একা – ২৩

তেইশ

হাতুড়ির এক আঘাতেই দেয়ালের প্রায় সব পলেস্তারা ঝুর ঝুর করে খসে পড়ল। বেরিয়ে পড়ল সেকালের পাতলা পুরোনো ইট। অতীতে পাঁচ ইঞ্চি মাপের মোটা ইট পোড়াবার ভাঁটা ছিল না। এই রকমই আমি শুনছি। সব ইটই হত তিন ইঞ্চি। সে প্রায় হবে আলিবর্দির কাল। নবাবি আমলের কথা। বর্গিদের হামলা শুরু হবে। সিরাজ সিংহাসনে বসবেন। ক্লাইভ এসে আমবাগানে নামে মাত্র একটা যুদ্ধ করবেন। একদিনেই জয়পরাজয়ের নিষ্পত্তি। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হবে অতঃপর। সেই সময় আমার কোনো পূর্বপুরুষ মুৎসুদ্দি হবেন। ইংরেজের আনুকূল্যে ধনী হবেন। জায়গাজমি কিনে গঙ্গার ধারে চকমেলানো বাড়ি করবেন। চুনসুরকির গাঁথনি। অদ্ভুত তার প্ল্যান। ঘরের মধ্যে ঘর। আঁকাবাঁকা দালান। কোনো ঘরে আলোর বন্যা, কোনো ঘরে ঘুপচি অন্ধকার। রহস্যময় সিঁড়ি। চোরকুঠুরি।

তারপর তিন পুরুষে সেই সব উড়ে যাবে। ছত্রিশ ভাগ হবে। শেষে ভাগের মা গঙ্গা পাবে না। এই বাড়ির সেই দশা। পেছনের দিকটা ভেঙে মণ্ডপ হয়ে গেছে। কোন শরিক যে মালিক আমার জানা নেই। জানার কথাও নয়। আমার জন্মের আগেই সব ঘটে গেছে। আমার বাবাকেও আমি দেখিনি। খুব কম বয়সেই তিনি মারা গেছেন। আমার মাকেও স্পষ্ট মনে পড়ে না। এক একজনের বরাত এই রকমই হয়।

ইতিমধ্যে দেয়ালের দশবিশখানা ইট নেমে গেছে। আমি দর্শক মাত্র। তদারকি করছে রুমকি। এখন এই বাড়ির অন্যতম মালিক রুমকি, কারণ রুমকি আমাকে বিয়ে করেছে। তার বাবা, মা কোনো আপত্তি করেননি। কেন করেননি বলতে পারব না। পরে হয়তো জানা যাবে। নিজের বরাতের ওপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস নেই। যখনই যা পেয়েছি, পরমুহূর্তেই তা হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে।

এখন রুমকি আমার জীবনটাকে ধরেছে। সে আমাকে তুলবে। ঠাকুর যেমন বলতেন, ‘মেয়েরা এক—একটি শক্তির রূপ। কন্যা শক্তিরূপা। বিবাহের সময় দেখনি—বর বোকাটি পেছনে বসে থাকে। কন্যা কিন্তু নিঃশঙ্ক।’ ঠাকুর বলছেন, ‘আদ্যাশক্তিই এই জীবজগৎ, এই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। অনুলোম বিলোম। বলছেন, যিনি ব্রহ্ম, তিনিই আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এইসব করেন, তাঁকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনিই পুরুষ তিনিই প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী।’

ঠাকুর আবার শিবের দুই অবস্থার কথা বলছেন—’যখন সমাধিস্থ—মহাযোগে বসে আছেন—তখন আত্মারাম। আবার যখন সে অবস্থা থেকে নেমে আসেন—একটু আমি থাকে, তখন ‘রাম’ ‘রাম’ করে নৃত্য করেন। তা আমি কী নিজেকে শিব ভাবতে পারি না? আমার গুরু তো ছিলেন শৈব। শৈব মানে কী, যিনি শিবের উপাসক। আমি মহাযোগে হয়তো যেতে পারব না কোনোদিন, তথাপি নিজের জড়ভূত আমিটাকে শিবের আমি করে রাখতে বাধা কোথায়?

ঠাকুর যেদিন এইসব কথা বলছিলেন, সেই দিনটি কত সুন্দর মাস্টারমশাই লিখছেন—’আজ কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। সন্ধ্যার কিয়ৎকাল পরে চন্দ্রোদয় হইল। সে আলো মন্দিরশীর্ষ, চতুর্দিকের তরুলতা ও মন্দিরের পশ্চিমে ভাগীরথী—বক্ষে পড়িয়া অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। এইসময় সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বসিয়া আছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন।’

ঠাকুরের আবার কী সুন্দর কথা—বলছেন, ‘এইরকম আছে যে, সেই মহামায়া শিবকে টপ করে খেয়ে ফেললেন। মার ভিতরে ষটচক্রের জ্ঞান হলে শিব মার ঊরু দিয়ে বেরিয়ে এলেন। তখন শিবতন্ত্রের সৃষ্টি করলেন। সেই শক্তির, সেই মহামায়ার শরণাগত হতে হয়।’

রুমকিও তো সেই মহামায়া। শিবকে গিলে ফেলেছে।

এই সব ভাবছি, আর ওরা একটা একটা করে ইট খুলে যাচ্ছে।

দেয়াল ভেঙে, সামনের রকটাকে উড়িয়ে একটা দোকান করা হবে। এটা রুমকির উদ্যোগ। মূলধন তার। দুজনেই মেহনত করব। ব্যাবসাটা হবে ছাপা শাড়ির। সে ভেবেচিন্তে দেখেছে, এই জিনিস এখানে খুব চলবে। দ্বিতীয় আর কোনো দোকান নেই। লোকসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। রুমকি নকশার কাজ ভালো জানে। মাথাটা খুব ভালো।

ভেতরের উঠোন আর লম্বা একটা ঘরে কাঠের টেবিল পড়েছে। কাঠের ব্লক তৈরি হতে গেছে। পাড়ার কিছু মেয়ে চাকরিও পাবে। নামাবলিও ছাপা হবে। বড়োবাজার থেকে কাপড় কেনা হবে। ভালো রং ভালো ডিজাইন, এক নম্বর মাল। মানুষকে সেরা জিনিস দিতে পারলে ব্যাবসা জমতে বাধ্য।

রুমকির উৎসাহ দেখে আমার ঘুম—ঘুম ভাবটা আর নেই। উদ্দেশ্যহীন দৌড়োদৌড়ি, ছুটোছুটি বন্ধ হয়ে গেছে। স্বামীজির সেই কথাটি আমার বারে বারে মনে পড়ছে—সঙ্গে সেই অপূর্ব গল্প।

‘একটা লোক রাস্তা চলতে চলতে একটা বুড়োকে তার দরজার গোড়ায় বসে থাকতে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে—’ভাই অমুক গ্রামটা এখান থেকে কতদূরে?’ বুড়োটা কোনো জবাব দিলে না। তখন পথিক বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কিন্তু বুড়ো তবু চুপ করে রইল। পথিক তখন বিরক্ত হয়ে আবার রাস্তায় গিয়ে চলবার উদ্যোগ করলে। তখন বুড়ো দাঁড়িয়ে উঠে পথিককে সম্বোধন করে বললে, ‘আপনি অমুক গ্রামটার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন—সেটা এই মাইল—খানেক হবে।’ তখন পথিক তাকে বললে, ‘তোমাকে এই একটু আগে কতবার ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন তো তুমি একটা কথাও কইলে না—এখন যে বলছ, ব্যাপারখানা কী?’ তখন বুড়ো বললে, ‘ঠিক কথা। কিন্তু প্রথম যখন জিজ্ঞাসা করছিলেন, তখন চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন, আপনার যে যাবার ইচ্ছে আছে ভাব দেখে তা বোধ হচ্ছিল না—এখন হাঁটতে আরম্ভ করেছেন, তাই আপনাকে বললাম।’

‘হে বৎস, এই গল্পটা মনে রেখো। কাজ আরম্ভ করে দাও, বাকি সব আপনা—আপনি হয়ে যাবে। গীতায় ভগবান বলেছেন—

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তামাং যোগক্ষেমম বহাম্যহম।।

অর্থাৎ যারা কারও ওপর নির্ভর না করে কেবল আমার ওপর নির্ভর করে থাকে, তাদের যা কিছু দরকার, সব আমি যুগিয়ে দিই।

‘ভগবানের এই কথাটা তো আর স্বপ্ন বা কবিকল্পনা নয়।’

রুমকি সেদিন রাতে আমাকে পড়ে শোনাচ্ছিল—’কাজ আরম্ভ করে দাও, বাকি সব আপনা—আপনি হয়ে যাবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *