেখে। শ্রাদ্ধের সময়ে গীতাপাঠের পারায়ণ করা হত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বহু সংগ্রামী ফাঁসির মঞ্চে যাওয়া পর্যন্ত গীতাপাঠে নিবিষ্ট থাকতেন; মৃত্যুর পূর্বে মা-বাবাকে বা প্রিয়জনকে গীতাটি তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দান করে যেতেন, তাঁরাও পবিত্রজ্ঞানে গীতাটি রক্ষা করতেন। ভারতবর্ষে এবং অন্যত্র বহু গীতা আশ্রম আছে এবং ভারতবর্ষে অসংখ্য মেয়ের নাম গীতা। সাধারণ লোকের বিশ্বাস ধর্ম, নীতি ও সদাচার সম্বন্ধে যা কিছু জ্ঞাতব্য তা সব গীতায় আছে। একটা কাব্য পৃথিবীর বৃহত্তম মহান গ্রন্থ, এমনকী শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ। গীতা সেই মহাভারতেরই অংশ।

গীতার জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত। এর কারণও বহু। গীতায় জনপ্ৰিয় সদুক্তি, সুভাষিতাবলি এগুলি সবই গীতাকারের রচনা নয়— বহুদিন ধরে সমাজে প্রচলিত সদুক্তিগুলির সমাহারমাত্র— জীবনের নানা অবস্থার থেকে সে সব উপলব্ধি উঠে আসে। কোনও কথা চিরন্তন মূল্য থাকলে মানুষ তা ভোলে না। তেমনই সুভাষিত একটি একটি করে প্রথমে সমাজ-জীবনে, পরে সাহিত্যে স্থান পায়। গীতায় এমন উক্তি বহু আছে; একস্থানে নয় ইতস্তত ছড়ানো। এগুলি এত সুপরিচিত যে, অনেকগুলি সুভাষিত এখনও মুখে মুখে চলে। জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে এদের উদ্ভব। প্রথম থেকে দেখলে একে একে এদের স্বরূপ ধরা যায়। যেমন অর্জুনকে যুদ্ধে প্ররোচিত করে কৃষ্ণ বলছেন, ‘মানুষের দেহে যেমন কৌমার, যৌবন ও জরা আসে, তেমনই আসে মৃত্যুর পর ভিন্নদেহ ধারণ। কাজেই এতে শোক করার কিছু নেই।’ (২:১৩) অর্জুনকে এই স্বজন হত্যার নির্মম কর্মে প্রবৃত্ত করার জন্য কৃষ্ণ বললেন অর্জুন ও কৃষ্ণ বহুতর জন্ম পার হয়ে এসেছেন, অর্জুনের তা স্মরণে নেই, কৃষ্ণের আছে। একটু পরে কৃষ্ণ বলেন, সমাজের চারটি বর্ণ তিনি সৃষ্টি করেছেন, গুণ ও কর্মের নিরিখে। এগুলি অক্ষয় অব্যয়। এখানে মনে রাখতে হবে, কুষাণ যুগে জন্মগত জাতি অক্ষয় জাতি— এই কল্পনা সমাজ মানসে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত করার চেষ্টা হয়।[৪]

[৪. আজ আমরা জানি বর্ণগুলি কোনও একজন মানুষ সৃষ্টি করেননি, এবং হঠাৎ এক সময়েও হয়নি। ধীরে ধীরে সমাজ বিবর্তনের ফলে বর্ণ (জাতি)গুলি বিশিষ্ট রূপ ধারণ করেছে এবং একেবারে অনড় অবস্থায় আসতে অনেক দেরি হয়েছিল। প্রথমে ঋগ্বেদে একই পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন বর্ণভিত্তিক বৃত্তিতে নিযুক্ত এমন কথা শুনি। এর পরেও বর্ণগুলি অনেকটা সঞ্চরণশীল ছিল। ক্রমে ক্রমে সেগুলি অনড়, স্থির হয়ে গেল। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত হয়েছিল কুষাণ যুগে। যদিও বর্ণগুলির পরস্পরের মধ্যে সঞ্চরণ এখনও ঘটে চলেছে।]

‘জীবনে যেমন, জীর্ণবাস পরিত্যাগ করে মানুষ অন্য বসন পরিধান করে, তেমনই এ দেহ জীর্ণ হলে সেটা ছেড়ে রেখে তা নতুন এক দেহ পরিগ্রহ করে।’ (২:২২) দেহ শস্ত্রের দ্বারা ছিন্ন হয় না। অগ্নি একে দগ্ধ করে না, জল একে সিক্ত করতে পারে না কিংবা বাতাস একে শুষ্ক করতে পারে না।’ (২:২৩) এই বিখ্যাত শ্লোকটি এত সহজে সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে যে, মানুষ এটিকে নিষ্প্রতিবাদে গ্রহণ করেছে অভ্রান্ত সত্য বলে। জীর্ণবস্ত্ৰ যে মানুষ ত্যাগ করে তার পরবার মতো অন্য বস্ত্র থাকা চাই, তবেই সে বেশ পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কি তেমন নিশ্চিত আশ্বাস আছে যে, সে মৃত্যুর পরে অন্য দেহ পাবেই? তা ছাড়া শাস্ত্রে পুরাণে অসংখ্যবার বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর সে মনুষ্যদেহই পাবে? কুকুর, বিড়াল হয়ে জন্মালে তার পুণ্য অর্জনের সম্ভাবনা কম। প্রকৃতপক্ষে এ উপমাটি— মৃত্যুর পরে দেহান্তর লাভ করা— এসেছে সাপের খোলস ছাড়া থেকে। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় মহাকাব্যে গিলমামেশ-এ নায়ক অমরত্বের দ্বারে এসে বিফল মনোরথ হয়, তার কাঙ্ক্ষিত অমরত্বের গুল্মাংশটি একটি সাপ এসে খেয়ে নেয় এবং সাপটি তৎক্ষণাৎ খোলস ছেড়ে নতুন চর্ম পায়। অর্থাৎ, এই সাদৃশ্যের ওপরেই জন্মান্তরে নতুন দেহ পরিগ্রহ করার কথা ওঠে এবং জন্মান্তরবাদ সমর্থন পায়। কিন্তু সেখানেও বিস্তর প্রভেদ আছে: সাপ খোলস ছেড়ে প্রকৃতপক্ষে অন্য খোলস গ্রহণ করে না; তার গাত্রচর্মই শুকিয়ে তার পরবর্তী খোলস হয়ে ওঠে। এ উপমা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কাজেই শুনতে যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক না কেন, বস্তুত এটি নির্ভরযোগ্য কোনও আশ্বাস নয়।

তা ছাড়া জন্মান্তর মানেই পুনরায় মনুষ্যদেহ পরিগ্রহ করা নয়। রক্ষ, যক্ষ, কিন্নর ছাড়াও মনুষ্যেতর প্রাণীর দেহও পরিগ্রহ করার সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া প্রেতযোনিত্ব লাভের কথাও আছে। কাজেই একটা আশ্বাস মাঝে মাঝে পাওয়া যায় যে, এ জন্মে যা অসমাপ্ত থাকে পরজন্মে তার পরিপূর্ণতা লাভের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সব মানুষের মন এতে আশ্বাস পায় না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই প্রশ্নটি তুলেছেন:

হেথায় যা অসম্পূর্ণ
সহস্র আঘাতে চূর্ণ
বিদীর্ণ বিকৃত
কোথাও কি একবার সম্পূর্ণতা আছে তার
জীবিত কি মৃত?

যে শ্লোকটি যুগে যুগে মানুষকে প্রভাবিত করে এসেছে তা হল: ‘কর্মেই তোমার অধিকার কর্ম ফলে কখনো নয়।’ (২:৪৭) বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করে বলেছে হে ধনঞ্জয়, ‘বুদ্ধিযোগ থেকে কর্ম বহু দূরে (তাই) বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ কর। যে ফল কামনা করে সে কৃপার পাত্র।’ (২:৪৯) ঠিক পরেই প্রসঙ্গ বদলে গেল, ‘অতএব যোগে নিযুক্ত হও, যোগ হল কর্মে কুশলতা।’ এই যে ‘অতএব’ এটা নিষ্কারণ মনে হয়। এমন অযৌক্তিক সংশ্লেষণ অন্যত্রও অনেক আছে।

ইন্দ্রিয় দমন যোগ সাধনার বড় অঙ্গ বলে সর্বদেশে সর্বকালে গৃহীত। তাই খানিক পরেই বলা হচ্ছে ‘যার ইন্দ্রিয়গুলি নিজের বশে আছে তার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত।’ কিছু পরে একটি কবিত্বপূর্ণ শ্লোক: ‘অন্যান্য প্রাণীদের পক্ষে যেটা রাত্রি, সে সময়ে সংযত মানুষ জেগে থাকে, আর অন্যান্য প্রাণীকূল যখন জেগে থাকে তখনই সংযমী ব্যক্তি ঘুমিয়ে থাকে।’ (২:৬৯) ঠিক পরেই শুনি, ‘সমুদ্রে জল যখন চারদিক থেকে এসে ভরে যায়, সে তখন (জলের) পাহাড়ের মতো প্রতীত হয়। এই ভাবে যার জীবনে কামনাগুলি প্রবেশ করে, সে-ই শান্তি পায়, কামনায় নিবিষ্ট মানুষ তা পায় না।’ (২:৭০) একটু পরেই বলা আছে: ‘এই হল ব্রাহ্মী স্থিতি, [অর্থাৎ ব্রহ্মে অবস্থান], এ অবস্থা লাভ করলে কোনও মূঢ়তা আসে না, এতে অবস্থান করলে [জীবনের শেষে] ব্রহ্মে নির্বাণ পাওয়া যায়।’ (২:৭২) অবশ্য, এই ব্রহ্মে অবস্থানই বা কেন কাম্য এবং তার প্রকৃতি কী; সেই অবস্থান কী ভাবে চিরসুখের হতে পারে, তার কোনও নির্দেশ নেই।

এরই কিছু পরে শোনা যায় বহুশ্রুত কথাগুলি, যা মনুসংহিতায় এবং অন্যত্র পাওয়া যায়: ‘অন্ন থেকে জীবনের সৃষ্টি, অর মেঘ থেকে আসে অন্ন, যজ্ঞ থেকে উৎপন্ন হয় মেঘ, আর যজ্ঞের উৎপত্তি কর্ম থেকে।’ (৩:১৪) এতে যজ্ঞের অপরিহার্যতা ও মান্যতা প্রমাণ হল। আর কিছু নয়। ত্রিপুরাশঙ্কর দেবশাস্ত্রী বলেছেন, ‘কর্মই গীতার মধ্যবিন্দু।’ কর্মের গুরুত্ব গীতায় নানা ভাবেই বারেবারে বলা হয়েছে, তবে কর্মেই কর্মীর অধিকার, কর্মফলে কদাপি নয়। কুষাণ সাম্রাজ্য থেকে আদিমধ্যযুগ পর্যন্ত কর্মের সংজ্ঞা ও তাৎপর্যের গুরুত্ব বেড়েছে। দেশে তখন কৃষির প্রসার ঘটেছে আর সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম শিল্পেরও এবং এরই সঙ্গে চলছে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য। এ সবের ভিত্তিভূমি হল নানাবিধ কর্ম। তাই কর্মের প্রাধান্য ব্যক্ত হয়েছে।

কিন্তু অল্প দূরেই গিয়ে দেখি: ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ যেমন যেমন আচরণ করে, সাধারণ মানুষ তারই অনুকরণ করে, সে [জীবনে] যা প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষ সেই রকমই আচরণ করে।’ (৩:১৪) এ কথাটি বহুকাল ধরেই মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে এবং সমাজও এর প্রতিফলন দেখেছে। এর কিছু পরে শুনি একটি বহুশ্রুত শ্লোক, ‘কিছু ত্রুটিযুক্ত হলেও সম্পূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠিত স্বধর্ম, পরধর্মের থেকে ভাল। পরধর্ম ভয়াবহ।’ (৩:৩৪) এখানে ধর্ম বলতে কী বোঝাচ্ছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। কিন্তু যা কিছু অভ্যস্ত, চিরাচরিত তাই ধর্ম বলে মনে হয়। তবে তা নাও হতে পারে। বর্ণধর্ম ও বৃত্তিগত ধর্ম ধীরে ধীরে কর্মের বৃহত্তম সংজ্ঞায় পৌঁছেছে। যাই হোক, কোনও রকম এদিক ওদিক সমাজের বা শাস্ত্রের অনুমোদিত নয়।

‘শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যা আচরণ করে’– শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কে? তার কোনও সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি; অর্থাৎ সমাজ যার আচরণকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তার নীচের মানুষ তাকেই অনুসরণ করে। এ ভাবে গীতা শ্রেষ্ঠত্বকে সম্মান দিয়েছে যাতে মানুষ তার আচরণ অনুকরণের দ্বারা উন্নতি লাভ করে। পরে অবশ্য আমরা ধীরে ধীরে জানব, যোগী, তপস্বী, জ্ঞানী, ভক্তিমান এরাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে। এর একটা দিক হল, জনহিতের জন্য গীতার চেষ্টা ও আগ্রহ। এ ধরনের কথা গীতায় বিস্তর আছে এবং সেটাও গীতার জনপ্রিয়তার একটা কারণ। সে যুগে, অর্থাৎ মহাভারত রচনা যখন চলছে, বা সবে শেষ হয়েছে, তখন ছ’টি দর্শন এবং বৌদ্ধ, জৈন আজীবিক ও বাহুস্পত্য (চার্বাক) মতের, সন্ন্যাস ও জ্ঞান, যোগ, ইত্যাদির নানা রূপের চর্চা যখন সমাজে প্রচলিত তখন সাধারণ ভাবে মানুষের উন্নতির যে চেষ্টা প্রকাশ পায় তাতে এমন শ্লোক গীতাকে একটা আবশ্যকীয় গৌরব দান করে।

অন্য ধরনের গভীরতর তাৎপর্যের সুভাষিতও গীতায় আছে; সেগুলির কিছু কিছু উল্লেখ করি। মৃত্যুকে জীবনের একটা অবস্থা— শেষ এবং অন্য দিকে প্রথম— বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘দেহে যেমন কৌমার, যৌবন, জরা ইত্যাদি অবস্থাগুলি পরপর আসে যায়, তেমনই আর একটি অবস্থা হল জন্মান্তর। [অতএব] ধীর ব্যক্তি মৃত্যুভয়ে মূহ্যমান হয় না।’ (২:১৩) এরই সঙ্গে দেহের মধ্যে যে আত্মা আছে বলে বিশ্বাস করা হত তা অক্ষয়: ‘অস্ত্রশস্ত্র তাকে ছেদন করতে পারে না, অগ্নি তাকে দহন করতে কিংবা জল তাকে সিক্ত (ক্লিন্ন) করতে পারে না কিংবা বাতাস তাকে শোষণ করতে পারে না।’ (২:১৩) অকস্মাৎ একটি সদুক্তি শোনা যায়: ‘সম্মানিত মানুষের অকীর্তি মরণের চেয়ে বেশি।’ (২:৩৪) সমাজে সম্মান কত দামি বলে ধরা হত এতে তারই প্রমাণ; আর এ সম্মান সমাজের ওপরতলার মানুষেরই, যারা ধনী, সম্ভবত শিক্ষিতও। কিছু পরেই শুনি, এ ধর্মের সামান্য অংশও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। (২:৪০) নিষ্কাম ধর্ম এত শক্তিশালী যে, এর সামান্য অংশও মহৎ ভয় থেকে বাঁচায়। ‘সমস্ত দেশ যখন জলমগ্ন, তখন কূপের জলের যতটুকু প্রয়োজনীয়তা, তেমনই যথার্থ জ্ঞানী লোকের তুলনায় সমস্ত বেদের তাৎপর্য অকিঞ্চিৎকর।’ (২:৪৬) অর্থাৎ কৃষ্ণ যে জ্ঞানের কথা বলছেন তা এত বিপুলবিস্তারী যে, সমস্ত বেদ তার তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। এখানে গীতা বেদকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিজস্ব বক্তব্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে। তার পর প্রায় হঠাৎই সেই বিখ্যাত শ্লোকটি: ‘কাজেই তোমার অধিকার। ফলে যেন তোমার কখনও প্রবৃত্তি না হয়। অতএব ফলের আশা ত্যাগ করে তুমি কর্ম করে যাও, কর্মফলে যেন তোমার আসক্তি না জন্মায়।’ (২:৪৭)

সমাজ তখন শ্রেণিবিভক্ত। আর এ কথাটা বলছেন বৃন্দাবনের রাজপুত্র কৃষ্ণ হস্তিনাপুরের রাজপুত্র অর্জুনকে।[৫] কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ কথাটা বলছে সমাজের উচ্চশ্রেণির লোক সমাজের নীচের তলার মানুষকে। অর্থাৎ অন্যের শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল মানুষ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই উৎপাদক শ্রমজীবী মানুষকে বলছে: পরিশ্রম কর মুখ বুজে, পারিশ্রমিকের আশা কোরো না। অর্থাৎ সেটা ভোগ করবে সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত শ্রেণির মানুষরা। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে যে সামাজিক বিভাগ তার কুফলের প্রকৃতি এই শ্লোকে বোধহয় প্রথমবার উচ্চারিত, যে উচ্চারণ আজও সর্বত্রই ঘটে চলে। পৃথিবীর যে বোধ শ্রমজীবী মানুষকে সমাজের নীচে নামিয়ে রেখে বলে, তোমাদের অধিকার শুধু কাজে, কর্মফলে নয়। ওটা ভোগ করার দায়িত্ব আমরাই নিয়েছি, আমরা যারা নিজেরা পরিশ্রম করি না, তোমাদের পরিশ্রমের ফল ভোগ করি মাত্র।

[৫. ‘ভগবদ্‌গীতায় বেদ থেকে অর্থাৎ যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সময় থেকে পরবর্তী কালের উপনিষদ চিন্তা এবং লোকোত্তর উপনিষদের ভগবৎ-চিন্তা ও পরমপুরুষ ব্রহ্মন থেকে ভাগবতের ঈশ্বরবাদ, সাংখ্যের পুরুষপ্রকৃতি দ্বৈততা, যোগের ধ্যান এ সব কিছুকেই মেলাবার একটা চেষ্টা। …ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধের সঙ্গে ক্ষত্রিয় মূল্যবোধ ও চিরাচরিত ব্রাহ্মণ্য সর্বদেববাদ মিলিয়েছে গীতা। এরই সঙ্গে মিশেছে একটি নূতন ধর্মবোধ।’ [Mircea Eliade (দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ১২৫)] এরই সঙ্গে মিলেছিল সে যুগের চিন্তাজগতের ঝোঁকগুলি ও তাদের সীমাবদ্ধতা, যার মধ্যে রচিত হল গ্রন্থখানি। বাজাজ ভগবদ্গীতাকে চিহ্নিত করেন এই বলে যে, ‘এটি অভিজাতশ্রেণির দর্শন হিসাবে যারা এটিকে পরিত্যাগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে একটি আশাহত সমাজের অস্ত্ররূপে ব্যবহৃত হয়, যাতে সমাজের নীচেরতলার মানুষের সমাজে কোনও রকম স্থিতি এবং মমত্ববোধ আসে। যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে ধৈর্য ও পরিতৃপ্তি।’]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *