গীতা কেন – ৪

চার

যে কথা আগে বলেছি: যুগটা ছিল নানা ধর্ম, নানা বিশ্বাস ও পন্থার সহাবস্থান। সমাজে মানুষ কতকটা বিকেন্দ্রিক ও নানা মতের আবর্তে আলোড়িত, হয়তো কতকটা বিভ্রান্তও। অতএব তারা পথপ্রান্তের অস্থিরতা ভোগ করছিল। অতএব ভিতরে ভিতরে নিশ্চিত, ধ্রুব একটা কিছু আশ্রয়ের খোঁজ চলছিল, যা পেলে আত্মিক আন্দোলন বা বিচলিত হওয়া থেকে সে রক্ষা পাবে। ভুললে চলবে না যে, এ সবের শুরুতেই অর্জুন তাঁর অবাধ্য হয়েছেন, মানবধর্মের কাছে বর্ণধর্মকে হীন প্রতিপন্ন করে ক্ষত্রিয়ের ধর্মযুদ্ধ থেকে বিরত হতে চেয়েছেন। কৃষ্ণ নানা রকম যুক্তি কুযুক্তি অপযুক্তি দিয়ে তাঁকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে চেয়েও পারেননি। টি এস রুকমনি বলেছেন, ‘এটি [গীতা] কোনও চিন্তাগত বিষয়ের ধারাবাহিক ভাবে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাতে উৎসাহী নয়।[১২] ফলে আভ্যন্তরীণ যুক্তিবন্ধন ছাড়া একটা মতবাদ সৃষ্টি হয় যাকে গ্রহণ করলে সাধারণ মানুষ মোটামুটি তুষ্ট হয়। না করলে মানসিক অশান্তি, অস্থৈর্য। তাই সাধারণ মানুষ সহজেই যুক্তিহীন মতবাদকে গ্রহণ করে সুখে দিন কাটায়।

[১২. ‘It is not interested in a theoretical exposition of a system of thought in a consistent manner.’ Journal of studies on Ancient India. Vol ( 1 ), 1998 No. 1 p. 22]

কারণ, এ সব যুক্তির কোনও ক্রম ধারাবাহিকতা বা পারম্পর্য নেই। সম্ভবত এগুলি সবই কৃষ্ণের যুক্তি নয়; রচয়িতারা নানা মানুষের নানা যুগে সৃষ্ট যুক্তি সাজিয়ে একটা কৃষ্ণকেন্দ্রিক কাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিলেন, সেটা যে একটা স্থির বিশ্বাসযোগ্য অবয়ব পায়নি দশম অধ্যায় পর্যন্ত তা পরিষ্কার। অথচ, কৃষ্ণের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। সমাজে সঞ্চরণমান বহু মতবাদের উল্লেখ এতে আছে, যদিও সার্থক কোনও সমন্বয় বা সমাহারের চেষ্টা নেই। ফলে প্রাসঙ্গিক আলোচনাগুলি প্রকৃত অর্থে বিচ্ছিন্নই থেকে গেছে। কোনও কোনও পণ্ডিত বা ভাষ্যকার সেগুলিকে একটি সুগ্রথিত রূপ দেবার চেষ্টা করলেও তা সার্থক হয়নি। প্ৰমাণ একাদশ সর্গ।

এ ছাড়াও এই সর্গগুলিতে নানা রকম দর্শন প্রস্থানের, মত ও বিশ্বাসের উল্লেখ আছে। সেগুলি সমাজের নানা স্তরে নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা আকারে চালু ছিল। সেগুলিকে যথাসম্ভব সংহত করে একটা স্থির বিশ্বাসযোগ্য রূপ দেবার চেষ্টা সারা গীতায় ছড়িয়ে আছে। সে সংহতি কোথাও তৈরি হয়নি। তাই নানা বিচিত্র যুক্তিতে একটা কিছু স্থির মতাদর্শ নির্মাণ করার চেষ্টা গীতার সর্বত্র ছড়ানো।

দশম-একাদশ অধ্যায় স্বতন্ত্র আলোচনার অপেক্ষা রাখে, সেটা সরিয়ে রেখে দিই দ্বাদশ অধ্যায়ের কিছু কিছু অংশ। ‘যার কাছে মানুষ উদ্বেগ বোধ করে না, লোকের কাছ থেকে যে উদ্বিগ্ন হয় না, হর্ষ, ক্রোধ, ভয়, উদ্বেগ থেকে যে মানুষ মুক্তই এমন ভক্তই আমার প্রিয়।’ (১২:১৫) কৃষ্ণের প্রিয় কে সে সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, যে হৃষ্ট নয়, বিদ্বেষী নয়, যে শোক করে না, কামনা করে না, শুভ-অশুভকে যে ত্যাগ করেছে সে আমার প্রিয়।’ (১২:১৭) মানুষের সমাজে দৈবাৎ এক আধজনকে দেখা যায় যার হর্ষ, শোক, দ্বেষ, আকাঙ্ক্ষা নেই, সে-ই কৃষ্ণের প্রিয়। তা হলে সে ব্যক্তির কী কোনও অনুভূতি আছে শোক যার হর্ষ, দ্বেষ আকাঙ্ক্ষা নেই? অর্থাৎ প্রায় অনুভূতিহীন যে মানুষ সেই কৃষ্ণের প্রিয়। এ কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, যার হৃদয় সমস্ত অনুভূতি থেকে মুক্ত সে-ই কৃষ্ণের প্রিয়। এমন মানুষ তো কাঠের পুতুলের মতো। ভক্তিও তো একটা অনুভূতিই, এবং তার মধ্যেও মন্দজনের প্রতি বিরাগ, সজ্জনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে। কাজেই অনুভূতি মাত্রই— কৃষ্ণভক্তি ছাড়া— খারাপ নয়। কৃষ্ণভক্তির মধ্যেই নিহিত থাকে কৃষ্ণ বিদ্বেষের প্রতি ক্রোধ বা অনীহা, কৃষ্ণপ্রেমীর প্রতি অনুরক্তি। কাজেই ভক্তের হৃদয় ধোওয়া-মোছা সাদা পাতার মতো হলে তা কি কোনও কাজে লাগে? এই রকমই কথা পরের শ্লোকটিতেও আছে: শত্রু ও মিত্রে সমভাবাপন্ন, মান ও অপমানে সমান ভাবাপন্ন, শীত, উষ্ণ, সুখ, দুঃখ, যার কাছে সমান, যাঁর কিছুতেই আসক্তি নেই [তিনিই কৃষ্ণের প্রিয়]।’ (১২:১৮) বর্ণনা শুনলে মনে হয় অজ্ঞান বা মৃত ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে, যার কোনও ইন্দ্রিয়গোচর বা অনুভূতি-গোচর উপলব্ধি নেই বলেই সে পরস্পরবিরুদ্ধ অনুভূতিগুলির ক্ষেত্রে সমান অবিচলিত।

প্রশ্ন থেকে যায়, এমন মানুষ কি সমাজে সত্যই শ্রদ্ধেয়? মন্দকে ঘৃণা ও বর্জন করা যেমন বাঞ্ছনীয়, সৎ-কে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করাও তো তেমনই প্রয়োজনীয়। উভয় প্রান্তে সমান উদাসীন মানুষ কার কোন কাজে লাগবে? সে কেনই বা কৃষ্ণের প্রিয় হবে, সে তো ভাল ও মন্দে সমান উদাসীন; তেমন মানুষের ভক্তি কার কাম্য হতে পারে? কেনই বা কাম্য হতে যাবে? ওই প্রায় নির্জীব ব্যক্তির ভক্তি দিয়ে কৃষ্ণেরই বা কোন কাজ হবে? তেমনই শুনি, ‘নিন্দা, স্তুতিতে সমান প্রতিক্রিয়া যা-হোক-কিছুতেই সন্তুষ্ট, গৃহহীন, স্থিরমতি যে ভক্তিমান মানুষ, সেই আমার প্রিয়।’ (১২:১৯) এখানে নতুন একটি কথা আছে, অনিকেত অর্থাৎ যে গৃহে বাস করে না, যার গৃহ নেই। সে কে? অরণ্যবাসী বা যাযাবর অথবা ভিক্ষুক। সমাজে এমন মানুষ প্রান্তবাসী, ব্যতিক্রমী। এদের দিয়ে সমাজ গঠিত হতে পারে না, চলতেও পারে না, তা তারা যতই কৃষ্ণের প্রিয় হোক না কেন। মনুষ্যসমাজকে তারা কিছু দিতেও পারে না। সমাজ থেকে কিছু নিতেও পারে না। যাদের অনুভবশক্তি এত শিথিল বা এত নিষ্ক্রিয় যে ভালমন্দ সুখ-দুঃখ তাদের কাছে সমান, তেমন মানুষ সমাজে কাজে লাগে না, তারা কৃষ্ণের প্রিয় হলেও। যাঁরা সুখে উচ্ছ্বসিত, বা দুঃখে মুহ্যমান হন তাঁরা ছাড়াও যাঁরা সুখ-দুঃখ দুয়েতেই খানিকটা স্থৈর্য ও আত্মস্থতা রক্ষা করতে পারেন তাঁরা সত্যিই শ্রদ্ধেয়— সমাজের এবং বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেরই কিন্তু কৃষ্ণ যাঁদের প্রিয় বলছেন তাঁরা সমস্ত অনুভূতিতে উদাসীন। প্রকৃতপক্ষে এঁরা মনুষ্যসমাজে থেকেও তার বাইরে।

এর পরে তিন রকম যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে: ‘ফালাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে, শুধু যজ্ঞ করা উচিত বলে যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তা সাত্ত্বিক। ফালাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দম্ভ যুক্ত থাকলে তা রাজসিক। এবং, বিধিবর্জিত, মন্ত্রহীন, শ্রদ্ধাহীন যে যজ্ঞ তা তামসিক।’ (১৭:১১-১৩) তিন রকম মানুষ তিন রকম প্রবৃত্তি ও মনোভাব থেকে যজ্ঞ করে; বলা বাহুল্য, কৃষ্ণের কাছে সাত্ত্বিক যজ্ঞই গ্রাহ্য, অন্য দু’টি নয়। এ অংশে বোঝা যায়, সমাজে যজ্ঞ তখনও চলত, কিন্তু কৃষ্ণ উপাসনাকে প্রাধান্য দিয়ে, একক কৃষ্ণেরই আরাধনা চান। সেই কারণেই এই সব পদ্ধতির স্থান দেওয়ার চেষ্টা সারা গীতাতেই। কৌশলে যজ্ঞকে তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেন অশ্রদ্ধার সঙ্গে যা হবন করা হয়, দান করা হয়, অনুষ্ঠান করা হয়, তাকে অসৎ বলা যায়; তা ইহলোকে ও পরলোকে কোথাও ফলধারণ করে না।’ (১৭:২৮) এ কথার পশ্চাতে সামাজিক একটি তথ্য আছে, যা চিরকাল ছিল এবং থাকবে; তা হল, মানুষ লোক-দেখানো বহু উপাসনার অনুষ্ঠান চিরকালই করত। এখনও করে এবং করবেও, এর পশ্চাতে আছে আত্মম্ভরিতা ও আত্মপ্রচার; দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নয়, অনুষ্ঠাতার মহিমা প্রচারমাত্র। এ উপাসনা দেবতার কাছে পৌঁছয় না। এ অংশে বোঝা যায়, সমাজে যজ্ঞ তখন চলত, কিন্তু কৃষ্ণ আরাধনাকে প্রাধান্য দিয়ে একক কৃষ্ণেরই আরাধনার কারণে এই সব পদ্ধতিকে স্থান দেওয়ার চেষ্টা সারা গীতা জুড়ে। কৌশলে যজ্ঞকে তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেন যজ্ঞ, পূজা, হোম, জপ ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মাচরণের কোনওটিই কৃষ্ণ আরাধনার বাইরে না থাকে।

পরে দেখানো হয়েছে, যথার্থ সাত্ত্বিক মানুষ বিভিন্ন সদগুণে ভূষিত হয়ে যে ধর্মাচরণ করে তার মধ্যে আত্মম্ভরিতা, আত্মপ্রচার থাকে না; সিদ্ধিতে থাকে নির্বিকার ভাব। (১৮:৩০) এই সাত্ত্বিক উপাসনাই কৃষ্ণের কাছে গ্রাহ্য। তা হলে মোটামুটি জানা গেল, পূজা বা অনুষ্ঠানে নিজেকে গৌণ রেখে, যদি তা সম্পাদিত হয়, কেবলমাত্র কৃষ্ণেই অক্ষুণ্ন ভক্তি রেখে, তবেই তা সার্থক, কারণ তখনই তা সাত্ত্বিক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং তা কৃষ্ণের পক্ষে গ্রহণীয় হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *