ক্রন্দসী প্রিয়া – ১

মীরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বাসে হঠাৎ অন্তরঙ্গ বন্ধু জামানের সাথে দেখা। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর বলল, তোর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হল। এখন তুই কিছু করছিস, না শুধু লেখা নিয়ে আছিস?

বললাম, আমার কথা বাদ দে। তুই লাইব্রেরীর চাকরি ছেড়ে কি যেন কেমিকেলের ব্যবসা করছিস শুনেছিলাম, সেটা এখন কেমন চলছে?

আল্লাহপাকের রহমতে ভালই চলছে। তা ছাড়াও একটা বইয়ের দোকান করেছি। একদিন ভাবি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে আয় না। বাড়ি করেছি শুনিস নি বোধ হয়?

না শুনিনি। বাড়ি যখন করেছিস তখন ব্যবসা ভালই চলছে নিশ্চয়?

হ্যাঁ বলে একটা কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল, কবে আসবি বল? তোর সঙ্গে তো প্রায় দশ বছর পরে দেখা হল, এর মধ্যে আমার জীবনে একটা রোমান্টিক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। তুই আগামী শুক্রবার ভাবিকে নিয়ে সকালের দিকে আসবি। তোর ভাবিকে বলে লাখবো। ও শুনলে খুব খুশি হবে। তোদের কথা প্রায় মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে। ঐদিন ঘটনাটাও শোনাব।

বললাম, ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ যাব।

গুলিস্তানে আসার পর বাস থেকে নেমে জামান আমাকে নিয়ে একটা রেষ্টুরেণ্টে ঢুকে চা-নাস্তার অর্ডার দিল।

জিজ্ঞেস করলাম, তোদের ছেলেমেয়ে কয়টা?

দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তোদের?

মৃদু হেসে বললাম, তিন বছর হল বিয়ে করেছি। এখনও হয়নি।

এমন সময় মেসিয়ার নাস্তা নিয়ে এলে জামান বলল, নাস্তা খেয়ে নিই আয়। আমার একটু তাড়া আছে। শুক্রবার আসিস, চুটিয়ে গল্প করা যাবে।

রেষ্টুরেণ্ট থেকে বেরিয়ে জামান একটা রিকশায় উঠে বলল, চলি দোস্ত। তুই কিন্তু ভাবিকে নিয়ে সকালের দিকে আসবি, একসঙ্গে নাস্তা খাব। তারপর সালাম বিনিময় করে রিকশা ওয়ালাকে বলল, সদরঘাট চল।

বাসায় এসে গিন্নীকে বললাম, আজ বহুদিন পরে বাসে বন্ধু জামানের সঙ্গে দেখা হল। তার কথা তোমার মনে আছে?

আমার স্ত্রী বলল, সেই বন্ধু তো? যে নিউমার্কেটে লাইব্রেরিতে চাকুরি করত? আমাদের বাসায় কয়েকবার এসেছে?

হ্যাঁ, সে এখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেমিকেলের ব্যবসা করে বেশ টাকার মালিক হয়েছে, একটা বাড়িও করেছে। তারপর কার্ডটা তার হাতে দিয়ে বললাম, এটা তার ঠিকানা। আগামী শুক্রবার আমাদেরকে যেতে বলেছে। না গেলে বেচার মনে খুব কষ্ট পাবে।

কার্ডের উপর চোখ বুলিয়ে ফেরৎ দেওয়ার সময় আমার স্ত্রী বলল, বেশ তো যাওয়া যাবে।

শুক্রবার সকাল নটার সময় স্বস্ত্রীক জামানদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। সালাম বিনিময়ের পর জামান ও তার স্ত্রী অভ্যর্থনা করে আমাদেরকে ড্রইংরুমে বসাল।

জামানের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি কেমন আছেন?

আল্লাহপাকের রহমতে ভাল আছি। তারপর লেখক সাহেবের পরবর্তী কি বই কবে নাগাদ বেরোচ্ছে? আপনার আগের দুটো বই কিন্তু দারুন হয়েছে।

জামানও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, সত্যি দোস্ত, তোর জওয়াব নেই।

বললাম, কতটা দারুণ হয়েছে জানি না, তবে তোরা দুজনেই যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছিস তখন মনে হচ্ছে, দারুণ না হলেও কিছু একটা হয়েছে। বর্তমানে প্রেমের পরশ নামে একটি বই লিখছি।

বন্ধুপত্নী বলল, নামটা শুনে মনে হচ্ছে এটাও দারুণ হবে।

দোয়া করুন, আল্লাহপাক যেন আপনাদের মনের বাসনা পুরণ করার তওফিক আমাকে দান করেন।

তাতো করবই, তারপর আমার স্ত্রীর হাত ধরে বলল, আপা, আপনি চুপ করে আছেন কেন? আমরা পাঠক-পাঠিকারা যখন ওঁর লেখা পড়ে এত আনন্দ পাই তখন আপনার তো সব থেকে বেশি আনন্দ পাওয়ার কথা।

আমার স্ত্রী কিছু বলার আগে জামান বলে উঠল, তুমি বেচারীকে কিছু বলার চান্স দিচ্ছ কই!

তুমি থামতো বলে বন্ধুপত্নী বলল, তোমরা বসে গল্প কর, আমরা ভিতরে যাচ্ছি। তারপরে চলুন আপা বলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে উদ্দত হল।

জামান বলল, দয়া করে একটু জলদি আমার বন্ধুর জন্য কিছু পাঠাও। কত বেলা হয়ে গেছে দেখছ না?

শুধু বন্ধুর জন্য পাঠাব, আর তোমার জন্য? জানেন আপা, আমার উনি না ভীষণ পেটুক। সকাল থেকে কিছু খাওয়ার জন্য কয়েকবার তাগিদ দিয়ে বলেছে, মেহমানরা কখন আসবে তার ঠিক নেই, যখন আসবে তখন না হয় আর একবার তাদের সঙ্গে খাওয়া যাবে। এখন কিছু দাও না, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।

আমি বললাম, নটার আগে কিছু পাচ্ছ না। এর মধ্যে যদি না আসে তখন দেখা যাবে।

আমার স্ত্রী হেসে ফেলে বলল, এটা আপনার অন্যায় হয়েছে। ভাই সাহেব খিদে পেয়েছে বলা সত্বেও আপনি তাকে কিছু খেতে না দিয়ে ঠিক করেন নি।

আমি বললাম, ওর কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।

ভাবি বলল, আমি আপনাদের জন্য এত করলাম, আর আপনারা দুজনেই আমার দোষ দিচ্ছেন। এ যে দেখছি-যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর।

জামান বলল, হয়েছে হয়েছে, আমার কাছে আর ক্ষমা চাইতে হবে না। তাড়াতাড়ি কর, নচেৎ দেরি করলে ক্ষমা চাইলেও কিন্তু করব না।

স্বামীর প্রতি একবার কটাক্ষ হেনে ভাবি বলল, ক্ষমা চাওয়ার মতো অন্যায় করলে তো ক্ষমা চাইব। তারপর সে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।

খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালই হয়েছিল। তখন বর্ষাকাল। দুপুরের পর মুষলধারে বৃষ্টি নামল। জোহরের নামায পড়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে যাওয়ার সময় জামান স্ত্রীকে বলল, তোমরা দুজনে গল্প কর, আমাদের কাছে এসে ডিষ্টার্ব করো না। আমাদের দুজনের মধ্যে বিশেষ কিছু কথা। আছে। তবে এমন বর্ষামুখর দিনে মাঝে মাঝে ছোলা-কড়াই ভাজা আর চা পাঠালে খুব খুশী হব। তারপর ড্রইংরুমে এসে দুজনে মুখোমুখি সোফায় বসে সিগারেট ধরালাম।

প্রথমে আমিই বললাম, তুই কি যেন তোর জীবনের ঘটনা বলবি বলেছিলি?

জামান বলল, বলব, তবে তার আগে তোকে কথা দিতে হবে, এটাকে নিয়ে তুই একটা উপন্যাস লিখবি। তোর ফুটন্ত গোলাপ ও বিদেশী মেম বই দুটো তো খুব হীট করেছে। আশা করি, আমারটাও করবে।

বললাম, তোর ইচ্ছা পুরণ করার চেষ্টা করব।

তাহলে আরম্ভ করছি শোন–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *