১২
বিয়ের তিন বছর পর একদিন সেলিনা বলল, আমাকে কোনো লেডিজ গাইনীর কাছে চেকআপ করাবে?
রসিকতা করে ইংরেজীতে বললাম, বাট হোয়াই? এনিথিং রং?
বলতে যে লজ্জা করছে।
স্বামীর কাছে স্ত্রীর লজ্জা করতে নেই। তাছাড়া তোমার সব লজ্জাস্থানগুলো যখন আমার দখলে তখন লজ্জার কোনো কারণ নেই। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
তুমি দিন দিন ভীষণ অসভ্য হয়ে যাচ্ছ।
সে জন্য তুমিই দায়ী। তোমার লজ্জাস্থানগুলো দিন দিন আমাকে অসভ্য করে তুলছে।
এ রকম অসভ্যতা করলে আমি বলব না, যাও দুষ্ট কোথাকার?
ঠিক আছে, আর অসভ্যতা করব না। এবার আসল কথাটা বল, নচেৎ শান্তি পাচ্ছি না।
এতদিন হয়ে গেল মা হচ্ছি না কেন?
ও তাই বল, তোমার কথা শুনে তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সন্তানের জন্য এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? মা হতে খুব সখ হচ্ছে বুঝি?
সন্তানের মা ডাক না শুনলে নারী জনম সার্থক হয় না।
মহারানীর আদেশ শীরধাৰ্য্য।
কয়েকদিন পর সেলিনাকে একজন লেডীজ গাইনী স্পেশালিষ্টের কাছে নিয়ে গেলাম।
উনি পরীক্ষা করে বললেন, আপনার স্ত্রী কোনোদিন সন্তানের মা হতে পারবেন। কারণ ওঁর সন্তান জন্মাবার ঘর নেই।
কথাটা শুনে সেলিনার দিকে চেয়ে দেখি, একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর তার মুখটা সাদা হয়ে গেছে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডাক্তার বললেন, মিসেস খান, আপনি এত নার্ভাস ফিল করছেন কেন? আল্লাহ আপনাকে সন্তান ধারণে অক্ষম করে পয়দা করেছেন। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই।
ডাক্তারের কথায় সেলিনা সম্বিত ফিরে পেয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চল বাসায় চল।
বাসায় এসে তাকে বললাম, ডাক্তার খুব দামী কথা বলেছেন। আল্লাহপাক যা কিছু করেন বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। যদিও সেগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে খারাপ বলে মনে হয়। তার ইচ্ছার উপর বেজার হতে নেই। সব কিছুর উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমি যখন এইসব বলছিলাম সেলিনা তখন আমার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি তার কান্না থামাবার জন্য মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, কেঁদো না, আল্লাহপাক নারাজ হবেন। আর একদিন না হয় মেডিকেলে এক্স-রে করে দেখব।
কান্না থামিয়ে সেলিনা বলল, বেশ তাই হবে।
মেডিকেলে এক্স-রে রিপোর্টেও তাই পাওয়া গেল। এবার সেলিনা কাঁদল না। কিন্তু এরপর থেকে খুব ধীর ও গম্ভীর হয়ে গেল। আগের মত চাঞ্চল্যভাব আর দেখা যেত না। তার পরিবর্তন দেখে আমি বেশ চিন্তিত হলাম। কেন কি জানি কেবলই মনে হত, সে কোনো কঠিন অসূখে পড়বে। তার চিন্তা দূর করার জন্য একদিন আদর করতে করতে বললাম, তোমার প্রেমিক তোমার কাছ থেকে আগের মত আর প্রেম পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে।
কক্ষন তা হতে পারে না। এ তার ছলনাময় অভিযোগ! মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমি তাকে প্রেম দিয়ে যাব।তবে মাঝে মাঝে আমি খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
আছে, তুমি মা হবার চিন্তা দূর করে দিয়ে সব সময় আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) কথা চিন্তা করবে। যখন তা ভালো লাগবে না তখন ধর্মীয় বই পড়বে। তাও যখন ভালো লাগবে না তখন আমার কথা ভাববে।
তোমার কথা ভাবলে যে সব সময় তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছা করে। সেই জন্য তো আল্লাহপাকের কাছে অন্ততঃ একটা সন্তান চেয়েছিলাম কিন্তু আমি এমনই হতভাগী যে, তাও আমার ভাগ্যে নেই।
বললাম, তোমার ধারণা ভুল। দুনিয়ার দিকে ভালো করে তাকালে দেখতে পাবে, তোমার চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যহীনা রয়েছে। তাকে চিন্তার থেকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে চরম অস্ত্র ব্যবহার করলাম। যদিও মনে হয়েছিল এর ফলে তার মনে প্রচন্ড আঘাত লাগবে। বললাম, তুমি যে সন্তান সন্তান করে এত মূষড়ে পড়ছ, আমি কিন্তু তোমার গর্ভে সন্তান আসুক এটা চাইনি। সেই জন্য বোধ হয় আল্লাহ তোমাকে বন্ধ্যা করে সৃষ্টি করেছেন। কথাগুলো বলে ফলাফলের জন্য তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। মনে হল এক্ষুনি ভীষণ ঝড় উঠবে।
সেলিনা কয়েক সেকেণ্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে কয়েক ঘা কিল দিয়ে বলল, এই কথা এতদিন বলনি কেন? আগে বললে আমার আজ এই অবস্থা হত না। না জেনে তোমার মনে কত ব্যাথা দিয়েছি। মাফ করে দাও বলে বসে পড়ে আমার পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।
প্রথমে আমি মনে করেছিলাম, যা বলে কাঁদছে সেটা ঠিক। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমি তার গর্ভে সন্তান চাই না জেনে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। তাকে তুলে নিয়ে সেদিন এত বেশি আদর করেছিলাম, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
বিয়ের পর যখনই তার কাছে যেতাম তখনই প্রথমে আমার প্রথম স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করত।
একদিন তাকে বললাম, আচ্ছা, আমি তোমার কাছে এলেই ওদের কথা জিজ্ঞেস কর কেন?
বলল, তারা যে তোমারই অংশ, তাইতো তাদের খবর জানতে ইচ্ছে করে।
বিয়ের চার বছর পর একদিন যখন সেলিনা বাসার খবর জানতে চাইল তখন ভুল করে বলে ফেললাম, গত পরশু একটা খোকা হয়েছে। সাতদিনে আকিকা করব।
খবরটা শুনে সেলিনা আমার হাত দুটো ধরে আঁশু ভরা চোখে বলল, আমাকে নিয়ে যাবে? ওদের সাবাইকে দেখার জন্য মন বড় ছটফট করে।
ভুল করে কথাটা বলে আমি যে অন্যায় করেছি, তা টের পেয়ে বললাম, যা পারব না তা জেনেও আমাকে করতে বল কেন? তোমার ইচ্ছা পুরণ করতে না পারলে মনে যে কি হয়, তাতো তোমার অজানা নয়।
আমার কথা শোনার পর সেলিনা রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, খোকার কি নাম রাখবে?
মুহাম্মাদ সায়ফুল্লাহ খান।
এই নামের অর্থ কি?
প্রশংসিত আল্লাহর তরবারী।
আমাকে যখন তুমি নিয়ে যেতে পারবে না তখন ঐদিন আমি একটা উপহার দেব নিয়ে যেও।
বেশ তো তাই দিও।
আকিকার আগের দিন সেলিনা নিউ মার্কেটে এসে আমার হাতে একটা বাক্স দিয়ে। বলল, খোকার জন্য। আর এই হতভাগীর দোয়া দিও বলে রুমালে চোখ মুছল।
রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রীর হাতে বাক্সটা দিলাম।
সে বাক্সটা খুলল। দেখলাম, তাতে রয়েছে একজোড়া জামা প্যান্ট, একজোড়া জুতো আর একটা সোনার আংটি। আংটিতে মিনে করা সায়ফুল্লাহ নাম লেখা।
আরও এক বছর পর একদিন সেলিনা বলল, হয় আমাকে তোমার একটা ছেলে এনে দাও, নচেৎ আমাকে আপামণির কাছে এক সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা কর। আমি আর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে পারছি না।
এরকম কথা যে সে একদিন বলবে, সেটা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরিও ছিলাম। রাগ না করে খুব নরম সুরে বললাম, মাথায় বুঝি পোকা ঢুকেছে? ঐ সব খেয়াল বাদ দাও। সেখানে গেলে আরও বেশি অশান্তি পাবে।
যতই অশান্তি পাই, আর যে পরিস্থিতির উদ্ভব হোক, আমি আপামনির পায়ে ধরে কাঁদব। বাদির মত তার ছেলেমেয়েদের সেবা যত্ন করব। প্রথম দিকে তিনি যতই লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিক না কেন, আমার বিশ্বাস, ইনশা আল্লাহ একদিন না একদিন আমি তার মন জয় করতে পারবই।
আমি তার আগের মত একরোখা ভাব উদয় হতে দেখে বেশ চিন্তিত হলাম। সেদিন তাকে একটা সুখবর শোনাব মনে করে গিয়েছিলাম। সেই সুখবরটা এখানে কাজে লাগিয়ে তার মানষিক চিন্তা অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, আজ তোমাকে একটা সুখবর দেব। খবরটা শুনে আমাকে কি দেবে আগে বল।
তুমি যা পেলে সব থেকে বেশি খুশি হও তাই দেব।
আমি একটা ব্যাবসা করব। চাকরি গতকাল ছেড়ে দিয়েছি। বাসাও তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করব। ব্যাবসা উপলক্ষে সারা বাংলাদেশ ঘুরতে হবে। আমার ইচ্ছা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সব জায়গায় যাব। ব্যাবসাও হবে আর তোমাকে নিয়ে বেড়ানও হবে। কি, খবরটা শুনে তুমি খুশী হওনি?
নিশ্চয় বলে সেলিনা প্রথমে আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইল। তারপর দুহাতে আমার মুখ ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।