একা – ৬

ছয়

মন যদি তোমার চঞ্চল হয়, তাহলে তুমি কী করবে?

আমার মহাপুরুষ গুরু একদিন গভীর রাতে আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন। বসেছিলেন কম্বলের আসনে। একপাশে তাঁর কমণ্ডলু আর পরিব্রাজকের লাঠি। অন্যপাশে গীতা। তপ্তকাঞ্চন বর্ণ। মুখে খেলা করছে অদ্ভুত এক জ্যোতি।

আমি প্রশ্ন করেছিলুম, ‘আপনার মন কী কখনো চঞ্চল হয়?’

তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই হয়। মনের স্বভাবই হল চঞ্চল হওয়া। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যায়। তুলসীদাস সেই জন্যেই বলে গেছেন,

রাজা করে রাজ্য বশ, যোদ্ধা করে রণ জই।

আপনা মনকো বশ করো সো, সবকো সেরা ওই।।

‘মহারাজ, মনকে বশে আনার জন্যে কী করেন আপনি?’

‘অহংকার আর অভিমান।’

‘সেটা কেমন?’

‘প্রথমে করি অভিমান। পৃথিবীর ওপর অভিমান। কেউ কিছু দেবে না আমাকে। স্বার্থ থাকলে আসবে, না থাকলে আসবে না। যারা আসবে তারা স্বার্থ বুঝে নিয়ে পালাবে। অতএব তোমরা আমার কেউ নও। তোমরা তোমাদের এলাকায় থাকো, আমি আমার এলাকায়। এই অভিমানটা এলেই আমি আমার অতীতের দিকে তাকাই। আমার বাবা, মা, ভাই, বোন। যেই আমি সাবালক হলুম, সবাই অমনি হিসেবের খাতা খুলে বসল, গোরু তুমি কতটা দুধ দেবে! তোমাকে সাবালক করতে এত খরচ হয়েছে, এইবার শোধ করো। বসে বসে অন্ন ধ্বংস করবে তা তো হতে পারে না। শ্যামল, বিমল, কমল সবাই রোজগার করছে। স্নেহ! ফেলো কড়ি মাখো তেল। বড়ো ছেলের মোটা রোজগার, মা সামনে বসে থেকে মাছের মুড়ো খাওয়াচ্ছে। দুধের বাটিতে আমসত্ত্ব। বিছানা করে মশারি ফেলে গুঁজে দিচ্ছে। সবচেয়ে ভালো ঘরটা তোর জন্যে। ছেলে যে ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী স্বামীকে খুব খাতির করছে। কেন? মোটা রোজগার। পরিবারকে খুব সুখে রেখেছে। রোজগার গেলে কী হবে? নিত্য মুখঝামটা। উঠতে বসতে খোঁচা। তোমার প্রেম কোথায় গেল! ওই ফোয়ারার মুখ খুলতে হলে চাঁদির চাকতি ছাড়তে হবে। স্বামীকে হয়তো ছেড়েই চলে গেল। যেখানে সুখ সেইখানে আমি। যেখানে মধু সেইখানেই মাছি। পৃথিবীটা মস্ত বড়ো একটা দোকান। না দিলে কিছু মিলবে না। এইভাবে আমি আমার অভিমানকে টনটনে করে তুলি। আর তখনই মনে করতে থাকি, আমি একটা গাছ। একা দাঁড়িয়ে আছি। মাথার ওপর আকাশ, তলায় জমি। গাছ কারও কাছে ভিক্ষে চাইতে যায় না। প্রেম, দয়া, মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা। গাছ চাকরি করে না। গাছ কারও কাছে যায় না। গাছের কাছেই সকলে আসে। গাছের গতি একটা দিকেই। সেটা হল আকাশের দিকে। গাছ নিজের খাদ্য নিজেই সংগ্রহ করে। সূর্যই তার উপাস্য। গাছ কারও পরোয়া করে না। এইটাই আমার অহংকার। তখন চোখ বুজিয়ে নিজেকে দেখি—অচল, অটল আমি। বসে আছি আসনে। আমি পর্বত, আমি নদী, আমি আকাশ। মনের কথা আমি শুনব না। আমি রাজাধিরাজ। মন আমার নীচ ভৃত্য। এই করতে করতে মনটাকে একসময় ধাক্কা মেরে বাইরে ফেলে দিই। রাজপ্রাসাদে থাকার তার অধিকার নেই। তখন আমি সন্ত তুকারামের মতো বলতে থাকি,

শুদ্ধ পবিত্র আনন্দ আমার অলংকার,
মুক্তির উল্লাসে আমি নাচি।
আমি যে আছি এই কথাটাই ভুলে যাই,
শরীর আছে; কিন্তু তার বোধ নেই।
আমি অগ্নি
ভালো অথবা মন্দ প্রবেশের সাধ্য রাখে না।।
আমার যত তৃষ্ণা ছিল
সবই আমি পান করেছি
যত ক্ষুধা ছিল
সবই আমি আহার করেছি।
বাসনা স্থান নেই আর
মন মরে পড়ে গেছে
তাঁর শ্রীচরণে।

অন্ধকার ঘরে আমি সেই খেলাতেই মাতলুম। জীবন আমাকে কিছু দেয়নি, দেবেও না। আমি বোকার মতো ভাবছি, এ আমার বন্ধু, ও আমার প্রেমিকা। সবই স্বপ্ন, ভোরের শিশির। সত্য যখন সূর্যের মতো উঠবে তখন সবই অদৃশ্য। সত্যটা কী? তুমি এবং তুমি এবং তুমি। নিজের ক্রুশ নিজেকেই বইতে হবে। যত জড়াবে ততই জড়িয়ে পড়বে। এক সিকি আনন্দের জন্যে একটা টাকা বেরিয়ে যাবে।

দরজা বন্ধ করে বসেছিলুম অন্ধকারে। টোকা পড়ল দরজায়। এমন তো হয় না! আমার খোঁজখবর কে আর রাখে! একা মানুষ একাই থাকি। গোরুর মতো রাস্তায় চরে বেড়াই। শাকপাতা যা জোটে তাই খাই। দরজা খুলেই দেখি সামনে রুমকি।

‘কী ব্যাপার। এত রাতে তুমি?’

‘নীচে চলো, বাবা ডাকছে।’

‘কেন বলো তো! বকবেন নাকি!’

‘বকবে কেন? দরকারি কথা আছে।’

বয়স্ক মানুষ, বিছানায় বসে আছেন। চেহারাটা বেশ ভারিক্কি। ব্যবসায়ীর যেমন হয়। চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বোসো। খাওয়া—দাওয়া কিছু হয়েছে?’

‘রাতে আমি তেমন কিছু খাই না।’

‘খাবে কী করে। খেতে গেলেই তো রাঁধতে হবে। আজ থেকে তুমি আমাদের এখানে খাবে।’

‘আমি রাঁধতে পারি কাকাবাবু। আজ তেলেভাজা খেয়ে পেট ভার। তাই।’

‘তেলেভাজা তোমাকে খেতে হবে না, আমাদের সঙ্গে ডাল ভাত খাবে এবার থেকে। আচ্ছা, কাজের কথাটা বলি এইবার। তুমি চাকরি করবে?’

চাকরি! যেচে চাকরি! কপালটা খুলছে মনে হয়।

‘কেন করব না! বেকার বসে আছি। আপনি আমাকে চাকরি দেবেন?’

‘দোবো বলেই তো ডেকেছি। আমার এক বন্ধুর ফার্মে। বড়ো কোম্পানি। মাইনে ভালোই দেবে।’

‘আমাকে কী করতে হবে কাকাবাবু?’

‘ওরা বিদেশে মাল পাঠায়। তোমাকে সেই বিভাগটা দেখতে হবে।’

‘আমি পারব?’

‘পারবে না কেন? তুমি যথেষ্ট ইনটেলিজেন্ট। আমার মনে হয় তুমি খুব ভালো পারবে।’

ভদ্রলোক কেন এত ভালো ব্যবহার করছেন! কী কারণ! নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ আছে। অকারণ ভালোবাসা তো পৃথিবী থেকে উঠে গেছে। অহেতুকী ভালোবাসা! তবু ভালো লাগছে। পিতার মতো একজন কেউ বলছেন, বোসো—খেয়ে যাও। তোমার জন্যে একটা চাকরি ঠিক করেছি।

ভয়ংকর, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর এই পৃথিবী কেমন কোমল হয়ে গেল এই মুহূর্তে! সত্য যাই হোক, মিথ্যাকে কখনো কখনো বড়ো ভালো লাগে। নেই তবু মনে হচ্ছে আছে। তৃষ্ণার্ত মানুষের চোখে মরীচিকার মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *