একদিন অপরাহ্নে – ৮

৮.

শেষ পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আয়েশা আমজাদকে বলল, আজ মা তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে বলেছেন।

আমজাদ বলল, মা যেতে বলেছেন, তুমি বলবে না?

আয়েশা লজ্জা পেয়ে বলল, সরি, ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা প্রার্থী বলে দু’হাত জড়ো করল।

আমজাদ তার দু’হাতে চুমো খেয়ে বলল, ক্ষমা চাওয়ার মতো অপরাধ তুমি করোনি। তা ছাড়া আমি জানি কেন তুমি নিজের কথা না বলে মায়ের কথা বললে। তারপর একটা সি. এন. জি. থামিয়ে তাকে নিয়ে উঠে বসে আয়েশাদের বাসার ঠিকানা বলল।

বাসায় পৌঁছে প্রথমে আমজাদ মিস্টার ও মিসেস ব্রাউনকে কদমবুসি করে আয়েশাকেও করতে বলল।

আয়েশা করার পর আমজাদ ওনাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আজ আমাদের পরীক্ষা শেষ। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। দোয়া করবেন, আমাদের পরীক্ষার ফলও যেন খুব ভালো হয়।

ওনারা দু’জনেই দোয়া করে বললেন, তোমরা রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ডাইনিং টেবিলে এস। তোমাদের অপেক্ষায় আমরাও খাইনি।

রুমে এসে আমজাদ আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে সারা মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে দু’হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে খাটে শুইয়ে দিয়ে তার বুকে মাথা রেখে বলল, পরীক্ষার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি। কয়েকদিন এখানে রেস্ট নিয়ে তারপর বাড়ি যাব।

আজ এক বছরের বেশি তাদের বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে একবারও আমজাদ তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে আদর করেনি। আজ করতে আয়েশার তনুমনুতে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে। তারপর যখন খাটে শুইয়ে দিয়ে তার বুকে মাথা রেখে ঐ কথা বলল, তখন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। আমজাদের মুখে পাগলের মতো চুমো খেয়ে চলল।

আমজাদ বলল, প্লিজ আয়েশা, এবার থাম। তোমার মা-বাবা ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছেন।

এক সপ্তাহ আয়েশাদের বাসায় থেকে আমজাদ তাকে নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা দিল।

আমজাদের বাবা আফজাল হোসেন অল্প শিক্ষিত অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। তাই ছেলে আমজাদ ও মেয়ে কণাকে উচ্চশিক্ষিত করার জন্য টাকার মায়া করেন নি। ছেলে এম. এম. পাস করে ফিরে এলে তার বিয়ে দেবেন চিন্তা করে স্ত্রীকে নিয়ে তার সই ও তার স্বামী রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা পাকা করে রেখেছেন। আমজাদ পরীক্ষার দিয়ে বাড়ি এলে একটা ভালো দিন দেখে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবেন।

ভালো ছেলে হিসাবে গ্রামে আমজাদের খুব সুনাম। আফজাল হোসেন ও মাজেদা খাতুনও ছেলের জন্য গর্বিত। সেই ছেলে যখন মেম বিয়ে করে নিয়ে এল তখন দু’জনেই মনে খুব আঘাত পেলেন? আর গ্রামের লোকজনও আমজাদকে ছিছি করতে লাগল।

আমজাদ মা-বাবার পা জড়িয়ে ক্ষমা চাওয়ার সময় বলল, তোমাদেরকে না জানিয়ে ও তোমাদের মতামত না নিয়ে বিয়ে করে অন্যায় করেছি ঠিক; কিন্তু শরীয়তের বরখেলাপ কিছু করিনি। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইনশাআল্লাহ এ বৌ বিদেশী মেয়ে হলেও তোমাদেরকে ও আমাকে সুখী করবে। তোমরা আমাকে। ক্ষমা করে বৌকে তোমাদের পায়ে স্থান দাও। অন্যায় করলে আমি করেছি, ওতো করেনি।

স্বামী থেমে যেতে আয়েশা শ্বশুর-শাশুড়ীকে কদম বুসি করে ভিজে গলায় বলল, আমরা একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। আর এটা তো ইসলামে নাযায়েজ নয়। তবে হ্যাঁ, ছেলেমেয়েরা মা-বাবার অনুমতি নিয়ে বিয়ে করা উচিত। আমি তা নিয়েছি, আমজাদকে আপনাদের অনুমতি নিতে বলেছিলাম। কেন নেয়নি তা আমি জানি না। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আপনারা ক্ষমা না করলে আল্লাহও আমাদেরকে ক্ষমা করবেন না।

বৌ মেম সাহেব হলেও বোরখা পরেছে, বাংলায় ভালোভাবে কথা বলছে, সর্বোপরি এত সুন্দর মেয়ে ওনারা আর কখনও দেখেন নি। মাজেদা বৌকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, আমজাদ আমাদের একমাত্র ছেলে। তা ছাড়া ছেলেমেয়েরা অন্যায় করলে মা-বাবা ক্ষমা না করে থাকতে পারে না। তারপর স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমিও ওদেরকে ক্ষমা করে দাও। তকৃদিরের ওপর তো কারও হাত নেই। আল্লাহ ওদের জোড়া করেছেন, তাই এরকম হল।

আফজাল হোসেনও বৌ দেখে ও তার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছেন। মনের ভাব গোপন করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ; কিন্তু তনিকে বৌ করব বলে যে কথা দিয়েছিলাম তার কি হবে? আমরা ওর মা-বাবার কাছে মুখ দেখাব কি করে?

বাবা থেমে যেতে আমজাদ চমকে উঠে বলল, আমাকে না জানিয়ে তোমরা পাকা কথা দিয়ে খুব ভুল করেছ। আমি তনিকে কণার মতো দেখি। আয়েশাকে বিয়ে না করলেও ওকে কিছুতেই বিয়ে করতাম না। যাক, আল্লাহ যা করেন বান্দাদের ভালোর জন্য করেন। তোমরা এটা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করো না। আমি তনির মা বাবাকে যা বলার বলব।

ভাইয়া মেম বিয়ে করে এনেছে জেনে কণা তাদের কাছে না গিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে রাগে ফুলছিল আর ভাবছিল, গালিব সাহেবের কথাই ঠিক হল। তনির কথা চিন্তা করে তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। শেষে আয়েশা যখন মুখের নেকাব সরিয়ে মা-বাবাকে কদমবুসি করল তখন তাকে দেখে ও তার কথা শুনে ভাবল, ভাইয়া খুব ভাগ্যবান, তাই এরকম বৌ পেয়েছে। ভাইয়া থেমে যেতে সামনে এসে আয়েশাকে সালাম দিয়ে বলল, আমি আপনার একমাত্র ননদ কণা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ননদ মানে বোঝেন তো?

আয়েশা সালামের উত্তর দিয়ে মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল, তোমার ভাইয়ার কাছে এ বাড়ির সকলের কথা শুনেছি। তারপর আবার বলল, ভাবিকে আপনি করে বলছ কেন? তুমি করে বলবে।

কণা মৃদু হেসে বলল, ঠিক আছে। এবার চল, তোমাকে ভাইয়ার রুমে পৌঁছে দিই।

আয়েশা বলল, মা-বাবা ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।

মাজেদা বেগম বললেন, আমরা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি। যাও মা, ওর সঙ্গে যাও।

এমন সময় আসরের আজান হচ্ছে শুনে আফজাল হোসেন মসজিদে চলে গেলেন। আমজাদ কণাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ওকে নিয়ে তুই নামায পড়, আমি মসজিদ থেকে পড়ে আসি।

তনির ভাই রাসেদ ক্লাস এইটে পড়ে। মসজিদে নামায পড়তে এসে আমজাদকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, ভাইয়া কেমন আছেন?

আমজাদ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো?

হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। কখন এলেন?

এই কিছুক্ষণ আগে। নামায পড়ে আমাদের বাড়িতে এস।

রাসেদও জানে আপার সঙ্গে আমজাদ ভাইয়ের বিয়ে হবে। তাই তাদের বাড়িতে এসে আমজাদ ভাই মেম বিয়ে করে নিয়ে এসেছে দেখে অবাক হল। এত সুন্দর মেয়ে আগে দেখেনি। নাস্তা পানি খেয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে বাড়িতে এসে আপাকে কথাটা জানাল।

তনি শুনে চমকে উঠে বলল, তুই ঠিক বলছিস?

হ্যাঁ, আপা। আমজাদ ভাইয়া মসজিদ থেকে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল। ভাবি আমার নাম ও কোন ক্লাসে পড়ি জিজ্ঞেস করল।

তনির তখন গালিবের কথা মনে পড়ল। ভাবল, উনি মনে হয় আমজাদ ভাইয়ার ব্যাপারটা জানতেন, কিন্তু কেমন করে? তখন তার চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে রাসেদকে বলল, ঠিক আছে, তুই এখান থেকে যা। রাসেদ চলে যাওয়ার পর চোখে ওড়না চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

তনির বাবা রুহুল আমিন মসজিদে এশার নামায পড়তে গিয়ে কথাটা শুনে। মর্মাহত হয়ে বাড়িতে এসে স্ত্রীকে জানালেন।

মুনসুরা বেগমও শুনে খুব মর্মাহত হয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমজাদ কাজটা ভালো করেনি। আমার ও সই-এর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল।

রুহুল আমিন বললেন, তুমি আমজাদকে দোষ দিচ্ছ কেন? যখন বিয়ের কথা পাকা করা হয় তখন আমি বলেছিলাম, আমজাদের সামনে কথা পাকা করা উচিত। তুমি ও আমজাদের মা-বাবা আমার কথার গুরুত্ব দিলে না। বললে কি না, আমজাদের মতো ছেলে আমাদের কথা অমান্য করা তো দূরের কথা খুশি মনে মেনে নেবে। এখন কি হল? আমার তো মনে হয় আমরা যে বিয়ের কথা পাকা করেছি, সেকথা আমজাদ জানেই না। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। আল্লাহর ইশারা ছাড়া যখন কোন কিছুই হয় না তখন এ নিয়ে মন খারাপ করা উচিত নয়।

মনসুরা বেগম বললেন, তুমি বাবা। মেয়ের খবর রাখনি। অবশ্য রাখা সম্ভবও নয়। কিন্তু মায়েরা ছেলেমেয়েদের মনের খবর সবটা না হলেও অনেকটা জানতে পারে । তনি যে অনেক আগে থেকে আমজাদকে পছন্দ করে তা আমি জানি। সে বিয়ে করে বৌ এনেছে জেনে খুব কষ্ট পাবে।

রুহুল আমিন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমজাদকে তনি পছন্দ করে, তুমি ও আমি করি না? ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস,” মানুষ আশা করে এক আর আল্লাহ করেন আর এক। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে মানুষ এতটুকু কিছু করতে পারে না। তনির মতো আমরাও ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু সেই ব্যথা সারাবার মানুষের কাছে কোনো চিকিৎসা নেই। আছে একমাত্র আল্লাহর কাছে। তনির সঙ্গে আমাদেরও সবর করতে হবে। শুধু শুধু আমজাদকে দোষ দেয়া আমাদের ঠিক হবে না।

মুনসুরা বেগম বললেন, হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক। তাই বোধ হয় বিয়ের পাকা কথা বলার সময় তুমি বলা সত্ত্বেও আমরা আমজাদকে সে সময় কাছে রাখাকে গুরুত্ব বলে মনে করিনি। আমার কি মনে হচ্ছে জান, এই ঘটনায় সই ও সয়া আমরা কি মনে করব ভেবে যেমন খুব লজ্জিত হয়েছে তেমনি ছেলেকে খুব রাগারাগি করেছে।

এটাই স্বাভাবিক। তাদেরকে লজ্জা থেকে বাঁচাবার জন্য আমাদের কিছু করা উচিত।

কিভাবে বাঁচাবে কিছু ভেবেছ?

হ্যাঁ, তনির বিয়ের জন্য আড়াই ভরী ওজনের যে নেকলেসটা বানিয়েছি, কাল সকালে তুমি বৌ দেখতে গিয়ে তার গলায় পরিয়ে দিও।

খুব ভালো কথা বলেছ। পরে না হয় তনির জন্য আর একটা নেকলেস বানানো যাবে। তারপর বলল, আমি একা যাব নাকি?

একা যাবে কেন? তনিকে নিয়ে আমরা দু’জনেই যাব।

তনি কি যেতে রাজি হবে?

হবে না কেন? তার পেটে দ্বীনি এলেম আছে। এতক্ষণ হয়তো এটাকে তক্বদিরের লিখন ভেবে সামলে নিয়েছে। বলে দেখ, আমার মনে হয় অরাজি হবে না।

এশার নামায পড়ে ফিরে এসে আব্বাকে আম্মার সঙ্গে কথা বলতে দেখে তনি এতক্ষণ আড়াল থেকে তাদের কথা শুনছিল আর চোখের পানি ফেলছিল। আব্বার শেষের কথা শুনে সামলে নিয়ে আল্লাহর কাছে সবর করার দোয়া চাইতে চাইতে নিজের রুমে ফিরে এল।

পরের দিন ভাবির সঙ্গে নাস্তা খেয়ে তনিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য কণা তৈরি হচ্ছিল, এমন সময় তনিকে রুমে ঢুকতে দেখে সালাম বিনিময় করে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ করে ঐ অবস্থায় থেকে ভিজে গলায় বলল, ভাইয়াকে তুই মাফ করে দে।

তনি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, তোর ভাইয়া কি এমন অন্যায় করেছে যে, তাকে ক্ষমা করার কথা বলছিস? বরং আমার তো মনে হচ্ছে, মনের কথা তাকে না জানিয়ে আমিই তার কাছে অন্যায় করেছি। জানালে হয়তো

এরকম ঘটনা ঘটত না। আসলে কি জানিস, মানুষ যাই কিছু চিন্তা করুক না কেন, আল্লাহপাক রাজি না থাকলে তা পূরণ হয় না। মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতেই হবে। শুধু তোর ভাইয়ার ওপর নয়, তোদের কারও ওপর আমার এতটুকু অভিযোগ বা মনে কষ্ট নেই।

কণা বলল, মা-বাবা যখন ভাইয়াকে তোর সঙ্গে বিয়ের পাকা কথা বলে রাগারাগি করল তখন ভাইয়া বলল, তোকে নাকি সই-মার মেয়ে হিসাবে বোনের মতো দেখে। কিছুতেই বিয়ে করত না।

তনি বলল, বাদ দে ওসব কথা। আমজাদ ভাই নাকি খুব সুন্দরী মেম বিয়ে করে এনেছে? চল, তার সঙ্গে পরিচিত হই।

কণা তাকে নিয়ে ভাইয়ার রুমে এসে দেখল, আত্মীয়-অনাত্মীয় মেয়েরা ভাবিকে ঘিরে গল্প করছে। তাদেরকে কণা পরে আবার আসার কথা বলে বিদায় করে দরজা লাগিয়ে দিল।

আয়েশা এতক্ষণ তনিকে দেখছিল। চোখে চোখ পড়তে সালাম বিনিময় করে। বলল, আপনার পরিচয় বলুন।

তনি কিছু বলার আগে কথা বলা, ও আপনার আর এক ননদ, নাম তনি। আমরা দুজনেই এবার বি. এ. পরীক্ষা দেব।

আয়েশা তাদেরকে বসতে বলে কণার দিকে তাকিয়ে বলল, আমজাদের কাছে জেনেছি, তুমি একমাত্র তার বোন। তা হলে উনি কি রকম বোন?

কণা বলল, ও আমার মায়ের সই-এর মানে বান্ধবীর মেয়ে। তারপর তাদের দুই ফ্যামিলির সম্পর্কের কথা বলল।

আয়েশা বলল, শুনে আনন্দিত হলাম। পাড়াগাঁয়ে তোমাদের মতো ননদ পাব আশা করিনি।

তনি বলল, আপনিতো খুব সুন্দর বাংলা বলতে পারেন।

আগে অল্প-সল্প বলতে পারলেও পড়তে বা লিখতে পারতাম না। আমজাদকে ভালবাসতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা শিখতে আরম্ভ করি।

কণা জিজ্ঞেস করল, আপনাদের ভালবাসার শুরু কতদিন আগে?

দু’বছরের বেশি হবে।

আর বিয়ে?

এক বছর আগে।

কণা খুব অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? ভাইয়াটা যে কি, এক বছর আগে বিয়ে করলেও আমাদেরকে জানায় নি।

আয়েশা বলল, বিয়ে বলতে যা বোঝায় তা হয়নি, শুধু কাবিন হয়েছিল। পরীক্ষার আগে পর্যন্ত আমরা বন্ধুর মতো মেলামেশা করেছি।

এমন সময় আমজাদ এসে তনির সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, কিরে, কেমন আছিস?

ভালো, পরীক্ষা কেমন দিলে বল।

আল্লাহর রহমতে ভালো বলে আমজাদ বলল, আয়েশার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে।

কি রকম মনে হল?

ভালোই তো? এখন যাই, পরে আবার আসব বলে তনি কণাকে বলল, চল যাই।

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর আমজাদ আয়েশাকে জিজ্ঞেস করল, তনিকে কি রকম মনে হল?

আয়েশা বলল, খুব ভালো। তারপর আরও বলল, এরই সঙ্গে তা হলে তোমার মা বাবা তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে কথা পাকা করে রেখেছিলেন? আমজাদ বললেন হ্যাঁ।

ভাইয়ার রুম থেকে বেরিয়ে কণা তনিকে নিয়ে নিজের রুমে এসে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, তোকে একটা কথা বলব, কথাটা শুনে তুই হয়তো একজনের ওপর রেগে যাবি। তবু তোকে বলা উচিত। তাই বলতে চাচ্ছি।

তনি বলল, কথাটা বলা উচিত যখন বলেই ফেল। অত ভূমিকার দরকার নেই।

গালিব সাহেবকে তো তুই খুব ভালো লোক বলেই জানিস, তাই না?

তনি একটু রেগে উঠে বলল, আবার ভূমিকা বলছিস? যা বলার বলে ফেল।

তার আগে যা জিজ্ঞেস করেছি বল।

হ্যাঁ, উনি খুব ভালো লোক।

প্রথম দর্শনে উনি তোকে ভালবেসে ফেলেছেন এবং সেই ভালবাসা এত গভীরে চলে গেছে যে, তোকে না পেলে জীবনে বিয়েই করবেন না।

তনি কয়েক মিনিট কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, গালিব সাহেব তোকে কথাটা বলেছেন, না তুই আমার কাটা ঘায়ে লবণ ছিটাচ্ছিস?

কণা কান্নাজড়িত স্বরে বলল, তুই একথা বলতে পারলি, তোর কাটা ঘায়ে। লবণ ছিটাচ্ছি?

সরি, মাফ করে দে, তুই তো আমার মনের অবস্থা জানিস? তাই কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

কণা চোখ মুছে বলল, খুব অবাক হয়েছি যখন তোর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ের পাকা কথা ও ভাইয়াকে তুই ভালবাসিস জেনেও কথাটা বললেন।

তোকে হঠাৎ ঐ কথা বলতে গেলেন কেন?

যেদিন ওনাকে ছোটলোক, ইতর বলেছিলাম, সেদিন ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাইয়ার সঙ্গে কেন তনির বিয়ে হবে না আপনাকে বলতেই হবে। কিছুতেই বলতে চাইলেন না। শেষে যখন বললাম, একটা সত্যকথা বলবেন?

বললেন, আমি কখনও মিথ্যা বলি না।

বললাম, আপনি কি তনিকে পছন্দ করেন অথবা ভালবাসেন?

বললেন, শুধু পছন্দ করি বা ভালবাসি না। ওনাকে না পেলে জীবনে বিয়েই করব না। এরপরও তুই ওনাকে ভালো লোক বলবি?

তনিমা বলল, তুই ওনার উপর এত চটেছিস কেন বলতে পারিস?

কণা অবাক হয়ে বলল, তুই চটিস নি?

উনিতো চটবার মতো কোনো কাজ করেন নি, শুধু শুধু ওনার ওপর চটতে যাব কেন? শোন, আমজাদ ভাই যে এক বছর আগে আয়েশাকে বিয়ে করেছে উনি হয়ত তা জানতেন। তাই ঐ কথা বলেছেন। আর পছন্দ করা, ভালবাসা কিংবা বিয়ে করা এসব ব্যক্তিগত ব্যাপার। উনি যদি সেসব তোর কাছে বলেই থাকেন, সেটা তুই দোষ বলে মনে করছিস কেন? ধর, তুই যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ অথবা ভালবেসে বিয়ে করার কথা আমাকে বলিস, আমি কি তোকে খারাপ ভাবব, না তুই অন্যায় করছিস বলে তোর সঙ্গে আড়ি করব? আমার কি মনে হচ্ছে জানিস?

কি?

আমাকে ভাবি করতে পারলি না বলে তুই মনে দুঃখ পেয়েছিস। আর আমজাদ ভাই অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে তার ওপরও ক্ষোভ জন্মেছে। গালিব সাহেব আমাকে বিয়ে করতে চান শুনে সেই দুঃখ ও ক্ষোভ গালিব সাহেবের ওপর রাগে পরিণত হয়েছে।

একটা সত্যি কথা বলবি?

আমাকে কখনও মিথ্যে বলতে শুনেছিস?

তুইও কি গালিব সাহেবকে ভালবাসিস অথবা বিয়ে করতে চাস?

ওনার কিছু কিছু ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছি ঠিক, তাই বলে কখনও ভালবাসার বা বিয়ে করার কথা চিন্তা করিনি। তবে তকৃদিরে লেখা থাকলে অন্য কথা। কারণ তকৃদিরে যা লেখা থাকে তা তো হবেই। এবার আমি যদি বলি তুই গালিব সাহেবকে ভালবেসে ফেলেছিস?

কণা রেগে উঠে বলল, কি করে বুঝলি?

তনি হেসে উঠে বলল, তোর রাগটা তার প্রমাণ।

তুই বললেই হল। যাকে যে অপছন্দ করে তার কথা শুনলেই সে রেগে যায়।

হ্যাঁ, তোর কথা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিক। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পছন্দের মানুষ যদি তার অপছন্দের মতো কাজ করে তখন তার ওপর রেগে যায়।

কথাটা ঠিক বুঝলাম না?

না বোঝার কি আছে? ধর, তুই একটা ছেলেকে পছন্দ করিস অথবা ভালবাসিস। সেই ছেলেটা যখন অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে নির্জনে আলাপ করে বা মেলামেশা করে তখন তার ওপর তোর রাগ হবে কি না বল।

তা হলে তুই মনে করেছিস, গালিব সাহেবকে আমি ভালবাসি। তাই তিনি তোকে ভালবাসার এবং বিয়েও করার কথা বলছেন বলে আমি তার ওপর রেগে আছি, তাই না?

হ্যাঁ, তুই ঠিক ধরেছিস।

তাই যদি মনে করে থাকি তা হলে দু’জনেই গালিব সাহেবকে বিয়ে করলেই ভালো হয়। তাতে করে আমাদের আজীবন একসঙ্গে থাকার স্বপ্নও সফল হবে।

এই কথায় দু’জনেই হেসে উঠল। তনি হাসি থামিয়ে বলল, তোর আইডিয়া দারুন।

কণা বলল, থাম থাম, গালিব সাহেবও কিন্তু বলেছিলেন, আমাদের দুজনকে আজীবন একসঙ্গে রাখার ব্যবস্থা করতে পারবেন।

তনি বলল, ফাজলামি রেখে আমার কথার উত্তর দে, গালিব সাহেব যে কথা তোকে বলেছেন, সেকথা এত দিন আমাকে বলিসনি কেন?

বলার আগে উনি ওয়াদা করিয়েছিলেন, তোকে বা অন্য কাউকে যেন না বলি।

তা হলে ওয়াদা ভঙ্গ করে বললি কেন?

ওয়াদার মেয়াদ ছিল, ভাইয়া বাড়ি না আসা পর্যন্ত । ভাইয়া তো গতকাল এসেছে। এবার তুই বল, গালিব সাহেবের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিবি?

আমার সিদ্ধান্ত নেয়া লাগবে না, যার মাথা ফাটবে সেই চুন খুঁজে নেবে।

মানে?

অত মানে মানে করছিস কেন? এই সামান্য কথাটাও বুঝতে পারলি না। গালিব সাহেব যা কিছু তোকে বলেছেন, তা কাজে পরিণত করতে হলে যা করার তা উনিই করবেন, আমাকে কিছু করতে হবে না।

উনি যদি তোর মা-বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন, তা হলে কি করবি?

মা-বাবা প্রস্তাব মেনে নিলে আমার কি করা উচিত তুই-ই বল না?

কণা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ওনাকে তোর পছন্দ হলে রাজি হবি, না হলে হবি না। এবার বল, গালিব সাহেবকে তুই পছন্দ করিস কি না?

তনি বলল, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা জানতে চাচ্ছিস কেন? এতে প্রমাণ হয় তুই-ই ওনাকে পছন্দ করিস। কথা সত্যি হলে বল, আমজাদ ভাইকে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলব।

এমন সময় একজন কাজের মেয়ের এসে বলল, আপনাদেরকে নাস্তা খাওয়ার। জন্য আম্মা ডাকছেন।

কণা বলল, তুমি যাও, আমরা আসছি।

সেদিন কণাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর গালিবকে নিয়ে তনি অনেক ভাবল। কণার মুখে গালিবের কথা শোনার পর থেকে আমজাদকে না পাওয়ার যাতনা যেন দূর হয়ে মনের মধ্যে এক প্রকার আনন্দের অনুভূতি বোধ করতে লাগল। আবার ভাবল, কথাগুলো সত্যিই কি গালিব সাহেব বলেছেন? আবার ভাবল, কণা কি গালিব সাহেবকে ভালবেসে ফেলেছে? তাই গালিব সাহেবের কথাগুলো কি বানিয়ে বলেছে আমাকে পরীক্ষা করার জন্য? তবে যাই হোক না কেন, সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখতে হবে।

এক মাস বন্ধ ছিল কলেজ। খোলর দু’দিন পর কলেজে গিয়ে তনিও কণা শুনল, রায়হান নামে একজন ইংলিশের নতুন প্রফেসার জয়েন করেছেন।

রায়হান যখন ক্লাস নেয়ার জন্য ঢুকল তখন তাকে হুবহু গালিব সাহেবের মতো দেখে তনি ও কণা অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর যখন লেকচার দিতে লাগলেন তখনও হুবহু গালিব সাহেবের মতো গলা শুনে আরও বেশি অবাক হল। শুধু তাই নয়, বচন ভঙ্গিও গালিবের মতো বলে তাদের মনে হল। ক্লাসটা স্বপ্নের মধ্যে কেটে গেল। রায়হান স্যার চলে যাওয়ার পর কণা তনিকে বলল, কি ব্যাপার বলতো, নতুন স্যার দেখতে হুবহু গালিব সাহেবের মতো।

তনি বলল, হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস, স্যার যখন লেকচার দিচ্ছিলেন তখন মনে হল গালিব সাহেব দিচ্ছেন।

কণা বলল, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়েছে।

তনি বলল, আমার কি মনে হচ্ছে জানিস? গালিব সাহেবই রায়হান স্যার।

কণা কপাল কুঁচকে বলল, গালিব সাহেব পোস্ট মাস্টার আর রায়হান স্যার ইংলিশের প্রফেসার। দু’জনে একই লোক হতে পারেন না।

তনি বলল, এক কাজ করি আয়, বাকি ক্লাসগুলো না করে বাড়ি যাই চল। যাওয়ার পথে পোস্ট অফিসে গেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

কণা বলল, ঠিক বলেছিস, তাই চল।

পোস্ট অফিসের দরজা দিয়ে একে একে উঁকি দিয়ে দু’জনেই দেখল, গালিব সাহেব ও রহিম চাচা কাজ করছেন।

কণা ফিস ফিস করে বলল, দেখলি তো, আমার কথাই ঠিক।

গালিব পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে পুলিশ বিভাগে ঢুকে। তারপর ট্রেনিং নিয়ে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। গালিবের আগে যিনি এখানে পোস্ট মাস্টার ছিলেন এবং যাকে ভূতেরা গলাটিপে মেরে ফেলেছে, তিনি গালিবের খালু আফসার উদ্দিন। খালুকে ভূতে গলাটিপে মেরে ফেলেছে সে বিশ্বাস করেনি। তার দৃঢ় ধারণা কোনো মানুষ ওনাকে হত্যা করেছে। আফসার উদ্দিন খুব ধার্মিক ছিলেন। কারও সাথে প্যাঁচে থাকতেন না। তবু কেন তাকে হত্যা করল এবং হত্যাকারীদেরকে খুঁজে বের করার জন্য খালুর পোস্টে চাকরি নিয়ে এসেছে। ভেবেছিল, থানার দারোগা সাহেবকে পরিচয় দিয়ে এই কেসের ব্যাপারে সাহায্য চাইবে। কিন্তু বাড়ির ছাদে ইট ফেলার ব্যাপারে দারোগার সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারল, তিনিও হত্যাকারীদের সঙ্গে আছেন। তাই পরিচয় না দিয়ে নিজেই তদন্ত করার মনস্থ করে।

গালিবের যমজ ভাই রায়হান। এস. এস. সি. পাস করার পর দু’বছর খুব কঠিন অসুখে ভুগে। তাই দু’ভাই একসঙ্গে এস. এস. সি. পাস করলেও রায়হান পড়াশোনায় দু’বছর পিছিয়ে যায়। গালিব যখন এখানে পোস্ট অফিসের চাকরি নিয়ে আসে তখন রায়হান ইংলিশে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে। তারপর মাস্টাস কমপ্লিট করে এখানকার কলেজে চাকরি নিয়ে এসেছে। দুই ভাই প্রায় একই রকম দেখতে। স্বাস্থ্য, উচ্চতা, চলন-বলন ও গলার স্বরও একই রকম। দু’জনেরই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। একসঙ্গে থাকলে কে গালিব আর কে রায়হান চেনা খুব মুস্কিল। তবে রায়হানের ডান দিকের জ্বর সামান্য উপরে একটা কালো তিল আছে। এটা ছাড়া দু’জনের সবকিছু এক। ওদের দুজনের চেহারার এত মিল যে, ওদের মা আমেনা বিবিও একটু অন্যমনস্ক থাকলে মাঝে মাঝে কে গালিব আর কে রায়হান বুঝতে ভুল করে ফেলেন। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে ঐ তিলটা দেখে ভুল সংশোধন করে নেন।

কণা ও তনি যখন পোস্ট অফিসের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে তখন গালিব তাদেরকে দেখেও না দেখার ভান করে কাজ করতে থাকে। তারপর তারা যখন ফিস ফিস করে কথা বলছিল তখন তাদেরকে বলল, বাইরে কেন, ভেতরে আসুন।

ভেতরে এসে দু’জনেই সালাম দিল।

কলেজে রায়হানকে দেখে ওদের মনে যে সন্দেহ হয়েছে এবং সেই সন্দেহ যাচাই করার জন্য যে ওরা ক্লাস না করে চলে এসেছে তা গালিব বুঝতে পেরেছে। তাই সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কি ব্যাপার ক্লাস না করে চলে এলেন যে? আবার বাইরে থেকে এ ঘরে উঁকিই বা দিচ্ছিলেন কেন?

ওরা কি বলবে ভেবে না পেয়ে একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নিচু করে রইল।

কি হল, আমার কথার উত্তর দেবেন না।

ততক্ষণে রহিম চাচা নিজের ও অন্য একটা টুল এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনারা বসুন।

তনি বলল, আমরা বসব না চাচা, বরং আপনি টুলে বসে কাজ করুন। আমরা এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।

গালিব বলল, আমার কথার উত্তর না দিয়েই চলে যাবেন?

কথা না শোনার ভান করে ওরা চলে গেল।

গালিব মুচকি হেসে নিজের কাজে মন দিল।

যখন রায়হান ঢাকা থেকে আসে তখন রহিম চাচাও তাকে গালিব মনে করেছিল। তারপর যখন দুই ভাইকে একসঙ্গে দেখল এবং তাদের পরিচয় জানল তখন খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনাদের আলাদাভাবে চিনবো কি করে?

আমার এই তিলটা দেখে আমাকে চিনবেন বলে রায়হান ডান চোখের ভ্রুর উপরের তিলটা দেখাল।

তনি ও কণা চলে যাওয়ার পর রহিম চাচা বলল, মা মনিরা আপনার ভাইকে কলেজে দেখে ধাঁধায় পড়ে গেছে। তাই মনে হয় ক্লাস না করে আপনাকে দেখতে চলে এসেছে।

গালিব বলল, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

রায়হান প্রথম যে দিন আসে, সেদিনই গালিব তাকে খালুকে যে হত্যার করা হয়েছে, সে ব্যাপারে আলাপ করেছে। এরপর কি করবে না করবে তাও আলাপ করার পর তনি ও কণার সবকিছু বলে বলল, মায়ের সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করেছি, আমি তনিকে বিয়ে করব। আর তুই কণাকে করবি। অবশ্য কণাকে যদি তোর অপছন্দ না হয়। তনি ও আমজাদের ব্যাপারটাতো তুইও জানিস। তারপর তনি ও কণার দু’কপি পাসপোর্ট সাইজ ফটো তাকে দিল।

অনেক আগে গালিব তনি ও কণার অজান্তে তাদের দুটো ফটো তুলে রেখেছিল।

রায়হান বলল, খালুর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা তোর কাজ। ঐ ব্যাপারে আমি নাক গলাব না। তবে সাহায্যের দরকার হলে নিশ্চয় করব। তারপর ফটো দুটোর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, কণাকে বিয়ে করার ব্যাপারে এখন কিছু বলতে পারব না। কারণ তাকে তুই চিনলে জানলেও আমি চিনিও না, জানিও না। তবে মা যখন রাজি তখন আলাপ পরিচয়ের পর বলতে পারব।

দুই ভাই প্রথম যখন একসঙ্গে মসজিদে নামায পড়তে আসে তখন মুসুল্লীরা অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিল। তাদের অবস্থা দেখে গালিব রায়হানকে দেখিয়ে বলল, আমরা যমজ ভাই। আমি বড় আর রায়হান ছোট। ও আপনাদের এখানকার কলেজের প্রফেসারের চাকরি নিয়ে এসেছে। যাতে আপনারা কে কোনজন সহজে চিনতে পারেন, সেজন্য আমার বামহাতের কব্জিতে সব সময় সবুজ রুমাল বেঁধে রাখব। অবশ্য আরও একটা উপায়ে রায়হানকে চিনতে পারবেন। ওর ডান চোখের ভ্রুর উপরে একটা কালো তিল আছে।

তনি ও কণা বাবার মুখে রায়হানের পরিচয় শুনে খুব অবাক হয়েছে।

একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে দু’জনে দেখল রায়হান স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে এসে তনি সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

আমরা তো আপনার ছাত্রী, আপনি করে বলছেন কেন?

নতুন তো, পুরনো হয়ে গেলে আর বলব না।

এবার কণা বলল, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কেন?

চলুন, যেতে যেতে বলছি বলে রায়হান হাঁটতে শুরু করল।

ওরাও হাঁটতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর কণা বলল, কই, বলবেন তো, কেন অপেক্ষা করছিলেন?

আপনি তো আমজাদ সাহেবের বোন তাই না?

কণা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞেস করল, ভাইয়াকে চেনেন মনে হচ্ছে?

সে কথা আপনার ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন।

তা তো পারব; কিন্তু এখন আপনিই বা বলছেন না কেন?

কারণ আছে, তাই বলতে পারছি না।

ঠিক আছে, এবার বলুন, আপনার ভাই গালিব সাহেব অনেক পশু-পাখির ডাক ডাকতে পারেন। আপনিও পারেন নাকি?

রায়হান হেসে উঠে বলল, না। তবে ওর কাছেই মানুষের গলা নকল করা শিখেছি।

এখন প্রমাণ দেখাতে পারবেন?

ইনশাআল্লাহ পারব বলে রায়হান বলল, সামনের দিকে অল্প দূরের ঐ খিরীশ গাছটার দিকে তাকান।

ওরা তাকাবার সাথে সাথে খিরীশ গাছের তলায় কণার গলা শুনতে পেল, “আপনার ভাই গালিব সাহেব অনেক পশু-পাখির ডাক ডাকতে পারন, আপনিও কি পারেন।”

তনি তেমন অবাক হল না। সে আগে গালিবের কাছে এরকম শুনেছে। কিন্তু কণা এত অবাক হল যে, বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। তার মনে হল কথাগুলো গাছের তলা থেকে তার কাছে এসে থেমে গেল। সামলে নিয়ে তনির দিকে তাকিয়ে তাকে মিটি মিটি হাসতে দেখে বলল, কিরে, হাসছিস কেন? তোকে অবাক লাগে নি?

তনি বলল, গালিব সাহেব একবার আমাকে এরকম কথা শুনিয়েছেন। তারপর তারা খেয়াল করল, রায়হান স্যার তাদের কাছে নেই। সামনের দিকে তাকাতে দেখতে পেল, তিনি গাছ পার হয়ে চলে গেছেন।

কণা আবার অবাক হয়ে বলল, এরই মধ্যে উনি অতদূরে গেলেন কি করে? তা হলে উনিও কি গালিব সাহেবের মতো যাদু টাদু জানেন?

তনি হেসে উঠে বলল, গালিব সাহেবের এরকম ঘটনার কথা যেদিন তোকে বলে বললাম, উনি যাদু জানেন; সেদিন তুইতো বললি, যাদু বলে দুনিয়াতে কিছু নেই। এখন আবার ওকথা বলছিস কেন? তারপর চলতে শুরু করে বলল, দুই ভাইয়ের মধ্যে এত মিল, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।

কণা বলল, হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। দু’জনের মধ্যেই মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতাও আছে।

বাড়িতে ফিরে কণা এক সময় ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের কলেজে রায়হান নামে একজন ইংলিশের প্রফেসার কয়েকদিন আগে জয়েন করেছেন। ওনার যমজ ভাই গালিব। উনি প্রায় দু’বছর হল এখানকার পোস্ট অফিসের মাস্টার হয়ে এসেছেন। ওনাদেরকে তুমি চেনো?

যেদিন আমজাদ রেবেকাকে দু’জন সন্ত্রাসী ছেলের হাত থেকে রক্ষা করে, তার কয়েকদিন পর একা পেয়ে সেই দু’জন সন্ত্রাসী তার দলের আরও দু’তিনজনকে নিয়ে আমজাদকে আক্রমণ করে।

আমজাদ শক্তিশালী যুবক; কিন্তু একা আর কতক্ষণ তাদের সঙ্গে লড়বে? এক সময় যখন তাদের মারের আঘাতে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেল, ঠিক তখনই গালিব ও রায়হান সেখান থেকে যাচ্ছিল। ঘটনাটা বুঝতে পেরে দু’ভাই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে লড়াই করে আমজাদকে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং চিকিৎসা করিয়ে হলে পৌঁছে দেয়। সেই থেকে দুই ভাইয়ের সঙ্গে আমজাদের হৃদয়তা গড়ে উঠে। তারপর আমজাদ যেমন ওদের সবকিছু জেনেছে তেমনি ওদেরকেও নিজের গ্রামের বাড়ির সব কিছু জানিয়েছে। এমন কি কণা ও তনির কথাও জানিয়েছে।

আমজাদের সরলতায় গালিব ও রায়হান তাকে বন্ধুর আসনে বসিয়েছে। তাই রেবেকাকে মুসলমান করে বিয়ে করার ব্যাপারে তাকে সাধ্যমতো সাহায্য করেছে। তারপর দু’বছর আগে গালিব কেন পোস্ট মাস্টার হয়ে আমজাদদের গ্রামের পোস্ট অফিসে চাকরি নিয়ে এসেছে এবং কয়েকদিন আগে রায়হান যে ওদের কলেজে জয়েন করেছে তাও জানে।

বাড়িতে আসার পর আমজাদ একদিন বৌ নিয়ে গালিবের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেদিন আমেনা বিবি গালিবের কথা মতো গালিবের জন্য তনিকে ও রায়হানের জন্য কণাকে বৌ করার কথা তাকে বলেন।

গালিব তনিকে পছন্দ করার ও বিয়ে করার কথা চিঠি দিয়ে আমজাদকে আগেই জানিয়েছিল। জেনে খুব খুশি হয়েছিল আমজাদ। এখন রায়হানের জন্য কণাকে বৌ করার কথা তাদের মায়ের মুখে শুনে আরও বেশি খুশি হয়ে বলল, আপনাকে আমি মায়ের মতো মনে করি। আর মায়ের কথা ছেলের মেনে নেয়া অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে তনির ও আমার মা বাবার সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাব। আশা করি, ইনশাআল্লাহ এই কাজ হবে।

আমজাদের বৌ আয়েশা গালিব ও রায়হানকে জানলেও তাদের মায়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। আজ পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছে। ফেরার পথে স্বামীকে বলল, এরকম মা না হলে কি গালিব ও রায়হান ভাইয়ের মতো ছেলে জন্ম দিতে পারেন? তনি ও কণার বিয়ে গালিব ও রায়হান ভাইয়ের সঙ্গে হলে ওরা খুব সুখী হবে ইনশাআল্লাহ।

আমজাদ বলল, হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ। আমিও তোমার সঙ্গে এক মত। তাইতো খালা আম্মাকে কথা দিয়ে এলাম।

এখন গালিব ও রায়হানের কথা কথা জিজ্ঞেস করতে আমজাদ কিছুক্ষণ চিন্তা করল, মনে মনে ভাবল ওকি বিয়ের কথা শুনেছে?

ভাইয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে কণা আবার বলল, কিছু বলছ না কেন?

আমজাদ বলল, হঠাৎ ওদের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?

সে কথা পরে, আগে আমার কথার উত্তর দাও।

হ্যাঁ, চিনি।

কতটা চেনো বলবে?

এই পাগলি, ওদের সম্পর্কে তোর এত কৌতূহল কেন বলতো?

কারণ আছে বলেই তো জানতে চাচ্ছি।

ওরা দুজনেই আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তারপর কি করে বন্ধুত্ব হল সে কথা বলে বলল, এবার আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সঠিক উত্তর দিবি কিন্তু।

উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয় দেব।

তনি গালিবকে পছন্দ করে কি না জানিস?

কণা কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা অথবা শুনে ভাইয়া মনে কিছু করবে কিনা ভেবে চুপ করে চিন্তা করতে লাগল।

কিরে, বলবি তো, চুপ করে আছিস কেন?

কণা চালাকি খাঁটিয়ে বলল, সেকথা আমি কি করে বলব? তনিকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পরবে।

তা পারব, কিন্তু ও আমার কাছ থেকে যে দুঃখ পেয়েছে তা তো জানিস, তাই তুই যদি তনির কাছ জেনে নিয়ে আমাকে বলিস, তা হলে ওর দুঃখ দূর করার চেষ্টা করতাম।

তা না হয় হল। কিন্তু গালিব সাহেব যদি তনিকে পছন্দ না করেন?

সে চিন্তা তোর করার দরকার নেই। তুই তনির কাছ থেকে কথাটা জেনে আমাকে বলবি।

সবকিছু জেনেও কণা বলল, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, গালিব সাহেব তোমাকে উঁকিলি করতে বলেছেন।

আমজাদ হেসে উঠে বলল, তুই তো বেশ পেকে গেছিস? শোন, গালিব বলেনি, বলেছেন তার মা। এবার বল, তনির মতামত জেনে আমাকে বলবি কিনা?

মতামত আর জানতে হবে না, তনি আগে তোমাকে ভালবাসলেও তুমি বিয়ে করেছ জানার পর থেকে গালিব সাহেবকে পছন্দ করতে শুরু করেছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই।

এবার বল, রায়হানকে তোর কেমন মনে হয়?

গালিবকে কণাও ভালবেসে ফেলেছিল। তারপর যখন জানতে পারল গালিব তনিকে ভালবাসে ও বিয়ে করতে চায় তখন তার উপর খুব রেগে গিয়েছিল। তারপর তনিকে কথাটা বলার পর সে যখন প্রতিবাদ করল না তখন বুঝতে পারল, তনিও গালিব সাহেবকে ভালবাসে। সে সময় তনির উপর রাগ হলেও সই বলে তাকে ক্ষমা করে দেয় এবং তকৃদিরের ওপর ভরসা করে সবর করে। তারপর রায়হানকে দেখে ও পরিচয় পেয়ে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। রায়হান ভাইয়ার বন্ধু জেনে ভেবেছিল, বন্ধুর সঙ্গে কখনই বোনের বিয়ে দেবে না ভাইয়া। তাই মন খারাপ করে সবর করেছিল। এখন ভাইয়া তার কথা জিজ্ঞেস করতে ভীষণ লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে রইল।

কি রে, কিছু বলছিস না কেন?

কণা লজ্জারাঙা মুখ তুলে কোনো রকমে জানি না যাও বলে ছুটে পালিয়ে গেল।

আমজাদ তার কথায় ও আচরণে যা বোঝার বুঝে গেল। এমন সময় আয়েশা এসে বলল, কি ব্যাপার? কণা ওরকম করে পালিয়ে গেল কেন?

আমজাদ বলল, রায়হানকে ওর পছন্দ কিনা জানতে চাইতে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল।

আয়েশা বলল, কিছু বুঝতে পারলে?

হ্যাঁ, ও রায়হানকে পছন্দ করে?

তনি গালিব ভাইকে পছন্দ করে কিনা ওকে জিজ্ঞেস করলে না কেন?

করেছি। বলল, সেও গালিবকে পছন্দ করে।

তা হলে আর শুভ কাজে দেরি কেন? তনি ও তোমার মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করে শুভস্য শিঘ করে ফেলার ব্যবস্থা কর।

স্ত্রীর কথা শুনে আমজাদ হেসে উঠে বলল, ‘শুভস্য শিঘ্রম’ কথাটা সংস্কৃত ভাষা। তুমি এটা জানলে কেমন করে?

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাসে ঐ কথাটা পড়েছিলাম।

আমজাদ বলল, সত্যিই বাংলা ভাষা তুমি এত সুন্দর আয়ত্ত করেছ, তোমার কথা শুনলে সবাই তোমাকে বাঙালি মেয়ে না ভেবে পারবে না।

আয়েশা হাসি মুখে বলল, এটা আল্লাহর পাকের রহমত আর তোমাকে ভালবাসার প্রতিফলন।

আমজাদ তাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা আদর দিয়ে বলল, সেই মহান রাব্দুল আল আমিনের দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানাচ্ছি, যিনি তাঁর এক নেক বান্দির স্বামী হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন।

আয়েশাও আদরের প্রতিদান দিয়ে বলল, আমিও সেই আল্লাহ পাকের দরবারে শত কোটি শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি তাঁর এক নেক বান্দার স্ত্রী করে আমাকে ধন্য করেছেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *