ক্রন্দসী প্রিয়া – ৪

নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বললাম, আমার ফিরতে হয়তো একটু রাত হতে পারে, তুমি কোনো চিন্তা করো না।

সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তো এভাবে বলে কখন কোথাও যাওনি? মনে হচ্ছে এই কদিন যেন কিছু ভাবছ?

আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, পাগলী, তোমাকে কি করে সুখী করব সেই কথা ভাবছি। এই অকাট্য মিথ্যা বলতেই আমার মনের মধ্যে সুঁচের মতো বিঁধল।

আদরের প্রতিদান দিয়ে আমার স্ত্রী বলল, আমি এর চেয়ে বেশি সুখ চাইনি। তোমার হাসি মুখ দেখলেই শান্তিতে আমার মন ভরে যায়। আল্লাহপাক যেভাবে রেখেছেন তাতেই আমরা শোকর করে থাকব। আমার জন্য তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।  

স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনটের অনেক আগেই পার্কের গেটে পৌঁছলাম। ইচ্ছা ছিল পার্কটা একটু ঘুরে দেখব। কিন্তু রিকশা থেকে নেমেই সেলিনাকে একটি মেয়ের সঙ্গে গেটের ভিতর কথা বলতে দেখলাম। তাদের সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোকও রয়েছেন।

আমাকে দেখতে পেয়ে সেলিনা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে আমাকে সালাম দিয়ে বলল, এখন আড়াইটা বাজে। আমি জানতাম, আপনি ঠিক তিনটেয় আসবেন। কেমন আছেন?

সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবুজ রং এর শাড়ী ও ব্লাউজে খুব সুন্দর মানিয়েছে।

চোখে চোখ পড়তে সেলিনা বলল, কি দেখছেন? কথা বলছেন না কেন?

বললাম, ওরা কারা?

ভদ্রলোক আমার খালু, আর মেয়েটি খালাতো বোন। গতকাল সিলেট থেকে আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওরা পার্ক দেখে কোথায় যেন যাবে। আমাকে সঙ্গে থাকতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। বলেছি একজনকে তিনটের সময় এখানে। আসতে বলেছি, তার সঙ্গে বিশেষ দরকার আছে। রেষ্টুরেণ্টে যাই চলুন।

না, বরং কোনো নির্জন জায়গায় বসা যাক। হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে আড়াল দেখে ঘাসের উপর দুজনে পাশাপাশি বসে পড়লাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, চিন্তা ভাবনা করে কি ঠিক করলেন?

সেলিনা লেকের পানির দিকে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে চেয়ে রইল। তারপর ঘুরে আমার মুখোমুখি বসে বলল, আমি আমার ফাইন্যাল মতামত বলছি শুনুন, মরে গেলেও আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারব না। আমাকে কোনো কারণ দেখিয়ে ভুলাতে পারবেন না। আমি আপনাকে ভালবেসেছি, আপনার পরিচয়কে নয়। সে জন্য যত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় করব, যত দুঃখ সহ্য করতে হয় করব, তবু আপনাকে হারাতে পারব না।

অবাক হয়ে বললাম, আপনি পাগলের প্রলাপের মত কথা বলছেন। কোনো সুস্থ মানুষ এই রকম কথা বলতে পারে না। আমার কাছ থেকে আপনি দৈহিক, মানষিক ও আর্থিক কোনো দিক থেকেই এতটুকু সুখ-শান্তি পাবেন না, বরং পাবেন শুধু অবহেলা আর অশেষ দুঃখ। আপনি ধনীর দুলালী, এইসব সহ্য করতে পারবেন না। পৃথিবীর কোনো মেয়েই প্রেম দিয়ে এইগুলো ক্রয় করতে চাইবে না। অনেকে শত দুঃখ সহ্য করতে পারলেও স্বামীর অবহেলা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে। আমি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।

সেলিনা আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, আপনি এইসব কথা বলবেন না। পৃথিবীর মেয়েরা প্রেম দিয়ে কি খরিদ করে তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, প্রেম দিয়ে প্রেম খরিদ করব। সে জন্য আপনি আমাকে যত দুঃখ দেন, যত অবহেলা করুন না কেন, সবকিছু আমি নীরবে সহ্য করব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনাকে আমি প্রেম দিয়ে একদিন না একদিন জয় করবই করব। পৃথিবীর কোনো বাধাই আমি মানব না। প্রয়োজন হলে চির কুমারী থাকব। যদি তা না পারি অন্যের অঙ্কশায়িনী হওয়ার আগে আত্মহত্যা করব। জানব, এটাই আমার তকৃদির। দেশী বিদেশী অনেক বই পড়েছি। জেনেছি, প্রেম মানেই দুঃখ। লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স। সুতরাং দুঃখের কথা বলবেন না। আমাকে বিয়ে করতে হয়তো আপনার অনেক বাধা থাকতে পারে। অথবা আমাকে নষ্ট চরিত্রের মেয়ে ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরে যেতে পারেন। তবু আমি আমার প্রেমকে চিরকাল বাচিয়ে রাখব। তাতে অক্ষম হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেব।

ভাবলাম, ও আমাকে এত বেশি ভাল বেসে ফেলেছে যে, যদি আমাকে না পায়, তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে ফেলবে। খুব চিন্তিত হলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম, বিয়ের কথা পরে ভাবা যাবে। আমি আপনাকে একটা চিঠি দেব, তার উত্তর পাওয়ার পর ভবিষ্যতে কি করব জানব। কথাগুলো বলে ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার মুখের দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ সেলিনা আমার ডান হাতটা দুহাতে ধরে প্রথমে চুমো খেল, তারপর নিজের দুগালে ঘষতে লাগল।

আমার হাত তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল। আমার কাছ থেকে নাম মাত্র আশ্বস পেয়ে সেলিনা আনন্দ অশ্রু ফেলতে লাগল। তার গভীর প্রেমের পরিচয় পেয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। অনুভব করলাম, আমি তার গভীর প্রেমের সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি? পরক্ষণে আমার স্ত্রীর মুখ মনে পড়তে স্বজ্ঞানে ফিরে এলাম। হাতটা টেনে নিয়ে বললাম, ইসলাম এইজন্য মেয়েদেরকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছে। আর নির্জনে যুবক যুবতীর সাক্ষাৎও হারাম। করেছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কখনও কোনো বেগানা মেয়েকে স্পর্শ করি নি। জানি না, আল্লাহপাক আমাকে ক্ষমা করবেন কি না। আমি আপনার ডাকে আসতাম না। যদি না আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করতেন। আর এই যোগাযোগ বন্ধ করার জন্যই আজ এসেছি। ভেবেছিলাম, আমার পরিচয় পেয়ে ঘৃণা করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এখন দেখছি সে ধারণা ভূল। আপনাকে আমার সত্য পরিচয় দিয়ে শত বাধা বিপত্তির কথা বলে যতই দুরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি, আপনি ততই প্রেমের জাল বিস্তার করে আমাকে ঘিরে ফেলছেন। উপরের মালিকই জানেন আমার কি হবে?

সেলিনা রুমালে চোখ মুখ মুছে বাদাম ওয়ালার দিকে গেল। আমি লেকের। পানিতে অজু করে ঐখানেই ঘাসের উপর আসরের নামায পড়লাম। সেলিনা ফিরে এসে আমার নামায পড়া দেখছিল। নামায শেষ করে টুপিটা পকেটে রেখে বললাম, যাবেন না বসবেন?

কিছু না বলে সেলিনা বসে পড়ল। তারপর বাদামের ঠোঙাটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, নিন খান।

বাদাম নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা নামায পড়েন?

আমি ছাড়া আর কেউ পড়ে না।

আসরের নামায পড়বে না?

কথাটা শুনে সেলিনা প্রথমে চমকে উঠল। তারপর আমার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে কেমন করে পড়ব? বাসায় গিয়ে পড়ব।

তার চমকে উঠার কারণটা বুঝতে পারলাম না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে নামায পড়ছ?

যখন থেকে আপনার প্রেমে পড়েছি।

প্রেমের সঙ্গে নামাযের কি সম্পর্ক?

তা বলতে পারব না। শুধু এইটুকু মনে হয়েছে, নামায পড়া আল্লাহপাকের হুকুম। তার হুকুম পালন করলে আপনি নিশ্চয় খুশী হবেন। তাই আমার প্রেম নামায পড়তে বলেছে।

মেয়েদের মাথায় কাপড় বা রুমাল দিয়ে চুল ঢেকে রাখাওতো আল্লাহপাকের হুকুম।

আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সেলিনা শাড়ীর আঁচল মাথায় দিল। তারপর থেকে তাকে কোনোদিন মুহুর্তের জন্যও খালি মাথায় দেখিনি। তারপর বললাম, চল উঠা যাক, নচেৎ তোমার আসরের নামায কাযা হয়ে যাবে। কেউ যদি ইচ্ছা করে এক ওয়াক্ত নামায কাযা করে (না পড়ে), তবে তাকে আশী হোকবা দোজখে জ্বলতে হবে। (এক হোকবা সমান দুই কোটি অষ্টআশী লক্ষ বছর)।

সেলিনা, উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে বলল, একটা অনুরোধ করব রাখবেন?

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

এতক্ষণ যে সম্বোধনে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সব সময় সেই সম্বোধনে বললে খুব খুশী হব।

চিন্তা করলাম, সে আমার অন্তরের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। ফলে মনের অজান্তে তাকে এতক্ষণ তুমি করে সম্বোধন করেছি। আর সেই কারণে সেলিনা বোধ হয় তখন চমকে উঠেছিল।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবেন?

বললাম না, আমার মাথার মধ্যে তখন চিন্তার পোকাগুলো কিলবিল করতে আরম্ভ করেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম, সেলিনা বুঝতে পেরেছে যে, সে আমার অন্তরে প্রবেশ করেছে। নিজের উপর খুব রাগ হতে লাগল এবং তার সূত্রটা খুঁজতে গিয়ে সেলিনাই দায়ী বলে মনে হল। তখন সমস্ত রাগটা তার উপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। কারণ রাগের সঙ্গে কিছু বললে, তার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। আর সেলিনার ক্রন্দসী মুখটা আমাকে বড় বেশি ব্যথা দেয়। অনেক কষ্টে সম্বরণ করে নিলাম।

গেটে এসে সেলিনা বলল, আপনাকে কোথায় পৌঁছে দেব বলুন?

আচ্ছা, আপনি আমাকে কি মনে করেন? কোথাও পৌঁছাতে হবে না, আমি নিজেই যেতে পারব। রাগান্বিত অবস্থায় চিন্তিত ছিলাম বলে কথাগুলো একটু রাগের সঙ্গে বলে ফেলেছি। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো বর্ষায় পুরিপূর্ণ। নিজেকে সংযত করে বললাম, আমি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। অন্যমনস্কতায় একটু রেগে বলে ফেলেছি। এবার আসি, আল্লাহ হাফেজ বলে একটা রিকশায় উঠে বায়তুল মোকাররাম যেতে বললাম। সেলিনার দিকে চেয়ে দেখি, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, আর তার চোখ থেকে শ্রাবণের ধারা ঝরছে। বায়তুল মোকাররামে মাগরিবের নামায পড়ে অনেকক্ষণ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে মোনাজাত করলাম

আয় পরওয়ারদেগার রহমানুর রাহিম, তোমার মোবারক নামে শুরু করিতেছি। তুমি অনাদি অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তুমি সর্বত্র সব সময় বিরাজমান, তুমি অসীম করুণাময়, ধৈৰ্য্য ও ক্ষমার আধার। আমি তোমার আঠার হাজার মাখলুকের শ্রেষ্ঠ মাখলুকের একজন নাদান বান্দা। তোমাকে আমার রেজেক যোগাতে হবে, আমার আশা-আকাঙ্খার কথাও শুনতে হবে। সর্ব প্রথম পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর রুহমোবারকের উপর তোমার রহমতের ধারা বর্ষণ কর। তারপর দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নর-নারীর উপর তোমার রহমতের দরজা উম্মুক্ত করিয়া দাও। দয়াময়, তুমি আমার মনের খবর জান। এই পাপী বান্দা বিবাহতি হইয়াও একটি নারীর প্রেমে দিন দিন আসক্ত হইয়া পড়িতেছি। তুমি উত্তম ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি উত্তম সৎপথ প্রদর্শনকারী, আমাকে সৎপথে চলার তওফিক দান কর। হে রাব্বল আলামিন, আমি কি করব বলে দাও। একদিকে আমার স্ত্রীর গভীর ভালবাসা, আর অন্যদিকে একটি মেয়ে প্রেমের দাবীতে আত্মহত্যা করতে চাইছে। তুমি উত্তম ফায়সালাকারী, আমি তোমার কাছে ফায়সালা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি ফায়সালা করে দাও। জানি তোমার আইন : অনুযায়ী চারটে পর্যন্ত বিবাহ হালাল। কিন্তু সেটাও তো প্রয়োজনের তাগিদে। আরও জানি তুমি বলেছ বান্দা যদি সব স্ত্রীকে সমানভাবে রাখতে না পারে তবে যেন সে একটাতে সন্তুষ্ট থাকে। হে গাফুরুর রাহিম, তুমি সবকিছু জান, সারা জাহানে যা কিছু হচ্ছে তোমার হুকুমেই হচ্ছে। তুমি আমার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে আমার এই দোয়াকে কবুল কর। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর এবং সমস্ত আম্বিয়া (আঃ)-এর উপর শান্তি বর্ষণ কর। আমিন সুম্মা আমিন।

তারপর এশার নামায পড়ে বাসায় ফিরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *