১১.
একদিন আমজাদকে সঙ্গে নিয়ে গালিব খালেক উজ্জামানের কাছে গিয়ে তার প্ল্যান প্রোগ্রামের কথা বলে বাড়িসহ বাগানটা কিনে নেয়ার কথা বলল।
খালেক উজ্জামান ভাইপো আমজাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি জান কিনা জানি না, কয়েক বছর আগে চেয়ারম্যান এ জায়গা কিনে কি একটা প্রজেক্ট করার কথা বলেছিলেন। আমি রাজি না হতে বলেছিলেন, ঠিক আছে, আপনার জিনিস বিক্রি না করলে জোর তো করতে পারি না। তবে যদি কখনও বিক্রি করেন, আমাকে জানাবেন। এখন যদি বিক্রি করি, তা হলে ওনাকে আগে জানাতে হবে।
আমজাদ গালিবকে বসতে বলে চাচাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে গালিব ও রায়হানের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা জানিয়ে বলল, কণা ও তনির সঙ্গে ওদের দু’ভাইয়ের বিয়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। ওদের বাড়ি তেঁতুলিয়ায়। সেখানে ওদের কেউ নেই। সেখানকার জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর বিক্রি করে এখানে চলে এসেছে। ওদের মায়ের ইচ্ছা বাড়িসহ বাগানটা কিনে পাঁচ কাঠার উপর বাড়ি করবেন। তারপর ছেলেদের বিয়ে দিয়ে বৌ তুলবেন। আমি বলি কি আল্লাহ তো আপনাকে অনেক ধন সম্পত্তি দিয়েছেন। বাড়িসহ বাগনের পাঁচ কাঠা জায়গা ওদের কাছে বিক্রি করুন। আর বাকি জায়গা মাদরাসা ও এতিমখানার জন্য ওয়াকফ করে দিন। তা হলে একদিকে চেয়ারম্যান যেমন আপনাকে কিছু বলতে পারবেন না, অপরদিকে আপনার পরকালের মাগফেরাতের জন্য একটা ওসিলাও হয়ে যাবে।
খালেক উজ্জামান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হারুনের সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু বলতে পারছি না। হারুন ওনার একমাত্র ছেলে। সে ঢাকায় ব্যবসা করে বাড়ি করে সেখানেই থাকে।
আমজাদ বলল, নিশ্চয় পরামর্শ করবেন। আমার মনে হয় এসব কথা শুনলে হারুন ভাই রাজি হয়ে যাবেন।
ঠিক আছে, আমি কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা যাব। আলাপ করে এসে তোমাকে জানাব। তুমি কথাটা পোস্ট মাস্টারকে বলে দাও।
বাবার মুখে সবকিছু শুনে খুশি হয়ে হারুন নিজে এসে আমজাদ ও গালিবের কথামতো সবকিছু করে দিয়ে ঢাকা ফিরে গেল।
কথাটা এক কান দু’কান করে চেয়ারম্যান সাহেবের কানে পৌঁছাতে খুব রেগে গেলেও খালেক উজ্জামানের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারলেন না। কারণ তার ছেলে হারুন যে সরকারি দলের আমলা তা জানেন। চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করলেন, গালিবকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে তার ভাই ও মা ভয় পেয়ে পালাতে পথ পাবে না।
একদিন থানায় গিয়ে কথাটা দারোগাকে জানিয়ে বললেন, আগের পোষ্ট মাস্টারকে যেভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়েছিল, একেও সেইভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে হবে।
দারোগা বললেন, তাই হবে। আমি তো আছি, আপনার গায়ে এতটুকু আঁচড় পড়বে না। মোটা অঙ্কের মা পানি ছাড়লেই চলবে।
চেয়ারম্যান ব্যাঙ্গ হাসি দিয়ে বললেন, মাসে মাসে তো মালপানি পাচ্ছেন, বেশি লোভ ভালো নয়। জানেন তো, “অতি লোভে তাঁতী মরে?” শুনুন, খালেক উজ্জামান বাগান বাড়িটা যেমন করে তোক আমাকে হস্তগত করতেই হবে। কারণটা তো আপনি জানেনই। তত্ত্ববধায়ক সরকার যেভাবে তোলপাড় শুরু করেছে, ঐ বাড়ির আন্ডার গ্রাউন্ডের গোডাউনটা না থাকলে কবেই জেলে যেতে হত।
তা আর জানি না। শুধু সরকারের ত্রাণ সামগ্রী নয়, আপনার চোরা কারবারের কোটি কোটি টাকার মালও ওখানে আছে।
চেয়ারম্যান রেগে উঠে বললেন, আহ! আস্তে বলুন? দেয়ালেরও কান আছে জানেন না? দেশের পরিস্থিতি ঠিক হলে তো ইলেকশন হবে। তার আগে আমার বাগানে একটা আন্ডারগ্রাউন্ডের কাজ শেষ হবে। ইলেকশনের পর সব মাল সেখানে নিয়ে যাব। আর কিছু মাল ওখানে রেখে আপনার দ্বারা সার্চ করিয়ে খালেকুজ্জামানকে জেলের ভাত খাওয়াব। তখন বুঝবে আমাকে বাগান বাড়ি না বেচার ফল। তারপর বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় অনুচ্চস্বরে বললেন, পরশু গভীর রাতে কয়েকজনকে পাঠাব। আপনি তাদেরকে নিয়ে অপারেশন চালাবেন।
অপারেশন সাকসেসফুল হলে নগদ পঞ্চাশ হাজার পাবেন।
থানায় ইয়াসিন নামে একজন ধার্মিক সেন্ট্রি ছিল। সে দারোগার দুশ্চিরিত্রের কথা জেনে খুব অশান্তিতে ছিল। একদিন দেশের বাড়িতে টাকা মানি অর্ডার কারার জন্য পোস্ট অফিসে এলে গালিব তার সঙ্গে আলাপ করে দারোগার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে। তারপর ইয়াসিনকে সৎ ও ধার্মিক জেনে তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে এবং তাকে নিজের আসল পরিচয় দিয়ে জানায়, কেন সে এখানে পোস্ট মাস্টারের চাকরি নিয়ে এসেছে।
সেদিন ইয়াসিন তাকে কথা দিয়েছিল, তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে। তাই চেয়ারম্যানকে আসতে দেখে গোপনে জানালার পাল্লার আড়ালে ছোট টেপ রেকর্ডার ফিট করে রেখেছিল। চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার পর সেটি সরিয়ে ফেলে। পরের দিন বাড়িতে টাকা পাঠাবার নাম করে পোস্ট অফিসে এসে গালিবকে দারোগা ও চেয়ারম্যানের মধ্যে যা কথাবার্তা হয়েছে জানিয়ে ক্যাসেটা দিয়ে বলল, এতে ওনাদের দুজনের কথা রেকর্ড করা আছে। তারপর আবার বলল, আপনারা খুব সাবধানে থাকবেন। কথা শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
কয়েকদিন আগে ছোট টেপ রেকর্ডারটা গালিব তাকে দিয়ে বলেছিল, কি করতে হবে না হবে। ঘরে এসে রায়হান ও মায়ের সামনে ক্যাসেটা বাজাল।
মা কিছু বলার আগে রায়হান বলল, হাতে মাত্র দু’দিন। এর মধ্যে কি করবি?
কি করবে না করবে গালিব চিন্তা করতে লাগল।
আমেনা বিবি বললেন, চুপ করে আছিস কেন? যা করার এই দু’দিনের মধ্যে তোকে করতে হবে।
গালিব বলল, কাল সকালে তোমাদেরকে খালেক উজ্জামানের বাড়িতে রেখে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করার জন্য ঢাকা যাব। ফিরে এসে তোমাদেরকে এই বাসায় নিয়ে আসব।
রায়হান বলল, রহিম চাচা কোথায় থাকবে?
তাকে দু’তিন দিনের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।
আমেনা বিবি বললেন, খালেক উজ্জামানকে কি বলবি?
ভূতেরা আবার ছাদে ইট ফেলতে পারে ভেবে তোমরা ভয় পাচ্ছ।
পরের দিন ঢাকা যাওয়ার সময় গালিব আমজাদকে ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে ঢাকা যাওয়ার কারণ ও রায়হান ও মাকে তার চাচাঁদের বাড়িতে রেখে যাওয়ার কথা জানিয়ে বলল, আমার ফিরতে কয়েকদিন দেরি হতে পারে। রায়হানের দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস।
আমজাদ ঘটনা শুনে খুব অবাক হয়ে বলল, বাগান বাড়ির নিচে চেয়ারম্যানের চোরাচালানের মাল আছে একথা ওনাকে জানান উচিত নয় কি?
গালিব বলল, উচিত হলেও জানা যাবে না। বললাম না, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে যাচ্ছি? তিনি যা বলবেন তাই হবে। অবশ্য তোর কথা ঠিক। কিন্তু তুই কাকে দিয়ে সার্চ করাবি? থানার দারোগা তো চেয়ারম্যানের হাতের পুতুল। যাই হোক, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করবি না। এমন কি তোর মা-বাবা, চাচার সঙ্গেও না।
আচ্ছা, তুই কি আগে জানতে পেরেছিলি বাগান বাড়ির নিচে গোডাউন আছে?
হ্যাঁ, পেরেছি; কিন্তু ওটার রাস্তা অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাইনি। আমার মনে হয় বাগানের পিছন দিকে নদীর পাড়ের কোনো জায়গা থেকে সুরঙ্গ আছে। সেটা দিয়ে মালপত্র আনা-নেয়া হয়।
তবে জমিদারের আমলে যে পথ ব্যবহার করা হত, সেটা পেয়েছি। আমি যে রুমে থাকি, সেই রুমের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে তিন ফুট স্কয়ারের একটা ঢাকনা আছে। সেটার নিচেই সিঁড়ি।
তুই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমেছিলি?
মাত্র একবার নেমেছিলাম।
আচ্ছা, নদীর পাড়ে সুরঙ্গ পথের সন্ধান করিস নি?
করিনি আবার। বললাম না, কোনো ফল হয়নি।
ভেতরে সুরঙ্গ পথের সন্ধান পাসনি?
পেয়েছি এবং ঐ পথের শেষ প্রান্তে লোহার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। খোলার চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি। তোকে যা বললাম মনে রাখিস। তারপর গালিব ঢাকা রওয়ানা দিল।
নির্দিষ্ট দিনে গভীর রাতে চেয়ারম্যানের সাত আটজন গুণ্ডা নিয়ে বাগান বাড়িতে এসে দারোগা সাহেব দরজায় টোকা দিলেন। চেয়ারম্যান শুধু গালিবকে হত্যা করার কথা বললেও দারোগা সাহেবের প্ল্যান দুই ভাই ও তাদের মাকে গলা টিপে হত্যা করার। যাতে কেউ তাদেরকে চিনতে না পারে সেজন্য কালো মুখোশ পরে এসেছে।
বেশ কয়েকবার টোকা দেয়ার পরও যখন কোনো সাড়া পাওয়া গেল না তখন ধাক্কা দিতে দরজা খুলে যেতে বেশ অবাক হলেন। তারপর টর্চ লাইট জ্বেলে কাউকে দেখতে না পেয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। দেখতে পেলেন, দুটো খাটের বিছানা পরিপাটি করা। পাশের রুমে গিয়ে একই অবস্থা দেখে ভাবলেন, আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে মনে হয় জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। প্রায় দু’ঘণ্টা গোটা বাগান খুঁজেও কাউকে পেলেন না। খুব অবাক হয়ে ভাবলেন, সবাই গেল কোথায়? আরও ঘণ্টাখানেক সারা বাগান ও বাড়ির ভেতর খোঁজাখুঁজি করে বিফল হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় চারদিকে ফ্লাড লাইড জ্বলে উঠল। সেই সঙ্গে শুনতে পেল, সবাই অস্ত্র ফেলে হাত তুলে দাঁড়াও।
দারোগা সাহেব তাড়াতাড়ি পিস্তলের বাঁটে হাত দিতে গেলে গালিব বলল, খবরদার, কেউ নড়াচড়া করবেন না, করলেই গুলি চালাব। এক পন্টুন পুলিশের সঙ্গে লড়াই সম্ভব নয় জেনে সবাই হাতের অস্ত্র ফেলে দিল। ওদেরকে গ্রেফতার করার জন্য গালিব পুলিশদের হুকুম করল।
গ্রেফতার করার পর গালিব বলল, ওদের মুখোশ খুলে গাড়িতে উঠান। অল্প দূরে দুটো জীপ গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সেখানে এসে গাড়ির পাশে পুলিশ কমিশনার ও গাড়িতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় চেয়ারম্যানকে দেখে দারোগা সাহেব যেমন খুব অবাক হলেন, তেমনি ভীষণ ভয় ও লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠলেন।
থানায় এসে দারোগা সাহেবকে ক্লোজড করা হল এবং চেয়ারম্যানের জবান বন্দি নিয়ে হাজতে রাখা হল। আগের পোস্ট মাস্টার গোডাউনের সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন, তাই তাকে চেয়ারম্যান পোষা গুণ্ডাদের দ্বারা গলটিপে হত্যা করিয়েছিলেন এবং এই কাজে দারোগা সাহেবও যে জড়িত ছিলেন, জবান বন্দিতে সব কিছু জানালেন।
পরের দিন সকাল দশটার দিকে হাতকড়া অবস্থায় চেয়ারম্যানকে গোডাউনের সুড়ঙ্গের গেট কোথায় দেখাবার জন্য নিয়ে আসা হল। গেটটা একটা জেলের ঘরের তিনটে রুমের একটাতে। জেলের ঘরের অল্প দূরে নদী। নদীপথে বজরায় করে গোডাউনে মাল আনা নেয়া হয়।
গোডাউনে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের মাল। কমিশনার সাহেব সেসব সীজ করে দিলেন। তারপর জেলে, থানার দারোগা সাহেব ও চেয়ারম্যানকে বিচারের জন্য ঢাকায় নিয়ে এলেন।
এরপর থেকে গোয়েন্দা হিসাবে গালিবের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এখন তাকে সবাই আগের থেকে বেশি ভক্তি শ্রদ্ধা করতে লাগল।
এই ঘটনা কণা জানলেও তনি জানতে পারল না। কারণ ফাইন্যাল পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর সে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। প্রায় পনের দিন পর ফিরে এসে শুনে খুব অবাক হল। ভাবল, কণাকে সঙ্গে নিয়ে গালিবের সঙ্গে দেখা করবে। দুপুরের খাওয়ার পর ঘুমাতে গিয়েও ঘুমাতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই গালিবের ছবি মনের পাতায় ভেসে উঠছে। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে ঘুমাবার চেষ্টা করল কিন্তু গালিবের স্মৃতি তাকে ঘুমাতে দিল না। শেষে খাট থেকে নেমে ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বাগানে এল। ইজেল টাঙিয়ে মাছরাঙা পাখি কিভাবে উড়তে উড়তে নদীর ঢেউ-এর মধ্যে ছোঁ মেরে মাছ ধরে সেই দৃশ্য আঁকছিল। তখন গ্রীষ্মের অপরাহ। চারদিক নিঝুম। হঠাৎ পিছনে খুব কাছে থেকে একটা বৌ কথা কও পাখিকে ডেকে যেতে শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, গালিব একটা জামগাছে ঠেস দিয়ে বৌ কথা কও ডেকে চলেছে।
তখন তার হার্ট বিট বেড়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে তুলি রেখে তার কাছে আসতে লাগল।
গালিব ডাক বন্ধ করে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
কাছে এসে তনি সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
গালিব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো।
বসুন কিছুক্ষণ আলাপ করব। তারপর জিজ্ঞেস করল। মামার বাড়ি কেমন। বেড়ালেন?
একথা জানলেন কেমন করে? নিশ্চয় কণা বলেছে?
না, মন বলেছে। কেমন বেড়ালেন বলবেন না?
বলতে ইচ্ছা করল মামার বাড়ি বেড়াতে গেলেও মনটা আপনার কাছে রেখে গিয়েছিলাম, তাই বেড়িয়ে আনন্দ পাইনি। লজ্জায় সেসব কথা বলতে না পেরে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, কেমন বেড়ালাম আপনার মন আপনাকে কিছু বলে নি?
হ্যাঁ, বলেছে।
কি বলেছে বলুন তো?
বললে মাইন্ড করবে?
না, করব না।
ওখানে আমার স্মৃতি তোমার হৃদয়ে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। তাই বেড়িয়ে আনন্দ পাও নি।
তনি লজ্জা পেয়ে বলল, যদি বলি আপনার মন ঠিক বলেনি।
আমি যদি বলি তোমার কথাটাই প্রমাণ করছে আমার মন ঠিক বলেছে?
তা হলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?
উঁহু, হল না।
কি হল না?
আমাকে আপনি করে বলা।
কেন?
আমি তোমাকে তুমি করে বলছি, অতএব তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।
আমার যে লজ্জা করবে?
লজ্জা আছে বলে করবে। তা ছাড়া নারী-পুরুষ সবারই লজ্জা থাকা উচিত। কারণ হাদিসে আছে “যার লজ্জা নেই তার ঈমান নেই।” এবার একটা কথা জিজ্ঞেস করব উত্তর দেবে তো?
উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয় দেব।
আমজাদ সাহেবের উপর এখনও রেগে আছ?
না।
কারণটা বলবে।
তক্বদিরকে মেনে নিয়েছি।
যদি বলি আমজাদ সাহেবকে মনের মধ্যে যেখানে বসিয়েছিলে, সেখানে আমিও বসতে চাই?
তনির বলতে ইচ্ছা করল, আপনাকে অনেক আগেই সেখানে বসিয়েছি। লজ্জায় তা বলতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে রইল।
চুপ করে আছেন কেন? আমার কথার উত্তর দেবেন না?
তনি মামার বাড়ি থেকে ফিরেছে কিনা জানার জন্য কণা কিছুক্ষণ আগে তাদের বাড়িতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাগানের ভিতর তাদের দুজনকে দেখে পা টিপে টিপে এসে অল্প দূরে একটা সেগুন গাছের আড়াল থেকে তাদের কথা শুনছিল ।
গালিবের কথা শুনে সামনে এসে বলল, এখন আবার নতুন করে বসাবে কি? অনেক আগেই তো সেই মনের কুঠরিতে আপনাকে বসিয়েছে। তারপর আবার বলল, গায়ের মাহররম সাবালক ছেলেমেয়ে নির্জনে আলাপ করা গুরুতর অপরাধ। তা ছাড়া গুরুতর অপরাধ জেনেও আপনারা এরকম করায় সেই অপরাধ আরও বেড়ে গেছে। শুধু তওবা করে আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে হবে না, আপনাদের অতি সত্বর বিয়ে করে ফেলা উচিত। নচেৎ বার বার এই অপরাধ করতেই থাকবেন। কথা শেষ করে তনির পাশে বসে পড়ল।
গালিব কিছু বলার আগে তনি একটু রাগের সঙ্গে বলল, আর তুই যে রায়হান স্যারের সঙ্গে অভিসার করিস, সেটা বুঝি কিছু না?
কণাও রাগের সঙ্গে বলল, দেখ, মিথ্যে করে কিছু বলবি না। আমি রায়হান স্যারের সাথে অভিসার করি, প্রমাণ করতে পারবি?
গালিব বলল, ঝগড়া করার দরকার নেই, তার চেয়ে এক কাজ করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারপর কণার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তনিকে নিয়ে কাজী অফিসে যাচ্ছি, তুমিও তোমার স্যারকে নিয়ে সেখানে চলে এস।
কণা মনে মনে বলল, ভাইয়া বাড়িতে না থাকলে তাই করতাম।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তনি বলল, কিরে, কিছু বলছিস না কেন?
সম্ভব কিনা চিন্তা করছিলাম।
চিন্তা করে কি ঠিক করলি?
সম্ভব নয়। কারণ ভাইয়া আমদের ব্যাপারটা সমাধান করবে বলেছে। তোর তো ভাইয়া নেই, তুই যা ইচ্ছা তাই করতে পারিস।
না তা পারি না, ইচ্ছা করলেই সব কিছু করা যায় না।
গালিব বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ, আমিও তা পারি না। এমনি কথাটা বলেছি। কারণ আম্মা তনির ও আমার ব্যাপারটা সমাধান করবেন বলেছেন।
কণা বলল, সমস্যার সমাধান যখন গার্জেনরা করবেন বলেছেন তখন এ ব্যাপারে কোনো কথা না বলাই ভালো। তারপর গালিবকে উদ্দেশ্য করে বলল, একজন এতবড় গোয়েন্দা হয়ে পোস্ট মাস্টারের চাকরি নিয়ে এখানে এসেছেন কেন?
আমার খালুর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার জন্য।
হত্যাকারীকে তো খুঁজে বের করেছেন, এবার তা হলে কি ঢাকা ফিরে যাবেন?
গালিব তনির দিকে তাকিয়ে বলল, যাওয়া না যাওয়া নির্ভর করছে ওর ওপর।
কণা তনিকে কুনুইয়ের গুতো দিয়ে বলল, কিরে, যেতে দিবি না কি?
তনি বলল, ধরে রাখবো কি করে, ধরে রাখার অধিকার তো এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কণা বলল, তুই অবশ্য ঠিক বলেছিস। তারপর গালিবকে উদ্দেশ্য করে বলল, একদিন কি বলেছিলেন মনে আছে?
আছে।
তা হলে চলে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে ওর কথা বললেন কেন?
ওর মনের কথা জানার জন্য।
তনি বলল, তুই যে অত ফট ফট করছিস, ও তোর ভাসুর আর আমি তোর বড় জা হব। বড়দের সঙ্গে বুঝে সুঝে কথা বল।
কণা বলল, কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তারপর গালিবকে উদ্দেশ্য করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সঠিক উত্তর দেবেন তো?
গালিব বলল, উত্তর জানা থাকলে নিশ্চয় দেব।
এখানে আসার পর পর আপনি আমার সঙ্গে হদাকান্তর মতো ব্যবহার করতেন কেন?
গালিব হেঁসে উঠল বলল, সেকথা না শোনাই ভালো।
ভালো নাই হোক, তবু শুনব।
হাঁদাকান্তর মতো ব্যবহার না করলে আপনি আমার প্রেমে পড়ে যেতেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
তা হলে বোঝা যাচ্ছে, আমাকে আপনার মনে ধরেনি অথবা পছন্দ হয়নি।
আসল কথা কি জান, তোমাকে দেখে কেন কি জানি মনে হয়েছে রায়হান তোমাকে দেখলে পছন্দ করবে।
তনিদের কাজের বুয়া তাকে ডাকতে এসে গালিব ও কণাকে দূর থেকে দেখে ফিরে গিয়ে তনির মাকে বলল, আপার সঙ্গে পোস্ট মাস্টার ও কণা আপা গল্প করছে।
তনি যখন মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সেই সময় আমজাদ তার মা বাবার কাছে গালিবের পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে তনির বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল।
ওনারা খুশি মনে প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেছিলেন, তনি ফিরে এলে তার মতামত নিয়ে জানাবেন।
গতকাল তনি ফিরে এলেও তাকে জানানো হয়নি। এখন বুয়ার মুখে গালিবের সঙ্গে মেয়ে গল্প করছে শুনে তাকে বললেন, ওদের সবাইকে নিয়ে এসে বৈঠক খানায় বসা। আমি ততক্ষণ নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
বুয়া আবার বাগানে তাদের কাছে এসে বলল, আম্মা আপনাদের সবাইকে বৈঠকখানায় গিয়ে বসতে বললেন।
তনি বলল, তুমি যাও, আমরা আসছি। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে গালিব ও কণাকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলো যাই।
গালিব আমজাদের মুখে শুনেছে তনির মা-বাবা প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন একটু আগে তনির মাতামতও জেনেছে। বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভেবে ঠিক করতে না পেরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, তোমরা যাও। আমি আসি বলে হাঁটতে উদ্যত হলে তনি বলল, মনে হয় তুমি এখানে আছ জেনেই মা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, না গেলে কি ভাববেন?
গালিবকে তনি তুমি করে বলছে দেখে কণা তাকে বলল, কিরে, বিয়ের আগেই তুমি করে বলা শুরু করে দিলি?
তনি লজ্জা পেয়েও কপট রাগ দেখিয়ে বলল, একটু আগে বললাম না, আমরা তোর থেকে বড়? আর বড়দের ব্যাপারে ছোটদের নাক গলানো যে উচিত নয় তা বুঝি জানিস না?
কণা বলল, স্যরি। ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দে।
তনি বলল, প্রথমবার বলে মাফ করে দিলাম। বার বার করলে করব না। কথাটা মনে রাখবি।
কণা বলল, ঠিক আছে রাখব। তারপর গালিবকে বলল, চলুন যাই ।
নাস্তা খেয়ে গালিব বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর কণা তনিকে বলল, তোকে একটা সুসংবাদ দিতে এসেছিলাম। গালিব সাহেব ছিলেন বলে বলতে পারিনি। এখন কি সেটা শুনবি?
তনি বলল, তুই না বললে শুনব কি করে?
গালিব সাহেবের আম্মা ভাইয়াকে দিয়ে তার মা-বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। ওনারা রাজি হয়ে তোর মতামত নিয়ে জানাবেন বলেছেন।
তনি তাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে কয়েকটা কিস দিয়ে বলল, সু-সংবাদটা দেরিতে দেয়ার শাস্তি। তারপুর বলল, তোর ব্যাপারে গালিবের মা রায়হান স্যারের জন্য প্রস্তাব পাঠান নি?
হ্যাঁ, পাঠিয়েছেন বলে কণাও তার গালে কয়েকটা কিস দিয়ে বলল, এই কথা জিজ্ঞেস করার শাস্তি। তারপর দু’জনেই হেসে উঠল।
– সমাপ্ত –
সুন্দর , বেশ কিছু বই পড়েছি