১৪
এই ঘটনার পর সেলিনা প্রায় বলত, আবার কবে তোমার বাসায় যাব অথবা তাদেরকে আমাদের বাসায় করে নিয়ে আসবে? এখন নয় পরে বলে আমি কাটিয়ে দিতাম।
চাকরি ছেড়ে ব্যাবসা আরম্ভ করার পর কমলাপুরে বাসা ভাড়া নিই। সেলিনাকে বাসার কাছে একজন ডাক্তারের ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলাম, দরকার হলে এই নাম্বারে ফোন করবে। ডাক্তার সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন দাদুও সেলিনাকে নিয়ে এসে ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দিয়েছিলাম। আর বলেছিলাম, কোনো ইমারজেন্সী খবর থাকলে ফোনে অথবা দাদু এসে ডাক্তারকে জানাবেন। ডাক্তার আমারও সেলিনার ব্যাপাটা আগের থেকে জানতেন।
ব্যাবসার কাজে চিঠি পেয়ে হঠাৎ করে আমাকে সিলেট যেতে হয়। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হয়েছিল। সেলিনার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারিনি। তবে ফোনে সে কথা জানিয়ে ছিলাম। যেদিন ফিরে আসি, সেদিন রাত্রি আটটায় ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হতে বললেন, ড্রাইভার গত পরশু এসেছিল। সেলিনা ভাবি এ্যাকসিডেন্ট করে মেডিকেলে আছে। অবস্থা খুব খারাপ। আমি গতকাল গিয়ে দেখে এসেছি। এই নিন ওয়ার্ড ও বেড নাম্বার।
সংবাদটা আমাকে বিদ্যুৎ পৃষ্টের মত সর্ট করল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না।
ডাক্তার আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আল্লাহপাকের রহমতে ভাবি ভালো হয়ে যাবেন। নিন ধরুন বলে ঠিকানা লেখা কাগজটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।
আমি কাগজটা নিয়ে লুংগি ও পাঞ্জাবীপরা অবস্থায় একটা রিক্সায় উঠে মেডিকেলে গিয়ে পৌঁলাম। স্পেশাল পাশ বের করে সেলিনার ওয়ার্ডে গিয়ে দেখলাম, শুধু নাক, মুখ ও হাত ছাড়া তার সমস্ত শরীর ও মাথা প্লাষ্টার করা। তখনও জ্ঞান ফিরেনি। এই দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে উঠল।
বেডের পাশে জরিনা ও আম্মা ছিল। জরিনা আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলে বলল, আপা গত পরশু এ্যাকসিডেন্ট করেছে। আজ পর্যন্ত জ্ঞান ফিরেনি। প্রচুর রক্ত গেছে। আপাকে বাচাতে হলে আরো অনেক রক্তের দরকার। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই। মাত্র দুবোতল পাওয়া গেছে। ডাক্তার বলেছে কালকের মধ্যে রক্ত জোগাড় না হলে আপাকে বাঁচান যাবে না।
আমি রুমালে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলাম, এ্যাকসিডেন্ট হল কি করে?
জরিনা বলল, আমি ও আম্মা গাড়ি নিয়ে গুলশান গিয়েছিলাম। আপা বাড়িতেই ছিল। হঠাৎ ফোন পেলাম আমাদের আয়া বলছে, মেডিকেল থেকে ফোন এসেছে আপা এ্যাকসিডেন্ড করে সেখানে আছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে ইমারজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে আপার কাছে আসি? ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম, মালিবাগের মোড়ে একটা ট্রাক, আপা যে রিক্সায় ছিল সেটাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। আপা রিক্সা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর একটা প্রাইভেট কার আপার উপর দিয়ে চলে যায়। এইসব কথা ডাক্তার রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে শুনেছেন। তাকেও মেডিকেলে আনা হয়েছিল। সে অল্প আঘাত পাওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আজ কেবিনের ব্যবস্থা করা গেছে। আপাকে এক্ষুনি কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার সেই ব্যবস্থা করতে গেছেন।
এমন সময় একজন ডাক্তার দুজন নার্সসহ এসে ট্রলিতে করে সেলিনাকে কেবিনে নিয়ে গেল।
আমি ডাক্তারকে পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা রক্ত পাব কোথায়? তার চেয়ে আমার রক্ত টেষ্ট করে দেখুন, চলবে কি না?
ডাক্তার যখন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখন জরিনা ও আম্মা আমাদের সাথে এল। যেতে যেতে আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম সেলিনা বাচবে তো?
ডাক্তার বললেন, কিছুই বলা যাচ্ছে না। মাথায় ও পেটে ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। আমাদের কর্তব্য আমরা করছি। এরপর উপরের মালিকের উপর নির্ভর করুণ। সি ইজ সিরিয়াসলি উনডেড।
আমার দেখাদেখি জরিনা ও আম্মা টেষ্ট করার রক্ত দিল। ঘন্টা খানেক পরে রিপোর্ট এল আমাদের কারুর রক্ত সেলিনার রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলছে না। রাত্রি বারটা পর্যন্ত থেকে বাসায় ফিরে সেলিনার এ্যাকসিডেন্টের ও রক্তের কথা আমার স্ত্রীকে বললাম।
সব শুনে আমার স্ত্রী বলল, মেয়েটি খুব ভালো। একদিনের পরিচয়ে আমাকে ঠিক আপন বোনের মত করে নিয়েছে। তুমি আমাকে কাল সকালে নিয়ে যাবে। আমার রক্ত যদি তার গ্রুপের সঙ্গে মিলে যায়, তবে তাকে আমি রক্ত দিয়ে বাঁচাব।
বললাম, বড় বোনের মত কথা বলেছ!
পরের দিন সকালে তাকে নিয়ে মেডিকেলে গেলাম। কেবিনে ঢুকে দেখলাম, আমার শাশুড়ী রয়েছেন। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, সেলিনার আম্মা। আমার স্ত্রী সালাম দিয়ে বেডের কাছে এগিয়ে গেল। সেলিনাকে দেখে কেঁদে ফেলল। জিজ্ঞেস করল বাঁচবে তো?
আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। সামলে নিয় বললাম, আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া কর। তিনি যেন ওকে সুস্থ করে দেন। আল্লাহ তায়ালার কি শান। আমার স্ত্রীর রক্ত টেষ্ট করে ডাক্তার বললেন, সেম গ্রুপ, চলবে। রক্ত দেওয়ার পর তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলাম।
আমার প্রথম স্ত্রীকে দেখে আমার শাশুড়ীর চেহারায় বিরক্ত ও রাগের চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখলাম। তার পরের ঘটনা দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হয়ে ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, সেলিনা বাচবে তো বাবা?
এই পাঁচ বছরের মধ্যে আজ প্রথম উনি আমার সঙ্গে কথা বললেন। বললাম, আপনি দোয়া করুন, আল্লাহপাক সন্তানদের প্রতি মায়ের দোয়া কবুল করে থাকেন।
সারাদিন সেলিনার কাছে থাকতাম। রাত্রি বারটার দিকে বাসায় ফিরতাম। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে বলতাম, ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত থাকি, আসবার সময় সেলিনাকে দেখে এলাম আজও জ্ঞান ফিরেনি।
সাতদিন পর সেলিনার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু ভালো করে কথা বলতে পারল না। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার দুদিন পর আমাকে কাছ বসতে বলল। আমি তার কাছে বসে মাথায় হাত রাখলাম।
কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল, জান, আমার প্রেম আমাকে বলছে, আমি আর বাঁচব না, যা কিছু বলার তোমার প্রেমিককে শিঘ্রী বলে ফেল। কথা বলার সময় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছিল।
আমিও কান্না রোধ করতে পারলাম না। প্রথমে নিজের তারপর তার চোখ মুছে দিয়ে তার ঠোঁটে একটা আংগুল রেখে বললাম, তুমি এ রকম কথা বলো না, আমি সহ্য করতে পারছি না। প্রেমিকাকে হারিয়ে প্রেমিক কি করে বাঁচবে?
সেলিনা আমার আংগুল সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি তোমার কাছে যা কিছু অন্যায় করেছি মাফ করে দাও। আমি মরে গেলে আমার জন্য দোয়া করো। আর যত শীঘ্র পার আপামনি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে এস, শেষ দেখা একবার দেখব।
আমার চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছিল। বললাম, তোমার আপামণি তোমাকে দু-তিন দিন এসে দেখে গেছে। রক্ত পাওয়া যায়নি বলে সে তোমাকে নিজের রক্ত দিয়েছে। অবশ্য তখন তোমার জ্ঞান ছিল না। আমি কালকেই তাদেরকে নিয়ে আসব।
এমন সময় নার্স এসে আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ওঁকে বেশি কথা বলাবেন না। ওঁর শরীর খুব দুর্বল, কোনো কারণে উত্তেজিত হলে হার্টফেল করবেন। সেজন্য ডাক্তার মাঝে মাঝে ইনজেকসান দিয়ে অজ্ঞান করে রাখতে বলছেন।
আমি সেলিনার কাছে ফিরে এসে কথা বলতে নিষেধ করলাম। আর উত্তেজিত না হওয়ার জন্য অনেক বোঝালাম।
আমার কথা শুনল না। বলল, আমাকে কিছু কথা বলতেই হবে, পরে আর সময় পাব না। তুমি মেজ মামাকে দিয়ে কালকের মধ্যে একটা উইল করে নিয়ে আসবে, আমি সিগনেচার করে দেব। উল্লেখ থাকবে আমার ব্যাংকের সমস্ত টাকা আমি স্বেচ্ছায় আমার স্বামীকে সত্ত্বাধিকারী করলাম।
বললাম, তুমি থাকবে না আর আমি তোমার টাকা ভোগ করব, তা কখনও আমার দ্বারা হবে না। তার চেয়ে তোমার পরকালের ভালোর জন্য আমি ঐ টাকা খরচ করতে চাই।
না, তোমাকে আমার সবকিছু নিতে হবে। নচেৎ আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব না। তুমি নিজে টাকাটা ভোগ করলে আমি বেশি শান্তি পাব।
তাকে শান্ত করার জন্য বললাম, প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য যদি ঐ টাকা দিয়ে কিছু করে, তাহলে তো আর তোমার তাতে কোনো আপত্তি নেই?
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সেলিনা বলল, প্রেমিক যা ভাল বুঝবে করবে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
নার্সের গলার শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি জরিনা ও আম্মা আমার পিছনে দাঁড়য়ে আছে। মনে হল, আমাদের সব কথা ওঁরা শুনেছেন।
নার্স সেলিনাকে ইনজেকসান দিয়ে চলে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ও ঘুমিয়ে পড়ল। জরিনাকে ওর কাছে থাকতে বলে আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কোর্টে মেজ মামার কাছে গিয়ে আমারও সেলিনার মতামত বললাম।
মামা বললেন, এত তাড়াহুড়ো কিসের? সেলিনা তো বেঁচে যেতেও পারে?
আমি বললাম, আল্লাহপাক যেন তাই করেন। কিন্তু সেলিনা এটা আগামী কাল করে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব পিড়াপিড়ী করেছে। প্রথম উইলটা সেলিনার মতে করবেন। দ্বিতীয়টা যে করবেন তাতে উল্লেখ থাকবে, আমি আমার স্ত্রীর সবকিছুর সত্ত্বাধিকারী হওয়ার পর তারই সম্মুখে তার পরকালের মুক্তির জন্য মেডিকেলের পুওরফান্ডে সব কিছু দান করে দিলাম।
পরদিন সকাল আটটায় সেলিনার কেবিনে গিয়ে দেখি, মামা এবং আরও দুতিনজন উকিল বসে আছেন। আমি আসবার তিন চার মিনিট পর জরিনা ও আম্মা এলেন। সেলিনা নীরবে সকলকে লক্ষ্য করছিল। আমি সেলিনার কাছে গিয়ে বললাম, মামা তোমার কথামতো উইল করে এনেছেন, তুমি সিগনেচার করার পর ওঁরা সাক্ষী হিসাবে সিগনেচার করবেন।
সেলিনা আমার দিকে তাকিয়ে উইলটা পড়তে বলল। মামা পড়তে লাগলেন
আমি (সেলিনা খানম), পিতা মরহুম মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঠিকানা……….. আমার মৃত্যুর পূর্বে আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এবং ব্যাংকের সমস্ত টাকা স্বজ্ঞানে খুশীর সঙ্গে আমার স্বামী (…) কে স্বত্বাধিকারী করে গেলাম। ভবিষ্যতে আমার কোনো অংশীদার ঐসব সম্পত্তিতে কোনো রকম দাবি করলে আইনতঃ তাহা আগ্রাহ্য হবে।
এরপর মামা দ্বিতীয় ইউলটাও পড়লেন।
সব শুনে সেলিনা মৃদু হেসে বলল, পরের উইলটা যে তুমি এভাবে করবে, তা আমি জানতাম। তবে টাকাটা তুমি নিজে ভোগ করলে, আমি বেশি শান্তি পেতাম।
আমি বললাম, তুমি নিজের দিকটা শুধু দেখলে, আমার দিকটা দেখবে না?
কয়েক সেকেণ্ড সেলিনা কি যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, তোমার মতই আমার মত। তারপর মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি সিগনেসার করতে পারব না। আপনি আমার হয়ে করে দিন।
তার সম্মতি পাওয়ার পর আমরা সকলে সিগনেচার করলাম।
কিছুক্ষণ পর সেলিনা মামাদের চলে যেতে বলল। ওরা চলে যাওয়ার পর আম্মাকে ডেকে বলল, আমি তোমার অবাধ্য মেয়ে। তোমার কথা না শুনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। জীবিত কালে মাফ না করলেও আমার মরণের পর তুমি আমাকে মাফ করে দিও। পারলে তোমার জামাইকেও মাফ করে দিও। ওর কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার। তারপর জরিনার দিকে চেয়ে বলল, তুই যেন আমার মতো আম্মার মতের বিরুদ্ধে কিছু করে তার মনে কষ্ট দিসনি।
তখন সকলের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।
আমার শাশুড়ী ডুকরে কেঁদে উঠলেন। একটু সামলে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি তোদেরকে মাফ করে দিয়েছি মা। তোদের দুজনকে বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি, তোরা আমাকে মাফ করে দে।
সেলিনার মুখে বিজয়িনীর মতো হাসি ফুটে উঠল। আমাকে বলল, তুমি আমার হয়ে মাকে কদমবুসি কর।
আমি ওঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে উনি মাথায় ও চিবুকে হাত বুলিয়ে ভিজে গলায় বললেন, থাক বাবা থাক, আমাকে আর বেশি অপরাধী কর না, এমনিতেই এতদিন তোমাদের প্রতি যা অন্যায় করেছি, তা যেন আল্লাহ মাফ করেন।
সেলিনা আমাকে ডেকে বলল, আজ তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। শুধু আপামণি ও ছেলেমেয়েদেরকে এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে এস। শেষ বারের মতো আপামণির সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চাই।
আমার মনে হল ও বুঝি আর বাচবে না। আম্মা ও জরিনাকে তার কাছে থাকতে বলে বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি করে সবাইকে নিয়ে এসে দেখলাম, আম্মা ও জরিনা তার দুপাশে বসে আছে, সেলিনার চোখ বন্ধ।
আমি বললাম, তোমার আপামণি এসেছে।
জরিনা সরে বসলে আমার স্ত্রী সেলিনার কাছে বসল।
সেলিনা চোখ খুলে প্রথমে সকলকে দেখল, তারপর আমার স্ত্রীর একটা হাত ধরে বলল, আপামণি, তুমি তোমার রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রাখলে। এই ঋণ শোধ করার সুযোগ আমাকে আল্লাহপাক দিলেন না। যদি ইসলামে জায়েজ থাকত, তাহলে মরণের পর আমার গায়ের চামড়া দিয়ে তোমার জুতো তৈরি করে দিতে ওসিয়ত করতাম। আমি তোমার কাছে অনেক বড় অন্যায় করেছি। যা কোনো মেয়ে অন্য মেয়েকে ক্ষমা করতে পারে না। তোমার স্বামীকে এ ব্যাপারে কোনোদিন কোনো কিছু বলো না। উনি মানুষ হয়েও ফেরেস্তার মত চরিত্রবান। আমি ওঁকে প্রেমের যাদু দ্বারা পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছি। অনেকবার বহু অনুনয় বিনয় করেছি তোমার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য। শুধু তোমার মনে কষ্ট হবে বলে উনি রাজি হননি। তুমি ওঁর সমস্ত অন্তর জুড়ে রয়েছে। অনেক কষ্টে দুবছর ধরে চেষ্টা করে আমি সেখানে একটু জায়গা করতে পেরেছি। তাতেই আমি বুঝেছি, কত গভীরভাবে উনি তোমাকে ভালবাসেন। এত কথা বলে সেলিনা হাঁপাতে লাগল।
আমি বললাম, তুমি এখন চুপ কর, বেশি কথা বললে তোমার বিপদ হবে।
সেলিনা হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, কথাগুলো আমাকে শেষ করতেই হবে। সারাজীবন তোমার কোনো হুকুম অমান্য করিনি। যাওয়ার সময় তুমি কোনো হুকুম করো না। তারপর তার আপামণির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, শেষকালে অনেক জীদ করে শুধু একটিবার তোমাদেরকে দেখতে চেয়েছিলাম। তাই সেদিন। পার্কে তোমাদেরকে রেখে উনি বাইরে গিয়েছিলেন। তারপর যা কিছু ঘটেছে তা আমি নিজে করেছি। উনি এসবের কিছুই জানতেন না। আপামণি, এসব কথা শুনে তুমি খুব দুঃখ পাচ্ছ, কোনোদিন কথাগুলো হয়তো তুমি জানতেও পারতে না, তোমার কাছে মাফ না চেয়ে মরতে পারছি না, তাই বললাম।
এমন সময় নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, আপনারা কি পেসেন্টকে মেরে ফেলতে চান? যান, সবাই চলে যান। ওঁর এখন কথা বলা একদম নিষেধ।
সেলিনা নার্সকে ধমকের সুরে বলল, সিস্টার, আপনি থামুন, আমাকে বলতে দিন। তা না হলে বলার আর সময় পাব না। তারপর তার আপামণিকে বলল, তুমি তো আমাকে ছোট বোন বলে গ্রহণ করেছ? ছোট বোনের এই অন্যায়টা কি মাফ করে দেবে না? আমি তোমার দুটি পায়ে ধরে বলছি, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। চুপ করে আছ কেন? সহসা মাথাটা একটু তুলেই লা-ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ বলে কাৎ হয়ে গেল।
প্রথমে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি, সেলিনা মারা গেছে।
নার্স কয়েক সেকেণ্ড নাড়ী ধরে বলল, সি ইজ ডেড। তারপর একটা চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে দিল।
ওরা সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তখন আমার মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে গেল ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
এর পরের ঘটনা আর কিছু নেই। জামানের শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মত শোনাল। গল্পটা শুনতে শুনতে আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল।
আমাকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে দেখে বলল, কি রে, তুইও কাঁদছিস? সত্যি কথা বলতে কি জানিস, তার কথা মনে পড়লে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারি না বলে চোখ মুছল।
জিজ্ঞেস করলাম, সেলিনার মৃত্যুর পর তোর শাশুড়ী কী তোর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেন নি?
বললাম, না রাখলেই ভালো হত।
বুঝলাম না!
না বোঝার কি আছে? তিনি এখন আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন, যা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।
সেটাতো আরও বুঝতে পারছি না।
তোর মাথায় গোবর আছে। তুই যে কি করে লেখক হলি, তা ভেবে পাচ্ছি। আরে তিনি আমাদের বাসায় প্রায়ই আসেন এবং আমাদের সঙ্গে এত মধুর ব্যবহার করেন, যেন আপন মেয়ে জামাই ও নাতি-নাতনি।
তাই বল, এটা তো খুব ভালো কথা। আফটার অল তুই তো তার আপন। মেয়েকেই বিয়ে করেছিলি। তা ছাড়া তিনি তার ভুলও বুঝতে পেরেছেন।
হ্যাঁ, তা তো তোরা বলবি। কিন্তু সেলিনা বেঁচে থাকতে যদি এ রকম করত, তা হলে সে যে কত খুশি হত বলে রুমাল দিয়ে আবার চোখ মুছল।
আমি তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম, কি আর করবি বন্ধু? সবকিছু আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছা। তার কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করার এতটুকু কারুর ক্ষমতা নেই। সবর কর। দোয়া করি, আল্লাহপাক তোকে সবকিছু সহ্য করার তওফিক দিক। জেনে রাখ, কোনো এক কবি বলেছেন
প্রেমের পবিত্র শিখা চিরকাল জ্বলে
স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে।
তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি যেন আড়াই ঘন্টা স্বপ্ন দেখলাম। সত্যি এরকম ঘটনা দুনিয়াতে বিরল। এখন আসরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। চল দুজনের মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসি।
বৃষ্টি অনেক আগে ছেড়ে গিয়ে সোনালি রোদ উঠেছে। নামায পড়ে এসে চা নাস্তা খেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
ফেরার পথে স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, দুবন্ধুতে এতক্ষণ ধরে কি এত গল্প করলে?
বললাম, ও নিজের জীবনের একটা রোমান্টিক ও মর্মান্তিক ঘটনা আমাকে শুনিয়েছে। শোনাবার আগে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে, কাহিনীটা নিয়ে যেন একটা উপন্যাস লিখি।
কাহিনীটা আমাক শোনাবে না?
আগে লিখি, তারপর সেই পাণ্ডুলিপিটা তুমি পড়ো।