একা – ১৬

ষোলো

শব্দটা বেশ জোরেই হল। ভাড়াটেদের এলাকায়। ওদের ব্যাপার ওরাই বুঝবে। আমার মাথা ঘামাবার কিছু নেই। আবার বেশ জাঁকিয়ে বসা যাক ধ্যানে। আমার গুরু বলেছিলেন, লীলা—ধ্যান করবে। সেটা কী ব্যাপার? অনেকটা এইরকম, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘর। সময় সন্ধ্যা। ধুনো আর চন্দনের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। ঠাকুর পশ্চিমের বারান্দায় পায়চারি করছেন। হাততালির সঙ্গে গুনগন করে গান গাইছেন,

শমন আসবার পথ ঘুচেছে, আমার মনের সন্দ ঘুচে গেছে।
(ওরে) আমার ঘরের নবদ্বারে চারি শিব চৌকি রয়েছে।।
এ খুঁটিতে ঘর রয়েছে, তিন রজ্জুতে বাঁধা আছে।
সহস্রদল কমলে শ্রীনাথ অভয় দিয়ে বসে আছে।।

এমন সময় পুবদিকের দরজা দিয়ে নরেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথ, রামচন্দ্র মশাই ঢুকছেন। ঠাকুর উঁকি মেরে বলছেন, বাঃ, তোমরা এসে গেছ, নরেন এসেছিস, নরেন? বোসো, তোমরা বোসো।

ঠাকুর ভাবে টলতে টলতে ঘরে ঢুকছেন। এইবার গাইছেন :

শিবসঙ্গে সদারঙ্গে আনন্দে মগনা,
সুধাপানে ঢল ঢল ঢলে কিন্তু পড়ে না
বিপরীত রতাতুরা, পদভরে কাঁপে ধরা,
উভয়ে পাগলের পারা, লজ্জা ভয় আর মানে না।

মনে হচ্ছে, ঠাকুর সমাধিতে চলে যাচ্ছেন। বাঁ হাত ধীরে ধীরে বুকের দিকে উঠছে, ডান হাত উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। দৃষ্টি ভূমির দিকে অবনত। মুখ উদ্ভাসিত। সারা অঙ্গে জ্যোতি। নরেন্দ্রনাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। সমাধি সম্পর্কে তাঁর ভয়ংকর কৌতূহল। কী ব্যাপার? কেন এমন হয়? মন কোথায় চলে যায়। এই মুহূর্তে তিনি কি মৃত? এই অভিজ্ঞতাটা তাঁর হওয়া চাই? বিদেশি দর্শন অনেক পড়েছেন। ভারতীয় দর্শনেও প্রভূত জ্ঞান। তবু এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, মনের এই আরোহণ, অবরোহণের। ঠাকুর পাছে পড়ে যান, তাই রামদত্ত মশাই পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মহেন্দ্রনাথও প্রস্তুত। কিছুক্ষণ ওইভাবে থাকার পর ঠাকুর আবার পরিবেশে ফিরে এলেন। মৃদুস্বরে বলছেন, আমি জল খাব। ঠাকুর ধীরে ধীরে তাঁর খাটের ধারে বসছেন। বসেই বলছেন, রাম, আমার জিলিপি।

দত্তমশাই জিলিপির ঠোঙাটি তাঁর পাশে সসম্ভ্রমে রাখলেন। ঠাকুর তাকাচ্ছেন। একটা জিলিপি বাঁ হাত দিয়ে চূর্ণ করে ফেলে দিলেন। গ্রহণ করলেন না। উঠে গিয়ে হাত ধুলেন। মহেন্দ্রনাথ হাত মোছার জন্যে গামছা এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, খেলেন না?

ঠাকুর মৃদুস্বরে বললে, ওদের সাবধান করে দাও, দ্রব্যের অগ্রভাগ বের হয়ে গেলে, তা কোনোমতেই ঠাকুরের সেবায় ব্যবহার হয় না।

ঘরসুদ্ধ সবাই দত্তমশাইয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। মুখটি ম্লান, বিষণ্ণ।

দত্তমশাই তখন বলছেন, আজ একটা ব্যাপার ঘটেছিল।

মহেন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার?

দত্তমশাই বললেন, শ্যামবাজারের পুলের কাছের ময়রার দোকান থেকে জিলিপি কিনে গাড়িতে উঠছি, এমন সময় কোথা থেকে ছ—সাত বছরের একটি মুসলমান ছেলে এসে বায়না ধরলে, বাবু, আমাকে একটা জিলিপি দাও। আমি কিছুতেই দেবো না, ছেলেটাও ছাড়বে না। গাড়ি চলছে, সেও পেছন পেছন ছুটছে, বাবু একটা জিলিপি। হঠাৎ আমার মনে হল, হয়তো ভগবানই ছলনা করে আমাকে পরীক্ষা করছেন। সেই গল্পটাও মনে পড়ল, একদা কোনো সাধু রুটি তৈরি করে ঘি আনতে গেছেন, ফিরে এসে দেখছেন, একটা কুকুর রুটিগুলো মুখে করে পালাচ্ছে। সাধু তখন সেই পলাতক কুকুরটার পেছন পেছন দৌড়চ্ছেন আর বলছেন, রাম অপেক্ষা করো, রুটিগুলোয় ঘি মাখিয়ে দিই। আমি তখন ইতস্তত ভেবে একখানা জিলিপি তাকে ফেলে দিলুম।

ঠাকুর এইসময় উঠে চিকে ঢাকা উত্তরের বারান্দায় চলে গেলেন।

নরেন্দ্রনাথ তখন প্রশ্ন করলেন, উনি কী করে জানলেন?

দত্তমশাই বললেন, আমি নিঃসন্দেহ, শ্রীরামকৃষ্ণ এযুগের অবতার। কারণ এর আগে আরও একটা ঘটনায় আমি সেই প্রমাণ পেয়েছি। ঠাকুরের এক ভক্তের পালিতা কন্যার কয়েকবার ভেদবমি হয়, সেই ভক্ত তখন নিরুপায় হয়ে রামকৃষ্ণকে স্মরণ করতে লাগলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, সামনেই ঠাকুর উপস্থিত। স্মরণ মাত্রই তিনি চলে এসেছেন আর্ত ভক্তের ডাকে।

নরেন্দ্রনাথ বলছেন, অবতার—টবতার কিনা জানি না, তবে অদ্ভুত এক মানুষ। চুম্বকের মতো আকর্ষণী শক্তি। ছুটে না এসে পারা যায় না। কেবলই জানতে ইচ্ছে করে, সমাধিটা কী?

উত্তরের বারান্দা থেকে ঠাকুর আবার ঘরে প্রবেশ করছেন। মুখে হাসি। বলছেন, তোমরা কী আলোচনা করছ গো? শাস্ত্র? করো করো, আমি একটু শুনি।

মহেন্দ্রনাথ বলছেন, নরেন্দ্র জানতে চাইছে সমাধি কাকে বলে?

—তোমরা কী বলছ?

—বলিনি, তবে বলব ভাবছি—চিত্তবৃত্তীনাং সুতরাং নিরোধঃ। চিত্তবৃত্তির নিরোধই সমাধি। আত্মস্বরূপের প্রকাশই সমাধি। দ্রষ্টা আর দৃশ্যরূপের অভেদই সমাধি। একমাত্র নিত্যসিদ্ধরাই সেই অবস্থা উঠতে পারেন। আত্মকৃপা, গুরুকৃপা, শাস্ত্রকৃপা এই ত্রিবিধ কৃপা ব্যতীত সত্যলাভ অসম্ভব। তদা দ্রষ্টুঃ স্বরূপেহবস্থানম। যোগাবস্থায় দেশ অথবা কালের কোনো বোধ থাকে না। এই অবস্থা বাক্য ও মনের অতীত।

নরেন্দ্রনাথ সামান্য রাগের গলায় বলছেন—মশাই! সেই অবস্থায় যাব কেমন করে?

—শ্রুতি কী বলছেন, তুমি তো জানো নরেন্দ্রনাথ—যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বৃণুতে তনূম স্বাম। আত্মা যাকে বরণ করেন—স্বীকার করেন, তার কাছেই তিনি নিজের স্বরূপটি প্রকাশ করে থাকেন। দেবীসূক্তেও বলা আছে—আমি যাকে যাকে ইচ্ছা করি, তাকে তাকেই সকলের চেয়ে উন্নত করি। ব্রহ্মাণ্ডে উপনীত করি, ঋষিত্বে উপনীত করি, সুমেধা করি।

ঠাকুর মুচকি মুচকি হাসছেন। হাসতে হাসতে আবার গাইছেন—

কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে না পায় দরশন।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন,
সে যে ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।
কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা বুঝ কেমন,
যেমন শিব বুঝেছেন কালীর মর্ম অন্যে কেবা জানে তেমন।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন,
কালী পদ্মবনে হংসসনে হংসীরূপে করে রমণ।
প্রসাদ ভাসে লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু তরণ,
আমার প্রাণ বুঝেছে, মন বুঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন।

গান শেষ। সবাই স্তব্ধ। ঘোর লেগেছে। শাস্ত্র পালিয়ে গেছেন। ঠাকুর কথা বলছেন, ভজনানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, এই আনন্দই সুরা। প্রেমের সুরা। মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরে প্রেম, ঈশ্বরকে ভালোবাসা। ভক্তিই সার। জ্ঞান বিচার করে ঈশ্বরকে জানা বড়োই কঠিন।

মহেন্দ্রনাথ বললেন, আমার অধ্যাপক বন্ধু কালীকৃষ্ণকে যেদিন প্রথম এখানে নিয়ে আসি আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় নিয়ে যেতে চাও?

বলেছিলুম, শুঁড়ির দোকানে যাবে তো আমার সঙ্গে এসো; সেখানে এক জালা মদ আছে। বাড়ির নীচের গোলমালটা খুব বেড়েছে এইবার। মনে হচ্ছে অনেক লোক ঢুকে পড়েছে। এইবার দেখতেই হচ্ছে, ব্যাপারটা কী হল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *