একা – ২

দুই

আমরা যেন বিশাল একটা হাটে বসবাস করছি। ব্যাবসা ছাড়া কোথাও কিছু নেই। অষ্টপ্রহর কলকোলাহল। সময়ের স্রোতে কচুরিপানার মতো ভেসে চলেছে জনজীবন। কে কোথায় যাচ্ছে, কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তবে যে আপনি বলেছিলেন, ‘কাম—কাঞ্চন ত্যাগ না করলে কিছু হবে না।’

সে আমি কাদের বলেছিলুম গো! সকলকে নয়। যারা চায় তাদের বলেছিলুম। কাকে চায়! যাঁকে পেলে সব তুচ্ছ হয়ে যায়। এই চাওয়া ক—জনের আছে! হাতে গোনা যায়। সকলের ভেতরেই একটা আমি আছে। নীচ আমি, বজ্জাত আমি। এই বজ্জাত আমিটা কেমন? সে তো তুমি ভালোই জান। যে ‘আমি’ বলে, ‘আমায় জানো না? আমার এত টাকা, আমার চেয়ে কে বড়োলোক আছে! যে ‘আমি’তে সংসারী করে, কামিনী—কাঞ্চনে আসক্ত করে, সেই আমি খারাপ। এই ‘আমি’র লড়াই সংসার জুড়ে। সেই গল্পটা মনে আছে? একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা ছিল। একটা হাতি সেই গর্ত ডিঙিয়ে গিয়েছিল। তখন ব্যাংটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিকে লাথি দেখাতে লাগল। আর বললে, তোর এত বড়ো সাধ্যি যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস! এই হল টাকা। আমি আর আমার টাকা। মানুষ নেশায় বুঁদ। উড়ছে কাগজ ধরছে মানুষ।

‘শ্যামাধন কি সবাই পায় রে। কালীধন কি সবাই পায়;
অবোধ মন বোঝে না, একি দায়!
শিবেরও অসাধ্য সাধন, মন মজানো রাঙা পায়।।
ইন্দ্রাদি—সম্পদ—সুখ, তুচ্ছ হয় যে ভাবে মায়
সদানন্দ সুখে ভাসে, শ্যামা যদি ফিরে চায়।।
যোগীন্দ্র মণীন্দ্র ইন্দ্র, যে চরণ ধ্যানে না পায়
নির্গুণ কমলাকান্ত, তবু সে চরণ চায়।।’

কাম—কাঞ্চন দুটোতে আসক্তি তো আমারও আছে। ডিশে সাজানো গরম আগুন আলুর চপ। হাত দিচ্ছি, ছ্যাঁকা লাগছে, ছেড়ে দিচ্ছি। আবার ধরছি। শেষে কামড় মেরে গরমে হা হা করছি। শেষে ঝালেতে, গরমেতে নাকের জলে, চোখের জলে। তবু বলছি আহা কী স্বাদ! তারপর অম্বল। নিয়ে আয় দাওয়াই। প্রতিজ্ঞা, আর কোনো দিন নয়। আবার একদিন।

ভাসতে ভাসতে আমার শৈশব আজ যৌবন পেরিয়ে কোথায় চলে এসেছে! অতীত এখন স্মৃতি। একটা দীর্ঘশ্বাস। নিজেকে নিজে নষ্ট করেছি। আমার নিজের কী ছিল জানি না। একটা পুরোনো বাড়ি ছিল। কিন্তু এই অনাথটিকে পুত্র—স্নেহে যাঁরা মানুষ করেছিলেন, আমার সেই পালক পিতা—মাতা, তাঁরা আমাকে কী না দিয়েছিলেন, সৎ শিক্ষা, সৎ সঙ্গ, পুণ্য পরিবেশ। অলৌকিক আধ্যাত্মিক পুরুষেরা আমার সেই কৈশোর দীপশিখাটিকে আড়াল করে রেখেছিলেন। উচ্চ ভাবসমূহের তৈল—নিষিক্ত করেছিলেন দীপাধারে। কিন্তু যৌবনের সিংহ—দুয়ারে যখন প্রবেশ করলুম, তখন এই নিঃস্ব প্রাণ, নির্জন, একাকী। কেউ নেই পাশে তার। যেন পাহাড়ি নদী। মেঘ ভাঙা জলের ধারা দু—কূল প্লাবিত করে বয়ে চলে গেছে—পড়ে আছে উপলখণ্ড সমূহ। যত কিছু সদুপদেশ, সৎসঙ্গের অভ্রচূর্ণ। বিস্মৃতি ঘিরে এল। নীচে আমির অহংকারের টঙ্কার। সেই জীর্ণ গৃহটির যাঁরা ট্রাস্টি ছিলেন, তাঁরা বললেন, লায়েক হয়েছ ছোকরা, এইবার তোমার সম্পত্তি তুমি বুঝে নাও। তা মন্দ কী! বড়ো রাস্তার ওপর দোতলা মকান। পেছনে অনেকটা জমি। নীচে তিনঘর দোকান। সোনা—রুপোর গয়না, ছবি—বাঁধাই, এক মেঠাইঅলা। নীচের পেছন দিকটায় একঘর ভাড়াটে। দুর্দান্ত, দুর্বিনীত নয়। শান্তশিষ্ট গৃহস্থ। বাঙালি নয়। উত্তরপ্রদেশের। তবে তিনপুরুষ এই বাংলায়। বাঙালিই হয়ে গেছে। কর্তা, গিন্নি, একটি মেয়ে। কর্তার কলকাতায় ব্যাবসা আছে। খুব বড়ো কিছু নয় তবে সচ্ছল পরিবার। ভদ্র, শিক্ষার আলো পড়েছে। আদব—কায়দা জানে। এলাহাবাদের ঘরানা। তা বেশ! মন্দ কী! বাড়ি হল। গোটা দোতলাটা আমার। একা আমার। সঙ্গে কিছু ভাড়ার টাকা। ছাদটা বিশাল। আবার গঙ্গা দেখা যায়। হে ভগবান! কী আনন্দ!

আনন্দ কেন?

এই হল পতনের শুরু। মুক্ত—বিহঙ্গ খাঁচায় ঢুকেছে। বিষয়ের স্বাদ পাচ্ছে। এতকাল ভাগ্য পথে—ঘাটে—মাঠে যখন যেখানে পেরেছে সেইখানে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। ভোজন, কখনো আশ্রমের খিচুড়ি। কখনো দেহাতি রুটি, অড়হর ডাল। কখনো কারও ঘর সামলেছি, কখনো কারও দোকান। বৃদ্ধ মানুষের সেবা করেছি। কখনো ভালো পোশাক, কখনো শতচ্ছিন্ন। অসুবিধে হয়নি কিছুই। যে কিছুই পায়নি তার কাছে, একটু পাওয়াই অনেক পাওয়া। ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ করে বেশি উতলা না হলে বর্তমান তেমন ভয় দেখাতে পারে না। একটা দিন যেই গেল, বিস্তারা বিছিয়ে শুয়ে পড়। তোফা ঘুম। আবার একটা সকাল। পাখির জীবন। আপনি যেমন বলেছিলেন ভগবান—পঞ্ছী অউর দরবেশ, সঞ্চয় করে না। আমার পশ্চিমা যোগী শুরু বলেছিলেন,

অজগর না করে নকরি, পনছি ন করে কাম।
দাস মুলুককো এই বচন হ্যায়, সব কি দাতা রাম।

বেটা শুনো—অজগর কখনো কারও চাকরি করে না। শুয়ে থাকে। খিদে পেলে হাঁ করে শ্বাস টানে সেই আকর্ষণে যা চলে আসে মুখে। ছাগল কী হরিণছানা বা একটা খরগোশ। সাধুরা একেই বলেন অজগর বৃত্তি। পাখিরা কখনো চাকরি করে কি? করে না। অথচ তাদের দিন চলে যায়। যিনি দেবার তিনিই সব ব্যবস্থা করে দেন। দাতা ভগবান। ভগবান মেহেরবান।

মন কী সহজে বোঝে! হিন্দিতে বলে, লালচ বুরি বালাই। লোভ এক মহা দুশমন। মাথার ওপর পায়ের নীচে পাকা মেঝে। নানা স্বপ্ন এসে গেল মনে। গোলাপি স্বপ্ন। নীচের ভাড়াটের মেয়েটির নাম ছিল রুমকি। ঘাগরা পরা সেই মেয়ে। তাকাবো না, তাও তাকাই। বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখতে পাই তাকে। তার একটা পাখি ছিল খাঁচায়। চন্দনা। উঠোনের তারে ঝুলছে খাঁচা। রুমকি পাখির সঙ্গে কথা বলছে। লংকা খাওয়াচ্ছে। ধারালো মুখ। পানপাতার মতো চিবুক। পাতলা টেপা নাক। নাকছাবির ঝিলিক। এলোখোঁপা। লাল ঘাগরা। মাঝে মাঝে ওপরের বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়লেই দৃষ্টি নামিয়ে নিচ্ছে। এক সময় আমি ভয়ে সরে যাচ্ছি। আবার ফিরে আসছি এই ভেবে, আমার বারান্দায় আমার দাঁড়াবার অধিকার আছে নিশ্চয়।

কিন্তু আমার আর একটা মন জানত, আমি নির্দোষ, নিরাসক্ত নই। ভগবান! আপনি বলেছিলেন,

 ‘রোগটি হচ্ছে বিকার। আবার যে—ঘরে বিকারের রোগী সেই ঘরে জলের জালা আর আচার তেঁতুল। যদি বিকারের রোগী আরাম করতে চাও, ঘর থেকে ঠাঁই নাড়া করতে হবে। সংসারী জীব বিকারের রোগী, বিষয় জলের জালা; বিষয়ভোগতৃষ্ণা জলতৃষ্ণা। আচার তেঁতুল মনে করলেই মুখে জল সরে, কাছে আনতে হয় না; এরূপ জিনিসও ঘরে রয়েছে; যোষিৎসঙ্গ। তাই নির্জনে চিকিৎসা দরকার।’

এই কথা সবসময় কানের কাছে বাজত। বাজত আপনার কণ্ঠস্বর; কারণ, আপনি আমার সংস্কার ছিলেন। আর তাই তো আমার যত অপরাধবোধ। আমার ছোটো আমি, নীচ আমি, বজ্জাত আমিটা এ কী করছে! বারে বারে আমাকে নানা ছলছুতায় বারান্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মেঘ যেমন রোদকে ঢেকে দেয় সেইরকম আমার বিচার আমার শিক্ষা—সংস্কার আচ্ছন্ন করে ফেলছে। মোহ আসছে। আমার ভেতরে অন্যরকমের একটা যুক্তি খাড়া করছে। অন্যরকমের একটা আনন্দের ঝংকার তুলছে। বলছে, প্রেম। বলছে, তুমি বড়ো নিঃসঙ্গ, একজন সঙ্গী খুঁজে নাও, দুঃখ—সুখের চিরসঙ্গী। দেখবে, ভীষণ ভালো লাগবে। সে এক কবিতার মতো। লাল ঘাগরা, সাদা চোলি। ফর্সা দুটো পা। গোড়ালির কাছে ঘুঙুর। মাঝের আঙুলে একটা রুপোর আংটি। কানে দুল, নাকে নাকছাবি, কপালে হলদে টিপ। নরম উষ্ণতা। দু—চোখে ছুরির ধার। একা একা পৃথিবীতে থাকা যায় কী! এই চাঁদ উঠবে, বসন্তের বাতাস, তারার মালা, তোমাদের খোলা ছাদ, একটা মাদুর, জুঁই ফুলের গন্ধ। বসে বসে, জীবনের কথা, প্রাণের কথা। এ তো ঈশ্বরের পৃথিবীরই আয়োজন। তোমার এত শঙ্কা কীসের!

মন! আমাকে যে ভগবান বলেছেন, ‘সংসার—সমুদ্রে কাম—ক্রোধাদি কুমির আছে। হলুদ গায়ে মেখে জলে নামলে কুমিরের ভয় থাকে না। বিবেক—বৈরাগ্য হলুদ। সদসৎ বিচারের নাম বিবেক। ঈশ্বরই সৎ, নিত্যবস্তু। আর সব অসৎ, অনিত্য, দু—দিনের জন্য।’

বেশ তো! তাই না হয় হল। তিনি তো আরও একটু বলেছেন, ‘বিবেক—বৈরাগ্য লাভ করে সংসার করতে হয়।’ তা তোমার তো বৈরাগ্য হয়েইছে, এইবার সংসার কর। দেখবে, বেশ লাগবে। ঈশ্বর তো তোমাকে নিজে সঙ্গ দিতে আসবেন না। মহাপুরুষ পাঠাবেন। তিনি আরও পাঁচজনের সঙ্গে তোমাকে কিছু উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দেবেন। দিয়ে বলবেন, যাও এইবার চরে খাও। অসুখ—বিসুখে ঈশ্বর তোমার সেবায় আসবেন না। মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। হাসপাতালে যাবে, সেখানে কোনো সেবিকা নামে তোমার সেবা করবেন। সে করাও যা না করাও তাই। স্ত্রীর মতন কে করবেন! আর তোমার ওই ‘অজগর’, ‘পনছি’, ও শুনতেই ভালো। রোজগার আর সঞ্চয় দুটোই তোমাকে করতে হবে। হয় সন্ন্যাসী হও না হয় সংসারী। জীবন দিয়ে ইয়ারকি চলে না। অনেক কিছু শুনতেই ভালো, বেশ মধুর মধুর কথা। সেই ভাবে জীবন চালাতে গেলে চলবে না। আটকে যাবে।

বেশ প্রবল যুক্তি। সত্যিই তো! আমি তো সন্ন্যাসী হতে পারিনি।

সেদিন ছিল চৈত্রের দুপুর। কড়া রোদে চারপাশ ভাজা ভাজা হচ্ছে। পথঘাট নির্জন। কৃপণ ছায়া। জ্বোরো রোগীর নিশ্বাসের মতো তপ্ত বাতাস। সরসর করে ধুলো খেলে যাচ্ছে পথের ওপর। রাখহরির হোটেল থেকে খেয়ে ফিরছি। তা প্রায় পাঁচ—দশ মিনিটের পথ। আমাদের সদর পেরলেই বেশ ঠান্ডা। চল্লিশ ইঞ্চি দেয়ালের স্নিগ্ধতা। সদর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছি। কয়েক ধাপ উঠেছি। রুমকি কাপড়—জামা নিয়ে ছাদ থেকে নামছে। একেবারে মুখোমুখি। আধহাত মাত্র ব্যবধান।

রুমকি হাসল। আমাকে সামান্য একটু জায়গা দিল একপাশে সরে গিয়ে। সে প্রায় হেলে গেছে। ওপরে উঠতে গিয়ে তার কোমরে কোমর ঠেকে গেল। বিদ্যুৎ তরঙ্গ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *