গীতা কেন – ৬

ছয়

যোগ সম্বন্ধে গীতায় অনেক কথা আছে। কখনও শুনি, ‘যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ’ অর্থাৎ চিত্তবৃত্তি বা প্রবৃত্তিগুলির একান্ত সংযম— বহির্গতি বন্ধ হওয়াই— যোগ। অর্থাৎ চূড়ান্ত ইন্দ্রিয় সংযমই যোগ। কখনও বা শুনি, তপস্বিভ্যোঽধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোঽপি মতোৎধিকঃ। কর্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তস্মাদ্ যোগী ভবার্জুন।’(৬:৪৬) যোগীকে তপস্বী, জ্ঞানী ও কর্মীর অধিক বলা হয়েছে। তা হলে কর্মী ও তপস্বীর স্থান যোগীর নীচে। এই যোগ প্রায় নিঃসাড়, নিষ্ক্রিয়, নিজ্ঞান এক মানুষ; সেই নাকি শ্রেষ্ঠ মানুষ। ধ্যান ও তপস্যার সঙ্গে তুলনা করে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে যোগীকে। এই যোগী কৃষ্ণের মতে ভক্তশ্রেষ্ঠ। সমস্তটার মধ্যে একটা অন্তর্বিরোধ ও বিরুদ্ধতা আছে।

জ্ঞানীর চেয়ে যোগীকে শ্রেষ্ঠ বললেও জ্ঞানকে বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ: ‘নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্ৰমিহ বিদ্যতে।’ (৪:৩৮) অর্থাৎ জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই; যদিও যোগীকে জ্ঞানীর চেয়ে উচ্চে স্থান দেওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য, এ জ্ঞান ব্যাকরণ, সাহিত্য, বিজ্ঞানের নয়, এ হল তা যা অন্য সব জ্ঞানের ঊর্ধ্বে। উচ্চারণ করে বলা হয়নি বটে, কিন্তু কৃষ্ণ তৎকালীন পাঠ্যতালিকা অর্থাৎ বেদাদি শাস্ত্রের জ্ঞানের কথা বলছেন না, এটা সহজেই বোঝা যায়। তবু সাধারণ ভাবে বুঝলেও কথাটা অত্যন্ত মূল্যবান: জ্ঞান পবিত্র, এত পবিত্র পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। নানা রকম বুদ্ধিগ্রাহ্য দর্শনচর্চার প্রস্থানের আলোচনা, বিশ্লেষণ ও বিতর্কের যুগে জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বলা হবে এ তো স্বাভাবিক, কিন্তু গীতা বলছে জ্ঞান পবিত্র, এত পবিত্র যে এর তুল্য পবিত্র আর কিছুই নেই।

জ্ঞানের বিষয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, ‘তোমাকে আমি জ্ঞানের কথা সম্পূর্ণ ভাবে বলব, যা জানলে জানবার জন্য আর কিছু বাকি থাকে না।’ (৭:২) এর পরে বলেন, ‘আমার পরে উপরে জানবার আর কিছু নেই।’ (৭:৭ তার মানে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ জ্ঞাতব্য বিষয়, তার পরে বা তার উপরে আর কিছু জ্ঞাতব্য নেই। এই জ্ঞানকে তাই অন্যত্র শ্রেষ্ঠ জ্ঞাতব্যের জ্ঞান বলা হয়েছে। কৃষ্ণই সেই জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু, যাঁকে জানলে অন্য কোনও শ্রেয়তর জ্ঞাতব্য আর থাকে না। অর্থাৎ, কৃষ্ণই জ্ঞাতব্যতম। জ্ঞানের সারা বিশ্বভুবনের ভরকেন্দ্র বটে।

গীতায় কৃষ্ণপ্রাথম্য নানা ভাবে ব্যক্ত রয়েছে, কারণ, এ গ্রন্থ রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য হল কৃষ্ণপ্রাথম্য ঘোষণা করা। যে কারণে কৃষ্ণকে মাঝে মাঝেই ব্রহ্মস্বরূপ বলা হয়েছে। এক হিসেবে গীতার অধিকাংশ জুড়ে যে বিষয়েরই বিবরণ দেওয়া হোক না কেন, তার মূল বিবক্ষিত বিষয়ই কৃষ্ণ। কৃষ্ণকে স্বরূপে জানা অর্থাৎ তাঁকে ব্রহ্মাস্বরূপ বলে জানা-ই হল জ্ঞান। জ্ঞানযোগ বলে স্বতন্ত্র একটি প্রসঙ্গ, একটি অধ্যায় আছে। সেটি এবং ইতস্তত ছড়ানো অন্যান্য জ্ঞানের কথা— সবই গিয়ে ঠেকে কৃষ্ণে: মূল জ্ঞাতব্য হল কৃষ্ণ। তা হলে জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে মানুষ যত জেনেছে, জানছে, জানবে সে সবের ঊর্ধ্বে গীতার কেন্দ্রবস্তু কৃষ্ণই জ্ঞান। বাকি জ্ঞান অপরিহার্য নয়। অপেক্ষাকৃত গৌণ এবং গুরুত্বে হীনতর। গীতার মূল উদ্দেশ্য হল কৃষ্ণকে মনুষ্য জীবনের কেন্দ্রবস্তু বলে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এই কাজটিই নানা উপায়ে সিদ্ধ করছে এ গ্রন্থ।

আরও কতকগুলি প্রাচীন বিষয়কে নতুন যুক্তিতে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করছে গীতা। তার মধ্যে একটা প্রাচীন ধারণা হল, সমাজে নারীর স্থান পুরুষের বহু নীচে। ধারণাটা সুপ্রাচীন, বেদ থেকেই প্রচলিত। তাকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা কৃষ্ণ একটা কর্তব্য বলে মনে করলেন।

এ সময়ের বেশ কিছু আগে থেকেই জৈন, বৌদ্ধ ধর্মমতে জন্মান্তরবাদ স্বীকৃত ছিল এবং সম্ভবত দেশের চিন্তাজগতে জন্মান্তরবাদ সত্যই সঞ্চরণ ছিল।

আগেই কিছুটা উল্লেখ করেছি, তাই গীতার অপর একটি প্রতিপাদ্য হল জন্মান্তরবাদ। তবে গীতা যখন রচিত হচ্ছে তখন সমস্ত সমাজের দর্শন ও ধর্মমত জন্মান্তরবাদ স্বীকার করে; বস্তুত জন্মান্তরবাদ সত্য ও অভ্রান্ত ধরে নিয়েই সকল প্রস্থান আপন-আপন মত প্রচার করেছে এমন এক পরিমণ্ডলে যেখানে একে অভ্রান্ত ধরে নিয়েই সব আলোচনার শুরু ও শেষ। নিশ্চয়ই তখনও সমাজে কেউ কেউ এ মতে অবিশ্বাসী ছিল, যেমন চার্বাক ও বার্হস্পত্য মতবাদীরা। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই জন্মান্তরে বিশ্বাসী ছিল, কারণ এ ধারণার সুবিধা এই যে, মৃত্যুতেই সব শেষ নয়, তার পরও মানুষ পরবর্তী জন্মে আপন ভাগ্যকে পুনর্নির্মাণ করতে পারে; এতে খানিকটা সুযোগ থাকে পরজন্মে ত্রুটি শোধনের ও উন্নতির। স্বভাবতই এটা সব মানুষেরই কাম্য ছিল। অধিকাংশ মানুষই জীবনকে সৎ ও ভোগ্য বলে মনে করে। তাই মৃত্যু তার কাছে এক পরম অবসান। বিকল্প মতে এ অবসানের স্থানে যদি একটা নূতনতর অস্তিত্বের সূত্রপাত বলে মনে করা যায় তবে, মৃত্যুর আতঙ্ক মনে এবং জীবনকে পুনর্বার লাভ করার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই সব কারণে জন্মান্তর দিকটি ভাবকল্প থেকে আশ্বাসে এমনকী বিশ্বাসেও পরিণত করেছিল সমাজ। পৃথিবীর অন্যত্রও কোথাও (যেমন গ্রিসে) জন্মান্তরবাদে কিছু মানুষের বিশ্বাস ছিল, কিন্তু ভারতবর্ষের মতো এমন অভ্রান্ত পরিণতি বলে তারা বিশ্বাস করত না। এবং নানাদিক থেকে এ মতটি তেমন পরিপুষ্টিও লাভ করেনি।

সমাজে এ মত প্রচলিত ও সাধারণ গৃহীত হলেও গীতা চেয়েছে একে আরও সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলতে। এর একটা সুবিধা হল, মৃত্যুতেই যে সব শেষ হয়ে গেল এই চূড়ান্ত নৈরাশ্য থেকে মুক্তি। জন্মান্তর অসংখ্য, ফলে এ জীবনের অতৃপ্ত কামনার পরিতৃপ্তির, এ জীবনের অপরাধ-মোচনের অনেক সুযোগ পুণ্যকর্মের জন্য প্রচুর সময় এবং সর্বোপরি বহু শত লক্ষ জন্মের পরে মোক্ষলাভের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে শাস্ত্রে— এর চেয়ে বড় লোভনীয় প্রস্তাব ভারতীয় সমাজে আর কী হতে পারে? জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠা করার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য তত্ত্ব বা প্রমাণ দেওয়া হয়নি। শুধু দেওয়া হয়েছে এমন এক আশ্বাস যার জন্য সব মানুষ সর্বত্রই উৎসুক ছিল। এই ঔৎসুক্যকে যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। তবু এই অতি দুর্লভ সৌভাগ্য সাধারণ মানুষ, বিশেষত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ বঞ্চিত মানুষকে বোঝানো সহজ যে, জন্মে যা পেলে না পরজন্মে হয়তো তা পাবে। তা হলে ‘মা ফলেষু কদাচন’-এর একটা ব্যতিক্রমী ক্ষতিপূরণাত্মক সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখা যায়। যে এ জন্মে ভোগের সুখের কিছুই পেল না কোথাও, সে ক্ষতিপূরণ শুদ্ধতা পাবে, সে কথা সাধারণ মানুষকে কী পরিমাণ প্রলুব্ধ করতে পারে, হতদরিদ্র, অত্যাচারিত মানুষের দৃষ্টিতে যে স্বপ্নস্বর্গ সৃষ্টি করতে পারে, তা তো বোঝাই যায়।

এ তত্ত্ব প্রমাণ করার দায় নেই, যেহেতু প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবু এই প্রলোভন স্বপ্নখচিত স্বর্গের, এ জন্মের বঞ্চনা, শ্রম, অনাহার সব কিছুই মেনে নিতে বলে এবং চিরবঞ্চিত মানুষ এই অলীক আশ্বাসেই প্রাণপণে সেবাকর্মে নিযুক্ত থাকে। হতদরিদ্রের কাছে এ জন্মে না হলেও পরজন্মে ভোগসুখ প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা মরীচিকার মতো তুলে ধরা হল তা যেমন কূটনীতি-সিদ্ধ তেমনই এ জন্মে উচ্চ বর্ণ-ত্রয়ীর পক্ষে বিশেষ লাভজনক। নবজন্মের অলীক মরীচিকা তাকে এ জন্মের বঞ্চনা ও দুঃখদারিদ্র্য সহ্য করার শক্তি দেয়। লাভ উভয়তই উচ্চবর্ণত্রয়ীর প্রচুর অকুণ্ঠিত সেবা প্রাপ্তি। এবং ভাগ্যহত, বাস্তবে পীড়িতকে এক মোহিনী মায়ায় সারা জীবন নেশায় বিভোর রাখে।

সাধারণ মানুষকে বলা হয়েছে যে, কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে কখনও নয়। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কর্মের ফলে নিস্পৃহ হয়ে মুখ বুজে ধনী ও উচ্চ ত্রিবর্ণের ইচ্ছাপূরণ ও সর্বতো ভাবে সেবা করে চলতে হবে। এই মানুষগুলির সামনে এ জন্মে কোনও ফললাভের আশা নেই, তাই গীতা এদের বলেছে, এ জন্মে যা পেলে না, পরজন্মে শক্তির আসনে অধিষ্ঠিত মানুষরা তোমাদের সুখ ঐশ্বর্য সম্মান সব কিছুই পাবার ব্যবস্থা করবেন। কাজেই জন্মান্তরবাদ না হলে ইহজীবনের সমস্ত বঞ্চনা, যন্ত্রণার ক্ষতিপূরণ হত না। যে সমাজে শক্তিমান শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে শুধু হাতে খাটিয়ে, তাদের সমস্ত শ্রমের ফল নিজেরা ভোগ করতে চায়, জন্মান্তরবাদ তাদের হাতে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রায় অমোঘ অস্ত্ৰ।

এ তো গেল ব্যক্তির দিকটা। সমাজের দিক থেকেও এর প্রয়োজন ছিল। মানুষকে যদি বলা হয় যে, এ জীবনে যা পেলে না তা পরজন্মে পাবে, যদি এ জন্মে দেবদ্বিজের সেবা করে, শূদ্র যদি উচ্চ তিন বর্ণের যথাযথ সেবা করে, নারী যদি সর্বতো ভাবে পুরুষের পদতলে থেকে তার সেবা করে, প্রজা যদি নিষ্প্রতিবাদে রাজা বা জমিদারের আজ্ঞাবহ হয়, তবে পরজন্মে তার অবস্থার উন্নতি হবে। অর্থাৎ সে পরজন্মে উচ্চতর বংশে জন্মালে শিক্ষিত হবে এবং তার আর্থিক অবস্থা বহুগুণে ভাল হবে। সব মানুষের এ জন্মের অতৃপ্ত বাসনা পূর্ণ হবে— এ কি কম প্রত্যাশা? এই টোপ ফেলে অগণ্য দুঃস্থ মানুষের লোভ ও আশা জানিয়ে রাখা হয়েছে আড়াই হাজার বছর। এবং এখনও হচ্ছে। গীতার প্রয়োজন ছিল জন্মান্তরবাদের- পরে আসছি সে কথায়। জন্ম ও জন্মান্তরের মধ্যে আছে একটি মৃত্যু। এবং মৃত্যুই জীবনের সর্বাঙ্গীণ বোধের দ্বার উন্মুক্ত করে। ভগবদ্গীতায় তাই জীবন সম্বন্ধে কৃষ্ণের বোধ। উপনিষদের জীবনদর্শন এতে বিধৃত।[১৪]

[১৪. ‘It is death which opens the door for realization of life in its totality. The Bhagabadgita is an embodiment of Krisnas attitude to life, it is an elaboration of the Upanisadic idea of viewing life.’ I.T. Mallary]

জন্মান্তরবাদে মানুষের একক জীবন আপাত ভাবে মৃত্যুতে শেষ হলেও পরজন্মে অন্য রূপে অন্য পরিবেশে জন্মে সে পুণ্য অর্জন করার অন্য একটি জীবৎকালের সুযোগ পায়। মুশকিল হল, পরজন্মে তার এ জন্মের পাপপুণ্য ও ভালমন্দ কাজের স্মৃতি থাকে না, কাজেই সে যা করে তা নতুন করেই করে। অর্থাৎ সচেতন ভাবে পূর্বজন্মের পাপ খণ্ডন করে না, এ জন্মের পুণ্যও অর্জন করে না। সবই যেন সাদা পাতায় লেখা হচ্ছে; আগের জন্মের সঞ্চিত পাপপুণ্যের সঙ্গে যোগবিয়োগ হচ্ছে না। তা হলে তার নৈতিক, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক যোগফল বা বিয়োগফল বাড়ছেও না, কমছেও না। কর্মের কর্তা যদি পূর্বজন্মের পাপপুণ্যের হিসাব না মনে রাখে, তা হলে তার কর্ম প্রতিজন্মেই তো শূন্য থেকেই শুরু হবে। একে যুক্তিযুক্ত করে তুলতে গেলে কর্মকর্তার বাইরে একজন চিরকালীন হিসাবনবিশ কল্পনা করতে হবে, যার খাতায় অনাদিকাল থেকে প্রতি ব্যক্তির পাপ-পুণ্যের একটি নির্দিষ্ট অভ্রান্ত তালিকা আছে, যাতে প্রতি জন্মের পাপ ও পুণ্য যোগ-বিয়োগের দ্বারা কিছু পরিবর্তন ঘটছে— যা সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য এবং যার ওপর তার পরজন্মের অবস্থান নির্ধারিত হবে। কিন্তু তেমন কোনও চরিত্র শাস্ত্রে নেই। যেমন, ধনী দরিদ্র ভেদ, বা অন্যান্য কৃত্রিম উৎকর্ষ-অপকর্ষভেদ না মানা কতকটা ম্লান হয়ে যায়। সমাজে যে একবার উৎকর্ষ সম্মান পেয়েছে, বরাবর সেগুলির পিছনে তার সাধনা আছে এবং এই মনোভাবে সেই সাধনাকে তুচ্ছ করা হল। হাতি, গাভি, কুকুরের সঙ্গে মানুষ চণ্ডালকে একই ‘মর্যাদা’ দেওয়া হল। যেহেতু সমাজ শিক্ষিত চরিত্রবান বিত্তবান ব্রাহ্মণকে চিরকাল সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে এসেছে, সেই হেতু সমাজ যে চণ্ডালকে মানুষের মর্যাদা দেয়নি তাকেও একাসনে বসানো হল: হাতি, গাভি, কুকুরের সঙ্গে একই সারিতে। তাতে উভয়পক্ষেরই মূল্য সংশয়িত ও হীন করা হল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি সমাজস্বার্থের অনুকূল? গীতার শুরুতে কৃষ্ণ যুক্তিপূর্ণ কথা বলছেন। শ্রোতাকে স্বমতে আনার জন্য অনুনয়ের সুরও কিছু ছিল, কিন্তু ক্রমেই তাঁর সুর হয়ে দাঁড়ায় একক বক্তার এবং অবশেষে তা হয় ফতোয়া দেওয়ার ভাষা ও ভঙ্গিমা। এর থেকে কৃষ্ণ যুক্তিনির্ভর কথার ওপরে আর ভরসা রাখতে পারলেন না, অনেকটা সমাজে তাঁর উচ্চ অবস্থানের জোরে শেষ কথা বলার ভাষা ব্যবহার করলেন। অর্থাৎ, যুক্তি বা নমনীয়তার থেকে তাঁর আস্থা সরে গেল অর্জুনের দৃঢ় প্রতিকূলতায় এবং একাদশ সর্গে বিশ্বরূপদর্শনে যুক্তির সমাধি ঘটল। সর্বোচ্চ বক্তা সর্বশেষ বাণী দিলেন, অপ্রাকৃত ঘটনায় অর্জুনকে মোহাবিষ্ট করে তুলে। হয়তো এ ছাড়া কৃষ্ণের অন্য উপায়ও কিছু জানা ছিল না। তাই তির-ধনুক ছেড়ে অবশেষে যেন বাধ্য হয়েই ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করতে হল। একাদশ অধ্যায়ে কৃষ্ণকে সজ্ঞানেই যুক্তিতর্কের প্রচলিত পথ ছেড়ে যোগের হীনতর পথ অবলম্বন করতে হল, সজ্ঞানে এবং স্বেচ্ছায়। এ কথা কি অর্জুনও বোঝেননি? তিনি নিরুপায় ভাবে মেনে নিলেন কৃষ্ণের জাদুবিদ্যা। যাঁকে তিনি ত্রিভুবনেশ্বর বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন, তাঁকে গুনিন বা জাদুকর বলে দেখতে কিছু বেদনা কি অনুভব করেননি? কিন্তু যে আড়ম্বরের মধ্যে বিশ্বরূপ দর্শননের অবতারণা ঘটল তাতে সহজবুদ্ধি ম্লান ও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল।

আর একটি বিষয়ে কৃষ্ণ বারবার বলেছেন, তা হল সমদর্শিতা। যেমন বলা হয়েছে যে, যে মানুষ বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন, ব্রাহ্মণ, গাভি, হস্তী, কুকুর এবং চণ্ডালকে একই ভাবে দেখে, সেই কৃষ্ণের প্রিয়। (৫:১৮) অন্যত্র শুনি, সুহৃৎ, বন্ধু এবং নিরপেক্ষ উদাসীন সাধু ও পাপীকে যে একই দৃষ্টিতে দেখে, সে সমবুদ্ধি এবং বিশিষ্ট। মনে রাখতে হবে, সেই সময়কার (এবং এখনকারও) সমাজ নারী ও পুরুষের মধ্যে যে আপেক্ষিক উচ্চনীচের অবস্থান সৃষ্টি করেছিল— বা পূর্বতন ব্যবধানের অনুবৃত্তি করেছিল— তার ফলে নারীর স্থান হয়েছিল পুরুষের পদতলে। এমনই অলঙ্ঘনীয় ব্যবধান ছিল ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের মধ্যে, ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের মধ্যে এবং সর্বাধিক ভাবে একটি উচ্চ ত্রিবর্ণের সঙ্গে শূদ্রের। কিন্তু যে কথা শাস্ত্র উচ্চারণ করে বলেনি প্রায় কখনওই, তা হল, ডোম-চণ্ডাল, আদিবাসী ও সমাজের প্রত্যন্তবাসী যে সব মানুষ কোনও দিনই মানুষের মর্যাদা পায়নি— এখনও পায় না। অথচ এরা সমাজের মোট জনসংখ্যার বেশ ভাল একটি অংশ। তাদের কাজের ফলের দ্বারা বাকি সমাজ লাভবান হয়। কিন্তু তারা সমাজের কোনও মর্যাদা এমনকী ন্যূনতম পারিশ্রমিকও পায় না। অর্থাৎ সমদৃষ্টির যেখানে অবকাশ ছিল, সেটা কৃষ্ণ ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। কাজেই ভারী গলায় উচ্চারিত সমদৃষ্টির মধ্যে কত যে ফাঁক, অতএব কত যে ফাঁকি তা বাস্তব সমাজের অবস্থার দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অথচ গীতার বহুবিধ আকর্ষণের মধ্যে সমদর্শিতার আকর্ষণ একটি প্রধান আকর্ষণ। যেমন, কৃষ্ণ মাঝে মাঝেই বলেন কেউ আমার বিদ্বিষ্ট নয়, কেউ আমার প্রিয় নয়; অথচ বারবারই কে যে তাঁর প্রিয়, সে কথা নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। এমন পরস্পরবিরোধী মন্তব্য গীতায় নানা স্থানে বিস্তর ছড়িয়ে আছে। এই কারণে গীতা কোনও একটি দর্শন প্রস্থান হয়ে ওঠেনি; তৎকালীন সব দর্শনের একটা জগাখিচুড়ি এতে পাওয়া যায়; এবং বলা বাহুল্য, সাধারণ মানুষ একটি নির্দিষ্ট প্রস্থান অনুধাবন করতে চায়ও না, পারেও না। তারা জগাখিচুড়ির মধ্যে নিজের এবং আশপাশের লোকের মতের সমর্থন খুঁজে পায়। গীতার জনপ্রিয়তার মূলে এটিও একটি বিশিষ্ট আকর্ষণ: গীতা তার পাঠককে কোনও নির্দিষ্ট মতবাদে একনিষ্ঠ হতে বলে না। বরং নানা মতের মিশ্র একটি অস্বচ্ছ পটভূমির মধ্যে কৃষ্ণকে বেছে নিয়ে তাঁর প্রতি অনুগত হতে বলে। এই ধরনের উক্তি আরও আছে। কিন্তু এই মনোভাবটির শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নের অতীত নয়। কারণ, বিদ্যা, নৈতিক উৎকর্ষ যেমন সম্মানের বস্তু, তেমনি জ্ঞানীগুণী ব্রাহ্মণ, গাভি, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডাল যদি একই পর্যায়ভুক্ত করা যায়, তা হলে কোনও বিষয়ে উৎকর্ষ লাভের সাধনাই আর বিশিষ্ট থাকে না। তার সঙ্গে গাভি ও হস্তীকেও যদি একই দৃষ্টিতে দেখতে হয়, তবে মনুষ্যত্বও অবনমিত হয়। তেমনি সাধু ও পাপিষ্ঠকেও যদি একই দৃষ্টিতে দেখা বাঞ্ছনীয় হয়, তা হলে উৎকর্ষ-অনুৎকর্ষের মূল্যমান আর থাকে না। অথচ গাভি ও হস্তীর চেয়ে মানুষের মনুষ্যত্বেরও যেমন কোনও বৈশিষ্ট্য পায় না, তেমনি সমাজে যাঁরা সাধনার দ্বারা জ্ঞানবিদ্যা অর্জন করেছেন, তাঁরাও গাভি, হস্তী, সারমেয়র সঙ্গে একাসনে বসে যান। বিশিষ্ট জ্ঞানী ও সচ্চরিত্র মানুষের সাধনালব্ধ উৎকর্ষের মূল্যায়নে কোনও মাপকাঠিই আর থাকে না। সমদর্শিতা তখন নির্বিকারত্ব, এমনকী মূর্খতারই সমপর্যায়ে এসে যায়। তা হলে কোনও ভাবেই উৎকর্ষলাভের জন্যে যে দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন, সে সাধনাও নিতান্ত অর্থহীন হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *