একা – ২২

বাইশ

চিড়িয়াখানায় শীতের পাখিরা সব আসতে শুরু করেছে।

লেকের জল দেখা যাচ্ছে না। সাদা, কালো বিদেশি হাঁসের দল গায়ে গা লাগিয়ে সাঁতার কাটছে। পিঁক পিঁক চিঁক চিঁক শব্দে মুখর। আমি আর রুমকি পাশাপাশি বসে আছি, শরীর স্পর্শ করে।

রুমকি ভালো খায়, ভালো পরে। হিংসে করছি না, প্রশংসাই করছি। মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো হওয়াই উচিত। রুমকিরা জৈন ধর্মাবলম্বী, নিরামিষাশী। তার ডান হাতের নিটোল, শীতল উপর বাহুটি আমার শীর্ণ বাঁ হাতে লেগে আছে। আমার শরীর আমার অতীত সংগ্রামের সাক্ষী। বর্তমানও কিছু প্রাচুর্যে ভরা নয়। আমার ভাতের সঙ্গে নুন জোটে না। রুমকি দুধ আর ঘিয়ে চুবে আছে।

আমাদের মুখে কথা নেই, কারণ আমরা প্রেমের কথা জানি না। শুধু দেখছি, শুধু অনুভব করছি। শীতের শীত—শীত দুপুর। রুমকি কী ভাবছে জানি না, আমি ভাবছি মেয়েটার মাথাখারাপ! পৃথিবীতে কয়েক কোটি ভালো, বড়োলোক ছেলে আছে, আমার মতো একটা ভিখিরিকে কেন জড়াতে চাইছে নিজের জীবনের সঙ্গে? না খেয়ে মরবে বলে?

বসে আছি পাশে গায়ে গা সেঁটে, মন কিন্তু সিঁটিয়ে আছে।

সেই এক রোগ। কেবলই ভাবছি, নষ্ট হয়ে গেলুম, খারাপ হয়ে গেলুম! মনে কুভাব আসছে। ভুরুর মাঝখানে জ্যোতিদর্শন আর হল না। ছোটোখাটো একজন ত্রৈলঙ্গ স্বামী, কী শঙ্করাচার্য হওয়া গেল না। একটা মেয়ের ফাঁদে পড়ে গেলুম, গোবরে জোনাকি পড়ার মতো। ভীষণ ভালো লাগছে, গান আসছে মনে। কমলালেবুর মতো নরম মনে হচ্ছে পৃথিবীটাকে।

আমার গুরু বলতেন, মায়া খুব সাংঘাতিক দেবী। জীবের চৈতন্য হরণ করেন। বই খুলে দেখাতেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কী বলে গেছেন। বলতেন, এক এক করে সব লিখে রাখো। মন যখন টলবে, তখন তাঁর ছবিখানি চোখের সামনে রেখে বারে বারে পড়বে। জিভে নয়, নির্দেশ নেবে মনে। লোহায় জল ঢাললে জল ঢোকে না। লোহা জল টানে না। মাটিতে জল ঢালো, শুষে নেবে। শুকনো মাটি হলে তো কথাই নেই! সেই নোটখাতা আজও আমার কাছে আছে। মাঝে মাঝে পড়ি।

প্রথম যে কথাটি আমার খাতায় লেখা আছে, তা তো সাংঘাতিক—

‘কামিনী—কাঞ্চনই মায়া। ওর ভেতরে অনেকদিন থাকলে হুঁশ চলে যায়—মনে হয় বেশ আছি। মেথর গুয়ের ভাঁড় বয়—বইতে বইতে আর ঘেন্না থাকে না। ঈশ্বরের নাম গুণকীর্তন করা অভ্যাস করলেই ক্রমে ভক্তি হয়।’

তার মানে তুমি যেটা অভ্যাস করবে, সেইটাই তোমার স্বভাব হয়ে দাঁড়াবে। আমার গুরু বলেছিলেন, চীনেরা কী বলে জানো? যে কাজ তুমি ভালো ভাবে করতে চাও, সেটাকে আগে তোমার অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে এসো, তাহলে আর কোনো দিন ফাঁক পড়বে না, তুমি না করে থাকতে পারবে না, অস্বস্তি হবে।

এর পরের লেখাটি হল, ‘এই জগতে বিদ্যামায়া অবিদ্যামায়া দুই—ই আছে; জ্ঞান—ভক্তি আছে, কামিনী—কাঞ্চনও আছে।’

বলছেন যে, ‘তার ইচ্ছা যে খানিক দৌড়াদৌড়ি হয়; তবে আমোদ হয়। তিনি লীলায় এই সংসার রচনা করেছেন। এরই নাম মহামায়া। তাই সেই শক্তিরূপিণী মার শরণাগত হতে হয়। মায়াপাশে বেঁধে ফেলেছে, এই পাশ ছেদন করতে পারলে তবেই ঈশ্বর দর্শন হতে পারে।’

রুমকি কনুইয়ের ধাক্কা মেরে বললে, ‘একটাও কথা বলছ না কেন?’

‘আমার কী রকম একটা ঘোর লেগে গেছে। অনেক কিছু ভাবছি।’

‘কী ভাবছ?’

‘তোমার কি মাথাখারাপ হয়ে গেল?’

‘মাথাখারাপের কী লক্ষণ দেখলে?’

‘আমার মতো একটা ভিখিরিকে বিয়ে করতে চাইছ রাজার মেয়ে হয়ে!’

‘আমি রাজার মেয়ে তোমার এ ধারণা হল কী করে? আমি এক ব্যাবসাদারের মেয়ে।’

‘এ যুগে ব্যাবসাদাররাই রাজা। তাদের অনেক টাকা। তুমি যা করতে চাইছ, তা সিনেমায় হয়। বাস্তবে হয় না, হলেও সে বিয়ে টেকে না, ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এটা এক ধরনের পাগলামি। তা ছাড়া তুমি জোর করে আমার কাছে দীক্ষা নিয়েছ। যেমনই হোক, আমি তোমার গুরু। গুরুকে কেউ স্বামী করে?’

‘তুমি শাস্ত্রের কিছুই জানো না, স্বামীই তো শ্রেষ্ঠ গুরু। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কী করেছিলেন? সারদা মাকে পুজো করেছিলেন। পায়ে অঞ্জলি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, তুমি মা ভবতারিণী। আমার উলটো, তুমি আমার ভোলা মহেশ্বর। বাবা শ্মশানে থাকে, ছাইভস্ম মাখে।’

‘এখন বলছ বটে, তখন কি আমার সঙ্গে ভিক্ষে করতে বেরোতে পারবে?’

‘সংসার চালাবার জন্যে?’

‘সংসার হলে সংসার তো চালাতেই হবে। সংসার তো আর অটোমেটিক চলবে না। গাড়িতে পেট্রোল ডিজেল না ঢাললে যেমন গাড়ি চলে না, সংসারও তেমনি টাকা না ঢাললে অচল। সংসার করে বেকার বসে থাকলে চলবে না। ঠাকুর আমাকে গালাগাল দেবেন। সংসার করবে, ছেলেমেয়ে হবে, তাদের খাওয়াবে কে? পাড়ার লোকে? গৃহস্থের কর্তব্য আছে, ঋণ আছে—দেব—ঋণ, পিতৃ—ঋণ, ঋষি—ঋণ, আবার পরিবারদের সম্বন্ধে ঋণ আছে। সতী স্ত্রী হলে তাকে প্রতিপালন; সন্তানদিগকে প্রতিপালন, যতদিন না লায়েক হয়। এই আমার ঠাকুরের কথা।’

‘তাহলে শোনো, ঠাকুরের যত উপদেশ লেখা নোটখাতাটা চুরি করে আমি অনেকবার পড়েছি। সেখানে আছে, ঠাকুর এক জায়গায় বলছেন, মেয়েরা এক—একটি শক্তির রূপ। পশ্চিমে বিবাহের সময় বরের হাতে ছুরি থাকে, বাংলাদেশে জাঁতি থাকে—অর্থাৎ ওই শক্তিরূপা কন্যার সাহায্যে বর মায়াপাশ ছেদন করবে। এটি বীরভাব। আমি তোমার সেই শক্তি। শুধু দেখে যাও, আমি তোমার কী করি, কতদূর কী করতে পারি।’

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলুম রুমকির মুখের পানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *