একা – ৫

পাঁচ

দিশাহারা মানুষ পথে নেমে আনন্দ পায়। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি হল, অধিকাংশ মানুষই নিজেকে ভুলতে চায়। কোনো মানুষই নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ পায় না। আর সেভাবে বাঁচতে গেলে পরিণতিটা কী হবে বলা মুশকিল। প্রকৃতির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিলে ফল ভালো হওয়ার কথা নয়। আর নিবৃত্তি সহজে আসার নয়।

আমার সেই প্রাচীন বাড়ির সামনে দিয়ে পথ চলে গেছে সোজা দিল্লি। শের শাহ তৈরি করিয়েছিলেন এই রাস্তা। ইংরেজরা নাম রাখলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এই জিটি রোড ধরে গঙ্গাকে ডানপাশে রেখে আমি হাঁটতেই থাকি। কখনো বাঁ দিকে ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই কোতরং। ওই দিকটায় কয়েকটা বড়ো বড়ো বাগানবাড়ি আছে প্রাচীনকালের। তারপর আরও কিছুটা এগোলেই ইটখোলা। গর্ত খুঁড়ে, মাটি তুলে, বালি মিশিয়ে ছাঁচে ফেলে তৈরি হচ্ছে ইট। ঘর্মাক্ত শ্রমিকের দল। দেহাতি মেয়েদের নিটোল শরীর। তারা হাসছে, তারা কাজ করছে, রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে। গ্রাহ্যই করছে না। ভবিষ্যতের চিন্তায় আতঙ্কিত হচ্ছে না। ঝুটা সভ্যতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা নেই। কর্মই তাদের ধর্ম। আমার চোখের সামনে গর্ত ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কোন নীচে তারা নেমে যাচ্ছে, মাথায় মাটি নিয়ে তারা উঠে আসছে ধাপে ধাপে ওপরে। ছায়ায় শুইয়ে রাখা কোলের শিশুটিকে মাঝে মাঝে এসে দুধ খাইয়ে যাচ্ছে।

ছায়া খুবই কম। প্রখর রোদই এই শিল্পের মূলধন। মাটি, সে তো ধরিত্রীর দান। শ্রম, সে তো মানুষের পেশি। বালি নদীর উপহার, রোদ প্রকৃতির করুণা। আর এক—একটি নিটোল ইট মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের স্বপ্ন। আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। যারা কাজ করছে তারা আমাকে পাত্তাই দেয় না। নিষ্কর্মা একটা লোকের কোনো অস্তিত্বই নেই তাদের কাছে। গাছের তবু ছায়া আছে, আকাশের তবু রোদ আছে, বৃষ্টি আছে। মাটির তবু গন্ধ আছে। আমার কী আছে? ইন্দ্রিয় ছাড়া কিছুই নেই। দাস আমি। ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করি। নিজেকে ঘৃণা করা সবচেয়ে বড়ো পাপ। আমি সেই পাপে পাপী।

একদিন এইরকম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি একপাশে, হঠাৎ স্বাস্থ্যবান এক লোক কোথা থেকে এসে বেশ মেজাজ দেখিয়ে বললেন, ‘তুমি এইভাবে প্রায়ই এখানে দাঁড়িয়ে থাক কেন? তোমার মতলবটা কী?’

মানুষটির মুখটা ভারি মিষ্টি। তামাটে রং। চুল ছোটো ছোটো করে ছাঁটা। সাদা হাফশার্ট, মালকোঁচা মারা ধুতি। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, ‘কী হল? বোবা নাকি?’

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘আপনি কী সুন্দর। আপনার মতো যদি আমার একজন দাদা থাকতেন, তাহলে কত ভালো হত।’

কথাটা আমি অন্তর থেকে বলেছিলুম। চাটুকারিতা নয়। তাই বোধ হয় ভদ্রলোক কেমন যেন হয়ে গেলেন। কথাটা বলতে বলতে চোখে জল এসে গিয়েছিল আমার। আমি একটা উঠতি বয়সের ছেলে। কেউ কোথাও নেই আমার। মা, বাবা, ভাই, বোন। এমনি আমার বরাত। যাকেই আপনি বলে ধরতে গেছি, হয় সে মরে গেছে, না হয় সে পালিয়ে গেছে। গভীর রাতে দোতলার বারান্দায় চুপ করে বসে থাকি নির্জন রাস্তার দিকে তাকিয়ে। বাতাস ছুটে যায় ছেঁড়া কাগজ উড়িয়ে। কখনো মাতাল যায় টলতে টলতে, নেশার ঘোরে বকতে বকতে। পাগল এসে দাঁড়ায় কখনো ল্যাম্পপোস্টের তলায়। কখনো মৃতদেহ নিয়ে যায় হরিধ্বনি দিতে দিতে। আমি বসেই থাকি। কেউ এসে বলে না, রাত হল এইবার শুতে যাও। কেউ এসে জিজ্ঞেস করে না, কিছু খেয়েছো?

ভদ্রলোক হাতটা ধরে বললেন, ‘আমার সঙ্গে এসো।’

অনেকটা হেঁটে আমরা সেই ইটখোলার অফিসঘরে এলুম। টেবিল, কয়েকটা চেয়ার। সবের ওপরেই ময়দার মতো ধুলোর স্তর। টেবিলে খাতাপত্তর। মাথার ওপর অ্যাসবেসটাসের চাল। রোদে সব তেতে আছে। কোণের দিকে কালো একটা কুঁজো। মুখে উপুড় করা কাচের গেলাস। কুঁজোর গায়ে জলের বিন্দু জমে আছে। অসংখ্য অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে। বেলেমাটির ধর্ম। কুঁজো ঘেমেছে। এই ভয়ংকর গরমে কুঁজোটা যেন কোনো শীতল দেবতা।

ভদ্রলোক একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বোসো। ধুলো আছে, থাকবে, গ্রাহ্য কোরো না।’ ভদ্রলোক আমার উলটোদিকের একটা চেয়ারে বসলেন। সাদা জামা থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে। চোখ দুটো বড়ো বড়ো। চাউনিটা স্থির। যে সব মানুষের খুব আত্মবিশ্বাস থাকে তাদের চেহারা মনে হয় এইরকমই হয়।

ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বল তো! তুমি প্রায়ই আসো, এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো! কে তুমি?’

যতটা সম্ভব ছোটো করে বলার চেষ্টা করলুম, আমি কে। বলতে গিয়ে দেখি খেই খুঁজে পাচ্ছি না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বহু ফ্যাঁকড়া। জীবনের প্রথম দিকের অনেকটা জানা নেই। শীতের সকালে গঙ্গায় যখন খুব জমাট কুয়াশা নামে তখন যেমন হয়। হঠাৎ একটা বিশাল নৌকো কোথা থেকে বেরিয়ে এল। অতীত পর্দার আড়ালে ভবিষ্যৎও তাই। বর্তমানে আছি বলে দেখা যাচ্ছে। কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে একটা জীবনকাহিনি খাড়া করে বললুম, ‘অনেকটাই জানি না, কেউ আমাকে জানায়নি।’ কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এসে কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়া।

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম শ্যামসুন্দর। আমি এই ইটভাঁটার মালিক। জানি খুব পাপ করছি। বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। উপায় নেই। ভগবান যেখানে এনে ফেলেছেন।’

‘পাপ কেন?’

‘মহাপাপ! মাকে কোপাচ্ছি। পৃথিবী আমাদের মা। গাভী আমাদের ধর্ম। আমার অত জ্ঞানটান নেই। আমার দাদু যা বলতেন আর কী! একটু চা খাও।’

চা খেতে খেতে ভদ্রলোক বললেন, ‘বছরে কয়েকটা মাস কাজ হয়, বুঝলে? এই পুজোর পর থেকে চোত বোশেখ মাস পর্যন্ত। তারপরেই তো বর্ষা এসে যাবে। ইটে বৃষ্টি পড়লেই হয়ে গেল, পকমার্ক। আর দাম পাবে না। এই ক—মাসে যা পারো করে নাও। কেটলিতে এখনও চা আছে, ভাঁড়টা ফেলো না। এই লছমী, বাবুর ভাঁড়টা ভরতি করে দে।’

লছমী ইটখোলারই শ্রমিক। বোঝা গেল, মালিকের পেয়ারের লোক। বয়েস কম। একটু উঁচু করে শাড়ি পরেছে। স্বাস্থ্য যেন ফেটে পড়ছে। বড়ো খোঁপা। খোঁপায় একটা কাঠের চিরুনি গোঁজা। ভীষণ হাসিখুশি। আমার দিকে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে ভাঁড়ে চা ঢালছে।

ভদ্রলোক বললেন, ‘এরাই আমার আপনার লোক। তোমার যেমন কেউ নেই, আমারও সেইরকম কেউ নেই। মাটি কাটলে বংশ নির্বংশ হয়। কথাটা স্রেফ মিলিয়ে নাও।’

ওই ঘরেরই একপাশে রান্নার একটা ব্যবস্থা। ছোট্ট তোলা উনুন, হাঁড়ি, কড়া, থালা, বাটি, গেলাস। মেয়েটি জিজ্ঞেস করলে, ‘আজ কী খাবে গো?’

শ্যামসুন্দরবাবু আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত মেশানো গলায় বললেন, ‘তুমিও আজ খাও না, খাও না আমাদের সঙ্গে।’ এমনভাবে বললেন, না বলতে পারলুম না। অথচ কোথাও গিয়ে কারও ঘাড় ভেঙে খেতে আমার খুব সংকোচ হয়। পরে সদ্ভাব নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বলবে, ব্যাটা ধান্দাবাজ! আমার ঘাড় ভেঙে কত খেয়েছে, কাপ কাপ চা ধ্বংস করেছে, এখন আর ভুলেও একবার খবর নেয় না।’

‘কী হল? খাবে তো? কী দেখচ হাঁ করে?’

সত্যি অবাক হয়ে গেছি। এত বড়ো একটা ইটভাঁটার মালিক, দেদার যার টাকা, যার অধীনে এত লোক কাজ করছে, সেই মানুষটা আমার সঙ্গে মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলাপে এত ভালো ব্যবহার করছে! কিছু একটা বলতে গেলুম, ঠোঁট দুটো শুধু কাঁপল। কথা বেরলো না।

‘বুঝতে পেরেছি, তোমার আবেগটা খুব বেশি। বুঝলে, ঘা—খাওয়া মানুষ এইরকম হয়। আমিও তোমার মতোই ছিলুম। কেউ একটু ভালো ব্যবহার করলে চোখে জল এসে যেত। তারপর এই ইট তৈরি করতে এসে একটু যেন শক্ত হতে পেরেছি।’

শ্যামসুন্দরবাবু লছমীর দিকে তাকিয়ে ভীষণ লোভীর মতো বললেন, ‘আজ আমরা মুরগি খাবো। মুরগি! সরু চালের ভাত। তোর সেই রান্নাটা আজ দেখা লছমী। এই লে টাকা, লিয়ে যা। শেষপাতে একটু চাটনি রাখিস। আজ আমরা খুব খাবো। আজ তোর জন্মদিন।’

লছমী শরীর দুলিয়ে বললে, ‘ঢং!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *