ক্রন্দসী প্রিয়া – ২

বেলা তখন দুটো। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের আধাআধি। জোহরের নামাযের পর খাওয়ার পর্ব শেষ করে দোকানের সামনের আঙ্গিনায় রোদ পোহাচ্ছি। সে বছর শীত বেশ জোরে সোরে পড়েছিল। যখনকার কথা বলছি, তুই তো জানিস তখন আমি ঢাকা গভঃ নিউমার্কেটের একটা বড় লাইব্রেরীতে সেলস ম্যানেজার ছিলাম। অন্যান্য দোকানের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছি। এমন সময় আমার একজন সহকর্মীর ডাকে আমি দোকানে গেলাম। তিনজন ছাত্রীকে দেখিয়ে সে বলল, ইনারা দুটো বই ফেরত দিয়ে অন্য বই নিতে এসেছেন।

ওদের মধ্যে একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, দয়া করে এই দুটো বই চেঞ্জ করে দিন। তারপর একটা বই কাউন্টারের উপর রেখে বলল, এটার ভিতরের দুটো পাতা ছেঁড়া। আর ওরা গতকাল এখান থেকে যে বইটা কিনেছিল, সেটা না দিয়ে আপনারা ভুল করে অন্য বই প্যাকেট করে দিয়েছেন। তারপর দ্বিতীয় বইটাও কাউন্টারের উপর রেখে বলল, বইয়ের ভেতরে মেমো আছে।

শীতের রোদ থেকে আসতে এমনি বিরক্ত লাগছিল, তার উপর বই চেঞ্জের কথা শুনে আরো বেশি বিরক্ত বোধ করে সহকর্মীকে তাদের মেমো মোতাবেক বইটি দিতে বললাম। যে ছাত্রীটি আমার সঙ্গে কথা বলছিল, তার বইটা ছিল ইন্টারমিডিয়েটের ইংলিশের নোট। আমি ঐ বইটার অন্য এক কপি তাকে দিলাম। তারপর ফেরৎ বইটার ছেঁড়া পাতা খুঁজতে গিয়ে সেখানে এক টুকরো কাগজ ভাঁজ করা দেখলাম।

কাগজটা ছাত্রীটিকে ফেরৎ দিতে গেলে সে আস্তে করে বলল, ওটা আপনাকে দিয়েছি, পড়ে দেখবেন।

প্রথমে কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। পরক্ষণে কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম, হলুদ রঙ এর জাপানি সিফনে আবৃত দেহ থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে। দীর্ঘায়ত চোখে অপূর্ব কোমলতা।

চার চোখ এক হতে মেয়েটি স্নিগ্ধ কণ্ঠে শুধাল, আমাকে চিনতে পারছেন না?

আমি একটু চিন্তা করে বললাম, এখানে আমার চেনা জানা কোনো মেয়ে নেই। তবে আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।

মেয়েটি তখন মিনতি সুরে বলল, আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরী কথা আছে। এই চিঠিটা পড়ে সেইমতো আমার সঙ্গে দেখা করলে খুব উপকৃত হব।

কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না

মৃদু হেসে মেয়েটি জওয়াব দিল, দয়া করে তর্ক করবেন না। প্লীজ, মনে করুন এটা একটা আপনার খুব আপনজনের ঐকান্তিক মিনতি।

আমি কিছু বলার আগে তার সঙ্গিনীরা তাকে ডেকে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটির স্পর্ধা দেখে যদিও রাগে আমার আপাদমস্তক রি রি করে উঠল, তবু কাগজটায় কি লেখা আছে তা জানার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে দোকানের ভিতরে গেলাম। সেখানে অফিসিয়াল কাজের জন্য টেবিল, চেয়ার, লাইট, ফ্যান সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। বইয়ের আলমারী দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। কাগজটা খুলে পড়লাম

মাননীয় ম্যানেজার সাহেব, আপনি যদি আগামী সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল আটটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসেন, তাহলে আমি খুব বাধিত হব।
ইতি-সেলিনা।

প্রথম থেকেই মেয়েটির কথা বার্তায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সবকিছু যেন গায়ে-পড়া ভাব। তারপর এই চিঠি পড়ে বেশ অসন্তুষ্ট হলাম। কারণ আমি ধর্মের আইন যথাসম্ভব মেনে চলি। অন্য যে কোনো লোক হলে হয়তো রোমান্টিক কিছু অনুভব করত। এই রকম চিন্তা করা যে পাপ, তা আমি জানতাম। সিগারেট ধরিয়ে কাগজটা পুড়িয়ে ফেললাম। মনে হলো সব অসন্তোষ দুর হয়ে গেল। তারপর বেমালুম সব কিছু ভুলে গেলাম।

আমি যে দোকানে চাকরি করতাম সে দোকানের মাঝখানের দেয়াল ভেঙ্গে দুটোকে একটা করা হয়েছে। আমি ছাড়াও তিনজন সেলসম্যান ছিল। কর্মদক্ষতায় সকলের চেয়ে সিনিয়ার ছিলাম। আর ঠিকমতো নামায রোযা করতাম। সেই জন্য আমার সহকর্মীরা আমাকে খুব সমীহ করে চলতো। আমি তাদেরকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম। এই দোকানে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ ও আইনের দেশী-বিদেশী এবং নানারকম ধর্মীয় পুস্তক ছিল।

দোকানের অর্ডার লিষ্ট তৈরির কাজে কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ঐ চিঠির কথা হয়তো কোনো দিন আর মনেই পড়ত না। কিন্তু বিধির বিধান অন্য রকম। উক্ত ঘটনার দিন পনের পর একদিন মার্কেটের ভিতরের একটি ঘড়ির দোকানে আমার রিষ্ট ওয়াচটা ওয়েলিং করতে দিয়ে ফিরছি, হঠাৎ ঐ মেয়েটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। বলল, আমার সঙ্গে একটু আসুন।

মেয়েটিকে দেখে তার নাম ও চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। আর তার স্পর্ধার বহর দেখে রাগে চোয়ালটা আপনা হতেই শক্ত হয়ে উঠল। তথাপি নিজেকে সংযত করে সৌজন্য রক্ষা করার জন্য বললাম, আমার এখন সময় নেই।

মিনতি ভরা কণ্ঠে সেলিনা বলল, আপনার বেশি সময় নষ্ট করব না। দয়া করে যদি আসেন, তাহলে দুএকটা কথা বলেই ছেড়ে দেব।

আমাকে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে অন্যান্য দোকানের পরিচিত কয়েকজন সেলসম্যান আমাদেরকে বিশেষ ভাবে যে লক্ষ্য করছে, তা আমি এদিক ওদিক তাকাতেই বুঝতে পারলাম। বললাম, ঠিক আছে চলুন।

সেলিনা আমাকে নভেল ড্রিংক রেষ্টুরেণ্টের দোতলার একটি কেবিনে বসিয়ে বলল, কি খাবেন? ঠান্ডা না গরম?

কোনো কিছুই এখন আমি খাব না, যে জন্য ডেকেছেন বলুন।

আপনি যদি কিছু না খান, তবে ভাববো আমার উপর খুব রেগে আছেন।

বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠান্ডা।

তাহলে আপনিই অর্ডার দিন।

যদিও তখন শীতকাল তবু বেয়ারাকে ডেকে রাগের চোটে চারটে ঈগলু দিতে বললাম। বেয়ারা চলে যেতে ওকে বললাম, আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।

আপনি যেভাবে রেগে আছেন, তাতে কিছু বলতে সাহস হচ্ছে না।

তাহলে বলার দরকার নেই, চললাম। দয়া করে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করবেন না। এই কথা বলে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

তখন সেলিনাও দাঁড়িয়ে আমার একটা হাত খপ করে ধরে বলল, প্লীজ, যাবেন না। একটু বসুন।

আহ, কি করছেন, হাত ছাড়ুন। সেলিনা লজ্জা পেয়ে হাত ছেড়ে দিতে আমি বসলাম। এমন সময় বেয়ারা দুটো ঈগলু টেবিলের উপর রাখল। তাকে বললাম, তুমি কেমন মেসিয়ার? অর্ডার দিলাম চারটে, আর দিলে দুটো। অথচ অন্যেরা খদ্দেরকে বেশি খাওয়াবার চেষ্টা করে।

বেয়ারা কিছু বলার আগেই সেলিনা বলল, আমরা যখন এখানে আসি তখন দোকানের মালিক দেখেছেন। উনি জানেন আমি ঈগলু খাইনা। তবু যখন আমার কাছ থেকে অর্ডার গেছে তখন কম করে দিয়েছেন।

বুঝতে পারলাম দোকানের মালিকের সাথে সেলিনার ঘনিষ্ঠতা আছে। বললাম, আপনি ঈগলু না খেয়ে অন্য কিছু খান।

আগে কখনো না খেলেও এবার থেকে খাব বলে সেলিনা খেতে আরম্ভ করল। তারপর বলল, আজ তো আপনার সময় নেই। তাই আপনাকে আগামী ছুটির দিন কিংবা যেদিন আপনার সময় হবে সেদিন আমার সংগে এক জায়গায় যেতে হবে। বিশেষ জরুরী কিছু কথা আমি আপনাকে বলতে চাই। গত ঐ ছুটির দিন আমি সকাল আটটা থেকে বেলা বারটা পর্যন্ত আপনার জন্য মার্কেটের গেটে অপেক্ষা করেছিলাম।

কথাটা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যে আসবো সেটা আপনি ভাবলেন কি করে? একজন অপরিচতি লোককে একটা চিঠি লিখে আসতে বললেই সে যে আসবে, সেটাই বা বিশ্বাস করলেন কেমন করে?

জানি না, তবে আমার বিশ্বাস ছিল আপনি আসবেন। আর আমি আপনার কাছে অপরিচিতা হলেও আপনাকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি।

সেলিনার উত্তর শুনে আরও অবাক হয়ে বললাম, কি কথা। এখানে বলা যাবে না?

সে অনেক কথা, এখানে অত কথা বলা সম্ভব নয়।

একটু চিন্তা করে বললাম, একটা শর্তে যেতে রাজি আছি।

একটা কেন, যদি শত শর্ত দেন, সবগুলো মানতে রাজি।

আপনি এরপর ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আর কোনো রকম যোগাযোগ করবেন না।

ভবিষ্যতের কথা আল্লাহপাক জানেন, তবে আপনার শর্ত মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করব।

আগামী ছুটির দিন বেলা নটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসব বলে দোকানের মালিকের নিকট বিল দেওয়ার জন্য গেলাম। উনি বললেন, বিল আগাম দেওয়া আছে। চলে আসার জন্য ঘুরে দেখি, সেলিনা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার সঙ্গে কোনো কথা না বলে দোকানে চলে আসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *