একা – ১৫

পনেরো

একটা কঠিন সত্য তুমি হৃদয়ংগম করো বৎস। পৃথিবীতে অর্থই সার বস্তু। জীবনের সারাৎসার। অর্থ ছাড়া সবই অনর্থ। সংসার অথবা সন্ন্যাস। সংসার মানেই অর্থ। সংসারে সন্ন্যাসীর মতো থাকা যায় না, লোকে ক্লীব বলবে। তোমার মন বুঝবে না, বলবে অপদার্থ অলস। বলবে ভণ্ড শয়তান। খুব সাবধান! তোমার অতীতটা কিছুই নয়। যা চলে গেছে অতীতে, তা গেছে বিস্মৃতিতে। মহাপুরুষসঙ্গ, অলৌকিক দর্শন কিছুই কিছু নয়। দেখতে হবে লোহা সোনা হল কি না? তোমার পরিবর্তন কতটা হল? বুজরুক হলে তোমাকে কেউ পুঁছবে না। তখন তুমি না ঘরকা না ঘাটকা।

তুমি ধার্মিক দেখছ, তুমি সাধক দেখছ, সাধনা দেখছ—নিজে কি সেইভাবে সাধনা করেছ? নিজেকে ভাঁওতা মেরো না, সত্য কথা বলে। অন্যের তারিফ পাবার জন্যে সে যা নয় তাই বলে প্রমাণ করতে চায়। পরিপূর্ণ লোভী, বলবে নির্লোভ। প্রচণ্ড ভীরু, বলবে ভয়ংকর সাহসী। এই হল বারফট্টাই। যখন বালক ছিলে তখন তোমার অনেক প্রবৃত্তিই নিদ্রিত ছিল, যেই তুমি যৌবনপ্রাপ্ত হলে, অমনি তোমার সব প্রবৃত্তি জেগে উঠল। বাচ্চা বাঘ বেড়ালের মতো দুধ খেতে পারে, ধেড়ে বাঘ আর দুধ খাবে না, তার সমস্ত হিংস্রতা নিয়ে শিকারের পেছনে ছুটবে রক্তমাংসের লোভে। বালকের মধ্যে পবিত্রতা থাকলেও থাকতে পারে, সাবালক অবশ্যই ইন্দ্রিয়ের দাস।

স্বামীজির ওই জায়গাটা পড়ে দেখো না। তোমার জন্যেই তো লিখে গেছেন—পড়ো :

”আমাদের মনের একটি প্রবৃত্তি বলে, ‘এই কাজ করো’; আর একটি বলে— ‘করিও না’। আমাদের ভিতরে কতকগুলি প্রবৃত্তি আছে, সেগুলি ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া বাহিরে যাইবার চেষ্টা করিতেছে; আর তাহার পশ্চাতে যতই ক্ষীণ হউক না কেন, আর একটি স্বর বলিতেছে—’বাহিরে যাইও না।’ এই দুইটি ব্যাপার দুইটি সুন্দর সংস্কৃত শব্দে ব্যক্ত হইয়াছে—প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি। প্রবৃত্তিই আমাদের সকল কর্মের মূল। নিবৃত্তি হতেই ধর্মের উদ্ভব। ধর্ম আরম্ভ হয় এই ‘করিও’ না হইতে’, আধ্যাত্মিকতাও ওই ‘করিও না’ হইতেই আরম্ভ হয়। যেখানে এই ‘করিও না’ নাই, সেখানে ধর্মের আরম্ভই হয় নাই, বুঝিতে হইবে।”

আমার গুরু, তোমার ঠাকুর কী বলছেন শোন, ‘ঈশ্বর সৎ, আর সব অসৎ—এই বিচার। সৎ মানে নিত্য। অসৎ—অনিত্য। যার বিবেক হয়েছে, সে জানে ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু। বিবেক উদয় হলে ঈশ্বরকে জানবার ইচ্ছা হয়। অসৎকে ভালোবাসলে যেমন দেহসুখ, লোকমান্য, টাকা—এই সব ভালোবাসলে ঈশ্বর যিনি সৎস্বরূপ, তাঁকে জানতে ইচ্ছা হয় না। সদাসৎ বিচার এলে তবে ঈশ্বরকে খুঁজতে ইচ্ছা করে, শোনো একটা গান শোনো :

আয় মন, বেড়াতে যাবি।
কালী—কল্পতরুমূলে রে মন, চারিফল কুড়ায়ে পাবি।।
প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, (তার) নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি।
ওরে বিবেক নামে তার বেটা, তত্ত্বকথা তায় সুধাবি।।

তা, তোমার মধ্যে কি সেই বিবেকের নড়াচড়া টের পাচ্ছ না? জীবনে দুঃখ তো কম পাওনি। অর্ধাহারে, অনাহারে বহু দিন কেটেছে। তোমার সহ্যশক্তি বেড়েছে, তোমার আকাঙ্ক্ষা কমেছে, তোমার ধৈর্য বেড়েছে, তোমার অহংকার খাটো হয়েছে—তাহলে তোমার আর ভয় কীসের? তোমার দেহবাসনা এখনও আছে; কারণ কাম জয় করা কঠিন। আমার গুরু পরমহংসদেব বলছেন :

‘অভ্যাসযোগের দ্বারা কামিনী—কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ করা যায়। গীতায় এ—কথা আছে। অভ্যাস দ্বারা মনে অসাধারণ শক্তি এসে পড়ে, তখন ইন্দ্রিয় সংযম করতে—কাম—ক্রোধ বশ করতে কষ্ট হয় না। যেমন কচ্ছপ, হাত—পা টেনে নিলে আর বাহির করে না, কুড়ুল দিয়ে চারখানা করে কাটলেও আর বাহির করে না।’

শোনো বৎস, আরও কী অপূর্ব কথা তিনি বলেছেন, ‘যিনি আচার্য তাঁরই পাঁচটা জানা দরকার। অপরকে বধ করার জন্য ঢাল—তরোয়াল চাই, আপনাকে বধ করবার জন্য একটি ছুঁচ বা নরুণ হলেই হয়।’

সেই নরুণ হল তোমার বিচার। পরমহংসদেব বলছেন, ‘আমি কে, এইটি খুঁজতে গেলেই তাঁকে পাওয়া যায়। আমি কি মাংস, না হাড়, না রক্ত, না মজ্জা, না মন, না বুদ্ধি? শেষে বিচারে দেখা যায় যে, আমি এ—সব কিছুই নয়। নেতি, নেতি। আত্মা ধরবার ছোঁয়ার জো নাই। তিনি নির্গুণ নিরুপাধি।’

তবে বাবা, বিচারের পথ খুব শক্ত পথ। ও—পথে দু—একজনই এগোতে পারেন। মনে রেখো, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর নয়—এ হল কলি। পরমহংসদেব তাই সাবধান করছেন। বিজয়কৃষ্ণ যখন প্রশ্ন করলেন, ‘যাঁরা বেদান্ত বিচার করেন, তাঁরাও তো তাঁকে পান?’ পরমহংসদেব বললেন, ‘হ্যাঁ, বিচারপথেও তাঁকে পাওয়া যায়। একেই জ্ঞানযোগ বলে। বিচারপথ বড় কঠিন। তোমায় তো সপ্তভূমির কথা বলছি। সপ্তভূমিতে মন পৌঁছলে সমাধি হয়। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা—এই বোধ ঠিক হলে মনের লয় হয়, সমাধি হয়। কিন্তু কলিতে জীব অন্নগতপ্রাণ। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা কেমন করে বোধ হবে? সে বোধ দেহবুদ্ধি না গেলে হয় না। আমি দেহ নই, আমি মন নই, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নই, আমি সুখ—দুঃখের অতীত—আমার আবার রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু কই? এসব বোধ কলিতে হওয়া কঠিন। যতই বিচার করো, কোনখান থেকে দেহাত্মবুদ্ধি এসে দেখা দেয়। অশ্বত্থগাছ এই কেটে দাও, মনে করলে মূলসুদ্ধ উঠে গেল, কিন্তু তার পরদিন সকালে দেখো, গাছের একটি ফেঁকড়ি দেখা দিয়েছে। দেহাভিমান যায় না। তাই ভক্তিযোগে কলির পক্ষে ভালো, সহজ।’

বসে বসে ভাবলে কী হবে? এগিয়ে যাও, তোমার পথ ধরে তুমি এগোও। তোমাকে আমি কতবার বলেছি—জীবাত্মার প্রকৃত স্বরূপ আনন্দ ও শক্তি—দুঃখ ও দুর্বলতা নয়। তোমাকে আমি বারে বারে বলতে চাই, ধর্ম হচ্ছে মানুষের ভেতর যে ব্রহ্মত্ব—প্রথম থেকেই বর্তমান, তারই প্রকাশ। তুমি আমার ওই জায়গাটা পড়ো, আবার পড়ো, বারে বারে পড়ো। দেখ না, সকলের মধ্যে এইভাবে থাকতে থাকতেই তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে কী না।

‘যিনি সনাতন, অসীম, সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ, তিনি কোনো ব্যক্তিবিশেষ নহেন—তত্ত্বমাত্র। তুমি আমি সকলেই সেই তত্ত্বের বাহ্য প্রতিরূপ মাত্র। এই অনন্ত তত্ত্বের যত বেশি কোনো ব্যক্তির ভিতর প্রকাশিত হয়েছে তিনি তত মহৎ। শেষে সকলকেই তার পূর্ণ প্রতিমূর্তি হতে হবে।’

আমি সব শুনছি। আপনারা যা বলছেন সবই খুব সুন্দর কথা, মহৎ কথা। আমার খুব লোভও হচ্ছে। সেই অনন্তের স্বাদ আমি পেতে চাই। আমার এই মলিন জীবন অমলিন হবে। কিন্তু প্রত্যহের জীবন আমাকে গ্রাস করে ফেলে। আমার ভয় আসে—অনাহারের ভয়, অসম্মানের ভয়, মৃত্যুভয়। সকলেরই সব আছে, আমার কেন কিছু নেই। আমি অল্প বয়সেই কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। সবাই আমাকে ঘৃণা করে, উপেক্ষা করে। এড়িয়ে যায়, করুণার চোখে দেখে।

তোমার ওই নেকামিটা ছাড়ো। ওসব প্যানপ্যানানির যুগ চলে গেছে। তোমার ওই অভিমানের দাম কেউ দেবে না। পৃথিবীটা এখন এইরকম—তুমি তোমার, আমি আমার। বসে বসে কাঁদলে কিছু হবে না বাবা। তেড়েফুঁড়ে ওঠ। আমি কি চাই জানো? ‘আমি চাই এমন লোক—যাহাদের পেশিসমূহ লৌহের ন্যায় দৃঢ় ও স্নায়ু ইস্পাতনির্মিত, আর উহার মধ্যে থাকবে এমন একটি মন, যাহা বজ্রের উপাদানে গঠিত। বীর্য, মনুষ্যত্ব, ক্ষাত্রবীর্য, ব্রহ্মতেজ।’

আমি তোমাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো, ‘একজন জ্বলন্ত ক্যারেকটার—এর কাছে ছেলেবেলা হইতে থাকা চাই। জীবন্ত দৃষ্টান্ত দেখা চাই। কেবল মিথ্যা কথা বলা বড়ো পাপ—পড়িলে কিছুই হইবে না। সম্পূর্ণ নিখুঁত ব্রহ্মচর্য অভ্যাস করাইতে হইবে প্রত্যেক ছেলেটিকে, তবে তো শ্রদ্ধা বিশ্বাস আসিবে।’

আমার ছেলেবেলা তো সেইভাবেই কেটেছে স্বামীজি। জ্বলন্ত চরিত্রের সঙ্গে থেকেছি। তাহলে আমার কেন এই অবস্থা?

কারণ একটাই তোমার চিন্তা—দুর্বল। নিজেকে যখনই তুমি ভাবলে দুর্বল, অসহায়, তখনই তুমি তাই হয়ে যাবে। শক্তির চিন্তা করলে শক্তিমান হবে। আলোর চিন্তা করলে জ্যোতিমান হবে। আকাশের চিন্তা করলে উদার হবে। ‘আমার গুরুদেব বলতেন, যে আপনাকে দুর্বল ভাবে, সে দুর্বল হবে।’

এতক্ষণ আমার দোতলার ঘরটা যেন ভরে গিয়েছিল। তাঁরা এসেছিলেন, যাঁদের কথা আমি অহোরাত্র চিন্তা করি। দুঃখে—সুখে অসুখে—অনিদ্রায় স্মরণমাত্রই তাঁরা আসেন। আমাকে ঘিরে বসেন। আমাকে মেরামতের চেষ্টা করেন। আমি কে, আমি কেমন—এ বিচার তাঁরা করেন না। আমি আর্ত, তাপিত আমি, তাঁদের পক্ষে এইটুকুই যথেষ্ট। তাঁরা কখনো বিচারকের আসনে বসে বিচার করেন না। তাঁরা শুধুই দিতে চান, অকৃপণ দান। আমি সেই দানের মূল্য দিই আর নাই দিই তাঁদের কোনো অভিমান নেই। নিজেকে বদলাতে পারি ভালো, আমারই ভালো, না পারলে তাঁরা তিরস্কার করবেন না, দুঃখ পাবেন মাত্র। তোমার হল না বলে অশ্রু বিসর্জন করবেন। তুমি সোনা হতে পারলে না, সেয়ানা হয়েই রইলে। শের নয় শেয়ালই থেকে গেলে।

চমৎকার কথাটা দেয়ালে লিখে রেখেছি। বেশ মজার কথা :

The tools of the mind can be wrongly used
but the mind possesses no wrong tools.

মনের যন্ত্রপাতিকে আমি যা—তা ভাবে ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু মনের নিজস্ব কোনো বাজে যন্ত্র নেই।

নীচের তলায় বিশাল একটা শব্দ হল। চমকে উঠেছি। কেউ মনে হয় পড়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *