একা – ১৪

চোদ্দো

সকাল হলেই মনটা খারাপ লাগে। মেঘলা হল তো কথাই নেই। দিন চলে যাবে, কাজের কাজ তো কিছুই হবে না। আমার করার মতো কোনো কাজই নেই। আলসেমি করেই দিন কেটে যাবে। মনে মনে ভাবব, গোলামি করতে হচ্ছে না, এই তো আমি মুক্তপুরুষ। পাঁচ টাকা হলেই আমার দিন চলে যায়। এই তো আমি কামিনীকাঞ্চন—ত্যাগী প্রকৃত এক বৈরাগী। আমার ঠাকুর বলছেন :

‘শরীর, টাকা—এ—সব অনিত্য। এর জন্য—এত কেন? দেখ না হঠযোগীদের দশা। শরীর কীসে দীর্ঘায়ু হবে এই দিকেই নজর। ঈশ্বরের দিকে লক্ষ নাই। নেতি, ধৌতি—কেবল পেট সাফ করছেন। নল দিয়ে দুধ গ্রহণ করছেন।’

ঠিকই তো, আজ আছে, কাল থাকবে না। সে কী শরীর, কী টাকা। যা অনিত্য তার পেছনে ছুটি কেন? ঠাকুর বলছেন, শোনো হে ছোকরা—

‘টাকায় খাওয়া—দাওয়া হয়, একটা থাকবার জায়গা হয়, ঠাকুরের সেবা হয়, সাধু—ভক্তের সেবা হয়, সম্মুখে কেউ গরিব পড়লে তার উপকার হয়। এইসব টাকার সদব্যবহার। ঐশ্বর্য ভোগের জন্য টাকা নয়। দেহের সুখের জন্য টাকা নয়। লোকমান্যের জন্য টাকা নয়।’

সমস্ত কথা বুকে সেঁটে বসে যাওয়ার মতো। চাকরির চেষ্টা করছি টাকার জন্য। টাকা জমলে বাড়িটা মেরামত করে আগাপাশতলা রং করাব। খাট—বিছানা—বালিশ কিনব। একটা সাইকেল কিনব। কয়েক প্রস্থ ভালো জামা—কাপড়। একজোড়া জুতো।

বলে যাও, বলে যাও—থামলে কেন—?

একটা হারমোনিয়াম কিনব নাম—সংকীর্তনের জন্যে। স্টিলের বাসন কিনব, লোহার আলমারি। কিছু ফারনিচার তো কিনতেই হবে। চেয়ার—টেবিল—আলনা। একটা আয়না—সামনে দাঁড়িয়ে মুখ দেখব, চুল ফেরাব।

না, টাকার ব্যবহার এসব নয়। টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। টাকাতে মানুষ আবর্জনা খরিদ করে। গুচ্ছের অপচয়। নিঃস্ব, নিঃসম্বল হওয়াই ভালো, ভগবানের কাছাকাছি যেতে পারব। এমন কথাই বা বলি কী করে! ঠাকুর যে একথাও বলছেন—দুখচেটে, তেলচিটে সংসারী হবে না, হবে না হত—দরিদ্দির। টাকা তো চাই, ঠাকুরের সেবা, সাধু—ভক্তের সেবা, সম্মুখে কেউ গরিব পড়লে তার উপকার হয়। তিরস্কার করছেন অচলানন্দকে—

”অচলানন্দ ছেলেপিলের খবর নিত না। আমায় বলত, ‘ছেলে ঈশ্বর দেখবেন—এ সব ঈশ্বরেচ্ছা!’ আমি শুনে চুপ করে থাকতুম। বলি ছেলেদের দেখে কে? ছেলেপুলে, পরিবার ত্যাগ করেছি বলে টাকা রোজগারের একটা ছুতা না করা হয়। লোকে ভাববে ইনি সব ত্যাগ করেছেন, আর অনেক টাকা এসে পড়বে।”

তাহলে আমি করিটা কী? না ভোজে, না যোগে কোথায় আছি আমি? এ আমাকে কোন কলে ফেললে ঠাকুর? দরকচা করে রেখে দিলে! সকালে এই আমার চিন্তা। সুস্থ, স্বাভাবিক সংসারী মানুষের দল ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছে, ক্যান হাতে দুধ আনতে যেতে যেতে পানবিড়ির দোকানে সিগারেট কিনে দড়িতে ধরাচ্ছে, খুচরো গুনে পকেটে পুরছে। ছেলেমেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে বকবক করতে করতে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে এক মহিলা স্টেশানের দিকে ছুটছেন হাতব্যাগে রুমাল ঢোকাতে ঢোকাতে, কলকাতার টেলিফোন অফিসে চাকরি করতে। ভারিক্কি কর্তা ছড়ি হাতে ভ্রমণে বেরিয়েছেন। নতুন গাড়ি চেপে নামি ডাক্তার চলেছেন রুগী দেখতে।

ব্যস্ত কাজের লোকের এই পৃথিবীতে আমি এক অকাজের লোক। বসে আছি একপাশে কাজ না—পাওয়া রাজমিস্ত্রির মতো। এ—পকেট, সে—পকেট ঝেড়ে খুচরো কয়েক টাকা বেরোবে হয়তো। পাঁচশো চাল, একতাড়া নটেশাক, গোটাকতক আলু। কেরোসিন কোথায়, স্টোভ ধরানো যাবে না। কয়লার উনান ধরাতে জানি না। ঘরে ঘরে ধুলো, আবর্জনা, ঝুল। বিদঘুটে একটা অবস্থা। ছাতে চারখানা থান ইঁট সাজানো আছে। এপাশে দুটো, ওপাশে দুটো। মাঝে এক হাত ব্যবধান।

স্বামীজি বলতেন, হতাশা থেকে বাঁচার শ্রেষ্ঠ উপায় ধ্যান, জপ, শাস্ত্রপাঠ নয়—ব্যায়াম। ঝপাঝপ ডন মারো এক—শো, বৈঠক দু—শো। ঘাম ঝরাও। ঘাম অশ্রুর চেয়ে ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *